অলস দুপুর অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন: পর্ব ০৮

অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন : পর্ব ০৮

 সাইটে প্রবেশের জন্য আপনাকে স্বাগতম। এটি অলসদুপুর ওয়েবম্যাগের একটি অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন। এই সংকলনে বাংলাদেশ ও ভারতের নানা প্রান্তে যারা দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্য চর্চা করে চলেছেন, লিটলম্যাগ চর্চা করে চলেছেন, তাদেরকে বিশেষ ভাবে স্থান দেয়া হচ্ছে। আমরা জানি যে পুঁজিবাদের বিকাশের প্রক্রিয়াটিই এমন যে ইটের নিচে সবুজ ঘাস চাপা পড়ে যায়। আমরা প্রশান্তির জন্য দিগন্তের দিকেই তাকিয়ে থাকি।

অলসদুপুর সেইসব কবিদেরই খুঁজে চলেছেন। যারা নিরবে কাজ করে যাচ্ছেন, কোন এক দূরে বসে লিটলম্যাগ চর্চা করে চলেছেন বছরের পর বছর। সন্ধ্যায় জোনাকির মত তার চোখও জ্বলে ওঠে নতুন কবিতায়। সেইসব নতুন কবিতাকে খুঁজে চলেছে অলসদুপুর।

অনলাইন কোন স্থান নয়। ইন্টারনেট মানে বিশ্বের যে কোন প্রান্তের সাথে যুক্ত আপনি আমি। এখন আমি আপনি বিশ্বের যে কোন প্রান্তের কবিতার সাথেও যুক্ত। কিন্তু প্রান্ত তো আছে। যে এসে মিলিত হয় মুক্তির সাথে। অলস দুপুরের কাছে জেলা হচ্ছে এক একটি প্রান্ত, যে যুক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত শুধু বাংলাদেশ নয়, বাংলা কবিতা নয়, বিশ্ব কবিতার সাথে। আমরা অলস দুপুরে বাংলাদেশ ও ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কবিদের কবিতা এই আয়োজনের মাধ্যমে পাঠকদের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি।

 সংকলন পদ্ধতি: একজন মূল সম্পাদক থাকেন। মূল সম্পাদক থাকবেন দুপুর মিত্র। বিভিন্ন জেলা থেকে একজন অতিথি সম্পাদক নির্বাচিত করেন। অতিথি সম্পাদক তার জেলা থেকে কবি নির্বাচিত করেন এবং তাদের কাছ থেকে কবিতা সংগ্রহ করে মূল সম্পাদকের নিকট প্রেরণ করেন। প্রতিটি পোস্ট এক একটি জেলা বা প্রান্তের সংকলন হিসেবে গণ্য হবে। যিনি অতিথি সম্পাদক থাকবেন তার সম্পাদনা নিয়ে একটি ছোট সম্পাদকীয় থাকবে। এভাবে ছোট ছোট সংকলন মিলে একটি বড় সংকলন হবে।

 যাদের কবিতা সংকলিত হবে

 ১. দীর্ঘদিন ধরে লিটলম্যাগে জড়িত

 ২. বিভিন্ন জেলায় বসবাসরত

৩. সাহিত্যচর্চায় নিয়মিত

সংকলনটি চূড়ান্ত নয়। বিভিন্ন সময় এটি আপডেট হবে। সংকলনটি সমৃদ্ধ করতে পাঠকের প্রস্তাবনা ও মন্তব্যকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। প্রস্তাবনা বা মন্তব্য জানান mitra_bibhuti@yahoo.com এ।

অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন: ০৮ পর্বের অতিথি সম্পাদক কবি রবিন পারভেজ।  তিনি বাংলাদেশের শেরপুর জেলা থেকে কবিতা সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে ‘অলসদুপুর’ ওয়েব ম্যাগাজিনকে সহায়তা করেছেন।  তার প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা।

রবিন পারভেজের সম্পাদকীয়

কবিদের থেকে কবিতা সংগ্রহ, বাছাই এবং সংকলন প্রকাশের কাজটি খুব সহজ নয়, বেশ কঠিন। এই কঠিন কাজটিই করতে হলো কবি দুপুর মিত্রের ওয়েবম্যাগ 'অলস দুপুর' এর জন্যে।

অলস দুপুর প্রকাশ করছে জেলা ভিত্তিক অনলাইন বাংলা কবিতা সংকলন। শেরপুরে বসবাস সূত্রেই দুপুর মিত্রের অনুরোধে শেরপুর জেলা সংকলনটির কাজ আমাকে করতে হলো। কবিতা কোন নির্দিষ্ট স্থান বা ভূ-খণ্ডের সীমাগণ্ডি মানে না আমি এরকমটা ভাবতে আনন্দ পাই, তথাপি কবি'র তো র'য়েই যায় নির্দিষ্ট স্থান, জন্মভূমি। অস্বীকার করা যায় না। অলস দুপুর বলে—অনলাইন কোন স্থান নয়। ইন্টারনেট মানে বিশ্বের যে কোন প্রান্তের সাথে যুক্ত আপনি আমি। এখন আমি আপনি বিশ্বের যে কোন প্রান্তের কবিতার সাথেও যুক্ত। কিন্তু প্রান্ত তো আছে। অলস দুপুরের কাছে জেলা হচ্ছে এক একটি প্রান্ত। যে যুক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত শুধু বাংলাদেশে নয়, বাংলা কবিতা নয়, বিশ্ব কবিতার সাথে।  সেই প্রান্তের ঔজ্জ্বল্যে এগোই।

এখানে মোট দশ জন কবির কবিতা একত্র করা গেল। বাইরে রয়ে গেলেন অনেকেই। আবার অনেকের কাছে কবিতা চেয়ে বিমুখ হতেও হলো। এটা হয়। এভাবেই জ্বলে ওঠে বাল্ব। 

চাহিবামাত্র কবিতা দিয়ে যারা আমাকে সহযোগিতা করেছেন তাদের সকলের উদ্দেশ্যে ছোট্ট করে বলি—ধন্যবাদ।

 

রণজিত নিয়োগী

 জন্ম ৭ নভেম্বর ১৯৪২ শেরপুর জেলা শহরের গৃর্দানারায়ণপুরে, মৃত্যু ১১ জানুয়ারি ২০১৬। তিনি একাধারে একজন মেধাবী অঙ্কনশিল্পী ছিলেন।  আট/নয় বৎসর বয়স থেকে পরিবারের উৎসাহে ছবি আঁকায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। বারো বৎসর বয়সে কবিতা লেখার সূচনা। ১৯৬৩  সালে প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে। 

