এই গল্পে প্রধান নিরীক্ষা করতে চেয়েছি বিভিন্ন কালে (বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যত) ওঠানামা করা: মুরাদুল ইসলামের গল্প ও নিরীক্ষা

Post date: Oct 29, 2017 5:54:20 PM

মুরাদুল ইসলাম বলছিলেন, এই গল্পে প্রধান নিরীক্ষাটা, যা আমি করতে চেয়েছি তা হলো সময়ের বিভিন্ন কালে (বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যত) ওঠানামা করা। এই ধরনের এটা আমার প্রথম গল্প। হয়ত পাঠকের পড়তে অসুবিধা হবে, কিন্তু মনে হয় যদি কেউ পড়তে যান তাহলে এ গল্পটি বেশি মনোযোগ দাবি করবে। এই মনোযোগ গল্পটির সাথে পাঠকের গাঢ় সংযোগ তৈরিতে সক্ষম হবে বলে ধারণা করি।

বিষয়বস্তু অনেকটাই গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত লোককথার সাথে যুক্ত, এবং এইরকম একটি ঘটনা আমাদের জগন্নাথপুর এলাকায় ঘটেছিল বলে লোকমুখে শোনা যায়। ফলে বিষয়বস্তু ভিত্তিক নিরীক্ষা এখানে হয় নি, উপস্থাপনের দিক থেকে হয়েছে বলে আমি মনে করি।

তার ভাষায়-এই গল্পের বর্ণনায় দাঁড়ি ব্যবহার করি নি। দাঁড়ি ছাড়া এমন আরো গল্প লিখেছি। যেমন, মসলিন চাষী, গরু ও মানুষের বিবরণ, তকদির ইত্যাদি।

মসলিন চাষী, বা গরু ও মানুষের বিবরণ গল্পে বিষয়বস্তু ভিত্তিক ভিন্নতা ছিল, যাকে বিষয়বস্তু ভিত্তিক নিরীক্ষা বলা যায়। মসলিন চাষীতে একজন লোক স্বপ্নে দেখে সে প্রাচীন বাংলার একজন মসলিন শ্রমিক, এবং এইসব দুঃস্বপ্নের ভিতর দিয়ে সে একটি ইঁদুরে পরিণত হয়। গল্প কথক হিসেবে সে খুব নির্ভরযোগ্য না, অপ্রকৃতিস্থ।

গরু ও মানুষের বিবরণ কসাইখানা থেকে পালিয়ে আসা একটি গরুকে নিয়ে, মূলত আধুনিক সমাজের এনিম্যাল ফার্মিং এর নামে ভয়ানক যে অপরাধ মানবজাতি করে যাচ্ছে সেদিকে ইঙ্গিত করে।

তকদির গল্পটিতে সাধারণভাবে শুরু করা হয়েছে, যেন অপ্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলে যাচ্ছেন গল্পকথক। মাঝখানে গল্পের ঘটনা, যা কথোপকথন আকারেই অনেকাংশে। এরপরে আবার অপ্রাসঙ্গিক কিছু ঘটনা। এবং শেষদিকে আবার মূল ঘটনায় ফিরে দ্রুত চমক দেবার চেষ্টা করা হয়েছে পাঠকদের।

সম্প্রতি আরেকটি গল্প লেখার চেষ্টা করছি, যাতে রাশোমন পদ্বতিতে তিন বা চারটি গল্প বলার চেষ্টা করছি একই ঘটনার, যার কোনটাই নির্ভরযোগ্য নয়। এবং এই তিন বা চারটি ঘটনার সাথে পারস্য সাহিত্যের কয়েকজন গল্পকারকেও ধরার চেষ্টা করছি।

