এরকম প্রশ্ন দিয়ে আলাপচারিতা শুরু করাটা রীতিমতো প্রশ্নসন্ত্রাস: কবি মুজিব মেহদীর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 4, 2012 9:38:49 AM

প্রকাশিত সৃজনশীল গ্রন্থ:

চিরপুষ্প একাকী ফুটেছে

http://mmchiropushpo.blogspot.com/

মমি উপত্যকা

http://mmmomyupattyaka.blogspot.com/

শ্রেণিকরণ এমন এক সংকীর্ণতা যা সৃষ্টির মহিমাকে ম্লান করে দেয়

http://mmsrenikoronsonkirnota.blogspot.com/

বৃষ্টিগাছের তলায়

http://mmbristigachertolay.blogspot.com/

ময়দানের হাওয়া

http://mmmoydanerhaowa.blogspot.com/

খড়বিচালির দুর্গ

(এটার কোনো ওয়েব লিংক নেই)

রূপান্তর, সটোরি লাভের গল্প

http://mmsatorilave.blogspot.com/

প্রকাশিত মননশীল গ্রন্থ:

মাদ্রাসা শিক্ষা : একটি পর্যবেক্ষণ সমীক্ষা, অনুসন্ধান, বিএনপিএস ২০০১

http://www.bnps.org/publications.html#madrasa_education

হাওর : জলে ভাসা জনপদ, অনুসন্ধান, আইইডি ২০০৫

http://www.iedbd.org/publications/pdf_files/Haor.pdf

ইকোপার্ক উন্নয়ন : জীববৈচিত্র্য রক্ষার নামে জীবন ও প্রতিবেশ বিনাশী তাণ্ডব, অনুসন্ধান, আইইডি ২০০৫

http://www.iedbd.org/publications/pdf_files/Ecopark.pdf

মুক্তিযুদ্ধ ও নারী, রোকেয়া কবীরের সঙ্গে যৌথভাবে, অনুসন্ধান, আইইডি ২০০৬

http://www.iedbd.org/muktijuddho.htm

দুপুর মিত্র: সাজ্জাদ শরিফকে কি আপনার বাংলা সাহিত্যের মাফিয়া বলে মনে হয়? সাজ্জাদ শরিফ ও রণজিৎ দাশের সংকলন নিয়ে আপনি বেশ কিছু যৌক্তিক প্রসংগ উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন নোটে। এ বিষয়ে আপনি কিছু বলবেন?

মুজিব মেহদী: এরকম প্রশ্ন দিয়ে একটা আলাপচারিতা শুরু করাটা রীতিমতো সন্ত্রাস, প্রশ্নসন্ত্রাস। ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ হলো না। তবে এ ব্যাপারে বলবার কথা কিছু আছে বলে শেষপর্যন্ত উপেক্ষাও করলাম না!

সাজ্জাদ শরিফ একজন কবি ছিলেন; কবিতা লিখতেন অর্থে কবি নয়, কবিতা হতো অর্থে কবি। কিন্তু পরে ঘটনাক্রমে তিনি এমন এক মসনদে আরোহণ করেন, যেখান থেকে কবি ও কবিতা শুধু নয়, ক্রমশ আরো বিস্তৃত হয়ে শিল্প-সাহিত্য ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টজনদের ওপরে শাসন চালাবার তাঁর অবাধাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সাম্প্রতিককালে এরকম ক্ষমতায় এদেশে আরো অনেকেই আরোহণ করেছেন, এর মধ্যে দুজনের প্রচুর দাপটও দেখা গেছে, কিন্তু সেভাবে তাঁদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ও স্থায়ী হয় নি। এই তিনজনের বাইরে থাকারা রাখালরাজা, কেউই তাঁদের পোছে না! যাহোক, বন্ধু-স্বজন নিয়ে এ ক্ষমতাকে সাজ্জাদ শরিফ চুটিয়ে উপভোগ করতে লাগলেন। স্বাভাবিক নিয়মেই তাঁর অনেক ফেউ জুটল। ক্ষমতা সবসময়ই ফেউ (চ্যালা-চামুণ্ডা, তোষামোদকারী ও শিষ্যসাবুদ) পয়দা করে। তাঁরও অনেক হলো। ইত্যবসরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে কবিতা লেখার সাহস ও সক্ষমতা হারিয়ে ফেললেন তিনি (এটাই অবশ্য হবার কথা)। চাইলে তিনি এরপরও কবিতামতো লেখা লিখতে ও ছাপতে পারতেন না তা নয়, কিন্তু লিখেন নি ও ছাপেন নি এই ভয়ে যে, শিষ্যসাবুদরা তাঁকে ইতোমধ্যেই শ্রেষ্ঠত্বের যে আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন, নতুন করে লিখলে কে জানে, তাঁর ওই আসনটাই কেঁপে ওঠে কি না! এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে তাঁর কবিত্ব পুরোপুরিই মৃত্যুবরণ করে (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন), পরিবর্তে তিনি হয়ে যান এদেশের একজন গণ্যমান্য শিল্পব্যাখ্যাতা পণ্ডিত (একাধারে কবিতা, চিত্রকলা, সিনেমা, নাটক, সংগীতসহ সবকিছুর)!

