অবিন সেনের স্মৃতিকথা আমার কবিতা জন্ম

Post date: Nov 26, 2014 4:49:42 PM

(আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের ফর্ম বাংলা ভাষায় তেমন চর্চিত নয়। আবার এখানে কিছু কুসংস্কারও রয়েছে। যেমন মনেই করা হয় কেবল বুড়োদের স্মৃতি থাকে। তরুণদের নয়। মানে বুড়ো লেখকরাই আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা লিখবে। তরুণরা এটা লিখবে না। কিন্তু এটা তো জাস্ট একটা সাহিত্যের ফর্ম। যে কোন সময় যে কোন বয়সে যে কেউ- এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লিখতে পারে।

এবার আমার টার্গেট এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেওয়া। এখন থেকে অলস দুপুর ওয়েব ম্যাগাজিনে যে কোনও বয়সের যে কোনও লেখকের স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী ছাপা হবে। অলস দুপুর ওয়েবম্যাগে সকলের স্মৃতিকথা লেখার আহ্বান জানাচ্ছি। স্মৃতিকথা লেখার ভেতর দিয়ে মিথ্যা বা ভুয়ো আত্মজীবনী লেখার জায়গাটাও কমে আসবে।

আসুন আমরা স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেই।-দুপুর মিত্র)

প্রথম পর্ব

মাঝে মাঝে মনে হয়েছে সারা পৃথিবী একটি ফসলের মাঠ আর সেই মাঠ আদিম কাল থেকে ভরে আছে অগণন কবিতার গাছে, তা বৃক্ষ-লতা-গুল্ম-ফুল; সেই বিপুল বাগিচায় আমি আশ্চর্য হয়ে বেঁচে আছি। চারি দিকে নিশ্বাস উড়ে মরছে মানুষের, বাগানে ঝরে আছে নারকেলের মুচি, বেগুনের ক্ষেতে কাকতাড়ুয়া-তাদের দিকে তাকিয়ে থেকেছি কখনো আমার ভিতর এক পিপাসা বেড়ে উঠেছে,হয়ত কখনো সে পিপাসার কোনো ভাষা নেই—মাধ্যাকর্ষণ নেই, মনে হয়েছে চার পাশে চরাচরে সব ভেসে আছে, আমি কেবল সেই ভাসমান পৃথিবীর ভিতর কোথাও লটকে আছি..লটকে থাকবার উপলব্ধি হয়ে বেঁচে আছি। সেই কি কবিতা? সব মানুষই বোধ হয় হঠাৎ কোনো একদিন কবিতা লেখে কিংবা মানুষের জন্মের সাথে সাথে কবিতা পায়ে পায়ে পথ হাঁটে আর কোনো এক অলৌকিক মুহূর্তে সে কবিতা ভাষা পায় কারো কারো হাতে’কবিতার আত্মপ্রকাশ ঘটে। এমনি কোনো এক মুহূর্তেই বোধ হয় আমার প্রথম কবিতাটি লেখা হয়’ হয়ত বা..তা আজ আর মনে নেই..অনেকেরই হয়ত মনে থাকে না বা মনে থাকার কোনো অবকাশ গুঁড়ি মেরে অপেক্ষায় বসে থাকে না। কিন্তু স্কুলে পড়া বয়স থেকেই কবিতা আমাকে যারপরনাই অবাক করেছে, মনে হয়েছে আমি সেই কবিতার মাঠে কাকতাড়ুয়ার মতো অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছি। লেখা পড়া ফেলে খাতা কলম নিয়ে বসে আকাশ পাতাল ভেবেছি..ছিপুড়েদের মতো ছিপ ফেলে ঠায় বসে থেকেছি..কখন ফাতনায় টান দেয় আর আশ্চর্য নিঃসঙ্গতায় কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু কোনোদিনই ভাবিনি কবিতা লিখে একদিন কেউকেটা হব..কোথাও কবিতা ছাপিয়ে ধন্য হব ! শুধু কবিতার জন্য এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমার রক্তের ভিতর দ্রবীভূত হয়ে গিয়েছে..সেটা বেড়ে বেড়ে এক অলৌকিক ভালো-বাসাবাসির দিকে অন্তহীন হয়ে গিয়েছে। হ্যাঁ শুধু কবিতার জন্য..কেবল কবিতার জন্যই লেখা পড়ায় ফাঁকি দিতে আমার কোনোদিন এতটুকু অনুশোচনা হয়নি..মনে হয়নি পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করলে ভালো চাকরি বাকরি পাবনা বা ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো কিছু না ভাবার সচ্ছল পাগলামি করে গিয়েছি অনবরত। তবু কবিতা লিখে টিখে এক দিন কিছু নাম টাম হবে তা কি ভাবিনি ? ভেবেছি, নিশ্চয়ই ভেবেছি আর ব্যথা পেয়েছি। কারণ সেটা একদিন আমার কবিতার প্রতি গণিকা গমনের মতো আচরণ বলে মনে হয়েছে অর্থাৎ ভালোবাসা-হীন সহবাস। সেটা আসলে কবিতার প্রতি অবিচার। তবু ভালোবাসা থাকে বলেই তো কখনো কখনো ভালোবাসার প্রতি অবিচার হয়..আমাদের মনের ভিতর যে মগজ সে এক ভালোবাসার নামে স্যাডিজিমের দোকান খুলে বসে।

