অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন : পর্ব ০১

Post date: May 23, 2018 9:49:28 AM

 অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন : পর্ব ০১

সাইটে প্রবেশের জন্য আপনাকে স্বাগতম। এটি অলস দুপুর ওয়েবম্যাগের একটি অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন। এই সংকলনে বাংলাদেশ ও ভারতের নানা প্রান্তে যারা দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্য চর্চা করে চলেছেন, লিটলম্যাগ চর্চা করে চলেছেন, তাদেরকে বিশেষ ভাবে স্থান দেয়া হচ্ছে। আমরা জানি  যে পুঁজিবাদের বিকাশের প্রক্রিয়াটিই এমন যে ইটের নিচে সবুজ ঘাস চাপা পড়ে যায়।  আমরা প্রশান্তির জন্য দিগন্তের দিকেই তাকিয়ে থাকি।

অলস দুপুর সেইসব কবিদেরই খুঁজে চলেছেন। যারা নিরবে কাজ করে যাচ্ছেন, কোন এক দূরে বসে লিটলম্যাগ চর্চা করে চলেছেন বছরের পর বছর। সন্ধ্যায় জোনাকির মত তার চোখও জ্বলে ওঠে নতুন কবিতায়।  সেই সব নতুন কবিতাকে খুঁজে চলেছে অলস দুপুর।

অনলাইন কোন স্থান নয়। ইন্টারনেট মানে বিশ্বের যে কোন প্রান্তের সাথে যুক্ত আপনি আমি। এখন আমি আপনি বিশ্বের যে কোন প্রান্তের কবিতার সাথেও যুক্ত। কিন্তু প্রান্ত তো আছে। যে এসে মিলিত হয় মুক্তির সাথে। অলস দুপুরের কাছে জেলা হচ্ছে এক একটি প্রান্ত, যে যুক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত শুধু বাংলাদেশ নয়, বাংলা কবিতা নয়, বিশ্ব কবিতার সাথে। আমরা অলস দুপুরে বাংলাদেশ ও ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কবিদের কবিতা এই আয়োজনের মাধ্যমে পাঠকদের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি।

সংকলন পদ্ধতি: একজন মূল সম্পাদক থাকেন। মূল সম্পাদক বিভিন্ন জেলা থেকে একজন অতিথি সম্পাদক নির্বাচিত করেন। অতিথি সম্পাদক তার জেলা থেকে কবি নির্বাচিত করেন এবং তাদের কাছ থেকে কবিতা সংগ্রহ করে মূল সম্পাদকের নিকট প্রেরণ করেন। প্রতিটি পোস্ট এক একটি জেলা বা প্রান্তের সংকলন হিসেবে গণ্য হবে। যিনি অতিথি সম্পাদক থাকবেন তার সম্পাদনা নিয়ে একটি ছোট সম্পাদকীয় থাকবে। এভাবে ছোট ছোট সংকলন মিলে একটি বড় সংকলন হবে।  

যাদের কবিতা সংকলিত হবে

১. দীর্ঘদিন ধরে লিটলম্যাগে জড়িত

২. বিভিন্ন জেলায় বসবাসরত

৩. সাহিত্যচর্চায় নিয়মিত 

সংকলনটি চূড়ান্ত নয়। বিভিন্ন সময় এটি আপডেট হবে। সংকলনটি সমৃদ্ধ করতে পাঠকের প্রস্তাবনা ও মন্তব্যকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। প্রস্তাবনা বা মন্তব্য জানান mitra_bibhuti@yahoo.com এ।

 এই পর্বে সংকলিত কবিতার কবিগণ:  ১ । ফাউজুল কবির ২। রিজোয়ান মাহমুদ ৩। ওমর কায়সার ৪। শাহিদ আনোয়ার ৫। হাফিজ রশিদ খান ৬। সাজিদুল হক ৭। খালেদ হামিদী ৮। সেলিনা শেলী ৯। জিললুর রহমান ১০।পুলক পাল। উল্লেখ্য যে এ পর্বের সকল কবির নিবাস চট্টগ্রাম। এই শহরে আরো অনেক খ্যাতিমান কবির পদচারনা থাকলেও সকলের কবিতা সংকলিত করা সম্ভব হলো না।

অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন: ০১ পর্বের অতিথি সম্পাদক কবি জিললুর রহমান। তিনি কবিতা সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে ‘অলস দুপুর’ ওয়েব ম্যাগাজিনকে সহায়তা করেছেন। তার প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা।

 

ফাউজুল কবির

 

কবি ও প্রাবন্ধিক। ১৯৫৫ সালের ৭ আগস্ট মিরসরাই উপজেলায় জন্মগ্রহন করেছেন। পেশায় কলেজ শিক্ষক। সুদীর্ঘ কাল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন। কবিতা-ই তাঁর সৃজনশীল কাজের প্রধানতম আগ্রহ। কবিতাকর্মের জন্য ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন একুশে সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছেন। এছাড়াও পেয়েছেন মনন সাহিত্য পুরস্কার এবং মিরসরাই এসসিয়ে কর্তৃক কবিতা সম্মাননা। কবিতাকর্মের জন্য সংবর্ধিত হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। তাঁর প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থ সমুহ- ১। আমার সুন্দর আমার টেন্টালাস, ২। একা হলে জলতরঙ্গ নীলকন্ঠ বাউল, ৩। কবীর বাড়ি মেঘের নীলে, ৪। প্রতিদিন জন্মচক্র প্রতিদিন জাদুমন্ত্র, ৫। মেডুসার খেলা, ৬। রহস্যের চাবিকাঠি, ৭।সময়ের মায়াবী রাখাল।

ফাউজুল কবিরের কবিতা

 

কিছু কিছু মানুষের

 

কিছু কিছু

মানুষের খুব কাছে যেতে ভয় করে

ভেসে ওঠে শুয়োরের মুখ

জন্তু-জন্তু দুর্দান্ত অসুখ-----

 

কিছু কিছু

মানুষের মুখ থেকে রক্তলালা   ঝরে -

হেসে ওঠে সরীসৃপ সুখ

দগদগে--  ঘা  কামুক শামুক ।।

 

মেডুসার খেলা

 

মানুষ কি ভালোবাসে পথ

পথ কি মাতাল করে

মাতাল কি পথ চেনে

পথের কি টান আছে, আছে প্রেম মানুষের প্রতি ?

মানুষ কি তৈরি করে পথ সৃষ্টি করে নিজস্ব সড়ক

খননের-  আত্মহননের

পথেরা কি কুড়ায় মানুষ খোঁজে পদধ্বনি জীবনের ?

 

জীবন কি পথের কাঙাল

জীবন কি শুধুই ভ্রমণ! ইচ্ছা আর অনিচ্ছার ডাকে

সমূহ বস্তুর মতো

কোনো এক চুম্বকীয়

অদৃশ্য যাদুর কাছে

নিরন্তর আত্মসমর্পণ ?

জীবন কি শুধুই ভ্রমণ! ভ্রমণ কি নিরবধি পথ চলা

যাত্রার ভেতরে থাকা!  পথে পথে জাল ফেলা , মাছ ধরা

অথবা মাছের সাথে মাছের প্রাণের সাথে

বিদ্ধ করে আপন হৃদয় নিজেকেই জাল-বন্দী করা !

জাল-বন্দী সে কি কোনো খেলা , মায়া ও লীলার ছায়াবাজি

জীবনের বিচিত্র ক্রিকেটে নিয়তির সুনিপুণ ক্যাচ !

নিয়তি কি দর্শন অতীত ? নিয়তি কি গোপন ঘটক

নিয়তি কি চতুর শিয়াল , পায়ে পায়ে তক্কে তক্কে হাঁটে

জীবনের পাতায় পাতায় ? নিয়তি কি কপাল লিখন

অদৃষ্টের সীল- গালা করা পতনের অমোঘ আদেশ !

নিয়তি কি শুধু পরিণাম ! জীবনের বিপরীতে

মৃত্যুর জীবন্ত স্পর্শে যাওয়া ! মৃত্যু কি শীতল কিছু

বরফের নীল অভিসন্ধি , গ্রাস করে জীবনের উম !

জীবন কি নিখাদ সনেট অথবা কবিতা পরমাণু ?

 

স্বপ্ন নয় একান্ত পাথর

 

তোমার কি স্বপ্ন-টপ্ন নেই ?

 

আছে বাবা, আছে

সমস্ত স্বপ্নকে পাথর বানিয়ে

বুকের ভেতরে একটি খণ্ড

আরেকখানি বনের ভেতরে

মাটির তলায় লুকিয়ে রেখেছি।

আবার কখনো যদি হয়

খাণ্ডবদাহন, তুলে আনবো

বনের পাথর

তোমার চোখের ভেতরে দেবো বসিয়ে

দেখবে স্বপ্ন-টপ্ন কাকে বলে!

 

আর বুকের ভেতর বাড়িতে যে আছে

মনের পাথর

তাকে দেব বেচে নারীদের কাছে

নারীরাই পাথরের মূল্য বোঝে বেশি

স্বপ্ন-টপ্ন নয়।

 

যাও তবে কবি জিললুরের কাছে

 

বন্ধুরা চিন্তিত বড়ো পৃথিবীর দারুণ অসুখ নিয়ে

বন্ধুরা শংকিত আজ পৃথিবীর হয়েছে ক্যান্সার

বন্ধুরা শোকার্ত খুব---

পৃথিবীর রূপ-রস -ঘ্রাণ আর ভবিষ্যৎ নিয়ে

কেউ কেউ ঘোরে আছে মৃত স্বপ্নের কংকাল নিয়ে

বন্ধুরা শোকার্ত খুব বুকেতে হাসপাতাল

বন্ধুরা দুখার্ত খুব দুঃখ নিয়ে চিরকাল-----

 

আমি বলি আমার কাছেই কেন আসে লোকজন অকারণ

কেন আসে বন্ধু ও বান্ধব দূরের - কাছের

কেন আসে পৃথিবীর একান্ত সুহৃদ ও স্বজনেরা

কী কাজ তাদের আছে ভুলের ক্লিনিকে সারাক্ষণ অপেক্ষায় থেকে

সময়ের অপচয় করে হৃদয়ের ক্ষয় করে শুধুমাত্র পৃথিবী ভাবন !

 

যাও তবে বন্ধুগণ, যাও জনগণ সঙ্গে নিয়ে জনসাধারণ----

খুব বুঝি দেরি হয়ে গেছে ?

খুব বুঝি ভুল হয়ে গেছে ?

হয়তো বা এখনো হয় নাই দেরি

হয়তো বা এখনো কিছুটা সময় আছে-------

যাও তবে কবি জিললুরের কাছে

সে--ই রাখে নিশ্চিত সন্ধান খোঁজ ও খবর

অলিগলি অন্ধিসন্ধি জীবনের মানচিত্র লেখন-পড়ন

পৃথিবীর শরীরে ও মনে কোথায় জমেছে অন্ধকার

কোথায় ধরেছে পচনের নির্মমতা আগ্রাসী ঘাতক

কোথায় ভেঙ্গেছে আয়না নির্মমে নিষ্ঠূরে শতমুখ শতখণ্ডে

কোথায় চিত্রিত হচ্ছে চিত্রকল্প নিশ্চিত হতাশা

কোথায় রেখেছে হাত নীলের ইঙ্গিত

মৃত্যুর কষ্টের বেদনার রক্তজবা অমোঘের পরোয়ানা

বীক্ষনিক চোখে এসব বলার একমাত্র তারই আছে অনায়াস অধিকার ।

 

যাও তবে বন্ধুগণ!   যাও  জনগণ!

যাও কবি জিললুরের কাছে------

তুলে দাও তার হাতে--দাও তুলে সমস্ত জরুরি পরামর্শের ভার

তাকে গিয়ে বল ---প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত কর

পৃথিবীর দুর্দান্ত অসুখ নিয়ে মানুষের কী আছে করার ?

 

আর তাকে অবশেষে সবিনয়ে একথাও বলে দিও

জীবন মূলত কোনো এক সবুজ পাখির জন্য চিরায়ত হাহাকার।

 

তুমি কি তেমন পাখি

 

তুমি কি তেমন পাখি

অস্তিত্বে ধরেছ মাটি

চৈতন্যে ঝিঁঝির আত্মা !

 

তুমি কি তেমন পাখি

খুঁটে খুঁটে খাও

হৃদয়ের নীল

পৃথিবীর পরমাত্মা !

 

তুমি কি তেমন পাখি

ভালোবাস ভালোবাসা

পাতার সুন্দর

মেহগিনি বন

তুমি কি তেমন পাখি

জানো ভাষা সাংকেতিক

ঠোঁটের রূপকে কথার চুম্বন !

 

তুমি কি তেমন পাখি

তুমি কি তেমন পাখি

তুমি কি এমন পাখি !

 

 

স্বাগতম ! স্বাগতম ! হে বৈশাখ

 

স্বাগতম! স্বাগতম! হে বৈশাখ

বুকের ভেতরে পেতেছি বাঙালি মৃন্ময়ী আসন।হৃদয়ের গোলাঘরে

সঞ্চয়ে সংগ্রহে রেখেছি আকাঙ্ক্ষার সহস্র বিচিত্র বীজ। সেইসব বীজ

আশ্চর্য স্বপ্ন ও জাগরণের । পথে পথে বিছিয়েছি সবুজ পাতা,সোনালু ফুলের পাপড়ি আর বৃক্ষদের আত্মার হরিৎ । প্রাণের ভেতরে বুনেছি শব্দঃতোমার অপেক্ষা , হে বৈশাখ । এসো কা্লো মেঘ ঝড়ো হাওয়া আর পবিত্র বৃষ্টির পয়মন্ত আরকের আশির্বাদ নিয়ে । এসো বীজ বুননের প্রেমিক মন্ত্রের রজঃস্বলা উচ্চারণ নিয়ে। এসো সৃজনের গভীর বেদনা গহীন সুন্দরের সুসংবাদ নিয়ে।

এসো মৃত্তিকার ধূসর মেধাবি অন্তর স্পর্শ করা যাদুকরী কাঠি নিয়ে।

 

স্বাগতম! স্বাগতম! হে বৈশাখ

এসো রুদ্রের আবহে জীবনের নন্দিত গান। আমাদের কণ্ঠ হোক ঝিঁঝির কোরাস প্রকৃতির আনন্দ ঘুঙ্গূর। দ্বি-দল পত্রের চারা দেখুক স্বপ্ন, আকাশ ছোঁয়া বিস্ময়। আকাশ নেমে আসুক প্রান্তরের মাঠে। জাগুক আলৌকিক শিহরণ মনের প্রতিটি কোষে, রক্তের ছন্দময় গতির প্রবাহে। মানুষের মন ও বৃক্ষের পাতার অস্তিত্বে লেখা হোক জীবনের নতুন সংবর্ধনা। এসো হে বৈশাখ, প্রাণের সমুদ্রে জীবনের উৎসব আর উৎসবের বর্ণিল

আলিঙ্গন। এসো দুর্দান্ত কিশোর আরকিশোরীর চপল-চঞ্চল মগ্নতার সংগীতে। এসো বৃক্ষদের ছায়ায়, লতায়-গুল্মে আর ঘাসের নিভৃত সাধনে----- মূর্ত ও বিমূর্তের জিকিরে ।

 

স্বাগতম! স্বাগতম! হে বৈশাখ

জীর্ণ প্রাচীনের জামা খসুক পড়ে। নতুন বোধের ঘোষণা বিস্তারিত হোক হৃদয়ের শাখা ও প্রশাখায়, কাণ্ডে ও শিকড়ে। কৃষকের ঠোঁট আর চোখে চুম্বন মাখুক মৃত্তিকা ও জলের অপূর্ব সঙ্গম । আমাদের মন উঠূক ভরে রসালো পাতার যৌবনে । হে বৈশাখ----এই যে জীবন , জীবনের পাতায় পাতায় আনন্দ-ফড়িং রচনা করুক কাব্যের সুষমা । এসো হে বৈশাখ--- জীবনের ক্যানভাসে রচিত হোক প্রকৃতির মুগ্ধবোধ ভাষা স্বপ্নচারী পাণডুলিপি ।

 

স্বাগতম ! স্বাগতম ! হে বৈশাখ

আমাদের ঝর্ণা ও নদীতে প্রাণের উৎসে কল্লোলিত হোক তোমার সুসমাচার ।

 

স্টিফেন হকিং

 

মহা- পৃথিবীর চিত্রকল্প আঁকতে আঁকতে

আর স্মৃতির সুন্দর ভাবতে ভাবতে

স্টিফেন হকিং

চলেই গেলেন অবশেষে অচেনার দেশে-----

যেতে যেতে পথে পথে একাএকা

মায়াবী মৃদুল স্বপ্নে হাওয়ায় রেখে গেলেন

নির্বাচিত বোধনের দৃশ্যাবলী আর ত্ষ্ণার্ত- চুম্বন

ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলেন অনন্যের বীজমন্ত্র

নক্ষত্রের দেশে দেশে বিচিত্রের প্রলুব্ধ- বিস্ময়-------

 

আসুন আমরা সকলে মিলে

এখন জলের সাথে কথা বলি

আকাশের সাথে কিছুক্ষণ সরোদ-আলাপ

কথা বলি নিজেদের সাথে হৃদয়ের একান্ত চুপচাপ

কথা বলি জীবনের ঝিঁ-ঝিদের গোপন ভাষায়

কথা বলি কথাদের সাথে ছায়াপথে কথার ছায়ায় ।

 

যে রোদ আমাকে

 

যে রোদ আমাকে

একা ফেলে চলে গেলো

সন্ধ্যার মসৃণ হাত ধরে

তাকে আর করা যাবে না বিশ্বাস

কখনো দুপুরে অথবা সকালে-----

 

বাম হাত নাড়তে নাড়তে

যে রোদ আমাকে ফেলে

চলে গেলো পশ্চিমের দিকে

আর বলে গেলো---' আসি'

আমিও দিলাম ছুঁড়ে তার প্রতি

তীক্ষ্ণধার প্রতিবাদ অবিনাশী----

 

দিলাম অমোঘ দীর্ঘজীবী অভিশাপ

থাকুক সে বুকে নিয়ে কান্তিময় সর্বনাশ ।

 

***

 

চমৎকার! চমৎকার! বলে মধ্যরাতে জেগে ওঠে

কিশোরীর বুকের গোপন। মনে পড়ে শুধু মনে

বহুদূর প্রাচীন কিশোর স্মৃতির মুরলি ঠোঁটে----

দুর্গা-রাগে ছড়িয়েছে প্রাণ হাওয়ায় মাঠে ও বনে

এখন ও বটের হৃদয় স্নিগ্ধ ছায়া ডাকে, আয়!

ডাকে নীল মাছরাঙা টুনটুনি আকাশের সামিয়ানা

ভুঁই-খেলা ফেলে ঝাঁ-ঝাঁ রোদে একা,কে যায়-কে যায়

ও বাড়ির দুরন্ত কিশোর ছেলেটি মানে না মানা ।

 

দুপুরের তীব্র রোদ যাকে ডেকে নিয়ে অসময়ে

ঘুরিয়ে বেড়ায় তেপান্তরে-- কেন কষ্ট তার জন্য

কিশোরীর মনে? কেন দুঃখ? ও কিশোরী বিনিময়ে

কী তোমার চাই !চাই প্রেম-- ভালোবেসে হবে ধন্য!

 

বালিকা তো জানে না কিছুই কী যে তার প্রয়োজন

অবিনীত কিশোরের খোঁজে কেন খাঁ- খাঁ করে মন।

 

ব্যক্তিগত কাব্য-১

 

আমার সম্মুখে আজ উত্তোলিত জিজ্ঞাসার পরাক্রান্ত তলোয়ার

কী এঁকেছ কী লিখেছ কবিতায় গদ্যে-পদ্যে স্বপ্ন অথবা বাস্তব

জীবনের প্রতিপত্তি আশা ও বিশ্বাস আর সুন্দরের ভালোবাসা

কতটুকু প্রকাশিত হয়েছে তোমার গ্রন্থে শিল্পের প্ররোচনায় !