পত্রিকার প্রচারসংখ্যা, তাঁর স্টারসুলভ গ্ল্যামার, ইত্যাদি মিলিয়ে দিনে দিনে অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তাঁর পছন্দই শিল্প-সাহিত্যের প্রথম পছন্দ হিসেবে বাজারে জায়গা দাবি করছে। সমঝদারদের একাংশ তা গ্রহণও করছে। এদেশের শিল্প-সাহিত্যরুচির এই যে মনোপলি অবস্থার দিকে যাত্রা, এ দায় মোটেই সাজ্জাদ শরিফের একার নয়, বরং ভোক্তাদের বৃহদাংশেরও। কবি রণজিৎ দাশকে সাথে নিয়ে করা ‘বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকল্পের মতো এরকম আরো যা কিছু বিতর্কিত কাজ তিনি এ যাবৎ করেছেন, তা তাঁর প্রতি আমাদের লেখককুলের অকুণ্ঠ সমর্থনের শক্তিতেই করেছেন। সুতরাং তাঁকে যদি আপনি সাহিত্যমাফিয়া আখ্যা দিতেই চান (আমার তেমন কোনো খায়েশ নেই), তবে ওই মাফিয়াগ্রুপের সভ্যদের কথাও তুলতে হবে। মাফিয়া কেউ একা একা হতে পারে না, অনেকে মিলে ও সঙ্গে থেকে কাউকে মাফিয়া বানিয়ে তুলতে হয়।

সম্প্রতি ইত্তেফাক সাময়িকীকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তাঁর এক অদ্ভুত মনোবাঞ্ছার সাথেও আমাদের পরিচয় ঘটেছে। লেখক হিসেবে বিকশিত হবার জন্য যেসব তরুণকে তিনি নানাসময়ে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন, এখন তিনি তাঁদের মধ্যেই তাঁর স্বপ্নের বেড়ে ওঠা প্রত্যক্ষ করছেন; যে কারণে তিনি দাবি করছেন এঁরা (এখানে নাম বলা প্রয়োজনীয় নয়) তাঁর নিজেরই বিস্তার। এ দাবিতে সারবস্তু আছে বলেও মনে হচ্ছে, কারণ সাজ্জাদ শরিফের বিস্তার বলে চিহ্নিত কোনো লেখক এখনো পর্যন্ত উল্লিখিত দাবির প্রতি কোনোরূপ চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন বলে আমার জানা নেই। তাঁর কথার ওপরে যে কথা প্রায়-খাটছেই না, এ নীরবতা হয়ত সেটারই এক দাঁতাল প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল!

দুপুর: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

মুজিব: আমি ভেবে পাই না, একটা কবিতাঘনিষ্ঠ জীবনে একজন কবিতাকর্মীর সর্বমোট কতবার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়, যে প্রশ্নটা বিকৃতযোনি ও ক্লিশে।

এটা জানি যে, আমি কবিতা না-লিখলেও কিচ্ছু যাবে আসবে না কারো। আমারও না। তবু লিখি লিখতে পারি বলে! ধারণা করি, আমি হয়ত এমন কিছু কবিতা এক জীবনে লিখে উঠব, যা আমি না-লিখলে অলিখিতই থেকে যাবে চিরকাল।

