হয়ত যেমন খুশি তেমন লেখার ইচ্ছাটাই তুষ্টি ভট্টাচার্যের নিরীক্ষা

Post date: Sep 1, 2017 2:34:52 AM

অনেক কবিই আসলে ইচ্ছে করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন না। কারণ তারা ধরেই নেন নিরীক্ষা তাদের দিয়ে হবে না। কিন্তু ওদের মনের ভেতরে লেখার ইচ্ছাটা থাকে প্রবল। ফলে তারা যা বলেন এবং বিশ্বাস করেন, দেখা যায় তার চেয়েঅনেক ভাল কিছু লিখছেন।

তুষ্টি ভট্টাচার্যের সাথে আমার আগে কথা হয় নি বললেই চলে। উনি কবিতা লিখেন। ফেসবুকেই পরিচয়। ফেসবুক পোস্টে উনার একটি কবিতা পড়ে আমি একটু ভাবলাম। কবিতা আপনাদেরও পড়াতে ইচ্ছে করছে। কবিতার প্রথম অংশটি পড়ুন-

১) সম্পাদক চেয়েছেন পাঁচটি। পাঁচটি বা তার বেশীই কিছু চাই তাঁর। এমন অবস্থায় কবি ভাবছেন ডিম্যান্ড অ্যান্ড সাপ্লাইয়ের সাইকোডেলিকাল অর্ডার তিনি ঠিকঠাক মেনটেন করতে পেরেছেন কী না বা এতদিনে কোন কোন সিস্টেমে কি কি ইনপুট করতে পেরেছেন। সংখ্যাতত্ত্বের দিক থেকে দেখলে তাঁর সাপ্লাইয়ের গ্রাফ নিম্নমুখী। গ্রাফের নিম্ন অভিমুখ থেকে মুখ তুলতেই কবির আকাশ হাতছানি দিল। এই সময়টা আকাশের নয়। আকাশ থেকে এখন কোন দৈব কবিতার মত বাণী ঝরে পড়ে না। হোঁচট খাওয়ার আগের মুহূর্তে কবি সাপ্লাইয়ের তরিকা নিয়ে কিছু অংক কষলেন।

আমি খুব মজা পেয়ে গেলাম। আপনিও পেয়েছেন নিশ্চয়ই। ফেসবুকে উনাকে উনার পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। উনি যা জানালেন, সেটা আমাকে আরও বিস্মিত করেছে। উনি বলছেন-আমার লেখার কোন নির্দিষ্ট ধারা নেই। আজ একরকম লিখি তো, দু মাস পরে আবার অন্য রকম। লেখা, সে গদ্য বা কবিতা যাই হোক, আমার ইচ্ছে ও মর্জি নির্ভর। যে খেয়ালখুশির কাছে আমি নিজে বারবার পরাস্ত হই। আমি পাঁচ মিনিট পরে কী লিখব, নিজেই জানি না। তাই পরিকল্পনা করে কিছু লেখা আমার পক্ষে খুব সমস্যার।গদ্যের বা বিষয় ভিত্তিক লেখার ক্ষেত্রে তবু কিছুটা বা অনেকটা চিন্তাভাবনা করতে হয়। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে অবচেতন থেকে যে চিন্তাভাবনা আমাকে নির্দেশ দেয়, আমি সেভাবেই লিখি।

সেটা হতেই পারে। তবে আমি নিশ্চিত যে উনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তা না হলে কবিতায় এমন ভাষা হবার কথা নয়। কথা আমি তার পেয়েই গেলাম- প্রমিত ভাষার ব্যবহার এড়িয়ে চলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এবং মূলত সহজ ও আটপৌরে শব্দ নির্বাচন করি সচেতন ভাবেই। দুর্বোদ্ধ্য কিছু লিখি না বলেই মনে হয়, যদিও শ্লেষ বা ব্যঙ্গ আমার লেখায় এসে যায় বারবার। তো, এই সোনাব্যাঙ কবিতাটিও ব্যঙ্গার্থে লেখা। এর পেছনে একটা ছোট্ট গল্প আছে। এক সম্পাদক শারদীয়া সংখ্যার জন্য কম করে পাঁচটি কবিতা দাবী করলেন একবার। এদিকে তখন ভাঁড়ার ফাঁকা। খুব রাগ হল আর মনে মনে বললাম, পাঁচটা কবিতা দেবে না ব্যাঙ দেবে! ব্যাস্‌, তৎক্ষণাৎ সোনাব্যাঙ কবিতার পাঁচটি সিরিজ লেখা হয়ে গেল।

একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তো পাওয়াই গেল। উনি প্রমিত ভাষার ব্যবহার এড়িয়ে চলেন। সহজ ও আটপৌরে শব্দ ব্যবহার করেন। এটা নিঃসন্দেহে একটা নিরীক্ষা। তার আগে আমরা তার পুরো সোনাব্যাঙ কবিতাটাই পড়ি।

২) অংকের সময়ে কবি চোখ বুজে ফেলেন। তাঁর বোজা চোখ থেকে এক দিব্য আলো এসে পড়ে অংকের খাতায়। বীজগণিত থেকে বীজ উপড়ে নিয়ে পুঁতে দেন ক্যালকুলাসে। এযাবৎ বীজ ফুঁড়ে ওঠা আগাছার ঢের যত্ন নিয়েছেন তিনি। রাতে ঘুমের ঘোড়ে বিড়বিড় করে বলেছেন, জয় মার্কসের জয়! পাঠক, ভুলেও কার্ল মার্কস্‌ বা মার্কোজের নাম কবির স্মরণে আনবেন না। কবির ঘুম ভেঙে গেলে যে বিস্ফোরণের সামনা করব আমরা, তার কোন হিসেবনিকেশ করে উঠতে পারেন নি স্বয়ং আর্যভট্ট।

৩) জ্যোতি নামের প্রেমিকাকে নিয়ে কবির মাথাব্যথা। তিনি অন্য নামের আলো সহ্য করতে পারেন না। এমতাবস্থায় চক্ষু চিকিৎসক তাঁকে ডার্ক গ্লাস পরতে পরামর্শ দিলেন। তিনি কালো কাচ পড়লেন বিস্তর। মুখস্থ করতে করতে সমূহ সম্ভাবনা তাঁর চোখের ভেতর টপ্‌কে পড়ল। তিনি জ্যোতির হাতে গুঁজে দিলেন ভায়গ্রা এবং কনডোম। ফলে সন্তান উৎপাদনের সক্ষমতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করার অবস্থান কোন পক্ষেরই থাকল না।

৪) বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কবি ভ্রমণে যান সমুদ্র থেকে কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে। এবং পাহাড় থেকে এতটাই দূরে থাকতে চান যে তাঁর নিজের মাথাকেই পাহাড় বলে ভেবে নেয় তাঁর ছায়া। ছায়া থেকে মাথা-পাহাড়ের যে দূরত্ব, সেই দূরত্ব মাপতে কবি ফিতে হয়ে যান। ফিতে কৃমির আদলে এঁকেবেঁকে যা মাপা হয়, তার মাপ কবির থেকে অন্তত দশগুণ বড়। আমাদের চোখের আড়ালে কবির অ্যান্টিটোড থেকে কিছু ব্যাঙ লাফ দিয়ে কুয়োয় ফিরে যায়।

