কবিতা একটা হাতের কাজ, এতে ঐশী, দৈবী ব'লে কিছু নাই: সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Aug 22, 2012 8:16:13 AM

কবিতা : তনুমধ্যা -১৯৯০, পুলিপোলাও-২০০৩, কবিতাসংগ্রহ- ২০০৬, দিগম্বর চম্পূ- ২০০৬, গর্দিশে চশমে সিয়া- ২০০৮, ঝালিয়া- ২০০৯, মর্নিং গ্লোরি- ২০১০, ভেরোনিকার রুমাল- ২০১১, হাওয়া-হরিণের চাঁদমারি- ২০১১

উপন্যাস : কালকেতু ও ফুল্লরা- ২০০২

ছোটগল্প: মাতৃমূর্তি ক্যাথিড্রাল - ২০০৪

অনুবাদ: অন্তউড়ি -১৯৮৯, নির্বাচিত ইয়েটস -১৯৯৬, এলিয়টের প'ড়োজমি-১৯৯৮, কবিতা ডাউন আন্ডার -২০১০, স্বর্ণদ্বীপিতা -২০১১

প্রকাশিতব্য বই: ডিকিনসন-শতক (Dickinson Shatak - tranlation of Emily Dickinson's poems), পেন্টিমেন্টো (Pentimento - poems), কালকেতু ও ফুল্লরা (2nd ed), প্রবন্ধসংগ্রহ (collection of essays)

সম্পাদিত লিটলম্যাগ: প্রসূন (মাসুদ আলী খানের সাথে সহ সম্পাদনা), অগ্রবীজ (চৌধুরী সালাহউদ্দীন আহমেদ, সুবিমল চক্রবর্তী, সাদ কামালী, তাপস গায়েন ও সৌম্য দাশগুপ্ত)

দুপুর মিত্র: আপনাকে যদি বলা হয় আপনি কবিতায় বিশেষ একটা কিছু করতে চেয়েছেন। তাহলে আপনি কি বলবেন বা কোন বিশেষ কিছুকে উপস্থাপিত করবেন বা সেই বিশেষ কিছু করার পেছনের যুক্তিগুলো কি?

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: কবিতায় আমি খুব বিশেষ কিছুএকটা করতে চেয়েছি, এভাবে কখনও ভাবি নি। আমার বিশেষ কোনো ভাবনা থেকে যদি থাকে/থাকত তো সেটা বরং ভাষা নিয়ে। হ্যাঁ, আমি একটা নোতুন কাব্যভাষা আকাঙ্ক্ষা করেছিলাম, আর সে-আকাঙ্ক্ষা ম'রে যায় নি আজও। বাংলা ভাষার সকল রূপ আর সম্ভাবনার অবাধ অংশগ্রহণ দেখতে চেয়েছিলাম আমার কবিতায় - আমাদের কবিতায় - গদ্যেও। আর সেই দিল্লি এখনও দূর অস্ত হ'লেও, একেবারে বুদ্ধুর বেহেস্ত নয় আজ আর, দিগন্তরেখায় তার আবছা এক ছায়া ফুটে এরই মধ্যে উঠেছে ব'লেই-না ভাষা নিয়ে হঠাৎ এত হট্টগোল, এত গেল-গেল, এল-এল, চারিদিকে।

আর কবিতায় - আমার ভিতর কয়েকটি টানাপড়েন কাজ ক'রেই চলে। এক দিকে পশ্চিমের কবিতার নিটোল ডৌল কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারি না, আজও; অন্য দিকে এও প্রবলভাবেই অনুভব করি, আজ, যে, ও জিনিস ঠিক আমার নয়, এবং আমার ভাষার ও কবিতার আসল শক্তির জায়গা অন্য কোথা অন্য কোন্ খানে। তাই তো বারে বারে আমার কবিতা খুলে-খুলে পড়তে চায়, আর এ-দুইয়ের কোনো রীতিতেই কাব্য হ'য়ে উঠতে ব্যর্থ হ'লেও, বাংলা ভাষার নানা প্রায়-অদৃশ্য কোনাকাঞ্চিতে হ্যাজাকালোক ফেলবার চেষ্টা তার থামে নি, থামবে না।

দুপুর মিত্র: মাসুদ খান - সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ - মজনু শাহ্ এই তিন কবির ধরণটা ( কবিতা লেখার ক্ষেত্রে) একই রকম। বা ঘুরেফিরে মোটাদাগে একই রকম মনে হয়। আপনাকে যদি এরকম কিছু বলা হয় তাহলে আপনি মানবেন? মানলে কেন? না মানলে কেন নয়?

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: কথাটা এতই "মোটা দাগের" যে চিকন দাগে এর জবাব দিতে পারাটা প্রায় না-মুমকিন। উল্টে আপনাকে প্রশ্ন করতে পারি: এই তিন কবি'র "ধরন"-টা কী ধরনের? মানে, তাঁদের কবিতার কোন্ বা কোন্-কোন্ বৈশিষ্ট্যগুলি এক প্রকারের? কিছুদিন আগে রাজু আলাউদ্দিনকে করা আপনার সাক্ষাৎকারে আমি-সহ মাসুদ খান, সাজ্জাদ, মজনু আর গালিবকে বোধ হয় সাহিত্য-সন্ত্রাসী বলা হয় ব'লে উল্লেখ করেছিলেন, সে-বাবদেও প্রশ্ন থাকে, কাদের দ্বারা বলা হয়, এবং কেন।

আর, এখানে আমার মানা বা না-মানার প্রশ্নটাই অবান্তর। ধরা যাক জীবনানন্দকে শুধানো হ'ল তাঁর কবিতা যে রবীন্দ্রনাথের মতো এটা তিনি স্বীকার করেন কীনা, আর না-করলে কেন নয়। কী বলতেন তখন দাশবাবু? আমি-হেন ফাজিল হ'লে বড়জোর কইতে পারতেন "আপনার কান যে গাধার কানের মতো তা স্বীকার করেন? না-করলে কেন করেন না?"

মশকরা থাকুক - আপনার-আমার বাইরে দাঁড়িয়ে যে-কথাটা বলতে আমি পারি তা হ'ল, এইরূপ গোষ্ঠীকরণ (গোষ্ঠ, গোয়াল, থেকে গোষ্ঠি!) বা পিজন-হোলিং পশ্চিমা মিডিয়ক্রিটির একটা সুবিধাবাদী বদঅভ্যাস। যে-কবি (বা যে-কোনো মিডিয়ার শিল্পী) কোনোপ্রকার উল্লেখের যোগ্যতা রাখে, সে আর-কারুর মতো হ'তে পারেই না। এমনকি একই সাহিত্য-ঘরানা বা শিল্প-আন্দোলনের অন্তর্ভূত যারা, তারাও এ-অন্যের মতো হয় না। রোমান্টিক ওয়্যর্ডজওয়্যর্থ, কোলরিজ, স্কট, বায়রন, শেলি, কীটস - সবাই নিজের-নিজের মতো, আবার ইম্প্রেশনিস্ট মনে, রেনোয়া, মানে, দেগা, পিসারো, সেজান - এরাও কেউ কারো মতো নয়।

দুপুর মিত্র: আপনি মাসুদ আলী খানের সঙ্গে ‘প্রসূন’ নামের একটি লিটলম্যাগ সম্পাদনা করেছেন। সম্ভবত সেই সংখ্যাতেই আপনি ঘোষণা দিয়েছিলেন এর পরের সংখ্যা থেকে আপনি আর থাকবেন না। সেটা কেন? ঠিক কোন জায়গা থেকে আপনি লিটলম্যাগ সম্পাদনা করেছিলেন। আপনি কি এখনও লিটলম্যাগ সম্পাদনাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন? কেন?

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: না, 'প্রসূন'-এর দ্বিতীয় সংখ্যায় আমি ঐ ঘোষণা দিয়েছিলাম...

