মাসুদ খানের কিছু বাছাই কবিতা
Post date: Mar 8, 2011 12:31:19 PM
মাসুদ খান
জন্ম ২৯ মে ১৯৫৯ খ্রিঃ, বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলালে। পৈতৃক নিবাস সিরাজগঞ্জ। প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক, ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর। পেশায় প্রকৌশলী। এ যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থ ৩টি। ৩টিই কবিতার বই-পাখিতীর্থদিনে (নদী, ১৯৯৩ খ্রিঃ), নদীকূলে করি বাস (একুশে পাবলিকেশন্স, ২০০১ খ্রিঃ), সরাইখানা ও হারানো মানুষ (একুশে পাবলিকেশন্স, ২০০৬ খ্রিঃ)। বিবাহিত। এক কন্যা, এক পুত্র।
১.
বৃষ্টি-২
বৃষ্টি হচ্ছে
বিদেশে
আরো কত কত আবছা ব্রহ্মদেশে, রঙ্গপুরে,
ব্যাপিত বগুড়াবর্ষে,
অনেক নিম্নের দেশে, ম্লেচ্ছাবর্তে,
বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে আসা
বিকালের ব্রহ্মদেশে,
বৃষ্টি হচ্ছে।
এবং উপর্যুপরি এই বিজলিশাসনের নিচে
এই বৃষ্টিনির্ধারিত তৃতীয় প্রহরে
দেশে দেশে কত রাঙা ও রঙিন জাতি
অস্পষ্ট গঠন নিয়ে ফুটে উঠছে উৎফুল্ল ভেকের মতো
অজানা উৎক্ষেপে।
বৃষ্টি আর বিদ্যুতের এই সহিংস প্ররোচনাক্রমে
চূড়ান্ত প্রশ্রয়ে
প্রলোভনে
বৃষ্টির প্রবল ঘোর আর
ঘূর্ণির ভেতর
বাতাসের অন্ধকারে
পূর্বাঞ্চলে
আকাশের নিচে
একাংশে, বিশাল ফাঁকা মাঠে
বিস্তারিত কচুখামারের আড়ালে আড়ালে
প্রায় অবিশ্বাস্যভাবে জায়মান নতুন-নতুন সব রাষ্ট্র
ডানাভাঙা উত্থানরহিত কত ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র রাষ্ট্র
তাদের ময়লা মানচিত্র
এবং অস্থির কাঁপা-কাঁপা ত্রেফল
অশোধিত আইন এবং সব অসহায় খর্বকায় ন্যায়পাল
এবং অপরিষ্কার কিছু কুচকাওয়াজসমেত জেগে উঠছে শুধুই
শুধু যমনির্দিষ্ট নিয়তি নিয়ে।
এইবার রাত্রি সমাপ্তির দিকে প্রবাহিত। এখন বৃষ্টিও নিভুনিভু-প্রায়।
ওইসব কথিত উল্লাসশীল জাতি আর বিকাশচঞ্চল রাষ্ট্র আর
তাদের শরীরে
গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে স্ফুটমান আর সদ্যফোটা কত-না বর্ণাঢ্য ধর্মরাজি
সবসহ অচিরে মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে
ভোরের আলোয়। বিস্তারিত কচুপ্রান্তরের আড়ালে আড়ালে।
২. একজন বর্ণদাসী ও একজন বিপিনবিহারী সমাচার
বনের কিনারে বাস, এক ছিল রূপবর্ণদাসী
আর ছিল, বনে বনে একা ঘোরে, সেই এক বিপিনবিহারী।
কন্যা তো সে নয় যেন বন্য মোম, নিশাদল-মাখা, বন্য আলোর বিদ্রূপ
রাতে মধ্যসমুদ্রে আগুন-লাগা জাহাজের রূপ
অঙ্গে অঙ্গে জ্বলে_
দূর থেকে তা-ই দেখে কত রঙ্গে, কতরূপ ছলে ও কৌশলে
বেহুঁশ হয়ে যে যায়-যায়-প্রায় কত যে বামন গিরিধারী
আর যত অন্য-অন্য অর্বাচীন বিপিনবিহারী।
কন্যা তো সে নয়, বুনো সুর, বুনো তান, আর উপমান অরণ্যশোভার।
আঁচলে কূজন আঁকা তার, সেই বহুবল্লভার।
বনের কিনারে বাস, ছিল এক রূপবর্ণদাসী
আর ছিল বনে বনে একা ঘোরে সেই এক বিপিনবিহারী।
অসবর্ণ তারা, অসমান, অসবংশের জাতক
একসঙ্গে তবু দোঁহে একই বুনো বাদলে স্নাতক।
তবু সেতু গড়ে ওঠে সন্ধ্যাকালে দূর দুই তটে
সেতু, দেহকথনের গোধূলিভাষ্যে তা ফুটে ওঠে।
৩. একটি ভোরবেলা : সদ্য খসড়া-করা
ভোরের বাতাস আজ উন্নত দেশের
কাগজি টাকার মতো সপ্রতিভ_
একটানা সতেজ কখনো, কখনো-বা থেমে থেমে।
আর এই প্রভাতবেলায়
লালায়
রেশমসূত্রের গ্রন্থনায়
গাছে গাছে এখন গ্রন্থিত হয়ে আছে
প্রবন্ধের পাতার আকারে বহু উড়ন্ত জটিল পাতা
স্থগিত হয়ে থাকা কাণ্ডে, কাণ্ডজ্ঞানে,
অবাক বিন্যাসে যথা নদীর ওপারে।
কিছুক্ষণ আগেই এই তো
বেশ কিছু স্ফূর্তিশীল পাখি ও পতঙ্গ
তোলপাড় করছিল পৃথিবীর গাছে গাছে।
আকাশ তাদের জব্দ করে নিয়ে চলে গেছে অনেক উঁচুতে
মাখন-রাঙানো মেঘরাজ্যে
ওই ঝুরঝুর ঝরে পড়া চিকচিকে সোনালি চিনির দেশে_
মেঘে মেঘে প্রচারিত আজ তাই অনেক অচেনা কোলাহল।
অগ্রহায়ণের এই ভোরবেলা
দৃশ্য আর ঘটনার এই যে অসহ্য অতর্কিত রূপ
এসবের অন্তরালে, নিসর্গের কোন্ অভিপ্রায়,
সে-কোন্ প্রবাহে, ছকে, সে-কেমন ভাষ্যে, ব্যঞ্জনায়
কীভাবে যে মীমাংসিত হয়ে আছে!
ভোগী মানুষের অন্নগত প্রাণ আর
ব্যসনব্যঞ্জন উপলব্ধি দিয়ে যতদূর বোঝা যায়, বুঝি,
বুঝতে প্রয়াস পাই,
যতভাবে অনুভব করা যায়, করি।
আজ অগ্রহায়ণের এই তাক-লাগানো প্রভাতবেলা_
একা আমি বসে বসে ওইসব পাখিহারা স্তব্ধ গাছে গাছে
একটু একটু করে পাখি আর মৌমাছি মেশাই,
একটির পর একটি মৌচাক বসিয়ে যাই ডাল থেকে ডালে_
কিছুটা বিশেষ্য করে তুলি।
৪. তুমি, তোমার সরাইখানা এবং হারানো মানুষ
একটি দিকের দুয়ার থাকুক খোলা
যেইদিক থেকে হারানো মানুষ আসে।
মাংস-কষার ঘ্রাণ পেয়ে পথভোলা
থামুক তোমার সরাইখানার পাশে।
আজও দেশে দেশে কত লোক অভিমানে
ঘর ছেড়ে একা কোথায় যে চলে যায়!
কী যাতনা বিষে..., কিংবা কীসের টানে
লোকগুলি আহা ঘরছাড়া হয়ে যায়!
এ-মধুদিবসে আকাশে বাতাসে জাগে
ঘর ছাড়বার একটানা প্ররোচনা।
হারিয়ে পড়তে নদী মাঠ বায়ু ডাকে
ঘরে ঘরে তাই গোপন উন্মাদনা।
জগতের যত সংসারছাড়া লোক
ঘুরে ফিরে শেষে সরাইখানায় স্থিত।
এ-স্নেহবর্ষে তুমি কি চাও যে, হোক
ঘরছাড়া ফের ঘরেই প্রতিষ্ঠিত?
হারানো মানুষ সেই কত কাল ধ’রে
স্বজনের ভয়ে দেশ থেকে দেশে ঘোরে।
স্বজনেরা তবু নানান বাহানা ক’রে
বৃথাই খুঁজছে কালে ও কালান্তরে!
