আমরা যা করি তা হলো পরিবেশনের কৌশল: পিন্টু রহমানের গল্প ও নিরীক্ষা

Post date: Oct 25, 2017 5:44:39 PM

গল্পকার পিন্টু রহমান বলছিলেন-গল্পের শরীরে লেপ্টে থাকে ইতিহাস-ইতিহাস-ঐতিহ্য, দেশ-কাল, পাত্র-পাত্রীসহ নানাবিধ অনুষঙ্গ। এসবের কোন এক বা একাধিক বিষয় বিশেষ একটি গল্পে প্রাসঙ্গিক হয়ে বর্ণিত হয়। লেখক ভেদে হয়তো বর্ণনাকৌশল বা গল্প বলার ঢঙ আলাদা কিন্তু মূল প্রত্যয় অভিন্ন- যদি খুব বেশি ভিন্নতা হয় তবে তাকে আমি গল্প নয় রূপকথা হিসেবে আখ্যায়িত করবো। বস্তুত: এখানেই গল্প ও রূপকথার মধ্যকার মূল পার্থক্য। আর এ-কারণেই গল্প নিয়ে নিরীক্ষার খুব বেশি সুযোগ নেই; আমরা যা করি তা হলো পরিবেশনের কৌশল।

কিকার গাছ ও তিনটি পাখি গল্প নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বললেন-সাতচল্লিশের দেশভাগ নিয়ে অসংখ্য গল্প-উপন্যাস রচিত হয়েছে- এখনো হচ্ছে। খ্যাতিমান লেখক খুশবন্ত সিং- এর বিখ্যাত উপন্যাস ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ পাঠ করতে গিয়ে নিজের মধ্যে প্রচন্ড দহন অনুভূত হলো। মনে হলো, বহুদিন আগে সংঘঠিত ওই ঘটনাটার প্রত্যক্ষদর্শী আমি। নিজের মধ্যে গল্প ফাঁদার তাড়না! শেষমেষ লিখে ফেললাম দেশভাগের গল্প ‘কিকার গাছ ও তিনটি পাখি’। আমি যা করেছি- উপন্যাসের পাত্র-পাত্রী, স্থান অপরিবর্তিত রেখে নতুন আবহ সৃষ্টি করেছি। ইতিহাসের চরম ওই দুঃসময়কে বর্তমানের সাথে মিলিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা মাত্র। এমন প্রচেষ্টা আমাদের এগিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। তাতে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে মেলবন্ধন রচিত হবে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেশাত্মবোধ বৃদ্ধি পাবে। পাঞ্জাবের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পটভূমিকায় রচিত গল্পটির মানবিক আবেদন শুধুমাত্র পাঞ্জাবে সীমাবদ্ধ না থেকে বাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত। এ কথা মিথ্যে নয় যে,বিভাজনের ক্ষেত্রে বাংলা ও পাঞ্জাবের প্রতি চরম অবিচার করা হয়েছিল। বিশেষত বাংলার বিভাজন ন্যায়ের পরিপন্থি। ওই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমার বিবেক আমৃত্যু সোচ্চার থাকবে!

পাঠক চলুন পড়ে আসা যাক তার গল্প- কিকার গাছ ও তিনটি পাখি

গল্প- কিকার গাছ ও তিনটি পাখি

পিন্টু রহমান

যাত্রীপ্রসঙ্গ প্রাসঙ্গিক হিসেবে আলোচিত হলে বহুমুখী ভাবনা তাদের চৈতন্যে রেখাপাত করে। দূর অতীত থেকে নিকট বর্তমান পর্যন্ত ভাবে তারা। ভেবে ভেবে ব্যাকুল। তবু ভাবনার কিনারা হয় না; বরং আরো বেশি ডালপালাগজায়। কারো কারো কৌতূহল লাশ বিষয়ে- ট্রেনে কি তবে মুসলমানদের লাশ আসছে!