 

একাকী দাঁড়িয়ে থাকি বৃক্ষের পোষাক পরে দেখি দৃশ্য ব্যর্থতার

আমার আরাধ্য ছবি স্বপ্ন আর সব সাধ

আকাঙক্ষার প্রিয় বাক্য সমস্ত শব্দ-ভূগোল

বাণীর সব ভাস্কর্য আর শব্দের সংসার

রূপের লাবণ্য-বোধ সব চিত্রকল্প দেখি পরাজিত নতজানু

চতুর্দিকে ঝরাপাতা আগুনের অপেক্ষায় ------

 

সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কালের আলেকজান্ডার—কে দেবে উত্তর তার।

 

মনে হয় মনে হয়

 

মনে হয় কেউ যেন দিয়েছে ধারালো কোপ ধুরন্ধর কিরিচের

মনে হয় কেউ যেন রেখেছে রক্তাক্ত হাত হৃদয়ের শস্যক্ষেতে

 

মনে হয় মনে হয়

খণ্ডিত মস্তক নিয়ে স্নায়ুর কাতর কিমা নিয়ে বসে আছি একা

সমগ্র আকাশ আর পৃথিবীর অদৃষ্টের সন্তানেরা কাঁদিতেছে

আমার বুকের কষ্টে কেউ যেন আঁকিতেছে

কেউ যেন লিখিতেছে

কেউ যেন রচিতেছে রক্তজবা সর্বনাশ

 

মনে হয় মনে হয়

আমি এক বৃক্ষ - কবি শিকড়ের সম্ভাষণে আমার নরক যাত্রা ।

 

জেগে ওঠো পাখির প্রমায়

 

পাখিদের আকাশ তৃষ্ণার কথা আমি জানি।জানি আকাশেরও তৃষ্ণা আছে ভুবনখ্যাত।আমার মতোই পাখিরাও নীলাকাশ ভালোবাসে।নীলের আকাশ মানে হচ্ছে কবিতার নিখিল প্রচ্ছদ।পাখিরাও ভালোবাসে শুভ্রতার ডানা-মেলা বিশুদ্ধ কবিতা।পাখিরাও কবিতা লেখে নিপুণ শিল্পীর ভাষা ও কলমে।আসলে পাখিরাই প্রকৃতির জীবন্ত কবিতা।পাখিদের কন্ঠ চেনে ধ্বনি ও রূপের আত্মিক প্রতিমা।

 

পাখিদের সাথে প্রতিদিন সকালে বিকালে আমার আলাপ হয়ঃঅফুরন্ত কথা।আমি যে সব কবিতা লিখি,বাক্য-ছন্দে ছবি আঁকি তার সবই পাখিদের দান পাখিদের কাছে শেখা গান। পাখিদের কাছে যে কখনো শেখেনি উড়ার মন্ত্র,জানেনি ডানার সুর আর হৃদয়ের বোধে গড়া চিত্তের মর্মার্থঃ সে কখনো কবি নয়---কবি নয়।

 

পাখিরা আমাকে শিখিয়েছে বনের সুন্দর আর নদীর চরিত্র।শিখিয়েছে আনন্দের সূত্র,পৃথিবীর অন্তরের ভূগোল।যে যেখানে ইচ্ছা যাক,আমি আছি পাখিদের সাথে।পাখিরা আমাকে দিয়েছে আশ্চর্য মন্ত্র কবিতার মুগ্ধ পাখা।পাখিরা আমার প্রেম বুকের স্বজন মহত্তম কবিতার গুরু।একেকজন পাখি মানে একেকটি চমৎকার অনন্য কবিতা।পাখিরাই আমাকে দিয়েছে চোখ অনন্ত দেখার দৃষ্টি।আমার প্রাণের ভেতর এখন এক কোটি পাখির সাদা ও রঙিন পালকঃপাখিদের জয়ধ্বনি-পাখিদের বিদগ্ধ সংগীত।পাখিরাই চিরকাল বুনে বীজ জীবনের কোষে কোষে সুন্দরের আনন্দের নন্দনের বৃক্ষ।হে বন্ধু সকল,আসুন! একদিন সকালের রোদে সমর্পিত হই পাখি আর মানববন্ধনে।এবং উচ্চারণ করি দিল-খোলা কবিতা উৎসব। ও পাখি ও বন্ধু ও সুহৃদ ও আকাশ ও পৃথিবী ও মানুষ--নারী ও পুরুষ,বালক-বালিকা,শিশু ও কিশোর জেগে ওঠো পাখির প্রমায়।

 

ছবি আঁকা শেষ হলে

 

জুতোজোড়া ছিঁড়ে গেছে জুতোদের প্রাচীন নিয়মে

কিছুদিন আগে—বেশ কিছুদিন আগে

পেরেক গেঁথেছে পায়ে

তাই রক্ত ঝরে, তাই কষ্ট পাই, পাই বেদনাও

অনেকে শুনেছে এখবর তবু কেউ জানে নাই—জানে নাই

বোধ হয় কেউ বাসে নাই ভালো তাই জ্বালে নাই আলো

সময় সেলাই করে করে আপাতত একান্ত নিজের কবরে বেড়াই।

 

আমার জুতোর মতো ছিঁড়ে যাওয়া ক’টি মানুষ এখনো

সক্রেটিস-ক্রিটোর সংলাপ পাঠ করে অন্ধকার চোখে

আমার জুতোর মতো ছিঁড়ে যাওয়া ক’টি মানুষ এখনো

বিশ্বস্ত বিশ্বাস রাখে নক্ষত্র ও বৃক্ষদের বুদ্ধিমান আচরণে

মৃত শামুকের প্রাণ হয়ে ঝুলে থাকা তিনটি মানুষ এখনো

আকাশের তারা গোণে কথা বলে সন্ধ্যার-কাবাব খেতে খেতে

তারপর দক্ষিণ সমুদ্রে জোয়ার জাগে স্বপ্নে ভাসে সাপের ক্রন্দন

জলেরা চুম্বন খায় স্মৃতিদের ডানে -বামে ঘুরে ঘুরে হেঁটে যেতে যেতে….

 

এরকম ছবি আঁকা শেষ হলে শুধু ঘুম আসে শুধু ঘুম আসে ।

 

 

রিজোয়ান মাহমুদ

জন্মস্থান    ; দক্ষিণ হালিশহর,সল্টগোলা ,চট্রগ্রাম।

শিক্ষা জীবন ; স্নাতকোত্তর

পেশা        ; ব্যাংকার

প্রকাশনা     ; ৫ টি কাব্যগ্রন্থ

              ক) উজানীনগরের কন্যারা

              খ) কাঠ চেরাইয়ের শব্দ মাপছি দুপুরে

              গ) গগনহরকরা ডাকে

              ঘ) নীরবপুর

              ঙ) দুপুরলতা

সম্পাদনা  ; একলব্য

রিজোয়ান মাহমুদেরকবিতা

 

বিনয়কে কখনো জানতে দিইনি 

 

কিছু পঙক্তি রেখে দেবো

বিধবা অক্ষরগুলো তাকাবে আমার দিকে

প্রকৃত সারস আমার কখনো হবে না, যে উড়ে যাবে

গহীন আলোর দিকে।

 

একটি কাগজের ঠোঙার ‘পরে রেখেছি

কুলীন বন্ধুর মুখ ।

 

বিনয়কে কখনো জানতে দিইনি এ-কথা

কারণ আমাদের তফাৎ যে কতখানি, তা শুধু জেনেছে

চরে আটকে যাওয়া লাল কাঁকড়ার পা

 

একটি অপর কাব্য

 

এই কিছুদিন আগে মাত্র নামো রাস্তাটা আমাকে ফেলে চলে গেছে অনেক দূরে

রাস্তার সতীত্ব নিয়ে এরই মধ্যে গুঞ্জন হলেও এতে কী পরিমান ইট সিমেন্ট

বালি আর কংক্রিট লেগেছে সে আমি জানি । প্রতিদিন ভোরে আদর্শ পাড়ার বৃক্ষ

থেকে একটি সবুজ কচিপাতা এসে রাস্তাটির চোখে লাগে – সে জরাগ্রস্থ ইতিহাস

অন্যদিন । কাল অতিক্রান্ত সময়ে মহাফেজ খানায় ভাঙনের নিঃস্ব কণা জমা পড়েছে,

যে কেউ চাইলেই দীর্ণ এই নিঃশ্বাসের ভেতরে সহস্র বছরের কোনো চারণ কবির

ফেলে যাওয়া হাড়ের গল্প শুনতে পাবেন । জনশ্রুতি আছে আর্দশ পাড়ার উল্টো

দিকে নামো গেছে মহানন্দার দিকে । মনুষ্য বিহিন বিজন রাস্তায় দুজন ব্যতীত আর 

কেউ হাঁটে না এপথে । অথচ তৃতীয় জনের বুকে এসে ছ্যাঁত করে লাগে কিছু দাগ ।

গতরাতে এক ছায়ারমণীর অন্ধত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রাস্তাটি নিঃশ্বাস ছাড়ে ভুস ভুস 

অপরের – একটি অকবি পথ সুদূরের মহাশূন্যতায় - - - 

 

মান – অভিমান

 

হাঁসেদের মান – অভিমান আছে ; এ –কথাগুলো জেনেছি সেদিন

পুকুরের পাড়ে শাদা শাদা হাঁস, জলে না নেমে তিলপর্ণ আকাশ

জুড়ে নিজেদের ডানার গন্ধ ব্যাখ্যা করছিল –

রূপান্ধ পায়ের কাছে জল – ঢেউ এসে লাগলেই ডানা-রোদ ছড়িয়ে

হাঁসেরা বিষণ্ণ হয় ; হাঁস মানেই কোমলবতীর জন্যে দু’কলম লেখা

একটি পদ্য এবং জীবনানন্দের অসুখ ব্যবস্থাপত্রহীন মানুষের ধূসরিত

শয্যার উৎসব।

 

এই হলাহলে দুপুরের পেটে ছুরি চালিয়ে উন্মত্ত মানুষগুলো , তবু   

শেষ রাতে শোহিনী শুনে , অন্য কারবালায় ।

হাঁসেদের অভিমানে আমি জেগে থাকি কচুরিপানায় ভেসে যাওয়া

উদ্বাস্ত্ত বিকেল দেখবো ভেবে – নাফতীরে ।।   

 

রুবাপক্ষী

 

বউকে এখন লক্ষ্মী- পক্ষী ডাকলে সে আসে না কাছে ,বলে- যে নামে যখন

সবাইকে ডাকো – আমি অস্তিত্বহীনতার সংকটে পড়ে হাতড়াতে থাকি !

একটি মানুষ অস্থিহীন হলে যেমন ; অস্তিত্বহীনে থাকে ,না পাওয়ার বিলম্ব বেদনা ।

অতঃপর আমি ভাবি ২৩ সেন্টিমিটার দীর্ঘ একটা হাড় কেটে নেকলেস বানিয়েছে

যে চীনা শিল্পী ,তাকে শিল্প না বলে গ্রন্থিত সন্ত্রাস বলি । লক্ষ্মী – পক্ষীর চঞ্চলতা

ধুইয়ে আমি কী করেছি এযাবৎ ?

যে- বা যারা বুনো বাতাসের কোলে বৃক্ষের নিকুঞ্জে স্নায়বিক রোদে পাখিদের পাহারায়

সারাদিন- তারা জানে না উড়ার আগে আমি শিখেছি ডানার ভরকেন্দ্র । সাজিদকেও

ডাকি লক্ষ্মী –পক্ষী সারাদিন, দেখি তার কবিতায় ঢুকে আমাজন, ফুটন্ত নদীর জল

বউ বলে ; সবাইকে যে নামে ডাকো অন্তত আমাকে ডেকো না এভাবে , বরং

পারিবারিক ধারাবাহিকতায় ডাকো রুবাপক্ষী তাতে জাত কিছুটা গেলেও মানের

হয়না ক্ষতি বেশি ।     

 

যাবে আজ কোন ঘরে

 

এই সেই হাসি যাবে আজ কোন ঘরে

অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে ঠোঁটে এসে ঝরে

প্রতিদিন আলোকিত করে বিশদ বাগান

বাড়ি চিনি, থাকে আমাদের নিকট উত্তরে ।

 

স্বপ্ন তার ঘুড়ি হয়ে ওড়ে যখন বাতাসে

রুদ্ধশ্বাসে কেউ তো বলেনি আমার সে

গতরাতে চোখ-ওঠা দেখে , ঔষধ দেয়নি মা

অকারণে তাকে ভেবে, যদি করি হাংগামা।

 

আমি আজও সে – রকমের বোকা

বুঝিনি সে – ফুলে ছায়া ধরে থোকা থোকা

এসব ভূগোল জেনে লিখে নিয়েছি খাতায়

লজ্জা পুকুরে হারিয়ে খুঁজি বিজুরি ফিতায়।   

 

 

একটি অকারণ গদ্যের খসড়া

 

ছোট বেলায় রামেন্দ্র সুন্দর বসাক আর পাটিগণিত থেকে  

মুখটি কিছুটা তুলে দূরে তাকিয়েছিলাম । দূরেও দেখেছি শূন্য মেঘ।

হাফশার্ট পরা মেঘগুলো নিয়ে যে- স্নানের জলে রেখেছি বাঁ- হাত 

অমনি একটি বোয়াল মাছ এসে নিয়ে গেলো সবুজ শৈশব ।

এই নবারুণ ভাঙা বিকেল নখ সংক্রান্ত শৈশব নিয়ে বাজারে যাই –

বাজার মানে কারো হাতে তরকারি – আনাজ তুলে দেওয়া

আর লাল স্রোতের নদীতে ডুবে যাওয়া ---     

 

একতারা হাতে

 

আমি এক মেলোডিয়াস গাঁয়ে ঢুকে পড়ি । সঙ্গে দেহ – নিবন্ধিত ছায়া আছে শুধু

একরাত একা পেয়ে ছায়ায় সুকুমারী দেহ- নাক- কান -বুক খুঁজি, দেখিনা কোথাও

এ – ভাবে যেতে যেতে কানটুপিঅলা এক পুকুরের কাছে এসে দাঁড়াই । নিস্তরঙ্গ পুকুরে

সুরেণু গ্রামটি ভাসে ।

 

মাকে দেখেছি সেই কবে শাক – আনাজ তুলে নেওয়ার মতোন আঁচলে পুরো গ্রামটা

নিয়ে যাচ্ছে বাবার কাছে । মা গ্রাম , গাঁয়ের হাট ‘বাবা ; একই মূর্ছনায় একতারা হাতে

তরুণ বাউল ঢুকে পড়েছি নিরণ্ন গাঁয়ে ...    

 

একটানা তিন বর্ষা

 

চাঁদেরও স্রাব হয়

না হলে এতো আলো হবে কেন ?

আজ স্রাবের আলোয় তুমি প্রব্রজ্যা সুন্দর

যে দিকে যাবে যে ঘাটে

নামে ছায়া সুবর্ণ বন্দর । 

 

২)  

সাদা কালিতে এবার লিখে দেবো

তোমার দস্তানা

রক্তে ফুঁসে উঠেছে আজ

মোগল ব্যারামখানা ।

 

৩)  

শণখোলার ভেতরে ঢুকে পড়ি

মমতাময়ী কিছু খড় ,এলোমেলো

ওটা কার বাড়ি !

ঝুলে আছে শিশুতোষ খাবার

জেব্রারোদ ঠোঁটে

চাঁদলতা  আমাকে দিয়েছে আড়ি

সম্মুখে না যাবার । 

 

সোমেশ্বরীর হাঁটু জলে

অন্ধকার নিয়ে বাড়ি বানানোর কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত আলোর কারণে

তা আর হয়ে উঠেনি। পাড়া প্রতিবেশীরা দেখেছে ফণীমনসার ঝোপের ভেতরে

এক কাটুরিয়া গল গল বাটালি দিয়ে কাটছে অন্ধকার । ধারালো আঁধার যখন

পৃথিবীপৃষ্ট ভ্রমণ করে জানালা গলিয়ে এলোমেলো বোনের আঁচলে ,ভাইয়ের কপোলে 

এবং সোমেশ্বরীর হাঁটুজলে পেতে চাইছে যৌবন- এতেও আলোর খানিক আপত্তি ছিল । 

নদীগুলো মৃত মাছের ঠোঁটের মতন জেলেদের ভাষা পড়ছিল। আর সম্মুখে গড়িয়ে

যাবার উদ্দেশ্যে পাহাড়ের ধারণা খুঁজছিল । আমি মায়ের পায়ের কাছে কখনো অন্ধত্ব

চর্চা করিনি । অন্ধকারগুলো বড় হিংসুটে ,বিকৃত লোভী মানুষের জিহ্বা যার টোটকা

স্বাদে পৃথিবী হারাম। 

বাবা জানে ক্ষয়িষ্ণু সময় ছোট হলে কবিরা – অন্ধকার । একরাতে চুপি চুপি বিছানার

কাছে এসে কানে উষ্ণ ঠোঁট লাগিয়ে বলে ; কখনো তোর জামা এভাবে ছোট হয়ে এলে

মা ‘র কাছে দৌড় দিস - কারণ তোর মা দর্জির কাজটা ভালো বোঝে ।

 

চিত্রশিল্পী

 

কবোষ্ণ জলের দাগ

গড়িয়ে গড়িয়ে আঁকছে একটি সরুনাক

ঠোঁট এবং গোঁফের সারি

তারপর শরীরের দৃশ্যমান অংশগুলো সটান কাঁধ

হাতের আঙুল ; এ –জল দেহাগত মসনদের দিকে দৌঁড়াচ্ছে

জল দিয়ে মানুষ আঁকা খুব সোজা নয় যদিওবা ,তবু

জলই মানুষ ধরে আজ ।

প্রতিটি মানুষ জন্ম নেয় ক্লেদাক্ত মরুচি হাজা-পচা থেকে ;

যাতে পুঁজ রক্ত মিশে গঙ্গাজলে বয়ে যায় । এ – দৃশ্যকল্পের

রথে সবুজ রোদেরা ওঠে ।

ধীরে ধীরে যে মানুষ জলের ভেতরে রচিত হতে দেখেছি, তাঁকে

রবীন্দ্রনাথ ভেবে ভুল করিনি কখনো ।।   

 

এক বতুতার গল্প

 

যেই তুমি রদেভুর দেখা পাবে , আমাকেই বলো

দিলশাহ তোমার জিহ্বার নুন থেকে সরে গেছে দূরে

আমি দেখেছি তাকে ছায়াময় এগারো সিন্দুর পাড়ে

যেখানে বতুতা ও আমি দাঁড়িয়েছি ছোট এক ঘরে

হাওয়ায় নরম জাহাজে তুমি এশিয়ার ওপাড়ে ওঠ 

ইবনে বতুতা বয়সে আমার শুধু একমাস ছোট ।।

 

মন্দিরা ও বসন্তকাল

 

ঝড়ো হওয়া নেমেছে যে সব শব্দে তা বুঝি

তাকে হাড়ের টঙ্কার ভেবে পথে ফেলে যাই

পথফুল কুড়িয়ে নেবার ছলে দুপুরে কুড়াও হাড়

এসব না বোঝে আমিও সড়কে, বামে চলে যাই। 

মন্দিরের মন্দিরাকে ডাকি , দেবতার পাশ থেকে 

সরিয়ে আমার বাহুবন্ধে নিয়ে আসি । রেলবাংলোর

বারান্দায় বৃষ্টি নামে; মন্দিরা তখন ভিন্ন নাম,

মন্দিরা কাঁসার তৈরি দুটো স্নাতক বাটির মাঝখানে

এক অভিনব সুর ছিদ্র করে আমাকে বাজায় ।

অঝোর বৃষ্টিতে তাকেও অচেনা লাগে , দুপায়ের

সারেঙ্গী দুদ্দাড় জল । তাকে বসন্ত ডেকেছি

ঋতুবদলেও যার শব্দ শুনি সে মন্দিরা নাকি বসন্ত

একজন লিপিকার দেবে তার নিখুঁত বর্ণনা ।  

 

রাতের ঘুঙুর

 

ধীরে ধীরে মধ্যরাতের ঘুঙুর হতে নেমে এলো সেকেন্ডের কাটা

আমি দুচোখে তখন হাওড় বিলের শান্ত জলে অপরাহ্নের ছায়া 

নিয়ে মশগুল । ঘড়ি থেকে নেমে আসা কাটা সময়কে স্থির করে

দিয়ে একা আঁধার ডানায় মিশে গেলো ; এখান থেকেই শুরু তার

একাকীত্ব । আকাশচারী হবো না ভেবে ঘুমিয়ে ছিলাম দগ্ধ রাতে

নিন্দুক বাসক পাতা যে আমায় ঘুমোতে দিলো না ।।  

 

বালহামা

 

তোমার বাড়িটি পুড়ে কয়লা হয়েছে

একাকী নিশ্চুপ কোথায় বসেছ তুমি ?

