অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন : পর্ব ০২
Post date: Jun 11, 2018 5:52:09 AM
অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন : পর্ব ০২
সাইটে প্রবেশের জন্য আপনাকে স্বাগতম। এটি অলস দুপুর ওয়েবম্যাগের একটি অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন। এই সংকলনে বাংলাদেশ ও ভারতের নানা প্রান্তে যারা দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্য চর্চা করে চলেছেন, লিটলম্যাগ চর্চা করে চলেছেন, তাদেরকে বিশেষ ভাবে স্থান দেয়া হচ্ছে। আমরা জানি যে পুঁজিবাদের বিকাশের প্রক্রিয়াটিই এমন যে ইটের নিচে সবুজ ঘাস চাপা পড়ে যায়। আমরা প্রশান্তির জন্য দিগন্তের দিকেই তাকিয়ে থাকি।
অলস দুপুর সেইসব কবিদেরই খুঁজে চলেছেন। যারা নিরবে কাজ করে যাচ্ছেন, কোন এক দূরে বসে লিটলম্যাগ চর্চা করে চলেছেন বছরের পর বছর। সন্ধ্যায় জোনাকির মত তার চোখও জ্বলে ওঠে নতুন কবিতায়। সেই সব নতুন কবিতাকে খুঁজে চলেছে অলস দুপুর।
অনলাইন কোন স্থান নয়। ইন্টারনেট মানে বিশ্বের যে কোন প্রান্তের সাথে যুক্ত আপনি আমি। এখন আমি আপনি বিশ্বের যে কোন প্রান্তের কবিতার সাথেও যুক্ত। কিন্তু প্রান্ত তো আছে। যে এসে মিলিত হয় মুক্তির সাথে। অলস দুপুরের কাছে জেলা হচ্ছে এক একটি প্রান্ত, যে যুক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত শুধু বাংলাদেশ নয়, বাংলা কবিতা নয়, বিশ্ব কবিতার সাথে। আমরা অলস দুপুরে বাংলাদেশ ও ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কবিদের কবিতা এই আয়োজনের মাধ্যমে পাঠকদের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি।
সংকলন পদ্ধতি: একজন মূল সম্পাদক থাকেন। মূল সম্পাদক থাকবেন দুপুর মিত্র। বিভিন্ন জেলা থেকে একজন অতিথি সম্পাদক নির্বাচিত করেন। অতিথি সম্পাদক তার জেলা থেকে কবি নির্বাচিত করেন এবং তাদের কাছ থেকে কবিতা সংগ্রহ করে মূল সম্পাদকের নিকট প্রেরণ করেন। প্রতিটি পোস্ট এক একটি জেলা বা প্রান্তের সংকলন হিসেবে গণ্য হবে। যিনি অতিথি সম্পাদক থাকবেন তার সম্পাদনা নিয়ে একটি ছোট সম্পাদকীয় থাকবে। এভাবে ছোট ছোট সংকলন মিলে একটি বড় সংকলন হবে।
যাদের কবিতা সংকলিত হবে
১. দীর্ঘদিন ধরে লিটলম্যাগে জড়িত
২. বিভিন্নজেলায় বসবাসরত
৩. সাহিত্যচর্চায় নিয়মিত
সংকলনটি চূড়ান্ত নয়। বিভিন্ন সময় এটি আপডেট হবে। সংকলনটি সমৃদ্ধ করতে পাঠকের প্রস্তাবনা ও মন্তব্যকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। প্রস্তাবনা বা মন্তব্য জানান mitra_bibhuti@yahoo.com এ।
অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন: ০২ পর্বের অতিথি সম্পাদক কবি রাজীব আর্জুনি। তিনি কবিতা সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে ‘অলস দুপুর’ ওয়েব ম্যাগাজিনকে সহায়তা করেছেন। তার প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা।
রাজীব আর্জুনির সম্পাদকীয়:
কবিতা নাকি চিত্রকলা? কোনটা আদিতে? এনিয়ে অনেক মতভেদ থাকলেও কবিতা যে জীবন সংহারকারী কোনো বস্তু বা বিষয় নয় এ সত্য। এখন তো দেখি সত্যও অধিকসত্য হয়ে উঠে! অধিক সত্য হয়ে উঠার প্রবণতা আসলে কেমন? কবিতা কি শুধু ভাষাকেন্দ্রিক নাকি, ভাবকেন্দ্রিক, শব্দকেন্দ্রিক নাকি নন্দন তত্তের প্রপাত তারও জটলা রয়েছে।
পৃথিবী ছন্দপ্রবণ। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় পৃথিবীটা চলছে একেকটা বিট বা রিদমের উপর। প্রচলিত ছন্দ বা ছন্দজ্ঞান কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ন অনুষঙ্গ কিন্তু তা একমাত্র নয়। এনিয়ে পৈতাপনা খুব কি শ্রেয়তর?
লেসবস থেকে সাফো, আন্দালুসিয়া থেকে লোরকা, মার্তিনিক থেকে স্যাজায়ার,মোড়াইল থেকে আল মাহমুদ, কিংবা পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিনয় এঁরা সবাই বিশ্বের কবি। আদতে শুরু তো তাঁদের মাটি থেকেই। প্রিয় পাঠক, চলুন কবিতায়। এবারের পর্বে রয়েছে নেত্রকোণা|এনজয়!
জুয়েল মাজহার
জন্ম ১৯৬২ সালের ২০ জানুয়ারি। নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া থানার গড়াডোবা ইউনিয়নভুক্ত সাখড়া গ্রামে। পিতা মুকদম আলী, মা বেগম নূরজাহান (সরু)। দুজনই প্রয়াত। বিবাহিত। বন্ধু শিরিন সুলতানা ও পুত্র অর্ক মাজহারের সঙ্গে থাকেন ঢাকায়। বর্তমান পেশা সাংবাদিকতা। লেখেন মূলত কবিতা, বিচিত্র বিষয়ে প্রচুর অনুবাদও করেন।
প্রকাশিত কবিতার বই:
----------------------
দর্জিঘরে একরাত: প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৩, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।
দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, প্রকাশক শুদ্ধস্বর, ঢাকা।
মেগাস্থিনিসের হাসি: প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৯, বাংলা একাডেমী বইমেলা। বাঙলায়ন প্রকাশনী, ঢাকা।
দ্বিতীয় সংস্করণ: ফেব্রুয়ারি ২০১৫। বাংলা একাডেমী বইমেলা। প্রকাশকশুদ্ধস্বর, ঢাকা।
দিওয়ানা জিকির: ফেব্রুয়ারি ২০১৩। বাংলা একাডেমী বইমেলা। প্রকাশক শুদ্ধস্বর, ঢাকা।
প্রকাশিত অনুবাদগ্রন্থ:
----------------------
১.কবিতার ট্রান্সট্রোমার
(টোমাস ট্রান্সট্রোমারের বাছাই করা কবিতার অনুবাদ সংকলন), প্রকাশক শুদ্ধস্বর; বাংলা একাডেমীর ফেব্রুয়ারি বইমেলা,২০১২।
২.দূরের হাওয়া, ২০০ বিশ্বকবিতার অনুবাদগ্রন্থ। প্রকাশক চৈতন্য প্রকাশন, সিলেট। বাংলা একাডেমি ফেব্রুয়ারি বইমেলা, ২০১৬।
ইমেইল ঠিকানা: bn24jewel@gmail.com
সেলফোন:01 76 78 03 731
জুয়েল মাজহারের কবিতা
মেগাস্থিনিসের হাসি
নি:শব্দ কামানে তুমি একা বসে ভরছো বারুদ।
শীতকাল গেল;
নি:শব্দ কামানে তুমি একা কেন
ভরছো বারুদ?
আমি ভাবছি:
মেগাস্থিনিসের হাসিও কি মেগাস্থিনিস?
শক্তিচালিত এই তামাশার মধ্যে বহু
বাদামি ঘোটক উড়ে যায়
--এঞ্জিনের শব্দ আর রোবটের কাশি শোনা যায়।
নি:শব্দ কামানে তুমি এখনো কি ভরছো বারুদ?
চিরাং বাজারে কান্দে চান্দ সদাগর
১.
নিজের চেহারা দেইখা কেন্দে ফ্যালে চান্দ সদাগর!
কেনে কান্দে নিজেই জানে না।
সদাগর ঠাউর পাইতে থাকে ধীরে ধীরে
কেউ তারে দিয়া গেছে দাগা
কেউ তার সিনার ভিত্রে চুপে
রাইখা গেছে সুতানলি সাপ
আর তার চাইর পাশে যা-যা আছে সবই
কুহকের ফাঁদ আর মায়ার ছলনা।
কতো কী যে স্বপ্নে তারে ডাকে:
ডেউয়া-ডেফলগাছে শাঁসভরা শরমিন্দা ফল
জংলার ভাঁটফুল বাতাসে দোলায় লাল খোমা
তেঁতুলের ডালে বসা গিরবাজ একটা কৈতর
পুঁতির লাহান গাঢ় লালচক্ষু ঘোরায়া ঘোরায়া
কী মোহে যে অপলক তারে চায়া দ্যাখে!
নিঝুম দুপুইর বেলা সদাগর স্বপ্ন দ্যাখে ঝিমায়া ঝিমায়া
স্বপ্নে তার আলিশান প্রাসাদের ছবি ভাইসা ওঠে
সেইখানে লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে বেহুলারে
পুত্রবধূ কইরা আনলো পরম আদরে
শতশত ডিঙা আর সুবর্ণ পসরা লয়া
দিলখোশ সে ভাসে সায়রে
না ডরায় মনসারে, হেন্তালের লাঠি দিয়া
পিটায়া সে সিধা করে দেও-দানো-পেত্নী আর
ছদ্মবেশী ভয়ানক আজদাহা সাপ
সে ভাসে ঢেউয়ের ফনা মুঠা কইরা ধইরা ভয়হীন
রাশিরাশি সোনাদানা হীরাপান্না মরকতমণির আশায়
২.
কিন্তু তার স্বপ্ন ভাইঙ্গা যায়! তার উদলা পাছায়
ছিঁড়া লুঙ্গি, পেটে নাই ভাত!!
দয়াহীন কারিগরে কি দিয়া যে বানাইছে তারে
লুলা-ল্যাংড়া হয়া তার দিন কাটে চিরাং বাজারে!!
তদুপরি হায়, হায় রে হায়!
পিঞ্জিরার মতো তার বুকের খাঁচার ভিত্রে
পাখি এক দিগদারি করে
নিজের মনের দুঃখে একলা বাইদের পাড়ে
বইসা তাই কান্দে সদাগর
যেরকম বিহানে-বৈকালে কান্দে বেক্কলে-আবালে।
গায়ে ধুল মাখে আর পইসা-নাই-খালি-জেবে
হাটবারে গিয়া হাটে সারাদিন পুটকি নাচায়!
(২৪মে, ২০১৮)
দর্জিঘরে এক রাত
শূন্যতা বল্লম এক, গেঁথে আছে দর্জিমহলে!
রাশি রাশি বস্ত্র ফেলে দর্জিদল গোপনে উধাও;
শুধু দেয়ালের গলদেশে ঝুলে আছে
একটি পুরনো ঘড়ি; --মৃত!
দশবস্ত্রে-দিগম্বর বেশ্যার ইশারা আজ মেঘেতে উত্থান!
তাই, লক্ষ শিশ্ন হাতে চেপে দর্জিদল মেঘে ধাবমান!
শৃঙ্গারের গোলাপি আরকে আজ প্রতিপার্শ্ব ঢাকা;
আঁধারে ঝর্নার মতো বেজে ওঠে গণিকামহল।
সবুজ প্রিজমে আমি চোখ রেখে সবকিছু দেখি:
দর্জিদের অনুপস্থিতির এই দীর্ঘ অবসরে
আতশি কাচের গুঁড়ো জড়ো করে চুপে
ঢেকে রাখি ফাঁকফুঁক, দর্জিঘর, ঘড়ি ও জানালা।
রাইতের নীল ডহরে
আমারে তুইলা নায়ে রাইতে কারা লয়া যায় বিলে?
তেনাদের খোমাটোমা কিছু নাই। চউখ-মুখ নাই।
মুখের বদলে দেখি, শাদা কাপড়ের তিনখান ত্যানা
লড়েচড়ে আলগা বাতাসে। আর, আজগুবি নাও
নীল ডহরের জলে চেলচেলায়া-কলকলায়া চলে।
খাগড়ার আড়ালে এক কুড়া পাখি লেঞ্জা উঁচায়া কারে ডাকে?
ছর্রা গুলির লাহান বেবাক মাছেরা, দেখি, লাফায়া-ছিটকায়া-যায় দূরে ;
পশ্চিমে জাঙ্গাল আর দক্ষিণে গোপাট ; বুগলে বাইদের জলে
গোপনে সিনান করে লেংটা চান্দের গোল খুবসুরত খোমা;
এইসব তেলেসমাতি দেইখা ভাবি:
আমি ক্যান এইখানে আইজ?