কখনো কখনো অন্যদের কবিতা পড়তে গিয়ে মনে হয় যে, এটা কিছুই হলো না, কবিতা হবে অন্যরকম। এই অন্যরকমটা কীরকম নিজেকে সেটা দেখাতে গিয়েও আমি লিখি। আবার কখনো কখনো কোনো ভালো কবিতা পড়ে মনের ভিতরে এমন এক চাপ তৈরি হয় যে, একটা কবিতা নামিয়ে ফেলবার আগ পর্যন্ত কোনোভাবেই সে চাপকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

দুপুর: 'শ্রেণিকরণ এমন এক সংকীর্ণতা যা সৃষ্টির মহিমাকে ম্লান করে দেয়', ২০০৩ সালে আপনার এই বইটি বের হয় প্রতীতি থেকে। একে আপনি উভলিঙ্গ রচনা বলছেন। এ বিষয়ে কিছু বলবেন? ২০০৬ সালেও বাংলাপ্রসার থেকে প্রকাশ করেন 'বৃষ্টিগাছের তলায়'। একেও আপনি বলছেন উভলিঙ্গ রচনা। তার মানে এই ধরনের রচনার প্রতি আপনার বিশেষ একটা ঝোঁক আছে। এর কারণটা কী?

মুজিব: ২০১১-এ ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত আমার উভলিঙ্গ রচনা সংগ্রহ ‘খড়বিচালির দুর্গ’-এর ভূমিকায় এ নিয়ে বিস্তর কথা বলেছি। অতসব কথা এখানে আবার করে বলার দরকার নেই মনে করছি, আগ্রহীদের বইটিই পড়তে অনুরোধ করব। তবে সংক্ষেপে জানানো যায় যে, কবিতা কবিতা খেলায় মাঝে মধ্যে নিজের কলমে জন্ম নেয়া এমন কিছু রচনার সামনে আমাকে পড়তে হয়েছে যাকে মনে হয়েছে কবিতা নয়, বরং কবিতার চেয়ে কিছু কম বা বেশি। চাইলে এগুলোর একাংশকে কবিতা নামে চালানো যেত, অনেকেই চালান, কিন্তু আমি তা চাই নি। বরং ইতোমধ্যেই শনাক্তকৃত বৈশিষ্ট্যসমেত সংজ্ঞায়িত করে একে ‘উভলিঙ্গ রচনা’ নামে চিহ্নিত করেছি ও আলাদা বইয়ের ভাবনা ভেবেছি। প্রশ্নে উল্লিখিত দুটি বইয়ের পরে ‘ব্রাত্যপ্রতিম খঞ্জভাবেরও গোপন একটা চলচ্ছক্তি থাকে’ নামে এ ধারার আরেকটি পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়। ‘খড়বিচালির দুর্গ’ এই তিনটি বইয়েরই একত্র গ্রন্থন। এই সংগ্রহের পরেও এ ধারার আরো লেখা লিখিত হয়েছে। যতদূর জানি, ভবিষ্যতেও এ ধারার রচনা আমার দ্বারা লিখিত হবে এবং সংগতকারণে বইও হবে।

প্রথম দিকে এসব রচনা নিয়ে আমি রীতিমতো সংশয়াচ্ছন্ন ছিলাম। যখন চিনে উঠলাম, তখন আর এদের স্বতঃজন্মপ্রয়াসকে কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত করি নি; বরং সবুজ পতাকা উড়িয়ে রেখেছি, জেনেশুনে আগ্রহ নিয়ে মন পেতে থাকছি এদের চিৎকার শুনতে। সুতরাং এটা বললে অসত্য বলা হবে না যে, এ ধারার রচনার প্রতি আমার একটা তীব্র ঝোঁক আছে বা আমার ওপরে এসব রচনার একটা শাসন জারি আছে।

জনান্তিকে বলি, কবিতার চেয়ে সন্তান হিসেবে উভলিঙ্গ রচনাগুলোই আমার বেশি প্রিয়, কারণ এদের গর্ভে ধারণ, প্রসব ও লালনপালন করে মানুষ(!) বানিয়ে তুলতে আমাকে কবিতার চেয়ে ঢের ঢের বেশি বেগ পেতে হয়েছে।

দুপুর: আপনি বেশ কিছুদিন ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত সাহিত্যপত্র ‘দ্বিতীয় চিন্তা’র সম্পাদনার সাথে ছিলেন। সম্পাদনা বিষয়ে আপনার অভিমতটা জানতে চাই। মানে এ সময়ে যে সাহিত্য সম্পাদিত হয়ে আসছে, তাকে কি সম্পাদিত বলা যায়? বা সাহিত্যের সম্পাদনা বিষয়ে যদি কিছু বলেন।

