অলস দুপুর অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন : পর্ব ০৫

 অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন : পর্ব ০৫

সাইটে প্রবেশের জন্য আপনাকে স্বাগতম। এটি অলস দুপুর ওয়েবম্যাগের একটি অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন। এই সংকলনে বাংলাদেশ ও ভারতের নানা প্রান্তে যারা দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্য চর্চা করে চলেছেন, লিটলম্যাগ চর্চা করে চলেছেন, তাদেরকে বিশেষ ভাবে স্থান দেয়া হচ্ছে। আমরা জানি  যে পুঁজিবাদের বিকাশের প্রক্রিয়াটিই এমন যে ইটের নিচে সবুজ ঘাস চাপা পড়ে যায়।  আমরা প্রশান্তির জন্য দিগন্তের দিকেই তাকিয়ে থাকি।

অলস দুপুর সেইসব কবিদেরই খুঁজে চলেছেন। যারা নিরবে কাজ করে যাচ্ছেন, কোন এক দূরে বসে লিটলম্যাগ চর্চা করে চলেছেন বছরের পর বছর। সন্ধ্যায় জোনাকির মত তার চোখও জ্বলে ওঠে নতুন কবিতায়।  সেই সব নতুন কবিতাকে খুঁজে চলেছে অলস দুপুর।

অনলাইন কোন স্থান নয়। ইন্টারনেট মানে বিশ্বের যে কোন প্রান্তের সাথে যুক্ত আপনি আমি। এখন আমি আপনি বিশ্বের যে কোন প্রান্তের কবিতার সাথেও যুক্ত। কিন্তু প্রান্ত তো আছে। যে এসে মিলিত হয় মুক্তির সাথে। অলস দুপুরের কাছে জেলা হচ্ছে এক একটি প্রান্ত, যে যুক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত শুধু বাংলাদেশ নয়, বাংলা কবিতা নয়, বিশ্ব কবিতার সাথে। আমরা অলস দুপুরে বাংলাদেশ ও ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কবিদের কবিতা এই আয়োজনের মাধ্যমে পাঠকদের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি।

সংকলন পদ্ধতি: একজন মূল সম্পাদক থাকেন। মূল সম্পাদক থাকবেন দুপুর মিত্র।  বিভিন্ন জেলা থেকে একজন অতিথি সম্পাদক নির্বাচিত করেন। অতিথি সম্পাদক তার জেলা থেকে কবি নির্বাচিত করেন এবং তাদের কাছ থেকে কবিতা সংগ্রহ করে মূল সম্পাদকের নিকট প্রেরণ করেন। প্রতিটি পোস্ট এক একটি জেলা বা প্রান্তের সংকলন হিসেবে গণ্য হবে। যিনি অতিথি সম্পাদক থাকবেন তার সম্পাদনা নিয়ে একটি ছোট সম্পাদকীয় থাকবে। এভাবে ছোট ছোট সংকলন মিলে একটি বড় সংকলন হবে। 

যাদের কবিতা সংকলিত হবে

১. দীর্ঘদিন ধরে লিটলম্যাগে জড়িত

২. বিভিন্নজেলায় বসবাসরত

৩. সাহিত্যচর্চায় নিয়মিত

সংকলনটি চূড়ান্ত নয়। বিভিন্ন সময় এটি আপডেট হবে। সংকলনটি সমৃদ্ধ করতে পাঠকের প্রস্তাবনা ও মন্তব্যকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। প্রস্তাবনা বা মন্তব্য জানান mitra_bibhuti@yahoo.com এ।

 

অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন: ০৫ পর্বের অতিথি সম্পাদক কবি রিমঝিম আহমেদ । তিনি কবিতা সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে ‘অলস দুপুর’ ওয়েব ম্যাগাজিনকে সহায়তা করেছেন। তার প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা।

 

  রিমঝিম আহমেদের সম্পাদকীয়

 

কবিতা এক দোলাচল চেতন বা অবচেতনের। নিত্যকার যাপন থেকে নিঙড়ে নেয়া রস, ভাব ছুঁয়ে ছুঁয়ে কেমন করে জানি কবিতা হয়ে ওঠে কবিও হয়তো জানেন না। তবুও লেখেন অপার রহস্য নিয়ে আমাদের চেতনায় ঢিল ছুঁড়ে দেয় বোধ। কেন লিখতে হবে, কেনইবা না লিখে পারা যায় না এ-ও এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন কবির চোখের সামনে নিয়ত দুলছে। সমসাময়িক অনেকেই লিখছেন চট্টগ্রামে বসে। কিন্তু সাহিত্যের তো কোন বিশেষ এলাকা থাকতে নেই। কোন বিশেষ গণ্ডিকে ছাপিয়ে প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়াই তার সহজাত ব্যাপার। ব্যাপকতা থেকে আরও ব্যাপকতর হওয়ার অভিমুখে সাহিত্যের নিত্য পদস্খলন। সমসাময়িক ১০ জনের কাছে লেখা চেয়েছিলাম। অনেকেই সাড়া দিয়েছেন, কেউ কেউ পাত্তা দেননি তেমন। তাদের কবিতারও জয় হোক। এখানে যাদের কবিতা আছে, তারা প্রত্যেকেই নিজের ভাষাটিকে রপ্ত করতে বদ্ধ পরিকর। যে যার স্বরে বলতে চায়ছে নৈর্ব্যক্তিক কাব্যভাষা। পাঠক মাত্রই তা অনুধাবন করবেন। কেন না, কবিতা তো কোন একক বিন্দুতে মিলবার বস্তু নয়, কবিতা অদম্য, চির-গোঁয়ার সে তার নিজস্ব রেখা টেনে পেরিয়ে যায় সমস্ত মৌলিকতা আরও একান্ত মৌলিক হতে চেয়ে। কবি ও কবিতার জয় হোক।

 

 

রোমেনা আফরোজ

জন্ম: ২৯ নভেম্বর ১৯৭৯, আষাঢ়িয়া বাড়ি, কালিয়াকৈর, গাজীপুর।

কাব্য: হরিণ কাঠের নৌকা [ঘাসফুল, ২০১৪]