হুমুন্দির পোলারা ক্যান মাইঝ রাইতে
তুইলা আনলো এই নীল ডহরে আমারে?
পথভুলাইন্যা কানাঅলা? পরিটরি নাকি এরা পেরতের দল?
শইল্যে হাতায় কেডা? অজাগায়-বেজাগায়
লড়ে কার হাত আর খবিস আঙ্গুল?
ডর পায়া বোবা হয়া মিচকা মাইরা থাকি আমি চুপ!
আখেরে মালুম হয়: এইটা হৈল রাইতের লিলুয়া বাতাস
এই চান্নি রাইত, এই ফুরফুরা মিহিন বাতাসে কত-শত
কাঁইপা ওঠে সরালির-মরালীর ছতরের উদলা পশম।
জলের কৈতরগুলা পাঙ্খা নাড়ে বৈতলের মতো;
পাখনার আওয়াজে তারা ভইরা তোলে সাত আসমান।
কি কারণে কালবাউস, তিতপুঁটি, খইলসা-কই, উগোল-মাগুর
পানি থিকা ফাল মারে। মিশ্যা যায় পানিতে আবার!
শরতের চান্নি রাইতে মাছগুলা কী কারণে হৈল বেচইন?
মাছ দেইখা আহে উদ, আহে গুই গাতুম-গাতুম;
আহে ফেউ একলা আর দল বাইন্ধা খাটাশের দল;
গর্ত থিকা--হুক্কা হুয়া--খেঁকশিয়াল লাঙ্গুল উঁচায়া খেমটা নাচে!
ঘুরায়া-বেঁকায়া ঘাড় পেঁচা চায়া দ্যাখে;
কড়ুই গাছের উপ্রে বইসা এক ভেটেরান চিল
মাথার ভিত্রে তার আঁকতে আছে
প্রি-এম্পটিভ স্ট্রাইকের ভয়ানক ছক;
তারা য্যান অন্য কোনো মহাভারতের যুদ্ধের ভিতর থিকা
জন্ম লইতে থাকে ধীরে ধীরে; জন্ম লইতে লইতে নিজেগোর
বেশুমার আগামী যুদ্ধের ভিত্রে বইসা ধীরে নিশানা সাজায়;
অর্জুনের তীর হয়া, অব্যর্থ আয়ুধ হয়া, কিরাতের বাঁকনল হয়া
শানদার ঠোঁটে-নখে কখন যে আসবে নাইমা তারা
ফাল-পাড়া মাছেদের ঝাঁকে আচানক!
অহনে অনেক রাইত। একলা আমি তেনাদের লগে
নাও-ভাসা হয়া চলি।কই যাই কোন দিকে কিছুই জানি না
জানি এই আজিব রাইতের ভিত্রে আছে আরো রাইত;
আমার ভিত্রে আরো কতো-কতো আমি
বাইদের ভিত্রে আরো কতশত বাইদ রয়া যায়!
নাই শুরু নাই শেষ। এক আলাহিদা শুরু ও শেষের ভিত্রে আমি;
একা আর শতশত আমি। শতশত বিলে-বাইদে,
শতশত হাওরে-সায়রে আমি শতশত ‘আমি’হয়া ভাসি।
সেইসব নায়ে মাঝি নাই। আমি আর আমার বুগুলে তিনজন;
তেনাদের খোমাটোমা কিছু নাই। চউখ-মুখ নাই।
মুখের বদলে দেখি, শাদা কাপড়ের
তিনখান ত্যানা খালি লড়েচড়ে আলগা বাতাসে!
বীতশোক ফিরে এসো
১.
বিকেলের করোটিতে সন্ধ্যারাগ ঢেলেছে আগুন;
জ্যোতিরথে চোখ রেখে চেনা পথ শান্ত পায়ে হেঁটে
নিজেকে শুনিয়ে কোনো গূঢ়কথা, গোপন মর্মর
বীতশোক, চলে গেছে। পশ্চিমের প্রত্যন্ত প্রদেশে।
আমার ‘সামান্য ক্ষতি’?–বিপর্যয়! খসে পড়ে ফল!
বহুঘুম-রাত্রিব্যেপে অনৃত ঢেউয়েরা!—তরী ডোবে!
২.
পুরাতন বিষণ্নতা, গোপনে যে আঙুরলতায়
ফল রূপে পেকে ওঠে, সারারাত তস্করের ভয়ে,
শুষ্ক তৃণে ঢেকে তারে সযতনে দিয়েছে প্রহরা।
৩.
প্রত্যহের দুঃখ-দৈন্য বেদনা ও ক্লেশে–- হয়তো সে–
বসন্ত-রুধির এনে চেয়েছিল কিছুটা মেশাতে;
–যেন নীল প্রজাপতি এসে তার কাছে চায় মদ;
অধীর মক্ষিকা শুধু দ্রাক্ষা মেগে উড়ে উড়ে চলে।
৪.
সন্তর্পণে একা বসে পানপাত্রে দিল সে চুমুক;
লম্বা ঢোঁক গিলে নিয়ে স্তনলোভী শিশুর নিয়মে
আলগোছে মৃগনাভী ভরেছে উদকে–স্বার্থপর!!
‘শিশির-চোঁয়ানো রাতে, মধ্যদিনে দহনের শেষে’
অন্যরা ঘুমিয়ে ছিলো?—এ-সুযোগে হলো সে কর্পূর?
৫.
হেমন্তের মঞ্চ থেকে গরুড়ের ছড়ানো ডানায়
অতর্কিতে চড়ে বসে শরীর সারাতে গেছে–দূরে।
কত দূরে? কাউকে বলেনি; শুধু উপশমহীন
অনন্ত গোধূলিপথ ছেয়ে আছে হলদে পাতায়!
–এই তবে গূঢ়লেখ?বৃথা তব নর্তকী ও মদ ?
৬.
বীতশোক, তুমি আছো! অনন্ত পশ্চিমে নাকি পূবে?
অসম্ভব ভুলে থাকা; লিথিজলও স্মৃতিসমুজ্জ্বল!
অফুরান দ্রাক্ষা থেকে অন্ধকার প্রশীর্ণ আঙুলে
নিজের ভিতরে, চুপে, শমদায়ী পেড়ে আনো ফল?
৭.
বিকেলের করোটিতে সন্ধ্যারাগ! জ্বলছে আগুন!
ফিরে এসো সেই পথে;–ঝরাপাতা-মুখর সরণি–
কিছুটা যবের মোহে, কিছু প্রেমে, শর্করার টানে।
৮.
উপশম হলো ব্যথা? পিঞ্জিরার ভেতরে পাখির?
দ্রুত তবে চলে এসো, পরিত্যক্ত আঙুরের বনে;
অনন্ত গোধুলিপথ ভরে দিয়ে পাতায়, মর্মরে।
রুবিকন
আমার সামনে এক রুবিকন, পুলসিরাত, ভয়ানক ক্রূর অমানিশা
এর সামনে একা আমি;
কিস্তিহীন, নিরশ্ব, রসদহীন
পিগমিদের চেয়ে ছোটো আমি!
আর আমার ভাঙাহাড়, থ্যাঁতলানো খর্বকায় দেহের ভেতরে যতো
রক্ত-পিত্ত-কফ-থুথু-বীর্য-লালাসবই
অসীম বরফে-হিমে গ্রানিটের মতো ক্রমে হতেছে জমাট;
আর ওই থেকে-থেকে ফুঁসন্ত ব্লিজার্ড এক,
আর এক আনক্যানিকরা লহিমানী
আমাকে আদ্যন্ত ঘিরে আছে।
সান্নিপাতিক হেতু নাসিকার ছিদ্র বেয়ে
চোখ বেয়ে যে-জলগড়ায় আর মাটিতে পড়ে না;
শূন্য থেকে বর্শা হয়ে সিগ্নি ঝুলের য়যেননর্স দেবতার!
সারিসারি শতশত বল্মীকূট পেছনে আমার।
তাদের আড়ালহ’তে জুলজুল চেয়ে থাকে লোম-কর্ণশিবা।
লোলজিভ, অভ্রংলিহ জিভ নাড়ে মেদুসা-মনসা আর কালী।
আমার তরবারি নাই। তাই
দু’হাতে নখর আমার তরবারি!
আমি কি ডরাবো?
না, আমি ডরাবো না।
অসীম হিম্মত লয়ে এক পায়ে হয়ে আছি খাড়া।
কিস্তিহীন,শস্ত্রহীন, নিরশ্ব, রসদহীন—আমি একা;
পিগমিদের চেয়ে ছোটো আমি।
আমি ফুঁ দিচ্ছি হাপরে আমার।
আমি আমাকে বলছি: ওঠো, জাগো!
আমার অশ্ব নাই।
এক দুর্বিনীতাশ্ব জন্ম নিচ্ছে ভেতরে আমার।
থ্যাঁতলানো ভাঙা পায়ে আমি লাফ দিচ্ছি। আমি সাঁতরে চলেছি
আমার আয়ুর চেয়ে দীর্ঘ এক গন্ধকের নদী।
আমি ভেদক’রেযাবো ক্রূর অমানিশা
আমি জয়ী হবো
আমি পার হবো রুবিকন!!
দিওয়ানা জিকির
১.
আমারে পড়বো মনে, জানি তুমি, ডাকবা আমায়
খাড়া-সোজা-উপ্তা হয়া দিওয়ানা জিকিরে অবিরাম;
বাঁশের ঝিংলা দিয়া, জালিবেত-সুন্ধিবেত দিয়া
কানমলা দিয়া মোরে আর কতো করবা প্রহার।
আমি এর প্রতিশোধ নিব ঠিক। খাল-বিল-নদীনালা বাইদ
পার হয়া চলে যাব একশো ক্রোশ দূরে একদিন।
যেন, কনফুসিয়াসের স্বপ্নে বিভোর কোনো চীনা
সারাদিন একা একা খালেবিলে কিস্তি ভাসায়
২.
ডাকবা আমারে তুমি লুকায়া লুকায়া একদিন!
যেন এক ভেকশিশু, হাইঞ্জাকালে কচুর বাগানে
ডর পায়া, চিল্লায়া, মায়েরে একলা তার ডাকে।
যেমতি বাদলা দিনে পাইতা মোরে হাকালুকি হাওরে হাওরে
সাড়া তবু পাইবা না। যেনো বোবা কালেঙ্গাপাহাড়
চুপ মাইরা বইসা রবো; আর দেখব তোমার জিল্লতি
যত জোরে ডাক পাড়ো কোনোদিন পাবা না আমায়।
লক্ষ ক্রোশ দূরে গিয়া তোমা হতে থাকব স্বাধীন!
খেলব, খেলার ছলে একা বসে তাস সারাদিন।
৩.
আমারে খুঁজবা তুমি হবিগঞ্জে, তেকোনা পুকুরপাড়ে,
মিরাশির মাঠে আর উমেদনগরে,
করবা তালাস চুপে পুরান মুন্সেফি আর বগলা বাজারে।
দুই হাত উঁচা কইরা হাঁক দিবা যেন ক্যানভাসার:
চিফ রেইট,
দুই টেকা,
হলুদি ব্যাটাটা!
৪.
বেফিকির উড়াধুড়া আমি এক ফকিন্নির পোলা
আন্ধা-কানা ঘুইরা মরি লালনীল স্মৃতির বাগানে;
চান্নি-পশর রাইতে জারুলের নিচে বেশুমার,
আবালের সর্দি যেন অবিরাম ফুল ঝরে পড়ে
৫.
মগরা নদীতে আর লাফুনিয়া-কইজুরি বিলে
তোমার নাকের মতো বেঁকা ঘোলা জলে নাও লয়া,
মনভরা গোস্বা লয়া, পেটভরা ভুক লয়া আমি
অলম্ভুত কালা বাইদে ভাইসা রবো একলা স্বাধীন।
যেন আমি বাচ্চা এক উদ
খিদা লাগলে উপ্তা ডুবে আচানক কালবাউস ধরে
কুশার-খেতের ভিত্রে বইসা খাব ফুর্তি লয়া মনে;
৬.
আসমানে লেঞ্জাহাঁস উইড়া চলে হাজারে-বিজারে
চিতলের পেটি যেন কলকলাবে সামনে ধনুগাঙ;
তার বুকে ঝাঁপ দিব, করবো আমি সেখানে সিনান
৭.
আমারে না পায়া যদি নিজের জাগ্না চউখে মাখো তুমি নিদ্রাকুসুম,
আমি তবে পুটকিছিলা বান্দরের মতো
বসে রবো চুপচাপ
বদ্যিরাজ
গাছের
আগায় !!