দু'টি বন্ধু-গোষ্ঠির যৌথ প্রয়াস ছিল প্রসূন। এদের এক দল ছিল চারুশিল্পী : আমান ভাই (আমানউল্লাহ), প্রদীপ (চক্রবর্তী) দা, নাজিম ভাই (নাজিমউদ্দিন), নীলরতন দা, রতন (দস্তিদার) দা, শেখর দা (শেখররঞ্জন দত্ত), প্রমুখ। এরা তখন শাহজাহানপুরে একটা সুন্দর বাড়ি ("নীরব") ভাড়া ক'রে থাকতেন, ওখানে আমাদের তুরুন্তাজ আড্ডা হ'ত। দ্বিতীয় দলটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে আমার সহপাঠী ও অনুজ কয়েকজন : সৈয়দ তারিক, মনিরুল আলম, আহসানুজ্জামান সাকলায়েন এবং মাসুদ আলী খান। আরও দু'একজনা এসে হাত লাগিয়েছিল যারা এ-দু'দলের কোনোটিতেই পড়ত না, যেমন বাচ্চু দা (সুরজিৎ দত্ত), স্বদেশবন্ধু সরকার, রুমি (আহমেদ আবিদ)। আমাকে বলা যেত এ-দুই দলের সমন্বয়কারী। কিন্তু যা হয়, আমার একান্ত নির্বন্ধ, এবং আমার প্রতি দু'দলেরই সকলেরই ভালবাসা-সত্ত্বেও, মতবিরোধ দানা বাঁধল, পত্রিকাটিকে ঘিরে এক দলের স্বপ্ন আরেক দলের প্রণোদনার সঙ্গে জঙ্গে জড়িয়ে গেল, আর উভয়ের তাবৎ অসন্তোষ আর অভিমানের শিকার আমি হলাম মাঝখানে প'ড়ে।

দ্বিতীয় সংখ্যাটি (লেটার-) প্রেসে ওঠার আগেই, অনেকেই ছিটকে গেল (মাসুদ-সমেত - তারিক, মনির উধাও হয়েছিল আগেই, তেমন ক'রে শেষ-অব্দি টিঁকে ছিল কেবল আমান ভাই আর রুমি, আর শেষ মুহূর্তে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল কচি ভাই (শামসুল কবির ওরফে ইচক দুয়েন্দে)। আমি বুঝেছিলাম যে এ আর হবার নয় - অন্ততঃ আমার বর্তমানে; ভেবেছিলাম আমি স'রে গেলে আমার শেষকৃত্য-স্বরূপ হ'লেও, ওরা আবার মিলতে পারে হয়তো একসাথে। মেলে নি।

প্রসূনে আমার নিজের উদ্দেশ্য ছিল, কেবল সাহিত্য নয়, অধিকাংশ শিল্প-মাধ্যম (সাহিত্য, চারুশিল্প, সঙ্গীত, নাটক, চলচ্চিত্র, ইত্যাদি) নিয়ে একযোগে কাজ করবার - এদের মধ্যে একটা হার্দিক যোগাযোগ ঘটিয়ে দেবার, অন্ততঃ আমাদের প্রজন্মে। স্বপ্নটা আমাদের সামর্থ্যের তুলনায় বড় বেশিই বড় ছিল মনে হয়। আর নেশা-ফেশাও ছিল একটা বড় অন্তরায়। আর টাকা। আর আমরা নিজেরা - আমাদের অতিসংবেদনশীল, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী আত্মাগুলি।

আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় নি, কিন্তু আমরা ব্যর্থও হই নি। অপ্রতিষ্ঠার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আমাদের হাতে... আর, সেটাই তো আমরা চাইতাম আসলে।

লিটলম্যাগ গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই (যদি অবশ্য "গুরুত্ব" কথাটার গুরুত্ব থাকে কোনো)। কিন্তু যে-কোনো পত্রিকাই লিটলম্যাগ নয়। লিটলম্যাগকে অন্য নানা কাগজের থেকে যা-যা আলাদা ক'রে দেয়, তার মধ্যে প্রধান, কাগজটার "উদ্দেশ্য"। নিয়ত-ছাড়া রোজা যেমন উপাস-থাকা মাত্র, তেমনই, উদ্দেশ্যহীন বা ভুল-উদ্দেশ্য-প্রণোদিত কাগজ কাগজ-মাত্র, লিটলম্যাগ নয়।

দুপুর মিত্র: প্রসূন লিটলম্যাগে শোয়েব শাদাব, বিষ্ণু বিশ্বাস যারা গান্ডীবের লেখক নামেও পরিচিত; তাদের কবিতাও ছিল। গাণ্ডীবকে তারা কিভাবে দেখতেন? আপনি গাণ্ডীবকে এড়িয়ে কেন প্রসূন সম্পাদনা করতে গেলেন?

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: বিষ্ণু গাণ্ডীবের লেখক ছিল না আসলে, যেমন ছিলাম না আমি। আমাদের দু'জনেরই লেখা একই সংখ্যায় বেরয় যখন গাণ্ডীবে, তার আগেই প্রসূন বেরিয়ে গেছে। বিষ্ণু বরং ছিল "পেঁচা"-র লেখক, পেঁচা-তেই তার কবিতা প'ড়ে আমি প্রেমে প'ড়ে গিয়েছিলাম তার, আর পেঁচা আর বা'র হবার সম্ভাবনা নেই দেখে তার লেখকদেরকে জড়িয়ে নিয়েছিলাম প্রসূনে। অসীম দা (অসীমকুমার দাস), কচি ভাই আর বিষ্ণু ওভাবেই প্রসূনের হ'য়ে গেছিল।

জানা মতে, মাসুদ খানের লেখা কোনোদিন চায়ই নাই গাণ্ডীব (কেনই বা চাইবে? তাদের চাহিদা কি এত শস্তা!)। মজার ব্যাপার হ'ল, গাণ্ডীবের বহিষ্কৃত অর্জুন (সাজ্জাদ গাণ্ডীব ছাড়ার পরের ইশ‌্যুতে তপন দা-র সম্পাদকীয়র প্রথম বাক্য: "অর্জুন গাণ্ডীব ত্যাগ করলেন") যাদের বন্ধু তাদেরকে গাণ্ডীব দুই চোখে দেখতে না-পারলেও, কাগজটার সাথে তাদের নাম আজকাল জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে... অ্যাদ্দিনে আমরা সবাই গাণ্ডু, আমরা সবাই গাণ্ডীবী।

আবার শাদাব তো ছিল গাণ্ডীবের অন্যতম পাণ্ডব (পাণ্ডা?), সে মাঝে-মাঝে দর্শন দিত শাহবাগ-ধামে, মরমিয়া গাইত হ্যাট-কোট প'রে। কোনো-কোনোদিন সে তুই-তোকারি করত, আবার পরদিনই আপনি-আজ্ঞে। আমি নিরাপদ্ দূরত্ব বজায় রাখতাম তার সাথে। শাদাব আর শান্তনুর কবিতা ছিল না প্রসূনে। চেয়েছিলাম, দেয় নি। সাজ্জাদ একটা অনুবাদ দিয়েছিল, 'সলোমনের গান', বাইবেল থেকে... আহা! অমন আর হয় না।

তো এক দিকে সাজ্জাদ শরিফ (সে তখন নাই আর গাণ্ডীবে) আর অন্য দিকে শান্তনু চৌধুরী আর সেলিম মোরশেদ আমার ভারি বন্ধু ছিল। রনি ভাই (হোসেন হায়দার চৌধুরী) ভালবাসতেন খুব। নকীবের সঙ্গেও আগাগোড়া সুসম্পর্ক ছিল, (জাহেদুর রহিম) অঞ্চন দা, তারেক শাহরিয়ার, এরাও ছিল আপনজন। তবে তপন (বড়ুয়া) দা-কেও, শাদাবের মতোই, প্রায়শই বুঝতে পারতাম না। তদুপরি তিনি হামেশা ইংরাজিতে কথা কইতেন (কেননা, হয়তো, সুধীন দত্তও তা করতেন)।

