মৌমিতা ঘোষের স্মৃতিকথা

Post date: Dec 22, 2014 5:23:21 PM

দেখতে দেখতে ছত্রিশ বছর পার করে ফেললাম, বয়স বাড়ছে তখনই বুঝবেন যখন কথা বলতে গেলেই স্মৃতিচারণে চলে যাবেন। এরকমভাবেই বয়স বাড়তে বাড়তে এক সময় গোটা জীবনটা শুধুই স্মৃতিচারণে এসে দাঁড়ায়। আসলে আর তো নতুন গল্প তৈরি হয় না। আমি সে অবস্থায় না পৌঁছলেও আজকাল বেশ বুঝতে পারি বয়সটা তরতর করে গাছে চড়ছে। বকার কোন লোক নেই যে। আমার এ‌ই পঁয়ত্রিশ পেরোনে বসন্তে বেশ ভালই একটা স্মৃতির ভাঁড়ার জমেছে। জমেছে অনেকগুলো মুহূর্তগোনা রাত, হাসি ছড়ানো দিন।

আজকাল বেশ আমার একটু আধটু নামটাম হয়ছে। সেটা লেখালেখির সূত্রে কিছুটা আর কিছুটা আমার আবৃত্তি সঞ্চালনার ক্ষেত্রে। অবিশ্যি নামি প্রকাশকের দামি লিস্টিতে আমার নাম এখনও জায়গা করে উঠতে পারেনি, তবে নিজস্ব একটা পাঠককূল তো অবশ্যই আছে। আজ যখন পিছন ফিরে তাকাই তখন দেখি এই লেখালেখির শুরুটা হতই না যদি না আমার মা আমার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে আমাদের পাশের পাড়ায় সরকারি সাহায্যে চলা একটি লাইব্রেরি বিবেকানন্দ পাঠাগারে আমার কার্ড করিয়ে দিত। সেখানেই আমার কাছে খুলে যায় এক নতুন জগৎ। খুলে যায় অনেক অচেনা জানালা। জানালা খুলতেই এক খাবলা রোদ এসে পড়ে আমার উপরে। সেই শুরু রোদ দেখে চলা। সুকুমার রায়, লীলা মজুমদার, উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন বলে আমাদের ছোটবেলা এত সুন্দর -সুস্থ ছিল। সুকুমার রায় সে সময় মজা দিতেন শুধু, ধীর ধীরে যত বড় হয়েছি তত স্যাটায়ারটা গভীরভাবে বুঝতে পেরেছি বহু জায়গায়। যখন হ য ব র ল তে আমরা বিচারক পেঁচার কথা পড়েছি পেঁচা চোখে ব্যামো বলে চোখ বুজে থাকে, ছোটবেলার আর বড়বেলার বোঝার মধ্যে ফারাক থেকে যায়- অনেক অ-নে-ক। আমার শৈশব ভরিয়ে দিয়েছেন সুকুমার আর তখন গল্পের বই মানে বুঝতাম লীলা মজুমদার। পত্রিকা বলতে বুঝতাম সন্দেশ, শুকতারা, চাঁদমামা এবং মিলা। শারদীয় সন্দেশ ও আনন্দমেলা বরাবর পূজোর নতুন জামাকাপড়ের মতই প্রিয় ছিল।

একটা মজার ঘটনা বলি, চাঁদমামাতে একটি গল্প পড়েছিলাম যে এক ব্যক্তি সারাজীবন অনেক অন্যায় করেন ও আধ্যাত্মিক বিষয় থেকে অনেক দূরে থেকে বৈষয়িক বিষয়েই ব্যস্ত থাকেন। মারা যাওয়ার সময় খুব কষ্টে জল দেওয়ার জন্য তিনি তার চাকর ‘নারায়ণ’ কে একবার ডাকেন ও ঐ একবার ‘নারায়ণ’ ডাকার জন্য তার স্বর্গপ্রাপ্তি হয়। সেই থেকে অনেক বড় অবধি আমি কারণে-অকারণে মনে মনে ‘নারায়ণ’ উচ্চারণ করতাম। একজনের নাম না বললে ছোটবেলার বর্ষার লোডশেডিং এর রাতগুলো ব্যর্থ হয়ে যাবে। এখন তো লোডশেডিং হয় না। আমাদের ছোটবেলায় বর্ষাকালে লোডশেডিং হয়ে যাওয়া রাতে হারিকেনের চারিদিকে সব ভাইবোনেরা জড়ো হয়ে বসতাম। ঠাকুমা বা দাদু বা দাদা-দিদি কেউ একজন ভূতের গল্প বলত বানিয়ে বানিয়ে। সেই বানিয়ে তোলা আজগুবি গল্পে আলো-আঁধারি আমরা কাটাতাম, গা ছমছম করা ঐ রাতগুলোয়। আমি কোনোদিন বানিয়ে গল্প বলতে পারতাম না। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সহায় ছিলেন আমার। ভূতেদের এত নাম, এত বাহার। শীর্ষেন্দু আমাকে শেখালেন ভূতেদের ভয়ঙ্কর গল্পের পেছনে একটা মজার চেহারা। দুখীভূতও যে হয়, শীর্ষেন্দু না থাকলে জানা হত না। যার নাম না করলে আমার এতবার ‘নারায়ণ’ উচ্চারণ করেও নরকবাস করতে হবে, তিনি ছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী। হর্ষবর্ধনের গল্প পড়ার নেশা এমন ছিল যে প্রচুর ঝামেলায় সম্মুখিন হয়েছি। এমনিতে আমি খুব শান্ত মেয়ে ছিলাম। খুব পোড়ো গোছের। যত গেছোপনা আমার সব বড় হয়ে। একবার বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প পড়তে পড়তে বাড়ি ফেরার কথা ভুলে গেছি বিলকুল। তখন আমি ক্লাস এ বোধহয়, মা খুঁজছে, বাবা খুঁজছে, গোটা পাড়ার লোক খুঁজছে- রেললাইন, পুকুর পাড়, খাল পাড় যেখানে বিপদ হতে পারে সব জায়গা তোলপাড় এরকম একটা সময় অভিজিতের (বন্ধু) মা আমাকে বললো ‘ হে রে, একটা বাজে, খেয়ে যাবি তো?