১৯৬৪ সালে ঢাকা চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ৬৬ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় স্টাফ আর্টিস্ট পদে চাকুরী জীবন শুরু করেন। ১৯৭০ সালে প্রথম কাব্য গ্রন্থ 'কাল আগামীকাল' প্রকাশের উদ্যোগ নেন। সদর ঘাটের সিকদার প্রেসে ছাপার কাজ যখন শেষ পর্যায়ে— দেশ সংগ্রাম মুখর হয়ে ওঠে। ছাপার কাজ বন্ধ হয়। পাণ্ডুলিপিসহ মুদ্রিত কাগজপত্র খোয়া যায়।  ১৯৭১ সালে কোলকাতায় সংগঠিত বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার কর্মকাণ্ডে চিত্রশিল্পী হিসেবে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭৪ সালে দৈনিক আজাদ বন্ধ হওয়ার আগমূহুর্তে বস্ত্রশিল্প সংস্থায় সহকারী ডিজাইনার পদে চাকুরী নেন। ৭৬ সালে উক্ত সংস্থার মসলিন কটন মিলে প্রেরিত হলে কবিতার সাথে বিচ্ছেদ ঘটে।  ১৯৮৪ সালে মা জ্যোৎস্না নিয়োগী অসুস্থ হলে চাকুরী ছেড়ে শেরপুর চলে আসেন। মা এবং বাবা বিপ্লবী রবি নিয়োগীর অনুপ্রেরণায় আবারও জীবনের সাথে কবিতার যোগসূত্র গড়ে ওঠে। প্রচুর লিখেছেন। সম্পাদনা করেছেন দু'টি কাগজ— বজ্রে বাজে বাঁশী, মৃৎ। তাঁর কোন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি।

 


রণজিত নিয়োগীর কবিতা 


শস্যদানা চিবুতে চিবুতে


ইতিহাস উর্ধ্বশ্বাসে লেখে দুকলাম

লাল শিরোনাম।

 

মূলতঃ ধনেই ধ্যান, কল-কব্জা যা কিছু ঘোরায়,

শস্যদানা চিবুতে চিবুতে

এইগতি নাভি কাটে, নাড়িটান কাটে।

 

এই গতি নাড়িটান কাটে।

যন্ত্র আর ভারে, প্রকৃতি নেহাৎ তুচ্ছ,

কাটে পৃথিবীকে এফোঁড় ওফোঁড়, কাটে

প্রেমানুগ সৃজন-দর্শন;

এই কৃত্য নাভি কাটে, নাড়িটান কাটে।

 

আজ পাখা, সভ্যতার,

দমক দ্রুতির, 

উড়েছে হাওয়ায়;

কল-কব্জা যা কিছু ঘোরায়

ঘোরাচ্ছে ঘোরের চাকা, শস্যদানা চিবুতে চিবুতে।

 

প্রতিপাদ্য অন্ধকার

 

হৃদয় সম্পর্ক সূত্রে ছেদ টানে কড়ি। আর ইন্টারনেট দ্রুততায়

প্রতিপাদ্য অন্ধকার বাঁধ কাটে রাতে।

 

খসে পড়ে মুখাকৃতি থেকে

যা কিছু সরল মুক্ত দাঢ্য মানবিক।

সব মুখ ডলারের, সব মুখ ইউরোর উৎকষ রঙিন

পূর্বাপর দাম্ভিকতা

দর ভেদে বাজারে বিকোয়

 

অবারিত বাণিজ্যের খেয়া

তুলে আনে আরো দৃঢ় মঙ্গা-নীল বিষের জুড়ন

হাতে দেয় নুলোপনা

গোল্ডেন হ্যান্ডসেকের মিতালী মরণ।

 

সময়-সম্পর্ক হতে হৃদয়ের সময়ের অন্য এক ভাষ্য আছে

অজেয় কর্কশ

যে হাত পলির গন্ধে মাটির বোধক

যে মন আলোর রঙে ফলে ওঠা ধান

রাখে প্রাণ যুদ্ধমান। প্রতিবন্ধী মরণ মানে না।

 

একাত্তর প্রবল শরীরী

 

নতুন ঘাসের মধ্যে, নতুন পলিতে,

পরাজিত অন্ধকার আবার খুলেছে তার ঝাঁপি। 

নগরের ব্যস্ততায়, পাড়াগাঁর অলিতে গলিতে,

তারা ফের প্রেমময়, তুখোড় আলাপি।

 

গোপন ক্ষুধার ছকে, মুখোসেয় মুখে,

পুরোন রীতিতে মাখে মনোহর রঙ।

কলজে কামড়ে ধরা রক্তপায়ী ঝোঁকে

বিকট ছেদন দাঁতে ঝলকে ওঠে সুপ্রাচীন ঢং। 

 

পুরোন দুর্মর ঘৃণা রক্তে করে রীরী।

পরাজিত অন্ধকার এই মাটি সইতে পারে না।

 

যেহেতু চৈতন্যজুড়ে একাত্তর প্রবল শরীরী

আমাদের যোদ্ধামন মরে না হারে না।

 

ভিজি, তবু ভিজি

 

কদম ছিলোনা বনে। মনে পড়ে, মাটিতে খরান?

ফাটা মন বাঁশীতে কেঁদেছে খুব।

তার ধুন তুমি কি শোন নি?

হায় বাঁশী, শুষ্কস্বর, উদাস উম্মুল,

কামিনী রেণুর গন্ধ চেয়ে ভেসে চলে গেছে

ছলোছলো মেঘমল্লারের খোঁজে!

 

ভিজাও ভিজাও বলে কতোগান বেলায় সেধেছি,—

এলেনা, এলেতো আজ,

অবেলা স্বেচ্ছায় ভিজে নিবিড় শ্রাবণী।

তুমি কি বৃষ্টির মতো, বয়সেও কোমল গান্ধার,

নরম স্বরের মধু, নাভিলগ্ন গভীর আওয়াজ,—

ধারাস্নানে ডাকো নিধুবনে?

 

বেলার সহজ সে কী অবেলায় খুঁজে পাওয়া যায়!