মাহবুব কবির
জন্ম ১৯৬৮ সালের ২ জুন নেত্রকোনা শহরের দক্ষিণ নাগড়ায়। পেশায় সাংবাদিক। একটি জাতীয় দৈনিকে কর্মরত। স্ত্রী সুলতানা চৌধুরী ও কন্যা ব্রাহ্মী কবিরকে নিয়ে ঢাকায় বসবাস। প্রকাশিত কবিতার বই : কৈ ও মেঘের কবিতা (১৯৯৬), ফুলচাষি মালি যাই বলো (২০০৯), বেসরকারি কবিতা (২০১২), আয়নার দিকে (২০১৫), নির্বাচিত কবিতা (২০১৬), মীন ও মেশিন (২০১৮)। সম্পাদিত গ্রন্থ : নব্বইয়ের কবিতা (১৯৯৯), উকিল মুন্সির গান (২০১৩)। সম্মাননা : লোক সাহিত্য পুরস্কার (২০১২)। মোবাইল : ০১৭১৮৬১০৫২৪। ই-মেইল kabir_mahbub@yahoo.com
মাহবুব কবিরের কবিতা
আমার কবিতার বই
তোমার শিয়রে আমার কবিতার বই।
কবিতার ভেতরে চুপচাপ শুয়ে থাকি আমি।
কবিতার ভেতরে শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে নির্নিমেষ
তোমার সংসার দেখিÑ
তোমাদের সংগম দেখি, শীৎকার শুনি।
তুমি ক্লান্ত। ঘুমিয়ে পড়েছ।
তোমার বুকে আমার খোলা বইÑ
তোমার বুকে আমি কান পেতে রই।
আমাদের জার্নি
অনেক বছর ধরে আছি ইনসমনিয়ায়।
আর তুমি রিকশায় যেতে যেতে ঘুমিয়ে পড়ো,
কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ো,
সংগম করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ো।
আর আমার পাশ দিয়ে অবিরাম ছূটে চলেছে একটি অতনু ঘোড়া।
ধূলি উড়িয়ে কোথায় চলেছে সে?
কী অদ্ভুত জার্নি আমাদের- হে সড়ক, হে ছায়ামূর্তি!
চর দখলের দেশে
খুনি পরিবারের সন্তান আমি খুনি হতে পারি নাই-
রক্ত দেখলে ভয় পাই।
আমার বাপ ডাকু সর্দার, চাচারাও ডাকু।
লাঠিয়াল সর্দারের মেয়ে আমার মা।
চৌদ্দগুষ্টি মিলেও আমাকে লাইনে নিতে পারে নাই।
এই চর দখলের দেশে- তৃণভোজী কবি আমি।
আমার হাতে টেঁটা নাই, বল্লম নাই, আছে শুধু কবিতা।
ডাকু চাচার মেয়ে তো কবিতা বোঝে না।
ভূতু
ছোটবেলায় ভূতের সঙ্গে আমার গভীর বন্ধুতা ছিল।
দুজনে মিলে অনেক দুষ্টামি করতাম-
ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে যেতাম,
খেলতে খেলতে একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়তাম।
একবার ঘুমের মধ্যে হিসু করতে করতে
আমরা কাটাকাটি খেলছিলাম।
একসময় স্যাঁতসেঁতে অনুভবে জেগে দেখি-
বিছানা ভেসে গেছে।
সকালে মা ডেকে বললেন, তোর নুনু কেটে দেব।
নুনু কাটার ভয়ে সেই ভূতুকে হারিয়ে ফেলি আমি।
কতকাল তাকে দেখি না।
ভূতু তুই আজ কোথায়?
তোর সঙ্গে জঙ্গলে হারিয়ে যেতে মন চায়।
আফালের দিন
ঝুমাঝুম বৃষ্টিদিনে তুমি গেলা কই?
কাঁথা মুড়ি দিয়া আমি কুড়ে হয়ে রই।
ফড়িয়া এনজিও হাওরে ভাটিয়ালি শোনে-
সে বুঝিবে কী বিরহী উকিলের গানে?
টাকা ছাড়া চাকরির আজ খ্যাতা পোড়ো-
আফালের ঢেউ হয়ে এই বুকে আছড়ায়া পড়ো।
মেঘের গাঁজানো মদে মাছের খলবলানি শোনো-
বানা-পাতা ফাঁদে ঝপাঝপ কোঁচ হানো।
সরোজ মোস্তফা
১৯৭৬ সালের ১১ ডিসেম্বর নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন। বাংলায় স্নাতকোত্তর এবং বর্তমানে একটি কলেজে অধ্যাপনা করছেন।
তিনি 'অনুধ্যান ' নামে একটি লিটল ম্যাগ সম্পাদনা করেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'সকাল সন্ধ্যার বীজতলা' ২০১০ সালে ফেব্রুয়ারি বই মেলায় বের হয়। পরবর্তীতে‘কাগজে সমুদ্র লিখি’ও ‘হলুদ খামের হিমঘর’কাব্যগ্রন্থ দুটি প্রকাশিত হয়। ২০০০সালে তাঁর সম্পাদনায় ( দৈত সম্পাদনা) 'হট্টিটি গুচ্ছ 'নামে একটি কাব্যসংকলন বের হয়। লিখেছেন অক্ষর, মস্তক, ঝড়, চৈতন্যসহ আরো বিভিন্ন লিটলম্যাগাজিনে।
সরোজ মোস্তফার কবিতা
হিজল
হিজল মূলত জলবৃক্ষ!
শৈশব থেকে দেখছি
পুঁথি প্রেমিকের ওস্তাদিটা এই বৃক্ষ মনে রাখে।
নামানো মেঘের পৃথিবীতে ওর ইস্কুলটা সবুজ!
দরদ মাখানো মুখটা মা মনসার পুঁথি !
গোখরো বন্ধুর বিষচিহ্ন ও মনেও রাখে না!
ওর দিলের ভেতরে ধানকাটা ভাগীদের মুখ!
হাটগামী প্রেমিকের ঠাণ্ডা রুমালটা ডালে বেঁধে
ও কয়েক শতাব্দী বাঁচবে!
ধানের মোটা গুছির পাশে আইর মাছের হাসি!
হাওরফসলে ওর সুখ!
শ্যালো মেশিনেরনৌকা,
নাইয়োরির বাদাম উড়ানো বাতাসে
ওর ইস্কুলটা থাকে!
তরমুজ
মরা ঈগলের পাশে
পারফিউম মাখানো সন্ধ্যাটা
কাহিল করেছে খুব!
চৈত্রের ফাটা ভূমিতে
জলের গেলাস হাতে পিতা খাচ্ছে ভাত ।
খানিকটা দূরে পৃথিবীটা ডাউনলোড করছে জমির মালিক!
ফসলের মাঠ ঘুরে
সূর্যমাখা মগরায় হাতমুখ ধুয়ে
আব্বার কোচকানো পাঞ্জাবিতে সুবাস মাখতে থাকি !
ক্ষেতে দুই জাতের তরমুজ বুনেছি
পুঁজির বাজারে তার নাম র্যাব কিংবা বাংলালিংক।
বিউটির ওর্নার ভেতরে
গ্রামবাসীর গজলে
ব্যাধিঘরে বেগুন পুড়ছে!
পুরুষ কামড়াচ্ছে গোলাপ! চৌষট্টি পাপড়ি!
বিউটির ওর্নার ভেতরে হাওরের ধান!
বিউটির ওর্নার ভেতরে সূর্যের আক্ষেপ!
বিউটির ওর্নার ভেতরে স্কুল শিশু, বাদাম ক্ষেতের ঢেউ!
ধান-হিজলের তলে
পিতার চোয়ালেমেয়ের কবর!
গজল গায়ক কাঁদে!
কান্নায় ভিজেছে মাটি!
মানুষ ভিজেনি!
রেপসিন
জেন্ডারবাদের মাফিয়াও দেখতে চাইছেরেপ সিন
বিউটি ধর্ষণের ভিডিও!
পান চিবানো কথায় ভূমিতে উড়ছে রেপসিন!
নরম গোধূলি, কী ভাবে বন্ধ হবে যৌনসন্ত্রাস।
সূর্যমুখি ফুল নোয়ানো মাথায় বিচার চাইলে
থানার দারোগা সান্ত্বনা দিচ্ছেন!
ডুমুর গাছের কান্না
কৃষকের পিঠে চাবুক বসানো প্রভুবৃন্দ পালিয়েছে!
নাঙল কান্নার
দুঃখিত নিঝুম জমিদার বাড়িগুলো আছে।
ইটের ফাটলে বট পাতার কাঁপন দেখছেন
রাষ্ট্রের রাজস্ব কর্তা 'এসি ল্যান্ড'।
প্রাচীন বাড়িতে ডুমুর গাছের কান্না!
প্রভু পালানোর পর
এখানেই প্রেম করছে
পাড়ার মহুয়া আর স্মিত চাহনির সূর্য!
সমতলে
সমতলে বধ্যভুমি
হরতকি ও নয়নতারা।
বন্দুক কোম্পানি থাকবেই।
শামুক জীবন নয়
পাখি জীবনে আসুন!
জাদুকাটা তীরে
জাদুকাটা তীরে বালির প্রদীপে
করলা ফুলের দেশ!
খোঁপার শিমুলে হর্ষ
জল রমণীর প্রতিবেশ!
শোন, মাজারের গান!
শোন, দোতারার সুরে
ভেসে আসছে আকাঙ্ক্ষা,
বাঁধ ভাঙা হাওরের গান
কৃষক ভাইদের পরাণ।
দেহেই রেখেছি কথা!
চামরার ক্ষতে সিলগালা দেহের পিপাসা।
মনের পাতালে কথা নেই
কথা নেই মাটির কলসে
উনুনের চারপাশে ভাতের বলক
ঋণ গ্রহীতার পাশবই!
তুমি কাকে বিশ্বাস করবে!
কড়ই গাছের মাথায় ঝুলে থাকা পুরুষটি
ভেজা বকুলের ঘ্রাণে শুয়ে থাকা মহিলাটি
কালো ব্যাগের ঐ সমিতির লোকটিকে দেখে
খেয়েছে বিষের শিশি!
মেহেদি-গোলাপে সাধুর লণ্ঠনে
তাজা তাজা দিলফুল
ব্লু ম্যাপের জিজ্ঞাসার রাতে জেগে উঠে নিজের মূহূর্ত!
আকাশ নূপুরে, ক্যালেণ্ডারের পাতায় তাচ্ছিল্যের রেণু!
দোতারার সুরে
রুটি হালুয়ায় মানব ফুটেছে!
খাকি শাসকের চেয়ে নিমগাছ প্রিয় এই দেশে
জন্মেই শুনেছি 'জগৎ সার্কাসে তুমিও হরিণ'!
জাদুকাটা নদীতে পা ধুয়ে
ডাঙায় উঠবে!
অনিন্দ্য জসীম
জন্ম: ০১-০৫-১৯৭২ গ্রাম- বন্দ সাংসা, পোঃ কাকৈরগড়া, দুর্গাপুর, নেত্রকোণা। পিতা- মোঃ ফজর উদ্দিন সরকার । মাতা- জহুরা বেগম।
প্রকাশিত বই:
১. চন্দ্রাবতীর কয়েকজন সন্তান ১৯৯৭( বার কবির যৌথ) ২.মাতালের রাত্রি যাপন ২০০১ ৩.নদী মাতা যার ২০০৮
অনিন্দ্য জসীমের কবিতা
পরকীয়া
তার সাথে আমার গোপন প্রেম
আমরাদের ব্যক্তিগত বৌ ও স্বামী আছে
ফুল পাখি পাল তোলা নদী আছে যার যার নিঃসঙ্গ আঙ্গিনায়
দুঃখ ও অপ্রাপ্তি আছে শূন্যতার চারপাশ ঘিরে
মনের দুচালা বারান্দার টবে একটা গোলাপ চারা
একান্ত সুরভীময়, যা আমাদের বৌ বা স্বামীকে উই জানেনা,
জানবেও না কখনো।
দূরে এক চক্ষু হরিণের ডাক
কাছে আসতে আসতে ক্রমশ রিলিন
আমাদের মাঝখানে
আরো দূরে নড়বড়ে একটা পুরনো সাঁকো
চৈত্রের শুষ্কতা নিয়ে তৃষ্ণার্থ মাছরাঙার ঠোঁট
ব্যর্থ শিকারির চোখ এড়িয়ে বাঁশের কঞ্চিতে পড়ন্ত দুপুর
চোখ বন্ধ করে হেঁটে যাবার একটা
দীর্ঘ মেঠোপথ
নির্জনতার ভিতর- দুজনের মৌনতায়
এতো সব মিল অমিলের মাঝে কোথাও
একটা খোলা জানালায়
আমাদের যৌথমালিকানা আছে
শিরেনামহীন- ১
যখন তোমাকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয় তখন থাকো না তুমি, আমার ঝরা পাতায় এমন অনেক মুহুর্ত ছায়াঢাকা পাখিহীন। কেউ কাউকে নয় নিজকেই খূঁজতে বেরিয়েছি পথে, এতো পথ এতো নিঃসঙ্গতা! কে কাকে বুঝাবে বলো, প্রেমজন্মগত অবুঝ অপেক্ষা! অপেক্ষা ধারালো শিঙ্গের কাজলা ষাড়- অারঙের লড়ায়ে কখনো পরাজিত নয়।
রাতের পাখিরা
প্রিয় পাখিরা ঘুমিয়ে গেলে
দীর্ঘ হয় প্রতীক্ষার রাত
বৃষ্টি হয় হয় করেও হচ্ছে না
আকাশে দৌড়ছে চাঁদ
দক্ষিণের জানালায় জোসনাকে হৃদয়ে জড়িয়ে
অপেক্ষা বিষণ একা, শুয়ে আছে
ঝরা পাতার গল্পের মতো নিশ্চল শূন্যতা।
কেন এতো পাখি পুষি কামনার জালে!
