নিজেকে প্রকাশ করার জন্যই আসলে আমি কবিতা লিখি: জফির সেতুর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jul 23, 2012 11:33:17 AM

প্রকাশিত বই : কবিতা- বহুবর্ণ রক্তবীজ (২০০৪), সহস্র ভোল্টের বাঘ (২০০৬), স্যানাটোরিয়াম (২০০৮), তাঁবুর নিচে দূতাবাস (২০১১) ও সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী (২০১২); প্রবন্ধ- লোকপুরাণের বিনির্মাণ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (২০০৯); সম্পাদনা-শ্রেষ্ঠ কবিতা ॥ দিলওয়ার (২০১১) ও নন্দলাল শর্মা : ব্যক্তি ও মানস (২০১২)।

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

জফির সেতু : দুপুর, এটা একটা কঠিন প্রশ্ন! বিষয়টা এর আগে আমি কখনো ভাবিনি তো! আমি কবিতা লিখি, কিন্তু আমার ভাই বা বোন বা পরিবারের আর কেউ তো লিখে না! তাহলে আমি লিখি কেন? লিখছি কেন? এর উত্তরটা অবশ্য সহজ হয়ে যেত যদি বলতে পারতাম, বেঁচে আছি কেন? নির্ধারিত করে যদি বলা যেত আমরা বাঁচি কেন? মানুষ কেন বেঁচে থাকে! আবার বেঁচে থাকার জন্য লেখাটাও যে মানুষের জন্য অত্যাবশ্যকীয় শর্ত না! তাহলে সকলেই হতেন কবি বা লেখক। তাও তো না! না লিখেও মানুষ দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছেন জীবন বা কাটিয়ে দিয়েছেন। আবার কেউ বোধ হয় না লিখে বেঁচে থাকতে পারেন না। তাকে লিখতে হয়, বিশেষ করে বললে কবিতাই লিখতে হয়! কিন্তু কেন লিখতে হয় কবিতা? অবশ্যই বেঁচে থাকার অনুষঙ্গ হিসেবে আমার কাছে কবিতা লিখাটা খুবই জরুরি বলে মনে করি। আপনি হয়তো জানেন, সম্প্রতি সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী নামের একটি কবিতার বই বেরিয়েছে। এটি লিখেছি আমি গত মাসের পুরো একটি সপ্তাহ জুড়ে। বলা যায় লিখেছি দরোজা-জানালা বন্ধ করে। এর আগে আমি ভ্রমণ করেছিলাম কাশ্মীর উপত্যকা, যাকে ভূ-স্বর্গ হিসেবে জানেন পৃথিবীর মানুষ। দেশে ফিরে এসে আমার কী হলো, আমি একটি ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। কাশ্মীরে সিন্ধুর জলে আঙুল ডুবিয়ে আমি অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। সিন্ধু সভ্যতার এই সেই নদী! আমার মনে হলো আমি গোটা মানবসভ্যতা পরিভ্রমণ করে এলাম। ভেতরে ভেতরে এমনিতেই আমি দগ্ধ ছিলাম। আমার ভেতরে অনেক দগদগে ক্ষত জমা হয়েছিল। আমি অস্থির ছিলাম। পরাজয়, রণরক্ত, জয়, সফলতা, প্রেম, হিংসা আর মানুষের ভেতরকার মানুষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেলাম এক নির্জন দুপুর বেলায়। আমি লিখতে শুরু করি। আমি পাগলের মতো লিখতে শুরু করি। বদ্ধ-উন্মাদের মতো। আমি আমার ভেতর ডুবে যেতে থাকি। আর এক মধ্য রাতে মনে হলো আমি যা প্রকাশ করতে চেয়েছি এইমাত্র তা শেষ হয়ে এলো, আর এটাই আমি প্রকাশ করতে চেয়েছি অন্যের কাছে, ভাষায়, কবিতার ভাষায়। এই ভাষা আলো-আধাঁরির। এই প্রকাশ অন্যরকম প্রকাশ। কথা হলো দুপুর, এই যে সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী লেখা হলো, ওই সময়ে, পুরো সপ্তাহ জুড়ে, আমি ওটা না লিখলে পারতাম না। আমাকে লিখতেই হতো। একটা বিশেষ ভাব, একটা অনুভূতি আর উপলব্ধি আমার ভেতরে যখন কাজ করে আমি একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যাই। তখন আমি প্রকাশের ভাষা খুঁজি, হয়তো এই ভাষাটা কবিতার। আর সকল মানুষই প্রকাশ করতে চায় যার যার অনুভূতি ও উপলব্ধিকে নিজের মতো করে। কিন্তু মানুষকে তা প্রকাশ করতেই হবে। আমার প্রকাশের ধরনটা হয়তো এ-রকম। নিজেকে প্রকাশ করার জন্যই আসলে আমি কবিতা লিখি। আর নিজেকে এভাবে প্রকাশ করতে আমি গভীর আনন্দ পাই। আমি জীবনকে গভীরভাবে উপভোগ করি। কবিতা জীবনকে উপভোগ করার গুরুত্বপূর্ণ একটা মাধ্যম। যারা কবিতা লিখেন তারা জানেন।