এই যে ফলাও করে বললাম চার পাশে কবিতার গাছ বেড়ে উঠেছে আমাকে ঘিরে রেখেছে তবু কটি কবিতারই বা ভাষা পেয়েছে? সময় সময় সময় চলে যায়। দিনের পর দিন চলে যায় । জয়েন্ট এন্ট্রান্স এর রেজাল্ট খারাপ হয়ে যায় তবু কটা কবিতা লিখেছি..আর যা লিখেছি তা কেবল ছাই ভস্ম। সিগারেটের মতো অ্যাসট্রেটে পিষে দিয়েছি। কবিতাকে। যৌনতার মতো মগজে তাকে চন্দন চর্চিত করেছি। দু একটা কবিতা বন্ধুরা তাদের ছোটো পত্রিকার জন্য ঘাড় ধরে লিখিয়ে নিয়েছে। ছাপিয়েছে। না হলে আমার কোনো কবিতাই কোথাও ছাপা হতো না। আর মাঝে মাঝে কিছু কবিতা অর্কুট এর বন্ধুরা পড়েছেন। আমার কাছে তারাই বোধ হয় সেই সব কবিতার গাছ..নারকেলের মুচি ঝরিয়েছেন বাগান জুড়ে..আমাকে কবিতা লিখিয়েছেন....নতুবা নালেখা অজস্র কবিতা আমাকে নিঃসঙ্গ থেকে আরো নিঃসঙ্গ করে তুলত।

আমার কবিতা চির দিনই কোনো ফর্ম বিহীন..যখন যে ভাবে মনে হয়েছে তখন সে ভাবে লিখেছি..গায়ের জোরে কোনো স্টাইল দেখাবার চেষ্টা করিনি—বা সে গায়ের জোর ও আমার কোনো দিন হয়নি। আমার কাছে কবিতা মানে—কলাবাগানে এই মাত্র যে শালিকটি এসে বসল তার মতো অতি সরল বা অতি স্বাভাবিক। অবশ্য আমার বেশির ভাগ কবিতাই আত্মজৈবনিক অর্থাৎ এ যাবত আমি মাত্র একটি কবিতাই লিখেছি...মাত্র নিজের একটি কবিতা...নানা ভাবে নানা রূপে। বলা যায় আমার কবিতা অজস্র আমি হয়ে খণ্ড খণ্ড হয়ে চারি দিকে উত্তরে দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিমে ছড়িয়ে গিয়েছে....বস্তুত কবিতার নামে আমি কেবল আত্মজীবনের টুকরো টুকরো কিছু মুহূর্ত লিখে চলেছি...

“ভিখিরি বাচ্চার মতো হাঁটি আমি—

এভাবেই হাঁটে মানুষ—শিরদাঁড়া বেঁকে গেলে—

এভাবেই—বসন্ত বাতাসে খসে যায় সব সুখের পালক—

নিশ্চুপ ছাত জুড়ে—পড়ে থাকে শুধু ঘর বাড়ি—স্মৃতি—

কাঁটাতার—সময়ের দূরত্ব মেপে হৃদয় পরবাস—“ ......(পরবাস)