দূরের নৈঃশব্দ্য
জেগে উঠি মৃত্যুমুখো জোসনার স্তনে হাত রেখে
জলের তীব্রতা নিয়ে বৃষ্টি ঝরার শব্দ পিছনে রেখে ডেকে উঠে ভোর- দূরের মিনারে
পাখিদের খাবার সন্ধানি যৌথ কোলাহল
আফসোস থেকে যায় আরো গভীর রাত্রির তৃষ্ণা।
কেন এই গান প্রাণহীনতায়!
কেনো দেখাও স্বপ্নের রঙধনু
নির্জন রাত্রির আঁধারে জৈবিক মন্ত্রনায়!
পুরোনো প্রেমিক তোমার হৃদয়ে ঘুনপোকার শব্দের ছায়া
নৈঃশব্দে হামাগুড়ি দেয় অধরা শূন্যতা!
হায়প্রেম, হায়বিরহসন্তাপ!
গুহাচিত্রে দিনলিপি
১.
বল্লমের ঘায়ে লেগে আছে রক্তের দাগ, শিকার কি পালিয়েছে পাহাড় আড়ালে!
হরিণের মাংসের ঘ্রাণে বার্ধক্য শিকারী
পাথর গুহায় আঁকে যৌবনের দুরন্ত সময়।
শেষ হলে অপেক্ষার প্রহর
সুতীক্ষ্ণ চোখে ভাসে প্রর্থীত উল্লাস- খাবারের।
মেমথের চিৎকার দূরে, আরো দূরে
খাদে পড়ে আছে চাঁদ।
চিয়ার্স
আমাকে জিজ্ঞেস করো
কাল রাত ঘুম কেমন হয়েছে
নিঃসঙ্গতা কতোটা উদার হলে
অর্ধেক শূন্যতা নিয়ে অপেক্ষায় থাকে
মধ্যরাতের চিয়ার্স
আমাকে জিজ্ঞেস করো
দুপুরও ছায়ার জ্যামিতি
আমাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না
আমাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না
আজ আমার যেখানে থাকার সম্ভাবনা ছিলো
সবখানে খুঁজলাম, কোথাও পাচ্ছি না!
তাহলে কি আজ কোথাও ছিলাম না আমি!
নাকি দিকহীন গোলাকার রহস্যে নৈসর্গিক চেতনায়
শূন্যতার পাল উড়িয়ে উড়ে যাচ্ছি
যেখানে আমার সময়ের কোনদিন রাত্রি নেই,
জগৎ সংসার নেই, নেই প্রেম ও ময়ার বন্ধন!
ও জারুল বৃক্ষ ভাটিয়ালি নদী
আমি হারিয়ে গিয়েছি,
ও গারো পাহাড় লাল মাফলার পরা
হেমন্তের শীতোষ্ণ হাওয়া
আমি হারিয়ে গিয়েছি,
ও শিমুল যৌবনের মৌলিক ভুলের মাশুল
আমাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।
এমন ভাবতে গিয়ে কখন যে একটা মন ভাঙা দুপুর
নির্জন ভ্রমণে বিকেল হয়ে গেলো
কাশবনে ঘন হয়ে আসা নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায়, সোমেশ্বরী দ্বীপচর জানলোনা কিছুই,
পুচ্ছ নাড়িয়ে উড়ে যায় দোয়েলের শিষ।
একটা কবিতাও হলো না লেখা।
কতোদিন পড়া হয় না চিঠির খসড়া কুয়াশায় ঢেকে গেছে প্রেমিকার নাম!
শুধু একা একা নিরামিষ ভোজী আমার ভাবনাগুলো
পুরনো চিঠির মতোই স্মৃতির জাবর কাটে
আর কুঁড়েঘরে গজানো ঘাসের মতো
বেড়ে ওঠার আগেই অনাদরে মরে যায়।
মাঝেমধ্যে এমনই হারিয়ে যাই আমি,
হারালেই খুঁজার তৃষ্ণা বাড়ে!
আহা, সে কী প্রাঞ্জল তৃষ্ণা! যে হারায় সেই খোঁজে-
যে হারায়নি কখনো সে কি বুঝে
খুঁজার তৃষ্ণা কতো মধুমাখা! খুঁজেখুঁজে কতো নদী হয়ে গেছে পথ, কতো পথ আজ নদী,
কেন আলোমুখী আত্মাহুতি দেয় সবুজ পতঙ্গ!
কত অভিমান প্রিয় এই মন ভাঙা দুপুর!
কত দিন লেখা হয় না চিঠির খসড়া!
ফারুক আহমেদ
জন্ম : ১৯৭৯ সালের ২২ অক্টোবর নেত্রকোণায় জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনা : আঞ্জুমান আদর্শ স্কুল , নটর ডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রাষ্ট্র বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পেশা সাংবাদিকতা,
প্রকাশিত গ্রন্থ :
কয়েকজন দীর্ঘশ্বাস, অবজ্ঞাফল আবেগসকল বিবিধ, মন এইভাবে স্থির করা আছে ( কাব্য গ্রন্থ); বাস্তবতা দোলানো মুখ (গল্প), ঘূর্ণির ভেতর জীবন ( উপন্যাস)
ছোটদের : গল্পগুলো সবুজ
সংকলন গ্রন্থ : ১০ সাক্ষাৎকার
ফারুক আহমেদ এর কবিতা
ঘটনা
এক সঙ্গে দুটা ঘটনা পাশাপাশি কিছুদূর গিয়ে
বিভক্ত হয়ে যায়। দুটা ঘটনা কিছুদূর এক সঙ্গে চলার পর
বিভক্ত হওয়ার এতো কি প্রয়োজন, হু! কিন্তু সত্যি সত্যি
পাতা ঝরার দিনগুলোতে একটা ঘটনা আরেকটা
থেকে বিভক্ত হয়ে যায়, পাশাপাশি সিটে বহুদূর পথ পাড়ি
দিয়ে শেষে একটা আরেকটাকে বলে ‘আসি’।
যতবার সম্ভাবনা ক্ষেত দেখি, ততবার মনে হয় এসব
সম্ভাবনা ক্ষেতে ঘটনার চাষ হয়। কিছু সম্ভাবনা
চারা থাকতেই মারা যায় আর কিছু এমন সব
ঘটনার জন্ম দেয়; যার সঙ্গী ম্যাডাম নিরবধি,
যার সঙ্গে যায় ভূত্য নিরন্তর, যাকে বহন করে
বেড়ায় কলুরবলদ কাল। এইভাবে কবে জানি! কোন এক কালে,
এই ধরো তা গতকাল হতে পারে, একটু আগে বা আগের জন্মে-
একটি কালের নিয়তি নির্ধারিত সত্যেও মতো
এমন লাবণ্যময় ঘটনার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়।
নদীর মতো সহজাত প্রবাহমান এমন ঘটনা দেখে মনে হয়
হৃদয় ফুরে একটা শান্তির ফোয়ারা ভ্রমণে নামবে এক্ষণি।
মানুষ ভ্রমণশীল হোক, পাখি বা নদী, কিন্তু শান্তি কেন?
আহা, শান্তি তুমি ভ্রমণশীল বিহঙ্গের মতো হয়ে গেছো,
তোমার সঙ্গে ঘটনার জন্ম দিতে মানুষ সবচেয়ে উদ্গ্রীব।
অথচ তুমি এবং ঘটনা নিজ নিজ স্থানে থেকে কী এক
বিহ্বল প্রতিযোগীতার জন্ম দিচ্ছো ক্রমাগত।
সুমিষ্ট অবজ্ঞা খেতে আর ভাল লাগে না
আপ্যায়নের ভয়ে কোথাও যেতে ইচ্ছা জাগে না।
গেলেই মনে হয়, আপ্যায়নের বাড়াবাড়ি শুরু হয়ে যাবে-
মনে হয় ট্রে-ভর্তি বিচিত্র অবজ্ঞা সামনে দিয়ে বলবে- নিন।
সুমিষ্ট অবজ্ঞা খেতে আর ভাল লাগে না। আড়মোড়া
ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়লে সামনে অনেক অবহেলা
সেধে সেধে বলে, নিন- অবহেলাফল, অনেক সুমিষ্ট ।
পথ কোথায় পড়ে আছে? যে পথে গেলে কোন চেনা মুখ নেই,
কোন পথ বিস্তৃর্ণ জলরাশির মতো বিক্ষুব্ধ হয়ে ঘুরে বেড়ায়?
আপ্যায়কর্মীদের কাছে অচেনা এমন পথ আমার কাছে এলে
কানের উপর সিগারেটের মতো তা গুজে রাখতাম।
এলে হয়তো আর অবহেলাফল খেতে হতো না।
বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, অনুর্বর প্রত্যাশাক্ষেতে অনেক বীজ-
তাতে পানি, সার দিয়েও কোন উদ্ভিদের জন্ম হয় না, হচ্ছে না।
কেন? কেন? কেন?
চিনি শিল্প, ইস্পাত শিল্প অনেক মানুষের কোলাহলে
তৈরি হয়; বোঝলে হে। অথচ আমি শিল্প বলে প্লেট
ভর্তি অবজ্ঞা নিয়ে বসে থাকি, উড়ন্ত অবহেলা আঁকি।
দেখা হওয়া
অনেক করতালির ভেতর ফিতা কেটে একটা দেখা হওয়া উদ্বোধন হলো। উদ্বোধন করলেন রোদ্র ও ছায়া যুগল। অগণিত দেখা হওয়ার সম্ভারে হুমড়ি খেয়ে পড়লো বহু ক্রেতা। সূর্যের সঙ্গে সকালের, অন্ধকারের সঙ্গে সন্ধ্যার সহজলভ্য দেখা হওয়া চারদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও চাহিদা বিপুল। একটা ট্রাকের সঙ্গে বাসের মুখোমুখি হৃদয়বিদাকর দেখা হওয়ার দিকে মুখ কুচকে দেখছে অনেকে। আর কিছু রোমান্টিকের দল, অনেক সাধারণের দল মমতাজ-শাজাহান, লাইলি-মজনু প্রমুখদের দেখা হওয়ার কিংবদন্তি নিয়ে তুমুল আপ্লুত।
নীল নদের পানির সঙ্গে ভূ-মধ্যসাগরের পানির দেখা হয়; তা আমরা জানি। পানিপথে সম্রাট বাবরের সঙ্গে এদেশের হিন্দু রাজাদের লোমহর্ষক দেখা হয়েছিল- এরকম লোমহর্ষক দেখা হওয়া পৃথিবীতে অনেক ঘটে। প্রতিনিয়ত ঘাসের সঙ্গে পায়ের, রাজপথের সঙ্গে গতির, ঢেউয়ের সঙ্গে নৌকার, বাঘের চোখের সঙ্গে হরিণের চোখের দেখা হয়। ফড়িংয়ের সঙ্গে শিশিরে সিক্ত ধানগাছের দেখা হওয়ার স্মৃতি কারো কারো কৈশোরকে এনে দেয়। এই যে তার চোখের সঙ্গে আমার চোখ গিয়ে দেখা করতে চায়, তাওতো সবুজ, ভেজা প্রফুল্ল অভিজ্ঞতা জাগিয়ে দিতেই, তাই না?
অনেক দেখা হওয়ার ভেতর আমাদের দেখা হওয়া কোথায় হলো, বল। মাচ্চুপিচ্চুর মতো এ এক বিস্ময়। অথবা একটা চাহনির মতো গভীর রহস্য উদ্রেককারী এ দেখা হওয়া। তবু সিংহাসনের সঙ্গে রাজার, জেলের সঙ্গে মাছের, রাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাধীনতার দেখা হোক তাই আমরা চাই। নদী, সবুজ বনানী, সমুদ্রের মাতাল হাওয়া, সময়ের যৌবন, পৌষের রোদ- এসবের মতো সবায় চায় আমাদের দেখা হোক, নিশ্চুয় চায়। করতালি দিয়ে দেখা হওয়ার সঙ্গে শান্তি মিলিয়ে দিতে চায়, নিশ্চয় চায়।
সন্ধ্যায়, তারা
সন্ধ্যা, মানুষজন- আধো অন্ধকারে ভেসে ভেসে কোথায় কোথায় যাচ্ছে!
