কবিতার প্রচলিত ধারা বা ছন্দ বা ব্যাকরণ যা কিছুই আছে,আমি প্রায় কিছুই মানিনি: পৃথা রায় চৌধুরীর নিরীক্ষার জগৎ

Post date: Sep 9, 2017 3:11:07 PM

ডেনিয়েল ডুট্টন (Danielle Dutton) নামের একজন লেখককে একবার নিরীক্ষামূলক সাহিত্য কি এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া হয়েছিল, তিনি বলছিলেন, I suppose it’s generally thought that “experimental” writing is writing that experiments with (plays with, fucks with, risks) form . . . surely this means different things to different people. Mostly I think “experimental” is a watery sort of term, sweeping, more connotative than denotative, having to do with undertones, implications, context.

পৃথা রায় চৌধুরীর কথায় আসা যাক। উনি বলছেন-লেখার ক্ষেত্রে নিরীক্ষা করবো,এমন কিছুই কখনো মাথায় আসে না। সোজা কথায় বললে নিজের সম্পর্কে,বা বলা ভালো নিজের লেখার সম্পর্কে একটাই শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে পারি... "ভুলভাল"। কবিতা লেখাটা আমার কাছে ঠিক 'লিখতে বসা'নয়। কি ভাবে বোঝাই ব্যাপারটা? মনের মধ্যে ভেসে উঠতে থাকে আমার সব ভাবনার ছবি,ধরুন আকাশে মেঘ জমছে একটু একটু করে। এরপর আকাশে মেঘের ভার খুব বেশি হয়ে গেলেই যেমন বৃষ্টি শুরু,আমার ভাবনার ছবিগুলোও দানা বাঁধে,জমাট হয়,ছেয়ে ফেলে আমার সমস্তটা। নিজেদের মধ্যে তারা ঠ্যালাঠেলি করে,খুনসুটি করে আর একটা total chaotic। অবস্থার সৃষ্টি হয়। এবার তো তাদের ঝরতেই হয়,ঝরে পড়ে আমার লেখায়। এই হলো আমার কবিতা। আবার ধরুন আমি শব্দ নিয়ে খেলতে ভালোবাসি। শব্দের সাথে শব্দ মিশিয়ে তৈরি করি নতুন শব্দবন্ধ যা সম্পূর্ণভাবেই আমার থেকে জন্মানো,আমার ভাবনার দায় বহন করার দায় দিই সেইসব শব্দবন্ধদের। শব্দবন্ধেরা আমার কাছে তখন এক নতুন শব্দ শহরের বাসিন্দা। এর জন্য যে খুব মাথা ঘামিয়ে কিছু করি,তা নয় কিন্তু। এরা নিজে নিজেই জন্মে যায়।

তার একটি কবিতা পড়া যাক-

কপালনামা

পৃথা রায় চৌধুরী

রাইগর মর্টিসের আগে দাহ করে ফেলাই শ্রেয়

সেখানে অবুঝ থেকে গেছিলো দিন দুই বেশি।

কিছু খই রাস্তা ধরে ওলটপালট

খুচরো কুড়োতে ছোটে ছেঁড়া ইজের

খুশি হয়েছ আজ?

চলেই তো গেছে,

তাকে বারবার যাও বলে

নিজেকে ক্লান্ত করতে নেই।

বেঁচে থাকার তাগিদে যে হাত ধরেছিলে

দেখো, তার রেখা নেই আজ কোনও

মৃত ফুলে ওঠা শরীরের কোনও বিধাতা হয় না।

তার ভাবনাও আপনাকে দোলাবে। তিনি বলছেন-এবার এই নতুনদের পাঠকের ভাবনায় কি স্থান হবে, তা কিন্তু আমি ভাবি না। আমি লিখি নিজের খুশিতে। খোলা আকাশ ছেড়ে দিই পাঠকের সামনে। আকাশের মেঘে আমরা যেমন খুঁজে নিই নৌকা, প্রজাপতি, সিংহ, মানুষের আদল, ঠিক সেভাবেই আমার লেখা থেকে পাঠক নিজেই তৈরি করে নিন নিজের মতো কাব্যভাবনা... পাঠকের ভাবের সাথে কবির কবিতা ভাবনা মিলতেই হবে,এমন আমি মনে করি না। আবার মাঝেসাঝে নিতান্ত ব্যবহারিক ভাষায়,এক সাধারণ মেয়ে বা মানুষ হয়েও তো বেশ কিছু লিখে ফেলি। সেখানে শব্দের জাগলারি থাকে না,অথচ কবিতাতেই লিখে ফেলি তৃপ্তির ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ। সোজা কথায়, কখন যে কি লিখি,তা পূর্ব পরিকল্পিত থাকে না। কবিতার ধরণ আমার প্রচুর পালটেছে বিগত পাঁচ বছরে,২০১২ থেকে কবিতা প্রকাশকাল ধরলে।