তবু আত্মজীবন তো আর আত্মজীবনের ভিতর বন্ধ হয়ে নেই, সে ছড়িয়ে আছে চরাচর জুড়ে খণ্ড খণ্ড হয়ে, সেই চারপাশের দ্রবীভূত পৃথিবীর ভিতরে আমি শুধু আমার মতো কবিতার ভাষা খুঁজে ফিরেছি..একটা লাইনের পর আর একটা লাইন খুঁজে ফিরেছি। অনেকে বলেন কবিতার জন্য কবিতা শিক্ষা প্রয়োজন, কবিতা মেধার প্রয়োজন। আমার কোনো কবিতা মেধা নেই। প্রতিদিন বেঁচে থাকার জন্যে প্রতিদিন যে নিঃসঙ্গ ভাবে আমরা ক্ষয়ে চলেছি, আমার কবিতা এই প্রতিটা দিনের ক্ষয়ে যাবার ভাষা। সেই ভাষার কোনো আদর্শবানী শোনাবার প্রয়োজন নেই, সেই কবিতার কোনো দার্শনিকতার প্রয়োজন নেই—কিংবা নাই পথপ্রদর্শনের..কেবল একটা দিনের পর আর একটা দিনের স্তব্ধতা সাজিয়ে নিয়েছি, সাজিয়ে নিয়ে দেখছি কোনোদিন বাড়ির কাছের নিঃসঙ্গ কানা নদীটা কেমন ঘুমিয়ে আছে, তার উপর ফুলের মতো জ্যোৎস্না ঝরে পড়ছে। অনেকে বলেন আমার লেখা ঘোরতরও মফস্থলী..আসলে গ্রাম গঞ্জের রাতের মতো আমি স্তব্ধতা বিলাস করি। স্তব্ধতা, নিস্তব্ধতা আমাকে কবিতার শয্যা-সঙ্গী করে। কোলাহলে আমি হাঁপিয়ে পড়ি, মনে হয় কোলাহল আমার চারপাশের দরজা জানালা গুলোকে বন্ধ করে দেয়। আমার কাছে কবিতা এক জ্যোৎস্না রাতের মতো। এক রাতের পাখি আমার জানালার কাছে এসে বসে থাকে, আমার সাথে স্বপ্ন বিনিময় করে। একের স্বপ্নের ভিতর আর একজন ঢুকে বসে থাকি..যেন একটা ভার হীন শুন্য প্রান্তরের ভিতর কিংবা প্রান্তরের আলের উপর বসে থাকি,ইচ্ছা হলে কবিতার প্রান্তর থেকে দু-একটা ফসল কেটে নেবো, অথবা কিছুই নেবো না, শুধু বসে থাকা ছাড়া...সেটাই সত্যি..’নাই বা নিলাম কিছু’। আসলে কবিতা নিলামের বাজারে দর হাঁকবার জিনিস নয় যে দু-চার হাজার টাকায় তাকে কিনা নেবো।

অনেকে বলেন কবিতা আসলে অভ্যাস। আমার কোনো অভ্যাস নেই কবিতা বিষয়ে। আমি শুধু মনে মনে একটি নদীর কাছে গিয়ে বসে থেকেছি, দেখেছি জল বইছে আর বইছে..নদীর কাছে গাছের থেকে বুড়ো পাতাগুলো ঝরছে আর ঝরছে, আমি শুধু আলোর নদীর কাছে বসে থেকেছি...মাসের পর মাস, কোনো কবিতা লিখিনা, আমার প্রতিটা কবিতাই মাস পয়লা। তাই কোনো কালেই ফরমায়েশি কবিতা আমি লিখিনা। প্রতিটা কবিতাই আমার প্রথম কবিতা। এই ব্যাপারে ভাস্কর চক্রবর্তী আমার আদর্শ। আর জীবনানন্দকে আমি মাথার পাশে নিয়ে শুয়েছি।

আমি কোনোদিন ইরাক যুদ্ধের কবিতা লিখিনি...লিখিনি নন্দীগ্রামের কবিতা..আমার কবিতা আমার পাশের বাড়ির বৃদ্ধা পিসিমার দীর্ঘশ্বাস..কিংবা সন্তানহীন সেজোকাকিমার ছোটো ছোটো টুকরোময় জীবন..আমি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ফুটপাথের শিশুদের ভাত খাওয়া দেখি...আমার কবিতা হয়ে তারা রাস্তায় কাগজ কুড়িয়ে বেড়ায়। যে ছেলেটি চায়ের দোকানে কাপ ডিস ধোয় তার কথা আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে..ইচ্ছা করে তার জন্যে এক রাত জেগে দু-চার লাইন লিখি..

