উত্তরাধুনিকতার নামে পরাবাস্তব পরাবাস্তব জিকির করে চলেছে বাংলা কবিতা: পলিয়ার ওয়াহিদের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jan 7, 2014 10:10:19 AM

(দুপুর মিত্রকে ভালো করে চিনি না। কখনো কথা হয়নি। মুখোমুখি হবার ফুসরতও পায়নি। অবশ্যই তিনি একজন কবি আমিও একটুআধটু লিখি। সে সুবাদে একে অন্যের পরিচয়। তিনি আমাকে ফেসবুকে ম্যাসেজ দিয়ে জানান, একটা অনলাইন সাক্ষাৎকার দিতে হবে। আমি বুঝিনি বলে পাল্টা একটা সংবাদ চেলে দিই। তারপর উনি আমাকে অনেকগুলো কবিতাবিষয়ক প্রশ্ন পাঠিয়ে উত্তর করার জন্যে তাগেদা দেন। আমি সত্যি কবি নই। তবু কবিতার তাড়নায় না লিখে পারলাম না। পাঠক ভুল হলে ক্ষমা করবেন। ধন্যবাদ অলস দুপুর এর সম্পাদক কবি দুপুর মিত্রকে। এই নাদান কবির সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্যে নয় কবি হিসিবে গণ্য করার জন্যে। )

অলস দুপুর : লিটলম্যাগের সাথে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার সম্পর্ক থাকতেই হয় বলে মনে করেন কি? হলে কেন?

পলিয়ার ওয়াহিদ : না। কারণ যারা লিটলম্যাগ করেন তারা নিজেরাই জানেন না লিটলম্যাগই নিজেই একটা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠান বলতে আসলে তারা কি বোঝান তা আমি বুঝি না। আর প্রতিষ্ঠান বলতে তারা যা বোঝান তা হলে এ্যাড নেন কেন? আর এ্যাড মানে তো কোন না কোন প্রতিষ্ঠানের ধন্না দেয়া। আর এ্যাড ছাড়া বাঙলাদেশে কেন লিটলম্যাগ দাড়াতে পেরেছে এমন কোন নজীর বোধ হয় সাহিত্য ইতিহাসে নেই।

অলস দুপুর : আপনার কাছে কবি হয়ে ওঠা বিষয়টা কি?

পলিয়ার ওয়াহিদ : এটা পুরোটাই প্রাকৃতিক। এটা ইচ্ছের ব্যাপার না। জোর করে কেউ মহান কিছু হতে পারেন কিন্তু কবি হতে পারেন না। এটা সম্ভবও না।

অলস দুপুর : কবিতা কি?

পলিয়ার ওয়াহিদ : কবিতার কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। কবিতা আসলে আলো-আঁধারীর খেলা। খানিকটা যাদু রহস্যের মতো। কবিতা তাই যা বোঝা যায় ঠিক বোঝানো যায় না। কবিতা কখনো স্লোগান, কখনো উপমা, কখনো বিদ্রোহী কিংবা বিপ্লবী বাণী। কবিতা আসলে সত্য ও সুন্দরের গীতি-গাঁথা। মোটকথা কবিতা মানুষের জন্যে মানুষের মুক্তির মানুষের গান।

অলস দুপুর : সমসাময়িক বাংলা কবিতার প্রবণতাগুলো কি?

পলিয়ার ওয়াহিদ : উত্তরাধুনিকতার নামে পরাবাস্তব পরাবাস্তব জিকির করে চলেছে বাংলা কবিতা। খানিকটা শিকড় ভুলে যাবার মতো অবস্থা। খামাখা কবিতার শরীরকে ভারী ভারী গহনা পরিয়ে সঙ সাজানো হচ্ছে। যা পাঠক বোঝে না কিছুই কবি অভিযোগ করছে পাঠককেও শিক্ষিত হতে হবে। আরে বাবা আমরা তো আদি থেকে অশিক্ষিত জাতি। তাহলে কি কবিতাও পুঁজিবাদী পণ্যে পরিণত হচ্ছে না? এই প্রবণতা থেকে বের না হওয়া গেলে আমাদের সামনে ভাষা ও সংস্কৃতিক বিপর্যয় নেমে আসবে। অলস দুপুর : সাহিত্য আন্দোলন কি কবিতাকে পরিবর্তন করে?

পলিয়ার ওয়াহিদ : তা তো করেই। যে কোনো অন্দোলনই সাহিত্যকে প্রভাবিত করে। আর সাহিত্য আন্দোলন তো এখন নেই বললেই চলে। সাহিত্যতো আর সমাজ বা রাষ্ট্রের বাইরের কোনো ফল না, ভীতরেরই একটা ফসল।

অলস দুপুর : আপনি কিভাবে কবিতা লিখেন?