নাহ, যুতসই উত্তর নেই। কেউ কেউ বলাবলি করছে, সেই ট্রেনের মতো এই ট্রেনটাও ভূতুড়ে আর অপয়া! অবশ্য ভূত বিষয়ক উপাখ্যানে তরুণদের অনীহা; তারা একজন ম্যাজিশিয়ানকে নিয়ে ভাবত- শেষতক লোকটি আসবেতো?

পিপুল গাছের ছায়ায় ছেলে-বুড়ো-শিশু ও মেয়েদের উপস্থিতি বাড়তে থাকলে ভাবনার পরিধিও বেড়ে যায়। ম্যাজেশিয়ানকে নিয়ে বিবমিষা। লোকটি নিশ্চয় ছেলেধরা! শতদ্রু নদীর উপর ঝুলতে থাকা জরাজীর্ণ ব্রিজ সংস্কারেরজন্য যে মাথার প্রয়োজন, লোকটি হয়তো সেই মাথা সংগ্রহে আসছে!

খুবই ভয়াবহ ব্যাপার! ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রিজটিকে মুহূর্তে অপয়া বলে মনে হয়। বড় বড় ব্রিজ নির্মাণ ও মেরামতে যে মানুষের মাথা লাগে একথা মিথ্যে নয়-কমবেশি তারাও শুনেছে! বয়স্ক মেয়েরা একে অন্যেরমুখ চাওয়া-চাওয়ি করে; নেংটো শিশুদের কোলের মধ্যে জড়িয়ে ধরে; মাথা-মুখে পরম মমতায় হাত বোলায়; কেউ কেউ বুকে থুথু ছিটায়। ভয়ার্ত পরিবেশ দূর করতে জুগ্গাত সিং বার কয়েক গুরুর নাম উচ্চারণ করে; মা’দেরউদ্দেশ্য করে বলে, ভয় নেই; এসব সত্যি নয়, ওরা যা জানে না তাই আমাদের শোনাচ্ছে।

মিত সিং প্রতিবাদ করে, সত্য-মিথ্যার তুমি কি জানো জুগ্গাত? গুরুর নাম করে বলতে পারো- লোকটি যে আমাদের অনিষ্ট করতে আসছে না, তার নিশ্চয়তা কি? তাছাড়া দিল্লি ছেড়ে পাঞ্জাবের এই অখ্যাত গ্রামে আসবে কেনো! সে কী আমাদের আত্মীয়! নাকি আমরা তাকে নেমন্তন্ন করেছি?

মিত সিং এর সন্দেহ হয়তো অমূলক নয়। অন্য আরেকজন শিখ যুবক হাত নেড়ে নেড়ে জানায়, ওদের মতলব ভালো না ভাইজি। নতুন করে দিল্লি শহর ও শহরতলীতে দাঙ্গা শুরু হয়েছে।

ছেলেটির কথা থামিয়ে দিয়ে জুগ্গাত সিং বিস্ময় প্রকাশ করে, আবারো দাঙ্গা!

হা জ্বি। দাঙ্গাবাজরা মুসলমানদের হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট করছে, মেয়েদের ধর্ষণ করছে।

এসব কী বলছো তুমি? ইতিহাস থেকে কী ওরা শিক্ষা নেয়নি!

পিপুল গাছের নির্জনতা যেনো আরো ভারী হয়ে ওঠে! সকলের চোখে মুখে ভয়ের চিহ্ন। নিজেদের নিরাপত্তাহীন মনে হয়। ব্রিজের ওপারেই পাকিস্তান সীমান্তরক্ষীদের আস্তানা। উস্কানি ছাড়াই হঠাৎ হঠাৎ তারা গুলি ছোড়ে; সীমান্তরেখা অতিক্রম করে গরু-ছাগল ধরে নিয়ে যায়, জেলেদের নিকট থেকে মুক্তিপণ আদায় করে- কিন্তু দাঙ্গার খবর নিশ্চিত হলে হুলস্থূল বাঁধিয়ে দেবে; প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠবে। বোমা মেরে আশেপাশের গ্রামগুলোধ্বংস করে দেবে।