৮০০ পৃষ্টা পুড়ে ছাই হলো

ছাই হলো স্বপ্ন – বালহামা

সুদূরের পাণ্ডুলিপির অজস্র স্বরটি যখন

তুষের আগুনে , খবর পেয়েছি

আলজাজিরায় ভাট- ঘরে নেই কেউ

শুধু আগুনের ধোঁয়া , চাল ভুট্টা পোশাক

এবং ব্যবহৃত স্বপ্নের পোড়ানো গন্ধ

পাড়া – প্রতিবেশি জানতে চাইলে তুমি

বলেছ ; এটি টিউলিপ শাসিত মাজার 

তুমি সেই মাদহোশ বালহামি...

আমি জানতাম ।।

 

বৃষ্টি

 

তোমাকে জিকির করতে করতে

প্রাণবায়ু পাতা ছুঁয়ে আসমানে গেলে

বলবে ভালোবাসি ?

একটি গোলাপ ছুঁয়ে নেমেছিল বৃষ্টি

খুব একজন কুড়িয়ে নিতেই পাপড়িসব

নিঃশব্দে কেঁদেছিল ।

সারাগাঁয়ে রটে গেলো ; পাখিরাও গুটিয়ে নিয়েছে ডানা

নদীজলে ডুবে গেলে তোমার পা, সেই থেকে কোনো যোগী

আর দেখেনি রোদ

ননীচোর অষ্টমঙ্গলার দিনে তুমি কোথায় ছিলে ? 

 

 

 

ওমর কায়সার

পেশা:    সাংবাদিকতা

জন্ম:  ১৩ মার্চ

কবিতার বই :   প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ, প্রতিমা বিজ্ঞান, আকাশ বুনন, বাস্ত্তসাপও পালিয়ে বেড়ায়,

প্রাচীন প্রার্থনাগুলো, নির্বাচিত কবিতা।

উপন্যাস:        অ্যাকুরিয়ামের দিনগুলো

ছোটদের উপন্যাস:       দূর সাগরে পথ হারিয়ে, মেছো ভুতের গল্প

ছোটদের গল্প:            জাদুর বেলুন, পরী ও জাদুর তুলি

পরিবেশ বিষয়ক বই:     তৃণভূমি

 

সম্পাদনা :      ১. মধ্যাহ্ন (কবিতার কাগজ),

২. ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে (প্রথম কিশোর কবিতার সংকলন)

পেশাঃ ডেপুটি নিউজ এডিটর, প্রথম আলো, চট্টগ্রাম অফিস।

 

ওমর কায়সারের কবিতা 

 

তোমার চোখ

 

শ্যামলী তোমার চোখ নীল!

 

এত ঘন সুগভীর নীল

যেন একজোড়া অশান্ত অতলান্তিক

সহস্র যুগের তরঙ্গভঙ্গের কাল শেষ করে

শান্ত হয়ে বসেছে ওখানে।

 

এখনো কি রক্তে ধরে আছো

পরিযায়ী হাঁসের প্রণয়, ভাসমান নাবিক হৃদয়?

 

পলির আদর মাখা মাটির সুবাসে

সমুদ্র মন্থন করে এইখানে এসে

ওলন্দাজ বুঝেছিলো বন্দরের কথ্যভাষা ?

দেহভাষ্যে চিনেছিলো মায়ার অন্তর?

 

শ্যামলী তোমার চোখে এত এত নীল

যেন এক দীর্ঘ নৌবহর পালের বাতাসে

জলপথে ভেসে যেতে যেতে ওইখানে

বসিয়েছে স্মৃতির নোঙর। 

 

মাটি ও জলের অলিখিত প্রণয়ের

উপখ্যান নিয়ে সমুদ্র ঘুমিয়ে আছে

তোমার নয়নে।

 

আমিহীন আমার ছায়ারা

 

আমার আড়াল থেকে ওরা বেরিয়ে এসেছে

হেঁটে গেছে

সীমানা চিহ্নের বাঁধ ভেঙে

চলে গেছে কোন্ পরবাসে।

 

আমিহীন আমার ছায়ারা

পথে প্রান্তে ঘুরে ঘুরে

কোনো ব্যস্ত কোলাহলে থমকে দাঁড়িয়েছে।

অথবা নির্জনতার অতিব প্রাচীন কোনো গোলক ধাঁধায় হারিয়েছে পথ।

 

কিংবা কোনো ঘুমন্ত নদীর বাঁকে আড়ি পেতে

দুএকটা বেদনার গানে

আমারই প্রতিচ্ছবি কল্লোলিত হতে দেখে

ওরা ফিরে গেছে। 

নদীর সংগীত থেকে বহুদূরে

প্রান্তরের ধুলোর ভিতর মিশে থাকা

পালাগান আর বিরহ মাড়িয়ে

দিন ও রাতের বহু পুরোনো কথার ঝাঁপি পেরিয়ে পেরিয়ে

গাছের বাকলে লেখা পুঁথির স্মৃতিকে

গোপনে কাঁদিয়ে ওরা নিখোঁজ হয়েছে।

 

হয়তো নির্জনে পাহাড়ের কোনো ঝরনার প্রবাহে

রাংরাঙের একটি পালক ভেসে যেতে দেখে

বাতাসে মিলিয়ে গেছে।

 

সাহারায় বালির ঘুর্ণনে

প্রেইরির তৃণের ডগায়

পৃথিবীর এখানে সেখানে

বস্ত্ত ও অবস্ত্তর খেলা

নিমেষে নিঃশেষ করে

চলে গেছে অন্য ছায়াপথে - তারার গহীনে ?

 

কেউ কী দেখেছো সেই দৃশ্যটুকু

শেষ বিন্দু দুচোখের জলে অদৃশ্য লবণ আর অনিদ্রাকে

আমাকে, আমাকে

আর আমার ছায়াকে ?

 

তোমার ইঙ্গিত

 

ধরো তুমি পৃথিবীতে নেই, ছিলে না কখনো

তবুও রচিত হয় প্রতিদিন প্রত্যুষে তোমার গান

দিনের ভূমিকা হয়ে, রাত্রির বিস্তারে 

তুমি থাকো, তুমি থাকো।

 

করতলে নেই, তবু আছো ভাগ্যের ভূগোলে।

 

কীভাবে গোপন থাকো মানচিত্রে

নিয়তির চিহ্ন হয়ে আছো যদি পাহাড়ের গর্ভযন্ত্রনায়?

 

উৎসমুখের কান্না কিংবা কল্লোলিত সাগর সঙ্গম

বাতাসে বাতাসে কেন প্রতিধ্বনি পাইনি কখনো ?

 

নদী, কেন তুমি বয়ে চলো হরপ্পার বিজন প্রদোষে

মানুষে মানুষে, সভ্যতার ধুলিমাখা জলে?

 

একদিন লুপ্ত হবে জানো যদি কেন তবে গান দাও

                                        শস্যের দানায়?

 

ধরো তুমি আমাদের ছায়াপথে নেই, ছিলে না কখনো

তবুও আলোকবর্ষ দূর হতে রক্তের প্রবাহে ধেয়ে আসে

                                          তোমার ইঙ্গিত।

 

 

এইসব হিংসার কথা

 

তাকে তুমি প্রত্যাখ্যান করো

প্রকাশ্যে ফিরিয়ে দাও

বলে দাও তোমার শরীর জুড়ে কার এতো দখল মত্ততা

প্রতি রোমকূপে প্রোথিত করেছ তুমি অন্যের উপনিবেশ

 

কুরুক্ষেত্রে বেদের আরেক মন্ত্র উচ্চারিত হবে এই নতুন শতকে

প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে আমি অগণন বিচ্ছিন্ন মস্তক এনেছি অঞ্জলি

রক্তাক্ত ত্রিশূল হাতে আকুল প্রার্থনা করি তোমার প্রণয়।

বলে দাও — তোমার প্রদেশে আর শোভিত হবে না

অন্য কোনো রঙের পতাকা।

 

আমার দিনান্ত কাঁদে, রাত্রি কাঁদে আর  কাঁদে সকল সকাল।

 

যুদ্ধে যুদ্ধে কেটে যাক দিন, ভালোবাসা ছাড়া আমি ঘুমোতে যাবো না।

 

 

দোল পূর্ণিমার দিনে

 

দোল পূর্ণিমার দিনে বৃষ্টি হলে

উৎসবে এসো না।

 

সহজ নিয়মে জল

তোমার সকল বাঁকে যদি

উন্মোচনে মেতে ওঠে!

বহু বিস্মিত চোখের ঈশারায়, আহ্বানে তুমি দিকভ্রান্ত হবে।

খেলতে খেলতে কেউ বর্ণচ্ছটা লুফে নেবে

তুমি ঢেকে যাবে ভিন্ন কোনো রঙের প্রলেপে।

 

আর আমি বর্ণময় বাতাসে বাতাসে

অসংখ্য পায়ের নিচে দলিত কাদার মতো বর্ণহীন হব।

 

দোল পূর্ণিমার দিনে বৃষ্টি হলে তুমি এসো

তার আগে

বাতাসে অদৃশ্য জলকণাদের গর্ভে ঘুমন্ত রঙগুলোকে নিয়ে

করতলে খেলতে খেলতে জাগিয়ে তুলব পৃিথবীর প্রথম জৌলুষ।

তোমাকে রাঙিয়ে দেব

জলরঙে জীবন্ত ক্যানভাস হয়ে তুমি বাঙময় হবে

শরীরী চিত্রকলায় আমি হব আদি চিত্রকর।

 

 

শাহিদ আনোয়ার

জন্ম: ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০

পৈত্রিক বাস: চট্টগ্রাম

পেশা: সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা

তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষাবোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় যথাক্রমে তৃতীয় ও পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স এবং মাস্টার ডিগ্রীতেও মেধার স্বাক্ষর রাখেন। প্রগতিশীল বাম রাজনীতির অত্যন্ত তুখোড় একজন কর্মী হিসেবে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। কবি শাহিদ আনোয়ার আশির দশকের জাতক। তিনি এমনই এক কবি যাঁর ঋজু বক্তব্য, মগ্নচৈতন্যের স্বতন্ত্র কাব্যভাষা ইতোপূর্বেই পাঠককূলের সাধুবাদ কুড়িয়েছে। :

তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে:

শুড়িখানার নুড়ির মধ্যে (২০০০)

কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে (২০০২)

দাঁড়াও আমার ক্ষতি (২০০৫)

বৈদেহী এক ওষ্ঠ পোড়ে (২০০৮)

এর বাইরে “আনলাকি থার্টিন” নামে দীর্ঘ একটি আত্মজৈবনিক গদ্য লিখেছেন- যার খন্ড খন্ড অংশ বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও, বেশ কিছু অনুবাদ কর্মও রয়েছে তাঁর। আত্মপ্রচার বিমুখ নিভৃতচারী শাহিদ আনোয়ার নিজস্ব কাব্যভঙ্গি, শব্দ বুননের দক্ষতায় এবং মৌলিকত্বে এক বিরলপ্রজ কবি।

 

শাহিদ আনোয়ারের কবিতা

 

হতাশা ও আশা

ক.

 

এ নিছক বেঁচে থাকা, সময়ের সাথে সঙ্গম

 

অবিরাম দোলখায় শঙ্খচূড় ইচ্ছের ফণা

আয়ুর স্ফটিক খেকো ঈশ্বরীও হলো বেরহম

কপালে লেপ্টে থাক পরান্মুখ মৃত্যুর কণা।

 

খ.

ও আমার প্রিয়তমা-

মৃত্যু আসে পায়ে তার রূপোলি খড়ম

আমাকে অচেনা লতা করে বেষ্টনী

পিপিলিকার দু ঠোঁটে পোড়ে

নিষিদ্ধ রৌদ্রের নুন

সূর্য সকাশে হাসে পৃথিবীরও মুখকরুণ !

 

নিজের চুমুতে বিঁধে

আমি এক ক্লীন্ন মাকড়

তোমার সকাশে হাসে

রোরুদ্যমান এই শীত অন্তর।

 

ছত্রাক হয়ে হাসেক্ষয়া চাঁদ, বেদনার কণা

হে আমার নদী তুমি বয়ে যা, বও উচ্ছ্বলা

রাত্রির পিঠে চড়ে কেঁদে যাক শীত অন্তর।

 

গ.

হতাশা ও আশা আমাকে বানিয়েছে

শাটল কর্কের মতো সাদাবস্তু। আস্তে আস্তে

আমি পুরনো হয়ে উঠি, আস্তে আস্তে আমার

শাদা পালক খসতে থাকে, আস্তে আস্তে

আমি নোংরা হয়ে উঠি, আস্তে আস্তে ধূসর…

আমার টানটান বুক ভাঙতে থাকে…

 

প্রিয়তমা

আমাকে ক্ষমা কর ম্রিয়মান কুশ্রীতার জন্যে।

 

পাপ

 

পাপিষ্ঠ এক ঘাটের কানায় ভিড়াও পাপের তরী

পাপতরঙ্গে নৌকা চালায় পাপিষ্ঠা ঈশ্বরী

আনন্দিত, দুঃখিতহই, পাপের মধ্যে সুখ

পাপের জন্যে পাপিষ্ঠ জীব উড়ন্ত চুকচুক।

পাপ হচ্ছে প্রেমের কবর, বিনিষ্ট ইন্দ্রিয়

বিষদাঁতে তোর প্রেমের শিখা দারুণ ঈশ্বরীয়।

 

দালি ও আমার দ্বিতীয় কান

 

ভাবছি আমার ঘড়িগুলো সালভাদর দালিকে পাঠাবো

ওগুলো গলিয়ে গলিয়ে দালি আমার

আসল সময় বের করতে পারবেন

 

দা ভিঞ্চিকে অনেকগুলো প্রেমের চিঠি পাঠাতে হবে

তিনি আমার প্রকৃত প্রেমিকার ছবি আঁকবেন

পিকাসোকে পাঠাবো যথার্থ নষ্ট সময়

তিনি বিনষ্টির বহুভুজ ছবি আঁকবেন

 

ভ্যান গখের মতো আমারও একটি কান নেই

ভ্যান গগ আঁকবেন

আমার দ্বিতীয় কানে

ভালোবাসাগ্নি খচিত রৌদ্র ঝুম্কো।

 

চিতাদাহে প্রেম-২

 

যখন চিতায় গেলাম

জ্বলছে আগুন দাউ দাউ শিখায়................

বহুদিন পর

যখন বাসায় যাবো ভাবছি

তখন মনে পড়লো

বুলডোজারের ইস্পাতের দাঁতে

ধুলিস্যাৎ শ্রী শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবন।

যখন দিদিমনিদের কাছে গেলাম

তারা সবাই পরলোকে।   

শুধু মনে পড়লো

এক জোড়া পোড়া পায়ের পাতা

আগুনের শিখায় হঠাৎ তুমি

পা গুটিয়ে নিয়েছিলে।

 

আঁখি দাশ গুপ্তা

মৃত্যুর পঁচিশ বছর পরেও

আমার স্মৃতিতে তুমি সেই প্রগাঢ় তরুণী

আগামি পঁচিশ বছর পর

আমিও থাকবো না

শুধু কবিতার খাতায়      

এক টুকরো কবিতা হয়ে তুমি বাঁচবে।

 

তোমাকে কী স্মরণ করবে দু’একজন পাঠক!

 

 

কবিতাচূর্ণ

কবি বিশ্বজিৎ   চৌধুরিকে

ক.

তোমার নধর থুতনিখানি

আমায় দিয়ো ধার

বিন্দুবিন্দু ঘামের ফোটায়

কাব্য সারোৎসার।

খ.

তন্দ্রা কুসুম ফুটছে তোমার চোখে

ঘুম পাড়াচ্ছে হাজার রাতের তারা

বাঁক নিয়েছে তোমার দেহখানি

বুকেরমধ্যে তাম্রলপ্তি ভরা।

 

 

কবিতা-সুন্দর

(কবি ওমর কায়সারকে)

 

কবিতা সুন্দর হাতে গোলাপ নোঙর কর 

নারীর সুন্দর হাতে চুম্বন নোঙর কর

দ্রোহের ওষ্ঠ জুড়ে কবিতা-অন্তর

আলস্যের গীতভাস্যে কবিতা-পিঞ্জর

কবিতা পৃথগায়নে কাব্য উবে যাবে

নদী-গৃহ মানুষেরাবেদনা ঝরাবে।

 

মৃত্যু

মৃত্যুর কালো ফোকরে ও ফাঁকে

জীবনরেখা ঘোরে

তোমার প্রেমের ভাঙা আয়নায়

মৃত কাকাতুয়া ওড়ে। যেন

ধূসর কপিলা

 

তোমাকেই মনে পড়ে বিষাদের ধূসর কপিলা

অযুত গুঞ্জনে তুমি এতোটুকু প্রীত হও নাই

ব্যথার রঙিন বিষ আঁজলায়, পদ্মার জলে

আভূমি আনত দেখে তোর মুখ হলো রোশনাই।

 

প্রেমময় নৌকা জুড়ে থরে-থরে উজানী ইলিশ

আমাকে পছন্দ হলে ছলের খোলস খুলে আয়

সাক্ষী থাকো ময়নাদ্বীপ জলের হিস্যা-চাওয়া নদী

কৃষ্ণ আকাশ জুড়ে শাদা চাঁদ আজও উছলায়।

 

ধূসর কপিলা তোকে দেবো ধেনো-চুম্বনের বন

কুবেরের বিনিদ্র গান বিষাদেরই রক্তক্ষরণ।             

 

দালি ও আমার দ্বিতীয় কান

 

ভাবছি আমার ঘড়িগুলো সালভাদর দালিকে পাঠাবো

ওগুলো গলিয়ে গলিয়ে দালি আমার

আসল সময় বের করতে পারবেন

 

দা ভিঞ্চিকে অনেকগুলো প্রেমের চিঠি পাঠাতে হবে

তিনি আমার প্রকৃত প্রেমিকার ছবি আঁকবেন

পিকাসোকে পাঠাবো যথার্থ নষ্ট সময়

তিনি বিনষ্টির বহুভূজ ছবি আঁকবেন

 

ভ্যান গখের মতো আমারও একটি কান নেই

ভ্যান গখ আঁকবেন

আমার দ্বিতীয় কানে

ভালোবাসাগ্নি খচিত রৌদ্র ঝুম্কো।

 

মৃত্যু

 

দোতলার বারান্দায় কবিতার ফনিমনসার

গাছ হাই তোলে।

স্তনে কাব্যগ্রন্থ

চিবুকে চুমুর মাখন

ওষ্ঠে অগাধ সবুজ

বিস্তীর্ণ গাঢ় সমর্পণ

দোতলার বারান্দায় কবিতার ফনিমনসার

গাছ হাই তোলে।

 

চুম্বনে চিবোই কিছু মললিকার হাড়

আয়ুকে জাপটে ধরে শার্টের কলার।

 

 

পহলো বৈশাখ

 

প্রজাপতি এসে খবর দিয়েছে তোর

অন্ধকার ও আলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক ভোর

হৃদতারল্য হৃদপ্রাবল্য দুই দিকে দুই ছুরি

প্রজাপতি ওড়ে দেখাচ্ছে তোর জাগরুক বাহাদুরী

বাঙালিআলোয়দেখিয়েছোমুখ, বারবারপিছুটান

তারুণ্যলাল সূর্যের নদী উচ্ছ্বল বহমান।

 

