Page 567

তিনি কি বলিলেন?


“ক্ষুরস্য ধারয়া নিশিত্যয়া, দুর্গমং পথস্তৎ কবয়োঃবদন্তিঃ নাহন্যো বিদ্যতে পন্থায়নায়”-উপনিষদ

এই খণ্ডে গুরুচাঁদ নীতিতত্ত্ব সার।

যাহা মান্য করে’ জীব লভিবে উদ্ধার।।

মানব-জীবন তত্ত্বে কি কি কথা কয়।

সে সব বর্ণিব আমি শ্রীগুরু কৃপায়।।

“আর্য সাধনার ভিত্তি মানব জীবনে।”

যুগ অনুসারে গড়’ গুরুচাঁদ ভণে।।

“গার্হস্থ্য আশ্রম শ্রেষ্ঠ” প্রভু কহে ডাকি।

“সামাল, সামাল, গৃহী” বলে থাকি থাকি।।

কিসে নষ্ট গৃহাশ্রম কিসে ভাল রয়?

জনে জনে ক্ষণে ক্ষণে প্রভু ডেকে কয়।।

Page 568 start

“ব্যভিচারে গৃহ নষ্ট” প্রভু বলে তাই।

“ব্যভিচারী হ’লে তার আর রক্ষা নাই।।”

কা’রে বলে ব্যভিচার কিসে তাহা হয়?

দিবারাত্রি বলে প্রভু সকল সময়।।

নিজ নারী ভিন্ন অন্য নারীতে গমন।

মহাপাপী ব্যভিচারী সেই একজন।।

দিকে দিকে দেখি যাহা তা’তে দুঃখে মরি।

নাহি জ্ঞান লঘু গুরু কিংবা মাসী খুড়ী।।

পরনারী সঙ্গে যেবা করে ব্যভিচার।

কিছুতে নরকে তার নাহিক উদ্ধার।।

এই বটে একজন আছে অন্য আর।

নিজ ঘরে ব্যভিচারী প্রায় সব নর।।

“পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্য্যাঃ শাস্ত্রের বচন।

অকারণ কর কেন নারীতে গমন?