নতুন করে আর ধ্বংসের কথা ভাবতে পারে না; ইতিমধ্যে অনেক ধ্বংসের স্বাক্ষী তারা। সাতচল্লিশ পরবর্তী সময়ে প্রতিবেশী দেশ দু’টি কাশ্মির ইস্যুতে তিন-তিনবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। অসংখ্য প্রাণহানি ঘটেছে। গ্রাম ছেড়েসাধারণ জনগণ পালিয়েছে- যাদের অধিকাংশই এখন উদ্বাস্তু। খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিমানের শব্দ শুনলে কাঁচকি মাছের মতো ছুটে পালায়। জুগ্গাত নড়েচড়ে বসে। সর্দার তাদের সাহস যোগায়, ভয় নেই সিংজি, একটুও ভয় নেই; ওই ট্রেনে নাকি একজন ম্যাজেশিয়ান আছে!

ম্যাজেশিয়ান!

পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী মনো মাজরা গ্রাম, ছোট্ট রেলষ্টেশন, ষ্টেশন সংলগ্ন রেষ্টহাউজ ও অস্ত্রহাতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী। রক্ষীরা তৎপর; এদিক-সেদিক হাঁটাহাটি করছে। ভারি অস্ত্রসমূহ পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষবস্তুতে তাক করারয়েছে। অঘটন ঘটলে সমুচিত জবাব দেবে। ঘটন-অঘটন বিষয়ে জানার অধিকার আর সবার চেয়ে সর্দারের বেশি। কেননা, কারণে-অকারণে সে ষ্টেশনে যায়, যত্রতত্র ঘুরতে পারে। মাঝে-মাঝে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাকে ডেকেপাঠায়, গ্রামবাসীদের করণীয় বিষয়ে পরামর্শ দেয়। তাছাড়া ষ্টেশনে দায়িত্বরত সৈনিকরা তাকে চেনে; হাসি হাসি মুখ করে কুশল বিনিময় করে।

অতএব, গ্রামবাসীর ধারনা, ট্রেন বিষয়ে সর্দার নিশ্চয় অবগত! তারা তাকে ঘিরে ধরে বলে, দোহাই সর্দারজি, আমাদের সব খুলে বলুন; কথা দিচ্ছি একথা আমরা কাউকে বলবো না।

গুরুদুয়ারার প্রতি ইঙ্গিত করে বুকে থাপ্পড় মেরে জুগ্গাত সিং কসম কাটে, বলুন সর্দারজি, বলুন আমাকে; গুরুর নামে কসম কাটছি, জীবন গেলেও গোপন ফাঁস করবো না।

প্রত্যয়ী জুগ্গাত সিংকে দেখে কেমন অচেনা মনে হয়। তার শরীরে যেনো অশুরের শক্তি! গুরুদুয়ারার সেবক মিত সিং কয়েক পা এগিয়ে সর্দারের পাশে এসে দাঁড়ায়, আলতো করে কাঁধে হাত রাখে- বলো সর্দার, কোনো অনিষ্টহওয়ার আগে সত্য জানাও আমাদের; প্রয়োজন হলে গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবো।

না ভাইজি, এক চুল নড়বো না; ভিটেমাটি ছেড়ে কোথায় যাবো আমরা!

মিত সিং ইতিহাসের পথ ধরে- জুগ্গাত, মুসলমানদের কথা মনে নেই? মনে নেই, রাতের অন্ধকারে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কিভাবে তারা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে! এই গ্রামে তাদেরও ভিটেমাটি ছিল; বাপ-দাদার কবর ছিল। একটিমসজিদ ছিল। গুরুদুয়ারার পাশের ওই পরিত্যক্ত ফাঁকা জায়গাটার কথাই বা কেমন করে ভুলে যাচ্ছো?