ভিজি, তবু ভিজি, নদী মাঠ ঘাসফুল মাটির মতোন,

সহজ আনন্দময় প্রাণের কিরণ যদি পাই।

 

কোথাও নক্ষত্র ভাঙ্গে

 

কোথাও নক্ষত্র  ভাঙ্গে। তার ঘাই চাঁদেরে কাঁপায়।

শূন্যের তুষার ভেঙ্গে দূর অভিযানে

আলোর মেখলা তার পৃথিবীর কটি ছুঁয়ে নাচে।

আমিও মৃত্তিকাবাসে

আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য খুঁজে পাই খুব। 

 

জীবন সমীক্ষা ভোল। কেন তুমি বুঝি না এমন

সর্বাঙ্গে বিভক্তি রেখা কেটে দাও! বলো,

এবার সুন্দর এসো জতুগৃহে ভস্ম হবো,

হবো নাচ আত্মলোপী সাধন-সঙ্গীতে।

অবশেষে তালকাটা উৎসবের লয়ে

সময়ের নাভি কেটে তুলে আনো বেতালা আওয়াজ।

 

বিভক্তি ফাঁটল চুয়ে প্রজন্মের রুক্ষ্ম ক্ষেতখলা

নদী আর অরণ্যানী থেকে

উঠে আসে বাষ্পরাশি ধূলো-ভস্মে নিহত শ্রাবণ।

ক্ষুধার্ত গৃধিনী দলে পাল্লা দিয়ে অরণ্যের রক্তভূক প্রাণী

ছুটে আসে লোকালয়ে নৃশংস নিষাদ।

 

কোথাও নক্ষত্র ভাঙ্গে আমাদের শীতে।

কোথাও নক্ষত্র ভাঙ্গে আমাদের মনে।

আলোর অভীপ্সা নিয়ে আর কত ভাঙ্গি?

উদয় শংকর রতন

 জন্ম : ২৯ ডিসেম্বর ১৯৪৮, শেরপুর জেলার সাতানিপাড়ায়। মৃত্যু : ২৫ মার্চ ২০০২।  কবিতা লিখতেন কিশোর বয়স থেকেই। অনুকূল পারিবারিক পরিবেশ তাঁর প্রতিভা স্ফুরণে সহায়তা করে।  প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থনিসর্গের নীল খামে, যা উড়ে যা কালো মেঘ।  প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ একজন মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য গল্প, খাঁচায় সংসারী।

উদয়  শংকর রতন-এর কবিতা

চিত্রার  চিত্রিত  রূপে

 

চিত্রা, চিত্রা তো তোমার নদী

যে ভাবে উল্লাসে, ছোটে, হাসে, উপমায় উৎপ্রেক্ষায়

নদীর দীঘল ঘূর্ণাবর্তে

উদ্বিগ্ন জলোচ্ছ্বাসে চিত্রিত রূপে

 

 চিত্রার উপমা দৃশ্যত তুমিই।

তুমিতো নদীর চিত্র রূপ

কিংবা চিত্র রূপে তুমি,

নদী মানে চড়াই উৎরাই জলকেলী

স্রোত ও বাঁক বন্যার্ত ভাঙ্গন

নদী মানে স্বপ্ন আর সর্বনাশ

নদীর বহতা জলে পঙ্কিলতা খেলা করে

  

চিত্রা, চিত্রা তো তোমার নদী

যে ভাবে রৌদ্রের কম্পমান আলোরা চিত্রার আজলে

খেলা করে, যে আমি স্খলনের স্রোতে

দিগন্ত আঁধার করা সজল শ্রাবণে

অক্লান্ত বৃষ্টি ধারার মতন উন্মুখ

নদীর নাব্যতা হারালে

 

যে মাঝি ফসলের অভীপ্সায়

দিকভ্রান্ত, শূন্যতার চরে চাতাল আকাশ

বুকে রাখে, সম্পন্ন নদীর জলে

খরকুটো হয়ে আমিও পড়ে থাকি

পাঁকে, শৈবালের চিকুরে

 

যখন নম্রনীল সন্ধ্যার ছায়া

হয়ে নেমে আসি, নদীর অজস্র ঢেউয়ের উল্লাসে তুমি

যাকে ধরে রাখতে পারো না কখনো

যে আমি সীমাহীন উচ্ছ্বাসে জড়াতে চাই বুকের

আঁচলে, তোমার অজানুলম্বিত স্রোতধারে

তুমি কি তাকে ভাসিয়ে দেবে নদীর কল্লোলে?

 

 শব্দের মুখোশ

 

শব্দের মুখোশ থাকে কোন কোন মানুষের মুখের লেবাসে

শব্দকে তারা ব্যবহার করে, সত্যের বরখেলাপে

ছলচাতুরীর ফন্দি ফিকিরে,

শব্দকে আড়াল করে

শব্দের উপরে কৃত্রিম শব্দ বসিয়ে

 

 প্রকৃত শব্দ আজ ঢুকে গেছে গুহায়

ভেতরে, শব্দের দৈন্যদশা মানুষের

 

 উর্বর মস্তিষ্ক থেকে শব্দ ছিটকে যায়

স্বার্থপরতায়, বুকের অলিন্দে যে শব্দ

উপচে ওঠে তাও বুদ্বুদের মতো

চুপসে যায়।

 

 কিছু কিছু শব্দকে মানুষ সরিয়ে রাখে

শব্দের ভেতর থেকে খুব সাবধানে

কেননা কিছু কিছু শব্দ আছে খুব

আত্মঘাতী।

 

 তাই মানুষ শব্দকে রেখে ঢেকে রাখে।

 

আমরা তিন বন্ধু

 

পথ চলতে চলতে অনেক পথ পেরিয়ে এসেছি

আমরা তিনজন সঙ্গী

আমি, ঈশ্বর ও দিগ্বিজয়ী শয়তান।

আমাদের তিন বন্ধুর স্বাচ্ছন্দ্য বসবাস মগজের কোষে যেন 'কর্মজীবী

মহিলা

হোস্টেল' আমাদের নিবাস

আমরা রয়েছি যেন এক জ্যামেতিক বৃত্তে

কিছুতেই পারিনা যেতে ধনুর সটান ছিলার মতো ছিটকে

আমাদের অভিন্ন বসবাস একে অপরের ভেতরে

মিলে মিশে আমরা তিন সহযাত্রী

আদর্শে যদিও ভিন্নগামী

আমি অমিতব্যয়ী

একজন পরিনামদর্শী

অন্যজন বিচ্ছিন্নতাবাদী মিলেমিশে একত্রে সঙ্গী।

রবিন পারভেজ

জন্ম ১০ নভেম্বর ১৯৬২ শেরপুর জেলা শহরের কসবা কাঠগড়-এ। কবিতা লেখা আশির দশক থেকে। শুরু থেকেই লিটল ম্যাগ এর লেখক, সম্পাদক এবং প্রকাশক। সম্পাদনা করেন— মন্বন্তর, কবি ক্যামেলিয়া সান্যাল এর সাথে যৌথভাবে সম্পাদনা করেন 'মানুষ থেকে মানুষে'।  কাগজটি ত্রৈমাসিক হিসেবে নিয়মিত প্রকাশিত হয় বিশটি সংখ্যা। শেরপুর জেলায় নিয়মিত, বহুল-প্রচারিত এবং দীর্ঘ আয়ুর এটিই একমাত্র কাগজ। বর্তমানে নিজে সম্পাদনা করছেন কবিতার কাগজ 'রা' এবং দুপুর মিত্র ও বিপুল দাম হৃদয় এর সাথে যৌথভাবে সম্পাদনা করছেন আরো একটি সাহিত্য-কাগজ 'বিহান'।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ—দৃশ্যের ওপাশে চিহ্নের আড়ালে (১৯৯৯)