স্বজন যখন খোঁজে উত্তরাপথে
হারানো তখন দাক্ষিণাত্যে যায়।
স্বজন যখন নিরাশাদ্বীপের পথে
হারানো খুঁজছে নতুন এক অধ্যায়।
৫. ছক
দশটি পথ এসে যেখানটায় কাটাকাটি হয়ে চলে গেছে দশ দিগন্তের দিকে, সেইখানটায় গিয়ে বসে থাকেন আমার মা। পথের ধারে বসে মা আমার মানুষ দ্যাখেন, মানুষের আসা-যাওয়া দ্যাখেন। কোনো পথ দিয়ে আসে হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা। কোনো পথ দিয়ে আসে গ্রহণ-লাগা, য়ে-যাওয়া, নিভু-নিভু সব বনি-আদমের দল। আবার মেঘ ও মিথুন রাশির ছায়ায় তুমুলভাবে বাঁচতে থাকা মানব-মানবীদের যাতায়াত কোনো কোনো পথে।
একদিন আসা-যাওয়ার পথের ধারে মা কুড়িয়ে পেলেন আমার ভাইকে (আমি তখনো আসিনি আমার এই মায়ের কাছে)। কিন্তু কিছুকাল পর আমার সেই ভাই হঠাৎ গেল হারিয়ে। তারপর থেকে মা আমার ওই পথমোহনায় বসে তীব্র পুত্রশোকে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন।
একবার, গোধূলিরঙের লম্বা-লম্বা চুলদাড়িঅলা এক বুড়ো পথিক ণিকের জন্যে থামালেন তার পথচলা। মা-র কাছে সব শুনে বললেন, ‘কোথাও তো কিছু হারায় না মা এই মহাবিশ্বে! যাও খুঁজে দ্যাখো।’ তারপর থেকে মা আমার উড়ে উড়ে বিশ্বসংসার তোলপাড় করে খুঁজে ফিরেছেন তার
সন্তানকে। শেষে সপ্ত-আকাশের পরপারে আমাকে কুড়িয়ে পেয়ে, এবং তার সন্তানকেই পেয়েছেন মনে করে, উড়িয়ে নিয়ে এলেন এই মর্ত্যরে ধুলায়। আমি তখন সাত আসমানের ওপারে অনন্ত নত্রকুঞ্জের ঝাড়জঙ্গলের ধারে সোনালি খড়ের গাদায় বসে অনাথ শিশুর মতো কাঁদছিলাম একা একা, মাকে হারিয়ে।
দিন যাবে, মাস যাবে, ঘুরে আসবে বছর...
একদিন হয়তো আবার হারিয়ে যাব আমি এই নতুন পাওয়া মায়ের কাছ থেকে আর আমাকে খুঁজে পাবেন অন্য এক মা। তারও হারিয়েছে
সন্তান। আমাকে পেয়ে ভাববেন, খুঁজে পেয়েছেন তারই হারানো ছেলেকে।
এইসব অনন্ত বিভ্রম আর বন্ধন
এই যে নিখিল ভুলবোঝাবুঝি
লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদা আর হারানো-পাওয়া খেলা
এইসব নিরন্তর মায়া ও ম্যাজিক...
সবকিছু অমীমাংসিত রেখে দিয়ে,
কাটাকুটি ময়লা ডুপ্লিকেট নকশা একখানা জগৎসংসারের,
তা-ই মেলে ধরে অবাক উদাস হয়ে বসে আছেন জরিপকর্তা।
নকশাটাতে একপাশে লেখা_ স্বাক্ষর/- অস্পষ্ট
নিচে তার চেয়েও অস্পষ্ট একটা সিল...
৬. শৈবালিনী
স্রোতে শুধু ভেসে চলো তুমি ওগো শৈবালিনী, শৈবালিকা, জলজা আমার
তুমি, তুমি ধর্মে মৎস্য, জাতিতে শৈবাল, আর স্বভাবে যে সৌদামিনী তুমি...
তুমি ঊর্মি-রাশির জাতিকা
ঊর্মিসঙ্গে ভেসে চলাতেই হয় তব ধর্ম, আনন্দ তোমার।
তুমি মাছ হয়ে যাবে, নাকি
হবে কোনো জলজ উদ্ভিদ_
এতকাল পর এই দ্বিধা আজ, শৈবালিনী, জাগছে তোমাতে
মুহুর্মুহু বিজলিবিলাসে।
ফোটে ফুল, আস্তে আস্তে, ফোটে তার বিবিধ ব্যঞ্জনা
আবার হারিয়ে যায় জলে সেই ফুল, সেই জলজ রচনা
জল থেকে জলান্তরে...বহু নাম জাগে পথে পথে,
সর্ব নাম ফের বদলে বদলে যায় স্রোতে।
বহুলনামিনী তুমি বহুলচারিণী বহু-আকারিণী জলজা আমার
তুমি, তুমি ধর্মে মৎস্য, জাতিতে শৈবাল,
স্বভাবে বিদ্যুৎ-লতা তুমি...
তুমি ঊর্মি রাশির জাতিকা, ঊর্মিসঙ্গে ভেসে চলাতেই হয় তব ধর্ম ও সাধনা
তোমাতে ক্ষণেই জাগে মাছের স্বভাব, ক্ষণেই তো ফের শিকড়বাসনা...
৭. জ্বরের ঋতুতে
তখন আমাদের ঋতুবদলের দিন। খোলসত্যাগের কাল। সুস্পষ্ট কোনো সর্বনাশের ভেতর ঢুকে পড়তে চেয়েছিলাম আমরা দুজন। তার আগেই তোমার জ্বর এল। ধস-নামানো জ্বর। তুমি থার্মোমিটারের পারদস্তম্ভ খিমচে ধরে ধরে উঠে যাচ্ছ সরসর করে একশো পাঁচ ছয় সাত আট...ডিগ্রির পর ডিগ্রি পেরিয়ে...সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী তাপের সহগ হয়ে উতরে উঠছ তরতরিয়ে সেইখানে, যেখানে আর কোনো ডিগ্রি নাই, তাপাঙ্ক নাই...তাপের চূড়ান্ত লাস্যমাত্রায় উঠে ঠাস করে ফারেনহাইট ফাটিয়ে বেরিয়ে আসছে থার্মোমিটারের ফুটন্তঘন বীর্যতরল।
তীব্র, ধসনামানো জ্বরেও নারীরা ধসে না। কেবল তাদের কিছুটা কদাকার দেখায়_কিছুটা করালী, কিছুটা পিশাচীর মতো।
যত রূপসী তত কদাকার...
একসময় মাথাফাটা থার্মোমিটারকে ব্রুমস্টিক বানিয়ে তাতে চ’ড়ে উধাও উড়ালে অস্পষ্ট অঘটনের দিকে হারিয়ে যাচ্ছ হে তুমি প্রিয়তরা পিশাচী আমার।
জীবনে প্রথম মুখোমুখি এরকম সরাসরি স্পষ্ট বিপর্যাস
মিটারের জ্বালাখোঁড়ল থেকে ঝরছে তখনো টগবগ-করে-ফোটা ফোঁটা-ফোঁটা রেতঃনির্যাস।
৮. বীতকৃত্য
যেইদিন বৃক্ষ ত্যাগ করবে তার বৃধর্ম
মিষ্ট নয়, ফল হবে কটু বা কষায়
আর সোজা না ফেলে সে ফল ফেলবে তির্যক ভঙ্গিতে...
যেইদিন আম্রবৃক্ষে জাম হবে, তাম্রবৃক্ষে সিসা...
দস্যুকে তো শীলাচারী হলে চলে না
তবুও যেদিন সে দস্যুতা ত্যাগ ক’রে
হয়ে উঠবে সুশীল, পাদ্রি ও পরার্থপর
বকেরা যেদিন মশগুল হবে মৎস্যমঙ্গলচিন্তায়...
যেদিন আয়না পরিত্যাগ করবে তার আর্শিধর্ম
দেবে না তো আর কোনো প্রতিবিম্ব
পাহাড় দেবে না প্রতিধ্বনি...
আর যত শীল ও দুঃশীল গতি অগতি কুশল অকুশল
আর যত অভিজ্ঞা ও সমাপত্তি, বারো রকমের বন্ধনযাতনা
সংসার সন্ন্যাস মো মোহ কাম কৃত্য ঘাম মূত্র বীর্য ধর্মাধর্ম পুরীষ পৌরুষ
সব একাকার হবে যেইদিন
সেদিন কোথায় কোন দূরে নিয়ে যাবে গো আমায়
ধর্মহারা বীতকৃত্য সূত্রহীন পুরীষবিহীন...
৯. নির্বাসন
অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে আকাশ ঢাকা
গায়ে তার জ্বলে কোটি-কোটি প্লাংক্টন
তারই মাঝে একা একটি শ্যামলা মেঘে
সহসা তোমার মুখের উদ্ভাসন।
হয়তো এখন আকাশ নামছে ঝেঁপে
মেঘ ও মেঘনার ছেদরেখা বরাবরে
ঝাপসা একটি মানুষীর ছায়ারূপ
ঝিলিক দিয়েই মিলাচ্ছে অগোচরে।
দূর গ্রহে বসে ভাবছি তোমার কথা
এতটা দূরে যে, ভাবাও যায় না ভালো
ভাবনারা হিম-নিঃসীম ভ্যাকুয়ামে
শোধনে-শোষণে হয়ে যায় অগোছালো।
অথচ এখানে তোমারই শাসন চালু
তোমার নামেই বায়ু হয়ে আমি বই
তোমারই আবেশে বিদ্যুৎ জাগে মেঘে
তোমার রূপেই ময়ূর ফুটেছে ওই।
মধুকর আজ ভুলে গিয়ে মাধুকরী
রূপ জপে তব কায়মনোগুঞ্জনে।
মনন করছে তোমারই বিম্বখানি
ধ্যানে ও শীলনে, স্মরণে, বিস্মরণে।
গন্ধকের এই গন্ধধারিণী গ্রহে
তটস্থ এক বিকল জীবের মনে
ক্ষার, নুন, চুন, অ্যাসিড-বাষ্প ফুঁড়ে
চমকিয়ে যাও থেকে-থেকে, ক্ষণে ক্ষণে ।
১০. শূন্য
নিখিলের হঠাৎ-বিগড়ে-যাওয়া সে-কোন গোপন সংখ্যামেশিনের থেকে
অচেনা অসুখের মতো, অজ্ঞাত গজবের মতো গলগল করে বেরিয়ে আসছে সব শূন্য।
সাধের মেশিন থেকে আশা ছিল বেরিয়ে আসবে কত-না বিচিত্র অঙ্ক আর সংখ্যা
আর ভরে যাবে এই দুখিনী দুনিয়া! তা নয়, কেবলই শূন্য।
তা-ও শূন্যগুলি সব দশমিকের ডানে বসা একটানা শূন্যের সিরিজ_
অর্থহীন উদ্বৃত্ত বন্ধ্যা ও হাহুতাশময়!