এই তো দেখা যাচ্ছে লাল নিয়নের উপর সাদা করে লেখা- ‘জিপিও’।
খুব নিঃসঙ্গ, স্ত্রীর মৃত্যুর পর মানুষ যেমন নিঃসঙ্গ হয়ে থাকে,
সেরকম নিঃসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জিপিওর সামনে একটি গাছ।
ব্যস এটুকু হলেই মনে হয় বেঁচে যাই- সন্ধ্যায়
একটি গাছ আছে এই দৃশ্যটি পুড়িয়ে বেঁচে যাই
দীর্ঘ নিঃসঙ্গতার কাঁপুনি থেকে।
আচ্ছা, পৃথিবীর গভীরতম বেদনার নাম কী? সেকি কোন নারীর উষ্ণ
ওড়না বা আঁচলের নীচেই থাকে? যেন স্নেহশীল সন্তান। একটু একটু
করে বড় হচ্ছে-অনেকের সঙ্গে মিশছে, সময় দিচ্ছে, নিচ্ছে।
নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায় একটি সকাল এসে যদি হাজির হয়-
যদি সকালের নাম হয়- সবুজ ঘাসের সকাল অথবা
সে সকালের মুখে লেগে থাকে সমুদ্রের ফেনিল সৈকত;
তাহলে গভীর বেদনার ক্ষতে জাগবে গাঢ় সীমারেখা?
পৃথিবীর সকল নিঃসঙ্গতা থাকে সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে?
সকল বেদনা কি কোন নারীর উষ্ণ ওড়না বা আঁচলের নীচেই থাকে?
অনেক চাহনি
চারদিকে অনেক চাহনি ফুটে আছে-
অনেক চাহনির ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে
মনে হয় একটা চাহনি ছিড়ে নিই।
এই আমি একজন একটা চাহনি ছিড়ে নিতেই পারি-
পারি না? আসলে চাহনির উদ্যানে এইভাবে অভাবনীয়
এক দাবী নিয়ে আমি হাজির হতেই পারিÑ পারি না?
তবে ছিড়ে নিতে চাইলেই হয়? এ বেলী বা গোলাপ
উদ্যান? গোলাপ উদ্যান হলেও আমি কোন মতেই
রানী যোসিফিন নই। নেত্রকোনা নামক একটা
মফস্বল শহর থেকে এই নগরীতে এসে আমি
নির্দিষ্ট চাহনি দাবী করে বসবো- এতো ঔদ্ধত্য!
বরং দুঃখিত। বরং ফুটে থাকা হাসোজ্জ্বল, নিরেট,
বেদনাবিধূর, বিহ্বল, রহস্যময়- এমন বিচিত্র চাহনিদের
দেখে আমি দ্রুতবেগে অনেক আত্মসমর্পনের সাঁকো পার
হতে থাকি। দ্রুতবেগে অনেক বস্তুবাদ মগজে ধাক্কা দিতে
থাকে। আর ভাবি- টবে একদিন একটা চাহনি ফোটাব।
সন্ধ্যা, সন্ধ্যা
বর্ষা বৃষ্টি, সন্ধ্যা- এইসব নামের সঙ্গে কোন এক
রহস্য জড়িয়ে আছে; মনে হয় তিনজন বান্ধবী
জনারণ্যে বেলি দুলিয়ে মিলিয়ে গেলো আদিগন্তে।
তবু সন্ধ্যা নামটার সঙ্গে আরো গভীর কোন রহস্য
তাকিয়ে থাকে। বর্ষা বা বৃষ্টি সুর নিয়ে এলেও
সন্ধ্যা খুব নিঃশব্দে এই গ্রহে নেমে আসে। একটা কালো
ওড়না নাড়িয়ে বলে এলাম- তবু এই আসাতেই কোন
এক অচেনা জগতের বারতা লেখা হয়ে যায়, যা অন্ধকার।
একটা লতা গাছকে যেমন প্যাঁচিয়ে ধরে, তেমনি
সন্ধ্যা দিনকে প্যাঁচিয়ে ধরে; যেন আবেগমন্থিত
যুগল। যেন সকল বন্দীদের ডাকছে শান্তির
নীড়। আর একটা সন্ধ্যা গৃহে যাচ্ছে, অনেক
সন্ধ্যা গৃহে যাচ্ছে- গৃহে যাওয়াই তো সন্ধ্যার নিয়তি।
আমাদের সৃষ্টিজগৎ
(কবি বিনয় মজুমদারকে নিবেদিত)
একটা ভুট্টায় টুকরো টুকরো অনেক নক্ষত্র ছড়িয়ে থাকে
অর্থাৎ বহু নক্ষত্রের মিলিত রূপের নাম ভুট্টা।
বহু নক্ষত্রের সহযোগে গঠিত একটা ভুট্টা চাঁদের দিকে যায়।
তারপর চাঁদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর মনে হয়
ভুট্টাটা কোথাও নাই। এইভাবে প্রমাণিত- ভুট্টা চাঁদের থেকে ছোট।
তবে কারো ঘাড়ে ভুট্টা চাপিয়ে দেওয়া হলে
তা বহনে কি সক্ষম। না, কেননা ভুট্টার প্রতিটি দানার
রয়েছে নিজেস্ব কক্ষপথ, গ্রহ-উপগ্রহ আরো কতকিছু।
এমন অনেক দানা সহযোগে গঠিত একটি ভুট্টা
তার ওজন কেমন হতে পারে সে এক রহস্য।
এভাবে অনেক রূপ-রহস্যের নাম আমাদের সৃষ্টিজগৎ।
কোরবানীর হাটের গরু ও রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া রিক্সাওয়ালা
নিজ নিজ স্থানে থেকে ভাবে মিলনের দীর্ঘশ্বাস।
নায়িকা আর দর্শক সবসময় একটা দুরত্বে থাকে
সব জুতা কি পায়ের সঙ্গে মিলিত হয়?
এইভাবে সৃষ্টিজগতের নানা রহস্য দেখতে পাই,
আর বাড়ির পাশে যে রহস্য থাকে
তাকেও প্রতিদিন সকালে একবার করে দেখি।
কথা
আমার কথা আমার প্যান্টের বাম পকেটে আছে
বুক পকেট খড়ের মাঠ, প্যান্টের ডান পকেট নিঃস্ব গলি,
পেছনের পকেটে তাবৎ আহাজারি উগরে উঠছে।
আমি জানি প্রত্যেকটা সকাল নিরাময় কেন্দ্র, সকালকেন্দ্রে
এসে আমরা তাপ দিতে দিতে বেদনাকে গলিয়ে দিই,
বেদনা থেকে নিঃসঙ্গতা গলে পড়ে সব স্থিতিশীল হয়।
তারপর সম্ভাবনার দিকে যায়, যায় প্রত্যাশার দিকে।
আবার লোডশেডিং হলে কেউ কেউ প্রত্যাশা জ্বালিয়ে
পরিক্ষার পড়া পড়ে, কেউ অন্ধকারকে তাড়ায়।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় পোকা খাওয়া আমকে পেড়ে আনি।
এনে পোকাধরা জায়গাটা কেটে ফেলি। অথচ ১৯৭১ আনতে
চাইলে চলে আসে ১৭৫৭। ভাবি, সকাল পেড়ে আনব।
কিন্তু কিভাবে জানি গভীর অন্ধকার চলে আসে। দূর পাহাড়ে
লুকিয়ে থাকা গাঢ় অন্ধকার ঘিরে ধরে। মনে হয় গলিতে গলিতে
উড়ছে একাকিত্ব, পৎ পৎ করে উড়ছে দীর্ঘশ্বাস। কিন্তু
বাম পকেটে আমার কথা। অন্যান্য স্থান খড়ের মাঠ,
নিঃস্ব গলি, তাবৎ আহাজারি- সেখানে বাম পকেটে লাবণ্যময়
কথা খুব নিঃস্ব, খুব একাকীত্ব, বহু প্রহসনে চুপ মেরে আছে।
তবু ওর অভিজ্ঞতা রাজপথের মতো বিশাল ও সম্ভাবনায় উজ্জ্বল।
আশ্চর্য নদী
আমার বালিশের নীচে চাপা পড়ে আছে একটা নদী
বিভোর ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠলে সে নদীর আর্তনাদ
শোনা যায়, শোনা যায় পরম্পরার আকুতি। তবে কখনও বালিশে
হাত ঢুকিয়ে নদীকে বের করে নিয়ে আসতে চাইলে
সে আর দৃশ্যমান থাকে না- অদৃশ্যে লোপাট হয়।
আমি বার বার বলি দৃশ্যতে আসো; হোক মেলবন্ধনের
নিপাট যোজন। এভিন্যুতে বৃষ্টি শেষে গাছের পাতাগুলো
যেমন চকচক করে, তেমনি তোমার উজ্জ্বল মুখ রচিত হোক,
বাদাম ভাঙার মতো আমাদের যোজন মুহূর্তগুলো ভেঙে ভেঙে
বের করে আনি সারাৎসার। অথচ নদী কোন দিক থেকে
কোন দিকে চলে গেল, শশাঙ্ক আর তাকে শাসন করতে পারলো
না, বিপাশা নামে যে নদী, সেও মুখ থুবড়ে পড়লো এর সামনে।
জৈষ্ঠ্যের খরতাপে মাঠ ফেটে কৃষকের কপালে ছোট ছোট
অগণিত দেয়াল। অথচ তখনও বহমান ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ
তোলে বালিশের নীচে খেলছে আমার আশ্বর্য নদী। অন্যদিকে
দেখো তোমার বালিশের নীচে আত্মার দীর্ঘ আকুতি। তার চেয়ে
বরং চলো নদীতে ছেড়ে দিই আকুতি, গোসল করুক, ভিজুক।
বর্ষাতো ঘড়ির কাটার মতো কৃতদাস হয়ে আসছে না।
হাসিসমগ্র
আমার হাসিরা সব বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিল
বর্ষায় হাসিরা ভিজে ভিজে সর্দি-জ্বরে একাকার।
ভেবেছিলাম শীতের রোদে ওদের শুকিয়ে নেব,
ভেবেছিলাম একটা উষ্ণ হাসিফোয়ারার জন্ম হবে।
কিন্তু না, ভিজে যাওয়া হাসি কাৎ হয়েই রইলো;
শীতে ফেটে যাওয়া ঠোঁটের মতো হাসিরা এলিয়ে রইলো।
ফলে বিরাট এক হাসি শূন্যতার সৃষ্টি হওয়ায়
শূন্য স্থান পূরণে অনেক মেকি হাসি ঝাপিয়ে পড়লো।
অনেকদিন ঠোঁটে একটা হাসি ধরে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি
ভাগাভাগি করে খাব বলে। একখানা শীতসন্ধ্যা
অধরে ধরা আছে, লক্ষ লক্ষ শীতসন্ধ্যা লক্ষ লক্ষ অধরে
ধরা থাকে, হাসিও, নিশ্চুপতাও আর প্রতীক্ষাও ধরা থাকে।
যে পথ দিয়ে অনেক কথা বেরিয়ে যায়, সে পথেই অনেক খাবার
প্রবেশ করে; এটা কথার বন্দর, খাদ্যদ্রব্যের, হাসিরও।
ঠাণ্ডায় নাকবন্দর বন্ধ থাকলে মহামূল্যবান অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন
যায়-আসে এ বন্দর দিয়েই। আর বন্দরের ফটক মাল
আনা-নেওয়ার জন্য খুললেই নানা বিষয়ের জন্ম হয়।
মঞ্চের সামনে বসে দেখি আমার একটা হাসি হেভি
ডায়ালগ ছাড়ছে। পরে একদিন দেখলাম যে হাসিটা নাচছে,
সারা শরীরে কালো কাপড় আর বুকের মধ্যিখানে শাদার কাজ-
সে হাসিটা নিশ্চিতভাবে আমার। যেখানে যেখানে হাসি
জেগে উঠবে, ভেসে উঠবে বা একটা চারা হাসিকে রোপন করা
হলেও আমার মনে হয় এটা আমার হাত দিয়েই রোপিত হলো।
মামুন খান
জন্ম : ২৫ আগস্ট, ১৯৭৮। নায়কেপুর।
স্থায়ীবাস : হাজরাগাতী,মদন,নেত্রকোণা।
পড়াশুনা : বাংলাসাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর
পেশা : একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে জ্যেষ্ঠ প্রযোজক পদে র্কমরত।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : জল ও জলপাই (ঐতিহ্য, ২০০৮);
বাইরে দুপুর ভতিরে ভৈরবী (ইত্যাদি, ২০১১)
হট্টটিটিগুচ্ছ (সম্মিলিত)
মামুন খানের কবিতা
পাখিটা
এতক্ষণ তার মতই সে ছিল বসে।
যেই দেখতে শুরু করলাম
সেও শুরু করে দিল গোছাতে তার পালক।
মনে মনে যেই বললাম- বাহ!
ডাল ছেড়েই সে দিল উড়াল!
ফেলে যাওয়া ডালটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
মনে হচ্ছিল, বহুদিন কেউ এসে বসে না
এমন একটি ভাঙা বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
আর ভেতরে, নির্জন দুপুরটাকে কাঁপিয়ে
কেঁদে যাচ্ছিল একাকিনী একটা ঘুঘু...