রবিন পারভেজের কবিতা 


চাঁদ আর চার অক্ষরের ঘোরের ভেতর

 

চাঁদটাকে মনে হচ্ছে নিসর্গের কপালে টিপ।  আর তার জোসনা মেয়ে পৃথিবীর

পাতা-চুলে বিলি কাটছে একমনে।  একটা সাদা বেড়াল পথের উপর ডিগবাজি 

খাচ্ছে- সে কি ছিন্ন করছে অদৃশ্য সব বাঁধন, নাকি বেড়ালির জন্য তড়পাচ্ছে –

ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। 

 

ছেলেটি-মেয়েটি কিসব মৃদু কথা ভাজতে ভাজতে চলে গেলো।  ওরা বেড়ালটিকে 

দেখতে পেলো না।  হয়ত ওদেরও ভেতর এরকম একটি সাদা বেড়াল ডিগবাজি 

খাচ্ছে-তড়পাচ্ছে।  চার অক্ষরের ঘোরের ভেতর- আঁচড়ে দংশনে উষ্ণ দুই খণ্ড

মাটি, খুঁজে ফিরছে কি দুই বিন্দু শিশিরের বাড়ি? ঠিক বোঝা গেল না । 

 

বোঝাবোঝি থাক।  পুকুরের শান্ত জলের বুকের মতো রাত-চাঁদ আর ফুরফুরে 

জোসনার ডানায়, বোঝবার চেয়ে দেখবার চোখ জরুরি।  আজ রাতটুকুর জন্য,

আমি বাঙলা ব্যাকরণ থেকে ,।  -;? কাঁটাগুলো তুলে দিলাম।

 

কথা 

 

দূর থেকে ভেসে এলো কথা         ভেসে এলো ঘ্রাণ। 

হৃদয় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় অদৃশ্যের অথৈ, মাটির 

মমতার ভাঁজ

 

কথা     সে তো নকশী তোলার সুতো 

কথা      সে তো স্বপ্ন বীজ শত শত

নিঃসঙ্গ মরুপ্রান্তে দীপিত অরণ্যের মতো অন্তর-কথাফুল 

আমাদের সম্পর্কের শেকড়ে 

রাখে রঙধনু ভাবনা 

 

কথার শক্তি বড় সূক্ষ্ম

তা যেমন ফুল 

আবার তা কাঁটাও হতে জানে, কথাকাঁটা-

 

প্রাত্যহিক স্বার্থপথে তাঁর খোচার গণিত

জমা রয় আমাদের বুকপকেটে।   

 

শূন্য অথবা ০ কথন

 

একটি সুদর্শন শূন্য এসে বসে পড়ে কোলে।  নড়ে না –সড়ে না, ঠায় স্থির।  মাঝমধ্যে 

হাত-পা ছোড়ে – যেন গর্ভে সন্তান জায়গা নিচ্ছে।  কীযে কুয়াশামুখো নাকাল সময়

চেপে বসে আছে কোলে

 

এদিকে কত কাজ।  উপচে পড়ছে ভাতের মাড়।  উনুনে উস্কে দেয়া হচ্ছে না আগুন। 

টেবিলে প্রাপ্তিহীন এলোমেলো থালায় শুকনো পাতার ঢঙে ঝড়ে পড়ছে 

সেকেন্ডমিনিটঘণ্টা 

 

কিছু মুখ তেতে ওঠে।  বাতাসে ডুব সাঁতার দিতে দিতে স্বপ্ন আঁকে কতক বেসামাল 

তর্জনী। 

 

শূন্য যাক-নিপাত যাক

 

বলতে বলতে চলতে চলতে কিছু লোক কাঁপায় পথ-উড়ে খুব ধুলো।  শেষমেষ ক্লান্ত

পা জড়ো হতে থাকে মিনারের ছায়ায়। মিনার মূলতঃ মূলেই ছিলো।  এখন-দিন নয়,

দৈব ভাবনায় দীর্ঘ হচ্ছে প্রার্থনার হাত 

 

প্রার্থনা আর দিন।  মাঝখানে যোজন যোজন পথ, ফাঁকা 

 

দেখি পথটির পাশ-ছুঁয়ে গুটি কয় লোক চিৎকার করছে- ভাইসব আসুন। আর 

একটি বার আসুন।  আমরা বুঝতে পেরেছি আমাদের মূলেই ভুল ছিল। আমরা 

আসলে বাগিচার যত্ন আর নার্সারির যত্নে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যটুকু বুঝতে পারিনি....  

হাদিউল ইসলাম

শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার মাটিয়াকুড়া গ্রামে ১৯৭৪ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন।  তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সম্মানসহ স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।  তার প্রকাশিত গ্রন্থ " ধুলোকালস্রোত " ( কবিতা) ২০০৪আগুনের শিরদাঁড়া ( কবিতা)  ২০১৯ এর বই মেলায় প্রকাশিতব্য।  " সাঁকো " একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন।  তার লেখা কবিতা  বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ও লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত ছাপা হয়ে আসছে।

হাদিউল ইসলামের কবিতা 


উৎসবে 

 

লাল পেড়ে শাদা কিম্বা হলুদ শাড়ির উতলা প্লাবনে

আমি আজ মাছেদের নিবিড় আত্মীয়

 

জলের ভাষায় কথা বলে দেখি 

এতো ঠাট্টা আমার কানকো বেয়ে চোরাগুপ্তা ঢুকে    

প্রফুল্ল মুল্লুকে তবু কোলাহলে থাকি

 

শহর তো আশ্চর্য এ্যাকুরিয়াম

পেট ভর্তি যার মারাত্মক ধাঁধা

এইসব সুক্ষ্ম কারচুপির ভেতরে আমি তবু দেশাত্মবোধক 

মাছেদের চলাফেরার নিচেই পড়ে থাকা নুড়ি

মন ভেসে যায় চোরা উৎপাতে

       

প্রিয় আততায়ী   

 

সর্বত্র ছড়িয়ে আছো ,প্রিয় আততায়ী

শোনো , আমি কিন্তু থাকতে আসি নাই

 

আস্তিনের ভাঁজে রক্তাক্ত প্রহর সর্বদা লুকিয়ে

যতোটা সম্ভব আমি সামাজিক

 

আমার মৃত্যুর পরোয়ানা তোমার পকেটে...