এক মহামেশিনের বিপুল ববিন থেকে, গোপন ও প্রকাশ্য সব স্লট থেকে
চিরতরে ছাড়া পাওয়া যেইমতো মাইল-মাইলব্যাপী সুতার বহর
সেইমতো এইসব খরস্রোতা শূন্যের নহর...
অন্য কোনো অঙ্ক নাই সংখ্যা নাই শুধু শূন্য উপচে উপচে আসা
লাফাংগার মতো লাফাতে লাফাতে আর গড়াতে গড়াতে আসা
বহরে বহরে পাতা আর পাতার বাহার করতে করতে আসা
ইঁদুর ও ভোঁদড়ের ভঙ্গি ধ’রে লীলা আর লাস্য করতে করতে আসা
চিকা আর চামচিকার মতো হাস্য ও রহস্য করতে করতেই
দিল্মে চাক্কুমারা পাগলা ও ভোলাভালা হাক্কু ও হাহাকার করতে করতে আসা
দশমিকের ডানে-বসা কানে-ঠসা কালা-নুলা নেলাফেলা খাটাশ-খবিশ নষ্ট-ভ্রষ্ট
ডাহা-ডাহা যত শূন্যের দল ভয়াবহ শূন্যের কাফেলা..............................
আর ওই যে বিকট বেঢপ অতিকায় এক শূন্য,
ওটাই পালের গোদা, আন্ধা-কালা কাফেলাসালার...
এসব কি স্রেফ বিগড়ে-যাওয়া সেই গূঢ় মেশিনের ঋতুবিভ্রম!
দশমিক-পরবর্তী শূন্যের প্রবাহ হয়ে মহাশূন্য ভরে ফেলছে ক্রমে
এমনিতেই জড়ের দুর্বহ দায়ভার
তদুপরি শূন্যের শাসন, অত্যাচার
কোথায় পালাবে তবে প্রাণ!
প্রাণী সব করে রব, ভয়ে_
বদ্ধ ও তটস্থ প্রাণিকুল
ফাজা আলাহুম কা’স ফিম্মাকুল।
ইতিমধ্যেই যে শূন্যস্থানগুলো তৈরি হয়ে আছে
সেগুলো তো পূরণ হচ্ছেই না, বরং তৈরি হচ্ছে নতুন-নতুন শূন্যস্থান
মহাশূন্য আরো মহা শূন্য হচ্ছে...
অবশেষে একসময় শূন্যস্থান দিয়েই, যাঃ, পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে
খসখসে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, দিনদুনিয়ার।
১১. নলজাতক
যদি আমি অর্জন করে থাকি দশপারমিতা, তবে এই বনে যত নল আছে সমস্তই গ্রন্থিশূন্য ও একচ্ছিদ্র হোক, যাতে নলের ভেতরে জাতকদের জন্ম, বর্ধন ও বিচরণ হয় অতি অনায়াস। অতঃপর একদিন দুপুরে, নুইয়ে ফেলে মোটা-মোটা নলখাগড়া অগণন, নলের ভেতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসুক সারা গায়ে নালঝোলমাখা কালো-ধলো সরল- ও কোকড়া-চুলো গমরঙা তামাটে কপিশ অগণিত রৌদ্রদিগম্বর ন্যাংটা নলজাতক। ভরে যাক নিস্তরঙ্গ এ-অরণ্য অক্ষৌহিণী দাপুটে দামাল শিশুবাহিনীর উত্তাল তরঙ্গরঙ্গে...
১২. ইতিহাস
কী করে সম্ভব তবে পৃথিবীর সঠিক ইতিহাস? কারণ, যিনি লিখেছেন, তিনি কে এবং কোথায়? কোন্ সময়ে, কোন্ অবস্থানে দাঁড়িয়ে কী উদ্দেশ্যে লিখছেন, সে-সবের ওপর নির্ভর তার ইতিহাস। আর তা ছাড়া বিষয়টি বিষয়ীগত, সাবজেকটিভ।
তবে কি সত্যিই অসম্ভব সঠিক ইতিহাস?
_না। ভূমণ্ডল হতে এ যাবৎ যত আলো বিকীর্ণ হয়ে চলে গেছে সে-সবের মধ্যেই মুদ্রিত হয়ে আছে পৃথিবীর ইতিহাস, কালানুক্রমিক। অর্থাৎ পৃথিবী হতে বিচ্ছুরিত আলোর ইতিহাসই পৃথিবীর ইতিহাস। আর তা-ই হচ্ছে প্রকৃত ইতিহাস, কেননা তা লিখিত প্রাকৃতিকভাবে। এই নিখিল নভোভারতের রাজ্যে রাজ্যে বসে দূরবীণ দিয়ে সেগুলি টুকে নিচ্ছে হয়তো-বা কেউ কেউ-আমরা জানি না।
তবে সে-ও কি হবে সঠিক ইতিহাস? কেননা, ইতিহাসের সেই সব অধ্যায়, যেগুলি কালো এবং অন্ধকার? সব আলো শুষে নিয়ে নিয়ে যেগুলি কালো ও কলঙ্কিত হয়ে পড়ে আছে? যেগুলি থেকে কোনোকালেই আর বের হয়নি এবং হচ্ছে না কোনো আলো? সেইসব?
তা ছাড়া সেই সব মানুষদের ইতিহাস, যারা কালো এবং কালচে তামাটে?
-হয়তো-বা দূরবীণে ঝাপসা হয়ে ধরা পড়ছে তাদের ইতিবৃত্ত, ঝাপসা মুদ্রিত হচ্ছে তাদের ইতিহাস-যেহেতু তারা যথাক্রমে কৃষ্ণ এবং ঊনকৃষ্ণ, যেহেতু তারা খুবই সামান্য আলো দিতে পারে বলে পৃথিবীতে প্রচারিত, বিচ্ছুরণে তারা প্রায় অম বলে প্রচারিত।
তাহলে কি কালো ও তামাটে মানুষদের ইতিহাস নিরন্তর ঝাপসাই থেকে যায়!? পৃথিবীতে!? এবং প্রকৃতিতে!? আলো নেই, তাই ইতিহাসও নেই!?
১৩. প্রত্যাখ্যান
হঠাৎ মায়ের স্তন্য থেকে, আজই, উৎখাত হয়েছে শিশু
ঘুরে ফিরে বারে বারে যায় তবু মায়ের নিকট
বকা খায়, কিছুটা অবাক হয়, তবু শিশু যায়...
অবুঝ কী আর বোঝে কী-বা অর্থ হয় এই উৎখাতলীলার!
কী-বা এর বিন্দু ও বিসর্গভাব
কিছুই পারে না বুঝতে মায়ের স্বভাব
শুধু ভাবে-মায়ের কৌতুক তবে এতটা নিষ্ঠুর!
মাতা কেন হয় আজ এতটা বিমাতা
এই খরাঋতুতে হঠাৎ?
ভেবে একা কষ্ট পায়, নিঃসহায়, ফের তবু যায়
শিশু ফের বকা খায়, আবার অবাক হয়, তবুও সে যায়...
কেঁদে কেঁদে অবশেষে বোবা অভিমানে
অবশ ঘুমিয়ে পড়ে মাটির শয়ানে।
শুধু তার পিপাসার ধ্বনি এসে লাগে কানে
থেকে থেকে, এই মহিমণ্ডলের এখানে ওখানে।
১৫. নিঃসঙ্গ
লক্ষ-লক্ষ মাইল উঁচুতে, মহাকাশে,
জনমানববিহীন ভাসমান একটি স্পেস-স্টেশনে পোস্টিং পেয়ে
এসে জয়েন করেছে একজন নভো-স্টেশনমাস্টার।
একদিন একটি রকেট এসে প্রচুর বোঁচকা-বুঁচকিসহ তাকে নামিয়ে দিয়ে,
ফুয়েল-টুয়েল নিয়ে কোথায় যে চলে গেল কোন আসমানের ওপারে...
সে-ও কতদিন আগে!
মৃত্যুরও অধিক হিম আর নির্জনতা...
মানুষটি একা-একা থাকে, খায়, ঘুমায়_ওজনহীন, নিঃসাড়, নির্ভার...
মাঝে মাঝে নভোপোশাক পরে বাইরে সাঁতার কেটে আসে শূন্যে,
তখন সে বাঁধা থাকে অ্যালুমিনিয়ামের লম্বা লাঙুলে, স্টেশনের মাস্তুলের সঙ্গে।
দুঃখে-অভিমানে কখনো কখনো গিয়ে হেগেও আসে মহাকাশে
জ্বলজ্বল করতে থাকে তার সেই স্বচ্ছ-সুগন্ধ পুরীষপিণ্ড,
স্ফটিকের মতো ফোঁটা-ফোঁটা মূত্ররাশি
কাছে-দূরে কোত্থাও কেউ নাই,
কোনো প্রেত-প্রেতিনী, অথবা কোনো যম-যমী, জিন-পরি, ভগবান-ভগবতী,
ফেরেশতা-ইবলিশ কাঁহা কিচ্ছু নাই, কেউই ঘেঁষে না কাছে, যে,
তার সঙ্গে একটু কথা বলবে, কফি খাবে...
এমনকি মানুষটা যে একটু ভয় পাবে, তারও উপায় নাই...