উন্মাদের হস্তলিপি
উম্মাদের হস্তলিপি পাঠের আগে কিছু খেয়ে নেয়া ভালো।
তাহলে তার হিজিবিজি কালো কালো একান্নবর্তী সংসারের
নিজেকে ইজিলি ভাবতে পারবা বায়ান্নতম সদস্য।
অথবা তেত্রিশ কোটি নিরানব্বই হাজারদের একজন
সুকুমার শিবরাম সুলতান... আরও আরও
তারপর তুমি।
নদীপাড়ে গিয়ে যদি শুধু পানির কথাই ভাবো
তাহলে তুমি পাণিণীর কাছে যাও- যাও
হায়াৎ মামুদের কাছে
তারা স্পষ্ট করে বসে আছেন মাতাল আর উন্মাদের সুস্পষ্ট ফারাক।
যেমন ফারাক্কা- বাংলাদেশ: ইন্ডিয়া।
যেমন টুপি- মগজ আর মাথা: বাম আর জামাত।
যদি অক্ষম তুমি সুশৃঙ্খলিত যাবজ্জীবন দণ্ডভার সইতে
তবে পড়ে যাও ওপেনএয়ার কনসার্টের কবিতা
শুনে যাও যেকোনো ক্রেজি আন্ডারগ্রাউন্ড কিংবা
তুমূল জালাল খাঁ।
আর দেখতে চাইলে দেখে শিখতে চাইলে
বাংলাচার্য হেংলোপোংলো কাঁটা (তার) বিদ্ধ
ঋত্বিক তো আছেন-ই।
শূন্য
আমার সবচেয়ে সুন্দর দিনটিতে আমি থাকবো না।
আমাকে ঘিরে চারপাশে ফুটে থাকবে
অজস্র নরম দৃশ্য-
গন্ধ উড়বে, পাথর গলবে
শংসাতরঙ্গে ‘হ্যাঁ’ ‘হ্যাঁ’ করে কাঁপবে বাতাস
মৃদু-পাপড়ি আর মৃত্তিকার বিক্ষত পরতে পরতে
বাজতে থাকবে অন্ধ-এস্রাজ...
শতদিক থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছুটে আসা শত শত স্বজন
ভেজা আকাশের ছায়া মেখে মুখে
দেখতে থাকবে আমাকে- আমার না-থাকাকে।
আমি দেখবো না এর কিছুই।
আমার কাছে এসবের কোনো মানেও আর থাকবে না।
আমি তো তখন এই মহাপ্রেক্ষাগৃহের সমস্ত
রঙ রেখা ঘ্রাণ প্রাণ ধ্বনি- সবকিছুকে একাকার করে দিয়ে
অতিকায় কালো একটা ‘শূন্য’ হয়ে যাবো।
আগুন অথবা আনন্দ
সৌরবিশ্বের সর্বশেষ সভ্যতার নাম- গুহা!
গুহার মুখে যার মশালের যত বেশি আগুন
তিনি তত মস্ত দেবতা।
গোলাপী শৈশব থেকেই তারা জেনেছে- তাদের প্রথম দাদীমা
আগুনের কাছ থেকেই শিখেছিল উপাস্যের ভাষ্য
আগুনের কাছেই প্রথম হয়েছিল-
চিৎ, উপুৎ ও আনত।
তারা মানে, আগুনই শেষ পুরান, শেষ মিনার
সর্বশেষ আনন্দ...।
সংসার
সন্ধ্যার আগে সারাদিন নানান ভঙিতে
এলোমেলো হয়ে থাকে জীবন।
থুথুর ফেনা জুতোর ধুলি নখের আচঁরগায়ে মেখে
যখন ফিরে আসি ঘরে
রাতের গায়ে একবিন্দু মোম জ্বালিয়ে
আলোর ওপাশে বসে থাকে বউ।
আলোর মতো নরম করে সে হাসে
নরম দু‘হাতে ভাঁজ করে দেয়
সারাদিনের এলোমেলো জীবন।
লোমের গোড়ায় জমে থাকা ঘামের গায়ে তখন
মনে হয় বসে আছে মাঝ-সমুদ্র থেকে উড়ে আসা
একঝাঁক শীতল ডানার পাখি...
জিতসোমা-চৌদ্দ
রঙের আড়ালে মাটি
মাটির আড়ালে খড়
খড়ের আড়ালে খন্ডিত বাঁশ
-এ সবকিছুকে ছাপিয়ে যে তুমি
মোহিত করে রাখছ মন্ডপ
আমিই তার শিল্পী।
তোমার চারপাশ উচ্চ উলুধ্বনি আর ধূপধোঁয়ায় আচ্ছন্ন।
দূরে, অস্পষ্ট দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে
মনেই নেই তোমার!
লগ্নশেষে চারদিকে যখন
তোমাকে ঘিরে বেজে উঠবে বিসর্জনের কোরাস
পৃথিবীতে একটিমাত্র মুখ
বিষাদে নত হয়ে থাকা একটি মুখ
দেখতে যদি চাও
আমার দিকে তাকিয়ো একবার।
আমি যে কারিগর তোমার!
বাদক
হলভর্তি নক্ষত্রের সামনে আমাকে বাজাচ্ছো তুমি
তোমার আঙ্গুলের আনন্দে
লাফাতে লাফাতে কোনো কোনো নক্ষত্র
ছুটে আসছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের দিকে
মহানক্ষত্রালোক থেকে ভেসে আসা করতালির শব্দে
আর মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে পৃথিবী
কেঁপে উঠছে তোমার আঙ্গুল
শেষ ঋতুর হাওয়া
বেড়ায় আড়াল হয়ে আছে বাগান
বাগানে গোপন হয়ে আছে ফুল
বেড়ার আশপাশে উড়ছে একজোড়া ভ্রমর
বাগান আর ভ্রমরের মাঝখান দিয়ে বইছে
শেষ ঋতুর হাওয়া
ভ্রমর জানে আড়াল-মধুর মাধুরী বেশি :
বাগান কী জানে বেলা পড়ে গেলে
তৃষ্ণা যে থাকে নাভ্রমরের!
গানওয়ালা
বিষণ্ন একতারার পাশে বসে আছে অন্ধ এক গানওয়ালা
সে জানে- চৈত্রের হাওয়া যতই উড়াক ধূলি
রোদে যতই পোড়াক লোকালয়
এই গানের কাছে কেউ না কেউ এসে দাঁড়াবেই
সে জানে তার আঙ্গুলের চেয়ে এমন মৌন ছন্দে
আর কে পারবে বাজাতে ধূলির মতো পতিত প্রাণ
তার গলার চেয়ে আর কে পারবে
এমন নম্র সুরে বোঝাতে বেদনা কারে কয়!
মানুষ যতই আনন্দবিলাসী হোক
সে জানে রোদনের চেয়ে মধুর কোনো সান্ত্বনা নেই!
কৃষক
বাতাসের মুখোমুখি বসে আছে আমার শরীর
আমার মন জানে এই বসন্তসন্ধ্যাটি
জ্যোৎস্নাহীন হয়ে যাবার আগে
পৃথিবীর ছোট ছোট শহরগুলো থেকে
বোরো সবুজের মতো কুমারীরা
নেমে আসবে আমাদের মাঠে মাঠে...
মাঠের মুখোমুখি কৃষকটি আমার মন।
গৃহিণী
শেষ বয়সী ডাঁটাটায় ঝুলে থাকা
যুবতী শিমগুলোর
অক্ষত বৃদ্ধা বয়স প্রার্থনা করছেন আমাদের মা
আমাদের দীর্ঘ বয়সী মা জানেন
শিমগুলোর প্রত্যেকটির রয়েছে
চারটি পাঁচটি করে অপার ভবিষ্যৎ।
আমাদের পাড়ায় পাড়ায় চালে চালে
মাচায় মাচায় অসীম সবুজের নিশ্চয়তা
চেয়ার
কেউ এসে বইসা পড়তে পারে- এই ভয়ে
কেউ-ই ছাড়ছেন না চেয়ার
ত্যাগের বেগ নিয়েও প্রকৃত সুখ থেকে তারা
বঞ্চিত আজ এই একমাত্র চেয়ারেরই কারণে
একমাত্র চেয়ারকেই তারা এই জীবনে মেনেছেন সার
তারা পশ্চাৎ দেবেন তবু ছাড়বেন না চেয়ার!
রোপন প্রক্রিয়া যতই প্রকাশ্যে ঘটুক
বীজের অঙ্কোরোদগম কিন্তু গোপনেই হয়
গোপনেই দীর্ঘ হয় তার পরম্পরা
এক্ষেত্রে ক্ষেত্রেরই মূল ভূমিকা :
তাপ ও তপে, আলো ও জলে, ছায়া ও মায়ায় সে
সমৃদ্ধ করে জীব ও জীবনের সজীবতা
কিন্তু উর্বরত্বের যতো কৃতিত্ব সাফল্যের যতো মহিমা
সব দেখা যায়- হায়! একমাত্র
কৃষক ব্যাটার নামের পাশেই এসে বসে থাকে!
দশশো বছর প্রাসাদ বাসের পরও
দশশো বছর প্রাসাদবাসে ছিলো আমার অক্ষরজীবন-
কিছু কিছু পংক্তি থেকে তা উদ্ধার করে পণ্ডিতেরা দেখলেন
আমার চোখ স্থির হয়ে আছে যেখানে
ভাতশূন্য হাঁড়িদের পাশে
শোভিত আমার শবরীর স্তনগুলো গুঞ্জারমালায়
একটি পদ্মের পাঁপড়িতে
যেখানে আমার ডোম্বীদের সুডৌল পায়ের নৃতকলা
পণ্ডিতেরা দেখলেন আমার শরীর থেকে
দশশো বছর প্রাসাদবাসের পরও ছড়িয়ে যাচ্ছে
সস্তা মদের একেকটি সহজ আনন্দ
একেকজন সহজিয়া সাধক
মাহমুদ সীমান্ত
১৯৭৯ সালের ৫ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থান- গ্রাম: নলুয়াপাড়া, থানা: দুর্গাপুর, জেলা : নেত্রকোনা। পিতা: মোহাম্মদ আলী (প্রয়াত), মাতা : আনোয়ারা খাতুন। 'হাওড় ' নামে একটি লিটল ম্যাগ সম্পাদনা করেন।
লিখেছেন বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে। তার মধ্যে মস্তক, অনুধ্যান, অক্ষর, বোধ উল্লেখযোগ্য।
প্রকাশিত কাব্য সংকলন : হট্টিটি গুচ্ছ ( সম্মিলিত)
মোবাইল : ০১৬৭০৯৯৪৪০৩, ০১৬৭৪১০৪১৮৫
মাহমুদ সীমান্তের কবিতা
আজকের ফুল
গতকাল-ফুটে যাওয়া ফুলে
এবং ভবিষ্যতের ফুল বিষয়ক
আমার বিশেষ কোনো কৌতূহল নেই।
প্রতিদিন এই পৃথিবীতে
অজস্র ফুলের কলি ফুটে
গন্ধ-তারতম্যে কোনো কোনো ফুল
মার খেয়ে যায় আর কোনো কোনো ফুল
ওঠে আসে আরো বেশি আবেদনসহ
তোমার টবের শুশ্রুষায়।
গতকাল-ফুটা গন্ধফুলে
এবং ভবিষ্যতের গন্ধফুল নিয়ে
আমার বিশেষ কোনো কৌতূহল নেই
আমি শুধু দেখি, আজকের ফুলটিকে
ফুল বলে চেনা যায় কিনা!
পাতাবৃষ্টি
পাতাবৃষ্টি! বিষ্মিত হয়েছি মেদিনীর অভিধানে
আদ্যন্ত নখর বিষে আমার তুলনা, তবু অধর কাঁপিয়ে
ঝুরঝুর পড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সম্ভাবনা সব।
মালা গেঁথে রাহুচালের কাকস্যের প্রার্থনায়...
নিজেরই অঙ্গের শোভা করে ডাকি দেবতা-চৈত্রের।
ভবিতব্য মেনে নেওয়া ভালো-
ঝরে যাওয়া পাতাকাহিনীর অভিধান কোনো সাজানো গাছের
ওসব বাদেও দেখ বেড়ে যায় ঈর্ষার প্রকার।
পাতাবৃষ্টি! আহা রে চৈত্রের বাড়াবাড়ি-
আমাকে শুইয়ে দেয় ভবিতব্যে, বাঁশবনে, এড়াতে পারি না।
বড় বড় লোকেদের স্ট্যাটাস সিম্বল
বাগানের ফুল-ফুটা দৃশ্য কিন্তু চমৎকার, তাতে
সৌন্দর্যচেতনা থাকে
যে গৃহে ফুলের উপস্থিতি, তাকে ঘিরে
আমাদের পবিত্রতা খেলা করে মনে।
এইকথা মনে হলো রামপুরা থেকে বাড্ডা হয়ে ফিরে আসবার পথে, রাস্তার দুপাশে কত নির্জন বাড়িতে ঊঁকি দিচ্ছে শত শত ফুল, জলসিক্ত, আহা! ফুলের বাহার। বিকেল-মনীষা তার ছড়িয়েছে প্রভা বিভাজিত ছাদে-বারান্দায়।
কালাকাল এইরূপে প্রজ্ঞাপিত। যোজন-বিজনে মগ্ন যারা, তারা আজ প্রভাময়।
ফুলের বশ্যতা মানি, একদিকে উপমিত কোমলতা আর দিকে পৃথিবীর তাবৎ বিপ্লব, রূঢ়-বাস্তবতা, সহিংসতায় তুমি নিরব-কঠিন দাঁড়িয়েছ। হরণের জাড্যতায় তুমুল কংগ্রেসী। রিক্স্রাঅলা বলে, বুঝলেন ভাই এইগুলা হইতাছে বড় বড় লোকেদের সৌন্দর্যচেতনা।
দেখলাম সত্যিই তো! সৌন্দর্যচেতনা...
