নিজস্ব গল্পভাষা তৈরির প্রবল ইচ্ছা নিরীক্ষামূলক গল্প লেখায় অনুপ্রাণিত করে: রুমা মোদকের গল্প ও তার নিরীক্ষা

Post date: Oct 19, 2017 2:10:11 AM

পিতৃপরিচয় গল্পটি আমি লিখি ২০০৩ সালে। নতুন উদ্যমে তখন গল্প লেখা শুরু করেছি, প্রথম যৌবনের তারল্যে লেখা অপরিণত কাব্যচর্চাকে বিদায় জানিয়ে মোটামুটি স্থিত হয়েছি গদ্যচর্চা অব্যাহত রাখার বাসনায়। সেই বাসনার প্রথম প্রচেষ্টা পিতৃ-পরিচয়। থার্ড পার্সন ন্যারোটিভে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভংগিতে বলা গল্পটির অবশ্যই একটি আ্যলগেরিকাল উদ্দেশ্য ছিলো। রুমা মোদক বলছিলেন। তার মতে -

নিজস্ব একটা গল্পভাষা তৈরির প্রবল ইচ্ছা এমন নিরীক্ষামূলক আংগিকে গল্প লেখায় অনুপ্রাণিত করে। সমকালীন সাহিত্য পাঠ আমাকে উৎসাহিত করে। এবং শ্রম, অভিজ্ঞতা ও ইচ্ছের পারস্পরিক বুননে গল্পটি লেখা শুরু করি।

গল্প কিভাবে শুরু করেন, কিভাবে তৈরি করেন-এসব প্রসঙ্গে উনি বিস্তারিত জানালেন-

গল্পটি আমি শুরু করি উপসংহার থেকে, যেখানে প্রচলিত ধারায় কোন রচনা উপসংহারে শেষ হয়। এবং এই উপসংহারে দুটি পরস্পর ঘটনা পাঠককে প্রস্তুত করতে চাই মূলগল্পে একটি অপ্রচলিত অভিজ্ঞতার সাথে তার পরিচয় ঘটাতে। শুরুতে ঘটনাটি এবস্যার্ড। যেখানে দেখা যায় চলতি ট্রেনের নীচে ঝাঁপ দিয়ে নিজের ‘আত্মহনন প্রক্রিয়া’ সমাপ্ত করে একটি যুবক। এবং তাকে নিয়ে স্বভাবতই গ্রামবাসীর চলমান আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমেই পাঠককে অবগত করাতে চাই, গল্পের অন্তর্গত বক্তব্যটি। তা হলো এই, ছেলেটির যে ‘আত্মহনন প্রক্রিয়া’ তা মূলত সমাপ্ত হয়েছে ঠিক। কিন্তু তা তার সত্যিকারের আত্মহননের মধ্য দিয়ে নয়। বরং তীব্র ভাবে বেঁচে উঠার মাধ্যমে।

এই বেঁচে উঠাও তার অভিনব। ক্রমাগত নিজের কাছে নিজের পরাজিত হবার এই অসহ্য আত্মহনন প্রক্রিয়া থেকে বেঁচে উঠার প্রবল আকাংক্ষায় সে এক অপ্রকৃতস্থ বীরাংগনা নারীর মাঝে আবিষ্কার করে প্রেমিকা সুদীপাকে, তাতে উপগত হয়। এবং নিজের ঔরসজাত ও বীরাংগনার গর্ভজাত সন্তান নিয়ে সে দাঁড়ায় নিজের পিতার সামনে। এক সন্তানের পিতৃপরিচয় নিয়ে সে মুখোমুখি হয় অন্য পিতৃপরিচয়ের। গত জীবনের সকল কেঁচোসুলভ আপোসকামীতার প্রায়শ্চিত্ত হয় এই একবার পিতার মুখোমুখি মেরুদণ্ডে দণ্ডায়মান মুখোমুখি দাঁড়ানোতে। লেখক হিসাবে এ হয়তো আমারই অন্তর্গত বাসনা। রাজাকারের সন্তানকে প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে বেঁচে উঠার পথ দেখানো।

উনি তার লেখা পিতৃ পরিচয় গল্প নিয়ে বলছিলেন। উনি বলছিলেন-

মূলত স্কুলে জনৈক শিক্ষকের কাছে যেদিন সে প্রথম তাঁর পিতার পরিচয়টি জানতে পারে,এবং পিতার কাছে তার ব্যাখ্যা জানতে চায়। ফলশ্রুতিতে যখন সেই শিক্ষকের চাকরিটি চলে যায়, তখন থেকেই শুরু হয় যুবকের আপোস তথা আত্মহনন প্রক্রিয়া। এভাবে জীবনের নানা বাঁকে, বন্ধুদের আড্ডায়, প্রেমিকা সুদীপার আহবানে নানা প্রেক্ষিতে একের পর এক আপস তথা আত্মহনন একসময় তাকে ক্লান্ত করে। কেঁচো থেকে মেরুদন্ডী মানুষ হয়ে উঠতে চায় সে। পিতার সহযোগী শিল্পপতি রাজাকার বন্ধুর কাছে চাকরির জন্য না গিয়ে নিজের সন্তানের পিতৃপরিচয় দাবি করে খন্দকার বাড়ির উত্তরাধিকার হিসাবে। এবং উপরে ব্যক্ত হয়েছে সেই সন্তানের মাতৃপরিচয়।

লেখক হিসাবে সকল অসম্ভবের গণ্ডি ভেংগে সম্ভবের দিগন্ত উন্মুক্ত করতে বোধকরি লেখক পারে। লেখক পারে সকল বাস্তবতার দেয়াল ভেংগেচুরে অবাস্তব কোন নির্মাণকে বাস্তবসম্মত করে তুলতে। গল্পের আগাগোড়া ন্যারেটিভে একটি জাতির ইতিহাসের কলংক আর সেই কলংকমুক্তির আকাংক্ষাতেই আবিষ্ট থেকেছে আমার লেখক সত্তা। মনে রাখা প্রয়োজন গল্পটি সেই সময়ে লেখা যখন দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারটি বলতে গেলে অকল্পনীয়।

গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় আজকের কাগজের সাহিত্যপাতা- সুবর্ণরেখায়, ২০০৪ সালে। আসুন পাঠক আমরা সেই গল্পটি পাঠ করি-

রুমা মোদক এর গল্প :পিতৃপরিচয়

উপসংহার,

ঘটনাটা ঘটতে পারতো এমন—কৃষ্ণপুর গ্রামের মাইল ছয়েক দুরে রেলক্রসিং এর সামনে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সী একটি যুবকের ছিন্নমস্তকের লাশ পড়ে থাকতে দেখে বেশ বড় একটা জটলা জমে গেছে। ইস কি সুন্দর ছেইলাটা...আহারে মইরলো কেন...। ইস কেমন মার কোল খালি কইরা মইরলোরে... ইত্যাদি বাক্যই থারে ছড়িয়ে দিয়ে ভাঙা হাট থেকে ফিরতি মানুষগুলো হাতে মাছ তরকারি লন্ঠন আর লুঙ্গির কোঁচরে টাকাটা ভাল করে গুঁজে দাঁড়িয়ে পড়েছে ভীড়ে। একটা বাচ্চা ছেলে লাশটি দেখেই হড়হড় করে বমি করে ফেললো, দুর্বল চিত্রের দু একজন একবার লাশটি দেখে পুর্নবার দেখার সাহস করল না। দৌড়ে পালাতে লাগল গ্রামের দিকে আর ভাবতে লাগলো খণ্ডিত মস্তকের বীভৎস যুবকটি উঠে দাঁড়িয়েছে, দৌড়ে আসছে পিছু পিছু।

পিছনে না তাকিয়ে তারা প্রাণপণে দৌড়াতে থাকলো আরো জোরে,সুপারি গাছের মাথায় অমাবস্যার গোধূলি, সম্পন্ন ঘরে জ্বলে উঠা হারিকেনের আলোতে নিমিষেই আশেপাশের গ্রামগুলোতে ঘটনার টেগেলো আর সন্ধ্যা গাঢ় হবার সাথে সাথে বাড়তে থাকলো কৌতূহলী মানুষের ভিড়, খবর পৌঁছে গেলো কাছের থানায়। ওসি সাহেব কাগজের পোঁটলা খুলে বাকী পানখানা গালে ঠেসে ফোর্সকে প্রয়োজনীয় প্রস্ততির আদেশ দিয়ে স্বগতোক্তি করলো শা-লা!কাপুরুষ! পুনঃপুনঃ আত্মহননে ক্লান্ত যুবকটি রেলক্রসিং এর চলন্ত ট্রেনের নিচে সমাপ্ত করেছে তার আত্মহননপ্রক্রিয়া। একেবারে যথার্থ কাপুরুষের মতো !

কিন্তু বাস্তবে ঘটনাটা ঘটলো অন্যরকম—মূলত যুবকটি পুরুষ হয়েছে। এবং সে ভাবছে যৎকিঞ্চিত মানুষও। অমাবস্যার গোধূলি যখন সুপারী গাছের মাথায়, সম্পন্ন ঘরে জ্বলছে হারিকেন তখন পুরুষটি দাঁড়িয়ে থাকলো খন্দকার বাড়ির কাচারি ঘরের ভিতর, তার কোলে একটি নবজাতক। গর্ভস্থ ঘুম না কাটার কারণে জাতকটি চিৎকার করে তার উপস্থিতি জানান দিতে পারছে না এবং এই জাতকটির পিতৃপরিচয় নিয়ে পুরুষটি দাঁড়িয়েছে নিজের পিতৃপরিচয়ের কাছে। কাচারিঘরে খোরশেদ খন্দকার গম্ভীর বসে আছেন একখানা মেহগনি কাঠের কারুকার্য খচিতচেয়ারে। চেয়ারখানা হিন্দু জমিদার বাড়ি থেকে ১৯৪৭ সনে লুট করে আনা। রাতের অন্ধকারে সর্বস্ব ফেলে জমিদার দেশত্যাগের পর, ভোরের দিকে খবরটা রটে যেতেই জমিদার বাড়িতে লুটের হিড়িক পড়ে। ফজরের নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় সম্পন্ন গৃহস্থ খোরশেদ খন্দকার কিছুটা প্রস্তুতির অভাবে এবং কিছুটা চক্ষুলজ্জার কারণে দু’একটা টুকটাক জিনিস ছাড়া বিশেষ কিছু আনতে পারেন নি। সে আফসোস এখনো মনে রয়ে গেছে তার। ভিতর বাড়িতে তার আসার খবরটা পৌঁছার পর ঘরে ঘরে কবরের স্তব্ধতা নামে, খোরশেদ খন্দকারের প্রথমপক্ষের স্ত্রী পান খাওয়া ভুলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় তাকিয়ে থাকেন খবর বিতরণকারী কামলাটির দিকে। হারিকেনের আবছা আলোতে তার প্রতিক্রিয়া ঠিক স্পষ্ট হয় না। আর বাইরে আলতাফ খন্দকার নামের পুরুষটির অন্তর্জগতে তখন আত্মজয়ের আনন্দ। খোরশেদ খন্দকারের প্রথম পক্ষের প্রথম ছেলে আলতাফ খন্দরকার আজ বেঁচে উঠেছে। ক্রমাগত আত্মহননে ক্লান্ত পুরুষটির হৃদয়ে আজ বেঁচে ওঠার আনন্দ...।