রোমেনা আফরোজের কবিতা

অসমাপ্ত গল্প

সেদিন চুপিচুপি লুকালে কামিনী বনে! এই ভঙ্গিমা আমার পরিচিত। রুপোর সিঁড়ি। ধাপে ধাপে ফেলে যাচ্ছ পদচ্ছায়া। আর একটু পেছনে আটপৌরে আলোচনা। যতই লুকাও স্ফুলিঙ্গ জ্বলছে পার্বত্য অঞ্চল । জেলখানায় বন্দী যোদ্ধাদল।  তারাও জানে এ দৃষ্টি! বিলাইছড়ি মাঠ। ইস্পাতনির্মিত হৃদয়। হরিণ মাংসের চপ। এই গন্ধে জেগে থাকে মাছ। মীনপাখি, এমনভাবে তাকিয়ে আছ ঘামের দিকে যেন মুক্তা! এসব মদ, সোনার টুকরো রেখে কারা ঘুমায়? তুমি কবি। মৃত্যুর দিকে মুখ রেখে তোমার যাবতীয় ঘুম। অন্ধকার উস্কে রেখে জ্বলে সন্ধ্যাপাথর। ধর্মতলা থেকে ঘুরে গেলে  অথচ দুধ চায়ের সাথে অসমাপ্ত  গল্পের কোন সুন্দর সুরাহা হল না। 

এমন ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর!

অথচ সমান্তরাল কোন পথ নেই তোমার কাছে যাবার। ঘুরপথে গেলে প্রপিতামহ। মুনি ঋষি। আমি একজনকেও চিনি না। আহারের বিনিময়ে  অন্য কোন প্রয়োজনের কথা যারা বলে তারা কোনও সাধু ব্যক্তি নয়।  এমন রৌদ্রদিনে বাঘের গল্প শুনতে বেশ লাগে। 

অণু, একদিন অন্ধকারে তোমার ছায়া নিয়ে পালিয়ে যাব সংসার থেকে

তখন ছুঁয়ে দেখ না বয়স। ভোরের কাছে বল না, প্রতারক। 

ফল ছাড়াও বৃক্ষের থাকে পাতা। শেকড়। ফুল--আমি কোন সবুজ নেব না। 

ধর্মান্তরিত ফলগুলির ভেতর জমছে কুয়াশা। দেখ,  ইহুদি পাখিরা আকাশটাকে দখল করে নিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমে। কাবাঘর ঘিরে আছে কালপুরুষ।  এই সব উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা সত্ত্বেও এক একদিন  মাংস পরোটার খিদে জাগিয়ে রাখে সারারাত। 

 

স্বরূপ সুপান্থ

জন্মস্থানঃ বড়ঘোপ বাজার, কুতুবদিয়া

জন্ম সালঃ ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৩৮৮ বঙ্গাব্দ

বর্তমান বাসঃ চট্টগ্রাম শহর

শিক্ষাঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিদ্যায় সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং মানবসম্পদ      উন্নয়নে এম.বি.এ।

পেশাঃ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত

প্রকাশিত বইঃ জলকামানের বই (কবিতা) প্রকাশকঃ বাতিঘর

ফোনঃ ০১৭১৯৩৫২৬৭৩

ইমেলঃ ssupantha81@yahoo.com

 

 স্বরূপ সুপান্থের কবিতা

 

শিকদার

 

এক.

সমস্ত প্রতিভার ভেতর কিছু আলোবিন্দু কেঁপে যায়। যা প্রতিবাদ ও জলসিঞ্চনের মত ব্যাপারগুলায় রেখা টেনে দেয়। কেন যে বাতাসের অনন্য প্রবণতা নিয়ে কথা বলি! তা মিশ্র অনুভূতির সন্ধান দেয়—বলে, বিষাদরেখা পেরোলেই নতুন ভূমি—আনুপূর্বিক স্মৃতি ও বিস্বাদ ভুলে, নতুন জগতে স্বাগতম

 

আকাশে তারার সংকলন, অনন্য ভিত্তির উচ্চারণ, সোজা শিবের ন্যায় মাথায় ধারণ করেন যেন জটা। আমাদের কে ছাড়াবে, একই আকাশের তলে—মায়াময় সভ্যতার উত্থানে সংস্কৃতির নতুন নির্মাণে। দেশ স্বল্পধারণা মাত্র, দর্শন গভীরতর ও বিবিধের

 

মুখ থেকে খুলে ফেলি মুখোশ, আবেগ রয়ে যায়, সবুজের ধাক্কায় ধাক্কায় লাঙল এসে যায়, গরু খেয়ে ফেলে বিরহের নালি ঘাস। আমরাও ঠিকঠাক লিখছি তো গল্প, সঠিকবেঠিক? তাহলে কে ছিল কার আগে, কখন শুরু হলো, মানুষের পায়ের ছাপ কি ঈশ্বর ধারণা থেকে প্রাচীন নাকি সত্য থেকে!

 

সবুজের নির্বিঘ্ন যাতায়াত, এই-ই ছিল, নিশ্চিত। যেন সম্পর্কের মিছিলে সমর্থ যুবতীর নিরপেক্ষ অংশগ্রহণ। কি বলা যেতে পারে একে—ভূমির উর্বর কর্ষণ? মহাজাগতিক ভিটায় কে কে আছে, সভ্যতা কি শাদা পৃষ্টা যেমন ইচ্ছে লেখার... আয় আয়ুমতি অলমতি বিস্তারেণ...

 

দুই.

আবেগের খোসায় পা কেটে যায়, রক্তে ডুবে যায় মাটি, আমাদের শিকারের হাত, আমাদের ফসলের হাত, আমাদের জোড়লাগানো ভাষা, উচ্চারণ মাত্র হয়ে যায়। আমরা অস্ফূট শব্দ, যে কোন কাজহীন সময়ে ছবি আঁকি। কে খুঁজেছে পাহাড়ের গায়ে এসব ছবি, সন্দেহ জাগে। গুহা কি অক্ষতই থেকেছে—সত্য মিথ্যা থাক, সে অন্য পৃষ্টার। মানুষ যতটা জানে তারও অধিক কি সে জানতে পারে!