বিধুমুখী বিরহ প্রপাত

 

 

নদীমাতৃক প্রেম দিয়ে বিছিয়েছি জলের ফরাস

ফুসফুস বন্ধক রাখি শরমিন্দা লজ্জাবান প্রেমের গোলায়।

ধানের দূরহ গন্ধ, ফুটন্ত পানিতে ফোটে অবিনাশী ফুল

ধূসর আয়ুর চোখে কাজল কবিতা পড়ি অবোধ নয়নে।

 

সবুজ দীঘিতে দেখো বোহেমিয়ান হাত কাটছে সাঁতার

শুভেচ্ছার জল নড়ে, রঙিন নিমন্ত্রণে আমিষের পাত

মূর্চ্ছনা তোলে হিম দশটি আঙুল আজ দীপ্র নয়নে

লজ্জা রঙিন আশা, দুর্বিত্ত নিরাশা দেখো সমানে সমান

আমাকে হত্যা করে ফুটিয়েছে রক্তাক্ত দিনের পারদ

আমাকে হত্যা করে কান্তিমান চন্দ্র দু’ভাগ

আমাকে হত্যা করে মরে ফুল, গায়ক গোলাপ।

 

 

ধূসরকপিলা

 

তোমাকেই মনে পড়ে বিষাদের ধূসরকপিলা

অযুত গুঞ্জনে তুমি এতোটুকু প্রীত হও নাই

ব্যথার রঙিন বিষ আঁজলায়, পদ্মার জলে

আভূমি আনত দেখে তোর মুখ হলো রোশনাই।

 

প্রেমময় নৌকাজুড়ে থরে-থরে উজানী  ইলিশ

আমাকে পছন্দ হলে ছলের খোলস খুলে আয়

সাক্ষী থাকো ময়না দ্বীপ জলের হিস্যা-চাওয়া নদী

কৃষ্ণ আকাশ জুড়ে শাদাচাঁদ আজও উছলায়।

 

ধূসর কপিলা তোকে দেবো ধেনো-চুম্বনের বন

কুবেরের বিনিদ্র গান বিষাদেরই রক্তক্ষরণ।            

 

চুম্বন

 

এ কেমন চুম্বন চর্চা, এ কেমন হাল

চুম্বনে ধুয়ে নিই মনোজঞ্জাল

নধর ওষ্ঠ জুড়ে বিয়াবান ঢেউ

চুম্বনেরগুল্তি ছোঁড়ে কল্লোলিত কেউ।

 

প্রার্থণা উবে যায় জলের মতোন

কিছুই রাখে না মনে-মনোনিপীড়ন

তবু সে চুম্বন পোড়ে ওষ্ঠে আমার

ফলিত চুম্বন জাগে মিলিত আত্মার।

 

দ্বিধা

 

জাগরণকে সূঁচ বিদ্ধ করি

নিদ্রাকে মনুসংহিতার নিবিড় পাঠ

স্বপ্নকে তৃষ্ণার্ত জলপরীর উচ্ছ্বলতা

দূঃস্বপ্নকে দেবতার স্বর্ণমুকুট----

 

তুমি যদি ফুল হও, তবে কেন আমাকে

মৌমাছি হওয়ার প্রত্যাশা দাও না?

 

 

দূরতমা

 

পিপাসা মেলেছে ডানা অষ্পষ্ট স্বরে

সে বড় তরতাজা-বৃষ্টির দুপুরে

সে এক বালিকা-ফুল,

অচেনা

হেসে ওঠা উচ্ছ্বাসী সমুদ্র জবা

ছুঁয়ে যায়, গলে যায় আঁজলা ও আঙ্গুলের

ফাঁকে

 

পিপাসায় বসত গড়ি

অযুত সংসারে।

 

 

হাফিজ রশিদ খান

 

জন্ম ২৩ জুন ১৯৬১

স্থায়ী নিবাস : ৬৭২, হাজি কালামিয়া মুনশি লেন, দক্ষিণ শুলকবহর, ডাক : চান্দগাঁও, থানা : পাঁচলাইশ, চট্টগ্রাম। পিতা : মৃত নুরুল আনোয়ার খান, মা : মৃত নুরুন্নিসা বেগম

শিক্ষা : স্নাতক,  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮৮। সহধর্মিণী : মিল্লাতুন্নেছা খানম

 

ছোটোবেলা থেকে লেখালেখিতে হাতেখড়ি। ২১ বছর বয়সে প্রথম কাব্যগ্রন্থ জোসনা কেমন ফুটেছে’র প্রকাশ। এ পর্যন্ত ১৫টি কাব্য ও ৯টি গদ্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জীবনধারা ও সংস্কৃতির ওপর তাঁর রয়েছে সবিশেষ অনুসন্ধিৎসা। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ‘আদিবাসী কাব্য’ তাঁকে বাংলাদেশে আদিবাসী জীবনের প্রথম কাব্যকার হিশেবে পরিচিতি দিয়েছে। তিনি ১৯৯০ সাল থেকে বাংলাদেশের আদিবাসী সংস্কৃতির পরিচর্যায় ছোটো কাগজ সমুজ্জ্বল সুবাতাস সম্পাদনা করে আসছেন। এ পর্যন্ত যার ১৮টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে সচেতনমহলের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।

পুষ্পকরথ (প্রথম প্রকাশ : ১৯৯৩) তাঁর সম্পাদিত আরেকটি ছোটো কাগজ, ২০১৭ সাল পর্যন্ত যার ৮টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর দুই কন্যা নাইসা হাফিজ খান ও রাইসা হাফিজ খান।

হাফিজ রশিদ খান চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত সুপ্রভাত বাংলাদেশ পত্রিকার বার্তা বিভাগে কর্মরত।

প্রকাশিত গ্রন্থ

কবিতা 

জোসনা কেমন ফুটেছে ১৯৮২

চোরাগোপ্তা ডুবোপাহাড় ১৯৮৮

লোহিত ম্যান্ডোলিন ১৯৯১

স্বপ্নখণ্ডের রোকেয়া বেগম রুকু ১৯৯৫ 

আদিবাসী কাব্য ১৯৯৭ ও ২০০৭

টোটেমের রাতে হত্যাকাণ্ড- ২০০২

জুমপাহাড়ের ওম ২০০২

এই সুন্দর আমাঙ হারাবো না ২০০৬

আদিবাসী কবিতাসংগ্রহ ২০১০

ঘূর্ণির গোয়েন্দা ঘেরা ২০১২

পড়শিওয়ালা জাগো ২০১৩  

রোদের পোস্টার ২০১৪

লর্ড ক্লাইভের পথিকেরা ২০১৫

প্রত্নজীবনের রত্ন ২০১৮

ডিঙা ভাসে দক্ষিণ সমুদ্রে ২০১৮

 

গদ্য

বাংলাদেশের উপজাতি ও আদিবাসী :

অংশীদারিত্বের নতুন দিগন্ত (সম্পাদনা) ১৯৯৩

আমাদের কবিতা ও আদিবাসী প্রসঙ্গ ২০০১

আদিবাসী প্রবন্ধ ২০০৪

নির্বাচিত আদিবাসী গদ্য ২০০৫

অরণ্যের সুবাসিত ফুল ২০০৯

আদিবাসী জীবন আদিবাসী সংস্কৃতি ২০০৯

অলস করতালি ২০১৬

উজানি ছড়া লামনি ধার (আদিবাসী সংস্কৃতিবিষয়ে প্রবন্ধ) ২০১৬

কবিতার কারাবাস কবিতার মুক্তি ২০১৭

সম্পাদিত ছোটোকাগজ 

সমুজ্জ্বল সুবাতাস (প্রথম প্রকাশ : ১৯৯০)

পুষ্পকরথ (প্রথম প্রকাশ : ১৯৯৩)

 

 

হাফিজ রশিদ খানের কবিতা

 

ঘৃতাহুতি

 

কোনো মূল্যবান বস্তু অতীতেও সঞ্চয়ে ছিল না

শাদামাটা এ জীবন চলে

              নিসর্গের উচ্ছিষ্টের অংশে

সেখানেও তুঘলক মোগল ব্রিটিশ আর ধর্মধ্বজী

                অভিজাতেরা মুলার মতো বড়-বড় দাঁত

                                       বসাচ্ছে অনবরত

করুণার নবীশ্রেষ্ঠ

     মহান গৌতম

        বেদনার মাতৃজঠর উন্মুক্ত করে জন্ম নেওয়া

                                        প্রবল যোদ্ধারা

                                  কারাগার ভেঙেছেন

                            ফেলেছেন অশ্রুজল

 

তারপরও লোভের থাবারা আসে

শাদা ভালুকের বেশে অমর বাণীর উচ্চারণে

       রামেরা পদদলিত করে অবিরাম শস্যক্ষেত্র

                     এভাবে এখানে শিশুরা রক্তাক্ত

 

বঞ্চনার প্রতিবাদে আকাশ ফাটানো শব্দে

        আমি শরণার্থী হই : আর্ত পীড়িত ও পরিত্যাজ্য

 

আমাকে আবার

ঘিরে-ঘিরে চলে তুঙ্গে ভূরাজনীতির বিনোদন

 

ওদের উজালা ভোজসভায় আমি তো সেই

                 একই নরমাংস

                    মূল্যবান রাজসিক ঘৃতাহুতি ...

 

ফাগুনের গুণ

 

আমি তো একুশে ফেব্রুয়ারি

ঢাকা দিয়ে এখানে দাঁড়াতে পারি

           প্রস্ফুটিত আট ফাল্গুনের রক্ত আর শোকে

        আমাকে দেখছ কেনো উপনিবেশিক চোখে

 

ছুঁড়ে দিয়েছি উর্দুর উর্দি

ইংরেজের দুর্বুদ্ধি

              নেবে না নেবে না

                    আগামীর শোভন বাঙালিয়ানা

এই নিয়ে বিশ্বসভায় আমিও আছি ষোলআনা

 

আমি  যে পলাশ, রক্তিম প্রকাশ দিক আলো করা ফাগুনের

ইতিহাস দেখেনি কী গুণ আমাদের আগুনের?

 

 

মানুষের আশা

 

কতো কিছুর আশায় অপেক্ষায়-অপেক্ষায় থাকে

                               দুনিয়ার মানুষেরা                                                   

হৃষ্টপুষ্ট নবজাতকের ক্রন্দনের জন্যে দম্পতিরা

       আকাশ কাঁপিয়ে আসা

            উচ্ছল বৃষ্টির জন্যে গাঁও-গেরামের

                                    তৃষ্ণার্ত চাষারা

ব্যালট পেপারে ভরে যাওয়া বাক্সের আশায়

        রাজনীতিবিদগণ গভীর জনসংযোগে

                             নিরন্তর মগ্ন থাকে

 

প্রেমিকেরা শজারুর মতো উৎকণ্টকিত দিনরাত পার করে

                   একটি কোমল মিষ্টি ডাকের আশায়

      ধূমায়িত কাপের কড়া চা নিয়ে হিমছড়ির মেরিন

                   ড্রাইভে দৃষ্টির রোদ ছিটিয়ে রেস্তোরাঁ

                                  মালিকেরা বসে থাকে

 

সৈকতের বালকেরা

 

শামুকের মালা ও শো-পিস বিক্রির পকেটভর্তি টাকা নিয়ে

             ঘরে ফিরে যাবে সূর্যাস্তের পরপর :

                       সারাদিন থাকে আশায়-আশায়

 

মুশায়েরায় যাবার আগে রাতজাগা কবি ঝকঝকে

         শব্দের সারিতে তাক লাগানো কবিতা

                   লিখবে : আশার শেষ নেই তারও ...

 

আমার কৃষ্ণাভ নায়িকারা

আমার কৃষ্ণাভ সেই নায়িকারা হারালো কোথায়

জেগে আছি যাদের ভালোবাসার

                         একরত্তি স্নিগ্ধ সভ্যতায়

 

স্মৃতির ভেতরে মর্মরিত কৃষ্ণাভ সুদর্শনারা

তোমরা কী বহুদূর চলে গেছ ম্যাড়ম্যাড়ে

              চাটগাঁ শহর ছেড়ে

                     অজপাড়া গাঁয়ের কিনারা

                              ভুলে সব রঙিন ইশারা

 

চারদিক ঝোপালু পুকুরে সিনান করছ লুকিয়ে-লুকিয়ে

তেজি রোদ আর খোলা হাওয়াকে নগ্ন শরীর দেখিয়ে

 

তোমাদের চোখের বিদ্যুৎরেখা

কাঁচুলির পিছে উষ্ণ উত্তেজনার গভীর দেখা

আজো আমাকে উজ্জ্বল প্রেমিক সাজিয়ে রাখে

     পুষ্পাঞ্জলি হয়ে তাই হাজার পাপড়ি মেলে

                বসে থাকি এই শহরের বাঁকে-বাঁকে

 

আশা, যদি নিয়ে যাও মোরে

     ঝলমল জরদ হাসিতে বিয়ে বার্ষিকীর

                                     গোপন বাসরে ...

 

রাতের চোখ

 

রাতেরও চোখ আছে

        রাতও চেয়ে থাকে

                 ফুটপাতে কারা নাচে

                        হাসে কারা সড়কের বাঁকে

 

কারা যায় দ্রুতগতি

       নুড়ি কুড়ায় কাহারা

               রাত জানে কে গভীর সুফি কে অসতী

              মোড়ে-মোড়ে কে কাহার স্বার্থের পাহারা ...

 

করপোরেট সংস্কৃতি

 

করপোরেট ঘোড়া

                       কোথায় যাস তোরা

কেশরজুড়ে আলো

                       লাগছে বেশ ভালো

ছুটছ অবিরত

                         কোথাও অবনত

করছ বহু চুরি

                          হরেক বাহাদুরি

লর্ড ক্লাইভের

                           নতুন কিসিমের

তোমরা সৈনিক

                          বিবিধ কৌণিক

স্বভাব একটাই

                            লুটিস ঘরটাই ...

 

মৌল মানবাধিকার

 

ও আমাকে, আমি ওকে সিনায়-সিনায়

দিচ্ছি পাহারা যুগের পর যুগ জীবনের সীমানায়

               মৃত্যুতেও এ টহল শেষ নয়

                  পবিত্র আত্মা ও গ্রন্থগুলো

                             একই কথা কয়

 

তাই আমি হতে চাই গভীর বনের রঙিন বিহঙ্গ

তুমি চাও আকুল পরানে আমার মধুর সঙ্গ

              হাসিমুখ মেহনতি গোয়ালার দুগ্ধ

                        আনে প্রাণপূর্ণ আবেগের বেগ

                                    তারপর পরস্পর মুগ্ধ

       কামজ্বরে টগবগ ফুটি নিরালায়

বিশ্বমানবতা আমাদের পক্ষে

প্লেকার্ড-ব্যানারসহ মানববন্ধনে দাঁড়ায়

 

                    আমাদের জয়

                         অহর্নিশ জেগে রয় ...

 

 

নগরে মুরলিওয়ালা

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শ্রী সুভাষ দে, সম্মানিতেষু

 

নগরে প্রাণের মুরলি বাজালে তুমি

        দিন পেরোনোর এই আহ্বান

                       পুরাণের কানুর পীরিতি নয়

 

ইট আর লোহার খাঁচায় বাস করা

     এ শ্রমিক কৃষ্ণবাঁশির মহাভারতে কাটিয়েছ

                         জীবনের বিস্তারিত বহুকাল

 

তোমাকে আমার আহত ঠাকুর পাড়া মনে হয়

         মনে হয় আরো, অন্তর্বয়নের শুদ্ধ ডাক পেলে

                            তুমি সমুজ্জ্বল হতে

 

আমারও বাড়তো আয়তন আর দূর পথের পিপাসা ...

 

বিজয় একটা শাদা প্রজাপতির নাম

বিজয় একটা শাদা প্রজাপতি

যতবার ষোলো ডিসেম্বর আসে

                ওই প্রজাপতি

                ব্রহ্মা- ভ্রমণ সেরে বাংলাদেশে ফেরে

                         খানিকটা বিশ্রামের প্রয়োজনে

 

তখন তাহার মখমল পাখনায় বাজে

    শিশিরবিন্দুর ভেজা কলতান

          তখন সকল নদীর কিনার থেকে

                   ভাসতে-ভাসতে আসে

                  মর্মছোঁয়া লোকগানের ঝংকার

নগরগুলোর বুক থেকে উছলে-উছলে ওঠে

            শোভাযাত্রা ও উল্লাস আর

                       বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির আন্দোলন

ওই শাদা প্রজাপতিকে আমরা সকলেই চিনি

      ওই ধবলিমা আমাদের আকাক্সক্ষার মসনবি

                  আমাদের অবিস্মরণীয় গীতাঞ্জলি

             ওর শরীরের কাঁপুনি অগ্নিবীণার কথা বলে

 

ওই সফেদ-সুন্দর পঁচাত্তরে আঘাতে-আঘাতে

                         লাল হয়ে কীভাবে আবার

                                     শুভ্রবর্ণ ধারণ করলো

সেই কিংবদন্তি আমাদের চেতনা ও হৃৎপি- জানে

                   বিশ্বজয়ী বাংলাভাষা জানে

              আমাদের শিল্পকলা ও সাহিত্য জানে

                   মেহনতি জনসাধারণ বুদ্ধিজীবী আর

                                রাজনীতিবিদেরা জানেন

 

এইভাবে

বিজয় একটা শাদা প্রজাপতির প্রকৃত

              নাম হয়ে এলো মানুষের ইতিহাসে ...

 

 

প্রিয়সঙ্গ

 

পার্বত্যপথের সেই প্রিয়সঙ্গ

কোথায় গিয়েছ তুমি, শিথিল হয়েছে অঙ্গ

 

তোমার মধুর বচন শুনবো বলে

আজো আমি ঘুরি গভীর জঙ্গলে

       চড়–ই পাড়ায়, লিমুঝিরি গাঁয়ে

             যাযাবরের আদল নিয়ে চলি পায়ে-পায়ে

 

কতো কুলাঙ্গার অস্ত্রধারী

       তির্যক কথার অশিষ্ট বাড়াবাড়ি

             আমাকে পারে না দিতে ব্যারিকেড

                      আমি তো বিহঙ্গ, মুক্তপৃথিবীর কমরেড

 

আমি বলি, সুলভে-দুর্লভে

গাঁথা আছে আমার সম্প্রীতি নিসর্গের পল্লবে-পল্লবে

            কেনো বাধা দাও অক্লান্ত পথিকে

                       ছুটেছে যে বন্ধুর সন্ধানে দিকে-দিকে

 

ভালো মনের আওতায় হও না তোমরা শরণার্থী

             প্রকাশ করো না হৃদয়ের আর্তি

                        তোমরা কেবলি চাঁদা

                                    পথে-পথে বাধা

 

কেবলি মাংসের ভোজ-কেবলি হুঙ্কার

এটাই উচ্চাশা তোমাদের, একমাত্র অলঙ্কার!

 

নই আমি তোমাদের মতো

        বন্ধুর প্রীতির গন্ধে আমি অবনত

                         আমি কাঁদি ওর জন্যে

তোমাদের চেয়ে সেরা সে, নিবাস ছিল এ অরণ্যে ...

 

আমার কাছে ফিরে এসো

 

সনির্বন্ধ প্রার্থনা আমার

  ফিরে এসো হে স্বদেশ অশেষ ভাণ্ডার

       ফসলের হাসিভরা চাষার সুন্দর ঘরে

             ভাটির উদাস মাঝিদের প্রাণের খবরে

 

পল্লবশোভিত মহান বৃক্ষের ছায়ায়-ছায়ায়

    নদীতীরের সমীরে গান গাওয়া রাখালের উদাত্ত আশায়

            কুলবধূদের আঁচলের কুণ্ঠিত মৌচাকে

                    যেখানে দরদি হৃদি সর্বক্ষণ জেগে থাকে

 

ফিরে এসো সোনা

     এখানে আমার হচ্ছে না তো ভালোবেসেও নিখুঁত বনিবনা

             আমি তো প্রয়াত আদুল বাঙাল

         এখন হয়েছি নতুন কাঙাল

                  বাণিজ্য ও বিনিয়োগের করুণ দাস

              আমার জীবন ঘিরে এ কি মত্ত পরিহাস

 

আমার তো কিছু নেই পরিপাটি

        শুধু খুলে রেখেছি শীতলপাটি

            তাই তো আমাকে ঘিরে বিপন্ন মানুষ আসে

                          সীমান্ত পেরিয়ে গভীর বিশ্বাসে ...