দ্বিতীয় পর্ব

কবিতা কি? কবিতার ভাষা কেমন হবে বা কবিতার কি নিজস্ব কোনো ভাষা আছে..এইসব চুল চেরা বিশ্লেষণ চলেছে একদিন কিন্তু একটি লাইন থেকে যখন একটি কবিতা জন্ম নেয় সে কোনো বিমূর্ত ভাষা দাবি করে না সে দাবি করে সম্যক স্বাধীনতা যেমন ছোট্ট চারাগাছ রোদ্দুরের দিকে মেলে দিচ্ছে তার সমস্ত অভীপ্সার পাতাগুলি। কিন্তু এ কি বানিয়া বললাম? এ কি বই পড়ে শেখা ? গড়ের পিছন থেকে ডুবন্ত সূর্য আমার কাঁধে এসে হাত রেখেছে আর মুচকি হেসে এই সব মেকি কথা আমাকে বলে গিয়েছে ? আমি বিস্মিত হয়ে পড়ি এবং কখনই এসব কবিতা লেখার ভাবনা বলে মনে হয় না আমার। যখনি কবিতার কাছে গিয়ে ভাবনার উপর কোনো ভাষা চাপিয়ে দিয়েছি তখনি তা চালাকি বলে মনে হয়েছে, কবিতা কখনই এই চালাকির সীমারেখা সমর্থন করে না। মাজে মাঝে আমার সে ভুল হয়ে যায় । কেউ কেউ বলেন এই লেখাটি আধুনিক না..এই লেখার মধ্যে কোনো কবিতার নতুন ভাষার জন্ম হয়নি, বস্তুত আমার মনে হয় জীবনানন্দের পরে বাংলা ভাষায় আর কোনো নতুন কাব্য ভাষার জন্ম হয়নি, আসলে জীবনানন্দের প্যাশন সেটা দাবি করেছে তাই সে ভাষার জন্ম হয়েছে..সেটা তিনি গায়ের জোরে চাপিয়ে দেন নি।

প্রথম দিকে আমার কবিতা জুড়ে ছিলো প্রকৃতি । মূক শান্ত চরাচর চিরকালই ভাষা হয়ে প্রতিভাত হয়েছে আমার কাছে আসলে আমি হচ্ছি বোবা প্রকৃতির কথাবলা পুতুল। আমার তাই মনে হয়। পুতুলের মতো সহজ ও সাধারণ দাবি নিয়ে আমি কবিতার কাছে গিয়ে বসেছি। বসেই থেকেছি। আমার রাত হয়ে গিয়েছে। রাতের বেলা কবিতা আমার দরজায় কড়া নেড়েছে, আমি আমার সরু সাধারন হাতে দরজা খুলে দিয়েছি—আর আলগোছে ধরে থেকেছি কবিতার অলৌকিক হাত। আস্তে আস্তে আমার ভিতর দু-এক লাইন জন্ম নিয়েছে..। মনে হয়েছে যে কোনো একটা লাইন থেকেই কবিতা জন্ম নিতে পারে, সে বড় সহজ একটা লাইন। কিন্তু তারপর? কবিতার কাঠামো কি হবে? এই ব্যাপারে কোনো শিক্ষণ-বিশী নেই আমার। আমি অকারণে দেখেছি একটা লাইনের পরে আর একটা লাইন ঠিক সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে তার পরে আর একটা লাইনের দিকে আমি ভোরবেলার ট্রামের মতো মন্থর পায়ে হেঁটে গিয়েছি। তার পরে এক সময় এসে মনে হয়েছে আমার সেই হাঁটা শেষ হয়েছে, কিন্তু হাঁটা কখনো শেষ হয় না কবিতার। বস্তুত কবিতার শেষ লাইন বলে কিছু নেই ; আবার যে কোনো লাইনই কবিতার কোনো এক শেষ লাইন হতে পারে। এমনকি আমার মৃত্যুর পরেও আমার কবিতা হেটে যেতে পারে বলে মনে হয়। মৃত্যুই কি এক মাত্র শেষ? আমি আর আমার কবিতা যেন দুটি সমান্তরাল সরলরেখা। এক দিন আমরা পরস্পর মিলিত হব এই প্রত্যাশা নিয়ে আমরা অনবরত হেঁটে চলেছি, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মিলন কখনই সম্ভব নয়। আমার কবিতা লেখা এমনই। যেন অনিঃশেষ এমনি হেটে যেতে পারি। কিন্তু এর মধ্যে কোনো ত্বরা নেই। কারণ আমি তো কোনো জ্যাকপট জিতব না।