আরেকটি গল্পের কথা এ স্থলে বলা যায়, পিপীলিকার পাখা, এতা উলোখাগড়া সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আমার প্রিয় একটি ফিল্ম সুইডিশ পরিচালক রয় এন্ডারসনের সংগস ফ্রম দি সেকন্ড ফ্লোর। এর গল্প, গল্প বলার ভঙ্গি বা উপস্থাপনের ধরন আমার কাছে অসাধারণ লেগেছিল। সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে গল্পটি লিখেছিলাম।

প্রিয় পাঠক, চলুন পড়ে দেখা যাক গল্পটি-

একটি পানিবাহিত গল্প

মুরাদুল ইসলাম

কটাই মিয়া যেদিন তার দুই পুত্রের জন্য দু’খানা নৌকা তৈয়ার করা শুরু করেছিলেন সেদিন তিনি ঘূনাক্ষরেও ভাবেন নি এই তরণীদ্বয়ই তার উত্তরপুরুষের জীবননাশের কারণ হবে এবং তার বংশের কোন চিহ্নই আর পৃথিবীতে থাকবে না, এবং এও তার জানার কথা ছিল না যে তার সাথে কোনরূপ রক্ত সম্পর্কহীন এক যুবক আব্দুল হামিদের সারা গা পিচ্ছিল হয়ে যাবার পিছনেও এই নৌকাদুটির একটি উহ্য ভূমিকা থাকবে, অনেক অনেক দিন পর;

কটাই মিয়ার দুই পুত্র সুজা মিয়া ও ভদ্র মিয়ার সেই মর্মান্তিক ঘটনাটির অনেক অনেক দিন পর, যখন সে ঘটনাটি কেবলই এক হৃদয় বিদারক অত্যাশ্চর্য ঘটনা হয়ে রয়ে আছে লোকমুখে, যুবক আব্দুল আব্দুল হামিদ শনিবার দুপুরে হেঁটে যাচ্ছিল মরাদীঘির পাশ দিয়ে, তার পরনে ছিল শাদা টিশার্ট এবং কালো প্যান্ট, এবং তার মনে ছিল একরাশ রঙহীন বেদনা; তার বেদনার উৎস হয়ত কোন মানবিক ঘটনা, হয়ত কোন প্রেম বা অন্য কিছু যা আমাদের অজানা, কারন মানব মনের গহীনের খবর সেই মানব ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে জানা কখনো সম্ভব নয়; সেই অজানা বিষাদের উৎস সন্ধান, সেই দুঃখের গতি ও প্রকৃতি সম্পর্কে যেহেতু জানার কোন সুযোগ নেই, তাই সেদিকে না গিয়ে আপনাদের জানিয়ে রাখি যে, সেদিন, সেই শনিবার দুপুরে মরাদীঘির পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আব্দুল হামিদের সারা শরীর পিচ্ছিল হয়ে ওঠে;

মরাদিঘীর পাশের রাস্তা দুপুরে জনমানবহীন, সেই রাস্তায় কেবল থেমে থেমে বইছে দমকা বাতাস, তা কোন পৃথিবী থেকে আসছে তা জানা যায় না; আব্দুল হামিদ সেই পথ দিয়ে হাঁটছিল একা একা এবং প্রথম সে অনুভব করে তার ঘাড়ের দিকে পিচ্ছিলতা এবং সেই পিচ্ছিলতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, ছড়িয়ে পড়তে থাকে, আব্দুল হামিদ হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করতে থাকে সেই পিচ্ছিলতার ছড়িয়ে পড়া, নিজস্ব বিষাদে বিভোর আব্দুল হামিদ প্রথম পর্যায়ে সেদিকে লক্ষ্য দেয় না এবং একবার তার মনে হয় তার অন্তস্থ বিষাদ বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে কোনভাবে, তাই হয়ত এমন লাগছে, কিন্তু একসময় সে সত্যি সত্যি অবাক হয়ে যায় যখন সে বুঝতে পারে অদ্ভুত এক পিচ্ছিলতা তার সারা শরীরকে জড়িয়ে ধরছে, নাকে এসে লাগছে বাসি গোবরের গন্ধ;