পলিয়ার ওয়াহিদ : কবিতা কিভাবে লিখি প্রশ্নটা বেশ অযৌক্তিক। কারণ কবিতা কখন কিভাবে ধরা দেয় সেটা কবি নিজেই জানেন না। তবে আমি যখন কোন থিম মাথায় আসেসেটা কাগজে টুকে রাখি। তারপর সেটা নিয়ে ভাবনা বাড়তে থাকে। ভাবনার হাত-পা গজায়। একটা সময় টুকরো টুকরো লাইনগুলো একত্রে করলে একটা কিছু দাঁড়িয়ে যায়। সেটা কতোটা কবিতা হলো সেটা বিবেচ্য বিষয় না তবে কিছু একটা ভাবনা জড়ো হলো আর কি।

অলস দুপুর : সমসাময়িক বিশ্ব কবিতা নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

পলিয়ার ওয়াহিদ : আমাদের দুর্ভাগ্য বিভিন্ন দেশের কবিতা অনুবাদ হিসেবে পাই কিন্তু আমাদের কবিতা তাদের হাতে পৌঁছে না। এখন বাঙলাদেশে বিশ্বসাহিত্যের তুলনায় অনেক মজবুত কবিতা সৃষ্টি হচ্ছে। অনুবাদের সুবাদে বা বিভিন্ন ওয়েব জার্নালের মাধ্যমে অনেক সমসাময়িক বিদেশি কবিতা পড়ার সুযোগ পাচ্ছি কিন্তু তাদের সাহিত্য থেকে আমাদের সাহিত্য কোনো অংশেই খারাপ নয়। আমাদের এই উপমহাদেশে উপনিবেশিক একটা ভাবনা সবার ভিতর কাজ করে তা হলো আমরা হা করে বিদেশী মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। সাহেবরা যদি বলে তাহলে সেই সবচেয়ে ভাল লেখক। এই ধারণা থেকে বের না হতে পারলে আমাদের মূল্যায়ন আমরা কোনো কালে করতে পারবো না। তবে আমাদের কবিদের আত্মবিশ্বাস অটুট এটা একটা ভালো লাগার বিষয়।

অলস দুপুর : আপনার লেখালেখির শুরু কবে থেকে?

পলিয়ার ওয়াহিদ : আমি যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তখন আমার এক কাজিনকে নিয়ে একটা প্রেমের কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলাম। সালটা ছিল ১৯৯৭। প্রথম লাইনটা এখন মনে পড়ল ‘তোমার ঐ মনটা যেন দেখি উড়ো উড়ো’ আর কিছু মনে নেই। তারপর আর লেখা হয় নি। নবম শ্রেণিতে এসে উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা অফিস থেকে একটা পত্রিকায় কবিতা ছাপা হলো। তখনও ভাবিনি আমি কবিতা লেখা শুরু করবো। এরপর ২০০৪ সালে কলেজ পর্যায়ে কবিতা লিখে প্রথম পুরষ্কার পেলাম। তখন আমার প্রেমের বাজার ছিল তুঙ্গে। আমি সত্যি সত্যি নিজেকে কবি ভাবতে শুরু করলাম। এর বছর খানিক পরে আমাকে বিরহের সাগরে সাপ দিতে হয়। আমি বাড়ি (যশোর) ছেড়ে চলে যাই সিলেট। লেখালেখিতে কোনো মন ছিল না। মিষ্টির দোকানে বার ঘণ্টা চাকুরি আর অনার্সে ভর্তি হয়ে একটা উপন্যাস লিখে ফেলি। ২০০৭ সালে একটা জাতীয় দৈনিকে আমার লেখা ছাপা হলে পুলকের ঘোড়া দৌড়াতে শুরু করে। সিলেটে বিভিন্ন প্রত্রিকায় রোজ রোজ ছড়া ছাপা হচ্ছিল। কিন্তু আবার ভাটা। প্রেমের দায়ে ময়নার ঘর ভাঙ্গলে চাকরীটা চলে যায়। নতুন চাকরি বেশ দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় তখন। নিজের খাওয়া দাওয়ার দায় নিয়ে বেশ কিছুদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। তখনো বাড়িমুখি হবার কথা ভাবতে পারি নি। বলা যায় লেখালেখিতে সরব হলাম ২০১০ সালে। অনার্স শেষ করে ঢাকার আসার পর। এখন নিজেকে লেখক বা কবি ছাড়া আর কিছু ভাবতে আগ্রহ পায় না।

অলস দুপুর : আপনি কেন কবিতা লিখেন?