৫) এই বর্ষার মরশুমে বেশ কিছু ব্যাঙাচির ব্যাঙ হবার সম্ভাবনায় বাদ সেধেছে কোন ডোম। ইলেকট্রিক চুল্লীর অযুহাতে ব্যঙাচির ছাইমাখা সেই কোন এক ডোম শিব গড়তে ব্রহ্মা গড়ছেন। ব্রহ্মার চারমাথা থেকে সিগন্যাল বিচ্ছুরিত হতে দেখে বিষ্ণুর মর্তে আগমন। বিষ্ণুর পাঁচটি ব্যাঙ পাঁচটি কবিতা লালন করে। তাদের পেটের ভেতরে সেই কবিতা বেড়ে ওঠে এমনভাবে যেন পৃথিবী ফেটে যাবে এখুনি। ব্যাঙদের পেটে পেটে কবিতা, কবিতার শরীর ভর্তি ব্যাঙাচি... ব্যাঙ ভরা এই ভুবনে কবির কবিতার আদ্যক্ষর থেকে জেড পর্যন্ত কষ্ঠি পাথরে ঝালাই করে দেখা গেছে, সব ব্যাঙই সোনা মাত্র।

বেশ মজার, তাই না? তো আমি তাকে সোনাব্যাঙ কবিতার বিষয়েই বলতে দেখলাম-

দুর্বোদ্ধ্য কিছু লিখি না বলেই মনে হয়, যদিও শ্লেষ বা ব্যঙ্গ আমার লেখায় এসে যায় বারবার। তো, এই সোনাব্যাঙ কবিতাটিও ব্যঙ্গার্থে লেখা। এর পেছনে একটা ছোট্ট গল্প আছে। এক সম্পাদক শারদীয়া সংখ্যার জন্য কম করে পাঁচটি কবিতা দাবী করলেন একবার। এদিকে তখন ভাঁড়ার ফাঁকা। খুব রাগ হল আর মনে মনে বললাম, পাঁচটা কবিতা দেবে না ব্যাঙ দেবে! ব্যাস্‌, তৎক্ষণাৎ সোনাব্যাঙ কবিতার পাঁচটি সিরিজ লেখা হয়ে গেল। দেখতাম, বিখ্যাত কবিরা নামী কাগজে শয়ে শয়ে কবিতা ছাপছে এই সময়ে। ভাবলে আশ্চর্য লাগত, এত উৎপাদন কীভাবে করেন এঁরা? শুধু তাই নয়, কে কত বেশি লিখেছেন, বা কত নামী কাগজে লিখছেন, এই নিয়ে তাঁদের টিআরপি ওঠানামা করে। এইরকম ভাবনা মাথার পেছনে ছিলই। ফলে রাগে বলুন, আর বিদ্রুপে, এই কবিতা লেখা হল। কবিতাকে কোন থিওরি দিয়ে লেখায় আমি বিশ্বাসী নই, নই কোন ঘরানার দাস। ঠিক আমার মাথার ভেতর থেকে, বুকের ভেতর থেকে (হ্যাঁ, কবিতা মস্তিষ্ক ও হৃদয় দুই দিয়েই আমি লিখি, কোন একটির ব্যবহার আমার কাছে একপেশে মনে হয়)যে সিগন্যাল আসে, বা বলা ভাল ওই সিগন্যালই আমার হাতে ধরে লিখিয়ে নেয়। প্রচলিত ছন্দ মেপে লিখতে আমি স্বচ্ছন্দ নই, তেমনি নিছক মিষ্টি-মধুর প্রেম বিরহের লেখাতেও আমি নতুন কিছু লেখার সার খুঁজে পাই না। উদ্ভট পরীক্ষা নিরীক্ষাও আমার আসে না। ফলে এই কবিতায় আমি কী নিরীক্ষা করতে চেয়েছি, তা আমি নিজেই জানি না। লিখতে ইচ্ছে হয়েছে, লিখেছি। এই ইচ্ছেটাই আমার কাছে শেষ কথা। যেমন খুশি ইচ্ছে লিখি আমি।

উনি পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে উদ্ভটই বলছেন। আবার যেমন খুশি তেমন লেখার ইচ্ছাটাও আছে। হয়ত তার ইচ্ছাটাই কবিতাকে একটা ভিন্ন নিরীক্ষার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, উনি না চাইলেও। তুষ্টি লিখছেন বছর চারেক হল। হয়ত তার ইচ্ছাটাই তাকে নিয়ে যাবে নতুন এক কবিতার পৃথিবীতে।