 

 

 

সাজিদুল হক

সম্পাদিত ছোট কাগজ

১.সুদর্শনচক্র

২. জোড়াসাঁকো

৩. সবুজ আড্ডা

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ

অন্যকোন সুরঞ্জনা

মহলের উল্টোদিকে

নাটোরের মির্জাকন্যা

১৯৯৩ সালে কোলকাতায় অল ইন্ডিয়া লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলনে অংশগ্রহণ।

১৯৯৪ সালে তনুশ্রী ভট্টাচার্য সম্পাদিত The Uttaradhunik (দি উত্তরাধুনিক) গ্রন্থে প্রকাশিত হয় কবির একটি প্রবন্ধের অনুবাদ।

 

সাজিদুল হকের কবিতা

 

শেষ রাতের চাঁদ

 

শেষরাতে চাঁদ দেখতে

অনেকটা সাম্পানের মতো

কেঁপে উঠলে নদীগর্ভ

ঢেউয়ের খেলায় মিলিয়ে যেতো ছায়া

জলের আঘাতে অভিমানী চাঁদ

এক সমুদ্রের পিপাসায়

আজ নিজেকে হারাবে

সর্বভুক নাবিকের ইচ্ছের কাছে।

তোমরা খুঁজতেই থাক কলঙ্ক

আমি অমাবস্যায় খুঁজে নেবো শৈশব

তুমি বলবে, চাঁদ উঠেছিলো

তোমার আদলে

আলো ফুটলেই পালাবে

তোমার সৌন্দর্য চুরি করে;

না জানুক কেউ

স্বাক্ষী ধ্রুবতারা

অমাবস্যার রাতে চুরি যাওয়ার ভয়ে

তুমি বন্ধক রেখেছিলে

আমার কাছে গোপন সুন্দর।

 

আমার অপেক্ষা থেকে

গোলাপজলের স্নানে পবিত্র হবো আমি

এমন ইচ্ছার পদাবলীতে নেই তোমার সায়

ফরাসী সৌরভে মুগ্ধ তুমি চেয়েছো বিষাদ

ঘিরে থাকুক আমাদের পৃথক ইচ্ছের পৃথিবী

বেদনা লিখুক ঘৃণা ক্ষুরধার অক্ষরে।

অতিমানবের গল্প ভীষণ অপছন্দ বলেই

বেছে নিয়েছো কী উইপোকার জীবন?

পুনরায় ফিরে আসার প্রবল অনাগ্রহ

অনেক পুরনো মানুষের এই গ্রহে।

আমাদের এখনো অনেক শেখার আছে

যেতে হবে স্কুলগামী মৌমাছির কাছে

এক জীবনে এসব শিখেছ পাখির আলিঙ্গনে

আমারও প্রশ্ন সুদর্শনা তোমাকে

আমার অপেক্ষা থেকে কী জন্ম নেবে না প্রেম?

 

মন কিছুই বলেনি

 

আগেও দেখেছি তোমাকে

কলেজের করিডোরে

দেখতে দেখতে চোখ নামিয়ে

দেখেছ বারেবারে

কী দেখেছিলে চোখের ভিতর!

মুখে বলোনি

মন কি বলেছে কিছু?

সেদিন অন্তর্দেশে

তোমার জন্য ছিলো না

এতটুকু অনুভূতি ;

চল্লিশটি শ্রাবণে ভিজেছে মন

আবার যদি দেখা হয়!

হেমন্তে কুয়াশা একটু আড়াল

করেছে বিকেলবেলার রোদ

সুপার মলের লিফট দিয়ে

নেমে আসছ তুমি

মুখোমুখি আমি

চোখ ফেরাতে পারিনি

চোখ নামিয়ে

আবার রেখেছি চোখ

কিছু বলতে চেয়েছিল মন

সময়ের ব্যবধানে

আমি আজ সেদিনের তুমি।

 

অন্য গ্রহ থেকে আসা কেউ

 

জলের টলটলায়মান শরীরে

কোথাও নেই চুম্বনের দাগ

বাতাসে মিশে থাকা অনুভূতি

করেছে নাবিক

আমি নীল মেঘের সাথে

তুলনা দেবো না কখনো

লাল লিপস্টিকের;

অনুভূতির কী রঙ আছে!

খুঁজে না পেয়ে বেছে নিল

পলায়নের পথ

কলতলার বারবনিতা

বারংবার মুছে পায়ের আলতা

আড়াল হয় না রূপ

তোমাদের বারন সত্ত্বেও আমি

তাকে নিয়ে যাবো গভীর সমুদ্রে

সাগর সঙ্গমে জন্ম দেবে

মানুষ নয় অন্য গ্রহের কাউকে।

 

ঘুরে এসেছি মধ্যযুগ

 

তুমুল বৃষ্টিজলে ভিজেছিলো রাত্রি

রাত্রির সাথে ছিল না নক্ষত্রপথে কেউ

দুঃস্বপ্ন আলতো করে খুলে দিল গিরিপথ

নিশ্চিত না এই পথ দিয়ে কখনো গিয়েছি কীনা

অলৌকিকভাবে বেঁচে যাবো এমন আশায়

শেষ দেখবো বলে উঠে বসি মৃত ঘোড়ার পিঠে

বাদশাহি আমল শেষে যে ঘোড়াগুলো

ইংরেজরা পেয়েছে সেসব অসুস্থ ঘোড়ার একটি

আমার জন্য কী ভেবে রেখে যায় মাউন্টব্যাটেন

যুবরাজের ভাগ্যদেবতা জন্ম দেয়নি আমাকে

অল্পদূর যেতেই পদাতিক আমি কীভাবে যেন

সুবর্ণপথ হারিয়ে একা ফিরলাম এ কোন অরণ্যে?

কথা দিয়েছিলাম যে গ্রহে যাই নেবো তোমাকে

কথা না রাখায় তুমি কী শাস্তি দেবে বলবে?

একুশ শতকের গাড়ির শব্দে ফিরে দেখি তুমি

কী এক দুঃস্বপ্নের ভেতর আমি ঘুরে এলাম মধ্যযুগ।

 

রাজনীতিবিদ

 

মৌলানার সফেদ পাঞ্জাবিতে অল্পকাল আড়ালে রেখেছো রক্তাক্ত তর্জনী

কী পেয়েছো দু'জনের মুখোমুখি সংঘাতে

শরাবের নেশা কেটে গেলে মাতালও ফিরে আসে

অপরাহ্নের অবসরে;

তোমাদের প্রত্যাবর্তনে শঙ্কিত ভ্রাম্যমাণ পতিতারা

বসন্ত কখনো নিয়ে আসেনি প্রেম

রাজদরবারে নিয়ে যায়নি তাই অভিযোগ

হিজড়াদের সাহস দেখে এরা কী শিখেছে কীছু?

জন্মভূমির না ফোটা গোলাপগুচ্ছ একবার

প্রশ্ন রেখেছিলো লালরঙের কাছে

কোথায় পেলে কৃষ্ণচূড়ার অনুরাগ!

এসব নয় অনুরাগরঞ্জিত

কারাগার যাপিত অর্জিত প্রিয়নেতার ক্রোধে

উত্তেজিত শব্দাবলী খোঁজে বারুদখানা।

 

তীরবিদ্ধ স্বপ্ন

 

পূণ্যবান নির্ঘুম প্রার্থনা শেষে আবারও

ফিরে পেলো যুবতীর উষ্ণতায় মধ্যাহ্ন

শুধুই একরাত্রি সরে ছিল নাভিদেশ থেকে

বুঝেছি বস্তুত এই আমাদের জীবনবোধ;

বলতে চাও বৃক্ষপতনের ছন্দে ভাঙে না তার ঘুম!

তাকে ঘিরেও চর্চা হয় ঐকিক নিয়মে

সংসারের নিত্যদিনের চাওয়া পাওয়া।

বেশিদিন পালিয়ে বেড়াতে পারে না মৃত্যুভয়ে

অবিরাম হিসাব নিতে আসে জীবন দেবতা

তীরবিদ্ধ স্বপ্ন ভুলিয়ে রাখে পরকালের ভয়।

 

অন্যঘর থেকে আসা

তলোয়ারের ধারে কেটে যাচ্ছে সবুজ

আমি সে নগরের অখ্যাত একজন

সামান্য কর দিই বলেই কী নাগরিক?

আমি অন্যঘর থেকে আসা

অন্যদের মতো হতে না চাইলেও

আমিও জোছনা বঞ্চিত রাত

বসন্তকালে হারিয়েছি সখি

এখনো লেগে আছে চুম্বনের স্বাদ

বড়ো সাধ জাগে নাগরিক হওয়ার!

পিতার রেখে যাওয়া আকাশের পাখিরা

পালিয়েছে যুদ্ধ বিমানের জন্য রেখে জায়গা ;

আমি কোথায় পালাবো?

এতো রক্তপাত দেখেও যদি কেউ

আর্তস্বরে না বলে

এ শহর আমার নয়,

নিয়তি মেনে থেকে যাবো এই শহরে।

 

অনিবার্য সত্য

আয়নার সামনে আমি

আমার পেছনে অপরিচিত কেউ

পাশে নেই প্রিয়তমা

অনিবার্য সত্যের কাছে পরাজিত

রুপসী প্রিয়ার যৌবন ;

অচেনা চাঁদ কৃষ্ণবিবরবাসী

অন্ধকার পথ দেখায় আত্মাকে।

কফিনে রাখা লাল গোলাপের

সুবাসে আতরের গন্ধ

দয়িতা সে গন্ধে কী মাতাল হয়?

মৃত্যুদেবতা আসে পাখির ডানায় উড়ে

আমি জানি না তার সত্যি

এতভাবে কাছে থেকে দেখেছি মৃত্যু

কখনো স্বাগত জানিয়েছি মৃত্যুকে!

মৃত্যুগুহার প্রবেশ মুখে দাঁড় করিয়ে

আজরাঈল আমার কথা ভুলে

আমার নামের অন্য কাউকে

নিয়ে চলে গেছে?

 

পুস্পকরথে পার হবে পুলসিরাত

বিশ্বাসে মিলিয়ে গেলে বস্তু

আমার কী ক্ষতি!

যে যেতে চায় স্বর্গে পুস্পকরথে

অথবা পুলসিরাত পার হোক নির্বিঘ্নে

এসবে নেই আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা

আগুনে দহনে পুড়ছে শহর

মানুষজন

তাদের মন

আমি কীভাবে চলি এড়িয়ে ;

মৌলভী শব্দের উচ্চারণে কী ঝরে

পুষ্পবৃষ্টি?

পুরোহিত মন্ত্রজপে সারাদিন

ক্ষুধাতৃষ্ণায় সেও ফিরে বস্তুজগতে

ভান্তের রিপুদমন হয় না গেরুয়া বসনে

ফাদারের চোখ থমকে যায় মুহূর্তকাল

যুবতী ঝোড়ো হাওয়ায়

ঘামের ঘ্রাণের মাদকতা এমনি

ভঙ্গ হয় মুনিঋষির সহস্র বছরের তপস্যা

আমিতো এক সাধারণ

মোহ আমাকে এনেছে পৃথিবীতে

ঈভের পথ ধরে।

 

খালেদ হামিদী

জন্ম : ২৪ জানুয়ারি ১৯৬৩

 

জন্মস্থান : আব্দুস সাত্তার কাস্টমস্ কালেক্টর বাড়ি,বাদামতলী,আগ্রাবাদ,চট্টগ্রাম।

 

শিক্ষা : ব্যবস্থাপনায় স্নাতক (সম্মান) : ১৯৮৫; স্নাতকোত্তর : ১৯৮৬; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

পেশা : প্রকাশনা বিভাগের প্রধান, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ।

 

পরিবার : স্ত্রী : মোশরেখা সুলতানা শাহী, কন্যা:  অন্বেষা তানহা হামিদী ও পুত্র : অন্বয় আশিক হামিদী

 

প্রকাশিত গ্রন্থ :

কাব্য:   আমি অন্তঃসত্ত্বা হবো (ডিসেম্বর ১৯৯৯)

হে সোনার এশীয় (ফেব্রুয়ারি ২০০৪)

মুখপরম্পরা (ফেব্রুয়ারি ২০০৭)

ধান থেকে শিশু হয় (ফেব্রুয়ারি ২০১০)

স্লামডগ, মিলিয়নার নই (ফেব্রুয়ারি ২০১৩)

তুমি কি রোহিঙ্গা মাছি  (ফেব্রুয়ারি ২০১৮)

গল্প :   আকব্জিআঙুল নদীকূল (ফেব্রুয়ারি ২০১২)

উপন্যাস : সব্যসাচী (ফেব্রুয়ারি ২০১৬)

প্রবন্ধ : কবির সন্ধানে কবিতার খোঁজে (ফেব্রুয়ারি ২০০৭)

না কবিতা, হাঁ কবিতা (ফেব্রুয়ারি ২০১৬)

অনুবাদ : ওঅল্ট হুইটম্যানের কবিতা (ফেব্রুয়ারি ২০১৬)                                        

 

খালেদ হামিদীর কবিতা

 

ও বি হামিংবার্ড

 

ও বি হামিংবার্ড,

তুমি কি হাভানা থেকে আসো খুব উড়ে,

নিজের চারদিকে নাকি আমি মরি ঘুরে!

পরিযায়ী পাখি নও ভুলেও কখনো;

তথাপি উড়াল তোর ক্রমাগত ঘন।

ক্ষুদ্রতম পক্ষী ওহে,

মৌমাছি সমান প্রায় ঝাঁকে ঝাঁকে এসে

কি খোঁজো আমার চোখে, মুখে, বুকে বসে?

মিলনযুদ্ধোত্তর অঙ্গে নিবিষ্ট তারপর,

অপিচ আমারই মধ্যে চাও তরুবর?

হে বাস্তব বিহঙ্গমী,

তোরও চেয়ে ক্ষুদ্রতর পুরুষ তোমারও

কি পায় আমার দেহে, সঙ্গে আর কারো?

তোদের সবুজ, নীল বিভার অঞ্জন

চোখে মেখে শুনি ডানা কি অনুরণন।

 

রে জ্বালানি কি সাম্রাজ্যকামী,

কলম্বাস নই মোটে, না ভূগোল আঁকি;

কিভাবে এশিয়া ব’লে কিউবাকে ডাকি?

হাওয়ার সমান আয়ু শ্বাসের আমার;

প্রাণ আর পাখি সদা চাহে অংশীদার।

 

ফুলশয্যার দ্বীপে

 

পুরুষ নাভির নিচে পশু কিনা মনেই থাকে না

যখন রবীন্দ্র গানে কিংবা সাতই মার্চের ভাষণে

নিজেকেই ফিরে পাই ধ্যানে ও চৈতন্যে শিহরিত।

তথাপি তোমার সঙ্গে এক টুকরো ঘাসের আশ্চর্য

সবুজে মিলিত হলে কোত্থেকে চারদিকে আসে স্রোত?

হঠাৎ চিৎকৃত তুমি: একি! ভাসে আমার বোনের

মরদেহ! নর কেহ মারে হিংসার বলাৎকার শেষে!!

 

ফুলশয্যার দ্বীপে ক্রমে আছড়ে পড়ে আরো মৃত নারী।

 

শিশুর ধরনে

 

গভীর রাতের ঘুম চিরে           হঠাৎ পানির শব্দ হলে

মনে হয় সারা ঘর জুড়ে           কে যেন খড়ম পায়ে হাঁটে।

তথাপি শঙ্কিত নই, শুধু           দৈবাৎ ঝিলিক দেয় কেউ

যাকে আমি ভালোবাসি নাই,       এমনকি দেখিনি খালি চোখে।

কোথাও কাঠের পাদুকায়          জখম কারুর আর্তি শুনে

দাঁড়াই রাস্তায়, মহল্লায়            কোন ত্রাসে বাড়ির খোঁজে, একা?

আশেপাশে কৌতূহলী হতে আসেন না ইটালো ক্যালভিনো

কিংবা তাঁরই গল্পের লোকজন।    দেখাও মেলে না আহতের,

কান্নাও অধুনা অবরুদ্ধ!           কিন্তু যেই হেঁচকা টানে কেউ

ছেঁড়ে তার হার, লকেটখানি        আমারই বুকের অতলান্তে

অমনি এসে গেঁথে যায় আজও।    এ কি অলংকারাংশের দাগ

নাকি কারো পদবৃদ্ধাঙ্গুলি           আমাকে মাড়ায় ছাপ রেখে!

হিং¯্রতার বিপরীতে বুকে        আলিঙ্গনে পারি নাই নিতে

আলতামাখা পা দু’খানি কার?      কে সে? দর্শন অলভ্য তার?

চক্ষু মুদে দেখা মাত্র ওকে         কেঁদে উঠি শিশুর ধরনে।

 

 

ধর্ষিত শিশুর রক্ত

 

মুঠোয় দুর্ধর্ষ রতি, হেড ফোনে প্রবল শিৎকার;

কোথায় নিবদ্ধ দৃষ্টি? রিকশায় চলেছে একা কিংবা ভিন্ন যানে

কোন্ তরুণ অথবা তন্বীগণ? মুষ্টিতে চিত্রিত

আমারও রিরংসা, কভু। পথ চলতে কখনো হঠাৎ

দৃষ্টি থেকে নেমে চিবুকের নবতর

মানানসই দাড়ি, কারুর ঈষৎ দীর্ঘ

চকচকে গোঁফের গুচ্ছ, মিষ্টি হাস্যময়

নেত্রপাতের চকিত প্রখর তারুণ্য,

ত্রিদিকের লঘু বিন্যাসের ওপর চুলের

অভিনব অগ্নিশিখা কিংবা ফিলিপিনা

হেন আস্কন্ধ কেশের আশ্চর্য ববকাট,

বর্তুল বুকের জোড়া কিসমিস অথবা

লিপস্টিকময় দুই ঠোঁটের বহুত্ববাদ

স্পর্শের আলপনা আঁকে আমারও নানান

অনুভবে শুধু নয়, শিরার রক্তেও।

তাই বলে আমিও কি, স্পন্দিত ওদেরই

কারুর সমান্তরালে, কিয়ৎ দিঘল মাছে সংগুপ্ত নিজেকে

আবিষ্কারে আনন্দিত? জানার আগেই

প্রচ- বৃষ্টির সঙ্গে আকাশচ্যুত অসংখ্য কাচকির

জীবন্ত রুপায় ভূমি ক্রমশ আস্তীর্ণ হলে কোত্থেকে রক্তিম

ক্ষীণ রেখা এসে চিরে ফেলে দৃশ্যপট।

তৎক্ষণাৎ ছাতা ফেলে বজ্রাহতের ধরনে সটান দাঁড়িয়ে

পড়ি, আর, কে যেন কানের কাছে

বর্ষণ ছাপিয়ে কহে : হাসপাতাল থেকে

ধর্ষিত শিশুর রক্ত কিভাবে এখনো

এতোদূর বয়ে আসে!