এর অনেক অনেক দিন পূর্বে বয়স্ক কটাই মিয়ার মনে হয়েছিল তার দুই পুত্রের জন্য দু’টি নৌকা তৈরি করা জরুরি, কারণ তাদের বসত ভিটার অনতিদূরে বিশাল দীঘি, দীঘিটার নাম তখনো মরাদীঘি হয় নি, এছাড়া যখনকার কথা এটা তখন নৌকা এক আভিজাত্যের লক্ষণ ছিল; নৌকাদ্বয় তৈরি করার জন্য সংগ্রহ করা জারুল কাঠ দীঘিতেই ডুবিয়ে রেখেছিলেন কটাই মিয়া এবং এই কাঠ ডুবানোর সময়ই একটা ঘটনা ঘটে যা উপস্থিত লোকসকলের মনে বিপুল প্রাণচাঞ্চল্য এনে দেয়, কটাই মিয়ার কাজের লোক শিশু মিয়া একটি খুবই বিশাল শোল মাছ ধরে ফেলে; মাছটির লেজের রঙ ছিল লাল;

এত বড় মাছ এর আগে এলাকায় কেউ চোখে দেখে নি, কানেও শুনে নি এত বড় মাছের কথা; যখনকার কথা বলা হচ্ছে তা অনেক অনেক আগের, যুবক আব্দুল হামিদ, যার গা অদ্ভুতভাবে পিচ্ছিল হয়ে পড়ে মরাদীঘির পাশের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, তার তখন জন্মই হয় নি, তার বাপ আব্দুল মজিদের জন্মও হয় নি, তার দাদা, মুন্সী বাড়ির সবচেয়ে বিখ্যাত ছেলে আবু আলীর জন্ম হয়ত হয়েছিল অথবা সে হয়ত তার মায়ের পেটে ছিল, তখন, সেই সময়েও এত বড় মাছ এলাকাতে আর দেখা যায় নি, এত বড় বিশাল মাছ, বিশাল বিশাল তার চোখ যেন দুই ফুটবল; এত বড় মাছটি কটাই মিয়ার টিঙটিঙে রোগা কাজের লোক শিশু মিয়া কীভাবে পাকড়াও করল তা এক বিস্ময়ের বিষয় বটে কারণ এইরকম আকার ও আকৃতির মাছ জনা বিশেক স্বাস্থ্যবান লোক মিলেও টেনে তুলতে পারবে কি না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না; শিশু মিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী, সে স্বাভাবিক নিয়মে নৌকার জন্য আনা কাঠগুলি পানিতে ডুবিয়ে রাখছিল, এইসময় তার হাত পড়ে পিচ্ছিল এক বস্তুর উপরে, তার মনে হয় বস্তুটি হয়ত মাঝারি আকৃতির কোন কোন কালবাউশ, তাই সে দু’হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করে এবং ধরে ফেলে, মাছটি ছিল নিরব, নিশ্চুপ, যেন কোন পাথরের মূর্তি বিশেষ; শিশু মিয়ার অবশ্য সেদিকে লক্ষ্য দেয়ার কোন কারণ ছিল না, সে কোনমতে মাছটি ধরে পাড়ের দিকে ছুঁড়ে মারে; তার কাছে পানির নিচে থাকা মাছের ওজন পালকের ন্যায় হালকা মনে হয়, তাই সে আয়েশেই মাছটাকে পাড়ে ছুঁড়ে ফেলে কিন্তু পাড়ে পতিত হওয়া মাছটিকে দেখে অন্য সবার মত তার নিজের চোখও ছানাবড়া হয়ে যায় এবং সেই ক্ষণে পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্য মানুষটি ছিল শিশু মিয়া তা নির্দ্বিধায় বলা যায়;