প্রথম দিককার প্রকৃতি প্রকৃতি আর প্রকৃতি পেরিয়ে একদিন দেখেছি প্রকৃতি আসলে মানুষেরই খণ্ড খণ্ড প্রচ্ছায়া চারিদিকে লগ্ন হয় আছে। লগ্ন হয়ে থাকার অভিনয় হয়ে আছে। তাদের অভিনয়ের ভিতর আমি নিদারুণ নিঃসঙ্গ হয়ে আছি। কবিতা আমাকে অনবরত এক ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গতা উপহার দিয়েছে। হ্যাঁ, আমি তাকে উপহারই বলি। একটা উপহারের অন্ধকার রাত্রি যেন অলৌকিক হাজারো তারার মৃদু আলোর অপেক্ষা হয়ে আছে। এই বুঝি সে টুকরো টুকরো আলোর পাখি আমার কপালে চুমা হয়ে নেমে আসবে । আমি তার নেমে আসার অপেক্ষা করি। আমার কবিতা এমনই। মনে হয়েছে আমি বুঝি এই অলৌকিক আশ্চর্য তারাদের ভিড়ে পথ হারিয়ে বসেছি—ঘর বাড়ি পৃথিবী তখন শূন্য মনে হয়..শূন্য মনে হয় বলে তারা আরো রহস্য ময় হয়ে যায়। কবিতার তুল্য রহস্যময় আর কিছু নেই। সেই বিপুল রহস্যের ভিড়ে আমি একটি জোনাকির মতো উড়ে উড়ে বেড়াই। আমার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। মানুষ কোনোদিন এ আকাঙ্ক্ষার, এ কবিতার রহস্য ভেদ করতে পারবে না। কারণ রহস্য বদলে বদলে যায়। মানুষ বদলে বদলে যায়। মানুষের জীবন ধারা বদলে বদলে যায়।

“তোমাকে জানব বলে

এই মেঘ—বৃষ্টি—রোদ—

প্রান্তরে রেখে যাওয়া হাঁসের শাদা

পালকের স্মৃতি—

গলাধঃকরণে—ক্রমশ তা গভীর

আস্বাদ এক – যেন

নির্জন নীড়

তার নীলাভ বন্দরে

বিলি কাটে হাওয়া

আঙুলে—বেতের বনে—

ছড়িয়ে রাখে স্খলিত

তারাদের ভ্রূণ

শস্যের ক্ষেতে---আকাঙ্ক্ষায়—

বসন্ত জোনাকি হয়—“ (অজানা)

এই যে এতো যে কবিতা কবিতা আর কবিতা। কবিতার জন্য অঢেল সময় আমি বইয়ে দিয়েছি। কবিতা লেখার অঢেল সময়কে আমি অবহেলা করেছি। যেটা লেখার ছিলো সেটা আমি লিখিনি। লেখার সময় ছিলো না যে তা নয়, লেখার ইচ্ছা যে ছিলো না তা নয়। কিন্তু আমি লিখিনি নিজের প্রতি এক আশ্চর্য স্যাডিজিম থেকে। কোনো কোনো সময় কবিতা না লিখেও আমি কবিতা লেখার মতো কষ্ট পেয়েছি...কষ্টের আনন্দ পেয়েছি, আশ্চর্য নিঃসঙ্গতা পেয়েছি। দেখেছি নীলিমায় যেন একটা শাদা হাস উড়ে চলে যাচ্ছে, একটি শাদা আলোর হাঁস—আমার কবিতা।

“শীতের ঝিম রোদ্দুর....................

পিঠে বিছিয়ে নিয়ে সাড়ে সাত মাইল এক ঝিল শুয়ে আছে,

.................সেই বিয়োবার সময়ের রোদ্দুরে এক ঝাঁক হাঁস

নুয়ে নুয়ে জলের সাথে মস্করা করে....

তাদের বুড়ো পালক চার পাশে ছড়িয়ে দিয়ে তারা যেন...

বয়সের বেড়া ডিঙতে চায়” (নির্মলা-১)

আমি দেখেছি কবিতা আমার কাছে সাধারণের থেকে সাধারণতা দাবি করেছে। আমাদের রোজকার তুচ্ছ তুচ্ছ কথা, ঘটনা, বেদনা, স্মৃতি। সবথেকে বেশি আমি বিষণ্ণতার কাছে গিয়ে বসেছি..হেসে তার ভালো মন্দ জানতে চেয়েছি। আমি পাশের বাড়ির অসুস্থ ছেলেটির জন্য বা মেয়েটির জন্য একটা কাগজের উড়োজাহাজ তৈরি করেছি আর বসে থেকেছি । তার পর বাতাস এলে সেটিকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছি। ছেলে বেলায় আমরা তালপাতা দিয়ে পাখা বানাতাম তারপর সেটিকে খেজুর কাঁটায় বিঁধে হা্‌ওয়ার দিকে মুখ করে দাঁড়াতাম। সেটি কেমন আহ্লাদে ঘুরতে থাকতো। আমি জীবনের রোজনামচার পাখা বানিয়ে কবিতার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি। কবিতার সহস্র মুখ থেকে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। আমার কবিতাময় নালেখা কবিতাদিন প্রদর্শনী হয়ে আছে।