দুপুর মিত্র: কাদের কবিতাকে আপনি অনুসরণীয় বলে মনে করেন এবং কেন?

জফির সেতু : এটাকে অনুসরণ বলে কি না আমি জানি না। আমার মতো করে বললে বলতি পারি প্রেরণা। আসলে পৃথিবীর সকল কবি মিলে একটা মালা, মালাইতো। এক কবির সঙ্গে অন্য কবির কাব্যিক সম্পর্ক অনিবার্য। এটাকে উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে মানুষের রক্তের সঙ্গে। সকল মানুষের রক্তেই একটা নিকট সম্পর্ক রয়েছে। অথবা রক্ত একটাই। কবিতাও সে রকম। স্বতন্ত্র কবিতা বলে আসলে কিছু নাই। এক কবির কাব্যপ্রেরণা অন্য কবির মধ্যে থাকবেই। প্রকাশটা ভিন্নরকম হতে পারে। আবার প্রাচীন কবি বা সাম্প্রতিক কবি বলে আছে নাকি কিছু? কবিরা সকল সময়েই চিরকালের। আর চিরকালের কবিদের কবিতা আমাকে প্রেরণা দেয়-আমি উজ্জীবিত হই, অনুরণিত হই। যেমন আমি যখন হোমার বা বাল্মীকি পড়ি অথবা কালিদাস বা ইমরুল কায়েস পড়ি তখন আমার মনেই হয় না এঁরা প্রাচীন কালের। আমার মনে হয় এঁরা সমকালীন কবি।

দুপুর মিত্র: বাংলা কবিতার কোন ধারাটাকে আপনার বেশি ভাল লাগে এবং কেন?

জফির সেতু : অবশ্যই আমার আধুনিক গীতিকবিতার ধারা বেশি ভালো লাগে। বলা বাহুল্য, এটাই আমাদের সাহিত্যের সর্বাধিক বিকশিত ধারা। আসলে গীতিপ্রবণতা আমদের রক্তের মধ্যেই নিহিত। আমাদের বলতে বাঙালি জাতির। এমন একটি ভূখণ্ডে আমরা জন্মেছি যেখানকার নিসর্গপ্রকৃতি ও প্রতিবেশ আমাদের অস্তিত্বেও কণায় কণায় লিরিকবৈশিষ্ট্য ছড়িয়ে দিয়েছে। এদেশের নদীর ঢেউ, হাওরের উচ্ছ্বাস, বৃষ্টির শব্দ ও সমুদ্রের কল্লোল আমাদের অনুভব, অনুভূতি ও উপলব্ধি, সর্বোপরি মানসচেতনাকে গভীরভাবে নির্মাণ করে দিয়েছে। ইচ্ছে করলেও আমরা চেতনাগতভাবে নৈর্ব্যক্তিক হতে পারব না। তাই এই দেশ মহাকাব্যের হতে পারেনি, হয়েছে গীতিকাব্যের। চেতনাগত দিক থেকে এদেশেব সকল মানুষের ভেতরে একজন সহজ কবির বাস। মধুসূদনের কথা চিন্তা করুন, প্রথাগত কাব্যফর্মের বাইরে গিয়েও কেমন আটকে গেলেন গীতিকাব্যের মিঠেপানিতে। এটাই আমাদের স্বভাব বা ধর্ম যেটাই বলি। আর মানুষতো নিজের স্বভাবের বাইরে যেতে পারে না! কবিতা আসে স্বভাব থেকে। জোর করে কবিতা আসে না।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনি বেশি পছন্দ করেন এবং কেন?