উনার আরও দুটি কবিতা পড়ি-

ধন ত্রয়োদশী

চোরা বাক্সে অগুনতি বৃষ্টি গুঁড়ি

তোর নাম লেখা

বুঝিয়ে দিতো,

অক্ষরপরিচয় না থাকলে

তোকে এভাবে শুনতে পেতাম না।

বধির হয়ে বুঝেছি,

মূক হওয়ার ভবিতব্য

প্রতি ফোঁটায় লিখে পাঠাতিস।

সোনারূপোর লুটপাটের দিনে,

আয়,

অন্ধ আমার, গয়না হবি।

শনি-বাসরীয়

শনিবাসর কয়েক ঘণ্টা

দুপুর আড়াই দুপুর খাঁখাঁ

ধর্মতলার বাস...

লক্ষ চোখের ভিড়ে

কালো আঁধার একক জোড়া

দুপুর তিনের আলসে কলিং বেলটা।

জ্বর মরসুম, ওষুধ?

ওসব ছাড়...

ব্যস্ত গায়ের শ্রম গন্ধ

অসমান দাঁত তবু দিনমান

হাসির ছররা মৌতাত।

চেনা ধুলো

অচেনা আঙ্গুল, কপট রাগ;

সাফ সাফাই, ভুল একতাল

কার অগোছালো,

খেলতে খেলতে

গুছিয়ে গুছিয়ে ভুলভাল।

ভুলভাল বহু পাপোষের গায়ে

হালকা সোল পলকা সবুজ ছাপ

কোথায় কোথায় মেঘের দেওয়াল

ছোঁবেই আবার

একতলা থেকে দেড়তলা চলা ধাপ।

উনি অকপটে বলছেন-কবিতার প্রচলিত ধারা বা ছন্দ বা ব্যাকরণ যা কিছুই আছে,আমি প্রায় কিছুই মানিনি। ওভাবে তো কবিতাকে কখনো দেখিইনি আমি। কবিতা শুধুই আমার খোলা আকাশ, কবিতা আমার খেলার মাঠ, কবিতা আমার মুক্তির আস্বাদ... স্কুলে পড়াশোনার ক্লাসের ফাঁকে যেমন খেলার সময়টা, ঠিক তেমন। শুধু জানি, যতোদিন বাঁচবো, লিখবো। না লিখতে চাইলেও আমার মনের মধ্যের সব কিলবিলে ভাবনাগুলোই আমাকে জোর করে লিখিয়ে নেবে। কবিতাগুলো আমাদের সেদিকেই নিয়ে যায়?

দাগ

এখন তখন উধাও হবার গল্প

পরিশেষে সমাপ্তির আগেই বিজয় ঘোষণা

সত্যি বলো কোণায় যে ঝুল জমেছিলো

লক্ষ্য করলে সেখানেও সংসারী বসবাস

রোদের স্বেচ্ছাচার সেখানে ঝিলিমিলি।

আবার বছর ঘুরে যাবার আদিখ্যতায়

হাত পা চোরা চাউনি

হিসেব না কষাই থাকে পর্যাপ্ত আলো পেলে।

ভেতরকথা তোলা থাকে ক্ষণনামচায়

সেখান দিয়ে পারাপারের জন্মদাগ... আগুন জড়ুল

নাভিতে আদিমের লালসা

যযাতির ফিরে ফিরে আসার নাম... আঁধারজোছনা।

ন্যায্য বিধান

তোমার বাথটাবে শ্যাওলা লাটসাহেব

তোমার শখের বাগান অপরিষ্কার

তোমার পেটিভর্তি রুপোলী ঝনঝনের সুরে

তন্দ্রা লেগেছে।

আমার আপাতশৌখিন কাঁধের কড়াগুলো

তোমার মনে হয় আক্রমণের ঢিল

গুলতি হয়ে যাই তোমার কাঠগড়ায়

অবমাননার দায়ে।

ধর্মাবতার, এখনো দুপুরে একলা কোকিল শুনি

হুজুর, খিদে চেপে রাখতে শিখেছি নিজের রায়ে

মি লর্ড, নিরপেক্ষতায় ভুগেছো কখনো?

নিজের হাতে হীনমন্যতা দাও...

কি ভালোবাসি, কাকে প্রেম, কেন ত্যাগের ভোগ

বুঝিয়ে বলতে পারিনি গো শাসক

এখন ক্ষুন্নিবৃত্তি বা স্বেচ্ছা অনশনের ভেতরে বুঝি,

নিজেই শেষের শুরু বুঝিনি।

পৃথা রায় চৌধুরীর কবিতাগুলো তো আমাকে তার পথ দেখিয়ে দিয়েছে। আপনিও কি টের পাচ্ছেন?