অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন : পর্ব ০৩
Post date: Jun 17, 2018 7:00:31 AM
অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন : পর্ব ০৩
সাইটে প্রবেশের জন্য আপনাকে স্বাগতম। এটি অলস দুপুর ওয়েবম্যাগের একটি অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন। এই সংকলনে বাংলাদেশ ও ভারতের নানা প্রান্তে যারা দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্য চর্চা করে চলেছেন, লিটলম্যাগ চর্চা করে চলেছেন, তাদেরকে বিশেষ ভাবে স্থান দেয়া হচ্ছে। আমরা জানি যে পুঁজিবাদের বিকাশের প্রক্রিয়াটিই এমন যে ইটের নিচে সবুজ ঘাস চাপা পড়ে যায়। আমরা প্রশান্তির জন্য দিগন্তের দিকেই তাকিয়ে থাকি।
অলস দুপুর সেইসব কবিদেরই খুঁজে চলেছেন। যারা নিরবে কাজ করে যাচ্ছেন, কোন এক দূরে বসে লিটলম্যাগ চর্চা করে চলেছেন বছরের পর বছর। সন্ধ্যায় জোনাকির মত তার চোখও জ্বলে ওঠে নতুন কবিতায়। সেই সব নতুন কবিতাকে খুঁজে চলেছে অলস দুপুর।
অনলাইন কোন স্থান নয়। ইন্টারনেট মানে বিশ্বের যে কোন প্রান্তের সাথে যুক্ত আপনি আমি। এখন আমি আপনি বিশ্বের যে কোন প্রান্তের কবিতার সাথেও যুক্ত। কিন্তু প্রান্ত তো আছে। যে এসে মিলিত হয় মুক্তির সাথে। অলস দুপুরের কাছে জেলা হচ্ছে এক একটি প্রান্ত, যে যুক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত শুধু বাংলাদেশ নয়, বাংলা কবিতা নয়, বিশ্ব কবিতার সাথে। আমরা অলস দুপুরে বাংলাদেশ ও ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কবিদের কবিতা এই আয়োজনের মাধ্যমে পাঠকদের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি।
সংকলন পদ্ধতি: একজন মূল সম্পাদক থাকেন। মূল সম্পাদক থাকবেন দুপুর মিত্র। বিভিন্ন জেলা থেকে একজন অতিথি সম্পাদক নির্বাচিত করেন। অতিথি সম্পাদক তার জেলা থেকে কবি নির্বাচিত করেন এবং তাদের কাছ থেকে কবিতা সংগ্রহ করে মূল সম্পাদকের নিকট প্রেরণ করেন। প্রতিটি পোস্ট এক একটি জেলা বা প্রান্তের সংকলন হিসেবে গণ্য হবে। যিনি অতিথি সম্পাদক থাকবেন তার সম্পাদনা নিয়ে একটি ছোট সম্পাদকীয় থাকবে। এভাবে ছোট ছোট সংকলন মিলে একটি বড় সংকলন হবে।
যাদের কবিতা সংকলিত হবে
১. দীর্ঘদিন ধরে লিটলম্যাগে জড়িত
২. বিভিন্নজেলায় বসবাসরত
৩. সাহিত্যচর্চায় নিয়মিত
সংকলনটি চূড়ান্ত নয়। বিভিন্ন সময় এটি আপডেট হবে। সংকলনটি সমৃদ্ধ করতে পাঠকের প্রস্তাবনা ও মন্তব্যকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। প্রস্তাবনা বা মন্তব্য জানান mitra_bibhuti@yahoo.com এ।
অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন: ০৩ পর্বের অতিথি সম্পাদক কবি শাহানা আকতার মহুয়া। তিনি কবিতা সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে ‘অলস দুপুর’ ওয়েব ম্যাগাজিনকে সহায়তা করেছেন। তার প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা।
শাহানা আকতার মহুয়ার সম্পাদকীয়
কবিতা হচ্ছে এক রহস্য আর এই রহস্যের স্রষ্টা রহস্যময় মানুষ। রহস্যময় মানুষ এক যেন রহস্য সৃষ্টি করে তার নাম দিয়েছে কবিতা। কবি কবিতা নির্মাণ করেন, অর্থাৎ তিনি নির্মাতা। এই নির্মাতা কোনো প্রস্তুতকারক নন, তিনি ঈশ্বরতুল্য স্রষ্টা। তিনি শব্দকে তুলে আনেন, রূপ দেন সম্পূর্ণতায়। ঈশ্বরের বাণীর মতো কবির শব্দমালাও নিজস্ব বিষয় নির্মাণ করে, তার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য করে তোলে। কবি সম্পর্কে প্রচলিত একটা ধারণা আছে যে তিনি এপোলোর পুত্র, প্রকৃতপক্ষে কবি এপোলোর প্রতিদ্বন্দ্বী মারসায়াসের পুত্র, যার আর্তস্বরে ধ্বনিত হয় শাশ্বত কবিতা এবং কবির বিদ্রোহী সত্তা।
এইরকম আতীব্র স্রষ্টাদের মধ্যে থেকে ১০ কবি এবং কবিতা নির্বাচন করা নিতান্তই কঠিন কাজ। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যে নাটোরের কথা উঠে এসেছে বারবার। নাটোরের রাজা জগদীন্দ্রনাথ রায় সাহিত্যচর্চা করতেন। ওই সময় প্রতি চান্দ্রমাসের পূর্ণিমা তিথিতে ‘পূর্ণিমা সম্মিলনী’ নামে সাহিত্য আসর চালু হয়। আয়োজন করা হতো বার্ষিক সাহিত্য সম্মেলনের। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারির কাজে শিলাইদহ, শাহাজাদপুর এবং পতিসর যাতায়াতের সময় বন্ধুপ্রতিম রাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়ের আতিথেয়তাকে গ্রহণ করতে মাঝে মধ্যে নাটোর আসতেন। বনলতা সেনের পাখির নিড়ের মতো চোখ যেমন পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে থাকে তেমন নাটোরের রাজবধু কবি ইন্দুপ্রভা দেবীর শতবর্ষের পুরনো হাতেলেখা আট-দশটি পান্ডুলিপি দেখে শিহরিত হয়েছিলাম। কবিতাগুলো পড়ে আরো অভিভূত হয়েছিলাম আরো! তাই আজো আধুনিক মনন নিয়ে ইন্দুপ্রভা দেবী কিংবা রাজা জগদীন্দ্র নাথ রায় নানাভাবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান।
এখন লিখছেন অনেকেই। তাদের মধ্যে থেকে ১০জন কবির কবিতাকে নির্বাচন করা আপাতভাবে সহজ মনে হলেও আসলে বেশ কঠিন। কামাল খাঁ, সুমন সৌপর্ণ, সালেহীন বিপ্লব, সজীব সরকার, রফিকুল কাদিরসহ অনেকেই ভাল লিখছেন, কোন এ্কসময় তাদের কবিতা নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে রইল। আপাতত কবিতায় পরিভ্রমণ হোক...
