শিল্পকে মনে করি যথেষ্ট ডার্ক হতে হয়: আল- ইমরান সিদ্দিকীর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Sep 23, 2012 9:22:36 AM

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

আল- ইমরান সিদ্দিকী: আমি যে সময় পার করে এসেছি,আজ যা কিছু আমার দৈনন্দিনতা এবং যা কিছুকে দৈনন্দিনতার ভেতর টেনে আনতে চাই,সবই আমার যাপনের অংশ, অংশ আমার অস্তিত্ব'র ।এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন "যা কিছু ঘটে গেছে তাই কেবল অস্তিত্ব নয়, অস্তিত্ব মানবিক সম্ভাবনার রাজ্য, মানুষ যা হয়ে উঠতে পারে, মানুষ যা করার যোগ্য তাই অস্তিত্ব"। কবিতা ছাড়া আর কিছু কি আছে যা অস্তিত্বকে, যাপনকে এমন বিচিত্রতায় ধরতে পারে কখনো মূর্ত কখনো বিমূর্তরূপে! আমি লিখি কারণ কবিতায় আমার অস্তিত্বকে সটান দেখি।

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

আল- ইমরান সিদ্দিকী: আমার নিজের যা করা উচিত বলে মনে হয় তা হলো মৌন থাকার চেষ্টা করা। এ এক ধ্যান। আর সব প্রস্তুতি এর ভেতরেই সম্পন্ন হতে থাকে। প্রকৃত শিল্প গোপনীয়তাকে ধারণ করে, নীরব থাকে। আমি যদি তেমন না হই তাহলে আমার প্রতিবিম্ব তেমন হবে কিভাবে? আমার ব্যক্তিত্ব আমার কবিতায় বিম্বিত হয়। আরো যা কিছু বুঝতে শিখেছি আমি, তা হলো, কেউ নিজের বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে পারেনা। ফলে নিজের আর্কিটাইপ বোঝাটা জরুরি। অবশ্যই আপনার আর আমার আর্কিটাইপ এক নয়? চিহ্নিত করা গেলে হাতে যা আসে তা হলো ভাষা। কারোটি গ্রাসে উদ্যত হয়, কারোটি মোহনমন্ত্র; টেনে নেয়, কারোটি আবার কিছুই করেনা, যেন নির্বিকার, তার অন্তঃস্থ সৌন্দর্য শ্রম দাবি করে। দেখেছি লোকে কবির ভাষাকে চিহ্নিত করে তার ডিকশন, ক্রিয়াপদের ব্যবহার, বাক্য ভাঙা-গড়ার ধরন ইত্যাদি দিয়ে! তাই যদি হয়, তবে প্রশ্ন থাকে, আপনি একজন চিত্রশিল্পী, একজন মিউজিশিয়ান বা একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার ভাষাকে কিভাবে চিহ্নিত করবেন? আমরা যে বলি ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’; তার তো ক্রিয়াপদ নেই, নিজস্ব ডিকশনও নেই। ভাষা সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা পেতে চাই আমি। নিজের স্টিমুলাস জানা দরকার অর্থাৎ যা কিছু আমাকে উদ্দীপ্ত করে, উত্তেজিত করে সেসব চিহ্নিত করা। এসব প্রস্তুতির অংশ। এসবই আলাপচারিতার বিষয়। প্রস্তুতি তো সারাজীবনের। আর যা কিছু সব তো চলমান প্রক্রিয়া, যেমন-পাঠ। শুধু সেসব নিয়েই কথা বলতে নেই; তাতে প্রত্যেকের নিজের দীনতা ও পাঠসর্বস্বতাই প্রকাশ পায়।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

আল- ইমরান সিদ্দিকী: এইমুহূর্তে যে কেউ কবিতা লিখছে তারা আমার সমসাময়িক। তেমন কবিতাই আমার অধিক পছন্দ যেখানে রেখা, রং, গতি-স্থিতি, মৌনী, আলো-ছায়ার সম্মিলন এক সঙ্গিতময়তার ভেতর দিয়ে কন্টেন্টকে গৌণ করে দিয়ে ফেনোমেনা তৈরি করে, আর তাতে পরমের আভাষ ফুটে ওঠে। সৃষ্টিবিশ্বের মতো কবিতাকেও বহুমাত্রিক হতে হয়। তারাই মূলত আমার কবি যাদের কবিতা চেনা বাস্তবতাকে ভেদ করে এক পরম বাস্তবতায় দাঁড় করিয়ে দেয়।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