 

জোড় হাত অশ্রুময় করুণ মিনতি

ঘরের বিলাপ ,শৃঙ্খলা তুমুল বিসর্জিত

 

আমি জানি , এ ঘর ঘুনে জর্জর

তবুও তো ধনুতে লাগাই তীর আহা রামধনু

অর্জুন অর্জুন

 

প্রার্থনার হাতে 

 

অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মুখে গেঁথে আছে আছে মন

প্রার্থনার দু’হাতে সে ছবি

                         কাঠ কয়লায় আঁকা

 

এতো যে মুখোশ খুলে যাচ্ছি

তবু বেরুচ্ছে না মুখ

ছিলো বটে ভালো চকখড়ি ধারাপাত

 

কটাক্ষ , হাসি ও স্পর্শের ফসিল

মনে পড়া না পড়ার মাঝখানে

                      কুটিল বাতাসে খেলে

 

অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মুখে গেঁথে আছে মন

প্রার্থনার দু’হাতে সে ছবি উগ্র খাজুরাহো

কোহিনূর রুমা

কবি-সমাজকর্মী। জন্মঃ১৬ ফেব্রুয়ারি,১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ নালিতাবাড়ী,শেরপুর। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাঃ আনন্দ মোহন কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পেশাঃ শিক্ষকতা, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আছেন। কবিতায় হাতে খড়ি কৈশোরেই-,১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে।প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থঃ নীল উপাখ্যান(২০১২)দ্বিতীয় মূদ্রণ(২০১৮)।কবিতা ছাড়াও ছোটোদের জন্য ছড়া লেখেন,লেখেন সমালোচনাও।একজন জনপ্রিয় উপস্থাপক-আবৃত্তিকারও।

কোহিনূর রুমার কবিতা 


ত্রিচক্রযান

 

তাকে বলেছি,গোলাপ নয় বেলি আমার প্রিয় ফুল।

এতটুকু বিরক্ত না হয়ে স্বপ্নকারিগর

খুশিমনে বয়ান করেনঃ

আমাদের স্বপ্নযাত্রার সচিত্র প্রতিবেদন;

ঠোঁটে স্মিতহাস্য ঝুলিয়ে বলেনঃ ‘সর্ষের ভেতর ভূত’-

গল্পটি তিনি শোনেন নি

 

এই দীর্ঘ ভ্রমণের পথে-

আমার কুমারীত্ব তুলে দিয়েছি

তোমার হাতে;

 

যদিও জানি,তুমি এখনো

পূর্ণ, সুওখাঁটি- এই ত্রিচক্রের যানে

নবিশি প্যাসেঞ্জার

 

একটি দুপুর

 

ভাঙা পুলের কিনারে হাঁপাচ্ছে কুকুর;

রোদের জলে জিয়ল মাছের মতো

হাঁসফাঁস করছে স্টেশন পাড়া

লোকাল বাস;

 

টিকিট কেটেও জল মেলে না,এবং এতে

অভ্যস্ত গাছ বাগানে ফিরে দেখে

ফুলেরা পিপাসার জল দিয়ে

খুশির ফোয়ারা বানাচ্ছে;

পোষা ময়না কথা বলছে আগের মতো।

 

এরকম এক ঝিঁ ঝিঁ ডাকা বেলায়-

মেঠো ধুলোয় ঝরে থাকে

মান্দার ফুল;

কেউ জলবসন্ত নিয়ে জলের আকাঙ্ক্ষা করে!

 

টুকরো গল্প

 

ছোট্ট খুপরীতে কবুতরগুলো থাকে

 

উঠোনের শস্যদানা আর ডানার ওমের

ভেতরে ওদের মেঘবিহীন দিন

বেড়ে ওঠে;

 

কোনো কোনোদিন জলের তালাশে বেরিয়ে

সন্ধ্যেয় ফিরে এলে-

দেখি,ডানায় লুকোনো

জলের জখম!

 

আমাদের মৃত চোখ অভ্যস্ত বলে

জগতে জখমের নির্মম খবরগুলো

কেবল মুদ্রিত হয়

 

সুমন সাজ্জাদ

 ০৮ মে ১৯৮০, স্নাতক, স্নাতকোত্তর, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষকতা, বাংলা বিভাগ,জা হাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; 

কবিতা : পতনের শব্দগুলো (২০০৭)- সমুত্থান; ইশক (২০১৪)- রাচী গ্রন্থনিকেতন; নীলকণ্ঠের পালা (২০১৪)- শুদ্ধস্বর; প্যাপিরাসে লেখা (২০১৬),

প্রবন্ধ : প্রকৃতি, প্রান্তিকতা ও জাতিসত্তার সাহিত্য - (২০১১)--- আবহমান; আধুনিকতা ও আত্মপরিচয় (২০১৬)-- চৈতন্য;

রম্যগদ্য: রসেবশে বারোমাস (২০১৫) -- অক্ষর প্রকাশনী

অনুবাদ : হোমারের দেশ থেকে (প্রাচীন গ্রিক গীতিকবিতা (২০১৬) --- অক্ষর প্রকাশনী "লাতিন কবিতা (২০১৭), "প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্য" (২০১৮) অক্ষর প্রকাশনী "লাতিন কবিতা (২০১৭), "প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্য" (২০১৮) অক্ষর প্রকাশনী

কিশোর গল্প : পাখি, পরি ও নাইটকুইনের গল্প (২০১৮)

সুমন সাজ্জাদের কবিতা 


ত্রিস্রোতা

বৃষ্টিকে চেন? -- মেঘেদের বান্ধবী।

শুনেছি শ্রাবণ প্রথম প্রেমিক তার।

বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল

বাতাসে ওড়ায় অস্ফুট হাহাকার।


শ্রাবণকে চেন? -- আকাশের সহচর।

শুনেছি শ্রাবণ বাদলের কথা জানে।

দূরদেশে ওড়ে বৃষ্টিমুখর মেয়ে।

থইথই স্মৃতি শ্রাবণের ঋতুগানে।

 

বাদলও পড়েছে টুপটাপ স্বরলিপি।

শুনেছে হাজার বর্ষারাতের তান।

অঝোর নদীর করতলে ভাটিয়ালি।

মেঘবন্ধুরা দেখেছিল অবসান।

 

বৃষ্টিকে দ্যাখো? -- উড়ন্ত ছায়াপথ --

কার্নিভালের রঙভরা ফাল্গুনে।

আসছে আষাঢ় -- মন-ভাসানের দিন

জারুলপাখিরা বৃষ্টির কাল গোনে।

 

তবে কি এখন তিন দিকে গেছে স্রোত?