বড় বড় লোকেদের স্ট্যাটাস সিম্বল।
ধর্মফল
একটু একটু করে গিলে নিচ্ছো সর্ষের যন্ত্রণা।
তবু বলি, অমৃতের বিষে জরো জরো...
তোমাকে চাইতে আসিনি গোধূলির ফল
কীট ভেবে যদি কেউ মুদ্রা বিনিময়ে
নিয়ে যায় নিজের সন্তাপ
আহতের গীতমালা তাকেই পড়াবো জনান্তিকে।
ওই দেখ সর্ষে পিষে জবুথবু অঙ্কুরিত...
অব্যর্থ আঙুলে আজ মননের মহিমা ঢেলে ঢেলে-
স্নানমুখি, নত, কাঁপা সর্বো কনিষ্টের অকণ্ঠ যমুনা!
একটু একটু করে গিলে নিচ্ছো সর্ষের যন্ত্রণা
তোমাকেই কিনা প্রণমিত ভাবি আমি
উত্তপ্ত মোহনা,
করুণ দগ্ধতা; মাতৃ-রূপিনীর বেদনার ভাষা
ছোট ছোট সাজিয়ে রেখেছি পথে পথে
অনুভূতিহীন ধর্মফল!
তোমাকে চাইতে হয়- হাস্যকর!
ভাষা জন্ম
খুব ভোরে কিছু বাতাস এসে জড়ো হলো উঠানে
এককোণে বেলিফুলে শোভিত ছিল না কোনো ঝাড়
ফলে পুষ্পঘ্রাণে মোদিত ঘুমভাঙাও হলো না।
শীতকাল নয় তবু কুয়াশামিশ্রিত কণ্ঠস্বর
টেলিফোনে শুনে আমাকে দাঁড়াতে হলো বিপর্যস্ত
কালোমেঘও নয় যতটাসম্ভব বৃষ্টির ঝুঁকি নিয়ে চলে গেছে ট্রেন
ফাঁকা রেললাইন, মাতৃভূমি আমার বহুদূরে
প্রথম ভাষায় মগ্নতার মতো বিস্মৃতির গহ্বরে।
বোধ করছি মানুষের প্রবণতাগুলি কোনো লোভাতুর টানে
জেগে ওঠার কৌশলে ইন্দ্রিয় লিপ্সতায় মাতে
শরীর ঘেমে ওঠার পরই ভাবি কাঁদবার প্রয়োজন ছিল।
বাতাসেরা চলে গেছে পূর্বপৃথিবীর কাছাকাছি
তার পিছে পিছে কাঁদতে কাঁদতে চলে যাচ্ছে
মহাসময়ের শিশু-
যথারীতি পরিষ্কার হচ্ছে দিবসের আলো চেনামুখব্যাপ্ত
কাহিনীর দেশে।
পরম্পরা
মনে হয় ধারণার মধ্যে কোন এক
সমুদ্র বিস্তার করেছিল,
আর আমি রচনা সম্ভারে আরো নত
হয়েছি কেবল কবিতা কবিতা বলে।
পিতামহ⎯তার দীর্ঘছায়া সুতো টেনে
আনিয়াছিলেন পিতৃদেব,
তারা চাষ করেছিলো শস্যের মহিমা
মানুষের প্রতি ভালোবাসা।
গেরস্থালী সূত্র ধরে একদিন সকলে
ঘরে ফিরে যায়
পথ ভুলে আমিও গিয়েছি কিন্তু
যে পথে যায় না আর কেউ।
পাতার জীবনী
মেঘেদের কলেজের পাশে বসে বলা⎯
নন্দনতত্ত্বের গল্পগুলি ম্লান হচ্ছে রোদে পুড়ে।
এখন কে তোমাকে বলেছে
সমুদ্রের মন্থরতা
তর্জন-গর্জন শেষে সমুদ্রও কোথাও কোথাও
বিরূপ চেয়েছে ওই পাহাড়ের মতো
দাঁড়িয়ে গুনতে নিস্তব্ধতা।
বরং এটুকু সার্থকতা শিখে এসো
পাতার জীবনী পড়ে
কী করে সবুজ থেকে থেকে
মলিনতাগুলি লিপিবদ্ধ হচ্ছে চৈত্রের দিবসে।
দারুণ অবহেলায় পড়ে আছে যে শুকনো পাতা
আমার জীবনী পাঠে এর চেয়ে কোনো⎯
সুন্দর উপমা নেই পৃথিবীতে।
সরল সমীকরণ
মানচিত্র দেখেই কাঁপছি, এত জটিল রেখার কারুকাজ
রেখার গভীরে আরো রেখা তবে কিনা
চোখ-বুঁজে ভেবেছি সহজ, ফলে তোমাকে লিখেছি
অজ্ঞানতা, অন্ধ বর্ণমালা।
যে ভেবেছে সরল সমীকরণ ভুল ব্যাকরণে
তাকে দিও পত্রালীর ছায়া, জমিনের মালিকানা আর
প্রবেশাধিকার নগরীর রূদ্ধদ্বারে
দেখো বুঝে নেবে ঠিকঠাক জল-শোষণের তাবৎ হিসাব।
কফিনে যায় না একা কোনো প্রাণ
সাথে থাকে জলে-ডুবে মরা অজস্র মৃত্যুর গান।
সবুজ মাঠের পাশে হেঁটে যেতে যেতে
যে বলেছে সুজলা সুফলা আজ হয়েছে বিলীন
সেই শুধু জানে সবুজের মানচিত্র
সহজ ছিল না কোনো কালে
যাও দেখে আসো গিয়ে শুক্রনদী পার হয়ে।
মরেছো উদ্ভিদ-জালে
ছড়িয়ে রেখেছি গৃহে⎯সহজ কথাটি
এত টানা-ছেঁড়া তবু প্রাণ যায় ঘাস-ফড়িঙের
লেজে; ক্ষুদ্রকীটে ডুবে মরা।
তারার ব্যাপ্তিতে তুমি জেগে ওঠো ধাতু, স্বপ্নপরী
ফুল বেঁচে যাক এইসব কোমলতা
ভোরের রঙিন সূর্যোদয়ে আর পাখিদের কণ্ঠে
শোভা পায় নিরস্ত্র ললিতকলা; বাদ্যের মন্ত্রণা।
মরেছো উদ্ভিদ-জালে, গূঢ়তত্ত্বে; দৈব প্ররোচনা বাজে কানে
দৈবের আগুনে নয় সহজিয়া কলা
তাপিত জলের স্তুতি, পতঙ্গের গান
খেলা শেষে পতঙ্গপ্রবণ শিশু অবাক সকালে
ব্যবহৃত হও মরাকাঠ, কয়লার ইতিহাসে।
ফুলের বাণিজ্য
ফুলের প্রত্যক্ষ চাষে শিশুবোধ লুপ্ত হয়ে যায়।
শিশুদের শিক্ষাদানে ব্যবহৃত প্রথম বর্ণই চিত্রকলা
ফুল ধরে ধরে তুমি শিশুদের শেখাচ্ছো ফুলের
গন্ধ বিবরণ;
তবুও শিক্ষার প্রশ্নে
যেসব চিত্রের ব্যাখ্যা করি আজ জড়তাপ্রসূত
সে তো অবয়বহীন শূন্যকায় দ্বিধা।
ক্যানভাসে ঝরাফুলে বেদনা থাকে না
প্রজাপতি বসে না কখনো ক্যানভাসে আঁকা ফুলে
এইভেবে ফুলচাষ করে বাণিজ্যের স্বপ্ন দেখে কেহ কেহ
ফলে প্রতিদিন পথে নেমে দেখি কত মৃতফুল!
এইসব প্রত্যক্ষ মৃত্যুতে বিরহিত থাকে মন।
একথা জেনেও তবু ফুলের বাণিজ্যে কিছুলোক
সম্ভাবনা দেখে প্রতিদিন।
নদীবৃত্তান্ত
নদী নয় জলের ঢেউই পারে বলে দিতে ছলাকলা
মাঝির ঘনত্ব,
কী প্রকার তীক্ষ্ণ লাগে পাল
জেনেছি নদীর গভীরতা পাঠ করে
বলেছ সে এক সূক্ষ্ম প্রশাসন জীবতত্ত্বে...
জলধর্মে, সবকিছু নদীমুখি থাকে।
একদিন নদীর কিনারে বসে ভাবছো সেকথা...
জোয়ারেই ভেসে ওঠে সকল সৌন্দর্য
জলের ঢেউয়ে খেলা বাড়ে শুধু পুলকিত তুমি
আর দেখো মাঝখানে বয়সটা বাঁধা হলো খুব।
এ কেমন বয়স হলো যে তোমাকেও পথে
শিখে নিতে হলো বৈবাহিক প্রচলন।
ক্রমে ক্রমে জানা হলো কোনো গান ছিল না নদীর
স্বাভাবিক চলা ছাড়া
মোহচক্রে ভাসিয়েছে, যুদ্ধে যুদ্ধে গত হলো দিন
পালের হাওয়ায় আজ বুঝে গেছে দিকপাল
মোহবিনা নদীও চলে না।
জলহীন সমুদ্র সমুদ্র নয়
প্রকৃত প্রস্তাবে ডাক কেউ শোনে? তবে কেনো⎯
বলে থাকো ডাকের মহিমা...
যদি সে ফিরে না চায় সাধনার ফল
বোবা-কালা ধুলায় লুটায় অনুতাপে
অনুযোগে তবু বলে রাখো তত্ত্বগূঢ় আলোচনা
সম্মুখ ভাষণে।
সমুদ্রে সকল ডাক অনর্থ-চিৎকার, এইকথা
জেনেও বলেছ তুমি সমুদ্র-কে মানো
উপেক্ষার ভাষা বুকে নিয়ে
সরল সমুদ্র আজ হয়েছে বিশাল।
গোলাপ ফুলের কথা ভেবে দেখো, সুবাসিত ঘ্রাণ আর
কোমলতা না হলে কী, দিতে তুমি তোমার প্রণয়!
যতই সমুদ্র বলো জলহীন সমুদ্র সমুদ্র নয়
খরা-পোড়া নিম্না ল শুধু
আকাশের পতিত বৃষ্টির জল ডেকেছে নিরবে।
ঈর্ষা
ঈর্ষার নিচেই দেখো লুকিয়ে রয়েছে লজ্জা
হীনমন্যতা, সম্ভ্রম।
নীতিশাস্ত্র গীতিশাস্ত্র পাঠ হয়ে গেলে
একদিন ফুলের সৌন্দর্যে তবু ঈর্ষান্বিত হলে
বৃক্ষের শরীর থেকে এরকম প্রস্ফূটিত হয়
যা কিনা তোমার পক্ষে সম্ভব ছিল না কোনদিন।
পাড়ায় পাড়ায় আজ প্রচারিত হচ্ছে
যে গাছে অধিক পাতা ও গোছানো থাকে
তা দেখেও ঈর্ষান্বিত হয়ে যায় পথের মানুষ।
মোমাখ্যান
আগুনের কাছাকাছি মোম কিন্তু আপনাতেই গলমান
পুড়ে পুড়ে নিজে প্রসারিত করেছে আলোক বিভা
দেহখানি পুড়েছে উত্তাপে,
যদিও প্রক্রিয়া শেষে প্রকাশিত ফলাফল আলোক প্রদান
আর তাতে পোড়ালো সে আপন ভুবন।
জ্বলো কিংবা জ্বালো উজ্জ্বল আলোর সম্ভাবনা ভেবে
যেরূপ দিয়েছ ভরে সুতোখানি মোমের গভীরে
সেমতো আলোর নিশ্চয়তা পাবে প্রতারণাহীন
বরং সলতে ব্যবহারে আছে যত জটিলতা
তার ফলে চেনা যায় ভুল কারিগর।
আগুনের কাছাকাছি মোম শুধু গলমান নিজেকে পুড়িয়ে
কারুময় আলোর সাক্ষর বলে দেবে
মোমের শরীর ভেদে⎯
কতটা আলোর প্রকাশক তুমি সুতো ব্যবহারে।
চৈত্রের কবিতা
আমাদের গ্রামগুলি সবুজে সবুজে ছেয়ে গেলে
চৈত্রেরা দাবিয়ে পড়ে খরাদাহে।
এ-তো বড় ধুরন্দর হাওয়া!
এলোমেলো বহে-
আমাদের অনাথ আশ্রমে,
ঝরে বাঁশপাতা শুকনো মর্মর।
বৈশাখের বাতাসের তাড়নায় সেইসব ঝরাপাতাও
একদিন গান গেয়ে ওঠে, পাতাদের গান হয়!
