ইনফরমেশনের সহজলভ্যতা শূন্য দশকের কবিতায় ভিন্ন মাত্রা এনেছে: রাজীব আর্জুনির সাথে অনলাইন আলাপ
Post date: Dec 21, 2013 4:53:11 PM
কবিতার বই: জলের মৈনাক
দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?
রাজীব আর্জুনি : হ্যাঁ, কেন লিখি!? আসলে যা আমি করতে চাই করি না; বলতে চাই বলি না ; ভাবতে চাই ভাবি না; এগুলো থেকে মুক্তি পাবার জন্য লিখি। মনস্তাত্ত্বিক এক প্রস্তুতি মৃত্যুর দিকে যাবার সে জন্য লিখি। ‘কেন লিখি’ বিষয়টি আমার কাছে জরুরি মনে হয় না সেজন্য লিখি। কারণ আমি জানি আমি সৎ ইচ্ছে ও প্রার্থনার জায়গা থেকেই লিখি।
দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরনের প্রস্তুতি দরকার?
রাজীব আর্জুনি : যে প্রস্তুতি পরীক্ষা শেষে সনদ পাইয়ে দেয় কবিতা লেখার ক্ষেত্রে সে রকম প্রস্তুতির দরকার নেই। আক্ষরিক প্রস্তুতি নিয়ে আপনি হয়তো কবিতা কবিতা খেলা খেলতে পারবেন, পুরোপুরি কবিতার কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারবেন না। কবিতা লেখার জন্য সৎ ইচ্ছেটাই জরুরি। ইচ্ছেটা সৎ হলে প্রস্তুতির ব্যাপ্তি স্বয়ংক্রিয় ভাবেই বেড়ে চলে। ইচ্ছাটা সৎ হলে মন ও মননের মেলবন্ধন দৃঢ় হয়ে প্রস্তুতির বিকাশ ঘটতে থাকে সুচারুরূপে।
দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন ?
রাজীব আর্জুনি : বিষয়টি বলা চ্যালেঞ্জিং। কেননা সমসাময়িক কবি ও কবিতার বিশেষত্বই এই যে তারা সমকালীন। সমকাল সব সময় স্ট্রাগল নিয়ে চলে; ঝড় বৃষ্টি রোদ মেঘ নিয়ে চলে। তাই সমসাময়িক কবিতা অনেক সময় চিরকালীন কালজয়ী কবিতার চেয়েও আনন্দ দেয়। তাছাড়া সমসাময়িক কবিতা সমকালকে আপনি যেভাবে দেখছেন, বহু বছর পর তা আপনার দেখার মাত্রা ছাড়িয়ে এমন এক জায়গায় পৌঁছবে যা আপনি কখনো ভাবেননি। সমকালের কবিতা আমাকে আনন্দ দিচ্ছে এটাই বলতে পারি।
দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?
রাজীব আর্জুনি : কবিতাই যদি হয় তাহলে খারাপ লাগবে কেন?
দুপুর মিত্র: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
রাজীব আর্জুনি : বিষয়টি এত ব্যাপক যে বিস্তর আলোচনার দাবি রাখে। নব্বই দশকের অসহায়ত্বটা এই এটি গোছানো ছিল না। অনেক ভয়েস দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে তবে তা কমপেক্ট কোনও জায়গায় পৌঁছেনি। নব্বই দশক যে জায়গাটায় আমাদের ইনস্পায়ার করে ও ঋণী করে দেয় সেটি এই ওই দশকে অনেক নিরীক্ষা হয়েছে, বিভিন্ন ভাবে নিরীক্ষা হয়েছে। ত্রিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের পরে আশিতে এসে কবিতার যে ভিন্নতা দেখা দেয়, নিরীক্ষা শুরু হয়, সেটা নব্বইয়ে এসে তীব্র আকার ধারণ করে। শূন্যেও যেটির রেষ থেকে যায় এবং কবিতা লেখার প্যাটফর্মটি সহজ করে দেয়। হতে পারে নব্বই দশকে টোটাল বিশ্বই অনেক কিছু নতুন করে দেখা শুরু করেছিল যেমন: প্রযুক্তির বিপ্লব, বাণিজ্য, অর্থনীতি, যোগাযোগ, ফ্যাশন কি নয়!? রাজনীতিতে স্বৈরাচার পতন শেষে গণতান্ত্রিক যাত্রাও বাদ যায়নি নব্বই দশকে। তাই অস্থিরতাও গিয়েছে অনেক। শূন্য দশকে যেটা হয়েছে বই বের করার কবির সংখ্যা কম হলেও যেভাবে চর্চাটা হয়েছে সেগুলোর প্রস্তাবনা, বাচনে, ভঙ্গিমায়, স্টাইলে অনেক পরিমিতি, স্থিতিশীলতা ম্যাচিউরিটি বিদ্যমান ছিল। এক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ভূমিকা, ব্লগিং উল্লেখ করা যেতে পারে। শূন্য দশকে ইনফরমেশনের সহজলভ্যতার কারণে এই দশকের কবিতার সৌন্দর্য ও প্রয়াস বাংলা সাহিত্যে ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে। তবে শূন্য দশকের কবিতা চর্চার নেপথ্যে এক ধরনের আয়েসি ভোগবাদিতার প্রবণতাও কি খেয়াল করা যায় নি?
দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা ও বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?
রাজীব আর্জুনি : পশ্চিমবঙ্গের কবিতায় যেটা হয় অধিকাংশই কবিতা বানানোর চেষ্টা করে। বুকিশ একটা প্রটোকলে থাকতে চায়। হিন্দি ও ইংরেজী ভাষার দৌরাত্ম এর একটা কারণ হতে পারে। এছাড়া ওদের বলিউড, টালিউড, টিভি স্যুপ ও সিরিয়াল তো আছেই। সত্তর আশির দশকের পরে কবিতার জৌলুস বাংলাদেশেই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে মনে করি কি ভাষায়, কি নির্মাণে, কি প্রস্তাবনায়।
দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?
রাজীব আর্জুনি : অবশ্যই দিচ্ছে। আজকের দিনে আপনি যত বেশি কমিউনিকেটিভ হবেন; যত এক্সপ্রেসিভ হবেন, যত আওতার মধ্যে আসবেন ততই বিস্তার, প্রসার এবং মূল্যায়নের সুযোগ ঘটবে। তাছাড়া এটা তো বিশেষ কিছু যে একজন আফ্রিকান অথবা ইউরোপিয়ান সে তার গবেষনার জন্য চাইলেও সার্চ ইঞ্জিন ক্লিক করেই পেয়ে যাচ্ছে আপনাকে। বিশেষ কিছু বলতে আপনি যদি আবার কালজয়ী বা অমর সাহিত্যের কথা বুঝিয়ে থাকেন তাহলে বলবো যে এটি ব্লগিং না করেও সম্ভব।
দুপুর মিত্র: লিটল ম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?
রাজীব আর্জুনি : দুটোর গুরুত্ব আলাদা। ব্লগ যেটা করবে আপনাকে তৈরি হতে সহায়তা করবে, আপনাকে দ্রুত পাঠকের কাছে পৌঁছিয়েও দিবে। তাছাড়া দ্রুততম সময়ের মধ্যে অনেকের মন্তব্য আপনার চিন্তা ও চর্চার মূল্যায়নের জন্য সহায়ক হয়। লিটল ম্যাগের গুরুত্বটা এই, এটি আপনাকে তৈরিও করবে, পৌঁছিয়েও দিবে, একই সাথে সংরক্ষণও করবে দালিলিক চিহ্ন স্বরূপ প্রযুক্তির ভয় ছাড়াই। এটারও গুরুত্ব আছে। লিটল ম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ কিনা সেই তুলনায় না গিয়ে আমি বরং দুটোর গুরুত্বকেই সমীহ বা খাতির করতে চাই।
দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?
রাজীব আর্জুনি : দেখুন, দৈনিকে বিপণনের একটা ব্যাপার থাকে। বিপণনের ‘ভ্যালু চেইন’ এর একটা ব্যাপার আছে। দৈনিক হলো ‘ভ্যালু চেইন’ প্রক্রিয়ার ডিস্ট্রিবিউটর যা সে বিতরণ করে। ফলে সে ক্ষেত্রে তার মধ্যে ঝুকিও পুঁজির ব্যাপারটা কাজ করে এবং সেখানে স্বাভাবিক ভাবে বিক্রয়ের ব্যাপারটাও চলে আসে। সে তখন চিন্তা করে কাকে সেল করবে। তাই অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ন বিষয়গুলোই বেছে নেওয়া হয়। সার্বিক দৈনিকের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না জীবন জীবিকার কারণে। তবে যেসব পত্রিকা অথবা ইন্টারনেটে সাময়িকী পর্যবেক্ষণ করি তাতে টের পাই পুঁজির কারণে অথবা অজানা কোনও কারণে তাদের ন্যাংটা হতেও সমস্যা নেই। বাজার ব্যবস্থায় সৃজনশীলতাকে পণ্য বানানোর যে প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয় সেটা ভয়ংকর।