ঈশানবের নিরীক্ষা কোয়াসি ফিকশন

Post date: Sep 6, 2017 5:57:20 AM

ঈশানব, কোয়াসি ফিকশন লিখেন। তার ভাষায়-কোয়াসি ফিকশন হল দু'টো জার্নি অর্থাৎ লিনিয়ার জার্নি আর নন লিনিয়ার জার্নিকে একই সাথে যাপন করা. যেখানে সময় এর স্পেসকে বারবার নষ্ট করে দেওয়া হবে। কারণ আমরা সবাই সত্যোত্তর সময়ে বেঁচে আছি।

ঈশানবের ভাষায়-সময় অনেক সময় অনেক কিছু করিয়ে নেয়। এই যে কাল কেউ মারা গেল,যাকে আমি দেখেছি কিংবা চিনতাম। সেইচেনা,সভা-সমিতিতে এক নির্লিপ্ত সমর্থন দেওয়াই তো যে কোনও বোধকে লালন করে। আর সেই লালিত উদ্বেগ কিংবা চিন্তারা দানা বাঁধতেবাঁধতে জন্ম নেয় এক তীব্র উস্কানি কিংবা বিবমিষা। দেশদ্রোহী তারই ফসল।

আসলে আমার ছাত্রজীবনের শেষভাগে,যখন নানা অনুষঙ্গে রাজনীতির এক উগ্র চেহারা দেখেছি। যখন রাত্রি বেলা খালি একটা উদ্বেগ বুকে করে ঘুমিয়েছি, তখনই তো অন্তরালে চলেছে এই আখ্যান নির্মাণের খেলা। সেই নির্মাণে বারবার সময় এবং চরিত্রকে ভেঙে চুড়ে দেওয়া আছে। না শেষ হওয়া এক অবনির্মাণ আছে। আর তেমনি আছে ঘটিত সত্যকে স্মৃতির আড়াল থেকে বের করে সারিবদ্ধ করার এক প্রচেষ্টা, ইতিহাসের স্বার্থে।

এ কথন আমি লিখিনি। আসলে সময় মাথায় বন্দুক ধরে লিখিয়ে নিয়েছে আমায় দিয়ে।

ঈশানবের এই নিরীক্ষাকে পাঠক আসুন পাঠ করি-

দেশদ্রোহী যে, যেভাবে, যখন হয়...

ঈশানব

রাত ৮টা বেজে ১৫ মিনিট। এ সময় নিচটা গমগম করা শুরু হয়। খাবার আসে। দ্বিতীয় দফা বাসটাও ফিরে আসে ওখান থেকে...। সামনের দোকানটাতে ফুলুরি ভাজার গন্ধ, সিগারেটের ধোঁয়া এবং কারো কারো গলার শব্দ সবই পাওয়া যায়। লিফটটা বারবার উঠতে –নামতে ক্লান্তি কিংবা ঢ্যামনামি দেখায় না। এমনকি দেওয়ালগুলো পর্যন্ত বুজে থাকা গলার স্বরের তেজ বাড়িয়ে দেয়। আর পাঁচটা বছরের ফেব্রুয়ারির মদ ছেলেরা যারা চুমু খায় না, গাঁজা টানে না, মদ্য পান করে না তারা নিজেদের শৌচের সাথে খানিক মৈথুন রস ফেলে ভারমুক্ত হয়ে খেতে আসে নিচে। কিংবা বসতে-খেতে-দেখতে আসে।

বিবস্বনও সেদিন নিচে বসেছিল এ সময়ে। সারাদিন না খাওয়ায় খিদে পেয়েছিল, তাই খেতে এসেছিল আর কি। খেতে খেতে একবার যার চোখ যায় টিভির দিকে টিভি মানে একটি মধ্যম দৈর্ঘ্যের এলসিডি যাতে তখন ভারত-নেপাল ফুটবল খেলা চলছিল। শেষ হতে বাকি আর কয়েক মিনিট, এবার ঠিক এই পর্যায়ে ধরে নেওয়া যাক ওখানে বিবস্বান ছিল না আসলে ছিল বুরহান। বুরহানের চুল কোঁকড়া, নাক টিপালো, বিবস্বানের মদ বোঁচা নয়। মুখে একটা প্রচ্ছন্ন আফগান ভাব লক্ষ্য করা যায়। বিবস্বানের মুখে একটা ইরানীয় প্রলেপ আছে, যেটা অন্নত তার মনে হয়। আসলে কিন্তু সে বাঙালী। বুরহান টিভিতে খেলা দেখানোয় সেদিন নেপালের পক্ষে ছিল। ভারত ভালো খেলছিল না, আর সে সমর্থনও করেনি। সে সমর্থন করেও না। খেলার মাঠে যে দল সমর্থনের দিক থেকে দুর্বল বুরহান সেই দলকে সমর্থন করে। বিবস্বানো ছোটবেলা থেকে মোহনবাগান পরিবারের ভেতর বড় হয়েছে। খেলায় ভারত হেরে গেল। ফলাফল ৩-১। স্টিভেন কন্সটাইন বিরক্তি প্রকাশ করে মাঠ ছাড়লেন। বুরহান বিদ্রুপসূচক আনন্দ প্রকাশ করে চ্যানেল ঘোরাল। ঘড়িতে তখন ৮টা বেজে ৪৫ মিনিট। বিবস্বান কলকাতা লিগে কিংবা দেশের ভেতর ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে সমর্থন করে।