ঐ সময়টায়, মানে সাজ্জাদ সদ্যঃ গাণ্ডীবচ্যুত হবার পর-পর, আমার, বিষ্ণুর আর তারিকের কিছু আলাদা খাতির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গাণ্ডীবে; কিন্তু যেই-না আমার একটা লেখা প্রান্ত-তে বেরুল, অমনি আমার সঙ্গে তারা কইতে চায় না তেমন, তাদের পলিট ব‌্যুরোতে সহসা গিয়ে পড়লেই হুশ-হুশ মুখ বন্ধ... বড়ই পোলাপাইন্যা ব্যাপার-স্যাপার। আমরা বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে ওদেরকে "গাণ্ডু" বলতাম, কিন্তু ভালোও বাসতাম, আজও যেমন বাসি।

উপরেই বলেছি, গাণ্ডীবকে এড়িয়ে প্রসূন সম্পাদনা করতে যাই নাই আমি। প্রসূন আদতে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজি বিভাগের পড়ুয়াদের দ্বারা নানা সময়ে প্রকাশিত নানা সাহিত্যপত্রের (যার একটার নাম ছিল প্রসূন, নামটা আমার সহপাঠী বন্ধু সৈয়দ তারিকের দেওয়া) বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গিয়ে এক দ্বিতীয় জন্ম। আমার বিভাগের সহপাঠী ও অনুজেরা যে তাতে "বহিরাগতদের" হস্তক্ষেপ বড় বেশি বরদাস্ত করবে না এ-কাগজে, তা অবশ্য আমার ভাবিতে উচিত ছিল সংকল্প যখন।

দুপুর মিত্র: এই পত্রিকায় মাসুদ খান, আশিক আকবর, ব্রাত্য রাইসু, বদরুল হায়দারের কবিতাও ছিল। এই কবিতা নির্বাচনে আপনার/ আপনাদের কোনও উদ্দেশ্য ছিল কি? এখন সেসব মূল্যায়ন মানে সেসময়ের মূল্যায়নের সাথে বর্তমান সময়ে আপনার নিজের মূল্যায়নের পার্থক্য তৈরি হয়েছে কি? হলে সেটা কেমন?

হ্যাঁ, তা তো ছিলই, ছিল আরও অনেকেরই। কবিতা নির্বাচনে আমার বা আমাদের তেমন কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। বিশেষ ক'রে আমার, প্রথমাবধি কবিতা বিষয়ে কোনো নাকউঁচু ভাব ছিল না। নানা কিসিমের কবিতা আমার ভালো লাগত, আজও লাগে। সমসময়ের যারা তখন আমার প্রিয় কবি ছিল, তাদের অনেকেই আজও তা-ই আছে (কেউ-কেউ নাই, হায়) : মাসুদ খান যেমন, অসীমকুমার দাসও তেমন, তেমনই বিষ্ণু বিশ্বাস, ফরিদ কবির, সৈয়দ তারিক, সাজ্জাদ শরিফ, শান্তনু চৌধুরী, শোয়েব শাদাব, রিফাত চৌধুরী, তসলিমা নাসরিন, জুয়েল মাজহার, ব্রাত্য রাইসু, শামিম কবির, সুমন রহমান, শাহেদ শাফায়েত... আবার যে-একটা দক্ষযজ্ঞ চলছিল তখন তাতে যে-কোনো পরিমাণ ইন্ধন জোগাবার কারণেও আরও অনেকেরই কবিতাকে যথেষ্ট আমলে আমরা নিতাম, যথা খোন্দকার আশরাফ হোসেন, মঈন চৌধুরী, রেজাউদ্দিন স্টালিন, আবু হাসান শাহরিয়ার, মোহাম্মদ সাদিক, ইকবাল আজিজ, তুষার দাশ, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, সিদ্ধার্থ হক, কাজল শাহনেওয়াজ, কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার, আহমেদ মুজিব, কফিল আহমেদ, সরকার মাসুদ, দারা মাহমুদ, স্বদেশবন্ধু সরকার, মারুফ রায়হান, রাজা হাসান, সঞ্জীব চৌধুরী, শিমুল মাহমুদ, তাপস গায়েন, কামরুল হাসান, ফেরদৌস নাহার, শামীম আজাদ, খালেদ হামিদী; আমাদেরই আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, দাউদ আল হাফিজ, তাছাড়া আহমেদ নকীব, সেলিম রেজা নিউটন, বদরুল হায়দার, বিলোরা চৌধুরী, খায়রুল হাবিব চয়ন, সরকার আমিন, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, জহির হাসান, আশিক আকবর, মাহবুব কবির, মাতিয়ার রাফায়েল, আদিত্য কবির, শিবলী মোকতাদির, চঞ্চল আশরাফ, বায়েজীদ মাহবুব, মাসরুর আরেফিন, কামরুজ্জামান কামু, বদরে মুনীর, মজনু শাহ, মুজিব মেহদী, মুজিব ইরম, তুষার গায়েন, আয়শা ঝর্না, রশীদ হারুন, সাজেদুল ইসলাম, খলিল মজিদ, তপন বাগচী, জাফর আহমেদ রাশেদ, শাহীন মোমতাজ, রণক মুহম্মদ রফিক, ওবায়েদ আকাশ, ইমরুল হাসান, বায়তুল্লাহ কাদেরী, মাহবুব লীলেন, অরূপ রাহী, পাঁশু প্রাপণ, পাবলো শাহী, মারজুক রাসেল, টোকন ঠাকুর, রাজীব নূর, শোয়াইব জিবরান, শুভাশিস সিনহা, নভেরা হোসেন, আলফ্রেড খোকন, শাহনাজ মুন্নী, সরসিজ আলীম, রাজীব আর্জুনি, জাহানারা পারভীন (এদের অনেকের সঙ্গে পরিচয় অবশ্য আরও পরে হয়েছে, ঠিক তখনই নয়; আর ও অনেকের নাম এখনই মনে পড়ল না চট ক'রে, বয়স হয়েছে, তারা যেন মার্জনা করে মোরে)।

অন্য দিকে, যারা ঠিক কবি ব'লে পরিচিত ছিল না বা হ'তে চায় নি, এমন অনেককেও আমরা তাতিয়ে গেছি, কবিতায় আরও-আরও নানা সুর শোনবার আশায়। চিত্রশিল্পী আমানউল্লাহকে দিয়ে কবিতা লিখিয়েছি, মাসুদ আলী খানকে দিয়ে (তার আসল জায়গা ছিল নাটক), এমনকি আমাদের মহান্ ইচকও ধোঁক্ষত্রবিলাসী কবিতা ঢের লিখেছে (বা বলেছে - তার অধিকাংশ "লেখা"-ই, তা গল্প হোক বা কবিতা, ছিল মৌখিক) সেকালে।

আমরা সব্বাই মিলে - এমনই মনে হয় আজকে - একজনই হ'য়ে-উঠতে-থাকা কবিসত্তা ছিলাম যেন, সব্বাই মিলে "আমি" ছিলাম যেন। গাণ্ডীবের শুচিবায়ু আমার কদাপি ছিল না, পেঁচার রুচিবায়ুও নয়। এমনকি যে রাইসু, ওরও একটা "স্টাইল" আগাগোড়াই ছিল, আমার তা কখনোই গ'ড়ে উঠল না...

অনেকানেক প্রকাশ্য ও চোরা স্রোতের এক মহামেঘনা ছিল সেই সময়টা আমাদের, সেই সময়ের আমরা। আজ সেই আমরার অংশগুলো একেকটা আলগা-আমি হ'য়ে উঠেছে, বড় বা ছোট - আজ বরং তাদের কবিতার দিকে নিরপেক্ষ নির্মোহ দৃষ্টি দিতে পারা যায়। কিন্তু এই মোহহীনতায় আমার কী নাফা তাও দেখলাম না এই নজরে। আজও কি বিষ্ণুর "নীল কৈ" হেন কোনো কবিতা প'ড়ে আমি খালি পায়ে ছুটতে পারব তার লেখককে জড়িয়ে ধরতে? কবিতা পড়তে তেমন ভালোই লাগে না আর। বলতেকি।

দুপুর মিত্র: গোষ্ঠী-ভিত্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা কি হতে পারে? হলে সেটা কেমন? আপনি কি কোনও গোষ্ঠী-ভিত্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সাথে জড়িত?