 

 

তোমাকে, ফিদেল ক্যাস্ট্রো

 

আমি হলুদের ফুল, সর্ষে পাতা কিংবা থানকুনির ভর্তাযোগে ভাতই খেতে চেয়েছি কেবল। হেলেঞ্চার মর্ম থেকে উৎসারিত রক্তাক্ত ফিনকি একদা জাতীয় পতাকাকে আহত করছে দেখেও কাচকির সাথে খেলে, মলার সংগে মিলে এবং ডাঙায় হামাগুড়ি এঁকে, আরও পরে ভুবন জুড়ে বুকে হেঁটে কিভাবে, কি করে যেন পাড়ি দিয়ে ফেলি আধেক শতাব্দী! নিজ গৃহশূন্যতায়, সংশ্লিষ্ট তাড়ায় আর বিভিন্ন ভাড়ায় অনন্তর ঠাঁই বদলের মজদুর বাংলার ফিলিস্তিনি আমার, মেলেনি আজও প্রাণ ভরে কিংবা নিজেকে উজাড় করে কাঁদবার ফুরসত। তথাপি তোমার পতাকার নিচে আমারও উড়েছে চুল।

 

পরিমাণবাদীদের তাচ্ছিল্যের নানা স্তর ডিঙিয়ে আমি কি আদুরে মধ্যম আজ? কতিপয় উত্তম চালিয়ে নিলে সংখ্যাহীন অধমদের, ক্ষুন্নিবৃত্তির সংগ্রামী সাথীদের সঙ্গে কোথায় দাঁড়াই তবে? প্রশ্নের অনতি পরে, জিজ্ঞাসার ঢের আগে, মাথা ঘষে মার্কিন ডলারে পুণ্যবান আখ্যায়িত যারা তাদের অনুুজ কতো মহাসাগরে ঝাঁপ দেয়, সে অর্থের দিকে ভাসে বিরাট, বিশাল হরেক টায়ারে। এদিকে ওদের বিপরীতে আমি কি পুরোই ন্যুব্জ, বিচ্ছিন্ন, পরাস্ত? জানার আগেই তোমার ভূভাগ থেকে উড়ে এসে হামিংবার্ড আমারই সত্তার অতলে নিবিড় খোঁজে কোন অবশেষ? ক্ষুদ্রতম পাখিটির ক্রিয়ার সমান্তরালে, তোমাকে, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, প্রণতি জানিয়ে রাখি, যে-তুমি দেহাবসানের পরেও সদা বিদ্যমান। যদিও, এখনো নই আমি নিজেরও সমান।

 

 

চেনো না আমাকে তুমি

 

তোমরা আমার শুধু বাস্তু হরণে ক্ষান্ত নও, আমাকে সপ্রজাতি নিশ্চিহ্ন করতেও অসম্ভব কৃতকার্য বলেই কি তোমাদেরই লক্ষ লক্ষ বৎসর পরের কিংবা কয়েক শত বছর আগেকার প্রজন্ম, কেটে নেয় বহু দূরান্বয়ী স্বজনের জিভ কঙ্গোয়, লাইফবয় হ্যান্ড ওয়াশ লিকুইড ছাড়াই ক্ষিপ্র ধুয়ে ফেলে নিজেদের রক্তস্নাত হাত এবং কখনো বিষ্ঠাকীর্ণ শিশ্ন দক্ষিণ আফ্র্রিকায়? হায়! ছি! তোদের ধরনে নই মনুষ্যপ্রতিম। তবু বলি কাউকে না কাউকে: শয়নে, রমণে, আহারে ও সর্বদা বিহারেও ভীষণ সংলগ্ন থেকেও চেনো না আমাকে তুমি, কিছুতেই, এক্কেবারেই না। উপরন্তু শুনতেই পাও না তোমাদের ব্যঞ্জন বর্ণের দুরন্তপনাশুন্য আমার স্বরবর্ণময় জবান, মুখরতায় যা শোনায় গানের অনুরূপ। কে বা কারা ঘোষণায় আজো তৎপর আমার অনস্তিত্ব! ফিলিস্তিন কি তামিল, বাগদাদ কিংবা দামেস্ক এবং এমনকি ত্রিপোলি জুড়েও এখনো প্রবহমাণ সেই তুরকানা হ্রদে, নিহত অথচ জ্যান্ত, কিন্তু মৃতবৎ খোলা চোখে চিৎ হয়ে আধো ডুবে ভেসে আছি অন্য নিয়ান্ডার্থাল, সঙ্গে কাছে ও দূরে বাতাসকে চোখ মেরে, কনুইয়ে আকাশ গেঁথে ও আরো নানান ভঙ্গিতে আমারই আবালবৃদ্ধবনিতা। একই জলভূগোলে ভাসমান আমার নিছক খাদ্য সংগ্রহের পাথুরে অস্ত্র, কাষ্ঠনির্মিত সিংহমানবের সজাগ আনন, কর্ণালংকার আর ছোট্ট ঢোলকতুল্য আশ্চর্য বাজনা। তুমি কিন্তু জানো না।

 

 

প্রেমের কবিতা আমি লিখতে পারি না, তবু

 

জ্যান্ত মাছের আঘাতে হঠাৎ আহত

তোমারই হাতের মধ্যমার মূল থেকে

অশ্রুর ধরনে গাঢ় রক্ত ঈষৎ গড়ালে 

তৎক্ষণাৎ আঁৎকে উঠে ওষুধের খোঁজে গৃহে ছুটি দিগ্বিদিক, আর,

ফিরে এসে টের পাই কতো কাল পরস্পর দেখাই হয়নি।

ঠিক তখনই কোথাও বিরাট অফিস

প্রাঙ্গণের প্রান্তঘেঁষা বৃক্ষডালে বসে,

রৌদ্রঝলমল দিবসে, কি আশ্চর্য, কাকে যেন নিজ সুরে ডেকে ওঠে

এক নিঃসঙ্গ মাছরাঙা!

 

 

একমাত্র তুমিই পিতা

 

মাতৃবিয়োগের পর মোচার আকারে তৈরি

কলাপাতার আধারে ভাত, তরিতরকারি কি

মাছেরও রেসিপি ঢেলে, স্বজনের পরামর্শে,

যে রাখে পথের ধারে, অদৃশ্য চলিষ্ণুতায়

জননী মেটাবে ক্ষুধা, এমন বিশ্বাসে, তারই

অনুসরণে আমি তো ভুলেও দেইনি ভোগ  

কারুরই স্মরণে। তবু কি চেয়ে, অপ্রাপ্তিযোগে

হেঁটে যাও হে জনক, দেখে নিষ্পলক কভু

আমাকেও! শ্মশান কি গোর ঘেঁষে এগিয়েও

দাঁড়াও নদীর কূলে? প্রয়াত মায়ের জন্যে

ওদিকে পারের কড়ি মোচাভাতে দিলে কেউ,

তক্ষুনি মাছের ঝাঁক জলের কিনারে এসে

কী যেন তোমাকে বলে আর পক্ষী সব উড়ে

জানায় কুর্নিশ। আমি তোমাকে কি দিতে পারি

অপূর্ণ কৃতির পদ্য? না। শত্রুর বিপরীতে

আমার একান্ত শব্দ বয়ে যায় ভূমি জুড়ে

তোমারই রক্তের দিকে। হারানো মাতারও যতো

স্মৃতির সমান্তরালে, নির্ভোগ কে চিরশোভমান?

একমাত্র তুমিই পিতা, শেখ মুজিবুর রহমান।

 

 

ফিরে এসো

 

পিতৃতর্পণের জল কোথা পাই! নাফ শুধু নয়,

সব নদ, পুষ্করিণী, সরোবর, হ্রদ ও সমুদ্রে

মিশে একাকার আজ উদ্বাস্তু নারী ও

শিশুর অন্তিম শ্বাস, হৃতঠিকানার আরো

সতেজ বালিকা-লাশ। গত তিন প্রজন্মের পূর্ব

একুশ পুরুষও তবে ওপারেও ঠিকুজিবিহীন!

আগুন ও উদ্যানের মধ্যখানে স্বর্গমুখী অপেক্ষায় ম্লান!

মাত্র ত্রিদশকাধিক কাল আগে কিভাবে উন্মূল

হতে পারে কোনো জাতি পিতৃভূমি থেকে?

হায় ভূ-রাজনীতি! ক্রূর বাণিজ্যবেসাতি!

না। কোমর জলে এবার দাঁড়াবো আমি,

প্রেমে পরিশুদ্ধ পানিতে অঞ্জলি পূর্ণ;

ভয় নেই। ফিরে এসো প্রয়াত অগ্রজবৃন্দ,

দ্বিকরতলের জল নাও তবে, থেকো না নিঃশব্দ যামে।

আমার প্রণাম শুধু পৃথিবীর সারা মাতৃপিতৃভূমে।

 

 

লক্ষ্মী পূজায় এবার

 

তুমি মা, হাতির পিঠে চড়ে কেন এলে ধরাধামে!

সৌর ব্যবস্থাপকের সঙ্গিনী হয়েও, দেখো,

আমার অকিঞ্চিৎকর সমূহ অর্জন আর

জন্মভিটাও হঠাৎ উপড়ে হস্তিপৃষ্ঠে তুলে ওরা যায় শ্যেন দৃষ্টি হেনে।

নিহতের ’পর হাঁটা হৃতসম্ভ্রম ও

জখমেও ক্ষীয়মাণ আমাদের কান্তার কি মরুভেদী ক্ষিপ্র

ধাবমানতায় কেন সামনে এসে পড়ে

শুধু পানি আর পানি! অনন্তর দিগন্ত পেরোয়

সমুদ্রের সব বিরাট তরঙ্গমালা।

 

তবে ফের কোথায় পালাই!

স্মৃতিই কি শেষাবধি অস্তিত্বের কেন্দ্র?

নইলে কেন, মাগো, আশ্চর্য পেঁচার পাশে

পদ্মাসনে তুমি এখনো দেদীপ্যমান!

 

এদিকে ওদিকে তবু কারা যেন কহে:

ইংরেজি বইয়ের সারি-কলামের সম্মুখে পাঠক

এক রাখেন কাঠের শো পিস সুচারু কালো ছোট ঐরাবত,

সেই ভাষা-সাহিত্যের আভিজাত্য বুঝে!

কেউ বলে, সাগর ও আকাশের সন্ধিস্থলে কখনো হারিয়ে গেলে

লক্ষ্মীছাড়া পেঁচামুখে আমিও তাকাবো দূর সভ্যতার দিকে।

 

 

 

সেলিনা শেলী

জন্ম: ১৭জুলাই, ১৯৬৭,

পৈত্রিকবাস: বরুরা, কুমিল্লা

পেশা: শিক্ষকতা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক(সম্মান) ও মাস্টার্স করেছেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর মহিলা কলেজ এ উপাধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষে মুক্ত চিন্তার লড়াই এ সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ভূমিকায় অত্যুজ্জ্বল তার ছাত্রজীবন। আশির দশক থেকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কবিতা গল্প প্রবন্ধ মুক্ত গদ্য লিখে চলেছেন।ইতোমধ্যে নানা সংগঠনের সম্মাননাও পেয়েছেন। পেয়েছেন কবি ওহীদুল আলম সাহিত্য পুরস্কারও।

 

প্রকাশিতগ্রন্থগুলো:

অন্ধকারহেঅন্তর্গত

নিভেআসেসূর্যসকাল

চিতাচৈতন্যেরগান

দ্বিধাসংহিতা

ছোটগল্প:

হনন

প্রবন্ধ/গদ্য:

কতিপয় কবিতার কথা

সেদিন কী দিন ছিল এদিন কী দিন

কবিতার ব্যঞ্জন ও ব্যঞ্জনা

 

সেলিনা শেলী একাধারে কবি গল্পকার এবং গদ্যকার। কবিতায় যারা একার সন্ন্যাস যাপন করেন উত্তমরূপে তাদেরই একজন তিনি। যখন কবি- স্বরের স্বরভঙ্গিতে সমসাময়িক কবিদের চেয়ে আলাদা। যখন প্রাবন্ধিক- ব্যবচ্ছেদে নির্মোহ- গুণবিচারী। ইতোপূর্বে তার গবেষণা ধর্মী প্রবন্ধ গ্রন্থ কবিতার ব্যঞ্জন ও ব্যঞ্জনা ব্যাপকভাবে পাঠক সমাদৃত হয়েছে। সেদিন কী দিন ছিল এদিন কী দিন ও কতিপয় কবিতার কথায়-ও শক্তিমান গদ্য শিল্পীর পাশাপাশি তার প্রজ্ঞা ও মননশীলতার পরিচয় পান পাঠক। এই গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো তার দূরাণ্বয়ী মেধা ও প্রজ্ঞার স্মারকও বটে। নিরন্তর পাঠের ভেতর নিজেকে নবায়ন করতে জানেন তিনি। ফলে তার গ্রন্থও একপাঠে ফুরিয়ে যায় না।তর্কপ্রতর্ক চিন্তানুচিন্তনে, আত্মদর্শন ও জিজ্ঞাসার সমবায়ে চিন্তাবর্গের নতুন দুয়ার খুলে দেন শেলী। এভাবেই তার চিন্তাশীল ভাবনা বিনিময়- চিরকেলে পাঠকের হয়ে ওঠে।

সেলিনা শেলীর কবিতা

 

মৃত্যুযজ্ঞ

 

আমার মাথার খুলিটি রোদে পেতে

বসে আছি। উড়ে যাচ্ছে কুয়াশা-মুক্তির ফাঙ্গাস

বাদামের খোসার মতো ভেঙে

মেলে রেখেছি দেহ। মহা সৌরজাগতিক সভায়

উড়ে যাচ্ছে আমার আয়ুর কণা.............

আর

যারা বিভঙ্গ মনের রেণু ছড়িয়ে

কেঁদে কেঁদে আকুল

তাদের বুকের পাশে চোখের জল ছুঁয়ে

আঁজলায় তুলে ধরি মুখ

বিষন্ন সূর্যের নিচে এরা জমে যাচ্ছে

সড়কগুলো কালো পিচ্ছিল সাপের মতো

আর গাছ গাছালির পাতা

তীব্র তরোবারি চক্চকে .................

মহাকাশ জুড়ে ঝুলে থাকা দড়িতে

দন্ডিত ক’জন

শূন্যতা-হে.................................

উবে যেতে যেতে দেহাতীত বোধের ভেতর

মনে হলো..................................

একদিন আমিও ছিলাম

 

প্রলেতারিয়েতের কান্না

 

শিকাগোর অগ্নিবিন্দুর মতো ছড়িয়ে পড়েছিলে তুমি

সাইবেরিয়া থেকে পেরু আর চিলির প্রান্তরে ।

তোমাকে কুড়িয়ে নিতে চেয়েছিলো এই বাংলাও

ওরা জানতো না-

 জল আর মাটির মিশেলের পরিমিত মাপ

ফলে দুই হাত আর আঙুলের ফাঁক ও ফোঁকরে

 গলে পড়েছ তুমি

মার্ক্স হেগেল লেনিনকে জিগ্যেস করো –

এখনও পরিবর্তিত সময়ের

পরিবর্তিত মাটি ও জলে

শিকাগোর আগুন মেখে তেভাগার রঙে

নাচলের ইলামিত্র জেগে উঠতে পারে-

ইলাকে জাগানোর আগে

তুমি

হে কারিগর তুমি ই জাগো ,...............।।

 

ভোর

সাধু তোমার মুখস্ত জীবনে বিবমিষা জাগে

সীমা লঙ্ঘন করো –ব্যতিক্রমই উপাদেয়

স্বস্বরে কথা বলো ,ধারের মাশুল দেবে ব্যাপ্ত জীবনে?

তোমার লঙ্ঘনে খোলে আমার দুয়ার

অতঃপর তোমাকে লঙ্ঘি আমি ।

আমাকে? নিশ্চয় কেউ ।

খঞ্জরনামা

একপ্রস্থ চুমুর মতো সুস্বাদ জীবন

বারান্দার নির্জন চিবুকের ছায়ায়

গৃহবন্দি হয়ে উঠেছে ।

যে যায় জীবিকালয়ে ,সবুজ বিভায়

তুলে আনে তুমুলআনাজ

সে এক অন্ধকার

একুশ শতকের রক্তেবন্দী

পরাবাস্তব ঘোর .

কী নামে ডাকবো তাকে ?-

খঞ্জরের ভাষা যখন বর্ণভেদকারী !

আমর বিন আস এর রোষে

পুড়ে যায় মেধা

নমিত নদের দেশে শংকরাচার্য যেনো!

তর্ক নয় প্রতর্ক নয় চিন্তানুদিনে

কে কাকে বয়ান করে -কে হয় সঙ্গীন ?

আমিতো পালিত গৃহে

সূর্যস্বরে কথা

যে বলে বলুক ,বাঁচি আপন ঈশ্বরে !

 

ব্রিজঘাটা

 

ব্রিজঘাটার জলের দিকে তাকিয়ে তুমি বলেছিলে

-মৃত্যু এক অনন্ত নদীর নাম

মাছের চকচকে চোখ আর আঁশটে গন্ধময়

 

 সূর্যাস্তের রঙে আঁকা একফালি তরল

তরমুজ বলে কর্ণফুলীকে পান করতে চেয়েছিলে ......।

আজ কাটা তরমুজ থেকে গড়িয়ে পড়া

 লাল বেদনাবিন্দুগুলো হিমায়িত

বুকের ভেতর।

শঠতার চোরাবালি গেঁথে আছে সাম্পাননোঙ্গর

সমুদ্রের নুন ঠোঁটে ডেকে যায়

 ধবল মরাল ।অন্তিম আলোর ভেতর

রিরংসার মেঘ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির মতো

 তুমি আজ ন্যাতানো ইলিশ

পতেঙ্গা ডানেই আছে বামে আজও দেয়াং পাহাড়

তুমি আছো আমি আছি -নেই শুধু আমরা দুজন

তবু

চিতই পিঠার মতো থম ধরা মেঘ উড়ে এলে

সমুদ্রে যেতে বড় সাধ হয়!

 

নিদ্রাকুসুমের আগে

 

ভাতফোটা ভোরে যদি জিলিপি পাহাড় ডাকে

-‘সুপ্রভাত!’

মৃত্যুমগ্নতা ছেড়ে আরও একটি দিন

আমাকে দিও।

খোসা ভেঙে কুসুম ছড়াও-

পাহাড়ে, নিম অন্ধকারে, অন্তরীক্ষে, সকল ইচ্ছামৃত্যুর চোখে।

নিদ্রাকুসুমের গভীর ঘুমে

অচেতন করো না আমায়-

 

এখনও অনেক গান আমাকে করেনি পাঠ,

এখনও অনেক নদী- ভঙ্গিমার কত্থকে, ওড়িশির ভাঁজে

আমাকে ডাকবে বলে

কথা দিয়েছে

 

শুধু মানুষের অনিঃশেষ প্রত্যাখানে

লোকালয় ছেড়ে-

বিশাখা, স্বর্গগঙ্গা, আকাশগঙ্গার আলো খুঁজে খুঁজে 

আরও খানিকটা প্রশ্বাসিত হতে দাও-

হে সকাল, হে আলোদায়িনী

 

এখনও সকাল হলে কাকেরা পাখনা মেলে

আমার জানালায় এসে বসে...

 

পুস্তককাহিনি

 

ছোটবেলায় ভূতগ্রস্ত ছিলাম

তোমার কাব্যগ্রন্থ -ভূত থেকে ভয়ের বার্তা শোনালো

এখন এতো ভয় -ঢেনডেরার আওয়াজের মতো

অস্থির ফাতা ফাতা হয়ে ভয়গ্রস্ত আমার ভালবাসা

ভয়ের অসহায় মার প্যাঁচে -

আর ভালবাসা হোল না .........

না তোমাকে না তোমার কাব্যগ্রন্থ

তবু তুমি চাও তোমাতেই সমর্পিত হই

বহুদীর্ঘ ভোর আমি তোমার সাধনায়

নিমগ্ন থেকেছি

বহু প্রদোষকে তোমার মহিমার কণাখচিত করতে চেয়েছি

তবু ভয় কী ভয়ানক ব্যাধি -

তোমাকে ভালবাসার বদলে কেবল

দূরত্ব যাপন ছাড়া

আর কীইবা করার ছিলো আমার ?

 

ভোর

 

সাধু তোমার মুখস্ত জীবনে বিবমিষা জাগে

সীমা লঙ্ঘন করো –ব্যতিক্রমই উপাদেয়

স্বস্বরে কথা বলো ,ধারের মাশুল দেবে ব্যাপ্ত জীবনে?