দেখে নি আকাশ একটি অন্ত্যমিলও।

চুপিসারে কেন মেঘদল বলে যায় --

শোনো হে আকাশ, কেউ ছিল, কেউ ছিল!


কালো মেয়ের গান

 

প্রথম, তুমি প্রথম এসেছিলে

আবার কেন সামনে এলে তুমি?

প্রথম, তুমি হলুদ পাতার মতো

ঝরেছিলে হলুদ বনভূমি;

 

প্রথম, তুমি প্রথম বারান্দাতে

মোহন বাঁশি, বুকে জমাট শ্বাস।

প্রথম, তুমি প্রথম এসেছিলে

নীলাভ চিঠি, সবুজ সর্বনাশ।

 

ওড়না ছিল রোদ্দুরে লাল ঘোড়া,

উড়ছিল তার কেশর ভরা গতি,

লুকনো ফুলের চিবুকে একতোড়া

আগুন ছিল, পাহাড়সমান ক্ষতি।

 

আগুন আমার লাগছিল যে ভালো

আঁচে আমার মুখ পুড়ে যায়, যাক...

যে এসেছে আসুক, তার দুহাতে

আমার সকল রঙিন হয়ে থাক।

 

বাঁকা সিঁড়ি, রেলিং ধরে নামি,

ত্রস্ত, কাঁপা দুইটি করুণ মুখ,

নামতে গিয়ে একটি নিমেষ থামি;

বাঁশির সুরে চমকে ওঠা বুক।

 

গুমোট ঘরে একটি চড়ই ডাকে,

দেয়াল জুড়ে বিক্ষত সব লেখা;

জানি না কোন স্বপ্নে পেলাম তাকে

মিলিয়ে গেল তার সে চরণরেখা।

 

প্রথম, তুমি প্রথম এসেছিলে

রঙিন ছিল, রঙিন ছিল সব,

প্রথম, তুমি প্রথম ভেঙেছিলে

ঝড়ের টানে পাখির কলরব।

 

প্রথম, তুমি আবার কেন এলে,

আবার কেন রোদ্দুরে টান মারো;

প্রথম, তুমি ঝড়ের অভিসারে,

জানো না কি, আগুন বড়ো গাঢ়!

 

প্রথম, তবু প্রথম সে তো নয়;

আবার কেন প্রথম প্রথম লাগে!

অবাক প্রেম টগবগিয়ে ফোটে

যেমন ছিল বছর কুড়ি আগে।

 

তাকিয়ে আছে ফুলের দোকান

 

শরীর জুড়ে তরুণ ক্ষুধা বলগা হরিণ।

তুমি আমার হাতের ওপর ছড়িয়ে দিলে

এক মুঠো দিন -- শস্যদানা।

 

এক মুঠো রাত লুকিয়ে নিলে আঁচল-পাড়ে।

নোংরা অটো। ব্যস্ত গলি। চমকে তাকাও

রঙবাহারে। বিড়াল ছানা।

 

আগুনবোমা ঝলসে ওঠে। সূর্য অস্ত।

দোলনচাঁপায় ঝড় লেগেছে। সন্ধ্যা মাতাল,

আদরগ্রস্ত। সাদায় কালোয়

 

অন্ধকারে হাসবে যখন শরীর দুখান

তখন কিন্তু দোষ দিওনা। শহর জুড়ে

ফুলের দোকান। নিওন আলোয়

 

দোষ দিওনা, তরুণ ক্ষুধা বলগা হরিণ

হাতের ওপর ছড়িয়ে দিলে এক মুঠো দিন,

একমুঠো রাত কাঁটায় কাঁটায় শরীর দুখান,

শহর জুড়ে তাকিয়ে আছে ফুলের দোকান...

 

পাণ্ডুলিপি, দেয়াল-ছবি -পুরনো সাত-পাঁচ।

 

পাতায় পাতায় সহজ কথা, বৃক্ষ শেখায় ঘর।

মানুষ থেকে মানুষ তবু ভাঙছে পরস্পর!

 

তারেক আহসান

জন্ম : ২২ অক্টোবর ১৯৮৫, শেরপুর জেলার নকলা উপজেলাধীন পাঁচকাহনিয়া গ্রামে। পড়াশোনা : ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পাশাপাশি নদী, নারী ও নিসর্গ পাঠ।  সম্পাদিত লিটলম্যাগ : চিরহরিৎ  শখ : প্রকৃতিকে পাশে নিয়ে গান শোনা মুঠোফোন : ০১৮২৬৬১০৮০৪ ই-মেইল : tareqahsan7 @ gmail.com প্রকাশিত বই: জীবনের জলছবি

তারেক আহসানের কবিতা


সুবন্ধু সমীপে

 

দুপুরের কাঠফাটা রোদের তীব্রতা বেড়ে গেলে

আমার ভিতরে একনদী জল ঢেউ খেলে যায়।

 

ক্রন্দনরত আগন্তুক

 

                           পাখিসমাজের আনাগুনা দেখে

 

তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে তৃষিত বিবেক।

 

 

বৃষ্টিদেবতা দূরে থাকে, ঔৎসুক্য মেটাতে

অলক্ষে বুকের 'পরে চাষাবাদ করি নিজস্ব শস্যক্ষেত

 

লতা       পাতা      গুল্মসহ জলজ বৃক্ষ  --

 

জল ছাড়া ধৈর্যশীল তারা

 

কেবল অনিবার্য কারণেই ভাঙ্গে যাদের শিরদাঁড়া।

 

আত্নদর্শন

 

শেষকৃত্যে কখন-যে লীলানৃত্য বন্ধ হয়ে যায়

                         শঙ্কিত নই;

মানুষ মাত্রই                       

পরশ্রীকাতর

 

পুরুষ মাত্রই                      

পরস্ত্রীকাতর

 

আমি মানুষ, আমি পুরুষ

অতএব উভয়েই আছি!