নিজের সঙ্গেই তাই নিজেরই মিথুন ও মৈথুন, খুনসুটি, হাসাহাসি, সাপলুডু খেলা
কেবল রজনীস্পর্শা, ভীষণবর্ণা এক গন্ধরাজ্ঞী ফুটে থাকে অবাধ, অনন্তরায়,
বহুকাল দূরে...
১৬. যোগাযোগ
ওই বাতবিতাড়িত মেঘমালা, বিজলি-জাগা মেঘের স্তবক,
তারই সাথে জাগে খর বজ্রের গমক
বজ্রের হাঁকের মধ্যে শুনছ তুমি গায়েবি অনুশাসন, বোবা ও সুদূর।
ঝিঁঝির ডাকের মধ্যে শ্রবণ করছ হে মহামণ্ডলের সুর।
সবগুলি ইন্দ্রিয় নিভিয়ে দিয়ে তুমি
গুরু গন্ধতেলের প্রদীপ জ্বেলে জেগে থাকছ, ভাসছ, একা-একা
তুলার মতন নিরপে, ধ্র“ব, অবন্ধন...
জ্বালিয়ে রেখেছ শুধু একাকী শ্রবণ!
শ্রব্যাশ্রব্য বহু কিছু ধরা পড়ছে শ্র“তিতে তোমার!
তোমার শ্রাবণ জ্ঞান থেকে আজ কিছুটা প্রসাদ
কিছুটা দ্রবণ যত্নে ঢেলে দাও শ্রবণে আমার
বেঁচে উঠি, এবং উৎপুচ্ছ হই, মেতে উঠি শ্রাবণ উৎসবে।
বাগিন্দ্রিয় বাগ্বিরুদ্ধ হোক এইবার
স্বাদরুদ্ধ স্বাদেন্দ্রিয়!
শ্রুতি ছুঁয়ে যাক শ্রুতি, হৃদিতে মিশুক হৃদি, শ্রবণে শ্রবণ...
যোগাযোগ হোক একদম সরাসরি, সোজা ও সহজ!
১৭. দমকল
উন্মাদ উঠেছে গাছে, তরতর ক’রে, ছাড়া পেয়ে পাগলাগারদ।
নামে না সে কিছুতেই, যতণ-না ওই খর্বকায়া নার্সটি এসে
মিনতি করে না-নামায় তাকে।
নার্স আসে দ্রুত, দমকলের মতন
কী-কী যেন বলে হাত নেড়ে নেড়ে,
তাতে খুশি হয়ে নেমে আসে উঁচু ডাল থেকে বিমুগ্ধ পাগল-
ঝোলের আনন্দে যেইভাবে নেমে আসে কইমাছ, পাতে
ক্রমিক সংখ্যার মতো সহজ স্বচ্ছন্দে।
ঝিলমিল করে বয়ে যায়, সেবিকার বোধে, পাগলের বিকল বিবেক।
উন্মাদ আবার ফিরে যাবে আজ উন্মাদ-আশ্রমে
ধর্মগণ্ডিকায় মাথা রেখে নির্বিকার নিয়ে নেবে
তেরোটি ইলেকট্রিক শক
তেরোবার স্বীকারোক্তি, স্বাস্থ্যযাজকের শান্ত সুধীর নির্দেশে।
১৮. আতাফল
এই সেই ফল
সেই মিরাকল
রূপকের মতো ঝুলে আছে পৃথিবীর বহু ছায়াচ্ছন্ন দেশে দেশে।
দেখতে যেন-বা এক সবুজ গ্রেনেড
আবার কিছুটা বটে হৃৎপিণ্ডের মতো_
অভ্যন্তরে বারুদের তোলপাড়-করা ঘ্রাণ, আর
সুস্বাদ! অচিন্তনীয়।
শৈশবে যেখানে থাকতাম, নিকটেই ছিল এক পরিত্যক্ত ভিটাবাড়ি। প্রাচীন উদ্ভিদ আর লতাগুল্মে ভরা। একদিন গোধূলিবেলায়, পিতামহ, ঘুম থেকে সহসাই জেগে উঠে, অনেকটা রহস্যের নায়কের মতো গেলেন আমাকে সঙ্গে নিয়ে সেই ভিটায়। হাওয়ায় আন্দোলিত পোড়ো ভিটা। বহু গাছগাছালির মধ্য থেকে গোপনে একটি গাছকে দেখালেন। সাধারণ একটি গাছ। কিছু ফল ঝুলে আছে তাতে। দেখতে অনেকটা গ্রেনেডের মতো। মেওয়াফল। আতা-মেওয়া। পিতামহ বললেন_এগুলা বেহেশতের ফল। একমাত্র স্বর্গজাত ফল, যার নমুনা দেখানো হয়েছে দুনিয়ায়। চুপচাপ দেখে নে। বলামাত্র আমার এবং পিতামহের সর্বাঙ্গ হাউই তুবড়ির মতো একসঙ্গে শিহরিত।
পিতামহের বিরল-বসন্ত-চিহ্নিত ফর্সা অবয়ব আর লম্বা-লম্বা গোধূলিরঙের দাড়ি, আমাকে, আমার শিহরনগুলোকে আচ্ছাদিত করে দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল একটানা প্রবল হাওয়ার ভেতর।
সূর্য ডুবে যাচ্ছে পরিষ্কার হারাবতী নদীর ওপার।
অস্তরেখা বরাবর ওই যে উঠছে জেগে সুদূর কদলীবন। তারই ফাঁকে ফাঁকে
একা-একা রূপকথা হয়ে ওই ঘুরছে এক গেরিলা কিশোর_সহযোদ্ধারিক্ত,
পরিবার-পরিজন থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন,
পাক খেয়ে খেয়ে শুধু হারিয়ে হারিয়ে
একেবারে একা হয়ে যাওয়া এক গেরিলা কিশোর_
ডান হাতে আতাফল, বাঁ-হাতে গ্রেনেড,
বাম কানে ছোট্ট রিং, কাঁধে কালাশনিকভ, গায়ে ইস্পাতরঙের
জ্যাকেট, গলায় বুলেটের মালা, মাঝখানে হৃৎপিণ্ড_
সব আলপিনে আলপিনে গাঁথা।
অস্তমাখা দূরের কদলীবনে ভিনদেশী গেরিলা কিশোর।
কথা বলে ঝটপট, অবিকল সন্ত্রাসের বাগ্বিধিতে।
অন্য কোনো ভাষা নেই, কোনো বিধি নেই বনভূমে ওই বাগ্বিধি ছাড়া_
আর সন্ত্রাসের বিপরীতে মুহুর্মুহু অপরূপ সন্ত্রাস...
প্রতিটি সন্ত্রাস প্রণয়নশেষে, বারবার, আঁজলা ভরে জল খায়
আর পাক খেয়ে খেয়ে হারিয়ে হারিয়ে
একদম একা হয়ে যায় এই গেরিলা কিশোর,
সন্ত্রাসশিল্পের রচয়িতা।
আর এই সেই ফল
সেই মিরাকল
রূপকের মতো ঝুলে আছে পৃথিবীর বহু ছায়াচ্ছন্ন দেশে দেশে
অস্তমাখা কাতর গ্রেনেডফল। অভ্যন্তরে বারুদের মৌ-মৌ ঘ্রাণ, আর
সুস্বাদ! অচিন্তনীয়।
পক্ষান্তরে, গ্রেনেড_অপূর্ব এক ইহফল।
গ্রেনেড_কিছুটা উগ্র কিন্তু চমৎকার এক ইহফল।
রূপকের মতো ঝুলে আছে পৃথিবীর বহু রৌদ্রোজ্জ্বল দেশে দেশে।
অভ্যন্তরে কোনো এক দুর্লভ ফলের মাতাল-করা ঘ্রাণ।
বিদেশী অরণ্য আজ আতায় গ্রেনেডে তোলপাড় এই গোধূলিবেলায়।
ভিনদেশী গেরিলা কিশোর
তার ডান হাতে আতাফল, বাঁ-হাতে গ্রেনেড এবং
মাঝখানে হৃৎপিণ্ড_এভাবে ভারসাম্য রেখে রেখে
টালমাটাল পায়ে স্বর্গসড়কের সেই মহাবিপদ্জনক সাঁকো
পার হয়ে সর্বাগ্রে, দুর্লভতর এক ইহফলের স্মারকবার্তা নিয়ে
স্বর্গদ্বারে করাঘাত...
অনেক পেছনে পড়ে থাকে পুণ্য যাত্রীদল।
তারা আতঙ্কজনকভাবে পেছনে।
আর এই সেই ফল
সেই মিরাকল
রূপকের মতো ঝুলে আছে পৃথিবীর বহু রৌদ্রচ্ছায়াময় দেশে দেশে।
১৯. বহুদিন পর আবার প্রেমের কবিতা
মেঘ থেকে মেঘে লাফ দেবার সময়
তূরীয় আহাদে দ্রুত কেঁপে-বেঁকে
একটানে একাকার যখন বিজলিসূত্র, ওই ঊর্ধ্বতন
মেঘের আসনে এক ঝলক দেখা গেল তাকে
আলোকিত ঘনকের আকারে।
তাকে ডাক দেবো-দেবো, আহা কী বলে যে ডাক দেই!
