আমার লেখা একই সাথে কিভাবে 'প্রতিবেদন' আর 'নিরীক্ষামূলক' হয়: কথাসাহিত্যিক অদিতি ফাল্গুনীর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: May 18, 2012 6:31:05 AM

অদিতি ফাল্গুনী: কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক।

প্রকাশিত বই: ১. খঞ্জ হংসীর গান (কাব্যগ্রন্থ ২০১২, শুদ্ধস্বর) ২. অপৌরুষেয় ১৯৭১ (গল্পসঙ্কলণ ২০১১, শুদ্ধস্বর) ৩. আপেল (অনুবাদ গ্রন্থ ২০১১, শুদ্ধস্বর) ৪. নক্ষত্র-শাপলা-স্পার্টাকাস ও ভাসানযাত্রার গল্প (দু’টো উপন্যাসিকা ২০১০, রোদেলা) ৫. বাংলার নারী আন্দোলনের ইতিহাস (অণ্বেষা ২০১০) ৬. তিতা মিঞার জঙ্গনামা (গল্পসঙ্কলণ ২০০৯, বাঙলায়ণ) ৭. আদিবাসী জনগণের অধিকার বিষয়ক জাতিসঙ্ঘের ঘোষণা (অনুবাদ ২০০৯, বাঙলায়ণ) ৮. অধিবর্ষ অপরিচয়ের (কাব্যগ্রন্থ ২০০৮, বাঙলায়ণ) ৯. মিকেলেঞ্জোলো: জীবন ও কর্ম (অনুবাদ ২০০৮, বাঙলায়ণ) ১০. চিহ্নিত বারুদ বিনিময় (গল্পসঙ্কলণ ২০০৭, অঙ্কুর) ১১. দ্য রাখাইনস্ অফ দ্য পটুয়াখালি এণ্ড বরগুণা রিজিয়ন (গবেষণাগ্রন্থ ২০০৭, কোডেক) ১২. বানিয়ালুকা ও অন্যান্য গল্প (গল্পসঙ্কলণ ২০০৫, ঐতিহ্য) ১৩. গোত্রপিতার হেমন্ত (অনুবাদ ২০০৪, সন্দেশ) ১৪. আমার জীবন: মার্ক শাগাল (অনুবাদ ২০০১, ঐতিহ্য) ১৫. খসড়া খাতা: নারীবাদী সাহিত্য তত্ত্ব ও বিবিধ প্রসঙ্গ (প্রবন্ধ সঙ্কলণ ২০০০, শ্রাবণ) ১৬. ইমানুয়েলের গৃহপ্রবেশ (গল্পসঙ্কলণ ১৯৯৯, স্টুডেন্ট ওয়েজ) ১৭. পারিবারিক আইনে বাংলাদেশের নারী (যৌথ গবেষণাগ্রন্থ ১৯৯৭, আইন ও সালিশ কেন্দ্র)।

দুপুর মিত্র: আপনি বলা যায় দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের সাথে যুক্ত আছেন। নিবিড়ভাবে একে পর্যবেক্ষণের সুযোগ আপনার হয়েছে। সে হিসেবে বাংলাদেশের কথা সাহিত্য

নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণটা জানতে পারি?