মুজিব: ‘দ্বিতীয় চিন্তা’য় আমাকে সম্পাদনার কিছু কাজ নির্বাহ করতে হলেও আমি ওই মর্মে ডেজিগনেটেড কেউ ছিলাম না। ওই কাগজের ডেজিগনেটেড সম্পাদক বরাবরই ছিলেন ইফফাত আরা। আমি আমার ছাত্রাবস্থায় ‘দ্বিতীয় চিন্তা’ কার্যালয়ে সবান্ধব আড্ডার একটা জায়গা পেয়েছিলাম। পেয়েছিলাম বিড়ি কিনবার উপযোগী মাসোহারাও। সুতরাং সম্পাদককে আমি সব ধরনের সহযোগিতা দিতাম পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসেবে। আমার সম্পাদনা-ভাবনার সাথে ওই কাজের কোনোই যোগ ছিল না।

লেখক হিসেবে আমি ভাবি, সাহিত্যকর্মের কোনো সম্পাদনা হয় না। সাহিত্যে লেখকের ঊর্ধ্বে তাঁর লেখনকর্মে আর কারো কোনো খবরদারি বরদাশতেবল নয়, যতক্ষণ না লেখক স্বেচ্ছায় তাঁর লেখাটাকে কেটেছেঁটে ফেয়ার করে দিতে বলছেন। আবার সম্পাদক হিসেবে ভাবি, লেখায় বক্তব্য ও চরিত্রগত কোনো অসংগতি, তথ্যগত ভ্রান্তি, বানান ও ভাষাগত বিভ্রাট থাকতে পারবে না। নিবিড় অধ্যয়নের ভেতর দিয়ে কোনো লেখায় এরকম ব্যাপার চোখে পড়লে সুনির্দিষ্ট নোটসহ লেখককে লেখাটা ফেরত দিয়ে বা না-দিয়ে জানান দেয়া যেতে পারে যে, উল্লিখিত সমস্যাগুলো দূর করে আবার লেখাটা জমা দিন। লেখক যদি বলেন, দয়া করে আপনারাই করে নিন, সম্ভব হলে তা নিজেরা করে ছাপবার জন্য মনোনীত করা অথবা লেখক যদি বলেন সেটা করা সম্ভব নয়, তাহলে লেখাটাকে অমনোনীত করা দরকার। আমার বিবেচনায় এর বাইরে আর কোনো গ্রহণযোগ্য রাস্তা নেই।

আমার নাতিদীর্ঘ অভিজ্ঞতা বলে যে, আমাদের দেশের সিংহভাগ সম্পাদক (সাহিত্য সাময়িকী ও লিটলম্যাগ) লেখকের নামটাই কেবল পড়েন। তাঁরা লেখকনাম পড়ে ও লেখার আকৃতি দেখেই ঠিক করেন, লেখাটা ছাপবেন নাকি বাতিল করবেন। এর ফলে ভুলভালে ভরা দুর্বল লেখাই এখানে বেশি করে ছাপা হয় এবং নামে গ্ল্যামার নেই এমন লেখকের ভালো লেখাও ময়লার ঝুড়িতে নিক্ষিপ্ত হয়। সাময়িকী সম্পাদক খুশি হন সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে পাতাটি বের করে চাকুরি বাঁচাতে পারলে, আর লিটলম্যাগ সম্পাদক খুশি হন কাগজটা সাইজে ঢাউস হলে ও মুদ্রণ সৌকর্য ঠিক থাকলে; কারণ প্রায়শই এর ওপরে বিজ্ঞাপনদাতাদের খুশি হওয়া নির্ভর করে।

দুপুর: আপনি দীর্ঘদিন ধরে দৈনিক পত্রিকায় লিখছেন না বা আদৌ লিখেন নি; কিন্তু প্রথমআলোব্লগে আপনি লিখেছেন। এ বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?