জন্ম এক রুদ্ধভাষ জাতিতে আমার_
মুহূর্তে মিলিয়ে গেল অপর আকারে।
দূর মহাকাশে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফুটে আছে কত ফুয়েল-স্টেশন_
সেইসব এলোমেলো নৈশ নকশার মধ্যে তাকে, প্রিয় তোমাকেই,
ঘোর মধ্যরাতে
এইভাবে দেখে ফেলি আমিও প্রথম।
সর্ববায়ু আমার সুস্থির হয়ে যায়।
যেই দেখি আর ডাক দিতে যাই প্রিয়, অমনি
তোমার সমস্ত আলো, সকল উদ্ভাস
হঠাৎ নিভিয়ে নিয়ে চুপচাপ অন্ধকার হয়ে যাও।
আবার উদ্ভাস দাও ক্ষণকাল পরে_
এইরূপে খেলা করো, লুকোচুরি, আমার সহিত।
আমি থাকি সুদূর রূপতরঙ্গ গাঁয়, আর তোমার সহিত
তোমারই সাহিত্যে আহা এভাবে আমার বেলা বয়ে যায়।
এরপর থেকে একে একে এক উচ্চতর জীবের বিবেক
প্রথমে প্রয়োগ করে দেখি,
মিলিয়ে যাচ্ছেন তিনি আকারে ও নিরাকারে।
এক অতিকায় জট-পাকানো যন্ত্রের
আগ্রহ সাধন করে দেখি,
তা-ও তিনি ছড়িয়ে পড়েন সেই আকারে নিরাকার;
আকাশে আকাশে মেলে রাখা তার কী ব্যাপক কর্মাচার,
একটির পর একটি গ্রহ আর জ্বালানি-জংশন সব
অতর্কিতে নিভিয়ে নিভিয়ে প্রবাহিত হন তিনি।
একদা মণ্ডলাকার ছিলে জানি
আজ দেখি দৈবাৎ ধর্মান্তরিত, ঘনকের রূপে!
ঘনক তো গোলকেরই এক দুরারোগ্য সম্প্রসার।
তবুও তো ধর্ম রা পায়। রতি, সাধিত হয় তবু।
গোলকত্ব পরম আকার
গোলকতা যথা এক অপূর্ব বিহেভিয়ার, প্রায়-
নিরাকারসম এক নিখুঁত আকার।
শৈশবের কালে, এক আশ্চর্য মশলা-সুরভিত
গুহার গবাপথে আচম্বিতে ভেসে উঠেছিল মেঘ,
যার বাষ্পে বাষ্পে কূটাভাস।
কিছুতেই পড়তে পারি নাই সেই মেঘ
আমরা তখন।
বিব্রত বাতাস তাকে, মেঘে মেঘে সংগঠিত ক্ষণ-ক্ষণ-আকৃতিকে,
ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে যাচ্ছে কত বিভিন্ন প্রদেশে।
নিরাকৃত হতে হতে প্রায়, ওই তো ব্যক্ত হচ্ছেন ফের আকারে আকারে।
ধর্মচ্যুত হতে হতে প্রায়, ফের প্রচারিত হন ধর্মে ধর্মে।
আহা, ধর্ম হারালে কী আর থাকে তবে এ ভুবনে!
ঘনক যে গোলকেরই এক নিদারুণ তাপিত প্রসার।
বৃহৎ, অকল্পনীয় এক জড়সংকলন। বড় বালিপুস্তকের মতো_
তারই মধ্যে অকস্মাৎ একটু প্রাণের আভা। মাত্র তার একটি পৃষ্ঠায়।
এই সংকলনের ভূমিকাপত্রটিও নেই। ছিন্ন। সেই প্রধান সংঘর্ষে।
নিষ্ক্রান্তিদিবসে, অতঃপর, ওই গুহামুখে পড়ে থাকে
এ বিপুল জড়সংকলনের ছেঁড়া ভূমিকাপৃষ্ঠাটি,
অর্থাৎ সেই যে প্রথম ক্যাজুয়াল্টি, নিখিলের_
ওই গুহাপথে, নিষ্ক্রমণকালে।
একবার মাত্র দেখা হয়েছিল কায়ারূপে
ঝাপসা, ছায়া-ছায়া!
তা-ও বিজলির দিনে, তা-ও মেঘের ওপরে
উলম্ফকালীন।
এরপর থেকে শুধু ভাবমূর্তি...
যেদিকে তাকানো যায়
কেবলই, উপর্যুপরি ভাবমূর্তি ঝলকায়।
মাঠে মাঠে স্প্রিং স্ক্রু আর নাটবোল্ট ফলেছে এবার সব জং-ধরা।
সে-সব ভূমিতে হাঁটু গেড়ে গলবস্ত্র হয়ে পরিপূর্ণ দুই হাত তুলে
যাচ্ঞামগ্ন সারি সারি সম্প্রদায়_তারা অসবর্ণ, তারা
লঘিষ্ঠ-কলহরত বিড়ালের আধো-আলো-আঁধারি বাচন ও কণ্ঠস্বর
কেড়ে নিয়ে দ্রুত নিজ কণ্ঠে কণ্ঠে গুঁজে দিয়ে সারিতে দাঁড়িয়ে যায় তারা।
তেজের অধিক তেজ
বাক্-এর অধিক বাক্স্ফূর্তি তুমি,
গোলকে স্ফুরিত হয়ে এসো পুনর্বার
পূর্বধর্ম ধারণ ক’রে সরাসরি উত্তম পুরুষে।
আর
কত অর্থ যে নিহিত করে রাখো বীজাকারে
সেইসব ভাসমান বাক্যের অন্তরে,
দৃশ্যত যা অর্থহীন অতি-অর্বাচীনদের কাছে।
সংকটে সংকটে, সর্ব-আকারবিনাশী
দহন দলন আর দমনের দিনে
আদিগন্ত কুয়াশা-মোড়ানো সেই তৎকালীন রৌদ্রের মধ্যেই
চতুর্দিক থেকে একসঙ্গে আর
বৃক্ষে বৃক্ষে আর দ্রব্যে দ্রব্যে আর ভূতে ভূতে সর্বভূতে
মুহুর্মুহু উদ্ভাস তোমার, এক অবধানপূর্ব রহিমের রূপে।
ঘনক তো গোলকেরই এক অপূর্ব অপিনিহিতি।
এইরূপে লীলা করো, লুকোচুরি, আমার সহিত।
আমি থাকি দূরের রূপতরঙ্গ গাঁয়, আর তোমার সহিত
তোমার সাহিত্যে দ্যাখো এভাবে আমার বেলা বয়ে যায়।
২০. সখাসংগীত
উদ্গান।
এই উদ্গান সখার উদ্দেশে।
অদেখা অচেনা এক সখার জন্যে আকাঙ্খা_
যে রঙিন। যে বহুদূর।
দূর কোনো অজানায় যার অবস্থান।
এবং যার কাছ থেকে, থেকে থেকে, অনিয়মিতভাবে, ভেসে আসে
কখনো সন্দেশ, কখনো সন্ধ্যাবাতাস,
কখনো উস্কানি, কখনো সমর্থন,
কখনো আনুগত্য, কখনো-বা অভিভাবকত্ব, মৃদু;
কখনো-বা রৌদ্রঢালা দিগন্তবিস্তৃত ঔপনিবেশিকতা।
আর কিছু বাক্য কিছু গান
কিছু রূপ কিছু প্রাণ_
এইসব আর যা যা ভেসে আসে...
সুরশলাকার মসৃণ কাঁপনের মতো করে কেঁপে কেঁপে
বাতাসে মিহি তরঙ্গ তুলে ভেসে আসে...
আমার সখারা দূরের, অনেক দূরের শহরে থাকে।
শুধু
একটি সখার নদীর কিনারে বাস
বিদেশী নদীর রাংতা-মোড়ানো বাঁকে
আমার বন্ধু নদীর কিনারে থাকে।
দূরে তার দেশ কাঁপা-কাঁপা রূপকাহিনির মতো কাঁপে
সখাটি আমার নদীর কিনারে থাকে।
এবেলা আমার গৃহ নাই কোনো সখা,
কী যে ঘোর গৃহতৃষ্ণা জাগছে তাই।
মনে করি, যাব তোমাদের দেশে চলে
নাকি
তুমিই আমাকে অধীনে তোমার ধীরে ধীরে টেনে নেবে?
তোমার অধীনে, অধিগ্রহণে আর শাসনের নীচে
একদিন জানি আমাকেও তুমি ধীরে ধীরে টেনে নেবে।
আমাকে তোমার পালনের, অভিভাবনের ছায়া দিয়ে
পুরোপুরি দেবে ঢেকে।
আহা
এমন সোনালি বন্ধুর খোঁজ পেলাম যে কোত্থেকে!
তোমাদের দেশে সন্দেশতে থেকে
হাওয়া এসে লাগে থেকে থেকে এই দেহে।
অচেনা পুলক শিহর তুলছে পালকে।
সন্ধ্যার কালে বার্তা পাঠালে রূপকে ও সংকেতে;
কিছু তার পাই ডাকে
আর কিছু আসে হঠাৎ দমকা তথ্যপবনে ভেসে।
তথ্যপবনে বন্ধু আমার সন্দেশ পাঠিয়েছে।
বোধ করি এই হাওয়াটা প্ররোচনার।
হঠাৎ খেয়ালে বদ্লে ফেলে দি’ এসো
পরস্পরের আগুন আর অঙ্গার_
প্রেরিত বার্তা উস্কিয়ে যায় এইসব অভিলাষ।
আমার সখার নদীর কিনারে বাস।
অদেখা অজানা বন্ধু আমাকে
জড়িয়ে ফেলছে অচেনা স্মারকে...
এবেলা আমার কেউ নেই পৃথিবীতে
কী যে আত্মীয়-পিপাসা জাগছে প্রাণে!