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: সেরকম তো হ'য়েই আসছে, তাই না? স্টোয়িকদের, এপিক্যুরিয়দের, "আকাদেমিক"-দের আমল থেকেই তো? কিন্তু আমি যে কোনো গোষ্ঠেই ঢুকতে পেলাম না কখনও, সে আমারই খাসলতের কারণে। চ্যাংড়া বয়সে তো বটেই, এখনও স্থির হ'য়ে দু'দণ্ড বসতে পারি না কোত্থাও, চোখমুখ হাতপা বড্ড বেশি চুলবুল করে আমার। কত মনীষীরই দরবারে গেলাম, এক-দু'বার ক'রে, তাঁদের কথা শুনে টাসকি লেগে গেল, কিন্তু পত্রপাঠ ছিটকেও পড়লাম আবার - সুস্বাদু খাদ্য কম-কম খেতে হয়, এই আপ্তবাক্যটার প্রয়োগ, খাদ্যে নয়, চিরকাল ক'রে এসেছি আমি জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে। মাধুকরী আমার কপালে লেখা, কে খণ্ডাবে।

যা হোক, দার্শনিকদের মতো শিল্পীরা, লেখকেরাও, কালে-কালে গোষ্ঠি গ'ড়ে তুলেছে/তুলছে, বিশেষতঃ নোতুন-কিছু করতে যারা চায়। ফরাসি দাদাবাদী, প্রতীকবাদী বা রুশ প্রকরণবাদীদের কথা তো সর্ববিদিত। আমাদেরও দেশে কালে-কালে নানা সাহিত্য-কাগজ বা সাহিত্যরীতিকে কেন্দ্র ক'রে গোষ্ঠি গ'ড়ে উঠেছে। শুনেছি বঙ্গদর্শন, সবুজপত্র, কবিতা, কল্লোল, উত্তরাধিকার - প্রভৃতি পত্রিকার দপ্তরগুলি মুখর হ'য়ে থাকত সমমনা লেখকদের পারস্পরিক মতবিনিময়ে।

আমাদের কালে, আমাদের ছোটকাগজগুলিকে কেন্দ্র ক'রেও ছোট-ছোট আড্ডার পত্তন হয়েছিল, যাদেরকে গোষ্ঠি বলা যেতে পারে। আড্ডা (বা গোষ্ঠি) মেরে-মেরেই তো এই এতদূর...

দুপুর মিত্র: গাণ্ডীব সে সময়ে লিটলম্যাগ কেন্দ্রিক চর্চায় কোনও প্রভাব রাখতে পেরেছিল? পারলে সেটা কেমন? না পারলে আপনার মতে কেন পারে নি?

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: "লিটলম্যাগ কেন্দ্রিক চর্চা" কী বুঝতে পারলাম না। কীসের চর্চা?

তা যাক। গাণ্ডীবের একটা বড় স্থান ছিল আমাদের অনেকের হৃদয়ে। তো আমাদের উপরে অন্ততঃ, তার আছর বেশ ভালোরকমই ছিল বলা যায়। গাণ্ডীবের প্রতি, আরও বিশেষ ক'রে তার পাণ্ডবদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আর ভালবাসার কমতি ছিল না কোনো, কখনোই। ওদেরকে নিয়ে নানা মশকরা আমি/আমরা করেছি ঠিকই, আর ওরাও আমাকে/আমাদেরকে কখনও ছেড়ে কথা কয় নি - তবু, বিশ্বাস করি যে আমার ভালবাসা ওরা আগাগোড়া অনুভব করেছে, যেমন করেছি আমি ওদের।

কিন্তু এ তো গেল ব্যক্তি-আমার বা আমার কতিপয় বন্ধুর অনুভূতির কথা। বাংলাদেশের, বা সামগ্রিকভাবে বাংলা সাহিত্যে কোনো দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব এই পত্রিকাটির ছিল বা আছে কীনা তার ফয়সালা অন্যভাবে হ'তে হবে। গাণ্ডীবের সঙ্গে যাদের নাম ওতপ্রোত, তাদের সাহিত্যকর্ম যাচাই করা দরকার, খেয়াল করা দরকার পরবর্তী প্রজন্মসমূহে তাদের লেখার অনুসরণ, অনুবর্তনকে। এই নিরিখে হয়তো দেখা যাবে যে পরের একটা প্রজন্মের উপর পাণ্ডবদের প্রভাব কিছু ছিল, কিন্তু তা এত প্রকট কখনও ছিল না যে তাকে নিশ্চিতভাবেই গাণ্ডীবীয় বলা যায়। গাণ্ডীবের কবিদের চেয়ে ঢের বেশি প্রভাব বিস্তার করতে দেখেছি একাই রাইসুকে (মাসুদ খানকেও, বলা বাহুল্য, এবং সেই সময়ে অসীমকুমার দাসকে), গাণ্ডীব-দীক্ষিত কেউ-কেউও পরে গাণ্ডীবের সাহিত্যরুচির বাইরে গিয়ে বিকশিত হয়েছে, যথা আহমেদ নকীব।

আবার বঙ্গদর্শন, ভারতী, বান্ধব, সবুজপত্র, কল্লোল, পরিচয়, প্রগতি, কবিতা, ইত্যাদি যেরকম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে কালে-কালে নিয়ন্ত্রণ ক'রে গেছে, সে-অর্থে শুধু গাণ্ডীব কেন, আমাদের কোনো কাগজই কোনোরূপ উল্লেখেরই দাবিদার হ'তে পারেই না। যদি সূচ্যগ্র ভূমিও দাবি করবার ফরিয়াদ জানাতে হয় তো তা করতে হবে আমাদের সবগুলি কাগজকে, এক সাথে: অচিরা, একবিংশ, সংবেদ, অনিন্দ্য, পেঁচা, গাণ্ডীব, নির্মিতি, নিসর্গ, প্রসূন, প্রতিশিল্প, নিরন্তর, নদী, কিছুধ্বনি, রূপম, অন্যস্বর, প্রান্ত, মন্ত্র, পূর্ণদৈর্ঘ্য, কারুজ, দ্রষ্টব্য, বিপ্রতীক, দ, নৃ, লোক, ঘণ্টা, চলক, লিরিক, মান্দার, দামোদর, ক্যাথারসিস, ইত্যাদি ইত্যাদি।

গাণ্ডীবের, বা এই গোষ্ঠির, কিছু অবদান অবশ্য ছিল সমসময়ের উঠতি লেখকদের অভিমুখ তৈরিতে। আমরা অনেকেই কবিতাকে, সাহিত্যকে সিরিয়াসলি নিতে শিখেছিলাম তারই প্রেরণায়। এই গোষ্ঠিই প্রকৃত সাহিত্যাড্ডার নবজন্ম ঘটিয়েছিল শাহবাগে, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে। মেলা উটকো তক্কো, হানাহানি, হাতাহাতি তখনও হ'ত, কিন্তু ফাঁকে-ফাঁকে সাহিত্য নিয়ে, শিল্প নিয়ে আলোকসঞ্চারী মতবিনিময়ও প্রচুর হ'ত। আজকাল তেমন হয় কি আর? নাকি কেবলই কুৎসা আর আত্মশ্লাঘা আর কার কোন্ লেখা কোথায় বের হ'ল, হবে, হবে না, হ'ল না? আমি জানি না। আপনারা বলতে পারবেন।

তপন বড়ুয়া আমার কাছে চিরকালই একজন পূজার্হ মানুষ হ'য়ে থাকবেন - তিনি ড. জনসন কি বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন না সত্যি, কিন্তু এমন একজন কেউ ছিলেন, যাঁর দিকে তাকিয়ে পথ চলা যেত - মানে যেতে পারত, যদি-না না-চাইতে তাঁর ভুল-বোঝার শিকার হ'য়ে যেতে হ'ত সেই কবে কোন্ আয়ামে জাহিলিয়ায়..