ভূমিকা,

পলেস্তারা খসা দেয়ালে রং চটা ঘড়িটা কাঁটাগুলোকে সমকোণে রেখে যুবকটি যখন রাস্তায় নামে তখন মাথার উপরে জ্যৈষ্ঠের সূর্য আর মগজের ভিতরে আত্মহননস্পৃহা। আত্মহনন...আত্মহনন—শব্দটি ভেসে বেড়ায় মগজের পানা ডোবায়। ভেসে বেড়াচ্ছে এক যুগ ধরে। কতবার আত্মহনন করেছে সে একযুগে... আজ সকাল থেকেই আজ মেজাজ খিঁচড়ে আছে যুবকটির। বদ্ধঘরের গুমোট গায়ে মেখে যুবকটি সকালে গোসল খানার সামনে দাঁড়ায় এবং আবিষ্কার করে তার লুঙ্গিটি কোথাও নেই। গতকাল গোসলের পর এটি বারান্দায় দেয়া হয়েছিল। সন্ধ্যা রাতে কেউ সেটি ঘরে আনেনি, সম্ভবত মাঝরাতে যখন সে মেসে ফিরেছে ততক্ষণে সেটি ছিঁচকে চোরের দখলে। এমন ধারণা প্রথমবারের মত মেজাজ খিঁচড়ে দেয়ার পর গোসল খানার সামনে গেলে সে পুনরায় আবিষ্কার করে গোসলখানার সামনে মেস মেম্বারদের লম্বা লাইন। অন্তত চারজনের। প্রাকৃতিক ডাকের এক বিশ্রী অস্বস্তি দ্বিতীয় বারের মতো তার মেজাজ খিঁচড়ে দেয়। তৃতীয় বারের মতো আত্মহননের স্পৃহা তীব্র হয় যুবকের। দ্বিতীয় আত্মহননটি করেছে সে পাঁচবছর আগে। সেকেন্ড ইয়ার দর্শনের যুবকটি দুপুরে ভাত ঘুম যেতো। সূর্যসেনের ফোরসিটেড রুমে। হালকা বিকেলের আলো গোলাপি উড়নায় জড়িয়ে বাতাসে বেলীফুলের সুবাস মেখে সূর্যসেনের চারতলায় নামত ও ফুলপরী সুদীপা, সুদীপাবসু... কতদিন সেই বেলীফুলেরগন্ধ পায়নি যুবকটি,পৃথিবীতে বেলীফুল ফোটেনা এখন,তৃতীয়বারের মত আত্মহননের সিদ্ধান্তটি স্থিত হয় ভিতরে ,পৃথিবীর কোথাও বেলীফুলের সুবাস নেই। ঘন্টাখানিক পর বাথরুমের দখল দারিত্ব পাওয়া গেলেও ভিতরে তখনকার বালা,কোন রকমে সারা যায় প্রাকৃতিক কাজটুকু,নিজের গায়ের গন্ধই ভিতরে প্রচণ্ড বিবমিষা, পথে নামে যুবকটি,গায়ের কয়েক পরত মাটি আর পলেস্টার শার্টে লেপ্টে থাকা ঘামের দুর্গন্ধ... কোথায় যেন বেলীফুল ফুটতো? সূর্যসেন এর চারতলায়। রুমমেটদের চোখ টাটাতো,শালা কপাল একখান, দীর্ঘশ্বাস বিদ্ধ করতো যুবকটিকে,পরিতৃপ্তি আক্রমণ করতো যুবকটিকে,সুদীপাবসু, বেলীফুলের সুবাস, দুই ভ্রুর মাঝামাঝি জ্বলজ্বল টিপ,যখন-তখন সূর্যসেন... বোকা কি ছিল যুবকটি? ফুটপাত বলতে ঢাকা শহরে এখন আর কিছু নেই। চেতনা গ্রাস করে বেলীফুল,রাস্তার পাশে আর্বজনা-স্তুপ, ঘ্রাণেন্দ্রিয় গ্রাস করে বেলীফুল, ঢাকা শহরের ফুটপাত হকারদের দখলে,আপেলকমলা, গেঞ্জি-ট্রাউজার, অমনোযোগে পাশকেটে চলা প্রায় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। অমিতদের ভাষায় সর্বহারা দখল করে নিয়েছে ফুটপাত,ভোট দেয় ওরা, বেঁচে থাকার অধিকার ভোগ করে। বস্তি ভাঙবে কেন? হকার উচ্ছেদ হবে কেন? অমিত বলতো- ওরা যাবে কোথায় ?অমিত নিজেকে বিপ্লবী ভাবতো। বি-প্ল-বী। মগজের কোষে আবার শব্দটি সাঁতরে বেড়ায়-- বিপ্লবী। বিপ্লবী নয় যুবকটি, হতে পারেনি। শুধু বিপ্লবীরাই মানুষ- অমিত বলতো। মানুষ কি যুবকটি? না আপাদমস্তক একটা কেঁচো, মেরুদণ্ডহীন... এই কেঁচোটিকে প্রেমপত্র লিখেছিল সুদীপা। মানুষভেবে। বিলবোর্ডে চোখ আটকে যায় হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের নায়িকার মতো ‘পাত্রী চাই’, জুয়েলার্সের বিজ্ঞাপন, শালা বিজ্ঞাপনের কি বাহার! মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে—কার কবিতা যেন! জয়গোস্বামী,শঙ্খঘোষ? মনে পড়ছে না!