পাড়ে মাছটি প্রায় নিথর হয়ে পড়ে থাকে এবং মাঝে মাঝে খুবই অল্প অল্প লাল লেজ নাড়ে, যেন সে নিতান্ত অনিচ্ছায় অলস ভাবে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে; উপস্থিত লোকেরা, যারা কটাই মিয়ার নৌকার জন্যে সংগৃহীত কাঠ ডুবানো দেখতে এসেছিল, এবং যারা কাঠ ডুবানোর কাজ করছিল তারা সবাই অবাক হয়ে যায়; দীঘির নৌকাঘাটে বাঁধা নৌকাগুলিতে বসে থাকা মাঝিরা, পারাপারের জন্য আগত লোকেরা এবং আরো নানা ধরনের লোকেরা উৎসুক হয়ে এগিয়ে আসতে থাকে বৃহৎ মাছের দর্শনে; কটাই মিয়ার চোখ আনন্দে চকচক করে উঠে, তিনি আনন্দিত মুখে মাছটির কাছে চলে আসেন এবং ধারালো কুড়ালটি নিয়ে মাছের সামনে গিয়ে দাঁড়ান; কিছু বর্ষীয়ান লোক সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তারা এত বড় এবং বিস্ময়কর মাছটিকে বধ করার বিরুদ্ধে ছিলেন, তারা কটাই মিয়াকে তাদের মনোভাব জানান কিন্তু কুড়াল হাতে তেজোদীপ্ত কটাই মিয়াকে বাঁধা দেবে এমন সাধ্য কারো ছিল না, তিনি যেন তার গায়ে প্রথম যৌবনের তেজ ও শক্তি অনুভব করতে লাগলেন, তার রক্তে রক্তে বইছিল উষ্ণ উত্তেজনা, এবং কারণহীন এক আক্রোশ; কুড়ালের ঘায়ের পর ঘায়ের মাধ্যমে তিনি মাছটিকে খন্ড বিখন্ড করেন, কটাই মিয়ার ছিল ধাতুর মত পেটানো শরীর, আসুরিক শক্তি তখনো বর্তমান ছিল তার শরীরে, কিন্তু মাছটিকে খন্ড বিখন্ড করতে করতে তিনি হাঁপিয়ে উঠেন, তার গা বেয়ে বইল ঘামের স্রোত, ঠিক যেমন অনেক অনেক দিন পরে তার দুই পুত্র একইভাবে কুড়ালের ঘায়ের পর ঘা দিয়ে চলছিলো নৌকায় এবং তাদের শরীরেও ঠিক একই ভাবে দেখা দিয়েছিল ঘামের ধারা;

কটাই মিয়ার দুই পুত্র সুজা মিয়া এবং ভদ্র মিয়া, তাদের ঘর সংসার, প্রত্যেকের ঘরে তিনটি করে সন্তান, তাদের দুই স্ত্রী, বাস তাদের পরস্পরের পাশাপাশি, আর অনতিদূরে ছিল মরাদীঘি, তখনো তার নাম মরাদীঘি হয় নি, তখনো তাতে কখনো অলৌকিক বাসন কোসন ভেসে উঠবার কথা কেউ শোনে নি; সুজা এবং ভদ্রের যখন বাস তখন কটাই মিয়ার জারুল কাঠ দ্বারা দুইটি নৌকা নির্মান এবং সেই বৃহৎ শোল মাছটি কুড়োল দিয়ে কুপিয়ে খন্ড বিখন্ড করার সময় থেকে অনেক সময় চলে গেছে; কটাই মিয়া যখন বর্ষীয়ানদের বারন স্বত্ত্বেও বৃহৎ মাছটি কাটেন তখন অনেকে আশংকা করেছিলেন তার বংশের কোন বড় ক্ষতি হবে, দীঘিতে অস্বাভাবিকতা দেখা দেবে, কারণ যে মাছটিকে কেটেছেন কটাই মিয়া তা কোন মাছ ছিল না, তিনি ছিলেন অন্য কিছু; কটাই মিয়া তার চিরাচরিত দুর্বীনিত চারিত্রিক বলের কারণে সেসব প্রাচীন ভয়কে পাত্তা দেন নি, হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, হাসি ভয়ের বিপরীতে এক মারাত্মক ব্রহ্মাস্ত্র এবং সত্যি সত্যি দেখা গেল, তার পরিবার, গ্রাম এবং দীঘিতে কোন অস্বাভাবিকতা দেখা গেল না মাছটি কাটার পর; এর অনেক বছর পরে সুজা এবং ভদ্র দুই ভাই পাশাপাশি বসবাস করে আসছিলেন, বাপের সম্পত্তির হিস্যা হিসেবে প্রত্যেক ভাই অর্ধেক সম্পত্তির সাথে পেয়েছিলেন বাপ কটাই মিয়ার দু’টি নৌকার একটি ক’রে এবং মূলত কটাই মিয়া নৌকা দু’টি বানিয়েছিলেন তার পুত্রদ্বয়ের জন্যই কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি তার সম্পত্তি বা নৌকা দু’টি পুত্রদের হাতে হস্তান্তর করে যেতে পারেন নি কারণ একদিন, মঙ্গলবার সকালে অপ্রত্যাশিত ভাবে হেঁচকি উঠে তিনি মারা যান;