সুখময় বিপলু’র কবিতা
সুখময় বিপলু’র জন্ম নাটোরে।নাটোর জজকোর্টে আইন পেশার সাথে জড়িত। নাট্যকর্মী ও ইঙ্গিত (অনিয়মিত সাহিত্যপত্র)-এর সম্পাদক।
তোমাতে তন্মনা
তোমার তন্ময়ে আমি আদি ও অনাদিকালব্যাপী
নানা শাখা-প্রশাখায় তবু সেই এক বৃত্ত পথে,
চরণ মাঝির নাও, অগণিত স্বপ্নযান আর
যাবতীয় যত্নযানে বহতা বাতাসে ভেসে ভেসে...
অনন্তের অন্ধকারে অবিশ্রান্ত ঘুরি বিশ্বময়;
ঘুরি শুধু শোণিতের উষ্ণতায় জ্বালিয়ে মশাল।
অন্তহীন ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য ভেদের ধারা ধ'রে,
অখণ্ড মণ্ডলে আছে যেথা যত সুমেরু-কুমেরু;
সর্বত্রগামীর মত হয়ে আমি নিয়ত তোমাকে!
নবরূপে নবোদ্যমে আবিস্কার-অভিযানে রবো।
মরণ-সাগর পাড়ে পুনর্জন্ম হোক বা না হোক,
জন্মান্তর-জয়বাদ সত্যি থাকুক বা না থাকুক;
দেহভস্ম থেকে কিম্বা দেহাংশের মাটিরূপ থেকে,
তোমাতে তন্মনা: রূপে জেনো জয়ী হবোই নিশ্চয়।
অন্তর্দৃষ্টি
তোমার দুচোখে সদা নাচে গায় শুচি শুক্লপক্ষ!
মাতোয়ারা হয় ওতে জহুরির নিবদ্ধ নজর!
রকমারি রঙধনু-রূপ বেড়ে হয় অফুরান!
ওই দৃশ্যে যোগ হয় নিত্য নব মুগ্ধের মদত!
অথচ আমার চোখে রোজ জ্ব'লে ওঠে সূর্য,
যৌথ জীবনের জন্য করি আমি উষ্ণতা উজার।
পাতা ঝরা শাখাসম হ'লেশীতে তোমার নয়ন,
কিম্বা কভু ওই চোখ তমসা তলায় যদি যায়;
আমার চোখের তাপে ফাগুনের ছড়িয়ে আগুন,
বসন্তে বসতি স্থায়ী গ'ড়ে দেবে নিশ্চিত তোমাকে।
তথাপি আমার চোখে অপলক তাকালেনা আজো!
দেখনি এ'চোখে ফোটেরক্তে রাঙা কত সেরা ফুল!
পালাও পলক ফেলে কভু না দাও কদরদানি,
সুন্দরের সুর-সংজ্ঞা চেনা-জানা হলো না আমার।
আশীক রহমান’র কবিতা
আশীক রহমানের জন্ম ১৯৬২ সালের ২৪শে মার্চ।
বর্তমান আবাস- নাটোর।
কাজ- কবিতা লেখা।
জীবিকা- বিচিত্র রকমের চেষ্টা।
প্রকাশিত বই- অলৌকিক চন্দ্রযান(প্রকাশক: উত্তরবঙ্গ বার্তা) মহান আঁধার-মহামান্য অন্ধকার(প্রকাশক: বর্ষা দুপুর)।
মহান আঁধার, মহামান্য অন্ধকার
একগলা কোজাগরি-মদ পান করে
ছায়াপথে পথে আমি ঘুরিয়া বেড়াই;
আলো নাই, দিন নাই, ক্ষণ নাই,
ইতিহাস নাই। শূন্য ধ্রুব, শূন্য সত্য
শূন্য ইতিহাস।
দিক নাই, বস্তু নাই, গণিত, নিয়ম
বুদ্বুদমাত্র শুধু। সত্য অন্ধকার;
অসীম শূন্যতা জুড়ে বিরাজিত শুধু
মহামান্য অন্ধকার, মহান আঁধার।
মহাকাল প্রব্রজ্যায় শিখি,
মহাশূন্যব্যাপি আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া শিখি¾
ব্যাপক আঁধার হ’তে জন্ম নেয় প্রকৃত আলোক,
ব্যাপক শূন্য হ’তে জন্ম নেয় প্রকৃত বস্তু।
হায়, আমাদের ইস্কুলসমূহ,
ভুলের আপেল, বিভ্রম- গণিত!
সেই কবে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
তারপর কতো পথ, পথের সন্ধান…;
অযুত বছর ধ’রে ঘুরিয়া ঘুরিয়া আমি
শিখি শূন্যতা অর্থাৎ বস্তু,
অযুত বছর ধ’রে ঘুরিয়া ঘুরিয়া আমি
শিখি আঁধার অর্থাৎ আলো;
মানে অন্ধকার, মানে শূন্য,
মানে শূন্য ইতিহাস, ধ্রুব অন্ধকার;
অর্থাৎ শূন্যতা পরম সঙ্গীত,
আঁধার পরম দৃশ্য।
সাম্পান
একগামী অর্থগৃধ্নুতাকে ঘৃণা করি আমি।
খুঁজি তাই অর্থাতীত অর্থের ভুবন;
মগজের কোষে কোষে খেলে যায় যে বিদ্যুচ্চমক,
তাকে ধরি, তাকে ছুঁই; ধরতে চাই, ছুঁইতে চাই-
অলৌকিক জালে,
স্পর্শকাতর আঙুলে, ত্বকে ও চুলে!