তোমার লঙ্ঘনে খোলে আমার দুয়ার

অতঃপর তোমাকে লঙ্ঘি আমি ।

আমাকে? নিশ্চয় কেউ ।

 

খঞ্জরনামা

 

একপ্রস্থ চুমুর মতো সুস্বাদ জীবন

বারান্দার নির্জন চিবুকের ছায়ায়

গৃহবন্দি হয়ে উঠেছে ।

যে যায় জীবিকালয়ে ,সবুজ বিভায়

তুলে আনে তুমুলআনাজ

সে এক অন্ধকার

একুশ শতকের রক্তেবন্দী

পরাবাস্তব ঘোর .

কী নামে ডাকবো তাকে ?-

খঞ্জরের ভাষা যখন বর্ণভেদকারী !

আমার বিন আসের রোষে

পুড়ে যায় মেধা

নমিত নেদের দেশে শংকরাচার্য যেনো!

তর্ক নয় প্রতর্ক নয় চিন্তানুদিনে

কে কাকে বয়ান করে -কে হয় সঙ্গীন ?

আমিতো পালিত গৃহে

সূর্যস্বরে কথা

যে বলে বলুক ,বাঁচি আপন ঈশ্বরে !

 

ঋতুবতী গোপন রোদে পুড়েপুড়েযায়!

 

জোছনা জোয়ারে নদী তার মর্ম খোলে

কত কথাস্মৃতিতারজলে

কিছুকিছু গল্প জানে জল মোহিনী পাখি

পাখিরা নদীর খুব কাছাকাছি হলে

বেজে ওঠে গূঢ় পাখোয়াজ

চাঁদনীতে, গ্রহসন্ধ্যায়, জোয়ারে, ভাটায়

পাখি ও নদীদের রঙ বদলায়-

আড়মোড় ভাঙে, শরীর খোলে, শরীর গুটায়

 

 

বালিকা পয়মন্ত হলে গোপন রোদে

পাখিদের নদীদের কী এসে যায়!

 

চিরকাল বানান ভুল

 

আমার বারান্দা জুড়ে মেঘে - রোদে চুমোচুমি হয়

যে ডাকেগভীর সেও কানেকানে বুনো কথা কয়

কথাই অকথা যদি কথকেরওনা থাকে প্রতিভা

জীবনের যত রঙ, যত স্বাদ- তারও  বিভা

যে জলে নেভে না তাপ, সেই জলই উর্বশীর খাড়–

দুপায়ে জড়িয়ে নিলে জংধরা শরীরও সাঁতারু

বুনোকথাবন্য কথাডাকেঅতিদূর সহবাসে

বানানে অজস্র ভুল - তবু প্রেম চিঠি  হাতে  আসে

 

 

প্রদোষ-প্রত্যুষে দেখো নদী তার মেলিতেছে ডানা

নদীরও যে আছে প্রাণ, সে কথা কি তোমাদের জানা?

 

 

 

নীলস্নান

পাহাড়ের শরীর আজ আত্মলীন সুরভীপ্রদোষ

এ পাহাড় সবুজ নয় -অতীত ছবির মতো

বাদামীসমেত।ওখানে রাইখং নদী

অন্ধকার যাপন করে আদি ঐশ্বর্যে ।

আমিও অন্ধকার হই --লিপিহীন

পাংখো ভাষায়।কোনও বোধ অনুবোধে

উৎকীর্ণবর্ণবিভায় -আমার কান্নাকণা

বেদনাগুচ্ছের ইতিকথা --খোদিত হলো না।

তবু,রাইখং নদী ঘিরে কাচতোয়া জলে

সবুজ অন্ধকারে --পাহাড়ে পাহাড়ে

আদি অস্পৃশ্য বনে অকর্ষিত পৃথিবীর

আদিম প্রান্তরে --নিজেকে খুলে খুলে

শংকরার্কীণ মন মেজে ঘেঁষে

ধুয়ে নিতে বড়ো সাধ হয় !

 

 

দ্বৈতায়নের পথে

 

 দ্বৈতায়নের দ্বিধাসত্ত্বায় কুচকুচি মনমণ্ডল

মরুর তাপাঞ্চল থেকে বেথেলহেমের খড়ের ওমে

আরও বহুদূর হেঁটে বিস্তারিত চোখের কাঁচুলি

খুলে দেখি কৈলাসের প্রাচীনপ্রদোষ 

পাকুড় গাছরে তলে ছায়াপাখি হই

সকল সমীহ ঘিরে–

দ্বিধার অঞ্চল-  প্রশ্নাকুল চিত্তের কাছে

নিজের রঙগুলো, পাখার ভাঁজবিভঙ্গে মুখ বুঁজে রয়।

 

সকল মৃত্যুগাঁথা, স্বর্গনরক কাব্য

লোভপ্রলোভের বয়ান –

ক্লান্তির করতলে একা শুয়ে রয়।

 

তবু যাই

টিকেট কেটেছিলো যারা অনেকেই নেই

তবু যাই –

কাউকে তো যেতেই হয় ভবদর্শনে 

 

মৃতকথামালা

অন্ধকারের ভেতর একটি বাতিজ্বালা জোনাকীপ্রতুল –তোমাকে

নিয়ে অথবা উল্টো করে –আমাকেই নিয়ে তুমি বহু বহু দূর!

আকাশের সৌরশিশুগণ –ভ্রাতা পুত্র জায়া মাতা সকলে জায়মান।

পথই খুলে খুলে রাখ– আরও আরও পথ-

আমার ক্লান্ত পা, ছেঁড়া পাদুকা, বেতসফলের

মতোন ফস্কা সাক্ষী-

এই আলো নির্বাপিত রাত্রিতে তোমার অনুস্মরণ ব্যাতিরেকে

কিছুই ছিলো না জানা। মোহমাদুলীর ঘরো টোপে

না বীর্যবৃত্তান্ত, না স্বপ্নআর্তি–চাওয়া আর পাওয়ার

সরল সমীকরণে –বুদ্ধিজীবী দূরত্বে রেখেছ। কতো কতো

লাল মলাট নীল মলাট অথবা নিষিদ্ধ কালো মলাটের

ঘুমে ললাট যাপন করেছি।আজ বহু বহু দূর হেঁটে

যেখানে থেমেছি–সে এক গোরখোদকের মহাফেজখানা।

 

তোমার গা বেয়ে র্কপুর আর আতরের ঘ্রাণ-

আমাকে আক্রান্ত করার  মুর্হূতইে টের পেলাম

তুমি এক মৃত মাছি, আমার গ্রন্থের ফ্ল্যাপে লেগে আছো

আঠালো-আঁশটে!

 

বধোকাণ্ড

 

তোমাকে দেখে আজ ফণমিনসার কথা মনে পড়ে গেলো।

আলপিন ঠাঁসা কাণ্ডে ও পাতায়-

অবশ্য আলপিন কেবল খোঁচা দেয়, রক্ত ঝরায়

কথাটা ঠিক নয়। বিযুক্তকে যুক্ত করাও তার কাজ।

তবে যুক্তকরণে ছিদ্র প্রক্রিয়ার বেদনা আলপিন বোঝে না,

-সমস্যা এখানেই।

ফণী আর মনসা সংক্রান্ত আখ্যান পর্বের সঙ্গে

এই ঐহিক চিন্তনের সাজুয্যও যার পর নাই বেমানান!

 

তবু, তোমাকে দেখলেই কেনো মনে পড়ে

ফণী ও মনসা!

ফণমিনসা!!  

 

আত্মনিপীড়ন

 

যে অসুখ রেখেছি পুষে

সুখেরচেয়েও দাপুটে তার শ্বাসকণা!

পথে যেতে যেতে পায়ের গীতল গর্তে

নকশা মহিমার নিচে

অযুত আয়ুর বয়ান -

ইচ্ছামৃত্যুর মতো আমাকে পোড়ায়!

শামুকের জামা গায়ে -

নিঃসঙ্গ চলি

বিন্দুর বৃত্তরেখা মুদ্রায়

ক্রমাগত নিজেরদিকেই চলি।

 

 

জিললুর রহমান

চট্টগ্রামে জন্ম, নিবাস, কর্ম। পেশায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষক। আশির দশকের শেষ দিকে থেকে লেখালেখি। লিটল ম্যাগাজিন ‘যদিও উত্তরমেঘ’ এর সম্পাদক, ‘লিরিক’ এর সম্পাদনা পরিষদ সদস্য। উত্তর আধুনিক কাব্যচর্চার পথিকৃৎদের একজন। মূলত লিরিক, নিসর্গ, একবিংশ সহ বিভিন্ন ছোট কাগজে লিখে আসছেন দীর্ঘদিন।

প্রকাশিত বই :

কবিতাঃ

অন্যমন্ত্র [১৯৯৫]

শাদা অন্ধকার [২০১০]

আত্মজার প্রতি [২০১৭]

শতখণ্ড [২০১৭]

ডায়োজিনিসের হারিকেন [২০১৮]

গদ্যঃ 

উত্তর আধুনিকতা : এ সবুজ করুণ ডাঙায় [২০০১]

অমৃত কথা [২০১০]

অনুবাদঃ

আধুনিকোত্তরবাদের নন্দনতত্ত্ব : কয়েকটি অনুবাদ [অনুবাদ, লিরিক, ২০১০]

নাজিম হিকমতের রুবাইয়াৎ [২০১৮]

এমিলি ডিকিনসনের কবিতা [২০১৮]

সম্পাদনা :

যদিও উত্তরমেঘ (২০১৭), লিরিকবুলেটিন (১৯৯৫), তরঙ্গ (১৯৯০, ১৯৯১)

সম্পাদনা পরিষদ সদস্য— ছোট কাগজ- ‘লিরিক’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা, ‘লিরিক’ উত্তর আধুনিক কবিতা সংখ্যা ১,২,৩,৪।

 

জিললুর রহমানের কবিতা  

 

জলপতন

 

এ বেলা হবে না নাওয়া

জলপতনের শব্দে মূর্চ্ছা যাই

 

সাজানো বাসরে কাল-নাগিনীর ফণা

তবু এসো ভাত খেয়ে নিই ভাত

 

খিড়কি দুয়ার নড়বড়ে ঝড়ে কাঁপা ও শিথিল

চেঙমুড়িকানি অট্টহাস্যরত

ডিঙ্গা ডুবে যাক মান যেন থাকে জিতে

 

যে ফণা নামে না তাকে বড় ভয়

কালবৈশাখী তেড়ে আসে বন্দরে

ষড়সন্তান মৃত্যু কবলে ডিঙ্গা বাও মাঝি ডিঙ্গা

(অন্য মন্ত্র/লিরিক, ১৯৯৫)

 

আব্রু

(কবি নির্মল হালদারকে নিবেদিত)

 

সে কার চোখের জল লোহা হয়ে যায় আজ? দুঃশাসন ক্রমাগত টেনে যাচ্ছে দেশমাতৃকার শাড়ি। কে আজ শুনবে তবে ধান ও জলের ধ্বনি, খুঁজে ফিরবে খ্যাপার মতন প্ররশ পাথর?

দরবারে সকলেই ধৃতরাষ্ট্র অথবা গান্ধারী। নির্বাক অমাত্য মাঝে শকুনির কী অদ্ভুত চোখের বিদ্রুপ। স্তব্ধতার অবসরে শুধুমাত্র দ্রৌপদীর স্বরঃ

                “কোথা কৃষ্ণ, রক্ষো আব্রু”

বিংশতি শতকে বুঝি কৃষ্ণ বাড়ায় দয়ার্দ্র সাহায্যের হাত?

 

আমাদের কৃষ্ণ হোক দ্রৌপদীর আপন সন্তান, সকালে সন্ধ্যায় যারা মাটিকে নির্ভর করে। ধান ও জলের ধ্বনি যাদের হৃদয়ে তোলে দোতারার সুর। পরশপাথর তাকে খুঁজতে দাও খ্যাপার মতন।

(অন্য মন্ত্র/লিরিক, ১৯৯৫)

 

 

জালে জটাজালে

 

বহুবিধ রূপকের আমি এক ঝাপসা একক

আমাকে ঘিরেছে নীল ক্যামফ্লেজ, নিজেকে দেখি না নিজে...

 

চারপাশে নিতান্ত ইমেজ শুধু আমাকে জড়িয়ে ডাকে

                        ‘কেবলি প্লাশটিক হও, ফ্যাণ্টাস্টিক হও”

মুখোশে শ্রমণ ঢাকা, হৃদয় মন্দির জুড়ে সিডরিক ভরত নাট্যম ককটেল তৃপ্তি...

 

বোধের বিকল্প বুঝি কৌশল—চাতুরি—রোডম্যাপ

হৃদয়ের উষ্ণতা না, মাপকাঠি আজ সারফেস—টেক্সচার – মুখোশ-মুখোশ

বহুবিধ রূপকের আমি এক ঝাপসা একক

বোধহীন আধা জাগরুক স্বপ্নভূক, জীবনের জালে মোড়া...

 

আহ! আমাকে বেরুতে দাও কুহকের জটাজাল থেকে

(শাদা অন্ধকার/লিরিক, ২০১০)

 

ডায়োজিনিস

(অনুজপ্রতিম কবি মেহেরাব ইফতিকে)

 

আমাকে এমন প্রজাতন্ত্রে কি করে রাখবে প্লেটো

কবি নেই

ভাব ভালোবাসা নেই

 

লোফালুফি চলে আকাশ তারার হাটে

লাশের মসলাপাতি

দুরন্ত বখশিশ

বাজারে কেতা দুরস্ত

ভেতরে হিজরা প্রাণ প্রতিবাদে মূককন্ঠ

 

আজ আমি দিবালোকে হারিকেন জ্বালি

বাজারে বাজারে ঘুরি

কোথায় সে সক্রেটিস

গুরুর যুক্তির ধারা পালটে যায় ভুল মতবাদে

 

নির্বাসন দাও আমাকে এখুনি

(ডায়োজিনিসের হারিকেন/ভিন্নচোখ, ২০১৮)

 

সব নদী গঙ্গা নয়

 

সব নদী গঙ্গা নয় শিবের সান্নিধ্য পাবে

আমারও সান্নিধ্যে এসে ধন্য ছিল হালদা কর্ণফুলী

 

নদীরা সংকীর্ণ হলে চর জাগে, দেবতারা দূরে সরে যায়

নদীর বালুর চরে মাছের পিপাসা মিছে মরে

 

নদীর ঢেউয়ের কাছে আর কোনো প্রশ্ন রেখো না

সে কেবল ছলকে ছলকে যাবে

নদীকে দু'হাত তুলে ডাকো, ফিরেও সে তাকাবে না

সে তার আপন গতিতে ছোটে।

নদীকে মাছের গল্প বলি

মুখ বাঁকিয়ে বলে এ তো সেই মাসীর গল্প মায়েরই নিকট

নদীকে বুকের কাছে ডাকো

হৃদয়ের শব্দ শোনাবে সে ধুকপুক ধুকপুক

সব নদী গঙ্গা নয় হৃদয়ে বন্যা বইয়ে দেবে...

              (ডায়োজিনিসের হারিকেন/ভিন্নচোখ, ২০১৮) 

ঢেঁকি

 

কিছু ঢেঁকি ঘরে থেকে যায়; স্বর্গ দেখে না,

এখনও ভানছে ধান, গাইছে শিবের গীত পার দিয়ে।

গ্রামবধূর হল্লায় শীত নামে

উড়েছে ধানের কুরা,

ভাপের পিঠার সাথে নেমে আসে খেজুরের রস।

 

কিছু ঢেঁকি চ্যালা কাঠ হয়

কিছু তো ঘরের খুঁটি, কেউ জ্বলে চুলোর উনোনে।

আমিও দেখি না স্বর্গ; জ্বলে যাচ্ছি তোমার অনলে;

কখনো বাজারে পুড়ি কখনো আঁস্তাকুড়ে।

 

কিছু ঢেঁকি ঘরে থেকে যায়; সকলেই স্বর্গ দেখে না…

(ডায়োজিনিসের হারিকেন/ভিন্নচোখ, ২০১৮)

ঊর্ধ্বমুখি আপেলের দেশে 

 

হঠাৎ আকাশ কেন এমন হলুদ? ছোপ ছোপ লালের চাদর লেগে আছে গায়ে। বৃক্ষদের দোষ আর কেন দেবে বলো, আপেলেরা ঊর্ধমুখী আজ।

 

যারা অন্যরকম পারে তাদের জন্য নিউটনের সূত্র পালটে যায়। আপেল কাটার ছুরি, কেটে যাচ্ছে প্রেয়সীর বুক, নিটোল চিবুক, কোন সুখে? এমন জগত নেই এলিসের, এমন পৃথিবী নেই কোনো ধর্মগ্রন্থে! এ তবে নিখিল স্বর্গ! না কি কোনো পাপস্য নরক, নিয়ত গুলজার।

 

তোমার কন্ঠার হাঁড়ে উৎকন্ঠা ভেসে ওঠে প্রিয়, আমারও তো ঠোঁটের প্রোবলেম!

(ডায়োজিনিসের হারিকেন/ভিন্নচোখ, ২০১৮)

জীববিদ্যা

 

তারপর বৃক্ষেরা গেড়ে গেল মাটির গভীরে, শেকড়ের দীর্ঘ বাহু প্রসারিত হলো—প্রোথিত হলো গভীর অন্ধকারে, রসের সন্ধানে—ঊর্ধ্বে প্রশাখার মেলে ধরা হাঁ-করা ক্লোরোফিল টেনে নিল বায়ু। বৃক্ষেরা আর কোনোদিন ডিঙি বাইতে পারল না—মাছ ধরতে পারল না—বৃক্ষরা আরো আরো বটবৃক্ষ হয়ে ছায়া ছড়ায়ে দিল পৃথিবীর বুকে।

 

জিরাফেরা পাতার খোঁজে গলা বাড়াতে বাড়াতে একদিন নিজেরাই দীর্ঘকাণ্ড হয়ে গেল। হরিণেরা বিচিত্র বুটির চামড়া নিয়ে দৌড়াল প্রাণভয়ে—স্থিরতার বড় সখ—বৃক্ষের নকল করতে করতে একদিন মাথার উপরে ডালপালা গজিয়ে আরো আরো আকর্ষণীয় করে তুলল নিজেদের।

 

যারা বানরতুল্য—ক্ষুদ্র, হৃদয়ে সবুজ নেই—বাঘের মোষের শক্তি—হরিণের ক্ষিপ্রতা নেই—বৃক্ষের আড়ালে ছুঁড়েছে পাথর—পাথরের অস্ত্র কোনোদিন—কোনোদিন তামাকে লোহাকে চোখা করে হেনেছে আঘাত—গাছ-পশু-জলাধার-ভোরের বাতাস শিথানে শায়িত—একদিন হৃৎপিণ্ড খুঁটে খুঁটে মঙ্গলের কী শনির স্বপ্ন ভেসে আসে…

(ডায়োজিনিসের হারিকেন/ভিন্নচোখ, ২০১৮)

ভুলে যাও

 

ভুলে যাও সেদিনের সেইসব একা – একত্র জীবন

সাধগুলো ঝরনাধারা – হেমন্তের যন্ত্রণার বেশে

শিশিরের ভোর হয়ে ঝরে – ব্যস্ততায়

 

মেয়েগুলো বেড়েছে বয়সে – অথবা সংখ্যায়

এই হুড়োহুড়ি দিনে চড়ুইপাখির হল্লায় মন্দারের ঘ্রাণ

আমাদের বটের ঝুরির ঝুলে-পড়া ল্যাকল্যাকে অবসর

পৃথিবীর – মহাপৃথিবীর বুকে – মিল্কি পথে ধায়

 

কোথাও কেউতো নেই প্রতীক্ষায় – না নবী না জাহ্নবী

(ডায়োজিনিসের হারিকেন/ভিন্নচোখ, ২০১৮)

প্যাটেলার গান

 