 

আমাদের ইচ্ছেভ্রমণ, ধৈর্য্যের সীমানাজুড়ে ঘোড়ার দৌড়, যেনবা ইচ্ছের অদূরে ঘুরে যাচ্ছে খুরের আওয়াজ। তার আগে পায়ে হেঁটে মানুষ কি পরিহার করেছে অঞ্চল-দূরত্ব! যেন পদচ্ছাপের অনুভূতি ধরতে জানে মাটি—কত কত কোটি হেঁটে গেল পা, তবু সমান মমতায় কিভাবে যে প্রশ্রয় পেল এত পা!

 

অপরিচ্ছন্ন আলোয় ভোর এলো,

দেখার-ইন্দ্রধনুকে দিনগুলি

রাত্রি-চিৎকার পেরিয়ে শরবিদ্ধ

 

জলরস জিকির করছে মাটির তলায়! নাচলোভী নারীর মতন ধুন্ধুমার তার পায়ের চলন। খাইবার গিরিপথ দিয়ে কারা আসছেন বা যাচ্ছেন? পথের গাছতলায় একটু জিরালে কি মনে পড়বে শেকড়ের টান? ঘোড়সওয়ার, ও ঘোড়সওয়ার নিজের বাচ্চাটির ডাক কি শুনতে পান অথবা ফেলে আসা সংগিনীর বুকের কাঁপন? কোথাও যাওয়াটা বহুমাত্রিক রঙিন, কিন্তু ফেরাটা নিতান্তই মর্মর! বিদ্যুতলতা নুয়ে নুয়ে পথের ইতিহাস লিখে যায়।

 

তিন.

সমস্ত প্রতিভার বন্য বিকাশে নটে গাছটি মুড়োলো। শুরু হলো সময় হর্তাকর্তার বিধানের। পুঞ্জিভূত ফসলের বিস্ফোরিত চোখ যেন রাঙাতে শুরু করেছে, এমনভাবে যে, সংগোপন যত মেসেজ আত্মার ভেতরে থাকে তা ফসলের মধ্য দিয়েই বেরিয়ে আসছে। সেই ফসল যথাপ্রস্তুতির আবিষ্ট শরীর লক্ষণের, যেন দীর্ঘ ভ্রমন শেষে একটি ফসলবীজ আত্মার সংগী হয়েই বেঁচে থাকে।

 

কৌম-সংগি ভাইবেরাদরেরা, ফসল কি নিত্য সংগীতই গায়! কত যুগ কত হাজার বছর ক্ষুধার নিবৃত্তি সে ঘটাচ্ছে। অথচ সেই, শুরু করেছিল যে প্রথম চাষ তার টিকিটিও খুঁজে পাইনি কখনই। তবুও কি থেমে গেছে কাল, ফসলের বিকাশ, উৎপাদন কৌশল? বলা চলে, মানব ইতিহাসে প্রথম বেদম মাইরের শুরু ফসলের ভাগাভাগি কেন্দ্র করেই

 

কিছু চিৎকার শোনা যায়, তা সঙ্ঘবধ হলে আরও বড়চিৎকার, আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে গোত্র থেকে গোত্রে, অঞ্চল ছাড়িয়ে অঞ্চলে। মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞান যেন শুরু হল, সে হিস্যা বুঝে নিতে চাইল। সে নিজেই হতে চাইল ফসল, ভাগবিভাজন। ক্রমবিচ্ছিন্নতার উদ্বৃত্ত ফসলের যুগে মানুষের নতুন প্রবেশ...

 

কোন এক ব্যাকুল সময়ে কী যে ঘটে গেল, সৃষ্টির কোনও অনবদ্য ফাঁকফোকরেই মনে হয় এসব ঘটে যায়, তার হালহকিকত হদিস মানুষ কত আর রেখেছে—পাথরে পাথরে আগুন, পাথরের তৈরি শিকারের অস্ত্র। মানুষ যেদিন প্রথম গুহা থেকে বেরুলো রাত কাটানোর জন্য কী ঘটেছিল সেদিন  মহাজগতে! ছায়া ও বিভ্রমের জ্বালা কি জুড়াতে পেরেছিল? এবং চিত হয়ে শুয়ে ঝমঝম নিশুতিতে তারাপূর্ণ আকাশের দিকে তাকিয়ে সৃষ্টির গভীর গোপন গহ্বরে সাঁতরে কোনও কূলে কি উঠতে পেরেছিল

 

মুগ্ধ, মুগ্ধ হতে হয়। মুগ্ধ হতে প্রেম। প্রেম থেকে ভালবাসার উদগীরন হলে সৃষ্টি সম্পন্ন হয়। মানুষের সৃষ্টিশীল সম্পর্ক! কী যে তারানা হচ্ছে

 

দীর্ঘ নাঙ্গা ভুখা স্বপ্নের শুরু

নাদান পেট প্রত্যাশামাফিক খাবারই খোঁজে

বাকি সব আত্মার বিতল গান

 

ক্ষুধা নিবৃত্তির যুগ থেকে উদ্বৃত্ত খাদ্যের মজুত পর্যন্ত, আত্মার ভেতরে অবিরাম কী যে খেলে গেল!

 

চার.

সুমহান সেই ভূখন্ডে আছি, যেখানে শুরু, যেখানে জীবন প্রবহমান। স্তব্দ চেহারার, অতিপ্রাকৃত, সীমানা কতদূর! ভিসা-পাসপোর্ট নাই, প্রহরীও নাই, তোমারে আটকায় কে—দূর্গম পথ নাকি ভীত মানসিকতা? মানুষের ছড়িয়ে পড়া আশ্চর্যের কিছু নয়, মানুষের স্থানান্তরনেও অবাক হওয়ার মত কোন ব্যাপার নাই

 

জলসীমানা ধরে হেঁটে যেতে যেতে অদ্ভূত খেয়ালের বশে স্বচ্ছজলে নিজের চেহারা দেখে কে চমকে উঠেছিল, সে কি অন্যদেরও ডেকেছিল, চেহারার ভেরিয়েশন, গঠন-আকৃতির সুসমঞ্জস ঐক্য সে একা একা খুঁজেছিল? স্বরস্বতী সরযূ’র কিনারে বসে দিগন্তে তাকিয়ে হয়ত ভেবেছিল—ভাবার আছে অনেককিছু!