টানায়, পড়েনে, লীলায়, অবলীলায়
অমান্য করি প্রকাশ্যে ভেদরেখা
তোমাকেই তবে করে ফেলি আত্মীয়
আজিকে আমার বন্ধুর গায়ে রঙিন উত্তরীয়।
তোমার অধীনে, অধিগ্রহণে, আর শাসনের নীচে
একদিন জানি আমাকেও ঠিক ধীরে ধীরে টেনে নেবে।
আমাকে তোমার পালনের, অভিভাবনের ছায়া দিয়ে
পুরাপুরি দেবে ঢেকে।
তার আগে সখা নিজে
খুব অনুগত আর দ্রবীভূত থাকুক একটি দিন
আমার এই রচনায়
এই প্রশাসনে, প্রহারে এবং আজ্ঞা-অনুজ্ঞায়।
শুধু
একটি দিবসে সুশীল বালক থেকো,
পরদিন থেকে ধীরে ধীরে তুমি অবাধ্য হয়ে যেয়ো।
কিংবা না হয় হয়ে থেকো তারও পরে
জটিল আর দুর্বোধ্য অনেক দিন।
শুধু একদিন
আমার বন্ধু আমারই প্রভাবে আমার এই রচনায়
ছায়াসহ উড্ডীন।
ভিন্ন ভুবনে ভিন্ন নদীর বাঁকে
সখাটি আমার নদীর কিনারে থাকে।
দূরে তার দেশ কাঁপা-কাঁপা রূপকাহিনির মতো কাঁপে
আমার বন্ধু নদীর কিনারে থাকে।
উৎসভূমিতে ভূমিধস নামে, আর
একে একে সব অবলম্বন হচ্ছে প্রত্যাহার।
বাকল লুপ্ত, ভাঙা-ভাঙা ডাল, মরিচা-প্রাচীন দেহ,
পাখিপল্লবহারা_
তবুও যে এই দারুণ দূষণদিনে
দাঁড়িয়ে রয়েছি ধুধুতর নির্জনে_
শুধু তোমারই সমর্থনে।
তোমার পাঠানো এই ধরনের বিরল সমর্থনে।
এ রচনাটিও পুনর্বাসিত তোমারই উদ্ভাসনে।
আমার বন্ধু নদীনির্দেশ করে।
থমকে-যাওয়া অনেক প্রকার নদীকে সচল করে।
তোমার আমার সরল সূত্র, সহজ বাক্যগুলি
চাপা পড়ে আছে নিস্তারহীন তথ্যজটের নিচে।
ফুরিয়ে যাবেই একদিন ঠিক আবর্জনার দিন_
তেড়েফুঁড়ে যত জট আর জঞ্জাল
আমাদের কথা আলো দিয়ে যাবে জোনাকি-পরিভাষায়।
ঠিক একই দিনে একই ক্ষণে
তুমি আমি মিলে উধাও উড়ালে
চলে যাব এই দেহ ছেড়ে, এই যৌথরচনা ফেলে।
আশেপাশে কত জরুরি ভাণ্ড, মহান কীর্তি,
গুরুত্ববহ স্থাপনাসমূহ আর,
কথিত সিভিল দুনিয়ার।
ভাণ্ড ভেঙে ফেলে, স্থাপনা উল্টিয়ে, যত
কীর্তি একাকার কীর্তি গড়াগড়ি যাবে...
মারণে উচাটনে কালের সন্ত্রাসে, যত
বিরামচিহ্নের প্রভাবে প্রটোকলে প’ড়ে
ঊহ্য হয়ে যাব আমরা একদিন ধীরে
সন্ধ্যানদীতীরে সন্ধ্যাভাষাকূলে
রঙিন মেঘেদের সন্ধ্যাচ্যানেলের ভিড়ে।
তুমি আমি মিলে, প্রস্থান থেকে প্রস্থানে যাওয়া-কালে
পাল্টিয়ে যাব এক এক করে
রং-রূপ-ভাষা, ঘটনার_
দৃশ্যের থেকে দৃশ্যের।
রেডিও ঢেউয়ের চূড়ায় চূড়ায় চেপে,
হোক হঠকার, তবু একদিন ডানা
ভাসাব বহির্বিশ্বে।
ঠিক একই দিনে একই ক্ষণে
তুমি আমি মিলে উধাও উড়ালে
চলে যাব এই দেহ ছেড়ে, এই যৌথরচনা ফেলে।
অদেখা অচেনা বন্ধু আমাকে
জড়িয়ে ফেলছে রঙিন স্মারকে...
তুমি আমি মিলে, প্রস্থানকালে, চলো
যথাযথভাবে নদীনির্দেশ করে যাই
থমকে রয়েছে অনেক প্রকার নদী।
বড় বড় সব উত্থানগুলি আজ
স্তব্ধ নদীর কিনারে অবস্থিত।
স্তব্ধ নদীকে করে দিয়ে যাই চলো
একটি তুড়িতে সচল, কল্লোলিত।
ভিন্ন ভুবনে ভিন্ন নদীর বাঁকে
সখাটি আমার নদীর কিনারে থাকে।
দূরে তার দেশ কাঁপা-কাঁপা রূপকাহিনির মতো কাঁপে
আমার বন্ধু নদীর কিনারে থাকে।
যুগ যুগ ধরে আড়ালে আড়ালে
নদীর সূত্রে, মেঘের চ্যানেলে
বিছিয়ে চলেছি আমাদের যোগাযোগ।
এই কবিতাটিসহ
সখাকে, আমাকে, নদীর আলোকে বিবেচনা করা হোক।
২১. সার্কারামা
আজ এক রুগ্ন অগ্নিকুণ্ডের কিনারে বসে আছি জবুথবু
চারদিকে চলমান সার্কারামা
ছবিগুলি খুব দ্রুত নাচতে নাচতে আসে আর যায়।
কুড়ি ল বর্ষ আগে প্রকৃতির লোহিততন্ত্রে-তন্ত্রে তীব্র দাহ
অণ্ড-আত্মা থেকে দ্রুত প্লাবনের বেগে ঢেলে ফেলে জন্মশুক্র
এত বাঁধ, এত যে বিন্যাস,
শুক্রগতি থামছে না তবু
উর্ধ্ব থেকে প্রতিহত হয়ে আসে প্রতিনিধি, অগ্নিকোণে।
রেতঃস্রোতে অবিরল তাপ ঢালে সপ্তবহ্নিজাল
অসহ্য অসহ্য এত বর্ণবিকিরণ, এত বহুতল হীরকের সন্ত্রাস
এত বাষ্প, গন্ধ, পঞ্চভূতের এতটা পচন ও মন্থন!
স্রোতে ঘোরে মহাচক্র
চক্রে চক্রে পাপ, পুঞ্জীভূত ফেনা
ফেনা থেকে প্রাচীন ডুবোপাহাড়ের মতো
তীব্র জলধ্বনিসহ ঘুরে ঘুরে উঠে আসে নতুন কিরণ
গনগনে নতুন কীটাণু
সদ্যোজাত ছেচল্লিশ লাল ক্রোমোজমের উল্লাস।
বনবৃক্ষে বাড়বাগ্নি জ্বলে
ধুম্রপাকে হারিয়ে ফেলে পথ
উচ্চ স্বরে কাঁদতে থাকে ব্যাঘ্র ও ম্যামথ।
নদীর জলে ওড়ে ভস্ম, ওরে মৎস্য, কোথায় যাবি তুই
বাইসনেরা ধুলায় গড়ায়
পক্ষীরা সব পক্ষ গুটায়
দিসনে ঠোকর, পুড়বে কেবল পুড়বে রে চঞ্চুই।
হিংস্র নখরা বিকট দন্তুর
অতিকায় সব প্রাচীন জন্তুর
চিৎকার শোনা যায়
কাতরায়, তারা কাতরায়
শুধু আলকাতরার জলাশয়।
অরেঞ্জ নদীর তীরে নামল রাঙা প্রমিথিউস
মৃত্তিকা-স্তর কাঁপল মৃদু-মৃদু
অরেঞ্জ নদীর তীরে
ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত রঞ্জিত সব মানুষ।
রাত্রিগস্ত দুই ঈশ্বর মাদুরে ঝিমাতে থাকে
মাটির পাত্রে অস্থিপোড়ানো অঙ্গার, কার্বন
বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে এক নারী বৈতরণীর বাঁকে
ওই অবিনাশী পৃথিবীর মতো আইবুড়ো, কার বোন?