গুষ্টি মারি কবিতার, এই কবিতা-কবিতা, জয়গোস্বামী, শঙ্খঘোষ, পূর্ণেন্দুপত্রী—তুমি কি আমার সর্বনাশ করনি শুভঙ্কর...সুদীপার মাথাটা খারাপ করে দিয়েছে। নইলে রাজাকার যার পিতৃপরিচয়, শিকড় যার টাট্টিঘেরা রক্ষণশীলতায়,তাকে কেন প্রেমপত্র লেখবে সুদীপা বসু? বাপের হিসেব করে পাঠানো টাকায় ছ্যাঁচড়ামি করে চলা যুবকটি কোনদিন একটা গিফটওতো দিতে পারেনি সুদীপাকে। নিজেরমেরুদণ্ডহীন কেঁচো স্বভাবকে জয় করে মুখোমুখি হবার সাহসও সঞ্চয় করতে পারেনি, অন্তত:একদিন, যেদিন সুদীপার বেলীফুলের গন্ধ মাখানো চিঠি আবিষ্কার করেছিল সূর্যসেন এর টেবিলে। দ্বিতীয়বারের মত কেঁচো স্বভাবটি সত্যি হয়ে উঠলো সেদিন। নিজের মেরুদণ্ডহীন কেঁচো স্বভাবটি সে আবিষ্কার করেছিল কৈশোরে,কৈশোরই তো বলে সময়টাকে। বয়স১৩-১৪ যখন। রাজাকার শব্দের আভিধানিক অর্থ স্বেচ্ছাসেবক। অথচ এই পবিত্র শব্দটি কলঙ্কিত হয়েছে ’৭১ এ। এভাবেই পাঠ শুরু করেছিলেন আতাহার আলী মাস্টার। সমস্যা ছিল না, যদি তিনি উদাহরণ না খুঁজতেন। নির্ভীক সাহসী হিসেবে তার খুব খ্যাতি ছিল গ্রামে তেমনটিও নয়। নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কিংবা রাজাকারের কারণে কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাও নয়, তবু উদাহরণ হিসাবে খোরশেদ খন্দকারের নামটা উচ্চারণ করে ফেলবেন স্পর্ধাভরে কিংবা বোকামি করে। রাজাকার হওয়া কতটা অপরাধ কিংবা অপমানের, তা যতটা না উপলব্ধি করলো স্যারের ব্যাখ্যায়, তার চেয়ে বেশী উপলব্ধি করতে পারতো আতাহার আলী স্যারের চাকরিটা চলে যাবার পর’। খোরশেদ খন্দকার ৭১ এ রাজাকার বাহিনীর ডাকসাইটে সদস্য ছিলেন বটে, কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পর ‘রাজাকার’ বিশেষণে তাকে অপমান করার চেষ্টা করবে কোন অখ্যাত স্কুলমাস্টার—এই স্পর্ধা তিনি সহ্য করবেন,তাকে এতটা দুর্বল ভাবার সুযোগ তিনি জনগণকে দেবেন, এমনটা গাঁয়ের কেউই প্রত্যাশা করেনা। যদিও খোরশেদ খন্দকার বিশ্বাস করেন, পাক পাকিস্তান অক্ষুণ্ণ রাখার সংগ্রাম তার ভুল ছিল না এবং এখনো তার বিশ্বাসে সামান্যতম চিড় ধরেনি,তিনি চান কেউ যদি তাকে রাজাকার বলতে চান, সেটা যেন শ্রদ্ধা মিশ্রিত হয়। খোরশেদ খন্দকারের অন্তর্জগতের সেই দর্শন অজানা ছিল আতাহার আলী মাস্টারের। কিংবা জানার দরকারও ছিল না। মুখ ফসকে নামটা বেরিয়ে গিয়েছিল এবং শুধু তাই নয়, সেই নাম উচ্চারণের সময় তার ফুসফুস তাড়িত বাতাসে মিশেছিল ঘৃণা। কিন্তু খোরশেদ খন্দকারের বড়ছেলের কৈশোরাচ্ছন্নদিনগুলো তখন হঠাৎ করে বোধ তাড়িত হয়। ছেলেটি টের পায় একটি শব্দের বহুমাত্রিক কিংবা একযাদুকরী ক্ষমতার। এবং আরো রহস্যময় কারণে ছেলেটি সেই ক্ষমতায় মোহাবিষ্ট না হয়ে শব্দটিকে ঘৃণা করে বসে। প্রথমবারের মত এক অচেনা ঔদ্ধত্য তাড়িত করে তাকে।