* একগামী অর্থের কাঙাল আমি নই।
ও খুব বিরক্তিকর, একঘেয়ে, পানসে স্বভাব, একগামী;
আমি বহুগামী; আমি চাই
এক বিচিত্র রঙের অর্থাতিরিক্ত সাম্পান
আসুক, ভেসে যাক অর্থভারহীনতার সৌন্দর্যের দিকে,
প্রণয় হারাক তার আর্থিক সঙ্গতি;
ছড়ায়ে পড়ুক জীবে ও জড়ের কণায় কণায়,
আঁধার বিলায়ে দিক তার অর্থের ভাঁড়ার
যেন সমস্ত আলোককণা,
ছায়াচ্ছন্নতা এবং আঁধার হয়ে ওঠে পরস্পর গুণগ্রাহী,
বহুঅর্থগামী শব্দেরা মিলুক প্রেমে
নতুন আর্থিক এলাকায়!
রহমান হেনরী’র কবিতা
কবি, বিশ্বকবিতার বাঙলায়ন কর্মী রহমান হেনরীর জন্ম ১৪ জানুয়ারি ১৯৭০ তদানীন্তন রাজশাহী জেলার নাটোর মহকুমায়। পড়াশুনা করেছেন নাটোরে ও ঢাকায়। পেশাগত জীবনে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ১৫শ ব্যাচের সদস্য। বর্তমানে, প্রেষণে, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, বাংলাদেশ-এ কর্মরত এবং স্থায়ীভাবে ঢাকাতেই বসবাস করছেন।
উল্লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থ: বনভোজনের মতো অন্ধকার(১৯৯৮); গীতঅনার্য (১৯৯৯); প্রকৃত সারস উড়ে যায়(২০০০); সার্কাসমুখরিত গ্রাম (২০০১, ২০০৪); খুনঝরা নদী (২০০৫); তোমাকে বাসনাকরি (২০০৫); গোত্রভূমিকাহীন(২০০৮); শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০০৮); ত্রাণসুন্দরী (২০০৯); ব্রজসুন্দরীর কথা (২০১২); প্রণয়সম্ভার (২০১৪); শতরথগুঞ্জন (২০১৬); শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০১৮)
বাঙলায়নকৃত কবিতাগ্রন্থ: কবিতার ত্রিভুবন (২০১২); আদোনিসের কবিতা(২০১২); অধিকৃত ভূখণ্ডের কবিতা(২০১২); নোবেলজয়ীদের কবিতা (২০১৪)
সম্পাদনা গ্রন্থ: বিশ শতকের বাঙলাকবিতা (২০০৯)।পোয়েটট্রি নামে একটি কবিতাকাগজ সম্পদনা করেন।
সমঝোতা স্মারক
শহর নিকটে নয়, গ্রাম বহু দূরে—
এমন আধানির্জনে, চলো, সংসার পাতি;
নিরবচ্ছিন্ন বনিবনা নয়—
প্রতিদিন দ্বন্দ্ব হোক আমাদের।
এই ফাঁকে, পাখিরাও ঝগড়াঝাটি শিখুক
মৃদু বাতাসের দিন হরমাসেই জিতে নিক
দমকা-হাওয়ার পদক;
আমাদের পুত্রকন্যারা, পরস্পরের দিকে পিঠ রেখে
আঙুল উঁচিয়ে বলুক:
ওই তো শহর
ওই তো গ্রাম
ঠিক সে সময়, ওদের মাথার ওপর দিয়ে বিমান উড়ে যাক
ডানার ইতিহাস নিয়ে দ্বিমত ও সহমত পোষণ করতে করতে
ওরাও একটা সমঝোতা-স্মারকে স্বাক্ষর করুক!
জিরাফ ও ডলফিনের ভাষা
ওপাড়ে জিরাফের ভাষায় কথা হয়
এপাড়ে ডলফিনের
মাঝের স্রোতে হাবুডুবু খাচ্ছে রোদনস্নাত মানুষ;
প্রাণিদের রতিশৈলীর ভেতর থেকে
ভাষাসূত্র উদ্ধার করতে হচ্ছে আমাকেই—
ইতিহাসের মর্মমূলে কী প্রকার হিতোপদেশ আছে
যার অনুসারী হয়নি হতভাগা দেশ; তারই সন্ধানে,
অনেক বছর পর, একদল মানুষ আসবে।
বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রতিটি পৃষ্ঠায়, মার্জিনে—
খুঁজে পাবে, এইসব ভাষাবিদ্যার ঘাম;
স্বেদবিন্দু থেকে সুগন্ধী তৈরির আশ্চর্য কৌশল
ওইসব মানুষেরই জানা থাকবে…
আনন্দ
পতনোম্মুখ পাতা, বাতাসের দমকা লেগে
উড়ে উঠলো— আসমানের দিকে;
পাতার পেছনে ছুটছে দুধরং ঘুঘু...
আর আমি, বৃক্ষকে বলছি: ধৈর্য ধরো!