পলিয়ার ওয়াহিদ : কঠিন প্রশ্ন বটে। একজন কবি কোনো ভাবেই বাধ্য নয় এই প্রশ্নের উত্তর দিতে। তবে হ্যাঁ, কবি নিজেই নিজের কাছে বাধ্য হয়ে পড়েন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে। আমি আসলে কবিতা লিখি না, কে যেন আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। ব্যাপরটা ঠিক এ রকম বলে আমার মনে হয়। বাপের টাকা নেই যে কাঠমঞ্চ তৈরি করে সমাজের অন্যায়গুলো তুলো ধরবো। অসাম্যের সমাজে সাম্যের সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলবো সে ক্ষমতাও নেই। তাহলে আমি কি করতে পারি? তাই কবিতা লিখি। নিজের দায়বোধ থেকে কবিতা লিখি। অমূল্য একটা কবিতা লেখার জন্যেই তো কবিতা লিখে যাওয়া।

অলস দুপুর : কবিতা লিখতে আপনার কতটুকু সময় লাগে?

পলিয়ার ওয়াহিদ : এটা কোনো বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন নয়। একটা কবিতা কখনো কখনো মুহূর্তের মধ্যে লেখা হয়ে যায় আবার অনেক কবিতা লিখতে কয়েক বছরও লেগে যায়। কবিতা লেখার সময় কি ধরে বেধে হয় নাকি? আমি একটি কবিতা দুই বছর যাবৎ লিখে শেষ করতে পারিনি। আর একটা কবিতা তো আমার জীবন যা সারা জীবনব্যাপী লিখে চলেছি। হয়তো একদিন শেষ হবে কিংবা অসমাপ্ত রেখেই যাবার প্রস্তুতি নিতে হবে।

অলস দুপুর : আপনি সাধারণত কোথা থেকে কবিতা লেখার বিষয় খুঁজে নেন?

পলিয়ার ওয়াহিদ : কবিতা লেখার বিষয় খুঁজতে হয় না অটোমেটিক মাথায় চলে আসে। এ জন্যে কবিকে বেশি বেশি ভ্রমণ করতে বা দেখতে হয়। প্রকৃতির কাছে যেতে হয় একজনসাধারণ মানুষের থেকে বহুগুন। তাহলে লেখার খোরাক বের হয়ে আসে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিদিষ্ট বিষয়ের উপর ভাবতে ভাবতে কবিতার লাইন সৃষ্টি হয়ে যায়। বিষয় তৈরি করে ফিচার লেখা যায় কবিতা হয় না বোধহয়। কারণ আরোপিত কোনো কিছু আর যাই-হোক কবিতা হয় না।

অলস দুপুর : কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার বলে মনে করেন?

পলিয়ার ওয়াহিদ : জীবন কবিতা না হলে কবিতা কতোটুকু কবিতা হবে তা আমার চিরকালের সংশয় । আমার সাহিত্যপ্রেমী অনুবাদক কাকা তোফাজ্জেল হোসের বলতেন- ‘অটোমোবাইলস এ কাজ করা শ্রমিককে দেখে যেভাবে চেনা যায় একজন কবিকেও ঠিক সেভাবে চেনা না গেলে সে কিসের কবি।’ কথাটা পুরোপুরি সত্যি না হলেও খানিকটা সত্যি বটে। বর্ণাঢ্য জীবন বা বিচিত্র শৈশব না থাকলে কবি হয়ে উঠা বেশ কষ্টের। কারণ অভিজ্ঞতার আরেক নাম তো কবিতা। অবশ্যই অবশ্যই কবিতা লেখার জন্যে অন্য যে কোনো পেশার জন্যে যে প্রস্তুতি দরকার তার থেকে অনেকগুনে বেশি প্রস্তুতি দরকার। বাঙালী কবিরা এই প্রস্তুতি নেয় না বলে অকাল ঝরে যান। দু’একটা কবিতা লিখেই নিজেকে অনেক বড় কবি ভাবতে শুরু করেন সেটাই ঝামেলা হয়ে দাঁড়ায়। শুধু ঝামেলা না সেটা তার জন্যে ধ্বংসের পথ রচনা করে। আমি একটা দর্শন নিয়ে চলি সেটা হচ্ছে আপনি যা কিছু হতে চান না কেন আগে আপনাকে মানুষ হবার প্রস্তুতি নিতে হবে। আর কবি হতে হলে তো আগে মানুষ তারপর কবি। যে ভালো মানুষ হতে পারে না সে যদি অনেক বড় কিছুও হয়ে যায় তাহলে সেটা নোনা ধরা ইটের মতো মরিচা পড়া লোহার মতো একদিন বিলীন হয়ে যায়। কবিতা লেখার জন্যে মানুষ হওয়াটা, মানবিক হওয়াটা বড় বেশি দরকারি বলে আমার একমাত্র বিশ্বাস।