হাম্মুরাবি ভেসে ভেসে আদিকৃত্যে যায়
উঁচিয়ে রাখা তর্জনীতে তার
একটি ফড়িং উড়ে উড়ে শুধু বসতে চায়।
ঝাঁক বেঁধে মাঠে ভ্যান্ডালদল নামে
দষ্ট ফসল চিৎকার ছোঁড়ে দীর্ঘে এবং বামে
সাদা হিংসায় গতি থমকায়
প্রবাহিত মানুষের।
শস্যকীটের লাল থেকে ঝরে তেজ
পানকৌড়ির দিকে তেড়ে আসে বন্যবহ্নিলেজ।
সহসা শূন্যে সালফার-মুঠি উড়ে যায় ক্রীতদাস
বায়ুমণ্ডল পুড়ছে খুব তখন
আকাশে আকাশে রক্তকাণ্ড, হঠাৎ বিস্ফোরণ
ক্রীতদাস ফেটে বীজাণুর মতো অংখ্য ক্রীতদাস
আকাশের থেকে হাঁস ভেসে আসে হাঁস।
আকাশের থেকে হাঁস নেমে আসে হাঁস
মধ্যরাত্রে বুদ্ধ জড়ায় গাত্রে
পশমীর মতো ছাইরঙা সন্ন্যাস।
আকাশের থেকে হাঁস ভেসে আসে হাঁস।
সার্কারামায় আসে উপসংহার
স্থিত গৌতমও গতির আহার, বোধির পাশেই অগ্নিপাহাড়
জ্বালামুখে জ্বলে মানুষের স্নায়ু, মগজ এবং স্নেহ
নিথর রেটিনা ধরে রাখে সাত রশ্মির মৃতদেহ।
গড়িয়ে নেমে আসে খঞ্জ লুসিফার
কাঁধের ডানে বামে আণব শীতকাল
চুলের হিসহিসে পতিত ইতিহাস
অন্ধকার দিয়ে গঠিত প্রস্তর।
জাগছে কালে কালে ইচ্ছা অদ্ভুত
ধাতব মুদ্রার, বিরামচিহ্নের।
মেঘের কশ বেয়ে গড়িয়ে নেমে আসে
গড়িয়ে নেমে আসে খঞ্জ লুসিফার
অন্ধকার দিয়ে গঠিত শিলাকাল
প্রতিদ্বন্দ্বিতা টোটেম ও মনীষার।
এইবার এই অবেলায়, হে জ্ঞাতি, হে রহস্যের উপজাতি,
অন্তহীন শিবলিঙ্গের প্রহরী,
গলমান গ্রাফাইট-স্তরের ওপর গড়াগড়ি দাও
পুনর্বার পাপ করে ফিরে এস
পুনর্বার মুদ্রণযন্ত্র ভেঙে ভূমিসাৎ করে দাও হে অর্জুন
স্মৃতিভ্রষ্ট ব্যাধ, স্মরণকালের হে অবিস্মরণীয় ব্যাধি।
পঞ্চভূতের শাসিত নিয়তি
পৃষ্ঠদেশের ত আর তি
তীব্র ক্ষুধা ও খাদ্যের গতি
বিস্মৃত হও, বিস্মৃত হয়ে যাবে।
বৃত্ত ঘোরে মহাবৃত্ত
বিনাশ, মহামারী নৃত্য
মনুকুলের শেষকৃত্য
প্রাণী এবং পতঙ্গের সাথে।
শ্রবণ বধির করে দিয়ে বয় মহাবৃত্তের হাওয়া
বস্তুর থেকে বিকশিত ফের বস্তুতে ফিরে যাওয়া!
শ্রবণ বধির করে দিয়ে বয় মহাবৃত্তের হাওয়া
শ্রবণ বধির করে দিয়ে বয় মহাবৃত্তের হাওয়া
শ্রবণ বধির করে দিয়ে বয় ...... ....... .....
শ্রবণ বধির ...... ....... ....... ....... .......
শ্রবণ ...... ....... ....... ....... ....... ......
২২. নাট্যমালা, তামাশাপ্রবাহ...
বিষয়ীরা মত্ত হয়ে আছে কামিনী-কাঞ্চনে। বাইরে টালির ঘরের ওপর দিয়ে ধীর গতিতে হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে এক বিশাল বুদবুদ। ভাঙা ছাদে বসে তাকে ধরবার চেষ্টা করছে একটি বানর। বানরের চোখে রঙিন সানগ্লাস, মাথায় রঙিন ক্যাপ। মাটির দেওয়ালে ঝুলছে বিড়াল-হারানোর বিজ্ঞপ্তি-ভেজা বিড়াল। হারিয়ে গেছে। মোল্লাবাড়ির বিড়াল-দু-চার হরফ আরবিও জানত। মাটির দাওয়ায় বসে ছোট ভাইকে নজরফোঁটা লাগিয়ে দিচ্ছে একটি মেয়ে। মেয়েটির নাম সম্ভবত হৈমবালা, তবে আয়শাও হতে পারে। রোদেলা আকাশ, তার মধ্যেই ফের বৃষ্টি ঝরছে। বাচ্চারা ছড়া কাটছে-রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে, খেঁকশিয়ালের বিয়ে হচ্ছে। বড়রাও যোগ দিয়েছে তাতে। রোদ বাড়ছে, তাই রোদের চশমাও বাড়ছে-এটা না-হয় বোঝা গেল; কিন্তু টুপিও বাড়ছে, শুঁড়িখানাও বাড়ছে-এটা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। মাথা ঘামাচ্ছেন, কিন্তু কূলকিনারা হচ্ছে না। এদিকে আনারস পচে যাচ্ছে অতিবর্ষণে। দুর্নীতি কিংবা দেশপ্রেম-কোনোটাই কারো একচেটিয়া নয় বলে ফতোয়া দিচ্ছেন কেউ কেউ। কী এক অচেনা আকর্ষণে পর্বতের দিকে ধেয়ে চলেছে মেঘেরা, আর শেরপারা। মেঘেরা আকাশ দিয়ে, শেরপারা নিচের এবড়োথেবড়ো জমিন দিয়ে। পেছন-পেছন ছুটে আসছে তাদের বউবাচ্চারা। যেতে দিতে চাইছে না তারা। কিন্তু কে শোনে কার কথা! রাজার প্রিয় কবুতরটির ভীষণ অসুখ। কবুতরের জানের ছদকা হিসাবে জোড়া মহিষ কোরবানি দিচ্ছেন রাজা। একেই কি বলে ‘কবুতরের কল্যাণে মোষ বলি?’ হয়তো-বা। প্রচুর বাতাসা উড়ছে আজ খর্খরে বাতাসে। ছেলেটির মন ভেঙেছে মেয়েটি। মন ভাঙা তো মসজিদ ভাঙার শামিল। কীভাবে পারল সে!-মনভাঙা ছেলেটি ভাবছে সেটাই। বিদেশ-বিভূঁইয়ে কাজ করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে ছেলে মারা গেছে। খবর আসেনি, তবে খবর হয়ে গেছে ঠিকই মায়ের মনে। ‘বিদেশে বিপাকে যার পুত্র মারা যায়, পাড়াপড়শি জানার আগে জানে তার মায়।’ এই যে আমি মরে গেছি বিদেশ-বিভূঁইয়ে, মা-র মন হয়তো জানছে ঠিকই। আচ্ছা, কবরে মা-র মনও কি পচে যাচ্ছে ধীরে-ধীরে? মা শূন্য হয়ে গেছেন, আমিও মিলিয়ে যাচ্ছি শূন্যে। হয়তো নতুন এক মা, নতুন এক আমি এসে যাচ্ছে পৃথিবীতে। প্রকৃতি তো শূন্যতা সহ্য করে না বেশিক্ষণ। পূজারির কী এক কথায় খুব চটেছে পুরোহিত। রাগে তার টিকি আস্তে-আস্তে কেমন খাড়া হয়ে উঠছে। ভোটপ্রার্থীরা পাড়ায়-পাড়ায় তো বটেই, এমনকি বেপাড়ায় গিয়েও ভোট না চেয়ে দোয়া চাইছে। ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন টিপ্পনি কেটে উঠল-‘মজা মারবে ফজা ভাই/আমাগো খালি ঘুম কামাই।’ নেতার এক চেলা এক তরুণী বারবণিতার তির্যঙ্নেত্রী মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছে তির্যক চোখে। বণিতাটি বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বলছে, ‘মানুষে খালি নজর দেয়! বালাই ষাট!’ আবার বলছে, ‘যার-যার বাচ্চা, তার-তার কাছে আচ্ছা।’ আর ওই যে প্রেমিক-প্রেমিকা-যুগল, ওদের প্রণয় কিছুতেই মেনে নিচ্ছে না সমাজ। সমাজ বড় কড়া। তাই ওরা এক মরণে দুইজন মরবার পরিকল্পনা করছে। ওদের নিয়েই তো গান বেজে চলেছে যুগ-যুগ ধরে-‘এক মরণে দুইজন মরে/এমন মরা মরে কয়জনে//’। মরার পরে তাদের লাশ নাকি কেউ সৎকার করবে না, নদীতে ভাসিয়ে দেবে। দিক। নদী তো সর্বগ্রাহী, সর্বংসহা, সর্বসা সর্বসাক্ষী । তবে পানিতেও ওরা ভাসতে থাকবে, ভেসে চলবে যুগ-যুগান্তর। প্রেমের প্লবতাশক্তি খুব তীব্র। ফের বেজে উঠবে গান, ঢেউ তুলে আকাশে-বাতাসে-প্রেমের মরা জলে ডোবে না.../ও প্রেম করতে একদিন, ভাঙতে দুইদিন, এমন প্রেম আর কইরো না দরদী//। ওই যে একজন গ্রহণ-লাগা নারী, নিদারুণ অর্থকষ্টে ভুগছে, ভুগছে নিকষ-কালো অন্ধকারে। সুখী ও স্বচ্ছল মানুষেরা উঁকি দিচ্ছে তার ঘরে। তারা অর্থকষ্টে ভোগা দেখছে। কে যেন বলেছিলেন, অর্থকষ্ট এমনই এক কষ্ট, যা অন্যসব কষ্টকে কাছেই ভিড়তে দেয় না। কে বলেছিলেন যেন! এরই মধ্যে