ডিম দুটোকে বলছি: অপেক্ষা সুন্দর।
ঘুঘুকে, কিছুই বলছি না;
কাণ্ড বেয়ে, তরতরিয়ে উঠে আসছে— ডিমখোর,
তার দ্বিভাজিত জিহ্বায়, লকলক করছে: আনন্দ—
বদরে মুনীরের কবিতা
কবি বদরে মুনীরের জন্ম ১৯৭২ সালের ১২ই জুলাই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর মুনীর শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘আঙুলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা’,‘মায়ার মুরতি, যাতনার যতি’, ‘আমরা যারা ভুল করেছিলাম’ ‘ফুলকিনিচয়’,‘পোকাসংহিতা’,‘উপমানুষের নকশা’য় কবি বদরে মুনীর রেখেছেন ভিন্নতার ছাপ।ছাত্রজীবনে যখন বন্ধুরা মিলে সাহিত্যের কাগজ ‘উটপাখি’ সম্পাদনা করতেন, তখন থেকেই তিনি নির্মাণ করে চলেছেন কাব্যদ্যোতনার এক প্রচ্ছন্ন পৃথিবী।
আমরা যারা পাথরে পাথর ঘ'ষে মমতা ঝরিয়েছিলাম
আমরা যারা জানলার পাল্লায় নাম লিখেছিলাম
দরজার পাল্লায় লিখেছিলাম আঙুলের টোকা
আর স্বপ্নের পাল্লায় প'ড়ে ভেঙেছিলাম তথাকথিত দরকারি দেয়াল
আমরা যারা নির্জন ঠান্ডার ভয়ে গায়ে আগুন ধরিয়েছিলাম
আমরা যারা ভালোবেসেছিলাম মফঃস্বল,
আজিমের-বিমলের-জব্বারের চায়ের দোকানে ব'সে
রঙ করেছিলাম জীবনের বিবর্ণ সময়
আমরা যারা চৌকিদারের চেয়ে বরং চোর হ'তে চেষ্টা করেছিলাম
আমরা যারা ঘৃণা করেছিলাম নর্তকীর নিম্ননাভি,
মঞ্চের মৌতাত, কবিসঙ্ঘ, এবং হাততালি
আমরা যারা ইশতেহার ফটোকপি করেছিলাম, সঙ্গে বিপ্লবও
আমরা যারা মাঝরাত্রি মাড়িয়ে বেহুঁশ,
বন্ধুর কাঁধে ভর দিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম
বমিতে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম ভাইয়ের খাবার প্লেট
আমরা যারা ছাই ঘেঁটে-ঘেঁটে আত্নীয়তার উত্তাপ খুঁজেছিলাম
আমরা যারা সোনার মুকুট প'রে দন্ডিত হয়েছিলাম
গোপন-সংগ্রহে রেখেছিলাম কাটা-বন্দুকের পরিত্যাক্ত বাঁট,
বোনের উদ্বিগ্ন চিঠি, পুরনো কয়েন
আমরা যারা ভাগাড়ে অনার্স ক'রে মাস্টার্স করিনি
আমরা যারা একপাতে খেয়েছি, কিন্তু যৌথতা বুঝিনি
আমরা যারা অপেক্ষা করেছিলাম
আমরা যারা সনাক্ত করেছিলাম ইতিহাসের পিঠের ক্ষতচিহ্নগুলো,
সন্দেহ করেছিলাম সম্পর্কের সূক্ষ সেলাইয়ের দাগকে
আমরা যারা আমাদের জঘন্য অবসর থুথু আর শাদা-শাদা ফেনার বদলে
রুখে দিয়েছিলাম হাসিতে-হাসিতে
আমরা যারা যৌবনের আর্দ্র, অন্ধকারাচ্ছন্ন গহন জঙ্গলের গা-ছমছম-করা
নীরবতা ভেঙে দিতে বাঘিনীর গালে চড় মারতে সাহস করেছিলাম
আমরা যারা ছোট মুখে বড় কথা না-বলে পারিনি
আমরা যারা গান গেয়েছিলাম
আমরা যারা দরজা খুলতে দেরি করেছিলাম
কয়েকটা ইমেজ মাত্র
নানির উঠানে সন্ধ্যা জোড়া-জুঁই-গাছের মাঝখান দিয়ে
হেঁটে গেল আরও অন্ধকারে।
সিঁড়ির তৃতীয় ধাপে ব’সে আছে নওগাঁর মেয়েটা,
পিছে বারান্দার আলো, বদনামের ভয়;
সামনে দাঁড়ানো একটা গাধা!
একটা খুব ফুটফুটে কিশোর এসে, খড়ির চুলার পাশে,
হাসতে-হাসতে মেরে দিল বোমা:
‘আপনারা কী জাত মামা, গরু খান, জুম্মাবারও মসজিদে যান না?’
বহু উত্তরের এক শীত-লাগা ঝাপসা-ঝাপসা লাজুক স্টেশনে
কে বলল, বালিকা-গলা, ‘আপনারা কি ভাই নাকি,
আপনি ছোট, গোঁফ রেখে বড়-বড় ভাব?’
একটা কুমিরেরগায়ে নিরঙ্কুশ লেপ্টে
শ্রীমতি অলিভঅয়েল,
সাবধানে পরখ করছে দাঁতের সামর্থ্য;
‘তুমি না এমন করো, আসো!’
উথলে-ওঠা অশ্রুরাশি কান্না, না প্রেরণা—
বোঝার আগেই ছবি শেষ।
কয়েকটা ইমেজ মাত্র, তা-ও ভাঙা, পোকা-খাওয়া;
এ-দিয়ে চলবে থাকা, খাওয়া?।
"তোমার নিকুচি করি, পিন্ডি করি যত কবিতার;
এতো যে সন্ন্যাস শুনি, ঠিকই তো প্রেমের পদ্য লেখো,
শ্মশান-বিলাসী ভূত, নিদয় চন্ডাল কোথাকার,
আসলে উল্লুক তুমি, পলাতক, মুগ্ধ রূপখেকো!