মুজিব: আমার লেখালেখির শুরুতে মানে নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকটায় বাজারে চালু খুব কম দৈনিক-সাপ্তাহিকই ছিল, যেখানে আমার লেখা ছাপা হয় নি, এমনকি ছাপা হয়েছে ইনকিলাব-মিল্লাত-জনতায়ও। বিশেষ জাতীয় দিবসগুলোতে আমাকে ও কবিবন্ধু আশরাফ রোকনকে অনেকগুলো করে বিশেষ সংখ্যা কিনতে হতো, যেগুলোয় আমাদের লেখা থাকত। ওসবে লিখতে লিখতে কয়েক বছরে এমনকি আমরা এ-ও বুঝে গিয়েছিলাম যে, কোন পত্রিকার জন্য কোন ধাঁচের লেখা পাঠালে ছাপা প্রায়-নিশ্চিত! এর বছর কয়েক পরে আমি সংবাদপত্রে লেখা পুরোপুরি বন্ধ করে দেই। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমার এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের নেপথ্যে কবিবন্ধু আশিক আকবরের একটা স্পষ্ট প্রভাব ছিল।

তারও অনেক পরে ২০০৭-এর শেষদিকে আমি ব্লগে লিখতে শুরু করি, সামহ্যোয়ারইন থেকে। ক্রমশ সচলায়তন, মুক্তাঙ্গন-নির্মাণ ও আমারব্লগে যুক্ত হই। এর পর থেকে বছরকয় ধরে যত ব্লগ কার্যক্রম শুরু করেছে, তার প্রায় সবকটিতেই আমন্ত্রিত হয়ে নিবন্ধন করি ও কমবেশি লিখতে শুরু করি; প্রথমআলোব্লগ, বিডিনিউজব্লগ, এমনকি পেচালিতেও।

প্রথমআলোব্লগ যে প্রথম আলো পত্রিকারই একটি কনসার্ন, এ ব্যাপারে আবছা একটা ধারণা থাকলেও দৈনিকের উৎকট খবরদারি এখানে থাকবে না বলেই ধারণা জন্মেছিল। ব্লগ আর পত্রিকার পার্থক্যটা আমার কাছে লেখকের স্বাধীনতাপ্রশ্নেই বেশি ধরা দেয়। প্রথমআলোব্লগেও স্বাধীনতা ছিল, তবু ওর প্রাতিষ্ঠানিক গন্ধটা কিছুদিনেই খানিকটা টের পেতে শুরু করি ও লেখা বন্ধ করে দেই। সব মিলিয়ে ওখানে খুব কম লেখাই পোস্ট করেছি এবং যেগুলো করেছি সেগুলোও আগে অন্যত্র প্রকাশিত। পরে অবশ্য সময়াভাব ও অন্যান্য কিছু কারণে কোনো ব্লগেই আর নিয়মিত লেখা হয় নি আমার। এখন তো ফেসবুক সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে, ব্লগে যাবার আর বিশেষ দরকারও বোধ হয় না। তবে অধুনা লেখা ছাপবার আগ্রহই অবিশ্বাস্যরকম কমে গেছে আমার। এখন আমার লেখা কেবল লিখে ফেলাতেই আনন্দ!

দুপুর: দৈনিক পত্রিকায় না লিখার ব্যাপারে আপনার যুক্তিগুলো কী?

মুজিব: এর পেছনে অনেক অনেক কারণ আছে। কয়েকটা বলা যাক :

প্রশ্নটা দৈনিকের নয়, সংবাদপত্রের। সংবাদপত্র, তা দৈনিক-সাপ্তাহিক-পাক্ষিক-মাসিক যাই হোক, প্রধানত সংবাদের জন্যই প্রকল্পিত। সাহিত্য ওর সঙ্গে খুব মানানসই ব্যাপার নয়। একটা খুন-ধর্ষণের সংবাদ পাঠের জন্য যে প্রস্তুতি দরকার, একটা কবিতা পাঠের প্রস্তুতি তেমন না, যদি তা খুন-ধর্ষণ বিষয়ক কবিতা হয়, তাহলেও না।

  • অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাময়িকী সম্পাদকগণ কবিতাকে ফিলার আইটেম হিসেবে ব্যবহার করেন।
  • কবির মনে খটখটে মহাচৈত্র্য বহমান যে সময়ে, সে সময়েও ওঁরা কবিকে দিয়ে বর্ষার কবিতা লিখিয়ে নেন বা নেবার চেষ্টা করেন।
  • মানসম্পন্ন হলেও যেকোনোরকম বিষয়ে যেকোনোরকম লেখা এঁরা ছাপতে পারেন না। কোনো কোনো শব্দ, বাক্য ও বিষয়ে ওঁদের অ্যালার্জি ও রিজার্ভেশন থাকে।
  • প্রতিটি সংবাদপত্রই একটা রাজনৈতিক মতাদর্শ লালন করে এবং কোনো-কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের (মালিকপক্ষ ও করপোরেট বিজ্ঞাপনদাতা) স্বার্থের দেখভাল করে, ওই নির্দিষ্ট রাজনীতি ও ব্যবসায়ী মহলের স্বার্থ বিঘ্নিত হয় এমন কোনো সাহিত্যকর্ম ওঁরা ছাপতে পারেন না।
  • সাময়িকী সম্পাদকগণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকতে চান ও থাকেন। লেখা ছাপা না-ছাপার সিদ্ধান্ত নেন মনগড়া উপায়ে।
  • সংবাদপত্রে লিখলে সাময়িকী সম্পাদকের ফালতু লেখাকেও ভালো বলতে হয় ও তাঁদের তোষামোদি করতে হয়। সর্বোপরি এতে লেখকের কলমের কাঁধে একটা বড়ো পাথর চেপে বসে।
  • সংবাদপত্রের স্থায়িত্ব একদিন বলে এখানকার সৃজনশীল লেখার পাঠস্থায়িত্বও খুব কম হয়।
  • এখানে লিখলে লেখার জন্য কমবেশি সম্মানী দেওয়া হয়, তাতে টাকা উপার্জনের প্রয়োজনেও লেখা ছাপবার আগ্রহ তৈরি হতে থাকে। এতে নিশ্চিত লেখার মান পড়ে যায়।
  • পরিচিতি অনেক বেড়ে যায়। কার্যত লেখায় বীর্য থাকুক বা না-থাকুক, মানে লেখা হোক বা না-হোক, সংবাদপত্রে নিয়মিত লেখা ছাপা হতে থাকলে কিছু মানুষ ওই লেখককে বড়ো লেখক মনে করতে থাকে। ছোটর মধ্যে বড়োর গ্ল্যামার ভর করলে লেখার ক্ষতি হয়।
  • সংবাদপত্রের পাঠকদের একটা বৃহদাংশ সাহিত্য পড়েন না; যাঁরা পড়বার কথা তাঁদেরও একটা অংশ মাত্র মন দিয়ে পুরোটা পড়েন, বাকিরা শুধু লেখকের নাম পড়েন। কখনো সাক্ষাৎ হলে সরাসরি, না-হলে ফোনে বলেন, আপনার একটা লেখা দেখলাম অমুক কাগজে।
  • সর্বোপরি, লেখা নিয়ে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবার জায়গা সংবাদপত্রের সাহিত্য সাময়িকী নয়।

দুপুর: লিটলম্যাগকে ইদানিং বলা হয় দৈনিকে যাওয়ার সিঁড়ি। এ বিষয়ে আপনার মত কী?

মুজিব: কারো কারো ক্ষেত্রে সেটা ঠিকই আছে। অনেককেই আমরা সেরকম করতে দেখেছি। এ বিষয়ে আমি খুব উদার মনোভাবাপন্ন। আমি মনে করি, লেখক যতক্ষণ পর্যন্ত স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারেন, সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, লিখতে পারেন, ততক্ষণই তিনি প্রকৃত লেখক থাকতে পারেন। কোনো লিটলম্যাগ সম্পাদকও যখন লেখকের স্বাধীনতাকে হরণ করতে শুরু করেন, তাঁকে নানাভাবে ব্যবহার করতে শুরু করেন, তখন তাঁর থেকে মুক্ত হওয়াও লেখকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এরকম লিটলম্যাগ, সংবাদপত্রের চেয়েও খারাপ। এ ধরনের লিটলম্যাগ লেখককে রীতিমতো বনসাই বানিয়ে ফেলে। এরকম পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে লেখক যদি অপেক্ষাকৃত গোঁড়ামিমুক্ত লিটলম্যাগ বা সংবাদপত্রে লিখে শ্বাস ফেলবার আনন্দ পান, তবে তাঁর সেটা করাই সংগত।

কেউ একজন লেখা ছেড়ে দেবেন নাকি লিখবেন, লিখলে কোথায় লিখবেন সে সিদ্ধান্ত কেবল তাঁর একার। আমি তাঁর ওই সিদ্ধান্তকে কেবল পছন্দ বা অপছন্দ করতে পারি, কিন্তু লেখা ভালো হলেও কেবল এই অভিযোগে তাঁর লেখাকে বাতিল আখ্যা দিতে পারি না, কিছুতেই না।

দুপুর: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন এবং কেন?