সবাই একইরকম ভালো অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, আবার যেহেতু আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি তার চরিত্র বিস্ময়কর এবং আগত সময় নানা ধরনের অনিশ্চয়তায় আপাদমস্তক ভরপুর থাকে তাই সবার অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত ভালো হয় না, এমন হয়েছিল সুজা মিয়ার ক্ষেত্রে, এবং দুর্ভাগ্য তার, তিনি দ্রুতই উত্তরাধীকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিগুলি হারিয়ে ফেলেন; তার ঘরে হানা দেয় অনাহার;

অন্যদিকে তার ছোট ভাই ভদ্র মিয়ার অবস্থা ছিল ভিন্ন, পিতার কাছ থেকে প্রাপ্ত সম্পত্তি তিনি বাড়িয়ে চলছিলেন এবং পাশাপাশি দুই ভাইয়ের এই দুই ভিন্ন চিত্র লোকসকলকে বিস্মিত করত;

মরাদীঘি, তখনো দীঘিটির এই নাম হয় নি, দুই ভাইয়ের বাড়ির পাশে বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে অবস্থান করত এবং এদিক দিয়ে গ্রামের বাইরে যেতে হলে দীঘির উপর দিয়েই নৌকা করে যেতে হত, এবং দুই ভাই সুজা এবং ভদ্রের যেহেতু পিতৃপ্রদত্ত নৌকা ছিল তাই তাদের নৌকায় চড়ে প্রায়ই দীঘির উপর দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতে দেখা যেত, কোনদিন কোন বিপদের মুখে তারা পড়েন নি; নৌকাঘাটের অন্যান্য নৌকার মাঝিরা, যারা এলাকার লোকদের দীঘির অন্যপাড়ে নিয়ে যেত এবং অন্যপাড় থেকে মানুষদের এ পাড়ে নিয়ে আসত, তাদের কাছে সুজা এবং ভদ্র দুই ভাইয়ের নৌকাই খুব পরিচিত ছিল;