তোমাকে লেখার চেয়ে শ্রেয়তর ঘরে ঝুল ঝাড়া,
অথবা ছড়িয়ে দানা ডেকে ডেকে পাখিকে খাওয়ানো ;
আঁধার আকাশে একা খ'সে পড়া তারার ইশারা
বুঝে নেয়া ভালো, ঢের ভালো পরিব্রাজিকার ভানও।
নৈঃশব্দ্যের ফাঁকে ফাঁকে খুলে রেখে আয়ুর জানালা,
কাগজের ভাঁজে ভ'রে একলক্ষ একশ' বছর
তোমাকে লিখেছি তবু, এঁকেছি আমার স্বপ্নমালা ;
তুমি তো কলম-ভূত, যে ভূত কলমে ক'রে ভর
-সব আলো বুঁজে এলে, নিভে গেলে সব পান্থশালা-
আমাকে লিখিয়ে নাও চিঠি, অনেক চিঠির পর।"
শাহানা আকতার মহুয়া’র কবিতা
৮ই জুন মহুয়ার জন্ম, নাটোরে। প্রথম পেশা শিক্ষকতা। ২০০৮ সাল থেকে সপরিবারে বসবাস করছেন কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে। বর্তমানে সেখানে ‘মাল্টিকালচারাল হেল্পিংহাউজ সোসাইটি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
প্রবাস জীবনের নানা প্রতিকূলতায় লেখালেখিতে খানিকটা ছেদ পড়লেও থেমে যাননি তিনি। ছোটকাগজসহ অনেক দৈনিক কাগজে নিয়মিত লিখছেন। কিছুটা নিভৃতচারী মহুয়া লেখালেখির পাশাপাশি সম্পাদনা করেন সুরুচিশোভন সাহিত্যের কাগজ ‘ছান্দস’।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ :
ধ্রুপদ সন্ন্যাসে (১৯৯৮- নিসর্গ) কাচের কোকিল (২০০০- উটপাখি) প্রত্নপিপাসার জল (২০০৫-বলাকা প্রকাশনী) মনঘর (২০১১- প্রকৃতি প্রকাশনী), শত পদ্য মলাটের ভাঁজে (২০১৮- পুথিনিলয়)
অনূদিত গ্রন্থতালিকায় রয়েছে:
আর্মেনিয়ার ছোটগল্প (প্রথম প্রকাশ ২০০৫- দিব্যপ্রকাশ, দ্বিতীয় প্রকাশ ২০১৮-অগ্রদূত এন্ড কোং)
ভারতীয় নারী-লেখকদের গল্পের সংকলন –জেনানা জবান (২০১০- কথাপ্রকাশ)
কানাডীয় আদিবাসী কবিতার অনুবাদগ্রন্থ-দূরের ক্যানভাস (২০১৬- ঐতিহ্য)
Email: Shahana.mohua5271@gmail.com
বালিকা
বালিকা তোমার কাচের চুড়িতে বেলোয়ারি-বন্ধন
ঘরকন্নার সাথীরা সবাই বেঁধেছে আপনঘর,
স্মৃতির উঠোনে এখনো তোমার ধুলোবালি রন্ধন
তোমার উঠোনে সজীবতাহীন কেন এই বালুচর?
এখনো তো সেই মায়াময়ী দিন টেনে রাখে হুতাশনে
বিছানায় খোঁজো চেনা গন্ধের জুঁই-পারিজাতমালা,
নিজেকে পুড়িয়ে বেদনার ভিত গড়ে তোলো আনমনে¾
কেন শুধু খোলো প্রতিদিন সেই স্মৃতিদের পাঠশালা?
বালিকা তোমার জলময় চোখে হারানো দিনের ছবি-
কেঁপে কেঁপে ওঠা চেনা কোনো মুখ বন্ধ কপাট খুলে
উঁকি দিলে যেন বোবা হয়ে যায় নিশ্চলা জল-রবি;
লতাদের মতো নুয়ে আসে মন সকল আড়াল ভুলে।
কত যুগ গেল বালিকা তবুও করছো হৃদয়ে বাস
যত দিন যায় ব্যাকুলতা যেন বেড়ে ওঠে ক্রমে ক্রমে
বেপথু দিনেরা পায়রার মতো খুঁটে আনে ফুল-ঘাস,
স্বপ্নের খোঁজে দিন ছুটে যায় পরিযায়ী পথ-ভ্রমে!
মুখোমুখি শেষ বিকেলে
মুখোমুখি বসে থাকা চাতক বিকেলে
ডানা মেলে উড়ে যায় ঝাঁক বাধা রোদ—
বোঝেনি কেউ কখন যে থেমে গেছে
বন আর বিথিকার গান,
কিছুদূরে, লেকের ধারে মৎস্য-উপাসনায় বসে থাকা লোকটি
হঠাৎ নিজের একটা চোখ তুলে বড়শিতে গেঁথে
বেমালুম ছুঁড়ে দিল মাছের আধারের মতো!
এইসব দেখতে দেখতে দৌড় দেয় সময়ে রখরগোশ
পুঁতির মতো ঘনলাল চোখদু’টো তুলে চারপাশ দেখে নিয়ে
টুক করে ঢুকে যায় ফের ঘাসের বুনোটে ঘেরা নিঝুম গুহায়।
খুব ছোট আর ভাঙা ভাঙা কথার জবাব,
কপালের লালটিপ, গালের একফোঁটা টোল,
আধুনিক কবিতার আড়াল কিংবা নির্লজ্জ উদ্ভাস
এইসব খুঁটিনাটি বিষয়ের অপ্রয়োজনীয়
কথার সাথে সাথে ফুরিয়ে আসে বিকেলের আয়ু।
গোধূলিটা বড় বেশি উজ্জ্বল আর মায়াময়,
আকাশের গায়ে রঙগুলো লেগে আছে ফাগুয়ার মতো
যেন আলতো ছোঁয়ায় তুলে নেয়া যাবে
বহতা নদীর মতো গোধূলির রঙ।
মুখোমুখি বসে থাকা এইসব উজ্জ্বল বিকেল কিংবা
লাবণ্যময় গোধূলিবেলারা খুব স্বল্পায়ু হয়।
দ্বীপের মানুষ, মানুষের দ্বীপ
প্রতিটি আজব দ্বীপে মানুষের ঘর,
সেই ঘরে লুকোচুরি, অযাচিত স্বর!
প্রতিটি মানুষ যেন জলে-ডোবা দ্বীপ,
ঘর বাঁধে¾ ঘরে জ্বালে ফানুস-প্রদীপ।
খুলে যায়, ভেঙে যায় বোধের বিভাব,
দ্বীপের মানুষ ভাবে খেয়ালের পাপ!