আর, কিছু লিটলম্যাগ-কর্মী, যারা এমনকি লেখক হিসাবে প্রকাশিতই হ'তে চায় নি, সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ দিয়ে গেছে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনকে, সেই সব বেকুব গাধাকে এই অপরাহ্ণবেলায় আমার সালাম জানাই: হোসেন হায়দার চৌধুরী, তরুণকুমার মহলানবীশ, স্বদেশবন্ধু সরকার, আমানউল্লাহ, হাসানুল বান্না, বাহার রহমান, তাজুল হক, নূরুল আলম আতিক, আহমেদ আবিদ রুমী - কত নাম কহি? কহিব কেমনে?...

দুপুর মিত্র: গাণ্ডীবের মেনিফেস্টোকে আপনি কিভাবে দেখেন? মেনিফেস্টো কি সাহিত্যকে কিছু দেয়? এটা কি বাংলা সাহিত্যে বিন্দুমাত্র প্রভাব তৈরি করতে পেরেছে?

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: প্রশ্নটার ভিতরেই এর একটা নেতিবাচক জবাব নিহিত আছে, অর্থাৎ এ একটা রেটরিকাল কোয়েসচন, যার উত্তর পূর্বনির্দিষ্ট ("তুমি কি মনে করো চুরি করা একটা ভালো কাজ?")। কিন্তু প্রশ্নটা কি ভুল নয়? মানে ম্যানিফেস্টোর অস্তিত্ব নয়, প্রশ্নটা হওয়া দরকার ছিল ঐ বিশেষ ম্যানিফেস্টোটির দোষ-গুণ-প্রভাব-প্রতিপত্তি-সার্থকতা-ব্যর্থতা নিয়েই শুধু। সাধারণীকরণের দোষ!

ম্যানিফেস্টো সাহিত্যকে কিছু দেয় কি দেয় না তা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক হওয়া সম্ভব; কিন্তু যে-কোনো (সাহিত্য-সংক্রান্ত বা সাহিত্য-পদবাচ্য) ম্যানিফেস্টোকে প্রথমতঃ সাহিত্যের অংশ হিসাবে, সাহিত্য হিসাবে পড়তে হবে আগে, এবং পরে। সাজ্জাদ-প্রণীত ম্যানিফেস্টোটি আমি পড়েছিলাম, এবং দেখেছিলাম যে তা সুলিখিত এবং সুচিন্তিত। এর কিছু-কিছু সিদ্ধান্তে আমি দ্বিমত থাকলেও মোটের উপর আমার খুবই মনঃপূত হয়েছিল রচনাটি।

আর তেমন-তেমন ম্যানিফেস্টো হ'লে, আর যাদের জন্য তা লেখা তারা তার জন্যে প্রস্তুত থাকলে, তা যথেষ্ট-পরিমাণ প্রভাব সঞ্চার করতে পারে তো - কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো করে নি? তবু যদি আপনার কথা মেনে নিই আর বলি যে গাণ্ডীব গোষ্ঠির বাইরে এর কোনোই প্রভাব ছিল না, তখন এ তো অন্ততঃ মানব যে এই ম্যানিফেস্টোটি কমসেকম তিনজন ভালো কবিকে চিনিয়ে দিয়েছিল আমাদের। এ-ই বা কম কীসে?

তবে, ইস্তাহারটির নামটা আমি তখন বুঝতে পারি নাই, এখনও পারি না। সমগ্রতা কী? যদি এ হয় জীবনানন্দের "কবিতা অনেক রকম" -এর প্রতিধ্বনি, তবে তো রামের মুখে ভূতের নাম বলতে হয় একে।

দুপুর মিত্র: যদ্দূর জানি এই মেনিফেস্টো সাজ্জাদ শরিফের করা। মিডিয়ায় তার সাম্প্রতিক প্রভাব ও তখনকার এইসব মেনিফেস্টো লেখা, তার কবিতা, প্রকাশিত কবিতার বই সব মিলিয়ে এই বিষয়গুলোকে আপনি কিভাবে দেখতে চান?

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: সাজ্জাদের এই ম্যানিফেস্টোর সাথে তার পরবর্তী জীবনে মিডিয়া ম্যানিপ্যুলেশনের সম্পর্ক বা দ্বন্দ্ব কোথায়? সেই লেখায় সে কি লিখেছিল যে এখন সে যা-যা করছে তা-তা করবে না? তাইলে লেখাটিকে বাইরে রেখেই কথা হোক? আর আমি এও বুঝতে পারছি যে আপনার আগ্রহ সাজ্জাদের সাহিত্য নিয়ে নয়, ব্যক্তি-সাজ্জাদকে নিয়ে, তার (তথাকথিত) মিডিয়া-মাফিয়া পরিচয় নিয়ে।

এই কৌতূহল আজকাল অনেকেরই মাঝে দেখতে পাই, আর এতে ক'রেই বুঝি যে সাজ্জাদ বোধ হয় সত্যিই আজকে সাগরময় ঘোষকে টেক্কা দেবার পথে। কিন্তু কী মনে হয় জানেন? তাকে ময়-দানব বানিয়ে তুলেছে যত-না তার উচ্চাভিলাষ আর দুরভিসন্ধি, তারও থেকে বেশি, দুই শ্রেণির প্রতিভাহীন লেখক: ক. যারা তার পা টিপে প্রথম আলো-র কৃপাধন্য হয়েছে, আর খ. যারা পা টিপেও সুবিধা করতে না-পেরে (বা পা টেপার সুযোগও না-পেয়ে) গালাগালির পথে তার মনোযোগ কাড়বার চেষ্টায় বলদ-ঘর্ম। এই দুই শ্রেণির জনসংখ্যা বিস্ফোরণ হয়েছে এখন - ঘরে-ঘরে এদেরকে পাওয়া যাবে; বলা যায় না, একই ঘরে দু'-শ্রেণির দু'জনও পেয়ে যেতে পারে (একই ছাদের নীচে আওয়ামী-জামাতি যথা)।

সাজ্জাদ শরিফকে আমি মিডিয়া-মাতব্বরের চেহারায় দেখতে পাই না। পাই না দেও কি দানো-র চেহারায়। সে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু (ছিল?) - তার মেধা আর পঠনপাঠন, তার কবিতার নিটোল সৌন্দর্য ("নিটোল" কথাটা পশ্চিমা কবিতা বিষয়ে উপরে আরও একবার বলেছি, সাজ্জাদের কবিতা নিয়েও বললাম, ইচ্ছা ক'রেই, আক্কেলমন্তরা বুঝে নেবেন, কেন), গদ্যের উঁচু মান বরাবরই আমার সমীহ আদায় ক'রে এসেছে। তার তার উপরে ওঠবার যে একাগ্র নিষ্ঠা, তাকেও আমি সম্মান করি। অলস, উদ্যমহীন মানুষই অন্যের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়।

কিন্তু সাজ্জাদের যা-কিছু আমি নিতে পারি না, তার মধ্যে আছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, পরিকল্পিত আচরণ, এমনকি ঘনিষ্ঠজনদেরও সাথে। "বন্ধুত্ব" তার কাছে ঠিক কী অর্থ বহন করে আমি এতগুলি বছরেও বুঝে উঠতে না-পেরে বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি। অসবর্ণ বিবাহের মতো অসম বন্ধুত্বেরও হ্যাপা কম নয়।

আমি এই এক জীবনে যত গালি খেয়েছি, তার অন্ততঃ অর্ধেক সাজ্জাদ আর রাইসুর বন্ধু হবার "অপরাধে" (মেয়া কুল্পা, মেয়া মাক্সিমা কুল্পা) এবং আজকে যদিও তারা আমার বন্ধু আর নাই, গালি তবু আমারে ছাড়ে না। যুধিষ্ঠিরের কুকুর, এখনও সঙ্গী, এখনও বিশ্বস্ত। এ-সিলসিলায় আমার প্রিয় কবি ডবল্যু বি ইয়েটসের কয়েকটা লাইন শোনাই আপনাকে (আমারই অক্ষম অনুবাদে):

এখন সকল সত্য তো হ'ল জানা,

এখন সময় গোপন হবার, কোনো

পিতল-গলার থেকে পরাজন মানার।

সম্মানে বড় হয়েছ তো তুমি, কেন

যুঝতে যাবে বা তেমন কারুরও সাথে

যে, যদিও তার মিথ্যার হাঁড়ি লোকের

হাটে ভাঙে, তবু হবে না তো লজ্জাতে

ম্রিয়মাণ নিজ কিংবা পরেরও চোখে?