অদিতি ফাল্গুনী: ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় থেকে যদি ধরি তাহলে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আবু বকর সিদ্দিক, কায়েস আহমেদ, মঞ্জু সরকার, হরিপদ দত্ত, হুমায়ুন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, ইমদাদুল হক মিলন, মইনুল আহসান সাবের, দিলারা হাশেম, রাবেয়া খাতুন, রাজিয়া খান আমিন, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, শহীদুল জহির, নাসরীন জাহান, হরি শংকর জলদাস, মামুন হুসাইন, জাকির তালুকদার, পাপড়ি রহমান, সেলিম মোরশেদ, শাহাদুজ্জামান, শাহীন আখতার, ইমতিয়ার শামীম, পারভেজ হোসেন, আনিসুল হক, মশিউল আলম, আহমাদ মোস্তফা কামাল, শাহনাজ মুন্নী, প্রশান্ত মৃধা, রাখাল রাহা, রাজীব নূর, অদিতি ফাল্গুনী, খোকন কায়সার, রাজা সহিদুল আসলাম, মাহবুব মোর্শেদ, রাশিদা সুলতানা, সাগুফতা শারমিন তানিয়া, বদরুন নাহার...প্রবীণ-নবীন মিলিয়ে অনেকেই লিখছেন। আমার ধারণা আমাদের এখানে ভাল ছোট গল্প কিছু হলেও ভাল উপন্যাস সেই অনুপাতে বলতে গেলে তেমন নেই। ওয়ালীউল্লাহ ও শওকত আলীর উপন্যাসগুলো অবশ্যই ভাল কাজ। তারপর ঘুরে ফিরে আর সেই ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ কিম্বা ‘খোয়াবনামা।’ হাসান আজিজুল হক ‘আগুনপাখি’ লিখলেন অনেক পরে। উনি আরো বেশি উপন্যাস লিখলে আমরা সার্বিক অর্থেই আরো অনেক বেশি ঋদ্ধ হতাম। শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ চমৎকার নভেলা বা আখ্যান। মামুন হুসাইনও মূলত: আখ্যান বেশি লিখেছেন। হরিশংকর জলদাসের লেখায় সমাজের নানা স্তরের মানুষের চিত্র পাচ্ছি আমরা। জাকির তালুকদার বরেন্দ্রর বিস্তৃত জীবন এঁকেছেন। আমরা সবাই কম-বেশি চেষ্টা করছি। কিন্তু তারপরও ১৯৪৭- ২০১২-এর এই সুদীর্ঘ কালপরিসর বিবেচনায় খুব বেশি সফল উপন্যাস আমাদের নেই। সেটা থাকতেই হবে এমনও বলি না। ভাল ছোট গল্পও গুরুত্বপূর্ণ। তা’ কিন্তু বেশ কিছু আছে আমাদের ভূখণ্ডে।

দু: অনেকেই অভিযোগ করেন, আপনার লেখা অনেক বেশি প্রতিবেদন নির্ভর বা দেবেশ রায়ের প্রতিবেদনের মত নয়। এই অভিযোগকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