ওরা ভুল করেছে ভাইজি। আমরা ভুল করতে চাই না।

ভুল ওদের না, ভুল আমাদের অদৃষ্টের; তা না হলে ইংরেজ সাহেবরা পাঞ্জাবকে এভাবে ভাগ করবে কেনো! তোমরাই বলো, ধড় থেকে দেহ আলাদা করলে কি মানুষ বাঁচে; না কি বাঁচতে পারে!

পরাধীনতার ইতিহাস আমাদের অস্থিমজ্জায়। মুঘল-পাঠান, সেন-পাল অসংখ্য শাসক শোষণ করলেও ইংরেজদের মতো ধূর্ত ছিল কী না সন্দেহ। যে তত্ত্বের তাত্ত্বিকতায় ভারত ভাগ করা হয়েছে তা ছিল অন্তঃসারশূন্য। পাঞ্জাব ওবাংলার ক্ষেত্রে তো রীতিমত প্রহসন। পরাজয়ের গ্লানি মানতে না পারা এবং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা জিইয়ে রাখতে পাঞ্জাব প্রদেশকে দু’টুকরো করা হয়েছে। এটা এমন এক সমস্যা, যা সমাধানের অযোগ্য। কাঁপা কাঁপা গলায়সিংজি পুনরায় বলে, জীবন কেনো এমন হয়; কেনো বার বার স্বপ্ন হারায়! এপারের মুসলমান আর ওপারের শিখগুলো বোধহয় খণ্ডিত কপাল নিয়ে জন্মিয়েছে! একসাথে বেশ তো ছিলাম; কারো সাথে কোন বিবাদ ছিল না, হানাহানি ছিল না। যে যার মতো ধর্ম পালন করতাম। উৎসবে মেতে উঠতাম। মাঠে-ঘাটে গল্প-গুজব করতাম।

মাঠের কাজকর্ম অসমাপ্ত রেখে আরো কয়েকজন যুবক পিপুল গাছের নিচে জমায়েত হয়। মাথার পাগড়ি খুলে রেখে রুমালে মুখ মোছে। ঢকাঢক শব্দে পানি পান করে। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে একজন কৃষক বলে, আহ, শান্তি!

মিত সিং এ কথায় খানিকটা বিরক্ত হয়। তীর্যক চোখে মানুষগুলোকে নিরীক্ষণ শেষে জিজ্ঞেস করে, তোমরা কি মশকরা করছো? এই বিপদের মধ্যে শান্তির কি দেখলে! নাকি তোমরা নিশ্চিত যে আগত ট্রেন আমাদের জন্য মৃত্যুরপরোয়ানা বয়ে আনছে না!

অস্থির চিত্তে সর্দার পুনরায় বলে, লেকিন ভাইজি, উস ট্রেন মে এক আচ্ছি চিজ হ্যায়; বো আদমি ম্যাজেশিয়ান।

ম্যাজেশিয়ান!

হা, জ্বি।

মিত সিং এর ভ্রুঁ জোড়া আরো কুঁচকে যায়; শরীর ও মুখের চামড়াও কুঁচকানো। চোখে যেনো আগুনের প্রজ্বলিত শিখা! ট্রেন ও ম্যাজেশিয়ানের আগমন কিছুতেই শুভ হিসেবে ভাবতে পারে না। জুগ্গাত সিংকে উদ্দেশ্য করে বলে, জুগ্গাত, হ্যামিলন শহরের ওই বাঁশিওয়ালার কথা কি ভুলে গেছো?

হ্যামিলন শহরে ঘটে যাওয়া ঘটনা বিষয়ে মহিলারা অবগত নয়। কেউ একজন জিজ্ঞেস করে, ভাইজি, ওখানে কি হয়েছিল?

মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে ভাইজি বলে, একজন বাঁশিওয়ালা তার বাঁশির সুরে শহরের সকল শিশুকে বিমোহিত করে পাহাড়ের ওপারে নিয়ে গিয়েছিল- যাদের একজনও আর ফিরে আসেনি।

এই প্রথম সর্দারকে ভীত-সন্ত্রস্ত মনে হয়। এমন কিছু ঘটলে সৈন্যদের সাথে সখ্যতা করেও নিস্কৃতি মিলবে না। তাছাড়া আড়ালে আবডালে কান পেতে যা শুনেছে, লোকটা না কি খতরনাখ; তার মতো ম্যাজিশিয়ান দিল্লিবাসীদ্বিতীয়টি দেখেনি। তার সংস্পর্শে আম-আদমীরাও জেগে উঠেছে। নিজেদের অধিকার বিষয়ে সচেতন। জান দেবে, প্রাণ দেবে তবু আত্মসম্মান হারাতে নারাজ। হারজিতের খেলায় পারিবারিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় উগ্রবাদ পর্যন্তপরাজিত হয়েছে। ঝাঁড়ুর তোপে রাজকীয় চিহ্নসমূহ ধুলোয় লুটিয়ে পড়েছে। তাদের লক্ষ্য এবার পাঞ্জাব; পাঞ্জাব অধিকার করতে উদগ্রীব। তাছাড়া ট্রেনে সে একা না অসংখ্য মানুষ আসছে!

আচ্ছা, আগত মানুষগুলো জ্যান্ত না মৃত?

সর্দার দ্বিধান্বিত। লাশের বিষয়টি উড়িয়ে দিতে পারে না; বরং তার সন্দেহের পালে ক্রমশ হাওয়া লাগে।

জুগ্গাত সাহসী, ন্যায়পরায়ণ; মুসলমানরা ফিরে আসুক বা না আসুক মন্দির ও গুরুদুয়ারার পাশের ওই পরিত্যক্ত জমি সে দ্বিতীয়বার দখল হতে দেবে না; প্রয়োজনে পুনরায় খুন করবে, জেলে খাটবে। এক টুকরো জমি শুধু জমিনয়, গ্রামের ঐতিহ্য; পবিত্র ভুমি। সে আছে বলেই গ্রামবাসীরা ভরসা পায়; চোর-ডাকাত পর্যন্ত এ পথ মাড়ায় না; কেউ কারো জমির ফসল লুট করে না। অথচ অজানা আশংকায় জুগ্গাত সিং আজ শংকিত- ভাইজি, আমাদেরতকদীর এমন না হয় যে, শতদ্রু নদীর স্রোতে আমরা ভেসে যাচ্ছি!

দূর থেকে বাঁশির শব্দ ভেসে আসলে স্টেশনে কর্তব্যরত শিখ সৈন্যদের কর্মচঞ্চলতা বৃদ্ধি পায়। ছোট্ট প্লাটফর্মের এ মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত পায়চারি করে; মাঝে মাঝে ঘড়ির পানে তাকিয়ে সময় দেখে। উঁচু চৌকির উপর একদলসৈন্য অবস্থান নিয়েছে। বাইনোকুলার দিয়ে তারা পাকিস্তানি সৈন্যদের গতিবিধি পর্যালোচনা করে। ওপার থেকে আক্রমন হলে সাথে সাথে প্রতিআক্রমন হবে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয়। অথচ নিরাপত্তাহীনতা দূর হয় না। জেলাম্যাজিস্ট্রেট হুকুম চাঁদ কয়েক দফা হুকুম জারি করেছে, তবু গ্রামবাসী দূরে দাঁড়িয়ে- সৈনিকদের সংস্পর্শে তাদের অনীহা।