একাকী দাঁড়িয়ে দ্বীপে, নীরব অধীর
নিজেকে হারিয়ে ফেলি ব্যাকুল-বধির।
একে একে সরে যায়, সরে যায় ঢেউ...
একাকী দাঁড়ানো দ্বীপে আর নেই কেউ!
সময় বুঝিয়ে দেয় একেলা সবাই
নিজে ছাড়া আর কোনো বান্ধব নাই।
এতো ভিড়ে তবু যেন একাকীই থাকি,
একেলা দ্বীপের মতো বসতিকে ডাকি।
রিপন মাহমুদ’র কবিতা
রিপন মাহমুদ
জন্ম-১৭.০৯.১৯৭১
জন্মস্থান: পুঠিয়া, রাজশাহী
বেড়েওঠা: নাটোর
পেশা: সহকারী অধ্যাপক,প্রাণিবিজ্ঞান, জাহাঙ্গীরপুর সরকারী কলেজ, নওগাঁ।
সাপগাথা
ভন্তে, দেখো, শ্রেষ্ঠতর খল বলে আর কিছু নাই।
সর্বে সরীসৃপ,রক্তে হিমাংকের ত্রাস। অবলুপ্ত
হতে হতে হাত-পা ভ্যানিস। চেরা জিবে লালা ঝরে।
প্ররোচনার মুরোদ হারিয়ে ঘষ্টানো বুকে মাটি
থেকে পচা-গলা খেয়ে বাঁচার নির্লজ্জ ইচ্ছাভিন্ন
কিছু দেখা যাচ্ছেনা কোথাও। কেন? নিজেরা উলঙ্গ,
অত ডুমুরের পাতা কই যে ছতর ঢাকবে তবে।
উন্মীলিত চোখে চামড়া গজায়না। সারা গায়ে শল্ক
লেজে জুড়ে আছে শতেকের বৃত্তি,কী মধুর জ¦ালা।
উপরন্ত গর্তে মাথা সেঁধে গেলেও লাঙ্গুল উদ্লা
থাকে, ফলে ল্যাঙ্গোটের খোঁজ পড়ে। কিন্তু পরিপাশর্^
ততোধিক নগ্নতাময় সেহেতু মেলেনা বসন।
ইচ্ছাময়ী-তারা জানে কার কর্ম কে করে, কিভাবে
করে? সর্ব খল,নীচ অপ্ররোচক অথর্ব সাপ।
পরম,কৃপাহি কেবলম
বিবিধার্থে না-মানুষ হয়ে আছি। এই যে, কেমন
তেলতেলে দেহ, যেন জলৌকা। যেহেতু জন্মান্ধ, ফলে
কোথায়- কোথায় বসি,খাই,শুই বুঝি না একদম।
গায়ে কিছুই ভরে না, স্বচ্ছ-কালো-সত্য হয়ে থাকি।
মাথা নাই,ব্যথা? বে-ঠাহর। রক্তে ভাসিÑপ্রেমাকাক্সক্ষা
তবে আছে,তীব্র,বাছবিচারহীন। উপগমে শয্যা,
বিছানা,বালিশ কোনো কিছুই লাগে না । দিগন্তের
ঐ পিঙ্গল প্রান্ত থেকে নেমে এসেছে যে-ছোট ঘর
আমার এবং আর-আর সকলে মিলে আমাদের,
বাৎস্যায়নে দীক্ষা হয় সেথা । অপার্থিব সক্ষমতা
নিয়ে আমরা অসম, কখনো বিপরীতে যাই। সবই
মধু। বিহারে অশ্লীল বলে কিছু নাই। কামাস্পদে
বুনো নিবেদন, প্রেমই। হস্তপদস্কন্ধমাথা-কাটা
সে-প্রেম,গুরু,কৃপাহি কেবলমÑদিতে থাকো আরো।
মলয় কর্মকার
জন্মঃ ৬ আগস্ট ১৯৭৩ নাটোরে
বইঃ যাপিত পদ্যাবলী
মলয় কর্মকারের কবিতা
ছুরি চালানোর আগে
আবারো তবে হোক শেষ কাটাছেঁড়া
শৈল্যমঞ্চের স্বচ্ছ আলোয় শেষবার দেখে নাও
আমাদের স্প্যাগেটি ভালোবাসা।
ভাই-বন্ধু-ভগিড়ব-দয়িতা
আবারো তবে হোক শেষ কাটাছেঁড়া-
আমার শত দ্বিখণ্ডিত হৃদয়ের ভাগ বাটোয়ারা।
তুলে নাও যে যার অংশ পছন্দ মতো
শৈল্যমঞ্চের স্বচ্ছ আলোয় শেষবার দেখে নাও
রঙ্গমঞ্চ তৈরী আছে...
তোমাদের পওনা মিটিয়ে দিয়ে
না-হয় আমি থেকে যাবো হৃদয়হীন
ভালোবাসাহীন সেই বেশ কেটে যাবে
আমার রক্তশূন্য দিন, স্বপড়বমগড়ব-স্পন্দনহীন রাত
হৃষ্ট হৃদয়ের নিচে অনেক তো দেখা হলো
ভ্রæণের পরাবর্তে কাঁদে জঠরের আবসাদ
আবার দুধমার দুধে গড়ে উঠতেও নগর।
তারচেয়ে তুলে নাও
এই তরতাজা হৃদয়ের এক টুকরো
চাইলে আমারই হৃদয়ের রক্তে
আমাকে করতে পারো রক্তাক্ত
যেভাবে হয়েছি খুন সময়ের হাত দিয়ে
নিজেরই উৎসর্গ করা আপন হাতে
যেভাবে সময়ের পায়ে পায়ে হয়েছি পিষ্ট
ফেলে আসা আপন পদভারে।
সুবিধাবাদী বাতাসে অনেক তো দেখা হলো
কেমন গর্ভবতী হয়ে ওঠে নৌকার পাল
সতীর্থের পায়ের নিচে আগুন দেখেও
সে আগুনে দেখেছি দিব্যি ওম নিতে-
অন্ধকারের নিরুত্তাপ বোঝাপড়ার ফাঁক গলে
কতজন দেখেছি অভিমানে হারিয়ে গেছে
হিসাবের অন্ধ হিসাব রক্ষক শেষমেশ
চলে গেছে হিসাবের খাতা ফেলে রেখে
আর সাগর ছুঁতে গিয়ে সবাই দেখেছি
ফিরেছে পকেটে পাথরের ভষ্ম নিয়ে।
পাওনা বুঝিয়ে দিতে তাই
হৃদয় রেখেছি বারোয়ারী মঞ্চে
ছুড়ি চালানোর আগে শেষবার দেখে নাও
আমাদের স্প্যাগেটি ভালোবাসা
তারপর তুলে নাও অথবা জুড়ে দাও
যে যার অংশ পছন্দ মতো
না-হয় আমি থেকে যাবো হৃদয়হীন
থেকে যাবো সঙ্গহীন-শিল্পহীন-ব্রহ্মহীন...