জফির সেতু : আমার বলতে দ্বিধা নেই সমসাময়িক অনেক কবিদের কবিতাই আমার ভালো লাগে। এখানে পৃথক করে নাম বলার প্রয়োজন বোধ করছি না। অবশ্য সমসাময়িক বলতে আপনি যাদের বুঝাতে চাচ্ছেন। আমি আগেই বলেছি পৃথিবীর বড় কবিমাত্রই সমসাময়িক। আবার সমকালে কবিতা লিখেও একজন কবি সমসাময়িক নাও হতে পারেন, আর এমনটা যদি কোনো কবি না হন তাহলে তিনি কবি হিসেবে মৃত। যদিও তিনি আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করছেন, দিব্যি গল্প করে যাচ্ছে বা সিগারেট বা মদ টেনেই চলেছেন। ইতিহাসে মৃত কবিদের কোনো জায়গা নেই। আমাকে প্রাণিত করে নিশ্চয়ই এমন কবিদের আমি পছন্দ করি।

সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার বাজে মনে হয় এবং কেন?

জফির সেতু : আমি বাজে বলবার কে? আর আমার বাজে বলায় কবিতাও বাজে হয়ে যায়না নিশ্চয়ই। এটা ঠিক, প্রতিদিন ভুরিভুরি কবিতা লেখা হচ্ছে। সপ্তাহান্তে পদস্থ দৈনিকের সাহিত্য পাতায় মুদ্রিত হচ্ছে কবিতার পর কবিতা। এর বেশির ভাগই আমার পড়তে ইচ্ছে করে না। না পড়লেও চলে। কিন্তু ভালো কবিতা না পড়লে চলে না। না পড়ে থাকা যায় না। কবিতা যারই হোক। আমি মনে করি যে-কবিতা না পড়ে থাকা যায় দিব্যি, তা-ই বাজে কবিতা। বাজে কবিতা আমাদের বিরক্তির উদ্রেক করে। আর সকল কালেই সকল ভাষায় বাজে কবিতা লিখা হয়েছে। আমার মনে হয় এটা নিয়ে আলাদা করে ভাবার কোনো কারণ নেই। আবার একটি ভালো কবিতার কবি ভয়ানক বাজে কবিতাও প্রসব করতে পারেন। তাতেও মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না।

সাম্প্রতিক কবিতা নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

জফির সেতু : সাম্প্রতিক বলতে কী বুঝাচ্ছেন? সম্প্রতি যারা শুরু করেছেন বা লিখছেন-দশক বা অর্ধদশক ধরে? এটা হলে বলতে পারি আমি তাদের কবিতা খুব এনজয় করি। কবিদেরও এনজয় করি। এই কবিদের অনেকেরই খুব তাড়া আছে! এই তাড়াটা আমি বুঝি না। যদি রূপক হিসেবে নিই তবে বলতে হয়, কবি হওয়ার আগে বাল্মীকির শরীরে বল্মীকের আস্তরণ পড়ে গিয়েছিল! তারপর একদিন মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, মা নিষাদ...! দশকের প্রশ্ন যদি ধরেন তবে এভাবে কবিতাকে বিচার না করাই ভালো। দশকে আমি বিশ্বাস করি না। ভালো কবি মাত্রই সাম্প্রতিক এবং চলমান দশকের, নাকি?

দুপুর, আপনাকে ধন্যবাদ।