আল- ইমরান সিদ্দিকী: পরপর করা আপনার এই দুটো প্রশ্ন এক করলে যা দাঁড়ায় তা হলো, আপনি আমার ষ্ট্যান্ডপয়েন্ট জানতে চাচ্ছেন? শিল্পকে মনে করি যথেষ্ট ডার্ক হতে হয়। অপার সৌন্দর্য ও রহস্যময়তা। কবিতা আমার কাছে: ‘’কিছু তার দেখি আভা,কিছু পাই অনুমানে,কিছু তার বুঝি না বা’’। এ হলো সৃষ্টিবিশ্বের শিল্পসত্য। চিরায়ত, মহত্তম শিল্পবিশ্বাস। কেননা এটি পরমের। সৃষ্টির খেলায় নামলে পরমকে অনুসরণ করাই শ্রেয় মনে করি, কেননা, পরম তো আদিকবি, কবিগুরু! অভিজাত বিশ্বরূপ বিম্বিত হয় মানুষের শরীর-মনে, আটকে যেতে চায়। সমগ্র শরীর যখন বেজে ওঠে, বলি, " উচ্ছ্বসিল মম তনুবীণা "। কবিতায় সেই সঙ্গীতময়তা থাকতে হয় যা আলোড়িত করবে। কি এই সঙ্গীতময়তা? একি শুধুই ধ্বনিমাধুর্য? নাকি কবিতায় ব্যবহৃত সকল উপকরণের পারস্পরিক যৌনতা, যা ঐকতান তৈরী করে? যা হোক, এমন সব প্রশ্নের ভেতর দিয়ে আমার ভেতর ক্রমাগত ভাঙা-গড়া চলতে থাকে। তবে এটুকু বলতে পারি, কবিতায় নন্দনের ঘাটতি থাকলে সেই কবিতা আমাকে তেমন টানেনা। আমি এও বিশ্বাস করি, কবিতা অনেক রকমের; এবং নিজের গ্রহণক্ষমতাকে বাড়াতে চেষ্টা করি সবসময়।

দুপুর মিত্র: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

আল- ইমরান সিদ্দিকী: নব্বই এবং শূন্য, দুই দশকেই অনেকে খুব ভালো লিখেছেন। পাঠক তো শেষ পর্যন্ত নিরীক্ষা দেখে না, বরং নিরীক্ষার ফলাফল দেখে। সেভাবে দেখলে দুই দশকেই অনেক ভালো কবিতা লেখা হয়েছে।

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

আল- ইমরান সিদ্দিকী: '৪৭ পরবর্তী সময়ে এপারে যতো কবিতা লেখা হয়েছে তাকেই হয়তো বাংলাদেশের কবিতা বলছেন। এর বৈচিত্র্যকে মাথায় রাখলেও আমি তেমন কোনো ফারাক দেখিনা। বিক্ষুব্ধ সময়ে অনেকটা উচ্চকিত হয়েছে এপারের কবিতা। এছাড়া তেমন কোনো বিভেদ নেই। ম্যান টু ম্যান ভ্যারি করার মতো কিছু টুকটাক ফারাক আছে আর্থ-সামাজিক অবস্হার কারণে মূলত।

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

আল- ইমরান সিদ্দিকী: ব্লগ বা ফেসবুক লেখকদের মাঝে শেয়ারিং বাড়িয়েছে। যারা লিখছে ভার্চ্যুয়ালে তাদের লেখা সহজেই চোখে পড়ছে, যারা নেই এতে অথচ ভালো লিখে তাদের কবিতা শেয়ার করে অনেকে। বইপত্র ইত্যাদির লেনদেন বেড়েছে। সব মিলিয়ে ভালো। আর আপদের কথা বললে তো বলি মন্দের কোথাও শেষ আছে কি?

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

আল- ইমরান সিদ্দিকী: লিটলম্যাগ যদি ব্লগের প্রিন্টেড ভার্সন হয় অথবা হয় তার চেয়ে নিম্নমানের তবে তো ব্লগই ভালো। তবে "লিটলম্যাগ" যদি লিটলম্যাগই হয়, অর্থাৎ গর্বভরে লিটলম্যাগ সম্পর্কে যা বলা হয়, তেমন হলে তা অনেক ভালো। অনেক বেশি পরিশ্রুত হয়।

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

আল- ইমরান সিদ্দিকী: দৈনিকের সাহিত্য বিষয়ে আমার তেমন কোনো পর্যবেক্ষণ নেই। মুখের সামনে না পেলে সচরাচর দেখা হয়না সাহিত্য পাতা। যতোটুকু যা বুঝেছি ভালো-মন্দ মিলিয়ে ছাপে, রুচির দায়ে, পেটের দায়ে যখন যা ছাপতে হয়। দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদক তো একই সাথে সম্পাদক ও চাকুরিজীবী।