এক পরিষ্কার রোদের উজ্জ্বল দিনে সুজার ঘরে চাল নেই, সন্তানেরা অনাহারে, তিনি ভাই ভদ্রের কাছে গেলেন, দুই ভাইয়ে খুব সদ্ভাব ছিল এমন বলা যায় না এবং তাদের স্ত্রীদের মধ্যে মারাত্মক বিরূপতা ছিল তা নিশ্চিতরূপেই বলা যায়, তথাপি সুজা ছোট ভাই ভদ্রের কাছে গেলেন চালের জন্য কারণ ঘরে তার সন্তানেরা অনাহারে; ভাইয়ের কথায় ভদ্র নিজ হাতে কিছু চাল একটি কাপড়ের পুঁটলিতে বেঁধে দিয়ে দিলেন এবং চলে গেলেন ক্ষেতে; সুজা তার স্ত্রী’র কাছে চাল দিয়ে নিজে চলে গেলেন বাজারে আড্ডা দিতে বা অন্য কোন ভাবে সময় ব্যয় করতে; এ পর্যন্ত তাদের গল্পটি সুন্দর ছিল, কিন্তু গল্প নতুন বাঁক নেয় যখন ঘন্টা তিনেক পরে সুজা বাড়িতে ফিরে আসেন এবং দেখতে পান তার সন্তানেরা না খেতে পেয়ে কাঁদছে; তার মুখরা স্ত্রী তাকে এবং তার অকর্মণ্যতাকে উদ্দেশ্য করে নানা কথা শোনান যার বেশীরভাগই ভদ্রসমাজে প্রকাশের অযোগ্য; সুজা শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারেন যে রান্না হয় নি কারণ তিনি চলে যাবার পর তার ভাইয়ের বউ এসে চাল ফেরত নিয়ে গেছে; ক্রোধে এবং নিজের অথর্বতায় অসহায় সুজা মিয়া তার নৌকা বার করেন, আলগোছে কুড়ালখানি নেন, এবং নানাবাড়িতে নেবার কথা বলে সন্তানদের নৌকায় তুলেন, লম্বা বাঁশের লগির সাহায্যে নৌকা দীঘিতে ভাসান এবং একসময় মাঝদীঘিতে পৌছে যান; এরপর ধারালো কুড়াল তুলে কোপের পর কোপ মারেন নৌকায়, যেন তিনি নিজের দুর্ভাগ্যকে, নিজের অকর্মণ্যতাকে কুপিয়ে হত্যা করছেন; নৌকায় জল প্রবেশ করে এবং সন্তানাদি সহ কটাই মিয়ার বড় ছেলে সুজা মিয়া দীঘির জলে ডুবে মারা যান;

এর ঘন্টা খানেক পরে সুজা মিয়ার ভাই ভদ্র মিয়া ক্ষেতের কাজ শেষে বাড়িতে ফেরেন; ভাইয়ের বাড়িতে ভ্রাতৃবধূর কান্না দেখে তিনি এগিয়ে যান এবং তার স্ত্রীর চাল কেড়ে নেবার বিষয়টি অবগত হন; তিনি এটাও জানতে পারেন যে তার ভাই সন্তানদের নিয়ে নৌকা ভাসিয়ে চলে গেছেন দীঘিতে; ভাইয়ের প্রকৃতি সম্পর্কে ভদ্রের জানা ছিল, তিনি দীঘির নৌকাঘাটে যান, ভাইকে খুঁজে ফেরেন এবং ঘাটের মাঝিদের বয়ানে তিনি বুঝতে পারেন তার ভাই ও ভাইয়ের সন্তানদের ভাগ্যে কী ঘটেছে; ভদ্র বাড়ি ফিরে আসেন; তিনি নিজের সন্তানদের নিয়ে নৌকায় উঠান, নৌকার পাটাতনের নিচে ধারালো কুড়াল; ভদ্র দীঘিতে নৌকা ভাসিয়ে সন্তানসহ মাঝদীঘিতে চলে যান, পাটাতনের নিচ থেকে কুড়াল বার করেন, আর একবার পুনরাবৃত্তি হয় কুড়ালচালনার, ভদ্র ঘামে নেয়ে উঠেন প্রায়, ঘামের সাথে সাথে তার শরীরে লাগে জলের ছিটা, তার পেশিবহুল শরীর ঠিক তার বাপ কটাই মিয়ার মত, বিকেলের ম্লান আলোতে টালমাটাল নৌকায় যেন চকচক করে উঠে; সন্তানসহ কটাই মিয়ার ছোট ছেলে, সুজা মিয়ার ভাই ভদ্র মিয়ার নৌকা জলে ডুবে যায়; যাত্রীদের প্রত্যেকে মারা যান;