বুরহান মানে বিবস্বান সারাদিন না খাওয়ার দরুণ কিঞ্চিৎ লোভেতেই আর একটু ডাল নিতে লাইনে দাঁড়িয়েছিল। তখন ওবরহান চ্যানেল ঘুরাতেই, বিবস্বান ওকে খবর দেখাতে বলে। সে শুনেছিল, দেখেছিল, ভেবেছিল কিংবা পড়েছিল, দেশের অবস্থা ভালো নয়। কিছু কিছু বিতর্ক, চাপা গুঞ্জন, সাবধান থাকার চেতনাবাণী আসছিল। চেতাবনি আসছিল গুগল, ফেসবুক, বাড়ি এবং আধার নম্বর থেকে। একটা কেমন প্লাস্টিক থমথমে পরিবেশ চারদিকে। ঢাউস লম্বা ঝাউ গাছে বাদুরের অতিরিক্ত দৌদ্যুলতা অথবা সময়ের অতিরিক্ত বয়ে যাওয়ায় প্রাক ফাগুনে যেমন দমবন্ধ ভালো লাগা তৈরি হয় তেমন। মাঝে মাঝে সেই দম ফেটে যায়, তখন বেরিয়ে আসে চরিত্রের আসল রূপ। কারা কি বলতে চায়। বাকিটা শুধু অভিনয়, কত ভালো কত সুন্দর দেখানোর। এরা কেউ উলঙ্গ হয়ে বাথরুমে দাঁড়ায় না। বিবস্বান হয়। বুরহান স্নান করে না। টিভির রিমোটটা তখনও না ছোঁয়া শিকারের মত দু'নম্বর টেবিলের কোণায় রাখা ছিল। পৃথিবীর সব বড় সমস্যাই কিছু ছোট ঘটনার জন্য হয়। বাবা বলেছিল। বুরহান চেয়ারটা নিয়ে খানিকটা এগিয়ে গেল। তারপর রিমোটটা ধরতে ধরতেই কাশুম্যান সেটা নিজের হাতে নিল। যেন ছিনিয়ে নিয়েছে এমন মনে হলেও তা আসলে তেমনটা নয়। ওয়ার্ডেনের তেমনটাই মনে হয়। অন্তত ওয়ার্ডেনের সেটাই মনে হয়। যারা তখন ওখানে বসেছিল, প্রায় সবাই তারা কাবাডি দেখতে চায়, আর কে না জানে সংখ্যাগুরু যা দেখতে চায় সেটাই দেখার। যেটা জানতে চায় সেটাই জানায়। যেটা বুঝতে চায় সেটাই বোঝার। কাশুম্যান কবাডি দেখে। পছন্দও করে। ওয়ার্ডেনও করে। বিবস্বান থালার ভাতটা প্রায় পুরোটাই ডাল দিয়ে খেতে থাকে। খায়। খাচ্ছিল। খেকে , খেতে ও কাশুম্যানকে অনুরোধ করে খবর দেখানোর। কাশুম্যান কবাডি দেখে। ওয়ার্ডেনও তাই। বুরহান তখন ঝাঁঝিয়ে ওঠে। কাশুম্যানকে একটু হেঁকে বলে খবরে দিতে। সংখ্যাগুরুর কানে সেটা বাজে। তখন বিবস্বান অনুরোধ করে থেমে যেতে। বুরহান কিছু প্রতিক্রিয়া দেওয়ার আগেই কাশুম্যান বিপক্ষ গোল কিপারের হাত থেকে বল ফসকে যাওয়ার পরকার ধূর্ত স্ট্রাইকারের ক্ষিপ্রতায় আবার বল গোলে পাঠায়। চপ্পল দিয়ে মারবো শালা,সংখ্যাগুরুরা উপভোগ করে। ওয়ার্ডেনও মজা পায়, বুরহান উঠে দাঁড়ায়। ওয়ার্ডেনকে বলে, শুনলেন তো ওকি বললো। এরপর বুরহান যাকে জানাবার জানায়। কেউ কেউ সেসব নিয়ে নানা উপদেশ তাকে দেয়। কেউ কেউ আবার কাশুম্যানকে কিভাবে এ থেকে বাঁচাবে সে ফন্দি খোঁজে। কেউ আবার দু'জনের মিলে-মোরগ লড়াই বাঁধানোর পরিকল্পনা বর্তায়। যেমনটা বিপদে পড়লে সংখ্যাগুরুরা করে আর কি। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় যখন গোটা ঘটনা গিয়ে পৌঁছায় তখন জল আরও কিছুটা গড়ায়। কিন্তু ফ্যাকড়া তাতে বাড়ে। আসলে ইতিহাস বরাবরই বড় মিনমিনে, তাই মোটা গলা একটা ঝেড়ে হাঁক দিলে সে তোতলায় এবং তার দিক পরিবর্তিত হয়।

