কবিতার ন্যারেটিভটা একটা বড় কাজ করার জায়গা ছিল: শোয়াইব জিবরানের নিরীক্ষা
Post date: Sep 11, 2017 6:12:55 PM
ফেসবুকে একদিন নিরীক্ষা নিয়ে কথা হচ্ছিল তার সাথে। তাকে বলেছিলাম,আপনার কোন কাজটাকে নিরীক্ষাধর্মী মনে করেন? উনি অকপটেই বললেন- কাঠ চেরাইয়ের শব্দ। কৌতুহল আমার বেড়ে গেল। তারপর একে একে উনি বলছিলেন,-নিজের ভেতর কেরির ক্ল্যাসিক ভাষা ও বাইবেলে কথা বলার ভঙিমা,বাঙলার লোক ভাষা,মহাভারতের গঠনশৈলি সব ঠেসে দেয়ার চেষ্ঠা করেছি গীতিময়তাকে অস্বীকার না করে। দীর্ঘ সময় নিয়ে কাজ করেছি। বইটি একসাথে না পড়লে ধরা যাবে না।এর সজ্জাটি ধরতে হলে পুরো কাব্যগ্রন্থটি একলগে পড়তে হবে। আমরা পুরো কাব্যগ্রন্থটি না তুলে ধরলেও গ্রন্থের প্রথম কিছু অংশ দেখে আসতে পারি-
উত্তেজনা-পর্ব
হে কাব্যসখা কবিগণ, আমাকে ধরো, আমাতে ভাব জাগরিত হইয়াছে, আমি ভাষাকে আলিঙ্গন করিব, উহার দেহে অবগাহন করিব,কাব্যবীজ বপন করিব।
ছায়া এলিজি
রাত্রি ছিলে। রাস্তায় একা পেয়ে শুনিয়েছ গান,মানে বুঝিনি। আজ অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে তুলে ধরেছি মাথা, ঐ যে আকাশ নুলোভাই আর তারা সাতজন,বোনের লাশ নিয়ে শ্মশানেতে যায় নিত্যরাতে, কী বেদনা তাদের সাথে খেলা করে,জানি।
ভাষা তার অর্ধ বুঝি। যিনি জেগে আছেন মাঠের ওপারে, বটগাছ নদী আর বাতাস নিয়ে। আত্মা মাঝে মাঝে পাঠাই তার খোঁজে, কী কঙ্কাল বেঁচেবর্ত্তে থাকা, অর্ধ স্বপ্ন আর অর্ধ জাগরতা নিয়ে। দিবানিশি।
সে ডাকে। দিঘির জলে ডুবে গেলে চাঁদের দেহ। আমি কি আর ফিরে যেতে পারি? ফিরে কি কেহ? যে ফেলে এসেছে ছায়া পথের ধুলোয়।
ছায়া ফেলে হাঁটি। তিনি স্নেহ আর শৈশব। তার সাথে জানাশোনা ছিল সেকালে,আজ শুধু মাছির মতো মুখ মনে পড়ে। রাত্রি ছিলে।
কৃষককন্যার গান
দুপুর এমনি সন্ন্যাসী। উলুখাগড়ার বন আরও উদাস করে দিলো কিশোরীর মন। উলু উলু উলুধ্বনি গ্রামের ওপারে মাঠের ধারে দুপুরের ভেতর, কৃষকেরা জটলা বেঁধেছে।
তামাক গন্ধ বাতাসে, সিল্কের ধোঁয়া উড়ছে কু-লী পাকিয়ে।
শস্য ভালো
ভালা, বন্যা নেই, হেই হেই
কন্যা ভালো
ভালা, খরা নেই, হেই হেই
বউ ভালো
ভালা, পামরী নেই, হেই হেই
রাজা ভালো
ভালা, সেপাই নেই, হেই হেই
বাও ভালো
ভালা, জরা নেই, হেই হেই
কৃষককন্যাকুমারী আনন্দগান শুনে পিতার, আনমনে। দুপুর এমনি সন্ন্যাসী। উলুখাগড়ার বন আরও উদাস করে দিলো কিশোরীর মন।
শিকারি
মাথায় পালক নিয়ে এই অসময়ে বেরুনো কি ঠিক হবে?
চারিদিকে আগুন নদী, পথঘাট অগ্নিবাতাস।
যারা গিয়েছিল অন্ধ পাখি হাতে কোড়া শিকারে
ফিরেনি। রক্তের ঘ্রাণ বাতাসে
চাপ চাপ ছড়িয়ে আছে।
পিতা প্রপিতামহ খেয়েছে বনের বাঘ
আমি সামান্য ভগ্নস্বাস্থ্য বালক, দু’হাতে কী আর আগলাবো
রক্তমাখা দাঁত, নখর, বাঘডাক।
নাকেমুখে বনের কাঁটা, পাতা লেগে আছে
কাঠুরিয়া শক্ত কুড়ালে কেটেছে বৃক্ষকোমর
অরণ্য হাত পা ছড়িয়ে বনের গায়ে পড়েছে
আমার শুধুই অরণ্যবাস, না কাঠুরিয়া, না শিকারি।
নারী এবং হরিণমাংস খেয়েছে যারা, জিহ্বা পাতালব্যাপী
নারীর গর্ভে জন্ম মাগো, পিতা ছিলেন হরিণ শিকারি
ব্যাধের সংসারে জন্ম বধূ বংশসুতোবনে
আমার হাতেই দিয়েছে তুলে তীরধনু পাখির পালক
এই অসময়ে করাল বনে কার কাছে আত্মা রাখি?