সেবার প্যাটেলাটুকু গুড়িগুড়ি হলে

অবসাদে বসে পড়ে হাঁটুর লাটিম

চারিদিকে মানুষের ত্রস্ত চলাফেরা

ভেতরের হাহাকারে এস্রাজের সুর

স্থির, কি নিষ্কম্প তার তারের ব্যঞ্জনা

সমস্ত শরীর জুড়ে প্যাটেলার গান

অর্কেস্ট্রার আর্তনাদ হু হু বেজে চলে

দুমড়ে মুচড়ে জগদ্দল প্যাটেলার হাঁটু

সমস্ত শরীর স্থানু হঠাৎ অথর্ব

তীক্ষ্ণ টোপ মহাজাগতিক শিকারের --

কতো দ্রুতযান শত শব্দদোষ শুধু

আমাদের চারিপাশে ক্রমশ বিস্তারে

ক্রমশ সময় স্রোত টেনে যায় ভূত-

ভবিষ্যতে -- কোষে কোষে তীব্রতর হয়

তীব্র ঘ্রাণ তীব্র তার ব্যগ্র মাদকতা

টোপের হরিণ আজ জনারণ্যে ভীড়ে

মিশে যায় শিকারীর শীতল দৃষ্টিতে

অথবা এমন কোন রক্তস্রোত ধারা

প্রবাহিত শিহরণ ঘর্ম কলেবরে

সমস্ত শরীর জুড়ে প্যাটেলার গান

অর্কেস্ট্রার আর্তনাদ হু হু বেজে চলে

তোমাদের দাঁড়াবার সে-সময় নেই

তোমাদের সামনে শুধু ঝুলে থাকে

অসমাপ্য কর্তব্যের লোভাতুর ঝুলি

চোখে ঠুলি পড়ে থাকে অগ্রগামিতার

সোপান পেরিয়ে চলে মানব জীবন

কেবল আমিই তবে স্রোতের বিপক্ষে

বেমক্কা পড়েছি বসে পথে-- মাঝপথে

নিষ্পলক দৃষ্টিরেখা দূরে স্থিরমণি

হাঁটুভাঙা চলৎশক্তি নিতান্ত রহিত

কেবল ভেতরে গুঞ্জে মর্ম বিদারক

বিষণ্ণ এস্রাজ – সাজ সাজ রব ওঠে

কোথায় চলেছে ছুটে কর্তব্যের গাড়ি

কোন সে স্টেশনে তার থামার ঠিকানা

বিসমিল্লা খাঁর সানাই হঠাৎ ফুকারে

উথাল পাথাল করে সারা দেহমন

সমস্ত শরীর জুড়ে প্যাটেলার গান

অর্কেস্ট্রার আর্তনাদ হু হু বেজে চলে

বসন্ত উধাও ধু ধু — ফের শীতকাল

ফিরে আসে জীবনের সবুজ চত্বরে

তবে সে মীড়ের সাথে সারা পৃথিবীতে

স্রোতের বিপক্ষে থাকা অনড় হাঁটুতে

জীবনের নতুন ব্যঞ্জনা জমে ওঠে

অনন্তর ছোটা ছেড়ে দক্ষিণের দ্বারে

হৃৎ-ক্ষরণের গান আলোর উচ্ছ্বাসে

সমস্ত শরীর জুড়ে প্যাটেলার গান

অর্কেস্ট্রার আর্তনাদ হু হু বেজে চলে

(অগ্রন্থিত)

শতখণ্ড

 

ক্রমাগত ধাক্কা খাই

নিজেরই প্রতিবিম্বে

শতখণ্ড - খণ্ড খণ্ড আত্মার দঙ্গলে 

নিজের ছায়ার সাথে দ্বন্দ্বে সংগ্রামে

আমার আয়নাঘর হে প্রিয় শহর

দৌড়ানোর হাঁপানোর যাঁতা

পীতবর্ণ ধুলা উড়ে ঘরেদোরে

বাগানে অফিসে - আদালতে

হৃৎপিণ্ডের লালে – অলিন্দে নিলয়ে

স্কাইস্ক্র্যাপারের তলে আমার তোমার – যতো

কীট-মানুষের চেহারা চোখের রঙ ম্লান

বিধ্বস্ত বিবর্ণ ঠোঁট

 

টর্নেডো প্রত্যহ ঘটে

প্রতিটি ঘন্টায়

মাথার ভিতরে - মনে 

সিডর নার্গিস ঘূর্ণি

সিনেমা দোকানে, বুকস্টল – ফুটপাতে 

তেলচিটা কাঁথার শীতে

মুড়িভাজা চানাচুর

মদে চুর যারা

আমার মতন সব – শত খণ্ড

প্রতিটি রাস্তায়

মোড়ে

এমনকি শীতাতপ্ত বিছানার ঘোরে

 

আমাদের যৌথ নেই

বাড়িঘর – বিছানা-বালিশ

মলমুত্র ত্যাগের আলয় –শীতলপাটির কোল

কল - জল

উনোনের ফূটন্ত গরম তেল

ঘটি বাটি প্লাস্টিক এলুমিনিয়াম কাঁসা

শিশুমন

উঠোনের তুলসী তলা

মসজিদ মন্দির গির্জা

ঠাকুরের ঘর 

আজান ওঙ্কার

সকলই ধুলির ঝড়ে খণ্ড খণ্ড

আমি দৌড়ে যাই আমার পেছনে

আমি ফিরে আসি আমার ছায়ার কাছে

অর্থহীন

এমনই হবার কথা – এমনই ইঙ্গিত

ডায়োজিনিসের পিঁপের প্রলাপে

হকিং ডুরিং তত্ত্বপথ্যে

 

মোরগের ডাক শুনে একদিন

ভেঙেছিল কুয়াশার ঘুম

একরঙা স্বপ্নের ঘোর

রাঙা হাতখানা ধরবার ঠিক আগেই

দূর-কুকুরের মরা কান্না বেজেছিলো

পাহাড়ের বুকে

তারপর থেকে শুধু জেগে থাকা

দু:স্বপ্নের জাগরণ

কিশোর বেলাটা বলো কেড়ে নিলো কে সে ?

নাই ধান

দুর্বা নাই

চন্দনের ঘ্রাণ সব মায়া সভ্যতার ছাই

চন্দন চরণামৃত বুকে

লোবান বাতির ঘ্রাণ নিষ্প্রাণ নিষ্প্রভ

চিত হয়ে থাকা শীতল শরীর

ভুলেছি সবুজ মানে রেইনট্রি মেহগনি

শাল সেগুনের বন

সবুজ কেবলই বুঝি পতাকার রঙ!

স্বপ্নের সবুজ ছিলো তোমার আঁচল

তোমার শাড়ির পাড়

আমার নদীর – কচুরিপানার – উঠানের 

আকাঙ্ক্ষার বুকের উল্লাস

বেঁকে যাওয়া পিঠ

রোদে পোড়া শ্রমের পৌরুষ পেশী

 

চোখের ভেতরে একদিন

সেই স্বপ্ন তবে

সোনালী বিভায় মেতেছিলো

হলুদ পাখির চোখধাঁধাঁ উঠোন মাতানো রঙ

বিস্তীর্ণ মাঠের সোনা ঝরেছিলো অনন্ত দুপুরে

শায়েস্তা খাঁয়ের সাথে আমিও তো

ঘ্রাণ তার পেয়েছি অনেক

বতুতা-পুত্রের খসখসে হাত ধরে

লাঙ্গলের পিতলের ফলা – হালের বলদ ঠেলে ঠেলে

হিয়েন সাঙের সাথে প্রতি লোকমা-য় ভাতে

পুকুরের পোনা মাছ খেয়েছি সেদিন

তাড়িয়ে ফিরছে দিবাস্বপনের সেই স্মৃতি

সেদিনের গঙ্গাফড়িং টিয়া চড়ুই  বাবুইয়ের ঝাঁক

হালদা নদীর পাড়ে গান ধরে

পোনামাছেদের দল

নুনদাগ ঘষে ঘষে

 

চাষের লাঙল আর

জেলে পাড়া জেগে ওঠে স্মৃতির ভেতর

সেদিনের কন্ঠ আজ

ফ্যাসফ্যাসে ফাঁপাটে বেলুন

কেবল অর্থের নামে

জপে যায় অর্থহীন হাজারো সংলাপ

আমরা সে ইদিপাস

সততই ধ্বংস করি মায়ের সম্ভ্রম

জননীর অনন্ত সবুজ আর

সোনালী যৌবন

আমাদের যতো ক্ষুধা পিপাসার জেদ

প্রকৃতির জানা নেই কিছু

মাথাপিছু সাড়ে তিন হাত

সন্তোষ জাগে না বলে জমি খাই খাল খাই

নদী পুকুরেরা – পাহাড়ের ঢাল – প্রতি সূর্যাস্তে সাবাড় 

আগামীদিনের থেকে তারাদের ভাগ বাটোয়ারা শুরু

খাবারের নতুন তালিকা

প্রতিদিন নতুন রুচির দেখা পাই 

 

সেদিনের যৌথস্বর

একসাথে বাইসন শিকার – নৌকাবাইচ 

ঝলসে নেওয়া পাঁজরের হাড় একসাথে

নগরের পথে পথে – ঘরে 

হাজারটা মানুষের ভিড়ে 

বিষন্ন একাকী ম্লান

ওভেনেই তপ্ত করি শীতল মুরগীর রান – বুক - মেধা

খণ্ডখণ্ড ভাঙা আয়নার খোপে

কেবল নিজের চারপাশে ঘুরপাক

বোকাট্টা ঘুড়ির লেজ

মান্জাহীন কাটা সুতো

লাট খায়

লাট খায়

 

সেদিনের সিকান্দর চেঙ্গিস দেখিনি যদিও

যদিও সে কালিদাস – উজ্জ্বয়িনীপুরে 

বিকেলে হেঁটেছি – কিংবা

শঙ্কাহীন ভোরে

মধ্যদুপুরে

একরোখা দখিনা বাতাসে

রবীন্দ্রের ঘোরে সুরে 

পুকুরের ভরাট গোলায় জীবনের সম্পন্ন আস্বাদ –

তবুও প্রমাদ প্রতি কৃষকের

গুনে যেতে হতো সকালে সন্ধ্যায়

তবুতো চার্বাক বুদ্ধ

তবু সক্রেটিস

চাঁদ সদাগর

আমাদের সাথী ছিলো

সেদিন ভোরের পাখি

বিহারীলালের মতো রাঙা গান গায়

আমাদের সম্মোহন কাল

স্বপ্নদিন ভেঙে দিলো সে কোন মোরগের ডাক

 

অপ্রস্তুত মুহূর্ত সকল

রাজবন্দী পড়ে আছে দারোগার দ্বারে 

হাওর জলের ঘের থেকে মুক্তি পাওয়া মাছ

ডাঙায় কাতর হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে

শ্বাস নেয় - তবু

যাবো না যাবো না হায় বিশুদ্ধ বাতাস তলে

প্রমিথিউসের আগুনে ঝলসে নেবো নিকোটিন শলা

হাঁপালে ইনহেলার - নাকে নল দাও

নেবুলাইজ করো

হায় থিয়োফাইলিন – সালবিউটামল

সুবাতাস সুবাতাস একমুঠো দাও

এখন ধুলায় মত্ত নগরের

মোড়ে মোড়ে তোমার বাজার

মানবাত্মা কাঁচের টুকরোর ফ্রেমে

শতখণ্ডে টুকরো টুকরো

নিজের প্রতিবিম্বের সাথে

ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ছিটকে পড়ি 

ব্ল্যাক হোলে

অনন্ত ইথারে

নীল জলে

(শতখণ্ড/বাঙময়, ২০১৭)

   পুলক পাল

 

কবি পুলক পাল এর জন্ম ৮ অক্টোবর, ১৯৭১। দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া গ্রামের পালপাড়ায়। শৈশব গ্রামে কাটলে ও বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসা প্রশাসনে  (ব্যবস্থাপনা  ) স্নাতকোত্তর।   মূলত ছোটকাগজকর্মী এবং লেখালেখির পরিসরও তাই। ছোটকাগজ “লিরিক” প্রকাশনার সাথে আশির উপান্  ত থেকে যুক্ত। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ “শূন্যপাঠ”, “নিজের সঙ্গে নির্নিমেষ”|

 

পুলক পালের কবিতা

 

শ্যামল হেমব্রম

 

ভেবেছো গুলি মেরে আমাকে শুইয়ে দিলেই

মিশে যাবো মাটিতে  !  ব্যাপারটা  অত সহজ নয়।

শুয়ে শুয়ে তোমাদের দৃষ্টিতে মৃত  আমি

পা টানটান করি। শিরদাঁড়া সোজা করি।

উপুড় হয়ে মাথা সাপের ফণার মতো তুলি।

যদিও আমার পায়ের গোড়ালি, হাঁটুর বাটি,

কোমরের যুগল সন্ধি এবং শিরদাঁড়া

ভগবান সান্তাল করে বানিয়েছেন।

তবুও আমি শুয়েশুয়ে তোমাদের  মত

পায়ের ব্যায়াম করি।

আমার পায়ের পাতা, উরুর পেশীও

কোমরের শক্তি পরীক্ষা করি।

 

ছররাগুলিতে বিদ্ধচোখের  দৃষ্টিতে

পলকহীন তাকিয়ে আছি

তোমাদের এই নিষ্ঠুর রাষ্ট্রের দিকে। 

                    নিথর!

আমি শ্যামল হেমব্রম!

                      ঘরপোড়া সান্তাল !

শুয়ে আছি গাইবান্ধায়।

এই বাগদা ফার্মের জমিতে।

চিনিকলের নিঃশেষিত আখ।

পৈতৃক ভিটা থেকে উচ্ছেদের আগে

তোমাদের এমন রাষ্ট্রের পোঁদে

কষে একটা লাথি মারবো বলে

পূর্ণচাঁদ দেখি আর পায়ের ব্যায়াম করি।

 

        `      

প্রার্থিতপরমায়ু

 

হে প্রার্থনা  ! নিঃশর্ত  আত্ম সমর্পণ আমার

কেমন আতঙ্কগ্রস্ত ও অসহায় আজ

চোখ বন্ধ করে সামনে আনত হতে গিয়ে

কী এক উৎকন্ঠায় পিছনের শব্দস্বরে

উৎকর্ণ হয়ে থাকি সে কী প্রার্থনার মন্দ্র

সমর্পণ নাকি আক্রোশের প্রাণঘাতী কোপ।

 

কে তবে ডাকছে আজ তোমাকে এখানে ?

 

কাতারে দাঁড়ানো ঐ সম্মিলিত মুসুল্লীর দল

নাকি আলখাল্লায় লুকানো ক্রোধ নিয়ে

নূরাণী অবয়বে ঢাকা সহিংস শ্বাপদ।

হে পরমপরোয়ার দিগার ! মহাবিশ্বের   প্রতিপালক

কী আর চাইব আজ এই আতঙ্কে আনত সিজদায় ?

বয়ে যাওয়া অমৃতের নহর ! আয়তলোচনা

বেহেশতি হুরের যোনি ! নধর কান্তির পায়ু !

মানবজন্মের তরে যেটুকু করেছ দান

বিশ্বশান্তির নামে

                      সেই অকিঞ্চিৎকর পরমায়ু !

 

 

আমাদের জলজন্ম

 

তুমি কী সেখানে আসো গুরু

যেখানে যৌবন আসে মেয়েদের

ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ও কামিজে

সালোয়ারের বিস্রস্ত দাগে।

দাড়ি কামানোর শুরু কবে হয়েছিল গুরু?

গুরুতর স্খলনের আগে নাকি পরে

এইসব লঘু বাক্যের গুরুচিন্তামনি

পদ্ম পুকুরের জলে টাল খায়

প্রস্ফুটিত পদ্ম কোরকে

স্বফণা সাপের নাচ দেখিবার অভিলাষে

হাত গেল পদ্মনাভিমূলে

তুমি কী তথায় আসো গুরু

যেখানে তথাগত গুপ্তচক্র ভুলে

জলের মসুল হয়ে পদ্মাপুরাণ থেকে নেমে

বয়ে যায় নদীর প্রমত্ততায়

আমাদের জল জন্মের  যৌবনে।

 

নিদাঘ আশ্বিন

 

তবে তুমি মেঘ! ঝরবে বৃষ্টি হলে?

জমেছো মেদুর এই নিদাঘ আশ্বিনে

পেরিয়ে প্রচল কাশরূপ

শরত আকাশে তাই তোমার শাদার পানে  চাই

যার রঙ নানাবিধ নিয়ত ছটায়

আর শাদা নাই।

সেখানে কিছুটা নীল আঁচড় কেটেছে

বেদনা ব্যঞ্জনে তোমার দিকেই

খটখটে চোখ মেলে রাখি

প্রবল এ আশ্বিনে

মেঘলোক ছেড়ে তোমার ঝরার অপেক্ষায়

স্নান বাসনার দিনে।

 

ও চিরচলিষ্ণুমেঘ

 

শুভ্র মেঘের কাফনে চড়ে কোথায় চলেছ একাকী  নীল ।

চিৎপাত হয়ে পড়ে আছি একা জলহীন এক বিরান বিল।

কোথা থেকে এলো এই শূন্যতাকোন শূন্যে যে মিলাবো ছাই।

ভেবে ভেবে শুধুদিন ও রাতে  তার কোনো আর দিশা না পাই।

চারিদিকে সব সমবেত আছে ভূমি জল নদী হাওয়া যে এই।

ভাবি শুধু তাই কেন আমি একা হারিয়ে সকল ভাবনার খেই। 

নীল মেঘ তুমি শুভ্র বসনা বল না তোমার কীসের তাড়না।

 নিরন্তর এই একা উড়ে উড়ে কোন শূন্যের বিলয় ভাবনা।

আমারও কী তবে বিলয়েই হবে এ শূন্যতার পরমা দিন ।

ঘুচবে সকল মাহেন্দ্রক্ষণ একাকীত্বের সকল ঋণ ।

 

ভেলোরের আকাশে চিল

 

শেষ জুনের আকাশ এখানে

এতটাই সুনীল মায়াময় আর হাওয়া

নিজেকে কেমন চিল চিল লাগে

আর চারপাশে তামিল আবহাওয়া ।

 

চিল সম্পর্কে আমার ধারণা অপ্রতুল

কেমন ভূমি থেকে অনেক উপরে কেন সে

সুনীল আকাশের নীচে ডানার শক্তি মেলে

ঘন রোদের ভিতর নির্বিকার উড়ে আর ঘুরে ।

 

সে কী পাখি না পর্যবেক্ষক! কে জানে ?

 

অদূরে পাহাড়গুলো সবুজ বনানী মেলে

আকাশের পানে আছে চেয়ে কিসের আশায়

চিল কী তবে  ঐ নীলিমা ও সবুজের

সুদূর আকাঙ্ক্ষার মাঝে প্রণয়ের দূত।

 

হে স্যানাটোরিয়াম, আরোগ্যশালা আমার

ক্যাথেটার বয়ে বেড়াতে বেড়াতেও কেন

বারান্দায় এলে সুনীল আকাশ দেখে

নিজেকে এমন চিল চিল মনে হয়!

 

বাণপ্রস্থ

 

নাই এর এই সংসার ছেড়ে

চলো পালাই যেখানে সংসার নাই।

দৈনন্দিনতার ফর্দ চাহিদার বিধি ভেঙে

যোগান রেখার মুখ হারিয়ে ফেলেছে

যেখানে সকল থাকার সুখ

অসুখের পরমায়ু নিয়ে পেতেছে

অন্তিম শয্যা।

বস্তুগত এই নাই এর নৈরাজ্যে

আমাদের প্রীতিময় দিন

আর সম্প্রীতির আশাগুলোও

                          দূরপরাহত।

প্রেমের পরম বিদ্যা প্রেমিক পুরুষ

শিখে নিচ্ছে বাণিজ্যিক চাতুরীর কাছে

তাই চলো সমাজ সংসার ছেড়ে যাই

যেদিকে দু’চোখ যায়

ধর্ম বর্ণ ও জাতির বিভক্তি পেরিয়ে

এইসব জাতিরাষ্ট্রের সীমানা মাড়িয়ে

গ্লোবালাইজেশন এর দিকে! সে তো রূপকথা

পুঁজির রূপে উদ্ভাসিত ততোধিক ঢেকে রাখা

বীভৎস ঘা !! কোথা তবে যাবো বলো ?

এই যাত্রা বাণপ্রস্থে অসীমের পানে !!