 

কোন দূর্মর আখ্যানে লেখা হবে না কত কিছুই। কত প্রাণ, কত অনুপ্রাস, কত শব্দ, লিপি, হরফ, গাছগাছালি, কত প্রেম, কত ধ্বংসলীলা তান্ডব, দূর্গ, গোত্র, কত ভূখন্ড তলিয়ে গেল জলের অতলে, কত মদ, কতপ্রকার যে খাদ্য, কুশল বিনিময়, চিন্তারাশি, কত ঘর, কত কত সভ্যতা দুরমুশ করা হয়ে গেল, যতটা হয় তার কতটা লেখা যায়?

 

সাগরের বিচিত্র জলরাশির সামনে বসে মানুষ কি ভেবেছিল, একদিন সাগরও পাড়ি দিতে হবে! অতুল জলের সম্মুখে, ঘনসন্নিবিষ্ঠ জংগলের ভেতরে, প্রকৃত খাদ্যের সন্ধানে বেরিয়ে মানুষ শক্তির ধারণা নিয়েছে, এবং সে শক্তি সাধনার গোলাম থেকেছে আবহমানকাল

 

দেবতারে ডাকি, ফলমূল ও ব্যঞ্জন

যতটা পারি সাজায়ে রাখি

কেন জানিনা ভাবনার মধ্যে আসেনা

দেবতা ক্যানে মাংস খায়না

 

পাঁচ.

গ্রন্থই কি ধরে রাখে সমস্ত জ্ঞান—যা লেখা ছিল বেদে, আবেস্তায়, ওল্ড টেস্টামেন্টে! হাঁটাচলার পরিসরে কত জ্ঞান, ভাবনাচিন্তা বাতাসে বাতাসে উড়ে গেল। মরুপথের বালি মানুষের পদচ্ছাপ যত দ্রুত ঢেকে দেয়, চিন্তার ভিন্নতাও কি তত দ্রুতই উসকে দেয়? ঘুরেফিরে একই ভূমিতে বারবার, গ্রহন-পরিধি মাত্রা ছাড়িয়ে সেই একই চিন্তা বারবার তাজা-নতুন স্বাদ নিয়ে মানুষ নতুন হতে চেয়েছে প্রতিবার

 

সম্মিলিত চিন্তার সংকলন করেছে কে, নাম জানি তাঁর! ঘিলু থেকে ঘিলু, স্মৃতি থেকে স্মৃতি, মুখ থেকে মুখে। হেমন্তের শিশিরের মত ঘাম জমে মনে, দেহাতীত ঐশ্বর্যের মত লিখে গেল কারা, অতি ধীরে? সে-ভাষার গুপ্ত তর্জমায় বসে কোনও পাখি নিয়েছিল বীজ, সংরক্ষণহেতু? মর্মোদ্বার কে করল? প্রশ্নের দুয়ারে দাঁড়িয়ে উত্তরকে বের হতে দেখা যায়না

 

ভগ্ অঙ্কুর হতেই থাকে

চলমান কৌশলের সাথে পাল্লা দিয়ে

যা কিছু লীন তা-ই সঙ্গম

 

শান্তি, স্বস্তি, সমর্পন—ঈশ্বরের ফাঁদে মানুষের বিচরণ! ধীরে ধীরে একটি একটি করে পালক জমতে জমতে যেভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠল তূণ, ধনুকের একটানে এক তিরে তা যে ছুটে গেল সম্মুখ-সমরে... ঐশ্বরিক সমাধানে মানুষ মেতেছে নিজের কংকালের সাথেই কথোপকথনে।

 

ছয়.

ভাষা কি হারিয়ে যায় গণিকার মত, জগতকে ফোঁড়-এফোঁড় সেলাই করে! মানুষের অন্বেষা তীব্র তাপিত হিংস্র সিংহের মত, নিজের অরণ্যে যে সে একমাত্র শেঠ। তবু ভাষা উদয়ের কালে যৌথ ভারাবনত সম্পর্কের সমৃদ্ধি রক্ষা করেছে সে। পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠেছে ভাষাগাছ, অক্ষর শব্দের হাজারো লাখো পাতা নিয়ে

 

কোন বই হাঁক ছেড়েছিল প্রথম ভাষার দুয়ারে দাঁড়িয়ে? সে ঘরের ভেতর রংহীন বাতাস চিরায়ত ভঙি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, শাদা পাখার রঙে ডুবে অবগাহন করে আলো, কোন সে মনীষী বসেন সেই ঘরে, খেলা খেলেন ভাষার সাথে, প্রথম অক্ষর বসান ভূর্জপত্রে নতুবা দেয়ালগাত্রে! তাঁর প্রেমে পড়ি, প্রখর সান্নিধ্য পেতে চেয়ে অতীত হয়ে

 

তা কি বিষ্ময়ের উদ্রেক করেনা, কথার জাহাজে চড়ে ভাষা ঘুরছে লক্ষ বছর! আমাদের মেছো-প্রকৃতির নদে ক্রমাগত এক আত্মখুন, নিমরাজির মত ভেসে চলেছে, গুম হতে হতে, শব্দ হারিয়ে যেতে যেতে। মানুষের কথা বলা, শব্দগঠন, তাঁর নিজের আত্ম-আবিষ্কারের মতই তুঙ্গ ও গভীর।

 

আত্ম-ঢেউ সমুদ্রের মধ্যে খেলে যায়,

বাতাস অনন্য পাশ কাটিয়ে ঢেউকে

যতই খেলাক বালুচরে, আছড়ে তা

মিলেমিশে যায় আবার সে-সমুদ্রেই

ফুয়াদ হাসান

 