অর্থাৎ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে, কাশুম্যান কিছু করেনি। বুরহান খেলা দেখছিল। বিবস্বান ইন্ধন দেয়। তাই বুরহান যেচে কাশুম্যানকে খোঁচায়। আর সেই খোঁচায় হিড়কে হড়হড়িয়ে, কিছুটা ১-২-১ হয়ে কাশুম্যান বুরহানকে তেড়ে খিস্তি করে। অঙ্কটা মোটামোটি এমনিভাবে দাঁড় করাবার পরই, সংখ্যাগুরুরা সেটা বিশ্বাস করে। যার যা কাজ। আর বিশ্বাস এক ধরণের ইনরেট বোধ মাথায় ঠেসে দেয়।

১৯ শে সেপ্টেম্বর মাঝরাতে, ক্লান্তিঘুমে একটা আবছা স্বপ্ন বিবস্বান দেখতে থাকে। লেনিনেন সোনার বরণ মূর্তি কোর্ট পড়া এগিয়ে চলেছে। অথবা ওপা আম্বেদকরের ও হতে পারে। বই হাতে বুকে চেপে থেমে থাকা। কিংবা আসলে টাই কোর্ট পরা একটা মূর্তি, আবছা , যার মুণ্ডু নেই। আসলে সে নিচের থেকে দেখছিল, তাই গলার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে তার ঘুম ভেঙে যায়। কারণ গলার কাছটাতেই সংখ্যাগুরু মদ্যপ হয়ে তাকে হেঁকে তোলে। তারপর হুমকি-খিস্তি ইত্যাদি ইত্যাদির পর তার বিচার শুরু হয়। কুরহান তখন একা ছাদেরউপরটাতে বসছিল। কারণ পরিস্থিতি সেদিনের পর থেকেই নজরবন্দি করেছিল তাকে। সারাদিন একা ছাদে বসে সে ছাতিমফুল আর বেদনার গন্ধ অনুভব করত আকাশের দিকে তাকিয়ে। বিবস্বানকে সংখ্যা গুরুদের ট্রাইব্যুনাল দোষী সাব্যস্ত করে। মাঝরাতের খানিক পরে শেষ হয় গণবিচার। পরদিন বিকালে শহরের মাঝে দাঁড়িয়ে আরো অনেকের সাথে বিবস্বান তার প্রতিবাদ জানায়। ভালো অভিনয় করার লোভে সংখ্যাগুরুদের মধ্যে থেকে সেখানে জড়ো হয়, ফোটে ওঠে। বুরহানের শুকিয়ে যাওয়া রক্তপড়া শরীর ঘুড়ির মত উড়তে উড়তে সেঁটে যায়। পাঁচ, দশ কুংবা পনের তলা বাড়ির আন্টানায়। পতাকা হয়। বিকেলের রোদ মেখে উড়তে উড়তে শোনা যায় রাজ্যপালের ভাষণ। কখন কিভাবে ভালো মরদ মানে চোদনকারী অথবা দেশ(ভ)ক্ত বনতে হয়। পরদিন সেটাই কাগজের প্রথম পাতায় বেরোয়। আর পিঙ্কি কোকিয়ে ওঠে ওর মুখেই হেগে দেয়।