সে পিতার মুখোমুখি হতে চায় কৈফিয়ত চেয়ে। কিন্তু প্রথমবারের মত সে আবিষ্কার করে আপন চরিত্রের অন্যদিকটিও। সফেদ দাঁড়িঅলা,ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পরিবারের সাথে অস্বাভাবিক দূরত্ব সৃষ্টি করে রাখা জন্মদাতার পাথর খোদাই করা চোখের সম্মুখে দাঁড়িয়ে কৈফিয়ত চাওয়া কিংবা প্রতিবাদ করার মতো দৃঢ় তার মেরুদণ্ড নয়। সাহস সঞ্চয় করার প্রয়াসে ব্যর্থ কিশোর তীব্র আত্মদহনকে হত্যাকরে অবশেষে। নীরবেই মেনে নেয় সে জন্মদাতার পরিচয়,ভীরুর মত, কাপুরুষের মত তার প্রথম আত্মহনন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়। কিন্তু নিজ জন্ম পরিচয়ের এক তীব্র গ্লানি তাকে তাড়া করে ফেরে তারপর থেকেই। যদিও সে তার পরিচিত আর কোন রাজাকার সন্তানের মধ্যে এ ধরনের গ্লানির সন্ধান পায়নি, বরং তাদেরকেও পিতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে দেখেছে, কিন্তু যুবকটি তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সর্বদা হীনমন্যতায় আক্রান্ত থেকেছে নিজের জন্ম পরিচয় নিয়ে এবং মধুর ক্যান্টিনের বৈকালিক আড্ডায় বন্ধুদের পরস্পরকে ঠাট্টাচ্ছলে‘রাজাকার’ গালাগালিতে রক্তাক্ত অপমানিত হয়েছে। আর মনে মনে প্রাণ পণে গভীরভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছে জীবন থেকে শব্দটির প্রভাব ঝেড়ে ফেলতে। তবুও পরিচয়টি পিছু ছাড়েনি তার। বারবার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে অনিবার্যভাবে এবং যখন তা পরিণত হয়েছে তার অস্তিত্ব সংক্রান্ত সমস্যায়, তখনই সে এক মেরুদণ্ডহীন কেঁচোর মত আত্মসমর্পণ করেছে এবং এই আত্মসমর্পণকে সে নিজেই বিশেষিত করেছে আত্মহননপ্রক্রিয়া হিসেবে। তৃতীয়বারের মত জাগ্রত আত্মহনন ইচ্ছাটিকে উল্টেপাল্টে দেখে যুবক। ভাবে এই ইচ্ছাটিকে চূড়ান্ত ইচ্ছায় পরিণত যায় কিনা! কেননা এযাবত কালেকৃত আত্মহনন প্রক্রিয়ার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আত্মহনন তার বোধ হচ্ছে এটিকেই। অবশ্য যখন যে প্রয়োজনে আত্মহনন করেছে সে, সেটিকেই তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। হঠাৎ চিপসের প্যাকেটে পা পিছলে যায় যুবকটির। এই এলাকার ফুটপাত হকারদের দখলমুক্ত তবে পুরো ফুটপাত জুড়ে আদম সন্তানের ত্যাগ করা প্রাকৃতিক পানির আঁকাবাঁকা নকশা। এমোনিয়ার ঝাঁঝালো গন্ধ ঝাপটা লাগায় নাকে মুখে। মাথার উপর তীব্র জ্যৈষ্ঠের সূর্য। পেটের ভিতর হা করা রাক্ষস। কিচ্ছু খাওয়া হয়নি তার সকাল থেকে। প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে সাত টাকার উপস্থিতি টের পায় যুবকটি। গায়ের কয়েক পরত মাটি আর ঘামে লেপটে সিনথেটিক শার্টটিতে অসহনীয় দুর্গন্ধ,পাশে প্রাকৃতিক কর্ম আর আবর্জনার ¯স্তুপের মিলিত দুর্গন্ধ যুবকের ঘ্রাণেন্দ্রিয় স্পর্শ করতে পারছে না। মূলত তার মস্তিষ্কের স্নায়ু গ্রাস করে আত্মহননেচ্ছা। পেটের ভিতরে রাক্ষসটি হাহা করে আবার। কিচ্ছু পড়েনি সকাল থেকে।পকেটে সাত টাকা,শেষসম্বল। ‘মিল’এর টাকা দেওয়া বন্ধ আজ থেকে। সকালে মেসের বুয়ার গৎ বাঁধা অরুচিকর খাবারের গন্ধে নিজেকে সংযত রাখা ছিল রীতিমত যুদ্ধ জয় করার মত। পায়ে চোট লেগেছে বেশ।আত্মহননেচ্ছ অতিক্রম করে পা ব্যথা, পেটের ক্ষুধা। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় সংসদ ভবন চত্বরে চলে আসে। তীব্র ক্ষুধায় ক্লান্ত অবসন্নতা গ্রাস করে তাকে। সাত টাকার একটা মেনু নির্ধারণ করতে হয়। তিন টাকার একখানা পাউরুটি, দুই টাকার একখানা কলা। বাকি থাকবে আরো দুই টাকা। একটা সিগারেটের দাম। বিলাসী তৃষ্ণা চনমন করে ভিতরে। নিয়মিত সিগারেট কেনা হয়না অনেকদিন, যতদিন বাপের কাছে হাতপাতা বন্ধ করেছে সে। এম এ পাশের সার্টিফিকেট খানা আসার আগেই। আজ শেষবার আত্মহননের আগে নিজের হালাল টাকায় একখানা সিগারেট কেনার জন্য মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যুবকটি। হঠাৎ কাঁধে মানুষের হাতের স্পর্শ। আরিফ। এক হাতে মোবাইল আর অন্য হাতে ব্রিফকেস। টাই-স্যুট পরা সুবেশ।