জন্ম: ২ নভেম্বর ১৯৭৯ সাল;ধূরুং,বিবিরহাট,ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।নপ্রকাশিত গ্রন্থ : মানুষ মানুষ নয় হোমোসেপিয়ানস (২০০৪), রাফখাতার কাটাকুটি (২০১০), অ্যা জার্নি বাই অ্যাম্বুলেন্স (২০১৮) ।  

 

ফুয়াদ হাসানের কবিতা

 

রাতভর কুকুরের কান্না 

সপ্তাহব্যাপী আগুন জ্বলবে না ঘরে

চারমাস ঘর থেকে বের হবে না ঘরনি

তিনদিন শোক পালন করবে আত্মীয়রা

চল্লিশা না হওয়া পর্যন্ত বিপদ

ঘোরা-ফেরা করবে সন্তানদের মাঝে 

বছরখানেক জমরাজ পাহারা দেবে বাড়ি

 

রাতভর কুকুরের কান্নাও থেমে যাবে একসময়

 

 

হিবাকুশা 

 

আকাশকে দেখি বিষে আর কতটুকু নীল হয়,

অশ্রুসজল মহাসাগরও কী লবণময়? 

শত স্খলনে উকি দিক দূরে রাত্রির ঊষা 

মারতে পারবে না -- চেষ্টা কর, আমি হিবাকুশা 

 

বড় ভুল ভাব, ভেবে ফেল যদি -- ভীষণ ছাপোষা

অামাকে মারতে পারবে না কেউ, আমি হিবাকুশা

এ উপত্যকা জমে-জমে আজ কত রক্তিম

মৃত্যুপুরীতে বেঁচে থাকাটাই দুরাচার, ভীম

 

খামোকা হারানো জীবাশ্ম ভাব দেখে বেশভূষা 

আমাকে মারতে পারবে না তুমি, আমি হিবাকুশা

 

 

প তে ঙ্গা   ম হি লা   ক লে জ 

 

দোয়েলের কণ্ঠ কে নকল করতে পারো

কুড়িটি দেশের ডাকটিকিট কার আছে

এক ডুবে তুলে এনেছ শালুক, মাছ

বল কাঁঠালচাঁপা কেমন রঙের ফুল

কার ফ্রেন্ড লিস্টে মিস বনলতা সেন

 

ওরা এগুলোকে সৃজনশীল উদ্দীপক

ভেবে গোপন খাতায় নোট করে নেয়

  

ক্লাসে সবচেয়ে 

অমনোযোগী 

ছাত্রীটি, বাইরে 

তাকিয়ে থাকে 

যে সারাক্ষণ,

ঐ শালিকদের

 আড্ডায় মন

 বেঞ্চিতে মাথা

 নামিয়ে রাখে

ম্যাসেঞ্জারেই

ব্যস্ত থাকছে

মুহূর্তক্ষণ 

যে কথা বলে 

চোখে ভারিক্কি

চশমায় যাকে

কী হাবাগোবা 

মনে হয়েছে

 

সেও আমার

 এসব বুঝে 

ফেলে, এমন 

ভোজবাজিতেও

পুলকিত না  

তোমাদেরও আগে অনেকে এমন ক্লাস পালিয়ে নীরব মুখোমুখি বসে ছিল রেস্তোরাঁয়, কম বয়েসী হাসৌজ্জ্বল বয়টি বারবার কী খেতে চাই জিজ্ঞেস করছিল, বৃষ্টিতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পালা করে খেয়েছে নারকেল-আইসক্রিম, রিকশায় দুজন মিলে ঘুরেছে সারা শহর, পকেটে গোপন দুপুরে লেখা কবিতার ঢঙে অসমাপ্ত চিঠি -- দেয়া হয়নি, সারারাত ফোনে চুপিসারে কথা বলেছে, "আসবে তো, কাল দেখা হবে?" তোমাদেরও আগে এমন অনেকেই ঘর পালিয়ে সংসার গড়েছে, গৌর অনামিকায় গুজে দিয়েছে ঘাসফুলরিং, হারিয়ে ফেলেছে ধ্রুবতারার মত ধ্রুপদী সেই নাকচাবি, অথবা, বিরহী আবেগে চোখ মুছে চলে গেছে অন্য কারও ঘরে, কড়িকাঠে ঝুলতে ব্যর্থ চেষ্টা চলেছে, তৈরি হয়নি আরেকটি তাজমহল; স্পর্শ দূরে থাক কেউ সারাজীবন অন‍্য পুরুষের মুখও দেখেনি, দু-চারখানা পদ‍্য লিখেছে হয়তো নিজস্ব দিনলিপিতে, কেউ মরে ভূত হয়ে গেছে।

 

এসবের বাইরে তোমরা নতুন কী কী করলে!  

 

   

সাগর শর্মা

মূলত কবি। গদ্য লেখেন। গল্পে আগ্রহী। প্রথম কবিতাগ্রন্থ—ঝাউপাতার ভায়োলিন  জন্ম: ২৯ অক্টোবর ১৯৮১ কক্সবাজারের রামু উপজেলার তিতারপাড়া গ্রামে।  পড়াশোনা: চট্টগ্রাম কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর।পেশা: ফ্রী-ল্যান্স সাংবাদিকতা ও উন্নয়ন কর্মী। কবিতা, গান, আড্ডা, সিনেমা প্রিয় অনুসঙ্গ।

যোগাযোগ:

sagarsharma.cox@gmail.com

                                                                    সাগর শর্মার কবিতা

 

সিম্ফনি

.

রাস্তা থেকে দ্রুত সরে গেলে ট্রেন

পরিদৃশ্যমান পরছায়া থেকে—

পথিকের ছায়া উড়ে আসে ঘাসে

অমলধবল বিচালির পাশে।

পথ থেকে পথে সরে গেলে ছায়া

কেবল ধূসর হয়ে আসে শীতে;

কুয়াশাপ্রবণ ভোরের এ-মায়া—

ফেলে ট্রেন ছোটেছে ধীর গতিতে।

তবু দূর থেকে মনে হয় কেউ—

হাতের ইশারা করে ডাকে একা;

ভোরের সময় দেখা, আচমকা!