অ: মজার ব্যাপার কি পেশাগত জীবনে আমি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করি বলে যারা আমার লেখাকে বছরের পর বছর ধরে ‘উন্নয়ন প্রতিবেদন’ বলে আসছেন, তারাই এক নিঃশ্বাসে বলেন যে আমার লেখা ‘নিরীক্ষা-প্রবণ’ ও ‘দুর্বোধ্য’। এবার তুমি তোমার একদম সরল বিবেচনা থেকে বলো ত’ একটি রচনাকর্ম কি করে একই সাথে ‘প্রতিবেদন’ হয় (প্রতিবেদন সবসময়ই সরল ও কম্যুনিকেটিভ) আবার ‘দুর্বোধ্য’ ও ‘নিরীক্ষাপ্রবণ’ (যা মূলত: আঁভা গার্দ যে কোন শিল্পকর্ম বিষয়ে বলা হয়)-ও হয়? তাহলে যারা এমন অভিযোগ করেন তারা হয় ‘প্রতিবেদন’ কি সেটা বোঝেন না অথবা ‘নিরীক্ষা’ ও ‘দুর্বোধ্যতা’ বোঝেন না। আমার ধারণা এদের কেউই আমার লেখা সঠিক ভাবে আদৌ পড়েন নি। আবার খোদ দেবেশ রায়কেও অনেকেই প্রতিবেদক বলে বাতিল করে দেবার চেষ্টা আমার সামনেই করেছেন! চায়ের টেবিলে রাজা-উজির মারা এত সহজ আর নিজে দুইটা লাইন লেখাও যে কত কষ্টের! এদেশে অনেক লেখকই পেশাগত জীবনে ব্যবসা, চিকিৎসক বা প্রকৌশলী থেকে শুরু করে ‘র‌্যাব’-এর মতো রাষ্ট্রীয় ঘাতক বাহিনীতে চাকরি করলেও তাদের ‘ব্যবসায়ী’, ‘চিকিৎসক,’ ‘প্রকৌশলী’ বা ‘র‌্যাব’ লেখক বলা হয় না। আমার পেশাগত জীবনকে জড়িয়ে এই গোটা মন্দ প্রচারণাকেই ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি বলতে পারি? এবং যে পেশাগত জীবনে আমার ব্যক্তিগত আপোষ খুব কম বলে প্রায়ই আমি নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করি? আমার সর্বশেষ গল্পগ্রন্থ ‘অপৌরুষেয় ১৯৭১’-এর ‘বারগির, রেশম ও রসুন বোনার গল্প’ থেকে উদ্ধৃত করি: ‘বিভাবতীর সাদা দাঁতগুলো নীল আকাশের নিচে ও ততোধিক নীল চিল্কা হ্রদের জলে হাসিতে বিচ্ছুরিত হয় অজস্র টোপা টোপা সাদা রসুনের মতো...গুনগুন করে ওঠে সে আহাদে...গত দু’মাস ধরে গর্ভে এক নতুন প্রাণ স্পন্দন টের পাবার পর থেকে যে গান সে থেকে থেকেই তার অনাগত শিশুকে প্রায়ই শোনায়, ‘ধান ফুরালো পান ফুরালো- খাজনার উপায় কি- আর ক’টা দিন সবুর করো...’ কিম্বা ‘চিহ্নিত বারুদ বিনিময়’ গ্রন্থের ‘দ্য কেজ বার্ডস ব্রিডার্স সোসাইটি’ গল্প থেকে বলি, ‘আবু করিম সত্যিই তার এভিয়ারির পাখিদের কঙ্কালের গুঁড়ো খেতে দিত কি না সেই রহস্য আর কখনোই আমার ভেদ করা হয়নি। মা বহুদিন হয় মৃত এবং সেই মফস্বল শহর আরো বেশি দিন হয় আমরা ছেড়ে এসেছি, যেখানে চৈত্রদিনে নিমগাছে পাতার সমসংখ্যায় টিয়া পাখি উড়ে এসে বসে! হোসেনি দালানের পাশে কুণ্ডা উৎসবে শিয়ারাও অনেক যুগ হয় আতশবাজির পাখি আর ওড়ায় না...যা লোহার শিক মোম গলিয়ে ছুটে চলবে অনন্তে! শুধু কেউ কেউ, কখনো কখনো...হয়তো একটি কি দুটি শতাব্দী ধরে, একবার মাত্র অচিন পাখিদের খাঁচার ভেতর যাওয়া আসা করতে দেখবে!’ কিম্বা ‘তিতা মিঞার জঙ্গনামা’ গ্রন্থে পুরনো ঢাকার আর্মেনীয়দের নিয়ে লেখা গল্প ‘কালান তার (পরিত্রাতা)’ গল্পের একটি অংশের উদ্ধৃতি: ‘...সার সার রুপোলী ক্রুশবিদ্ধ কবরস্থানের উপর চাঁদের সহর্ষ আলোয় বুঝি সত্যি সত্যি ছুটে গেল একপাল অশ্ব? সফেদ শুভ্র বর্ণ, রক্তিম ও ঘোর তমিস্রা বর্ণের একপাল তাজিয়ান অশ্ব? ছুটে গেল অথবা উড়েই গেল তারা কোন দূর নক্ষত্রবীথির উদ্দেশ্যে?’ উদ্ধৃতি আর বাড়াবো না! এই উদ্ধৃতিগুলোর কোনটি প্রতিবেদন? তবে হ্যাঁ...২০০০ ও ২০০১ সালে দৈনিক ‘প্রথম আলো’র সাহিত্য পাতায় যে দু’টো গল্প প্রকাশের প্রেক্ষিত আজ এক যুগের বেশি সময় ধরে একই অভিযোগের অস্ত্র বারবার আমার দিকে তোলা হচ্ছে...সেই ‘আসসিনী’ ও ‘উটের খোকন’-এ তথ্যের কঙ্কালের উপর খুব বেশি ভাষার জ্যোৎস্না বা শিল্পের লাবণ্য হয়তো যোগ করা হয় নি। এবং সেজন্য আমার কোন গল্প গ্রন্থেই এই গল্প দুটো কিন্তু অন্তর্ভুক্ত নয়। যদিও সমালোচকদের দূর ছাই সত্ত্বেও অনেক সাধারণ পাঠক ঐ গল্প দুটো নিয়েও প্রচুর প্রশংসা আমাকে করেছেন এবং আজো তারা অভিযোগ করেন যে কেন গল্প দুটো আমি কোন বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করিনি।

দু: কথাসাহিত্যে সমসাময়িক কাদের লেখাকে আপনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন এবং কেন?

অ: এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে ঝামেলা বাড়বে। এক কথায় উত্তর করি- সবার সামগ্রিক প্রচেষ্টাকেই শ্রদ্ধা করি অন্তর থেকে।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্য আর বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের মধ্যে ফারাকটা কোথায় এবং সেটা কেমন?