দুপুর মিত্র: সম্প্রতি মাসুদ খান এক সাক্ষাৎকারে আপনাকে গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে মনে করেন বলে জানিয়েছেন। অনেককে যারা তার গুণগ্রাহী তিনি এই ক্ষেত্রে তাদের নাম বলেন নি। এটা কি আপনার সাথে তার গোষ্ঠীভিত্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জোরালো অবস্থানের কারণেই সম্ভব হয়েছে?

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: প্রশ্নটা অদ্ভুত। আমার নাম না-নিয়ে, তিনি যাদের নাম করেন নি, তাদের নাম বললে আবার তাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই ওনার "গোষ্ঠিভিত্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জোরালো অবস্থান" (কী সাঙ্ঘাতিক!) খোঁজা হ'ত, নয়? তাইলে ওনার করণীয় কী ছিল? কোনো নাম-ই না-বলা? যেরকম সুবিধাবাদী অবস্থান নেওয়াটা প্রায় দস্তুর হ'য়ে দাঁড়িয়েছে আজকাল ("আমি নাম ব'লে কারো শত্রু হ'তে চাই না ভাই...")? মাসুদ খানের, নিজের ভালো লাগবার কথা অকপট বলতে পারার সৎসাহসকে আমি সাধুবাদ জানাই, আর তাঁর মুখে উচ্চারিত হ'তে পারার সৌভাগ্যে গর্ব বোধ করি।

মা.খা.-র সঙ্গে কোনো গোষ্ঠিগত সম্পর্ক আমার কখনোই ছিল না। উনি থাকতেন ডালে-ডালে, আমি পাতায়-পাতায়। উনি এই বগুড়া, এই কুড়িগ্রাম, এই ভুড়ুঙ্গামারি, আমি শাহবাগ, চান খাঁর পুল, নীলখেত - দেখা-সাক্ষাৎ অকালে-অভদ্রে। কয়েকবার আমাদের সুত্রাপুরের বাড়িতে এসেছেন, রাইসুর বগলদাবা হ'য়ে, আমি কুল্লে দু'বার হয়তো ওনার বাসায় গেছি, আর শাহবাগ-ধামে ওয়ান্স ইন আ ব্লু মুন। পত্র-যোগাযোগ ছিল, কিন্তু সেটা পারস্পরিক গুণগ্রাহিতার ফলেই শুধু। তাঁকে নিয়ে কোনোরূপ ঘোঁট পাকাবার সৌভাগ্য আমার হয় নি, যাদের হয়েছে তার আমার ঈর্ষাভাক্।

ভালো কথা, আপনি কি মনে করেন যে আমার আর রাইসুর নাম কারো নেওয়ার যোগ্য নয়? বা আমাদের নাম নিলে বাংলাদেশের আর-সকল কবিরই সাথে নেওয়া যেতে পারে শুধু, আলাদাভাবে কদাপি নয়? মনে করলে, কেন? না-করলেও, কেন?

এবার সদুক্তি কর্ণামৃত : "অনেককে যারা তার গুণগ্রাহী তিনি এই ক্ষেত্রে তাদের নাম বলেন নি।" এই কথার সরলার্থ কী? মানে, আমার "গুণগ্রাহী"-দের নাম নেওয়া আমার জন্যে ফরজে আইন? দাঁড়ান, আমি একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে নিই আগে, কারা আমার গুণগ্রাহী জেনে নিয়ে নিই...

মাসুদ খান তাঁর বিশেষ ভক্ত ব'লে কথিত কয়েকজন কবির নাম করেন নি (বোধ হয়) যেমন মজনু শাহ, সোহেল হাসান গালিব, তারিক টুকু, মাদল হাসান, নির্লিপ্ত নয়ন, প্রমুখ। তো আপনি হয়তো তাদের নাম না-নেবার কারণ ও ফলাফল জানতে চাইছেন? তাইলে যা শুনতে আপনার ভালো লাগবে তা-ই বলি আপনাকে:

মজনুর কবিতা বিষয়ে খান সাহেব বেধড়ক উদ্বিগ্ন হ'য়ে পড়েছেন। মজনু যে নিশ্চিতভাবেই তাঁর গদি য়ুসার্প করবার তালে আছে সেটা তিনি আগে টের পান নি, আমি জানাবার পর খেয়াল ক'রে হায়-হায় করছেন। আর গালিব আর টুকু তো দু'মুখো সাপ, হবু-বিরিয়ানিহারাম - তারা অলরেডি সাজ্জাদের ডান-বাম হাত। তাদের হাতে অর্ধচন্দ্র লাভের আগে তাদেরকেই তা দিয়ে ফেলা ধীমানের কাজ। অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স।

উনি আমার আর রাইসুরও সাথে এই কাণ্ড করতে চাইছিলেন, তো আমি তাঁকে থ্রেট দিলাম যে ওনার যাবতীয় আকাম (মজহারীয় তথা জামাতীয়) আর নানা জেনানা-ঘটিত গোপন কেলেঙ্কারি ও এসটিডি আমি ফাঁস ক'রে দেব। ভিতু মানুষ, এমন ভয় খেলেন যে আমাকে ছাড়া কারু নাম মনেই পড়ল না তেমন। আমি শ্যুর যে রাইসুও সেরকম কিছু করেছে - তবে সাজ্জাদ হয়তো অন্যরকম কিছু... খানের পরের বইখানা বছর-সেরা হ'লে অবাক্ হ'ব না।

খুশ?

দুপুর মিত্র: মাসুদ খানের কবিতা নিয়ে আপনার মন্তব্য কি? বা তাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: মাসুদ খানের কবিতা নিয়ে আমি আস্ত প্রবন্ধ লিখেছি, তাঁর অনেক কবিতার অক্ষম অনুবাদও করতে গেছি হঠকারী নোবিশের মতো, এমন গদ্য আমার কমই আছে যাতে তিনি অন্ততঃ একবার উল্লিখিত হ'ন নি - যে-কারণেই হোক। এসব থেকে আন্দাজ করতে পারেন হয়তো তাঁর কবিতা কতটা নাপছন্দ আমার।

আমি উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদার, রণজিৎ দাশ, অনন্য রায়, মৃদুল দাশগুপ্ত, জয় গোস্বামী বা গৌতম চৌধুরী পড়ি যখন, কী যে হাহাকার আমার হয় - হায়, আমাদের কেউ নাই অমন, কেউ না, কেউ না। কিন্তু মাসুদ খান পড়তে সময় মনে হয়, আমাদের এই যে মা.খা., এঁর মতো কেউ কি আছে ওদের - ওদের-আমাদের মিলিয়ে, "আমাদের"? হিমালয়ে কত-কত বেজায় উঁচু শৃঙ্গ, অনেক উঁচুর ভিড়ে আরও-একটু উঁচিয়ে-থাকা কোনো-কোনো মাথা, নজর করতে হয় দেখতে; কিন্তু খান হলেন মাউন্ট কিলিম্যাঞ্জারো, আশপাশে সমতল সাভানা, তার মধ্যে একা এক অভাবনীয়, বেঢপ, বিশালতা...

এবার আমাকে অভিযোগ করেন তাইলে, গোষ্ঠিভিত্তিক ইত্যাদির?

কিন্তু খান আসলে কবি ন'ন, কেননা তিনি "সৎ" ন'ন, সৎ হ'লে আরও অনেকের কথা তিনি নিশ্চয়ই কইতেন - আর অসৎ লোক কবি হয় কী ক'রে? বিশেষ, আমরার বাংলাদেশে? ওনার আল মাহমুদ হ'তে দেরি নাই। ফরহাদ মজহার তো হ'য়ে আছেনই।

দুপুর মিত্র: ক্ষমতা বা সামাজিকভাবে ক্ষমতাবান হওয়ার সাথে সাহিত্যিকভাবে ক্ষমতাবান হওয়ার কোনও সম্পর্ক আছে? থাকলে সেটা কেমন?