সন্তানের বাঞ্ছা যদি কর নিজ মনে।

ঋতুকালে কর সঙ্গ নিজ নারী সনে।।

তার জন্যে শাস্ত্রে দেখ রয়েছে বিধান।

“রতিশাস্ত্র নাম তার শাস্ত্রের বিধান।।

রতিশাস্ত্রে জ্ঞান যার নাহি কোন দিন।

কিছুতে ঘোচে না তার চিত্তের মলিন।।

কৃষ্ণ বহু শিক্ষা কৈল সান্দিপনি স্থানে।

“রতিশাস্ত্র শ্রেষ্ঠ বলি কৃষ্ণ সেথা ভণে।।

কালাকাল দোষে কত ঘটে বিপর্যয়।

কেহ কানা কেহ খোঁড়া কেহ বোবা হয়।

অধিকাংশ জন্মদোষে জানিবে নিশ্চয়।।

“রতিশাস্ত্রে অজ্ঞ জনে সেই ফল পায়।

বিস্তৃত সেসব যদি জানিবারে চাও।

রতিশাস্ত্র গ্রন্থ মধ্যে পরিচয় লও।।

সংক্ষেপে যা’ বলি আমি শুন সর্বজন।

কি ভাবে চলিবে সদা নরনারীগণ।

ঋতুকাল ভিন্ন নাহি কর নারী সঙ্গ।

অন্যকালে নারী সঙ্গ গৃহ-ধর্ম ভঙ্গ।।

ঋতু আদ্যে তিনদিন কর পরিহার।

যত বেশী দিন যাবে তত উপকার।।

ষোড়শ দিনের মধ্যে শুভ একদিনে।

আনন্দে বিহার কর নিজ পত্নী সনে।।

পূর্ণিমা কি অমাবস্যা কিংবা রবিবার।

বৃহস্পতিবার ধর সঙ্গে সঙ্গে তার।।

সন্ধ্যা কিংবা প্রাতঃকালে কিংবা দিনমানে।

দেবালয়ে, ঘাটে, পথে অথবা শ্মশানে।।

দুঃখিতা পীড়িতা কিংবা শোকাকুলা জেনে।

সেই জনে এই কালে কিংবা এই দিনে।।

নারী সঙ্গ করিবারে রতিশাস্ত্রে মানা।

নরমাত্রে এই গুলি থাকা চাই জানা।।

সু-প্রশস্ত বুধবার জানিবে সকলে।

পতি সঙ্গে রবে সতী গাঢ় নিশাকালে।।

সু-পুত্র লাগিয়া দোঁহে মিলি পতি সতী।

আকুল পরাণে ডাক জগতের পতি।।

এই আচরণ ভিন্ন অন্য পথে চলে।

নিজ ঘরে ব্যভিচারী শাস্ত্রে তারে বলে।।

ঘরে ঘরে এই রূপে হয় ব্যভিচার।

ব্যভিচার হ’লে শোন কিবা ফল তার।।

ব্যভিচারে ধ্বংস নাশ শাস্ত্রের বচন।

ব্যভিচারে ধ্বংস হ’ল রাজা দশানন।।

যেই জন করে সদা ব্যভিচার পাপ।

পিতৃ-পুরুষেতে সদা তারে দেয় শাপ।।

ব্যভিচারী জনে কেহ বিশ্বাস না করে।

ব্যভিচার দোষে কত জীব দেখ মরে।।

লজ্জা ভয়ে ব্যভিচারী ভ্রূণহত্যা করে।

পাপের আগুন জ্বলে ব্যভিচারী ঘরে।।

সামাল! সামাল! তাই সামাল সবাই।

ব্যভিচারী হ’লে কিন্তু আর রক্ষা নাই।।

ব্যভিচার দোষ হ’তে মুক্তি যদি চাও।

একমাত্র ঋতুকালে নারী পাশে যাও।।

Page 569 start

কোন নীতি নিয়ে চলে যত ‘রাজ হংস’।

বর্ষ মধ্যে একদিনে রক্ষা করে বংশ।।

রাজহংস নীতি মানে যে পরমহংস।

ধর্মাত্মা পুণ্যাত্মা সেথা হয় অবতংস।।

আপন পত্নীরে রাখ এই ধর্মে অংশী।

পতি সাজ রাজহংস সতী রাজহংসী।।

মম পিতা হরিচাঁদ বলে যে ভারতী।

সেই নীতি মান তোরা যত সৎ সতী।।

“পর পতি পর সতী স্পর্শ না করিবে।

না ডাক’ হরিকে হরি তোমাকে ডাকিবে।।”