সমুদ্র তুলেছে এই মাত্র ঢেউ।

জল থেকে সরে জলের সিম্ফনি

ভায়োলিনে বাজে ঢেউ'রগোঙানি।

সমুদ্র সঙ্গম

.

নত হয়ে বসে থাকি—সমুদ্রের পায়ে

বালুকাবেলায় নাচে ঝিনুকের ঘ্রাণ

পঙ্কিলতা ধুয়ে নেয়, সজল ঢেউয়ে;

এপারে সমুদ্র—অইপারে আসমান।

ঢেউ এসে আছড়ায় মাটির শরীরে

আকাশ পরেছে টিপ—পূর্ণিমার চাঁন,

ঢেউয়ের ওপর ভাসাই শরীরসাম্পান

এপার তাকায়া আছে ওপারের মোহে।

ঢেউ এসে ঢেউ খেলে ঢেউয়ের উজানে

চরে এসে সাঁতরায় ঢেউ'র চিৎকার,

ঢেউ কেন আছড়ায়, শারসিনা জানে;

সমুদ্র সঙ্গমে মন—ঢেউয়ের শীৎকার।

সমুদ্র সঙ্গমে একা, তুমি যাবে সাথে?

ঢেউয়ের ওপর ঢেউ খেলে রাতের প্রপাতে।

অভয়মিত্র ঘাট

.

মেরিনড্রাইভে হেঁটেছি অভয়মিত্র ঘাট

কর্ণফুলির কিনারে মন—ফেলেছি নোঙর;

প্রজাপতি পার্কে প্রেমের প্রথম পাঠ—

এখানে পেতেছি মন—সোনাদিয়াঘর।

পতেঙ্গা সৈকতে গ্যাছে আটকে জাহাজ

সেকথা লুসাই জানে, আর জানে কর্ণফুলি।

যেন নদীর ওপারে ভাসা একা রাজহাঁস;

বুকের ভেতর ঘাই মারে এক বুলবুলি।

এখানে অভয়মিত্র ঘাট—কর্ণফুলির কিনার

কেবল রয়েছে পড়ে একা একটি জাহাজ

বহুদিন বাঁধা পারে—মাস্তুলে জমেছে ঘাস;

জাহাজ থেকেও দেখা যায় কুতুবমিনার।

বাণিজ্যের ছলে এসে কি পেয়েছো মন?

আজীবন দরিয়ায় বেয়েছি সাম্পান—

পাইনি তোমারে—তুমি এক স্বপ্নের মতন;

বুকের ভেতর বাজে খালি—দাঁড়ের আজান।

তাস

.

সন্ধ্যার দুদণ্ড অবসরে আফিমের নেশা

ঝিম মেরে থাকা সকালের নরম কুয়াশা;

তাসের তুরুফ থেকে রঙ হেঁটে গেলে—

আগুন জলজ হয়ে যায়—যেরূপ অনলে।

অলস দুপুরে হেঁটে যাওয়া রোদের ভান—

পুকুরে নেমে বালিকা গায়ে মেখেছে সাবান।

জলের উপর ভাসে স্তনবৃন্ত কুসুম কোমল;

নারী আদিকাল থেকে যেনবা রসালো ফল।

জুয়ার টেবিলে তুড়ি মেরে—মার তাস

পাহাড়ের বিপরীতে বাজি ধরেছি আকাশ;

নেশা কেটে গেলে জুয়ার আসর মিথ্যা—

আকাশ থেকেও পাহাড়ের অধিক ক্ষমতা।

এইসব তাসের চাতুরী ভুলে এসেছি বালিকা—

সাদরে গ্রহণ করে নাও সোনা, ভুলে অহমিকা।

কবি

.

কী লিখে এসব, কবি? বাতায়ন পাশে

প্রসারিত চোখে দেখে নীলিমার শোক

শৈশবের নদী বয়ে যায় অনায়াসে—

সেই কথা কী লিখে,খাতায়? দুটি শ্লোক।

কী হয় এসব লিখে; কে পড়ে এসব?

সেইসব ব্যথাতুর হৃদয়ের গান—

কে শোনে হৃদয়ের এ করুণ আযান!

চারিদিকে জীবনের মূল্যবান শব।

তবু লিখে রাখে ক্ষত, বয়েসি খাতায়

সত্য কী লিখে? না কল্পনারও অধিক

কিছু। জীবনের করুণ ঝরাপাতায়

আঁকে, জীবনের অনুবাদ ততোধিক।

তবু কবেকার—কবিজীবন আমার

বাজিয়ে দেখতে চেয়েছি মানবতার!

 

শেখর দেব

জন্ম ২১ ডিসেম্বর ১৯৮৫ইং চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানার অন্তর্গত শেখেরখীল গ্রামে। পিতা শংকর কান্তি দেব ও মাতা নীলমণি দেব। পড়াশুনা করেছেন গণিত বিষয়ে। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে একটি বেসরকারী ব্যাংকে কর্মজীবন শুরু করেন। প্রায় সাত বছরের ব্যাংকিং ক্যারিয়ার ছেড়ে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে জয়েন করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে নির্পোটে। বর্তমানে নির্পোটের হোম ইকোনমিস্ট হিসাবে কর্মরত আছেন। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চার। তিনটি কবিতার বই হলো- প্রত্নচর্চার পাঠশালা(২০১৪), বাঞ্ছাকল্পতরু (২০১৬), আরাধ্য আকাশবৃত্তি (২০১৮)। একটি প্রবন্ধ বই- কবিতার করিডোর(২০১৭)।

 

 

শেখর দেবের কবিতা

রক্তিম বাগের ভেতর

(নিপোর্টের বন্ধুদের প্রতি)

 

পড়ন্ত দিনের চোখ জেগে উঠে ক্ষয়িষ্ণু অতীত-রঙে

জীবনের লাল আভা লেগে থাকে দূরে, অন্ধকার ঘরে

তোমার এমন খেলা, ভূতলের মায়াঘর নড়ে উঠে

কেঁপে কেঁপে ক্ষ্যাপা মন, ইতস্তত জলের কর্পূর কণা

নিঃশেষ হয়েছে জেনে, ছুটে যাই নতুন দিনের কাছে।

 

দূরের মায়ার মাঝে অথবা অদৃশ্য অবকাশ কালে

কী সব লালের মায়া কেঁদে উঠে পরীবিবির মাজারে!