তিনি বলছিলেন, বাংলা কবিতা বাণী প্রধান। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তাই। গীতগোবিন্দেরর পর আঙ্গিক নিয়া কাজ হইছে অমনটি নাই।আর বাংলার কবিতারা নিরীক্ষা বলতে ছন্দ বোঝেন কবিরা। এই ছন্দ নিয়াই নিরীক্ষাকে শেষ মনে করেন বা করেছেন। কিন্তু কবিতায় আমরা শেষ পর্যন্ত একটা কিছু ন্যারেট করি। সো,কবিতার ন্যারেটিভটা একটা বড় কাজ করার জায়গা ছিল। অকর্ষিত এখনো। মহাআখ্যানগুলো পদ্যেই রচিত।সে ইলিয়াড,ওল্ড টেস্টামেন্ট বা মহাভারত যাই হোক। ঢোড়াই চরিতমানসে মহাভারতের কাঠামোকে নিয়ে নিরীক্ষা হয়েছে।
তার ভাষায়-মহাকাব্যের দিন শেষ। দীর্ঘ কবিতারও। কিন্তু গীতিকবিতাপুঞ্জ দিয়েই একটা মোজাইক কাঠামো তৈরি করা সম্ভব। যে একটি কাব্যগ্রন্থ এজ আ হউল মহাকাব্যের ব্যাপ্তির চূর্ণকে ধরবে। একটা টোটালিটি দেবে আর বাংলা কবিতার ভাষা ব্যবহৃত হতে হতে শুয়োরের চামড়া হয়ে গেছে। ব্যবহার করে আরাম নাই। এরে রস দিয়া লবণ দিয়া লাবণ্যময় করা সম্ভব। পূর্ববঙ্গের ভাষার সাথে যদি ক্ল্যাসিক্যাল সাধুভাষার যেমন কেরির,বিদ্যাসাগরের ভাষার সংযোগ ঘটাতে পারি,নতুন কিছু হবে।যে বৈষ্ণব কবিতা করেছিলেন বৈষ্ণব কবিরা, মৈথিলির সাথে বাংলাকে মিশিয়েছিলেন।কবিতার নবযৌবন দিয়েছিল সেটা। টেক্সট শুধু ভাষাকে ধরে,বিষয়কে ইগনোর করে। দেহ আর আত্মা তো আলাদা নয়। আমি তো জার্নির চিহ্ন রেখে রেখে যাচ্ছি। অখনে পথিক সে পথে যেতেও পারে, আবার পথ হারাতেও পারে। সেটা সমালোচক বা বিশ্লেষকের দায়। এবং সে ব্যাখ্যাগুলোকেও আমি অস্বীকার করতে পারবো না। যখনে লেখার পর লেখকের মৃত্যু ঘটে- দ্যা ডেথ অব দি অথরে যেমন বলা হয়েছে। নিরীক্ষার ইতিহাসে যোগ করা হবে কি না সেটা তো যোগকরনেওয়ালার মর্জি। আমি আমার কাজটি করছি।
তাহলে আরও কিছু অংশ পাঠ করা যাক-
কবি ঘটনা
মাঝরাতে ডেকে তিনি তাকে দু’মুঠো রৌদ্র দিলেন, দু’হাতে। তাই ছড়ালো মন্ত্রের মতো অন্ধকারে মুঠো মুঠো রোদ, নামল শাহবাগী ভোর।
পালক হতে পায়রা উড়ালেন শা’পরান পুবের দেশে
ভোর হতেই খোলাকল হতে গড়িয়ে পড়ল জল। মদগ্রস্ত চক্ষু ধুলেন গৌণকবি। তাতেই আমাদের ভীষণ কবিতা হলো।
সেই দুই হাত উড়াচ্ছে দ্যাখ রৌদ্রধুলো। কে তাকে ডেকে দিয়েছিল এমন আলো, চারিদিকে না আলো, না অন্ধকার, এমন সান্ধ্যপুঁথি আহা গৌণকবি!
শ্লোকবলার ছোটবোন
বাঁশ বাগান ও একটি চাঁদ ছিল মেয়েটির
সে প্রতিরাতে চাঁদ উঠাত বাঁশ বাগানের মাথায়
চোখে কাজল পরে কাঁদত,
‘কাজলা দিদি কই, কাজলা দিদি কই’
আজ সে প্রেমিকা, আজ রজস্বলা।
এখন রাতে উঠান জোড়া শাদা পাটের বৃষ্টি হলে
ডাকে ডাহুকী, ফেটে যায় তার ছাতি
ও শ্লোকবলার ছোটবোন, আজ রাতে এইবেলা
বাঁশ বাগানের মাথায় চাঁদ, কার বিরহ আনো?