মাথার উপর চক্কর দিতে দিতে দুটি জঙ্গি বিমান অদৃশ্য হয়ে যায়। মিত সিং নির্বিকার; ধ্যানমগ্ন; স্মৃতিকাতর। বিমানের গোঙানি হয়তো সে খেয়ালই করেনি। জুগ্গাত সিং তার কাঁধে ঝাকি দেয়। নাহ, কোনো নড়াচড়া নেই।লোকটি যেনো অতীতের পথে! দূরতম অতীত নিকটবর্তী হতে থাকলে ইমাম বকশের মুখচ্ছবির পাশাপাশি স্টেশন সংলগ্ন কিকার গাছটিও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে! হিন্দু-মুসলমান-শিখ সম্মিলিতভাবে সুখি ছিল এখানে; সম্প্রীতিরঅভাব ছিল না। ইমাম বখশের কণ্ঠে ধ্বনিত হতো আযানের মধুর সুর; সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে ভেসে আসতো উলুধ্বনি আর শিখরা জমায়েত হতো সকালের প্রার্থণায়। উর্দু বা হিন্দি নয় পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলতো। ধর্মীয়পরিচয়ের বাইরে বিশেষ একটি পরিচয় ছিল- পাঞ্জাবি। অভিন্ন ইতিহাস-ঐতিহ্য ছিল; ছিল সার্বজনীন কিছু উৎসব। ওপারে রাওয়ালপিণ্ডি, মুলতান, গুজরানওয়ালা, শেখপুরা এবং এপারে পাতিয়ালা, আম্বালা, কাপুরতলায় বিক্ষিপ্তদাঙ্গার কথা শুনলেও মনো মাজরার জীবনে তার কোনো প্রভাব ছিল না। এবং প্রভাব না পড়ার প্রত্যাশায় উপাসনালয়ে নিয়মিত প্রার্থণা হতো। কিন্তু লাহোর থেকে একটা ভূতুড়ে ট্রেন এসে থামলে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়।মনো মাজরা ছোট্ট স্টেশন। দু’মিনিটের বেশি কোনো ট্রেন থামতো না; ওই ভূতুড়ে ট্রেনটি থেমেছিল, দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছিল।

কেনো এই অপেক্ষা!

কি আছে ওখানে!

জানালা-দরজাই বা বন্ধ কেনো!

গ্রামবাসীর পক্ষে কোনোকিছু জানার উপায় ছিল না। ট্রেনের আশেপাশে ভিড়তে সৈনিকরা বাঁধা দিচ্ছিলো। কিন্তু রাত গভীর হলে, স্টেশনের পাশে আগুন জ্বলে উঠলে, কেরোসিন তেলের সাথে মানুষ পোড়ার গন্ধ ভেসে এলেবুঝতে অসুবিধা হয় না- ট্রেনে লাশ ছিল! ট্রেনটি প্রায় ১৫০০ শিখ ও হিন্দুর লাশ বয়ে এনেছিলো। ওই পথ দিয়ে আরো অনেক লাশ যাতায়াত করেছে। এপার থেকে ট্রেন ভরে মুসলমানের লাশ গেছে আর ওপার থেকে এসেছে শিখও হিন্দুদের ছিন্নভিন্ন মরদেহ।

বাঁশির শব্দ পুনরায় উজানের পথ ধরে; স্টেশনের কর্ম-চঞ্চলতা দ্বিগুণ হয়। ট্রেনটি সম্ভবত কাছাকাছি। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পিছন পিছন ভীত-সন্ত্রস্তভাবে সর্দারজি হাঁটাহাটি করে। লাল ও সবুজ পতাকা হাতে স্টেশনমাস্টারঅপেক্ষারত। গ্রামবাসী উদ্বিগ্ন। শংকার আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। এমন না হয় যে, ঘরবাড়ি ফেলে রাস্তায় নামতে হবে, নতুন করে দাঙ্গার কবলে প্রাণ যাবে! নিজের প্রাণ নিয়ে জুগ্গাত সিং ভীত নয়, অনেক দিনের মরচেধরা বল্লমটি হাতে তুলে নেয়। গুপ্তচরের মুখে জেনেছে, শতদ্রু নদীর ওপারেও উত্তেজনা! পাকিস্তানি সৈন্যরা সতর্ক অবস্থায়। ট্রেনের টানা হুইসেল আরো নিকটবর্তী হলে বুকের মধ্যে ধপাধপ শব্দ অনুভূত হয়; আর কিকার গাছথেকে তিনটি পাখি নদীর ওপারে উড়াল দেয়!