 

বৃষ্টি ভরা মিষ্টি পদ্য

 

আকাশ ভরে মেঘ করেছে, বৃষ্টি এলো এই বুঝি

কী জানি কী কোন্ দোষে, তোমার মনের প্রেম খুঁজি।

 

আকাশে মেঘ, মাটিতে জল-- ডুবে গ্যাছে চাঁদ-তারা

বৌ ডেকেছে, 'চলে এসো'-- বাড়িতে ফিরতে তাই তাড়া।

 

অধরা মন, পোষ মানে না-- প্রাচীন প্রেমের পদ্যে

বস্তুবোধের অতীত ডাকে, কাম-রমণের গদ্যে।

 

ভালবাসা এমনই, কাম আরও জটিল বেদ

সময়ে প্রেমের ডাক-- অসময়ে অশনি সংকেত!

সুমন দাস

জন্ম : ১১ এপ্রিল ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দ।

শূন্য দশকের কবি। 

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : অসীম তুমি কবিতা হও।

সুমন দাস-এর কবিতা

 

নদী দিনের স্বপ্ন

 

নদী দিনের স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছে নৌকো আর কাশফুল

অপেক্ষায় একাকিত্ব মাছরাঙা দুপুর

বাতাস উড়াচ্ছে ধুলো তুমি আর আসছ না…

 

শিমুলের গন্ধ মেখে শুকাচ্ছ চুল

অনুভবের ঔজ্জ্বল্য নিয়ে কাছে ফিরে যায় কোকিল

দৃষ্টিহীন প্রতিবন্ধী বলে নিদ্রাহীন কেটে যাও রাতের দহন

 

বাতাসের ডানায় জেগে থাক পাখি

রাত শেষে প্রভাতের গল্প ফেরি করে আসি

এমন অপেক্ষার দিনে ভিজেছে ধূসর প্রতীক্ষা

 

উঠোনে ধান ছড়ানো, কেউ নেই

অথচ কাক ছায়াকে দিচ্ছে পাহারা

ভয়ে ভয়ে দিচ্ছে ঠোঁট কেবল তোমার উপস্থিতি নেই

 

মেঘের নিচে রঙধনু, মনে হয় দূরে কোথাও বৃষ্টি

মাঠগুলো ডুবে গেলে তুমি শুধু ভিজে যাও

বৃষ্টিকে বলি দীর্ঘ হও অপেক্ষার খেয়াপার

 

গুরু ভাবনা

 

যা ভাবছ তা না, অহেতুক গুরু ভেবে

শিষ্য তুমি ক্ষয়ে যাও কেন?

অরণ্যে পাখিদের বাস

ফলজ বৃক্ষ নেই এখন কাকেরাই সন্ত্রাসী 

শৌখিন নাগরিকের প্রাণীমাংস বড় সুস্বাদু

অথচ হায়! পাখি নিধন পাখি নিধন।

প্রার্থনায় পায় হাত ইচ্ছেটা কি?

ক্ষমা করো গুরু পাপে ভারাক্রান্ত সব

পাপ না, পাপ না, অন্যায়

জোড় হাতে হয় না, যা সুন্দর সবই মানুষের

যা দেখছ চোখে তা দেখ মনে

সুন্দরের রহস্য সৃষ্টির আনন্দ

তুমি সত্য তুমি সত্য।

 

কাকতাড়ুয়া

 

প্রভাত জন্মের গলি বেয়ে ঢুকে পড়লাম সুলেখাদের গ্রামে

কুমোড় আর লাউতলায় হেসে উঠলো কাকতাড়ুয়া

প্রদর্শিত ভঙ্গিমায় ঢঙ দেখে শিল্পীর মূল্যায়ন করছিলাম।

হঠাৎ শিশির ভেজা নূপুরের শব্দে জেগে উঠলো সূর্যসকাল।

অতঃপর রূপ আর রঙের মোহে কবিতার চোখ।

অভিজিৎ চক্রবর্তী

জন্মসাল:২৭/০১/১৯৯৪

প্রকাশিত বই: কয়েক'টি ঝিঁ ঝিঁ পোকার আর্তনাদ,মধ্যাহ্ন মুখোশ।

জন্মস্থান:শেরপুর।

লেখালেখির শুরু-২০১০

 

অভিজিৎ চক্রবর্তীর কবিতা


ষড়রিপু

 

১. কাম

 

ঘুমন্ত বোতলে কাত হয়ে শুয়ে আছে অর্ধভেদী চাঁদ

হাত থেকে হাতের দূরত্ব মাপছে মধ্যকার বাতাস

কাশফুল বনের পাশে সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলা সন্ধ্যামালতীর দুঃখ পৃথিবীতে দুষ্প্রাপ্য।

নৌকা হয়ে স্রোতের বিপরীতে হিংস্র হয়ে উঠে মাঝি

বুক চিরে ফেলার আশায় নদীর শিৎকার,

সৎকার করে যায় অসংখ্য সম্পর্কের মিছিল

তিল থেকে চুল খসলেই থলের বেড়াল নিজেকে টাইগার ভাবা শুরু করে।

শাপে বরে আরও ফুলে উঠে নবযৌবনার কামনদী

অনভিজ্ঞ পাইলট জানে না "পৃথিবীর সকল এরোপ্ল্যান নষ্ট ইঞ্জিন দিয়ে বানানো" 

 

২. ক্রোধ 

 

ব্যাঙের গভীর নেশা ছাড়াচ্ছে তালপাতার সেপাই

এদিকে যুদ্ধের ময়দানে মাছিদের সাথে মশার তুমুল লড়াই

কড়াইয়ে পুড়ে যাওয়া মাছ জানে না কতোটা তেল তাকে ডুবিয়ে দিতে পারে। 

'হারে যেহেতু লজ্জা নেই' 

খেই মারছে আস্তা হারানো জেলে

পেলের পা কিনে নেয়ার সামর্থ বা সাহস বিলগেটস্ কখনও করবে কিনা ভাবা যায়?

দোহাই দিয়ে কাজ হবে না জেনেও ধর্মযুদ্ধে বুলি আওড়েছেন স্বয়ং ঈশ্বর 

অবশ্য,সাক্ষীর অভাবে এসবই লিপিবদ্ধ রয়েছে ধর্মীয় বাণে!  

ব্যাঙ জানে যুদ্ধ যখন অবশ্যম্ভাবী,জ্ঞানের পরিধি সেখানে অস্ত্রবিদ্যায় সীমাবদ্ধ।

 

৩. লোভ 

 

পৃথিবীডা সম্পাপ্রি ভাইবা চাটছি

খাটছি নিজেরে বলদ ভাইবা

"ভাইবা বোর্ডে কেনো মাতৃভাষায় প্রশ্ন করেন না?"

বলতেই কিছু দুষ্টবীর্যে ঝলছে থাকা মুখের ছিদ্র ক্রমশ ডুবে যেতে থাকে

এই ফাঁকে একদল নিয়ম প্রবর্তক কবি বলে উঠবেন,এটা কবিতা নয় চলিত-আঞ্চলিকে দুষ্ট! 