বালকের প্রতি
ও হে মুদ্রিত বালক, চাকা ঘুরাতে ঘুরাতে ফিরছি
তোমার দিকে, তুমি শুয়ে আছ মদনকুমার ঘাটে
একা একা। পাশে তির তির জল
কত দূরে যাও গো নদী, কত দূরে যাও
আমাদের যৌথদিন আর দূরে
জেগে ওঠা মেঘমালা
খড়ের ঘরে(বনেদি কৃষকের পুত্র মোরা)বীর্যগন্ধভাপ
আহা যুগল ঊরু! ঐ যে বেদনা ভেসে আসে সাফোর কণ্ঠ হতে
কষ্ট আমার তোমার পাশে বসে আছে ভিন যুবক!
বৈজয়ন্তীদের গল্প
কাকসন্ধ্যা উড়তে উড়তে নামলো বৈজয়ন্তীদের বাড়ি। বৈজয়ন্তীরা পাঁচবোন। রজস্বলা। মাস শেষে বাসার গলি গলিয়ে পড়ে কাদাজল!
মা তাদের গেছেন আজ দূর কূলবনে
বড়োবোন চক্ষুবতী। চোখ তার দু’টুকরো আকাশ। জমানো মেঘ, বৃষ্টি, দুপুর রৌদ্র, হলুদ হরীতকী।
মেজোবোন কর্ণহার। অজন্তা ইলোরার অলংকার। কোকিল আর ঘুঘুর গান দু’টোই বুঝেন নীরব হলে বসতি।
সেজোবোন নাকচাবি। উট আর বেজির গ্রীবা। ভূমিকম্প, বন্যা, বালাই টের পান দশহাত দূর হতে। ঘামের ঘ্রাণ।
ন’সেজো বৈজয়ন্তী। হাত তার চাল ধোয়া। চুড়ি পরে পুরুষের পরাণ কাঁপিয়ে। আর ছোট মুখরা। সেই জানিয়েছে তারা আজ আত্মকামিতায় মেতেছে। মা গেছেন দূরবনে।
পঞ্চজন আমার প্রেমিকা, আত্মা গেছেন দূর বনে।
মাহাত্ম্য বর্ণন
আকাশের গলায় ঝুলিয়েছেন যিনি চন্দ্র সূর্য, তাঁকে ডাকো
(আল্লাহু, আল্লাহু)
হাত দিয়ে করেছেন যিনি দিন ও রাত্রির তফাত, তাঁকে ডাকো
(আল্লাহু, আল্লাহু)
কবি ও পাখির গলায় দিয়েছেন যিনি গান ছড়িয়ে, তাঁকে ডাকো
(আল্লাহু, আল্লাহু)
(অসমাপ্ত)
(পাঠকের জন্য রেখে দেওয়া হলো শাদাস্থান। তাঁরা ইচ্ছে করলেই আরও পংক্তি রচনা করে অশেষ ছোয়াব হাসিল করতে পারেন)
তার কথাগুলো নিয়ে আমিও ভাবছিলাম। পাঠকদের জন্য তিনি যে সাদাস্থান রেখে দিয়েছেন, সেই স্পেস, সেই ভাবনার স্পেসে নিজেদের তো নিয়ে যেতেই পারি। পারি কিনা-একবার ভেবে দেখুন।
কবি শোয়াইব জিবরানকে আমরা কমবেশি সবাই জানি। তিনি মূলত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বর্তমানে কাজ করছেন জাতিসংঘ শিশু তহবিলের শিক্ষা পরামর্শক হিসেবেও।
স্বীকৃতিস্বরূপ ইতোমধ্যে ‘মুক্তধারা একুশে সাহিত্য পুরস্কার’, ‘আব্দুল মান্নান চৌধুরী স্মৃতি পদক’, ‘সংহতি বিশেষ সম্মাননা’,‘চিরকুট সম্মাননা’ ইত্যাদি লাভ করেছেন।
তার গদ্য ও গবেষণাগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাসের করণকৌশল (বাংলা একাডেমি,২০০৯),কথা কবিতা ও শিক্ষা (ধ্রুবপদ, ২০১০)কমলকুমার চরিতম্ (শুদ্ধস্বর, ২০১০), শিক্ষা পরিভাষা (জেব্রাক্রসিং, ২০১৬) ইত্যাদি। তেমনি তার কবিতার বইও রয়েছে অনেক। যেমন-কাঠ চেরাইয়ের শব্দ (বাংলা একাডেমি, ১৯৯৬), দুঃখ ছেপে দিচ্ছে প্রেস (মঙ্গলসন্ধ্যা,২০০৩),ঘোর ও শূন্য জলধিপুরাণ (চৈতন্য, ২০১৭)।