সুখীসুখী রোশনাই চেহারায়। সুখী? নাকি নাগরিক জীবনের আত্মপ্রতারণার মুখোশ? বুঝার উপায় নেই। কি করছিস এখন? যাচ্ছিস কোথায়? আরিফের সুরে সফল মানুষের করুণা। যুবকটিও কুণ্ঠিত নয়- সম্পূর্ণ বেকার, যাচ্ছি আত্মহননে। এখনো আত্মহননেই আছিস? হা-হা হাসে আরিফ। কৌতুক আর করুণা টপটপ ঝরে তার হাসিতে। পরামর্শ দেয় বিষয় বুদ্ধিসম্পন্ন—আর কত পাগলামি করবি? এবার কাজে-টাজে লাগ। তার করুণা যুবক কে যতটা আঘাত করবে ভেবেছিল আরিফ, ততটা যে করেনি যুবকের, প্রত্যুত্তরে স্পষ্ট হয়—তোর মত ধান্দাবাজি করবো? শা-লা! অপ্রিয় আক্রমণ আঁচ করে চমকে ঘড়ি দেখে আরিফ। আরে ব্যাস- একটা বেজে গেছে? চলিরে। একটু গিয়ে পিছু ফিরে আবার। একখানা সুদৃশ্য চকচকে কার্ড বের হয় আরিফের চামড়া মোড়া মোটা মানিব্যাগের পেট থেকে। নে রাখ, দরকারে ফোন করিস। যুবক কৌতূহলী, জানতে চায়- কিন্তু তুই এখন যাচ্ছিস কোথায়? আরিফ বিব্রত হয় উত্তরে দিতে—এমপি হোস্টেলে। -ও, এখনো ধান্দাবাজিতেই আছিস-যুবক বলে। মুচকি হেসে দ্রুত হাঁটে আরিফ। পিছন থেকে স্বগতোক্তি করে যুবকটি কিংবা আহবানহীন সম্বোধন, শা-লা। আমি তবু আত্মহনন করি মানুষের মতো। আর তোরা করিস ধান্দাবাজি। শিয়াল-কুকুরের মতো। আরিফ শোনে কি শোনেনা। যুবকটি শরীর মেলে দেয় গাছের ছায়ায়। ঘুমঘুম লাগে। আরিফদের মত ধান্দাবাজি করতে পারলে কি আত্মহনন করতো সে বারবার ? সুদীপাকে এড়াতে একমাস বাড়িতে পালিয়ে থাকার পর হলে ফিরলে দুইএকজন সহপাঠীর প্রশ্নের বলেছে, গিয়েছিল আত্মহনন করতে। কথাটি বেশ রটে যায় ডিপার্টমেন্টে। আরিফই অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে ছড়িয়েছিল বার্তাটি। সহপাঠীদের বিদ্রুপময় দৃষ্টিমনে পড়ে যুবকের। যুবকটি আবার গালি দেয় আরিফকে। শা-লা! তোর মতো! ছয় বছর প্রেমের নামে পুরুষ জন্মসার্থক করে লীনার কাছ থেকে সরে আসা? সুন্দরী, সুকেশী লীনাকে সাথে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চোখ টাটালি অন্যদের, আর শালা বিয়ে করার সময় বাপের পছন্দে ব্যাংকের অফিসার? নাকি কলেজ শিক্ষিকা? কি জানি করে আরিফের বউটা? লীনা এখন কোথায়? সন্ধ্যা নামছে সংসদ প্রান্তরে, মাথার উপর ঘনায়মান অন্ধকার আর পেটের ভিতর হা করা রাক্ষস, একটা হকার খুঁজে যুবকটি। অভিজ্ঞতা থেকে যুবক জানে বড় দোকানে কম দামের খাদ্যও বিক্রয় করা হয় বেশীদামে। যুবকটি জীবনে পরিকল্পনার মত কাজ করতে সফল হয়েছে খুব কমই। কিন্তু আজ হলো। ঠিক তিন টাকার একটা পাউরুটি, দু টাকায় একটা কলা। পকেটে বাকি দু টাকা। দু’ এক কামড় দাঁত বসাতেই শুকনো ময়দার দলা আটকে যায় গলায়। পানির দরকার। আকণ্ঠ তৃষ্ণায় পুড়ে যুবকটি।পাউরুটি আর কলা হাতে যুবকটি তৃষ্ণায় পানি খোঁজে এদিক-সেদিক। পানিবেষ্টিত এই ব-দ্বীপে তার মতো আত্মগ্লানিতে দগ্ধ যুবকের জন্য কি তৃষ্ণার পানি নেই? মাথার উপর সূর্য তীব্রতা হারাচ্ছে অপরাহ্ণের অন্ধকারে? সূর্য কি পরাজিত অন্ধকারের কাছে ? শালা!প্রচণ্ড ক্রোধে এই একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করতে পারে যুবক... শালা, তোমরা প্রতিদিন মুখ লুকাতে পারো অন্ধকারে। আর আমি কৃষ্ণপুর গ্রামের আলতাফ খন্দকার বিখ্যাত রাজাকার খোরশেদ খন্দকার এর পুত্র, বাপের সহকর্মী প্রতিষ্ঠিত অন্য রাজাকারের কাছে চাকরীর জন্য ধর্না দিলে আত্মগ্লানিতে ভুগতে হবে? আত্মহননে আত্মসমর্পণ করতে হবে ? নিকুচি করি আত্মহননের। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া পাক্কা দু’বছর, চাকরি হলো না কেন দু’বছরে? অভিজ্ঞতা—কম্পিউটারে পণ্ডিত, এক হালি প্রথম বিভাগ! শালা বাহার কত? কে দেবে ? সাত বছর ব্যয় হয়েছে দর্শনের পিছনে। কান্টের দর্শন, চার্বাকের দর্শনে কি লাভ জীবনের? সব বো-গা-স! একটি পাগলী ছোঁ মেরে নেয় তার আধ খানা খাওয়া পাউরুটি, কলাটির দিকে হাত বাড়াতেই সচকিত সচেতন হয় আলতাফ খন্দকার। পাগলীটি গপা গপ খায়, কত দিন খায়নি সে, আলতাফ খন্দকারের ক্ষুধা-তৃষ্ণা উবে যায় নোংরা, উসকো-খুসকো পাগলীটির এলোমেলো অথচ তৃপ্তিময় খাওয়া দেখে।