আবার সমস্ত ভোগবিলাসের চূড়া দেখা শেষ হয়েছে কারো কারো! চূড়ান্ত বিবমিষা জেগেছে এখন তাদের। রাজা হওয়ার পর যেমন সন্ন্যাসী হতে ইচ্ছা করে, তেমনই ইচ্ছা করছে তাদের। ভোগবৃরে মূল হচ্ছে প্রবৃত্তি; আর ফল, নিবৃত্তি। প্রবৃত্তির নিবৃত্তি ঘটে ভোগ সম্পন্ন হলে। শোনা যায়, ভোগ তার চূড়ান্ত চরিতার্থতা পেয়ে আসছে পরাক্রমীদের মাধ্যমে। মাইট ইজ রাইট। আদিকাল থেকেই নাকি তা-ই। আগে মতা ভোগ করত ক্ষত্রিয়রা, ব্রাহ্মণদের সহযোগিতায়, তাদেরই সাথে সহজীবিতায়। এখন বৈশ্যদের ভোগের কাল। আর ভোগের ভাগাভাগি? ক্ষত্রিয়দের সাথে। তবে যুগ পাল্টে দেবার চেষ্টা হয়েছিল। শুদ্রযুগ কায়েমের চেষ্টা। সফল হয়নি। পরে হবে হয়তো-বা। তখন কি আবার সহজীবিতা হবে বৈশ্যদের সঙ্গে? কি জানি! তা কী করে হয়? কিন্তু কেমন যেন ওরকমই একটা গন্ধ, ওরকমই একটা আলামত! যেটাই হোক, হোক গিয়ে। আপাতত কারখানার প্রোডাকশন লাইনে এক বিপুল কনভেয়ার বেল্টে চড়ে দ্রুত ভেসে আসছে নাটবোল্টবিজড়িত একেকটি কিম্ভূত-কিমাকার গিয়ার। শ্রমিকরা ঠুলি-আঁটা চোখে আফিম-খাওয়ানো বলদের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একেকজন একেক নাটে টাইট দিয়ে চলেছে ক্রমাগত। ওইসব বিচিত্র গিয়ার একসাথে জোড়ামোড়া লেগে কী-না-কী-এক অতিকায় অদ্ভুতকিম্ভূত কলকব্জা হয়ে না-জানি কোথায়-না-কোথায় চলে যাচ্ছে, মানুষগুলি জানে না কিছুই। জানার দরকারও নাই। টাকাই আসল কথা। কে বলেছে ‘অর্থই অনর্থের মূল’? কত টাকা, কেন টাকা, কী টাকা, কেমন টাকা, রং কী, জাত কী, অতশত জানার টাইম কোথায়? টাইম ইজ মানি, মানি ইজ গড, অ্যান্ড ইন গড উই ট্রাস্ট; দ্যাট্স অল। এমনিতেই টাকা এক কাগজি প্রতীক, এক প্রায়-ভার্চুয়াল-রিয়ালিটি, তার ওপর ফের তা নাকি আরও প্রতীকী হচ্ছে, আরও ভার্চুয়াল হচ্ছে। শালার প্রতীকস্য প্রতীক, ভার্চুয়ালের ভার্চুয়াল! হাতে-হাতে-র বদলে অনলাইনে-টাকার চলাচল, লেনদেন, বলাবল যাচাই, সবকিছু। শিঘ্রি নাকি অদৃশ্য হতে যাচ্ছে টাকা। ভুতের মতো, জ্বিনের মতো, কিংবা ঈশ্বরের মতো। ঈশ্বরের মহিমা পাবার জন্যেই নাকি এরকম বেপরোয়া ও অদ্ভুত হয়ে উঠছে সে। অদৃশ্য, কিন্তু অসীম মতাধর। খেল দেখাবে, লীলা চালাবে, আড়াল থেকে। অবশ্য দুর্জনদের, দুর্যোধনদের কেউ-কেউ বলছে, ‘ওরকম তো গুয়েরও অসীম ক্ষমতা; এই যে গু, কেমন নরম (মাঝে-মাঝে অবশ্য কর্কশও হয়), ক্ষীরের মতো, অথচ পারা দিলে পা কেটে যায়; গুয়ে বাড়ি দিলে গুজব ছিটকায়, এমনভাবে যে, ঘটবার আগেই ঘটনা রটে যায় তামাম দুনিয়ায়। (ঘটনা ঘটনা হয় যখন তা ঘটে/রটনা রটনা বটে যখন তা রটে//)। একমাত্র গুয়ের প্রভাবই স্থায়ী ও নিত্য, আর সব অনিত্যপ্রায়।’ তো? তাতে হলোটা কী? ধ্যাত্তেরি, ভাল্লাগে না আর। একদম ফেড-আপ। একেবারে ৩৬০ ডিগ্রি ফেড-আপ। এত যুক্তি-তর্ক-আর্গুমেন্ট! কী হয় এত যুক্তি-তর্কে? এশেকে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। ওদিকে লীলাকারগণ চালিয়েই যাচ্ছে নিত্যলীলা। নিত্য ধরে ধরে লীলা, ফের লীলা ধরে ধরে নিত্য...। আড়বাঁশি বাজিয়েই চলেছে কলির কৃষ্ণকুল। সুরের সম্মোহে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়িমরি ছুটছে গোপ-গোপিনীরা। ধাবনধর্মই নাকি এ-যুগের ধর্ম। টাকাই এ-জমানার ঈশ্বর (দুঃখিত, কথাটা বোধহয় আগেও বলা হয়েছে একবার)। সকাল হতে-না-হতেই নানা জাতের সব ইঁদুর বাঁশির চুম্বকটানে মন্ত্রচালিতের মতো বিচিত্র বাক্শো ও খোঁড়ল থেকে, খোপ ও খুপড়ি থেকে, গর্ত ও গহ্বর থেকে, চতুর্দিক থেকে বেরিয়ে নানান পথ ধরে হুলুস্থুল করে ছুটে এসে শেষে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে ইতস্তত ছড়িয়ে রাখা জালে, ফাঁদে। কৃষ্ণের হাজার গোপিনী, রাধার কৃষ্ণ ভিন্ন আর কেউ নাই। মূরলিধরেরা ইতোমধ্যেই বলতে শুরু করেছে, উই আর আলফা, অ্যান্ড উই আর ওমেগা, উই আর অল। প্রলেতারিয়েতেরও নাকি রূপান্তর ঘটছে এই জমানায়। ধারণ করেছে বাহারি এক নাম-প্রিক্যারিয়েত। পাচ্ছে অদ্ভুত-বিচিত্র-বাহারি সব কাজ। মানুষ পর্যবসিত হচ্ছে রকমারি সংখ্যায়। সংখ্যাদের নির্বিকার বুকে ধরে থাকছে বিচিত্র সব কার্ড, হরকিসিম সব দলিল। সংখ্যার নিরঙ্কুশ শাসন, সংখ্যার অকহতব্য অত্যাচার...সংখ্যা ও কার্ডের কাঁটাতারে একেবারে জড়িয়ে-মড়িয়ে আচ্ছামতো আটকা-পড়া নিস্তারহারা প্রাণ-জেরবার মানুষ। সারা জাহানকে পুরাদস্তুর কয়েদখানা বানানোর প্রকল্প প্রায় শেষ। কয়েদির সারা শরীর ও মন জুড়ে ঝুলছে খালি নম্বর আর নম্বর, কার্ড আর কার্ড। কয়েদি খালাস পাবে ওই একবারই...তখন ওই নম্বর-টম্বর, কার্ড-ফার্ড সব খুলে ফেলে পুরা দিগম্বর হয়ে দে দৌড়, ঝেড়ে দৌড়, দৌড় দৌড়...দিগন্তের পানে...তো ওইখানেও আরেক জ্বালা, ভূগর্ভস্থ আরেক কারাগার! তবে রগড় আছে। সেখানে আরেক‘মনোমোহন বশীকরণ রাধারমণ রায়/মদ্যসহ আড্ডা মারে, অট্টহাস্যে বলে,/রগড় যদি বুঝতে চাস, মাটির তলে আয়//।’ কাঁটাতারের এত-এত জটাজটিল জট, গিঁট ও গিট্ঠু...মাঝে-মাঝে অতিচালাক শিয়ালও ফাঁদে পড়ে, ছাড়ে উপর্যুপরি ত্রাহি আওয়াজ। সেরকম কিছু আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। কেউ-কেউ বলছে, শিয়াল হচ্ছে হাইপার-অ্যানিম্যাল, আবার কেউ বলছে, হাইপো-...। ক্যারক্যার আওয়াজ উঠছে। ও কিছু না, ইতিহাসের ব্যাকল্যাশের শব্দ। থার্মোমিটার, ব্যারোমিটার, জ্বরাঙ্ক, প্রেষাঙ্ক সব ওঠানামা করছে একযোগে। রক্তমোণ হচ্ছে। ঘোরতর। ধস নামবে নাকি একেবারে! শোনা যাচ্ছে সাজ-সাজ রব, থেকে-থেকে মারণকলের কলরব। মহাহুলুস্থুল। কৃতশপথ শত্রুরাও মিত্র হচ্ছে, আবার পরম মিত্রদেরও কেউ-কেউ শত্রু। শাকাহারীরা কি হয়ে উঠছে বেঘোর মাংসাশী? আর মাংসাশীরা নীরব নিরীহ তৃণভোজী? কে জানে! তবে এই যে শো চলছে, অভিনীত হয়ে চলেছে এই যে নাট্যমালা, তামাশাপ্রবাহ, এ নাকি চলতেই থাকবে নিরন্তর। কোনো দাঁড়ি-কমা-বিরামচিহ্ন নাই নাকি এর। মনে হচ্ছে, কে যেন নেপথ্য থেকে বলছে-দ্য শো মাস্ট গো অন। ইট ওন্ট্ স্টপ। নো ওয়ে, নেভার। এইসব গায়েবি আওয়াজ নাকি আগে শোনা যেত, কেউ-কেউ বলেন সেমেটিক, কেউ-কেউ বলেন আর্যভাষায়। এখন শোনা যাচ্ছে পরিষ্কার ইয়াংকি জবানে। ভরকেন্দ্র সরে সরে যাচ্ছে আওয়াজের, ওঙ্কারের। পূর্ব থেকে পশ্চিমে। তবে আস্তে-আস্তে কি আবার সরে যাবে পশ্চিম থেকে সুদূর পূর্বে, কালের আহ্নিক-বার্ষিকের নিয়ম মেনে?