অ: ওপারে বাংলা কথাসাহিত্যের ‘তিন বন্দ্যোপাধ্যায়’ অর্থাৎ তারাশঙ্কর-বিভূতি-মাণিকের পরেও এসেছেন দুই জায়ান্ট মজুমদার অর্থাৎ কমলকুমার আর অমিয়ভূষণ। এসেছেন সন্দীপন, শ্যামল, অতীন, দেবেশ, অভিজিৎ সেন, মহাশ্বেতা দেবীর মতো লেখকেরা। আমার ধারণা লেখার পেছনে ওদের ডেডিকেশন অনেক বেশি। ওদের দেশে নামী লেখকের গাড়ি চড়ার, দামি এপার্টমেন্টে থাকার বাতিক নেই। তারা গ্রাম-মফস্বল-বস্তিতে থেকেও লেখার জন্য জীবন পার করে। আমাদের এখানে তুমি কি লিখলে তার থেকে অনেক বড় ব্যাপার হলো তোমার বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে কিনা, তুমি কত বড় চাকরি করো বা বিদেশী মুদ্রা উপার্জন করো কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে যা হবার তাই হয়। অন্যকে খামোখা গালি দেব কেন? নিজের কথাই বলি। এই আমার ২০০০ সালে মাস্টার্সের পরপরই শ্রীমঙ্গলের প্রত্যন্ত গ্রামে চাকরি হয়েছিল। যাই নি। ২০০৬-এ একবার চট্টগ্রামে গিয়ে একবছর থেকেই পালিয়ে এসেছি ঢাকার তুলনামূলক আয়েশি জীবনে। এবার আবার বরগুনা গিয়ে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে একমাস পরেই ফিরে এসেছি। যে আমি এক সময় জীবনে লেখাকেই একমাত্র সত্য ভেবেছি, সেই আমি আজকাল দিনের বেশির ভাগ সময় চাকরি করে এবং আরো ভালো চাকরির দরখাস্ত করে জীবন পার করি। বিদেশে পড়তে যাবার কথাও ভাবছি। অর্থাৎ লেখক অদিতির কাছে বোধ করি লেখার চেয়ে সো-কলড জীবনের স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা, আরাম-আয়েশ বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই আমি পশ্চিমবঙ্গে থাকলে এটা হতো না। হাজার হোক ওটা বহুদিনের বিদ্যাজীবী সমাজ। ওরা জ্ঞানের জন্য, সাহিত্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে জানে। সঙ্গের ত’ একটা ব্যাপার থাকে। সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ! কি আর বলবো? বিশেষ কিছু বলার নেই!

দু: বাংলাদেশে কথাসাহিত্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে বলে আপনি মনে করেন কি? হলে তা কেমন?

অ: সিনিয়রদের ভেতর হাসান-ইলিয়াস-শওকত আলী- মাহমুদুল হক-জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ভেতর এই নিরীক্ষা প্রবণতা সাঙ্ঘাতিক ভাবেই ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে শহীদুল জহির, মামুন হুসাইন, নাসরীন জাহান...এই তিনজনের লেখায় বিশেষভাবে নিরীক্ষার ব্যাপারটি রয়েছে। সেলিম মোরশেদের প্রথম দিকের একাধিক গল্পে এই নিরীক্ষা প্রবণতা রয়েছে। আমাকে ত’ নিরীক্ষাপ্রবণ বলে অভিযুক্তই করা হয়। এক কবি...হুম্...আল মাহমুদ...তাঁর একাধিক গল্প তাঁর কবিতার মতোই ঐশ্বর্যশালী, বেদম ক্ষমতাবান ও নিরীক্ষাপরায়ণ। পানকৌড়ির রক্ত, জলবেশ্যা আর সৌরভের কাছে পরাজিত...এই তিনটি গল্পকেই আমার শিখরস্পর্শী পঠন অভিজ্ঞতা বলে মনে হয়।

দু: অনেকেই বলেন, আমরা কথাসাহিত্যে গল্প বা উপন্যাস চর্চায় অনেকগুণ পিছিয়ে আছি। আপনাও কি তা মনে হয়? মনে হলে কেন না মনে হলে কেন?

