দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য অনেকটা দেহব্যবসার মতো: সাইইদ উজ্জ্বলের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 20, 2012 7:48:20 AM

প্রকাশিত কবিতার বই: দেউড়ি

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

সাইইদ উজ্জ্বল: কবিতা এমন একটি মাধ্যম যার চর্চা করলে আপনি অনেক কিছুই হারাবেন কিন্তু কিছুই পাবেন না। কবি জানে তার কাজের সামাজিক কোন মূল্য নেই। সমাজ প্রিয় হবার প্রচেষ্টাও তার ভিতর বিন্দুমাত্র নেই। কারন নীতিগতভাবে সে তার কাজের বিচারক হিসেবে সমাজকে মেনে নিতে পারে না। তাহলে কবি কেন কবিতা লেখে? কবির দায় তার শিল্পের কাছে। তার স্বপ্ন আছে। স্বপ্ন তাকে এতো জ্বালায় যে এর থেকে তাঁকে মুক্তি পেতে হবে। এর আগে তার শান্তি নেই। কবিতা লেখোর খাতিরে সম্মান, শিষ্টাচার, সুখ সব ভেসে যায়। কবিরা কেন কাব্য রচনা করেন এ বিষয়ে সক্রেটিসের পর্যবেক্ষণ হলো । ‘আমি শিঘ্রই আবিস্কার করলাম যে, বিজ্ঞ বলেই কবিরা কাব্য রচনা করেন না। তাঁরা কাব্য রচনা করেন একটি বিশেষ স্বভাব বা প্রতিভার গুনে যা সৃজণি উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পারে’। আমিও মনে করি সেই বিশেষ স্বভাব বা প্রতিভা যাকে অনেকে কল্পনা প্রতিভা বলেন তার গুনেই কবিরা কবিতা লেখে। আমিও সম্ভবত সেজন্যই কবিতা লিখি!

দু: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

সা: কবিতা লিখার জন্য কবির কোন প্রস্তুতির প্রয়োজন নাই। তবে একজন তরুণ কবিতাকর্মী যে বাংলাভাষায় কবিতা লিখতে চায় তার কিছু জানার বিষয় রয়েছে। তার কোন তত্ত্ব অনুসরনের প্রয়োজন নাই। পাঠ-অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিজের ভুল সে নিজেই শুধরাতে পারবে।

আরেকটা বিষয় আমি মনে করি যে একটু কষ্ট করে বাংলা ছন্দটা আয়ত্ত্ব করা উচিৎ। একজন কন্ঠশিল্পী সারেগামা জানলে যেমন গান গাইতে ও বুঝতে সুবিধা হয় তেমনি একজন কবির কবিতা বুঝার জন্য হলেও ছন্দ জানার প্রয়োজন রয়েছে। এলিয়ট বলেছেন ‘ যে কবি ভালো কাজ চান তার কাছে কোন ছন্দই মুক্ত হতে পারে না’। কবিতা-মুক্তি কে কেউ যদি ছন্দ থেকেই মুক্তি ভাবেন তাহলেতো কবিতাই হবে না। অনেককে বলতে শুনেছি ছন্দ মানেন না। কি ভয়ন্কর কথা! অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে একজন কবি স্বপ্রণোদিত হয়েই ধীরে ধীরে তার কবিতার ভাষা প্রস্তুত করে। এজন্য আলাদা করে যুদ্ধ সাজের মতো প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার নাই।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

সা: আমার জন্মের পূর্ব থেকে যারা কবিতা লিখতে শুরু করেছেন এখনও লিখছেন এবং আমার মতো তরুণ সবাই আমার সমসাময়িক। সে হিসেবে অনেকের কবিতাই আমার ভালো লাগে।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

সা: কারো কবিতাই খারাপ লাগে না যদি সেটা কবিতার শর্ত পূরণ করে। খারাপ লাগে যদি অকবিতাকে কবিতা হিসেবে বলা হয়।

দু: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

সা: আমি দশক বিভাজনে বিশ্বাস করি না। কবিতাকে জানতে হলে চর্যাপদ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কাব্যচর্চা সবই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কেউ একজন হয়তো বললো অমুক দশক থেকে আমরা কবিতায় বাঁক বদল করেছি। সেটা দাবী করা যেতে পারে তবে সাহিত্যের পূর্ব ইতিহাসকে কেউ খারিজ করতে পারেনা। এটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নয় যে আপনি এসে ভুল প্রমাণ করলেন। প্রত্যেকে প্রত্যেক যুগে কিছু না কিছু অবদান রেখেছে। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, সৈয়দ শামসুল হক, আবুল হাসান এদেরকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে কবিতার চর্চা চিন্তাও করা যায় না। আর একজন কবি সে যতই পূর্বসূরীর প্রশংসা করুক না কেন তার কাজ হলো তাঁকে অতিক্রম করা। কাউকে একবারে খারিজ করা নয়।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

সা: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা, ত্রিপুরার কবিতা, আসামের কবিতা, বাংলাদেশের কবিতা এভাবে ভাবতে আমি রাজি নই। জীবনানন্দ, নজরুল এদেরকে আপনি কোন বঙ্গের ধরবেন। হয়তো বলতে পারেন তখন সীমানার বেড়া ছিলো না। আমি মনে করি ভাষার ক্ষেত্রে সীমানা আরোপ করা ঠিক নয়। একটি ভালো কবিতা সব জায়গায় সমান আবেদন সৃষ্টি করতে পারে। তবে হ্যাঁ অনেক সময় ভৌগোলিক সীমারেখা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে যেমন এক সময় আরাকান বাংলা কবিতায় গুরুত্বপূর্ন জায়গা দখল করেছিলো কিন্তু এখন নেই। হিন্দি ভাষার আধিপত্য, বলিউডের সংস্কৃতির প্রভাব পশ্চিমবঙ্গ কিভাবে সামলাবে এটা তাদের ব্যাপার। আপনি যে ভাষায় সাহিত্য রচনা করবেন সে ভাষায় যদি কেউ কথা না বলে তবে তবে সে সাহিত্য ঠিকবে না। শুধু এটুকু বলতে পারি যে বাংলাদেশের কবিতা সঠিকপথেই এগুচ্ছে।

দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

সা: এখন পর্যন্ত ব্লগ সাহিত্য বিশেষ কিছু দিচ্ছে বলে আমার মনে হয় না।

দু: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

সা: এখন পর্যন্ত লিটলম্যাগকেই আমার গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। তবে ধারনা করছি ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এর কারণ হিসেবে বলা যায় বিশাল একটা পাঠক শ্রেণি গড়ে উঠছে। মান ধরে রেখে কাজ করলে এবং অসীম স্বাধীনতার অপপ্রয়োগ না হলে ধীরে ধীরে ব্লগ সামনে চলে আসবে।

দু: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

সা: ধরুন, আমি একটা দৈনিকে কবিতা দিলাম ছাপার জন্য। সেখানে আমার কবিতার সাথে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কবিতা ছাপা হলো। আমারতো কবিতার মান-সম্মান রক্ষার খাতিরে হলেও এটা জানা মাত্র আত্মহত্যা করা উচিৎ। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য অনেকটা দেহব্যবসার মতো।