ক্ষতি নেই
আমি অনঙ্গের সঙ্গ পাবো
সৃষ্টিহীন সঙ্গমে অকারণ ক্লান্ত হবো
শব্দহীন সুর পাবো, দৃশ্যহীন শিল্প
ব্রহ্মহীন দ্বিতীয় এক ব্রহ্মান্ডে
দ্বিতীয় ঈশ্বর আমি ঠিকই পেয়ে যাবো।
দৌড়াচ্ছি
(পরের জায়গা পরের জমি
ঘর বানাইয়া আমি রই ...)
দৌড়াচ্ছি...
অনবরত দৌড়ে চলেছি
রণে-বনে-জলে-স্থলে
পাহাড়ে-পাতালে-অন্তরীক্ষে
কোথাও এক টুকরো জায়গা নেই
যেখানে দাঁড়াবো;
ভেবেছিলাম নিজের একটা জায়গা হবে
একটা স্পেস হবে একেবারে নিজের
যেমন সবার থাকে-
ডাইনোসর টিকটিকি হলো
মানুষ এলো-
ওরা মূলতঃ গাছ খেত
মানুষ সব খায়
গাছ-মাছ-মাংস
জল-মাটি-পাথর-খনিজ-আয়নস্তর
সব কিছুই মানুষের খাদ্য
সব কিছু আজ যার যার স্বত্ত¡
আপন ভূবনে সকল আপনি মত্ত
আমি আর কোথায় যাবো
এক ¤েøচ্ছ আমি
দৌড়াচ্ছি তাই দৌড়াচ্ছি
দৌড়ে চলেছি অনবরত...
পলাশ সাহা’র কবিতা
[কবি পলাশ সাহার জন্ম নাটোরে, ১৯৭৫ সালে। দীর্ঘদিন ধরে ছোটকাগজ ‘বালুচর’ সম্পাদনা করে আসছেন।]
বনবালক
প্রভাতকালে সূর্যমাখা প্রাণ
হঠাৎ তুমি পালটে দিলে ভ্রমণের জাহাজ,
শব্দে কেন সেই পিপাসা
আগের মত রোদ-রূপসী মুখ।
খুব মেতেছি সেই মুখেতে
আগের আমি আজ হয়েছি বনবালক মন,
ভিতর থেকে বাহির হলো হরিণ উপজাতি
আর এসেছে রুগ্ন জনপদ।
এখন আমি পোড়া পথের রাখাল হয়ে
মায়ের মায়া ঐক্য করি
প্রান্ত থেকে সবুজ এনে
সহজ করি দেহ।
সে সৌন্দর্য হয়ে হয়ে আগুন হাত
বোধের দিকে তীব্রভাবে নীল
জেনেছি আমি, জ্বলেছি আমি
সে মুহূর্ত তোমায় বলি বিন্যাসে অমিল।
জলপথ
শুধু এই জল বিপন্ন হয়ে
পৃথক পৃথক রঙ্গ গড়ে তোলে
ঝরে পরা আমি শহীদ কবরে
এই দেহ নিয়ে দরজা খুলেছি আজ।
বর্ণালী ফেনা মুখোশ হয়েছে
সন্ধ্যার বন্ধন এলোমেলো করে,
নির্ঘুম জল মুক্তির ভাষা জানে
তবু সে বোঝে না সে ছিল আমার পুষ্পের দানে,
অন্যের বুকে ব্যাপক বর্তমান।
কিছু কিছু পথ সোনাবউ হয়ে জমকালো আজ,
উড়ন্ত সব উড়ন্ত শব,
শহর, সমাজ আর মুক্তির মুখ
পুষ্পের গানে ফিরেছে মানুষ
পথ চাই আজ, আর চাই শুধু
পুষ্পের বুকে ছোট্ট একটা কীট।
নাজমুল হাসান’র কবিতা
কবি নাজমুল হাসানের জন্ম নাটোর জেলার দত্তপাড়ায়,১৯৮৪ সালের ১০ নভেম্বর।
সাংবাদিকতা পেশার সাথে জড়িত। বর্তমানে যমুনা টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার হিসাবে কর্মরত। একুশে বইমেলা ২০১৫নদীপ্রকাশ প্রকাশ করেছে নাজমুল হাসানের কাব্যগ্রন্থ ‘মাতাল সূর্য, তোমাকে স্বাগতম’।‘আবহ’ নামে সাহিত্যের ছোটকাগজ সম্পাদনা করেন।
ফ্লাসব্যাক: একাত্তর
এই শহরে কোত্থাও কোন গণকবর নাই
আপামর জনগণ, জনসাধারণের বসবাস থাকলেও
গণকবর নাই।
গণকবর না থাকাটাই একটা খবর, একটা ইতিহাস।
এই শহরে মসজিদ আছে, মন্দির আছে
আছে গীর্জা, প্যাগোডা।
সিনেমা হল, পার্ক, উদ্যান সব থাকলেও
গণকবর নাই।
গণকবর না থাকাটাই একটা হতাশা, একটা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা।
এই শহরে আমরা গণকবর দেখতে চাই
অনুভব করতে চাই সারি সারি লাশের মিছিল
আত্মস্থ করতে চাই রক্তাত্ত বাংলাদেশ।
গতরাতে স্বপ্ন দেখার পর লিখা কবিতা
গতরাতে সে কি মধুর স্বপ্ন
স্বপ্নের মাঝেই ঝরনার গান-পাখির কলতান
স্বপ্নের মাঝেই আবেগ আর আবেশে ডুবে গেছি
গতরাতে স্বপ্নে দেখি সাদা খাতায়
আঁকিবুকি করতে করতে
একটা পরিপূর্ণ আবেগী কবিতা লিখে ফেলেছি
একটি কবিতার আগমনে আমি প্রণোচ্ছল
কবিতা ভূমিষ্ট হওয়ার আনন্দে দিশেহারা