নীরবে শায়েস্তা খাঁন চোখ মুছে লাল বাগের কেল্লায়।

লাল ফুল ভেবো নাকো প্রেমের প্রতীক, রক্তের ধারায়

মিশে থাকা ত্যাগ, বারবার জাগে শুধু শোষণ-শাসনে।

 

ভেবেছি এভাবে কেন জাগে ব্যক্তিগত বেদনার চোখ?

আঁধারের পিছু পিছু ছুটি, অসহায় পড়ে থাকে মায়া

যারে কভু বুঝিনি জীবনে, তার কাছে রেখে আসি মন।

মাজারে মননে ঘুরি, অন্ধকারে খুঁজি আলোর জীবন!

 

শূন্যতার প্ররোচনা

 

জীবনকে ছুঁয়ে দেখে ক্রমাগত এঁকেছি পথের রেখা

শোকের সুমিষ্ট ফুল ভাঁজ করে রেখেছি সুখের মাঝে

গন্ধ নয়, শুষ্ক সড়ক ভ্রমণ শেষে ছড়ায় মুগ্ধতা।

চুরমার ভেঙেছি বোধের আসবাব, শূন্য বিন্দু হতে

মেলেছি অসীম মায়া, বাড়ির বেদনা তবু ভেসে যায়

বাতাসের তালে তালে, শূন্যপথ দেয় তারে প্ররোচনা।

 

পথের পাথর নিয়ে কে বলো মণি মণি করে মাতাল!

দিন শেষে পাথরে পাথর ঘষে জ্বলে না আগুন-ফুল

ছড়ায় না কোন গন্ধ, প্রাচীন মুগ্ধতা ভাঙে, শ্বাস টানি

পরিচিত মায়ার ভেতর, আকুলতা ঝনঝন বাজে।

সশব্দ খুলেছে দ্বার, উঁকি দেয়া বোধে নিঃশব্দ ভ্রুকুটি

মানুষের প্রহসন নিয়ে, গেয়ে যাই প্রীতি গান বৃথা।

 

আশার ভরসা নিয়ে অন্ধ বুকে যে পাখি ধরেছে গান

তীরের ফলার ব্যথা কখনো বুঝে না জানি, দিন শেষে

অন্ধকার মনের দেয়ালে, বোধের গলিতে ওঠে ঝড়।

তুমুল বোশেখ কাঁদে, মুছে যায় পরিচিত রেখা আর

সমর্পিত সব গান, বেসুরা গেয়েছি তার এলোমেলো।

অন্ধকার মাথা খুঁটে, কেন আজ অপার্থীব নীরবতা!

 

ভ্রুণের মায়া

নিশ্চুপ রাতে অজানা ফুলের সুবাসে খুলে যায় দেহের ফণা। প্ররোচনার আলোয় জাগে রক্তচক্ষু মায়া। আলো থেকে খসে পড়ে এক-একটি জীবনের ভ্রুণ। ভ্রুণের বাগানে গুনে গুনে জমা রাখি মরণ ফুলের পাপড়ি। অথচ ফুল ছিঁড়তে গেলে কেঁপে উঠে হৃদয়। কম্পমান হৃদয়ের আবেশে কাঁপে দেহের রেণু। বোশেখী ঝড়ের সাথে বহে যাই আর কম্পমান ভূগোল থেকে কুড়িয়ে রাখি অনুভূতিমালা।

অবশেষে অনুভূতি উদ্বায়ী স্বভাবে উবে যায় চারপাশ। হাত ছুঁড়ে এপাশ-ওপাশ ধরতে চাই কিছু তার হাওয়া। শুকাতে থাকে ফুল, ভ্রুণ হতে জাগে না নতুন দেহ। তবুও ফণা মেলে থাকি জীবনের খোঁজে। ছোবল নয়, শুধু অপেক্ষায় থাকি রক্তচক্ষু কখন হবে নীল। নীল চোখের দিকে তাকিয়ে গুটিয়ে নিবো ভ্রুণের বেদনা।

 

ভেষজবিদ্যা

চোখের উপর দুটি তুলসী পাতা ঝুলে থাকে জন্মাবধি। পাতাদ্বয় চোখ ছোঁবে ছোঁবে করে কাটায় পিপাসার্ত প্রহর। সেই প্রহরের নাম দিয়েছি জীবন। কেউ কেউ এসব ভুলে যায়, স্বেচ্ছাকৃত সৌন্দর্যে দলিত করে কোমল পাতাদের।আমার ঔষধি জনম জেনেও অপচয় করেছি লব্ধ সুগন্ধি ও ভেষজ গুণ। অত:পর অর্থহীন হয়ে উঠে তুলসী আর চোখের দূরত্ব। তুলসীদ্বয় চোখ ছুঁলেই আমরা তাকে মৃত্যু বলি। অথচ কেউ জানে না, চোখের জলে তুলসী ফিরে পায় নতুন ভেষজবিদ্যা!

 

তারা ঝরে গেলে জোনাকি হয়ে যায়

 

ঘনায়মান রাতের জন্য রাখিনি কোন শোক

অপূর্ণতার মোহ করেনি করুণ অন্ধ

যুগপৎ খেলেছি বিগত নিবিড় আঁধারে

জোনাকি আর তারার শহর জুড়ে।

 

ঝোঁপের আড়াল হতে উড়ে উড়ে কাছে এলে

আলোর ডানায় জাদুকরি ফুৎকারে

জোনাকিরা আকাশের তারা হয়ে যেত!

 

তারা ঝরে গেলে ফুলের নামের বদলে

বিগত জোনাকির কথা ভেবেছি প্রবল

কারণ তারারা ঝরে গেলে জোনাকি হয়ে যায়!