তার অনেক অনেক বছর পরে মরাদীঘির পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে আপন বিষাদে আনমনা আব্দুল হামিদের জামা ভিজে উঠে পিচ্ছিল কী এক পদার্থে, তা সেই ঘটনারও অনেক পরে, যখন সুজা ও ভদ্রের সন্তানসহ মরাদীঘির জলে ডুবে মরার পর সেখানে বছরে একবার শিন্নির জন্য পিতলের বাসন কোসন ভেসে উঠত, আর এক বছর হাফিজ মুন্সীর স্ত্রী নসিমন বিবি একটি পিতলের গ্লাস লুকিয়ে রেখেছিলেন তার গোয়ালঘরে গোবরের গাদায়; সেবার সকলে লক্ষ করে শিন্নি শেষে পিতলের বাসন কোসন ভাসিয়ে দেয়া হলেও সেগুলি ডুবে না, কেবল ভাসতে থাকে এবং ভাসতে থাকে; লোকসকলের মনে ভয় আর দুশ্চিন্তা নেমে আসে, তারা দীঘিতে নামার সাহস পায় না, কেবল পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভাসতে থাকা অলৌকিক বাসনদের দেখতে থাকে, আর তারপর একদিন বৃদ্ধ সামাদ মাতবর ইস্তেখারা করে ঘুমান ও রাতে স্বপ্নে দেখেন যে, একটি বাসন লুকিয়ে রাখা হয়েছে, ওটা ফেরত না দেয়া হলে বাসন ডুববে না; সামাদ মাতবর তার স্বপ্নের কথা সবার সামনে বয়ান করেন এবং হাফিজ মুন্সীর স্ত্রী নসিমন বিবি ভয় পেয়ে দৌঁড়ে তার গোয়ালঘরে যান এবং গোবরের গাদা হাতরে বের করে আনেন সেই চকচকে স্বর্ণাভ পিতলের গ্লাস; গ্লাসটি দীঘির পানিতে ছেড়ে দেয়া হলে তা ডুবে যায় এবং অন্যসব বাসনকোসনও একসাথে ডুবে যায়; এরপর থেকে দীঘিতে আর বাসন উঠে নি;

এর অনেক অনেক দিন পরে আব্দুল হামিদ মরাদীঘির পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সারা শরীরে পিচ্ছিলতা অনুভব করে এবং এই পিচ্ছিলতা তার সমস্ত শরীর গ্রাস করে নেয়; তার চোখ অবশ হয়ে যায়, সে ঝাপসা দেখতে থাকে, তা পা যেন হয়ে উঠে চলৎশক্তিহীন; সে নেশাগ্রস্থের মত টলতে টলতে চলে এবং একসময় পড়ে যায়; অজ্ঞান হবার আগমুহূর্তে সে দেখতে পায় আকাশে উড়ে যাচ্ছে এক কালো কাক যার বা পায়ে লাল কাপড় বাঁধা; সে অনুভব করে তার নাকে আসছে বাসি গোবরের গন্ধ;

কটাই মিয়ার দুইটি নৌকা নির্মান, দীঘিতে তার দুই পুত্রের সন্তানসহ মৃত্যু, দীঘিতে বাসনকোসন উঠে আসা ইত্যাদি ঘটনার অনেক অনেক দিন পরে এক শনিবার শেষ দুপুরে লোকেরা মরাদীঘির পাশের রাস্তায় হাফিজ মুন্সী ও নসিমন বিবির এক উত্তরপুরুষ, যুবক আব্দুল হামিদকে পায় অজ্ঞান অবস্থায়, সারা গায়ে পিচ্ছিল চটচটে গোবরগন্ধওয়ালা পদার্থ লেগে আছে তার...