বোধবুদ্ধিহীন পাগলীটির কি অপরাধবোধ আছে আলতাফ খন্দকারের মতো? কেমন নির্বিকার পাগলীটি। পেটে যার ক্ষুধার তীব্রতা, সংকট যার অস্তিত্বের, অপরাধ বোধ তার বিলাসিতা। সান্ত্বনা খুঁজতে হয় আলতাফ খন্দকারের, আগে জীবন রক্ষা। প্রাকৃতিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নিয়াম কসে। দায় শোধ করতে হবে আরেকটি আদমসন্তানেরজন্মদিয়ে।তারপর সভ্যতা, নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধ। পাগলীটিকে গভীর পর্যবেক্ষণ করে আলতাফ খন্দকার, কোথায় যেন খুব পরিচিত ঠেকে। খাওয়ার ভঙ্গিটি খুব চেনা আলতাফ খন্দকারের, সুদীপার মতো? ঠিক এভাবেই সমুচা খেতো সুদীপা। বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে... ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় বসে সমুচা খেতো সুদীপা, চম্পাকলি আঙ্গুলে ছিঁড়ে ছিঁড়ে, ক্যাফেটেরিয়ায় আলো-আঁধারিতে আলতাফ খন্দকারের হাত নিসপিস করতো আবেগে। সুদীপার নেইল পালিশে সুসজ্জিত চম্পাকলি আঙ্গুলগুলো স্পর্শ করতে অস্থির হতো সে, ঠিক তখন কানে বাজতো বাপের বাজখাঁই গলা, না-জায়েজ! গ্রামে সদ্য চাকরি করতে আসা ব্র্যাকের সাইকেল চড়া মেয়েটিকে রাতারাতি গ্রাম ছাড়া করেছিল বাপ। সেই বাপের দেওয়া জন্ম পরিচয় তার, মানসিকতায় আপোষকামী মধ্যবিত্ত। গুরুগম্ভীর বাপ আর পানের রসে লাল ঠোঁটের মা, নামাজ পড়া আর বাপের খেদমত করা ছাড়া তাকে আর কোন কিছু করতে দেখেনি সে। যে বাড়িতে কেউ উচ্চস্বরে হাসে না, উচ্চস্বরে কথা বলে না, সে বাড়ির মেয়েরা বাপ-ভাই আর বিয়ের পর স্বামী ছাড়া পরপুরুষের চেহারা দেখে না, সে বাড়িতে দেওয়ালে প্রাণীর ছবি সম্বলিত কিংবা পুষ্পশোভিত ক্যালেন্ডার ঝুলে না, সে বাড়িতে কোন ফুলের গাছ লাগানো নিষিদ্ধ। পবিত্রগ্রন্থের বাইরে যে বাড়িতে শুধুমাত্র মোকছুদুল মোমেনীন নামে একটি মাত্র বই, সে বাড়িতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া আর আনা কারেনিনা পড়া সুদীপা কতটা বেমানান ভাবতেই আলতা ফখন্দকারের সারা গা কাঁটা দিয়ে উঠে। পাগলীটি খেতে থাকে সুদীপার মতো, অবিকল সুদীপার ভঙ্গিতে-সুদীপা হয়ে যেতে থাকে পাগলীটি, চোখের সামনে, কি তেলেসমাতি! অন্ধকার গাঢ় হতে থাকে সংসদ চত্বরে। চোখের সামনে পাগলী...সুদীপাবসু-পাগলী...সুদীপা...। ডিপার্টমেন্টের সংগঠন ‘অরুণিমা’য় পাশাপাশি জয়গোস্বামী, যতীন্দ্রনাথ পড়তে পড়তে ‘প্রেম বলে কিছু নেই, জড়ে আমার চেতনা মিশাইলে সব সমাধান পাই ‘সুদীপা বসু অস্বীকার করে ফেললো যতীন্দ্রনাথকেই। বাইপোস্টে আসা, সূর্যসেনের চারতলার টেবিলে আবিষ্কার করা বেলীফুলের সুবাস মাখা চিঠিখানাতে আহবান ছিল। পরদিন স্বোপার্জিত স্বাধীনতাকে সামনে রেখে কতটা সময় বসেছিল সুদীপা ঘন ঘাসে অপেক্ষা করে? শেষ পর্যন্ত সে কি হলে ফিরেছিল জল টলমল চোখে? কি ইচ্ছে করেছিল তখন সুদীপার? গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বেলে দিতে? পাগলীটি সামনে নেই। আশেপাশে কোথাও নেই। পাগলীটি নেই-সুদীপা নেই-সুদীপা নেই চোখের সামনে। যুবকটি ব্যবচ্ছেদ করে নিজেকে। সে পারতো সুদীপার আহবানে সাড়া দিতে? কি ঘটতো নিজের জন্মপরিচয়, শিকড় আর রক্ষণশীলতা ঘেরা অস্তিত্ব নিয়ে সুদীপার সামনে দাঁড়ালে? নীলজামার নিখুঁত ইউকাট গলা ভেদ করে ফুটে উঠা সুদীপার মোমের মতো পিঠ স্পর্শ করার লোভতো ছিল মনে, তবু আলতাফ খন্দকার সাহস করতে পারলো না, মেরুদণ্ডহীন কেঁচো আলতাফ খন্দকার। মানুষ হতে যতটা সাহস আর মনের জোর দরকার, তা নেই তার। তাই বরাবর আত্মহনন করে সে। কৈশোরে আত্মহননের প্রক্রিয়াটি প্রথমবার আত্মস্থ করার পর দ্বিতীয় বারের মত তখন আত্মহনন করে আলতাফ খন্দকার, সে রাতেই পালিয়ে আসে গ্রামের বাড়িতে। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী আত্মহনন করে কি? প্রতিবাদ হীন চুপচাপ হজম করে যাবার আত্মহননপ্রক্রিয়া কি জানা আছে অন্য কোন প্রাণীর? নিজের ভিতর জেগে উঠা প্রতিবাদী বিদ্রোহী মানুষটিকে হত্যা করা। জন্মের পর অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে মানুষের জন্ম হয় পুনর্জন্ম, আর আলতাফ খন্দকার করে আত্মহনন,পুনআত্মœহনন, অর্জনের সাথে সাথে, জ্ঞান বাড়ার সাথে সাথে। আজ তৃতীয়বারের মত আত্মহনন করতে যাবে সে। ইচ্ছে করলে সে পারে আজই তার আত্মহনন প্রক্রিয়াটিকে শেষ করে দিতে।