মৃদু মৃদু গানে ভেসে যায় সবুজ সুমন্ত গ্রাম।
ঝরাপাতা গানগুলি একদিন
ম্লান হয়...
উড়ে যায়...
চৈত্রের দিবসে।
একবিংশে মধ্যবিত্ত কথাগুলো
যে বছর আমি শিখি নদীস্রোত, চলার বৃত্তান্ত
সে বছরই বাবা বলে... থাক থাক তোমাকে সুতোয়
বেঁধে ফেলা জরুরি এখন...
কাল যদি অন্ধকার ফোটে ভুলে যাবে পথ-ঘাট,
পরিচিত নদী, প্রিয় বিলদিঘা, আমার বসন্তে⎯
কোকিলেরা গেয়েছিলো গান আর তুমি বলেছিলে...
রেডিওটা ফেলে দাও বাবা, তার চেয়ে চলো একটা
কম্প্যুটার কিনে ফেলি!
আমাদের অন্ধকার থেকে কথা বলে একজন...
আমার সন্তান।
কাল স্টাডি ট্যুরে যাবো চাঁদের মাটিতে, পাশাপাশি
মঙ্গলেও; চেকটা সই করে যেয়ো... সন্ধ্যায়ই ফিরবো।
০১৬৭০৯৯৪৪০৩, ০১৬৭৪১০৪১৮৫
রাজীব আর্জুনি
জন্ম ১২ মে, ১৯৭৯ সাল ।
পিতা : সুনীল চন্দ্র সরকার (প্রয়াত), মা : বীনা পাণি দাস। জন্মস্থান- গ্রামঃ গোবিন্দপুর, নেত্রকোণা সদর, নেত্রকোণা। প্রথম সম্পাদিত (দ্বৈত সম্পাদনা) কাব্য সংকলন হট্টিটি গুচ্ছ প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। প্রথম একক কাব্যগ্রন্থ- তরঙ্গ মথুরা প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে একুশে বই মেলায়। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ জলের মৈনাক প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে । তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'টাকি মাছের কলিং বলে ' প্রকাশতি হয় ২০১৫ সাল। মস্তক নামে একটি ছোট কাগজও সম্পাদনা করেন। ছোট কাগজেই মূলতঃ লেখালেখির শুরু। তার মধ্যে, অক্ষর, শালুক, অনুশীলন, সাঁতার, বিবিধ, হাওর, দ্বৈত, অনুধ্যান উল্লেখযোগ্য। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, পরে হিউম্যান রির্সোস ম্যানেজম্যান্ট নিয়ে এম বি এ করেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকায় সাব এডিটর পদে নিয়োজিত ছিলেন। তারপর থেকে গ্রামীন ফোনে কর্মরত আছেন।
ই-মেইল : rajibsarker7@gmail.com
মোবাইল : ০১৭১১০৮১৬৮৫
রাজীব আর্জুনির কবিতা
লাক্স সাবানের দুপুরে
লাক্স সাবানের দুপুরে ফুফু আমার
কেমন জানি করে
কেমন জানি করে ফুফু আমার
রাতের দেখা ডালিমে ;ডালিমকুমার
বাজনা বাজায় ঝম ঝমাঝম বৃষ্টিতে
ফুফু আমার লাক্স সাবানের দুপুরে
কাকে যেন দেখে আড়েআড়ে ;
আলতা মাখা রোদের ছাতায়
ফুফু আমার শহর ঢাকার ভাইরে বলেন :
এবার কিন্তু যাবার সময়
সেলাই করা রুমাল নিয়া যাবেন
দেখা করবেন পুকুর পাড়ে
জামের গাছের ছায়ায় ; বিকেল
শেষে ফেরার সময় কয়ে যাবেন
সামনে বছর আষাঢ় মাসে
শরত দিয়ে যাবেন।
হ্যালো বিস্কুট
একটি ম্যাজিক মগ
একটি কাঠ পেন্সিল
আর
বাকর খানির নীচে 'হ্যালোবিস্কুট ' নামক টোটেমগুলো তড়পাচ্ছে ;তড়পানো মাছে
কোনও অঙ্ক থাকে না ;
টোটেমীয় হ্যালোবিস্কুট কখনো ম্যাজিক মানব ;
উঁচাখিলার জংলি গাছ ; অঙ্কের লাকি সেভেনে থাকে সতত হ্যালো বিস্কুট ;
ম্যাজিক মগের পর
হারিয়ে যাওয়া একটি রিস্টওয়াচ নিয়ে যখন ভাবছি :গাঢ়নীল এক হাত দুম করে
সব নিভিয়ে হোহো করে হেসে চলে গেলো ;
বলে গেলো, হ্যালো বিস্কুট!
হ্যান্ড শেক হলো কাঁচামরিচ-ঘটিতব্যাপার
হ্যান্ড শেক হলো কাঁচামরিচ-ঘটিতব্যাপার ; ঘটনার এই লীলা সংহিতা তাই কোন মাসকট দাবি না করলেও সমতলায়নের ক্ষেত্রে এটি অনন্য; অনন্যতা মানে শুধু কৃষ্ণচূড়া দেখে যাওয়া নয় ;ফুটিয়ে তোলার
ভূমি থাকা কাচাই ; নামভূমিকায় যেমন অনেকেই মশা মারেন ! প্রকৃত ফুটে ওঠার গল্প তাই কদাচিৎ মুখ তোলা নয় ; যেখানে খুশি বসে আম্রকানন বইয়ে দিতে পারার গৌরবতাই ফুটে ওঠা ; লীলাসংহিতা; গৌরব;
গৌরবে থাকে বাউতি কাটার রহস্য ; ভালো বাউতি কাটার রহস্য এই, আগেই শিকার সামলে নেওয়া ; নিশিচত দড়িটিকে ছুঁয়ে ফেলার কৌশল; কৌশল তাই মানিলন্ডারিং কিবা পরীক্ষার খাতায়; ব্লাকবোর্ডে বিবসনায়; কৌশল তাই হ্যান্ডশেকেও ;
হ্যান্ডশেক হলো কাঁচামরিচ-ঘটিত একটি ব্যাপার।
মাংস
মাংস ছাড়াও তুমি অনেক সুস্বাদু
তবু মাংস মাংস বলে নীল হবার আগেই
বলছো যে সাদা হলো
প্রিয় হবার প্রতীক উপমা।
ফলে মাংস সিদ্ধের প্রক্রিয়া তোমাকে
ছোটায় স্টেট ব্যাংক; তেঁতুল নদের জলে ;
এ নাকি মাংসপিপাসু তকের টান
মেটাল গানের বেলা
সৌরভে সুস্বাদু যারা তারাও মাংসাশী ;
তবু মাংস ছাড়াই তুমি অনেক সুস্বাদু।
তরঙ্গ মথুরা
লতা যে জড়িয়ে আছে গাছ
তার নাম কি মাধবীলতা
বিনয় মজুমদার, দূরের বব ডিলান!
লতার জড়িয়ে থাকায় গাছের
সরল সৌন্দর্য বাড়ে
আর তাতে অভিভূত হয়
নৈঃশব্দের গাঢ় নীল
প্রবাহিত কলমি লতার তরঙ্গমথুরা ;
স্তরে স্তরে ভাসমান-
মৃত্তিকার পাঠশালা, মন্দির, প্যাগোড
বড়বড় শিলালিপি, চিত্রকলাযত।
লতা যে জড়িয়ে আছে গাছ
ভেবেছো কি-
কী করুণ লতার স্পন্দিত সবুজ; মদের গিলাব আর
রঙহীন খড়োঘর ;
গাছ বড় স্বার্থপর ;
নক্ষত্র রচনা করে বাল্মীকির মতো!
লতা যে জড়িয়ে থাকে গাছ
তার নাম কি পাতাবাহার
সমর সেন অথবা জীবনানন্দ দাশ?
প্রিয় মক্ষিকা মরুপথ
তোমাকে দেখার দারুণ ইচ্ছা দয়াল।
তোমাকে কি দেখা যায়!
তোমাকে কি দেখা যায় যমুনার জলে
কোনো তীরের বিস্তৃত ললাট জুড়ে স্ফীতমান,
তোমাকে দেখেছিলাম
পাকা ধানক্ষেতে কাকতাডুয়ার সাথে কথা কইবার বেলা;
দুধমাখা ভাত কাকের গলায়
পেয়েছিলাম বাঁশের মতিহার
আর সন্ধ্যের কার্নিশ বেয়ে বেয়ে
জেনেছিলাম খবর ;
অন্ধকার শেষে রাত গেলে ফোটে না সূর্যের কুঁড়ি
লাভা চলে গেলে আসেনা ফিরে আগুন গুহার শরীরে,
তোমাকে কি দেখা যায় মলিন মক্ষিকা!
চন্দ্র বিন্দু ভুলে গেলে ফাঁকা থাকে আলোর মহাল
সুতরাং, রেইন কোটের মাঝখান থেকেও তাকিয়ো
জঙ্গলে ঘাসে বিদ্যুতে
আর চুপ করে চাঁদ মুখে চন্দ্রবিন্দু দিয়ে
জয়ধ্বনি কোরো জীবের ও জীবনের;
গণিত ও লবণের ;
তোমাকে কি দেখা যায় বকুল প্রিয় মক্ষিকা মরু পথ?
নক্ষত্রকিরীটী
জলকে জীবন মানো, অগ্নিকে দেবতা-
এবার ফেরোতা মাটে মানুষ, এবার বলো
চৈত্রজয়ের কাহিনী।
চৈত্র কি ঘাসের গালিচা ; সোনার মুকুট
জলের মতো জীবন বিলিয়ে বেড়ায়?
অগ্নির মতো শুঁড়ে পেঁচিয়ে
জিহ্বায় তুলে ছাই;
চৈত্র কি নিয়ত ব্যবহার!
বায়ুকে জীবনমানো, মাটিকে বিনয়,
এবার চলো শঙ্খচূড় ; দীপ্ত ফড়িং ;
মহর্ষি ব্রক্ষ্মাণ্ড;
চৈত্রের ঘরে ফেরো-যে ঘর
নক্ষত্র, কিরীটী
হক আল্লাহ্হক
তুমি যে বিচিত্র ঢঙে
কথাকে গাজর আর তিতাকে মধুর
করে তোলো; এ-ওতো ক্ষমতা।
মাজারে পাগলা বাবা
ফুঁদিয়ে বলে ‘হকআল্লাহ্হক’
এটাও তো ক্ষমতা— না?
মাউসে হাত চেপে দূরের গুঞ্জনে মাতো;
ভেলকিও দেখো বিদ্যুত-মস্তকে;
এ-ওতো ক্ষমতার অংশ ;
ক্ষমতা তো শুভ্রকেশ, লালগাভী, গোপনকস্তুরি
ক্ষমতা দেখিয়ে
রঘুনাথ লঙ্কা জয় করেছিল আর অর্জুন দ্রৌপদিকে।
মুর্তজা বশীর
হুতুম পেঁচার দর্শন বোঝে না বলে ছেলেটিকে
ড্রয়িং রুমে তোমরা যা পারো বকে যাও,
পারো তো র্যাগিং-চর্চাটা সারতেও পিছুনও।
ফিরে আসা ছেলেটি ঝুমকোফুলের দর্শনে
বুঁদ হয়ে আবারও লিখলো পদ্য এবং ভাবলো:
মুর্তজা বশীর অনেক বিখ্যাত ছিলেন ‘ডেডলিজার্ডে’
আরেকটি ডেড কেস আঁকা বড় প্রয়োজন।
শনিবার, শ্রেষ্ঠদিন
শনিবার। লোকে বলে দিনটি অশুভ।
লোকে বলে এইদিনে মঙ্গলযাত্রাও ঠিক নয়।
নিরাকার সিদ্ধি বলে :
স্রোতের সঙ্গেও সবকিছু নয় ;
মননের কাছে সব,
মননের কাছে থাকে ধরিত্রীর
সকল সোপান ;
যেমন পথে ফুল হাতে মেয়েটির
কাছে শনিবার তার শ্রেষ্ঠদিন;
বছরের প্রতি শনিবার
ভীষণ কাহিনী করে ধরিত্রীর ডাক শোনে সে।
মেঘ, কাঠঘোড়া
অনিবার্য মন ফুলে
আসে মেঘ
ফিরে যায়
কাঠ ঘোড়া এক ;
কাঠঘোড়া
সে-ও এক প্রকৃতির সেতু ;
মনফুলে
যতঘর;
দেয়ালের ভাষা; তার নীচে
থাকে এক বেড়ালের রাত;
ফুলতার
থাকে সব ভর - ফুলে;
গাছে কিবা বনে
রেঁস্তোরার কোনে;
দু'পায়ের ফাঁকে ফাঁকে
ভর করে
আরো কিছু ফুলেল রমন;
কাঠঘোড়া আর কাঠুরের
ফাঁকে
বলি
এ বেলায়
অনিবার্য মনফুলে
আসে মেঘ;
ফিরে যায় কাঠঘোড়া এক।