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: ক্ষমতা বলতে অন্যকে লাঞ্ছিত করবার ইচ্ছা এবং শক্তি বোঝালে, নিশ্চয়ই আছে। যেমন ধরুন আমাদের প্রেজিডেন্ট এরশাদ। উনি ক্ষমতাবান্ ছিলেন, কবিও, আর কবিতা শুনতে বাধ্য ক'রে আমাদের নাজেহাল করার ইচ্ছাও তাঁর খুব ছিল (তাঁর কবিতা আমার মন্দ লাগত না অবশ্য)।

তবে প্রশ্নটা শুনে বুঝতে পারছি যে রাজনৈতিক নেতাদের কথা আপনি শুধান নি, আমাদের লেখকদেরই ভিতর যারা দুর্বৃত্ত, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, যারা যাকে-তাকে বড় লেখক বানিয়ে দেয়, বড় লেখকদের বিস্মৃতির রসাতলে ঠেলে দেয়, বানরকে মুক্তার আর যিশুকে কাঁটার মালা পরায়, সেই সব কুলাঙ্গার, যথা মাসুদ খান, সাজ্জাদ শরিফ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, ব্রাত্য রাইসু, মজনু শাহ, সোহেল হাসান গালিব হয়তো আপনার ভাববাচ্যের উদ্দিষ্ট।

কিন্তু এইরূপ অযাচিত সনদ-প্রাপ্তিতে আমার কোনোই গ্লানি নাই; আমার না-থাকা ক্ষমতাও কেউ-কেই বোধ যে করে, ক'রে দাঁত কিড়মিড় ক'রে গালি ঝাড়ে, এও কি কম আহ্লাদের?

আমাদের মধ্যে সাজ্জাদ-ছাড়া আর-কারুর বোধ হয় প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা নাই; আর, তাছাড়া, ক্ষমতার ভেল্কিতে সাজ্জাদ শুধুই যে আমিরকে ফকির এবং ভাইসি-ভ্যর্সা বানায়, তা তো নয়। আমাদের হগল লেখকেরই ধনুক-বাঁকা মেরুদণ্ডগুলিও খুলে দেখিয়েও দেয় বটে সে। আজ যে কীনা দিকে-দিগন্তরে বজ্জাত-শরিফ-মুর্দাবাদ স্লোগান দিচ্ছে, কালই সাজ্জাদের পুরস্কার গলায় গলাতে তার বাধছে না - এই দৃশ্য তো কম দেখা যায় না, তাই না? সাজ্জাদের সঙ্গে আমার সদ্ভাব থাকলে অনুরোধ করতাম কুলদা রায়কে বছরের সেরা বইয়ের পুরস্কার দিতে, আর দেখতাম সে কী করে তখন... হা হা।

আসলে পৃথিবীর মতো, সাহিত্যের জগৎটাকেও ক্ষমতা-কাঠামো-গত-ভাবে দেখতে, জানতে শিখতে পারা চাই। অনেক উপর থেকে দেখলে, এই সবই খেলাধুলা-মাত্র মানুষের। কিন্তু মানুষের, তার জীবদ্দশায়, ঐটুকুই কীনা সম্বল। মরার পর রাম (থুড়ি অমর) হবার লোভ পরম ধার্মিকেরও কদাচিৎ হয়, লেখকেরা আবার কমই ধার্মিক হয়, ফলে বেঁচে থাকতেই তারা যা পাবার পেতে, যা খাবার খেতে চায়, খেলতে চায়, খেলাতেও। মাঠের আকার, বলের আকার, খেলনরীতি - এসব আলাদা-আলাদা হ'তে পারে, দর্শক আলাদা হ'তে পারে, এই। টাকার মতো খ্যাতিও (আর নারীও?) যত পায়, তত চায় মানুষ। বিলিয়নেয়ার হ'য়েও, নোবেল পেয়েও, আস্ত এক হারেমের মালিক হ'য়েও মনে হয় কী জানি বাকি থেকে গেছে, বা সবই পেলাম, আসল জিনিসটা-ছাড়া। ফলে নানা মাত্রার হীনম্মন্যতা আর অবদমনের শিকার প্রত্যেকটা মানুষই হয়, আর তার থেকেই যত ঘিরিঙ্গি।

আবার যে যে-অবস্থানে আছে, সে নিজেকে তার যোগ্য ভাবতে না-পারলে তার চেষ্টা থাকে এই অযোগ্যতা ঢাকবার, যোগ্যতা অর্জনের পথে নয়, বরং ভেল্কিবাজিতে সাবিদ করার চেষ্টায় যে সে এমনকি আরও উঁচু কোনো জায়গার কেউ... কাজেই ক্ষমতা-কাঠামো-গুলি এই যে মানুষের, তা আদতে অক্ষমতা-কাঠামোও বটে। আর আমাদের দেশের কথা বললে, আমাদের ডাক্তারের সংখ্যা যত, তার অন্ততঃ পাঁচগুণ দরকার মনশ্চিকিৎসক।

দুপুর মিত্র: আপনার সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এবং কেন?

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: সমসাময়িকদের মধ্যে আমারই কবিতাকে আমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, তাই তো আমার কবিতা আমি সবচেয়ে বেশি আর সবচেয়ে মনোযোগে পড়ি। গোষ্ঠিভিত্তিক কী-সবের কারণে মাসুদ খান, ব্রাত্য রাইসু, অসীমকুমার দাস, মোহাম্মদ কামাল, বিষ্ণু বিশ্বাস, সৈয়দ তারিক, শান্তনু চৌধুরী, সাজ্জাদ শরিফ, রিফাত চৌধুরী আমার ভালো লাগে ব'লে বলি। আর গোষ্ঠির বাইরেরও অনেকের কবিতা পড়া লাগে, যাদের নামোচ্চারণের দ্বারা তাদের সর্বনাশ করতে আমি চাই না (কেননা "আমাদের" যাকে-যাকে ভালো লাগে তারাও রাজাকার-আল বদর-আল শামস-জামাত-শিবির-হিজবুত তাহরির ব'লে পরিগণিত হবেই হবে)।

পশ্চিম বাংলার কবিদের নাম তোতাপাখির মতো ব'লে যাওয়া যেত, কিন্তু আমার বিলক্ষণ ঘটি-এলার্জি আছে; খালি ওখেনকের তিন বাঙালের নাম আমি ল'ব - গৌতম চৌধুরী, সৌম্য দাশগুপ্ত আর মিতুল দত্ত, বিশেষতঃ এ-জন্য যে রাজাকারির আশঙ্কা তাদের আর নাই, তারা ইতোমধ্যেই...

বড়দের মধ্যে যাঁরা সমসাময়িক, তাঁদের ভিতর পয়লাই আসবে ফরহাদ মজহার আর আলতাফ হোসেনের নাম (হি হি, দু'জনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলাম, ডুয়েলে), তারপর সিকদার আমিনুল হক, আবু কায়সার, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, আবিদ আজাদ, আবদুল হাই শিকদার, মুহাম্মদ নুরুল হুদা, শামসেত তাবরেজী, নাসিমা সুলতানা... আর একেবারে বাচ্চাদের ভিতর কিশোর ঘোষ, জিফরান খালেদ, আশিক খুদাবখশ, রওশন আরা মুক্তা... তথাকথিত শূন্যকে বাই-পাস করলাম, কেন তাও বলব না, ধ'রে নিন আমার বাপের খুশি।

দুপুর মিত্র: একটা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলা কবিতায় প্রতিষ্ঠান বিরোধী কবি বলে একটি শব্দ উচ্চারিত হয়ে আসছে। এই বিষয়টি কি আপনি কবিতাতেও দেখতে পান? দেখতে পেলে সেটা কিরকম না দেখতে পেলে এর কারণটা কি?