মুজিব: আমার সমসাময়িক কবিতাকর্মীদের মধ্যে অনেকের কবিতাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু প্রশ্নের একটা লেজও আছে, মানে কেবল নাম বললেই হবে না, কারণও বলতে হবে, সেজন্য মাত্র মজনু শাহ্ ও মাহবুব কবিরের কথাই এখানে বলতে চাই।

মজনু শাহ্ দেখতে দেখতে আমাদের সময়ের কবিতায় অত্যাশ্চর্য সব চিত্রকল্প নির্মাণের সমীহজাগানিয়া এক মাস্টার (জেব্রামাস্টার নয়) হয়ে উঠেছেন। তাঁর হাতে শব্দ নব ও দূরজীবন লাভ করে, আপাত অসংলগ্নতার ঘেরাটোপে বন্দি শব্দেরা জাত-পরিচয় খুইয়ে নতুন করে জেগে ওঠে। এর ভিতর দিয়ে কবিতা এমন এক অবস্থানে উন্নীত হয়, শব্দেরা সাধারণত যেসব স্থান ভ্রমণে অভ্যস্ত নয়। কাব্যালংকারসম্ভূত অর্জনের সুবাদে তিনি প্রধানত কবিদের কবি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। এ কারণে আশঙ্কা হয়, কবিতাকর্মী নন এমন পাঠকের কাছে কখনো তাঁর কবিতা অপ্রয়োজনীয় ও দূরধিগম্য বলে বিবেচিত হলেও হতে পারে!

মাহবুব কবিরের কবিতা সাধারণ পাঠকের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ সংযোগ রক্ষা করে চলবার যোগ্যতাসম্পন্ন। মাহবুব দূরধিগম্য কোনো ইমেজ তৈরি করবার কোশেশ করেন না। পরিপার্শ্বের পরিচিত ও সহজলভ্য সব উপাদানকে পাশাপাশি স্থাপন করে মাহবুব তাঁর কবিতায় এক বা একাধিক এমন ইংগিত নির্মাণ করেন, যা মনোযোগী পাঠককে ভাবায় ও নাচিয়ে দেয়। এসব কোনো এক পরাকালের কবিতা নয়, বরং সর্বকালের। কবিতা জাগতিকতা ও মানবিকতাকে কীভাবে আনুকূল্য দেয় বা দিতে পারে, তাঁর সাম্প্রতিক সব বেসরকারি কবিতার শরীরজুড়ে সে জবাব মূর্ত হয়ে আছে।

আমার পাঠকসত্তা এই দুজনের আগামী সব কাব্যকর্মের প্রতিও আগ্রহে উদগ্রীব।

দুপুর: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনি বাজে কবিতা বলে মনে করেন এবং কেন?

মুজিব: সব কালেই বিপুলসংখ্যক কবিতাকর্মী থাকেন, যাঁদের লেখা মোটেই কবিতা না হয়ে উঠলেও নানা কারণে তাঁদের একটা কবি পরিচিতি জুটে যায়। এঁদের কারো নাম বলাকে আপাতত স্বাস্থ্যকর ভাবছি না আমি। কাব্যরুচি যেহেতু মানুষে মানুষে ভিন্ন, বাজে কবিতা লেখকের তালিকাও পাঠকভেদে ভিন্ন হতে বাধ্য। পাঠকগণ এটা তাঁর তাঁর মতো করে বুঝে নিতে পারেন ও নেন। সুতরাং সেরকম চেষ্টা আমি করব না। তবে এ তালিকার একটা নাম বলবার সাহস আমি এখানে করব, যেটা অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ। মোটেই ঠাট্টা নয়, আমার সময়ে আমার নিজের কবিতাকেই আমি সবচেয়ে বাজে বলে মনে করি। কারণ আমি কবিতাকে যেরকমভাবে পেতে চাই, আমার কবিতা আজো সেরকমটা হয়ে উঠছে না। কখনো হয়ে উঠবে কি না তা-ও আমি জানি না।

জুন ২০১২