চমকে উঠে আমি বললাম, না-না। বাড়ি যাব, অনেক দেরি হয়ে গেছে। বেড়িয়ে এক দৌড়। সারা পাড়ার লোকের কাছে সে কি বকুনি। আরে, তোমরা রেললাইন না খুঁজে কিছুটা এগিয়ে অভিজিৎদের বাড়ি খুঁজতে পার নি? জান না ওর বাড়িতে শিবরাম আছেন। ক্লাস ফাইভ-সিক্স থেকে নেশা শুরু হল গোয়েন্দা গল্পের। ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কাকাবাবু, গোগোল, পাণ্ডব গোয়েন্দা, শার্লক হোমস চ্যালা হয়ে কাটলো ৪-৫ টা বছর। কোনো লোক দেখলে তার জুলের কাদা দেখতে শুরু করতাম। মজাটা হল এই সব কিছু থেকে একটা জিনিস ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছিল মগজাস্ত্র বানাতে হবে আর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ‌ই পর্যবেক্ষণ বাড়াতে বাড়াতে এক অন্য জগতের খোঁজ পেলাম রামকিঙ্করের হাত ধরে।

তখন আমি কৈশোরের শেষে, যৌবনের শুরুতে। ‘দেখি নাই ফিরে’ তে সমরেশ বসুর হাত ধরে ফিরে দেখলাম জীবনের সব রঙেদের। প্রথমবার বুঝলাম আলো বদলালে গাছের পাতার সবুজ রঙও সারাদিনে বদলে যায়, আমার কাছে একটা নতুন পৃথিবী খুলে গেলে-যেটায় শুধুই রঙ আর রঙ। ঠিক এমনিভাবেই সম্পর্কের কিছু গূঢ় রহস্য, মানব চরিত্রের অনেকগুলো অচেনা দিক আমার কাছে খুলে গেছিল কুসুমের হাত ধরে। আমার পড়া অসম্ভব প্রিয় উপন্যাস-পুতুল নাচের ইতিকথা। মানিকবাবুতে ডুবে গেছিলাম ক্লাস এইট-নাইনের ঐ সময়, এই সময়টা বিভূতিভূষণ ও তারাশঙ্কর -ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিলেন। আমাদের সময়ে কৈশোরে শঙ্কর হতে চায়নি এমন ছেলে খুব কম ছিল। আজ দেব এর কল্যানে কয়েকজন কিশোর আবার হয়ত শঙ্করের নামটা জানল এই বছরে। এতক্ষণ আপনারা ভাবছেন যে আমি কি বলতে চাইছি? আরে আমার লেখালেখির পেছনে যে এতজন ভগবান আছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি স্মৃতিচারণ করে। সেই দিনটায় আমি কবি হয়েছিলাম যেদিন আমি ভেতরে ভেতরে কুসুম সেজেছিলাম, সেই দিনটা আমার মধ্যে একটা কবিতার জন্ম হয়েছিল-যেদিন রামকিঙ্করের প্রতিমা বানানোর সময়ের অনুভূতি আমার মধ্যে প্রবেশ করেছিল। বিভূতিভূষণের হাত ধরে আমি কিন্নরদলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতাম। এরকম আরো কতজন কাহিনিকার ছিলেন যারা মানুষ চিনিয়েছেন- আকাশ চিনিয়েছেন, প্রকৃতি চিনিয়েছেন। এবার আপনাদের মধ্যে যারা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছেন আপনি না কবি? ‘কোনো কবির নাম মনে এল না’ আরো আরো অনেকদিন লিখব দাদা। আজই সব বলতে হবে কে মাথায় দিব্যি দিয়েছে?