তুষ্ট করতে সম্পাপ্রির মতো চাটতে হবে,

হাঁটতে হবে তাদের সাথে,পেছনে কিংবা ডায়ে

সুযোগের ঘা দিয়ে বোঝাতে হবে

চেটে চেটেই আমরা বড় করছে তুলছি প্রতিনিয়ত

আমাদের প্রতিহিংসাক্তক লিঙ্গ। 

 

৪. মোহ

 

শেষবার দেখার সময় লীলাবতী

সুতির কাপড়ে মুড়িয়ে নিয়ে এসেছিলো একমুঠো নরম শরৎ

সেদিন মাটির পরতে পরতে বিছিয়ে পড়েছিলো প্রেম,দুধ চায়ের মাটির কাপটি পেয়েছিলো উষ্ণ প্রেমির দীর্ঘশ্বাস

এই আশ্বাস আর সম্পর্কের টান আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো প্রকৃতির লাইফসাপোর্টে

কোর্টে হৃদয় ভাঙার কেনো মামলা হয় না বলতে পারো?

ছাড়ো এ সব কথা,অনেক হলো

চলো আমরা বরং আমার বেঁচে থাকাটা উৎযাপন করি।

মদ

 

৫. মদ

 

হেরেমে বসে আছি

হাতে আমার রাজার সন্ন্যাস

বিন্যস্ত হয়ে আছে কালো আঙুর রাঙা গ্লাসে

ক্লাসে একবার নালিশ করেছিলো অখিলেস

সেই ক্লেস মিটেছিলো বছর দুয়েক পরে।

পকেটে টাকা নেই,বরে এসে নিয়ে গেলো আমার কিনে দেয়া আলতো হাতের মেয়াদ

পেয়াদা থেকে শাহজাদা আজ হেরেমে পান করছে তিনটি ভিন্ন ব্যান্ডের মদ

ক্রোধ থেকে যে ঈর্ষার নেশা পকেটে টাকা হয়ে ঢুকেছিলো

এক একটি পেয়ালায় পান করা এক একটি ফাঁদ হয়ে গেছে।

 

৬. মাৎসর্য

 

বাড়ির পাশের দাদার কিসের এতো সুখ! 

উন্মূখ হয়ে তাকিয়ে থাকি দরজার ওপাশে

রাতে দক্ষিণের জানালায় ভায়োলিন বাজায় কনকচাপা

বৌদির ভেসে আসা সুর

ধ্যুর,বাবা খুঁজে দিতে পারলো না সুমিষ্ট কণ্ঠধারী!  

পারবে কি করে?

নারী চেনা তো একটা জটিল মিথোক্রিয়া

রিয়া,রাইমা,রন্টি'র মাঝে কে যে কুহু বলে কখন ডেকে যাবে

এ যেনো ঝালোর একাগ্র দৃষ্টিতে পাতা কাঠি নেড়ে উঠা!

মাঝে মাঝে রোহানের প্রেমিকার দিকে চেয়ে থাকি

দেখি একজন নারী কতোটা বেঁকে গেলে একজন ভালো প্রেমিকা হতে পারে

ইচ্ছা করে ঈশ্বরের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলি "আল্লাহ্ মালিক,

চাইলাম ময়না-টিয়া

দিলা শালিক!"

অশেষ সেনগুপ্ত

জন্ম - ৩ ই এপ্রিল ১৯৯২, লছমনপুর শেরপুর।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - তীরবিদ্ধ শালিকের ঘুম(২০১৮) 

লেখালেখি শুরু স্কুল জীবন থেকেই।


অশেষ সেনগুপ্তের কবিতা 


সভ্যতা 

(উৎসর্গ – তারেক) 

 

ডাল থেকে

খসে যাওয়া পাতার শব্দ

কখনো পৌঁছায় না শেকড়ের কানে । 

তবুও

হাহাকার

বাতাসের মতো ছুটে আসে

আলোর ভিতরে। 

উড়িয়ে নিয়ে যায় কাগজের

মতো শাদা শাদা

মেঘ । 

সবুজ মাঠ থেকে

মুছে নেয়

সমস্ত সিঁদুর রঙা ফড়িং ।  তারপর , আবার

ধেয়ে আসে পুনর্জন্ম সন্ধ্যার মতো পাতাদের । 

 

 

ইঁদুর সমাচার

 

বাবার শরীর ভালো নেই

একথা শুনলেই

মনে হয় একটা চাকরি দরকার,

গুছাতে থাকি সার্টিফিকেট ভায়োডাটা খুঁজিফেরি খববের পত্রিকা।

 

পড়তে থাকি

আমি সারারাত পড়তে থাকি,

আর যখনি মনে পড়ে যায় আমার ভোট দিয়ে ফেলেছিল অন্যকেউ ,

পিয়নের চাকরির জন্য পাড়াতো ভাই গুছিয়ে রেখেছে ১৪ লক্ষ টাকা,

বেলুন ফুটে যায় আমার,

দেখে ফেলি

নোটিশ বোর্ড

যেখানে আমার কোন নাম নেই।

আমি চাকরি খুঁজিনা আর

কবিতা লিখি

এই রাষ্ট্রে,

যে

রাষ্ট্রে রংধনু নিয়ে কবিতা লিখলে মানুষ আমায় নেয়না।

তুমিও একদিন রাষ্টের মতো জিতে গিয়েছিলে প্রিয়তমা।

আজকাল কেন জানি মনে হয় -

মুখ থেকে ফসকে ফ্লোরে পড়ে যাওয়া সে দিনের একটা ভাত আমি -

যাকে একটা পিঁপড়ে এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ঠেলে নেওয়ার পর

গোগ্রাসে গিলে ফেলেছিল একটা ইঁদুর।

 

ডাকবাক্স

 

পাখি সব এদিক সেদিক উড়ে গেছে

প্রথম গুলির শব্দেই ,

ল্যাম্পপোস্টের নিচে উলঙ্গ পাগলটা এখনো দিব্যি ঘুমিয়ে।

 

দেওয়াল

খামছে ধরতে চাইছে ছেলেটি,

আঁচড়ে পড়ছে বারবার ,

দুইটা বুলেট পিঠ ভেদ

করে চলে গেল আবার ।

 

গড়িয়ে পড়ছে পিচঢালা পথে তাজা তাজা রক্ত,

তৃষ্ণার্ত কুকুর চেটে চেটে খাচ্ছে !

কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা ডাকবাক্স বিস্ময় নিয়ে দেখছে।