অ: এই প্রশ্নের উত্তর আগেই দিয়েছি। উপন্যাসে আমরা খুবই পিছিয়ে আছি। তবে গল্প কিন্তু কিছু ভাল লেখা হয়েছে।

দু: বাংলাদেশের সাহিত্যে সাহিত্যের চাইতে লেখকদের রাজনীতিকরণ বা গোষ্ঠী প্রিয়তা বেশি। আপনারও কি তাই মনে হয়? হলে কেন?

অ: কাজ কম বলেই কথা বেশি। অমিয়ভূষণের মতো ভাল ভাল এবং ভলিউম ভলিউম লিখে টিঁকে থাকতে হলে এসব কোথায় উড়ে যেত! এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে এদেশের তরুণ লেখকদের ভেতরেই দেখবেন...নাম করেই বলি...ওদের দু’জনের লেখার বিষয়বস্তু বা আঙ্গিক নিয়ে আমার অনেক বিরোধিতা থাকতে পারে...কিন্তু আমার সময়ে যে দু’জন তরুণ সবচেয়ে বেশি নিয়মিত লিখেছেন...আমার প্রজন্মের...আহমাদ মোস্তফা কামাল ও প্রশান্ত মৃধা দু’জনেই খুব ভদ্রলোক। ফেসবুকে অন্য লেখককে গালি দেওয়া, রহিমের বিরুদ্ধে নোট লিখে করিমকে ট্যাগ করা বা যদুকে গালি পেড়ে রাম-শ্যাম-মধুকে ট্যাগ করার মতো কাজে তারা কখনোই জড়ান না। অতি অমায়িক ও সজ্জন। দুঃখ পায় ও হাসিও লাগে যখন দেখি যে কর আঙুল গুনলে তিনটি কবিতা কি পাঁচটি গল্পও লেখেন নি এমন মানুষেরা ফেসবুকে তুলকালাম ঝগড়া-ঝাটি, বিবাদ-কাইজ্জা, দল গঠন ও ভাঙাভাঙি, এ ওর বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দেওয়া...কি সব কাণ্ডই না করেন!

দু: আখতারুজ্জামান ইলিয়াস শেষ পর্যন্ত মার্কসীয় প্রোপাগান্ডিস্ট সাহিত্যিক বলে অনেকে জাহির করছেন। আপনারও কি তাই মনে হয়? হলে কেন? না হলে কেন?

অ: ভাই, বালজাক রাজতন্ত্রী বা তলস্তয় জমিদার লেখক হলেও আমার যেমন কোন আপত্তি নেই তেমনি ইলিয়াস মার্কসীয় লেখক হলেই বা আমার সমস্যা কি? তাকে প্রোপাগাণ্ডিস্ট বলাটা বুঝে বা না বুঝে এক ধরণের সাহিত্যিক অন্যায় করারই সামিল। লেখকের রাজনৈতিক বিশ্বাস বড় কথা না। তাঁর রচনা আমার মনকে চিরদিনের মতো কোথাও স্পর্শ করলো কিনা সেটাই প্রশ্ন। এজন্যই খ্রিষ্ট বিশ্বাসী তলস্তয়ের ‘দ্য রেজারেকশন’ উপন্যাসের নায়ক নেখলিয়ুদভ উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে বাইবেল পাঠ করে যখন তাঁর অন্তরে প্রশান্তি খুঁজে পায়, তখন যেমন আমার চোখে জল চলে আসে মহৎ কিছু পাঠের আনন্দে, একই তূরীয় বোধ হয় যখন ‘চিলেকোঠার সেপাই’-এ ওসমান সেই অসাধারণ ছড়াটি বলে, ‘বন্ধ কপাট ইয়েস বন্ধ কপাট...কর্নেলে জেনারেলে করলো লোপাট...স্টেমেটিল সিডেটিভ ঝপাট ঝপাট!’ এই আমিই কৈশোরের শেষে অসুস্থতায় ছেড়ে দেওয়া সঙ্গীত চর্চা এই বুড়ো বয়সে এসে আবার যখন শুরু করি, তখন রবীন্দ্রনাথের লেখা ব্রহ্মসঙ্গীত থেকে ‘আপনি বাজে তোমারি নাম ধ্বনিবে সব কাজে’ পংক্তিটি গেয়েও একই অমৃতাবস্থা প্রাপ্ত হই। কে মার্ক্সিস্ট আর কে জমিদার তা’ একেবারেই নিস্প্রয়োজনীয় আলোচনা।