 

এভাবে আকাশ ও জোনাকির গল্পগুলো

হয়ে গেছে রাত ও নির্বাণের আলো।

অনিবার্য সকাল কী দেবে নতুন?

ভাবিনি কখনো তার অনন্ত মাধুরি

শুধু প্রথাগত দিনের প্রপঞ্চে

খুলে রেখেছি পয়মন্ত মৌচাক।

 

কাল ভোরে পুবের আলোয় আঁধার ফোটে যদি

পূর্ণিমার পূর্ণতা নিয়ে কথা হবে না আর

তারা ঝরার অপেক্ষায় রবে না কেউ

তখন তারারা ঝরে গেলে কি জোনকিই হবে?

 

রিমঝিম আহমেদ

জন্ম: ৮ জুলাই, ১৯৮৫, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।

পেশা: উন্নয়নকর্মী

কবিতার বই: লিলিথের ডানা [ চৈতন্য, ২০১৬]

কয়েক লাইন হেঁটে [জেব্রাক্রসিং, ২০১৮]

                                                        রিমঝিম আহমেদ এর কবিতা

 

সুবেহ তারা সিরিজ

 

মা তালগাছ, একপায়ে দাঁড়িয়ে ছিল প্রান্তরের কাছে

যতসব বিমর্ষতা ঘরে ঢুকার আগে মা গিলে খেত

বাবা উড়ুক্কু মাছ, জলের সন্তরণ ভালোবেসে

সমুদ্রের দিকে চলে গেছে

আমাদের  জন্মান্তর খিল এঁটে ঘুমিয়ে পড়েছে

তাকে জাগিয়ে দিও না, সুবেহ তারা

বরং শানিত পাথরে কেটে খসিয়ে দাও যত বিষফোঁড়া

 

লিলিথের চিঠি

মানুষ নিষিদ্ধ জেনে মানুষের কাছে যাও ফের

অন্তেবাসী বৃন্ত থেকে ঝরে যায় সব ধর্মপাঠ

আদমের ভাই তুমি নিষিদ্ধ গন্দম টেনে খাও

আমিও লিলিথ জেনো, শয়তানের অনিন্দ্য দোসর

তোমার হারামিপনা ভুলি নাই মানব মহান

পুরুষের ডামাডোলে পুষে রাখ অহমের ধার

পৃথিবী তোমার যত, ততটা আমারো ভাগে আছে

চাঁদের কলঙ্ক দেখো জোছনার বৈভব-ভোলা গান

ঈশ্বর স্বভাব নিয়ে জঙ্গার একক ভাগীদার

ভাবছ নিজেকে জানি – ভুলের মৌতাতে জেগে

কতখানি ঘুণেধরা মনে রাখো তোমার পাঁজর

কীট ও কণ্টক নাচে মর্মান্ধ শরীর খোলা-দ্বার

তুলেছি কি বিষ ফুল? হে ঈশ্বর তুমিও পুরুষ

স্নায়ুতে-শোণিতে জাগে দ্বিধাহীন জন্মগত রোষ

নস্টালজিয়া

পাঠ্যপুস্তকের দিন শেষ

মন্থর বিকেল পাহারায়

বারান্দায় একটা ইজিচেয়ার

দূরগামী গাড়ি হর্ন বাজিয়ে আসে

ক্যামেরার শাটার টানার শব্দ

কার ছবি কে তোলে, এই অবেলায়?

রোজ হাঁক ছেড়ে আসে

জেলেদের কচি বাচ্চাদুটো

ভ্যানের চাকায় মাখা দৈন্য

আঁশটে পানিতে ধুয়ে যায়

টুপটাপ, গড়াতে গড়াতে 

পাড়ার কলের মাপাজল 

জীবনকে পাঠ করায় লাল আমপারা

বারান্দায় ঘাসফুল বড্ড পুরনো

দিনগুলো জমিয়ে রাখে চড়ুইপাতায়

ইতিবৃত্ত

আমি কি জানি কোথায় পাখিদের দেশ?

পাতার আড়ালে কাকের সংসার

পালকের ওমে ছানাদের রাত্রিযাপনের সকল ইতিবৃত্ত?

জানালা বরাবর আমগাছে বাতাসে দুলছে কাঁচা-আম

ঝোড়ো বাতাসে সশব্দে টিনের চালে আম পড়া

ছাদের কার্নিশ ছুঁয়ে নারিকেলের ঝিরিঝিরি কাঁপা চিরল পাতাগুলো...

আমি কি জানি তাদের?

শুধু জানি – কোথাও পানিবন্যার মতো

আলভেঙে ঢুকে পড়ছে মুহুর্মুহু হাওয়া, ধূলার আস্তর

আর, একটা পোড়-খাওয়া ঘু ঘু

গলা ফুলিয়ে ডাকছে মাঝ দুপুরে...

 

ওয়েটিং রুম

কোন ওয়েটিং রুম নেই এখানে

এমন কথাও ছিল না অবশ্য

মুখের বদলে হাত মনে পড়ে, আর আঙুলও...

বেদম কাশির পর ক্লান্ত হচ্ছ জেনে

নিজেকে সংযত করি

এমনটা কথা ছিল –

আত্মসংযমের পর বৃষ্টি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া

টেবিলের ওপর চায়ের ধোঁয়া ফুরোয় 

স্যাঁতসেঁতে অপেক্ষার গায়েও ছত্রাক জমতে থাকে

 

 ৬

ভ্রমণবিলাস

 

নিরাপদ দূরত্ব থেকে লেবুগন্ধের মতো ছড়িয়ে পড়ছ আমার ভেতরে

কথার বুদবুদ উপচে ভিজে যায় স্নায়ুর পরিধি

গলনাংক ভুলে গেছে সময়ের অর্ধনগ্ন মুখ

আমিও টুরিস্ট এই ইচ্ছেবাহী বনে সরল জোছনা 

আশকারা পেলে আঙুলে তুলে নেয়া যায়

মানুষের চোখে গজিয়ে ওঠা কাঁটা 

 

Post date: Jun 26, 2018 5:46:16 AM