উপসংহারের আগে,

প্রথম মাসের মাইনে চারহাজার চারশো আশি টাকা নিয়ে যুবক দীর্ঘ একমাস পর যখন আবার সংসদ চত্বরে দাঁড়ায় তখন রাত এগুচ্ছে গভীরতার দিকে। প্রথম মাসের মাইনে পকেটে নিয়ে আজই এখানে এসেছে কেন আলতাফ খন্দকার, অন্তর্জগতে জাগ্রত কিংবা মস্তিষ্কজাত ইচ্ছেগুলো তীক্ষ্ণ ভাবে সনাক্ত করে সে। কেনো এসেছে সে এখানে ? সুদীপার মুখোমুখি হতে? সুদীপার মুখোমুখি দাঁড়াবার ভীতিকর পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে প্রায় দীর্ঘ একমাস গ্রামে ছিল আলতাফ খন্দকার। রাতের পর রাত ঘুম বিপর্যস্ত হতো তার। সুদীপা বসুর চম্পাকলির মতো গাঢ় রঙে সাজানো আঙ্গুলগুলো, নীল জামাভেদ করে মোমের মত খোলা পিঠ, শ্যাম্পু করা চুল,যতœ করে চোখের কোণে আঁকা কাজল রেখা—তন্দ্রার মধ্যে প্রায় প্রতিটি রাতে হা করে গিলতে এসেছে তাকে। নিজের শরীরে অনিবার্য জৈবিক আবশ্যিকতাকে অগ্রাহ্য করে ঘুমাতে পারতো না আলতাফ খন্দকার। নিজের শরীরে অনিয়ন্ত্রিত প্রবৃত্তিটি পাগল করে দিতো তাকে। স্থির আর সংযত করতে নিজেকে আত্মসমর্পণ করতো জায়নামাজে। নিয়মিত নামাজ পড়েছে সে ঐ একমাস। প্রাণপণে ভুলতে চেয়েছে বিধর্মী আর শরীয়তনামা না বেপর্দা একটি মেয়ে মানুষকে। তবু তার ভিতর জেগে উঠেছে অন্য একজন, সুদীপা বসুর নিষ্পাপ আহবান তাকে বারবার ব্যাকুল করেছে। কোনটি আসল আলতাফ খন্দকার? দ্বন্দ্ব অর দ্বিধায় ক্ষত-বিক্ষত অতিবাহিত হয়েছে তার ত্রিশদিন। প্রথম মাসের বেতনের টাকা থেকে বারোটা কার ফুল প্লেট চটপটির প্লেটটি হাতে নেয় আলতা ফখন্দকার। কতদিন ফুল প্লেট চটপটি খাওয়া হয় না...। ধোঁয়া আর পিঁয়াজ- মশলার মিলিত গন্ধে জিবে পানি জমে। দু’চামচ মুখ দিতেই সামনে পাগলীটি, লোভী দৃষ্টিতে, তবু কোথায় যেন সুদীপার মতো। দীর্ঘ একমাস পর ক্যাম্পাসে ফিরলে সম্পূর্ণ অপরিচিতদের মতো ব্যবহার করেছে সুদীপা। ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর ঘরে সুদীপা এখন দুই সন্তানকে টুইংকেল টুইংকেল লিটলস্টার পড়ায়। স্বামীর সাথে বছরের এ মাথা-ও মাথায় ইউরোপ ট্যুরে যায়—ভুলেও কি আলতাফ খন্দকারকে ভাবে? আর ভাবলেও কি সুদীপা বসু নিজেকে ধিক্কার দেয়না কাপুরুষ-কেচোঁ একটি পুরুষকে মূল্যবান আবেগ দিয়েছে বলে? যুবকটি প্লেটখানি এগিয়ে ধরে পাগলীর সামনে, পাগলীটি কি সত্যি সুদীপার মতো? পাগলীটির খাওয়ার ভঙ্গিটি কি সত্যিসত্যি সুদীপার মতো? যুবকটি কি পৃথিবীর সব নারীর মধ্যে সুদীপাকে খুঁজে বেড়ায় না? এই পাগলীটির মধ্যে সুদীপাকে খুঁজে পেলো কেনো... পাগলীটি সহজ লভ্য বলে? আত্মহননে হননে বিক্ষত যুবকটির ভিতরে গ্লানি। এবার বাঁচা দরকার, মেরুদণ্ডহীন সরীসৃপ হয়ে কতকাল? যুবকটি লক্ষ্য করে পাগলীটির খাওয়ার ভঙ্গি... ঠিক সুদীপার মতো, যুবকটি পাগলীটির হাত স্পর্শ করে... শেষ আত্মহননটা করেছে সে গত মাসে। রাজাকার বাপের সহকর্মী শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মোঃ সিরাজুল ইসলামের কাছে! এবার বাঁচা দরকার, যুবকটি পাগলীটির গলা স্পর্শ করে, ঘাড় স্পর্শ করে...। এবার বাঁচতে হবে তার! দু’হাতে পাগলীটির রুক্ষ শরীর নিজের দিকে টানে যুবকটি... বন্ধ চোখের ভিতরে সুদীপা..., সুদীপা দুহাতের দুবাহুর মাঝে...। অনেক দিন সিরাজুল ইসলামের কাছে যেতে চায় যুবকটি, চায়নি বাপের রাজাকার পরিচয় নিয়ে কোন চাকরি পেতে, যুবকটি বাঁচতে চেয়েছিল, আত্মহনন করতে চায়নি। কল্পনায় সুদীপা বসু, গয়না মখমলে ঝলমল, চেহারায় চর্বির জেল্লা, চামড়ার নীচে কালচে শিরা, গালে রক্তিমাভা বর্ধিষ্ণু। পাগলীটির ছেঁড়া জামায় কোন বোতাম নেই,অপুষ্টস্তন। যুবক স্পর্শ করে প্রথমবার নারীদেহ... সিরাজুল ইসলাম এখন রাজধানীর প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি। কয়েকটা ব্যবসা তার দেশে-বিদেশে।