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: প্রতিষ্ঠান-বিরোধী আর অপ্রাতিষ্ঠানিক - দু'টো আলাদা শব্দ; প্রথমটি আমি বাংলাদেশে তেমনএকটা দেখি নাই (হ্যাঁ, গাণ্ডীবকেও, সেলিম মোরশেদকেও মাথায় রেখেই বলছি); অপ্রাতিষ্ঠানিক এন্তার দেখেছি - বলতেকি প্রায় সকলেই তাই। কিন্তু এর উল্টোটা হ'লে আমাদের লেখালিখি নিয়ে খানিক আশাবাদের জায়গা দিতে পারতাম কথা, কাজ আর চিন্তায়। অবশ্য আমার আশাবাদের তোয়াক্কা কৌন স্লা করেগা? হামভি নাহি।

অচলায়তন ভাঙতে গাঁইতি-শাবল লাগে, গেঞ্জিতে "সচলায়তন" লাগিয়ে ঘুরলে কোনোকিছু নিজগুণে ভেঙে পড়ে না। সঠিক নিয়ত আর হেকমতের দরকার করে। যে-দেশের কবিরাও ভাবে আকাশের নীচে ব'সে থাকলেই ওহির মতো কবিতা নাজেল হবে, তারা হবে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী? ভাতের পয়সায় গাঞ্জা খেয়ে তারা দুষবে সরকারকে, এস্টাবলিশমেন্টকে, প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠা হাসিল করতে না-পেরে বলবে আঙুরফল টক, সাজ্জাদ শরিফরা ঠক, ঐ পর্যন্তই।

প্রতিষ্ঠান-বিরোধী কবি ছিলেন হয়তো সাবদার সিদ্দিকী, বা হয়তো তিনিও ন'ন। মানে, প্রথম আলো পুরস্কারের জন্মের আগেই তিনি (প্রথম আলোর থেকে) দেহ রক্ষা করায় নিশ্চিত হ'য়ে বলতে পারছি না। বেঁচে থাকলে সাজ্জাদ তাঁকেও একবার শেরাটনের লাড্ডু খাইয়ে আনত যে তাতে সন্দেহ নাস্তি, কিন্তু তার পর সাবদার ভাই কী করতেন তা ঠিক বলা যায় না...

দুপুর মিত্র: তরুণ বা উঠতি কবিদের কবিতাকে আপনি কিভাবে দেখছেন বা এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণটা কি?

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: এ-বিষয়ে আমার পর্যবেক্ষণ সুবিধার না। তরুণদের আমি ঈর্ষা করি তারা তরুণ ব'লে, মোবাইল-পিসি-ইন্টারনেট-চ্যানেল টিভি-হাতে তারা ভূমিষ্ঠ হয়েছে ব'লে, তাদের জ্ঞানার্জনের পথে কোনো বাধা নাই (গুগল), প্রেমার্জনের পথেও না (ফেসবুক, মোবাইল) - হায়, আর একটিবার শুধু জন্ম নিতে চাই!

ফলে, মানে অসূয়াজর্জর, প্রতিহিংসাপরায়ণ লোকেরা যা করে - তাদের কবিতা আমি পড়ি না। মানে পারতপক্ষে। ফেসবুকের দাপটে একদম না-পড়তে পারা কঠিন, তবু সেই কঠিনের সাধনা ক'রে চলি। তবে বারে বারে হেরে যাই। তারুণ্যের জয় তো অবধারিত।

কিন্তু - আমার শুচিবায়ুর অভাববশতঃ, তরুণদের কবিতা হজম করবার ক্ষমতা আমার অনেকের চেয়ে ঢের বেশি। তাদের নিজেদের আবার আহারের খ্যামতা যত, হজমের তত কম থেকে থাকে। আমি ভুল বাক্য, বানান, ছন্দ ধরিয়ে দিই - কেউ-কেউ নাখোশ হয়, কেউ হাঁখোশ; দু'টোই আমার ভালো লাগে, কেননা তাদের আমি ঈর্ষা করি, তাদের সম্ভাবনাকে, অসম্ভাব্যতাকে, বোকামিকে, চালাকিকে, সর্বোপরি চেহারাকে - আর তারা স্ত্রীজাতীয়া হ'লে তো কথাই আছে, আমার রীতিমতো জিঘাংসা জাগ্রত হয়।

দুপুর মিত্র: কেউ যদি কবি হতে চায় সেক্ষেত্রে আপনি কি পরামর্শ দিবেন?

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ: কোয়ান্টাম মেডিটেশন ব'লে এক এলাহি কারবারের কথা আমার বন্ধু আমায় বললেন। এর আগে খালি মঈন (চৌধুরী) ভাইয়ের কাছেই কোয়ান্টাম কোয়ার্ক ইত্যাদি শুনতাম আমরা, তো ভাবলাম (অ-) পদার্থবিদ্যার কোনো বিষয়। বন্ধু তো অবাক্ - "আরে ষাঁড়ের গোবর, এটা মনের শান্তি বাড়াবার আর মন পরিবর্তন করবার এক ব্রহ্মাস্ত্র!" হাতে-নাতে প্রমাণও দেখালেন : আমার প্রতি যৎপরিমাণ বিদ্বেষ আগে পুষতেন, এখন তার এক-লক্ষাংশও নাই আর, তার জায়গা নিয়েছে ঋষিসুলভ নির্লিপ্তি...

তো, কবি হ'তে চায় যারা, তাদেরকে আমি কোয়ান্টাম মেডিটেশন (বা ভবিষ্যতে বোসন মেডিটেশন চালু হ'লে, সেটা) করবার পরামর্শ দেব, যাতে তারা এই অনর্থক ইচ্ছাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে পারে, এবং কোনো গঠনমূলক ইচ্ছায় (যথা প্রথম আলো-র সম্পাদনা) তাকে বদলে ফেলতে পারে। কেননা, একটা মহাকাব্য লিখে যা না হয়, একটা সম্পাদকীয়তে তা হয়। আজীবন কবিতা লিখে একটা স্টার জুটবে না কপালে, সম্পাদক হ'লে তাদেরকে ছাড়ানো মুশকিল হবে। এ জন্যেই সাজ্জাদ শরিফ কবিতা লেখে না আর, র‌্যাঁবোও ছাড়ান দিয়েছিল দাস ব্যবসায় জড়াবার পর।... গরিবের কথা বাসি হ'লে ফলে, কিন্তু বাসি হ'লে তা আর খাওয়া যায় না।

তবে ইচ্ছা নয়, যদি কেউ তার তকদির ব'লে কবিতাকে নিশ্চিতভাবেই জানে এবং কোয়ান্টামও ফেল মারে (আহা রে বেচারা), তবে তাদেরকে সর্বাগ্রে বুঝতে হবে যে কবিতা, আরও দশটা শিল্পমাধ্যমের মতো, একটা আয়াসসাধ্য, আয়ত্তিসাধ্য বিষয় - ছেলের হাতের মোবাইল নয়। প্রতিটা মাধ্যমের শিল্পীকেই হাড়ভাঙা খাটুনি দিতে হয় সেই-সেই মাধ্যমে স্নাতকত্ব অর্জন করতে। বছরের পর বছর, চাইকি আজীবন রেওয়াজ করতে হয়, গুরুর সাকরেদি করতে হয় শিল্পী ব'লে পরিচিত হবার আগে, এবং পরেও।

তুলি ধরতে জানি না, কাগজে (বা পিসি স্ক্রিনে) যা-খুশি আঁচড় কেটে পেইন্টার হ'য়ে গেলাম, সারেগামা চিনি না, রেকর্ডিং-এর কারিকুরিতে গায়ক হ'য়ে গেলাম, ভাষার ভ জানা নাই, ফেসবুক আর বন্ধুদের পিঠমালিশে কবি হ'য়ে গেলাম, এমনটা আসলে হবার নয়। এমনকি রিকশাও চালানো শিখতে হয় (আমি পাড়ার পেয়ারের রিকশাওয়ালাদের থেকে ধার নিয়ে একটু-আধটু চালিয়ে দেখতে গিয়ে বুঝেছি যে বিষয়টা রীতিমতো বীজগণিত, রিকশা কেবলই কান্নি খায়, বেইজ্জতি কারবার)।

কবিতা একটা হাতের কাজ, এতে ঐশী, দৈবী ব'লে কিছু নাই। ওসব ঐশিতার ধারণা যাদের, তারা হয় অকবি, নয়তো কবি নয়। মূর্তিমান্ অভিনয়। খোদা হাফেজ।