আহারে! কতোকাল কবিতা লিখিনা
যেন যুগ যুগান্তর প্রাণহীন হয়ে আছি
গতকাল স্বপ্ন দেখার পর আবেগে আপ্লুত হলাম
গতকাল স্বপ্ন দেখার পর একটি কবিতা লিখলাম
আতোয়ার হোসেনের কবিতা
[আতোয়ার হোসেনের জন্মনাটোরে। নাটোরের স্কুল-কলেজে লেখাপড়া, প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর। পেশায় সাংবাদিক, একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদ-চিত্রগ্রাহক। চাকরিসূত্রে ঢাকায় বসবাস।]
সোনার বাংলাদেশ
কী মন্ত্রে ওঠে রাগ
কী মন্ত্রে নামে বিষ
কী মন্ত্রে পশ্চাৎ
নিসপিস নিসপিস
সকল দুয়ারে জমে সকালের ধূলা
কূলা ভর্তি হেমন্তের সোনালি ফসলে
আসলে ধূলার মতো তাতানো দুপুরে
ওসব দুয়ারে থাকে কপালের তালা
কালা জ্বরে মরে মাগি মনের ব্যারামে
হেমন্তের বায়ু বায় সমস্ত গেরামে
বায়ুরোগ মনোযোগ কুঁড়ে খায় আস্তে
মাঠ মাঠ কৃষকের কাঁদে হাল কাস্তে
অতপর কূলা থেকে পোক্ত ধানগুলো বাতাস ভেদিয়া পায়ের তলায় পড়ে আর বাঁকানো বাতাসে ওড়ে মুখরা মেয়ের শাড়ি আর উড়ে যায় অযৌন কামনা কী উল্লাসে।
ত্রাসে যেন কৃষকের ঘামগুলো মরে যায়, তেড়ে আসে কালো মেঘ আকাশে আকাশে।
অমন সাধের সোনা
অমন যতনে বোনা
কোণা থেকে কোণায় ছড়িয়ে পড়ে বউ
হেমন্তে পাকে না আর ধান
কোথাও ওড়ে না খোলা হাওয়া
এখন কলকারখানা দেয় ভাত
এখন খোয়াবে খাওয়া-দাওয়া
শাড়ি খুলে কামনার দুর্গা
পূর্বাপর ভুলে মূর্ছা যাচ্ছে
শহরতলির রেস্তোরাঁয়
পুরুষের চর্কিচক্রে চড়ে
এবং কোথায় ওড়ে ধান
এবং কোথায় ওড়ে শাড়ি
এবং কোথায় বেগবান
ঋতুবর্তী সুষমা সুন্দর
এখন বছর ভর্তি চাষ
গণতন্ত্রের উল্লাস আর
ভোটে ভোটে পুলসিরাতের ডাক
এখন ভোটের অধিকার
এখন না-গ্রাম সাধনার
সোনার বাংলাদেশ
চিরায়ত
সমাজে চিরায়ত চড়া
দৃষ্টিভঙ্গির চাকু,
ভিতরে জঙ্গির মনে
যুদ্ধ আঁকু-পাঁকু।
মরদ যোদ্ধার হাতে
ফর্সা সুন্দর দুধ
গুঁজে দিচ্ছে মালিকানা,
আলস্যের বুদ্বুদ।
বাঁশি বাজলে খেলা শুরু
বাঁশি বাজলে খেলা শেষ,
যুদ্ধ ছেড়ে উঠে আসে
সভ্যতার এলোকেশ।
এলোকেশীর হাসি ভালো
জড়িয়ে ধরে চুমু খায়,
হীরা-কী-দাঁত বুকে বুকে
চাকুর মতো ঢুকে যায়।
মাহমুদ শরীফ’র কবিতা
[মাহমুদ শরীফের জন্ম১৩ আগষ্ট ১৯৮৬, নাটোরে। বর্তমানে চাকরিসূত্রে ঢাকায় বসবাস করছেন]
না জীবন, না মৃত্যু
সকলের সকাল হয়েছে
রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন হাসছে
না জীবন না মৃত্যুর রঙে
তুমি সকাল গিয়েছো ভুলে
স্মৃতিগন্ধা তোমার দোলকে
পথভ্রান্ত পাখি ঘুরছে শীতে
সময়ের চিহ্ন গেলে থেমে
সকলের সকাল ফুরাবে।
তখনও কি থাকবে চেয়ে
হয়নি তোমার সকাল ভেবে!
অনেক বৃষ্টির দিনে
অনেক বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি হও তুমি
অনেক বৃষ্টির দিনে বৃষ্টিহীন আমি
রাতের কিনারে যাই অন্ধকারে বসি
অরিবত বাজে যার রাত জাগা হাসি
সেই হাসি ওঠে কেঁদে জীবন অবধি
তোমার মুখের মতো তার মুখ ভাবি
অনেক বৃষ্টির দিনে নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়
তোমার না ফেরা মুখ না ফিরে চমকায়
রাতের কিনারে বসে অন্ধকারে থামি
কুণ্ডুলি পাকানো ঘোরে অশ্রুঝরা হাসি
আলোমেঘে মুছে গেলে রাতের আঁধার
তোমার মুখের মতো সকাল আবার
অনেক বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি হলে আমি
অনেক বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি হওনা তুমি