কোন কথা বলেছিল দ্রুপদ নন্দিনী।

নারী পক্ষে সেই নীতি শ্রেষ্ঠ বলে মানি।।

অপরের পদে হাত কভু নাহি দেব।

অপরের উচ্ছিষ্ট দিলে তাহা নাহি খাব।।

কায়মনে বাক্যে কিংবা আহারে বিহারে।

পতি ভিন্ন স্পর্শ নাহি কর অন্য নরে।।

দৈনিক জীবন পথে যত নারী নর।

কিভাবে চলিবে বলি শুন অতঃপর।।

ব্রাহ্ম মুহূর্তের কালে শয্যা ছাড়ি দাও।

পতি পত্নী এক সঙ্গে হরিগুণ গাও।।

পতিরে প্রণাম করি কর প্রাতঃস্নান।

শ্রীহরি মন্দিরে পূজা কর অধিষ্ঠান।।

নর নারী প্রাতঃস্নান অবশ্য করিবে।

দেহ শুদ্ধি চিত্ত শুদ্ধি সকলি আসিবে।।

নরগণে গুরুজনে করিবে প্রণাম।

কোন ফল প্রাপ্তি নাহি গুরু হ’লে বাম।।

স্নান দানে শৌচাচারে সুসভ্য হইবে।

অপবিত্র ভাবে কেহ কভু না চলিবে।।

রাস্তাঘাট পায়খানা কর বন্দোবস্ত।

এ সব জিনিষ কিন্তু লাগিবে প্রশস্ত।।

লজ্জা বটে নারী পক্ষে একটি ভূষণ।

অনর্থক লজ্জা কিন্তু নিন্দার কারণ।।

বীর-মাতা হ’তে হ’লে হও বীরাঙ্গনা।

ব্যাঘ্র সিংহ দেখে যেন হৃদয় টলে না।।

সতীত্ব তেজেতে ঘেরা যার দেহ মন।

কামুক পশুরে ভয় করে না কখন।।

জননী সাজিয়া সবে কর শুভদৃষ্টি।

তোমারে দেখিয়া বিশ্বে হোক শান্তি বৃষ্টি।।

‘সুপাক’ নারীর পক্ষে অতি বড় গুণ।

গৃহস্থালি সর্বকর্মে সাজিবে নিপুণ।।

অবসর কালে কর ধর্মগ্রন্থ পাঠ।

ঘর দ্বারা বিছানাদি রাখ ফিটফাট।।

নর নারী যেবা হও মিথ্যা বলিবে না।

সত্য ভিন্ন ধর্ম বৃক্ষে ফল ফলিবে না।।

নরে করে সাধু পথে অর্থ উপার্জন।

অর্থ আয়ে মানামান ভেব না কখন।।

যথা তথা থাকে অর্থ তারে টেনে লও।

সৎ পথে ভিন্ন অন্য পথে নাহি চাও।।

বিদ্যা ভিন্ন মানবের গতি নাহি আর।

অজ্ঞ যেন নাহি থাকে তোমাদের ঘর।।

বালক বালিকা সবে শিক্ষা কর দান।

খাও বা না খাও সবে কর গে’ বিদ্বান।।

অলস লোকের তুল্য পাপী কেহ নাই।

“অলসের নাম চোর” শাস্ত্রে বলে তাই।।

কাজ করিলে ‘কাজী’কয়, না করিলে ‘পাজী’।

পাজী ছেড়ে রাজী হ’য়ে হও কাজে কাজী।।

কর্ম কা’রে বলে শোন সেই পরিচয়।

স্তরভেদে কর্ম দেখ তিন প্রকার রয়।।

সুকর্ম বলিয়া ব্যাখ্যা গীতা তারে করে।

জীবের কল্যাণ যাহা আনে ধরা’পরে।।

কুকর্ম বলিয়া ব্যাখ্যা গীতা যারে কয়।

জীবের মঙ্গলনাশী অশুভ নিশ্চয়।।

শুভ নষ্ট করে যাহা অমঙ্গল আনে।

অকর্ম অলস তাহা থাকে গৃহ কোণে।।

Page 570 start

সুকর্ম করিতে সবে হও অগ্রসর।

কর্ম ভিন্ন কোথা নাহি মিলিবে উদ্ধার।।

সামাজিক নীতি সব শোন ভক্তজন।

‘জাতিভেদ’ প্রথা নাহি মানিবে কখন।।

জাতিভেদ কা’রে বলে বলিতেছি তাই।

জন্মগত সামাজিক ভেদ যাহা পাই।

মতুয়ার নীতি এই শোন সর্বজন।

কুলে, বংশে, ধনে, মানে হোক হীনজন।।

চরিত্রে পবিত্র যদি সেই ব্যক্তি হয়।

তার অন্ন খেলে দিলে দোষ নাহি তায়।।

লৌকিক সম্বন্ধে যদি আপন স্বজন।

চরিত্রেতে পবিত্রতা না করে রক্ষণ।।

তার সাথে বসা খাওয়া মতুয়ার নাই।

জাতিভেদ বলিলে ত’ এই অর্থ পাই।।

আর এক কথা আমি বলিব এখানে।

“শ্রীহরি মন্দির” গড়’ প্রতি জনে জনে।।

শ্রীহরি মন্দির শোন কিবা করে দান?

বলিতেছি আমি এক পুরাণ আখ্যান।।

রতি, মতি দুই ভাই ছিল এক দেশে।

এক সাথে দুই ভাই আছে বটে মিশে।।

রতি বড় মতি ছোট ঘরে দুটি বউ।

কোন কাজে কোন ভাবে দুঃখী নয় কেউ।।

কালে কালে সে রতির হ’ল ছেলেপিলে।

সে সব বালাই নাই মতির কপালে।।

রতির গৃহিণী ছিল দুষ্ট সরস্বতী।

মতির গৃহিণী কিন্তু অতি নিষ্ঠাবতী।।

পতি পত্নী দুইজনে উভয়ে সরল।

রতির গৃহিণী কিন্তু উঠাল গরল।।

মতিরে সকলে বলে ‘বলদা’ গোঁসাই।

মতির পত্নীরে ‘বলদী’ বলিত সবাই।।

সরল মতির কিছু যোগ্যতা না ছিল।

স্নেহবশে রতি তারে যতনে পালিল।।

রতির গৃহিণী তা’তে ভাবে মনে মন।

এগুলিকে খেতে আমি দেই কি কারণ?

পৃথক করিতে তাই করে আয়োজন।

রতি কিন্তু তা’তে রাজী হ’ল না কখন।।

দুষ্ট নারী শেষে করে কত চাতুরালী।

ক্রমে ক্রমে রতি কিন্তু গেল শেষে ভুলি।।

মতিরে পৃথক করে দিল তার ভাই।

ভাগে মতি পেল মাত্র এক বুড়া গাই।।

কুঁড়ে ঘরে পতি পত্নী রহে এক ঠাই।

সতীর গুণেতে দেখ কোন দুঃখ নাই।।

‘বলদী’ সরলা অতি পতি-নিষ্ঠাবতী।

পতিসুখ বিনা চিন্তা নাহি করে সতী।।

‘বলদা’ সরল দেখে জুটিল কুচক্রী।

তারা বলে “তোর পক্ষে এনে দেব ডিক্রী।।

আট আনা অংশীদার সম্পত্তিতে তুই।

তা’তে কিনা নাহি দিল এক তোলা ভুই।।

কোন ভয় নাই তোর মোরা আছি সঙ্গে।

দাদাকে দেখা’ব তোর ফেলিয়া তরঙ্গে।।

আমাদের সঙ্গে চল উকিলের বাড়ী।

চল চল লাগিবে না কোন টাকাকড়ি।।

‘বলদা’ ভাবিল ‘এ’ ৎ কথা মন্দ নয়।

দেখা যাক এই কাজে কি ফল দাঁড়ায়।।”

এত ভাবি সে ‘বলদা’ চলে তাড়াতাড়ি।

উপস্থিত হল এক উকিলের বাড়ী।।

দালালের সঙ্গে সায়ে উকিল তখন।

“পাঁচ শত টাকা লাগে” করে উচ্চারণ।।

‘বলদা’ বলিছে “আমি টাকা কোথা পাই!

বুড়া এক গরু ছাড়া আর কিছু নাই।।”

সকল দালালে বলে “এক কাজ কর।

যে কাগজ দেই তাহা হাতে নিয়ে ধর।।

এক টিপ মাত্র তুমি দাও এর পরে।

বাবুজী করিবে যাহা ভাল মনে করে।।”

Page 571 start

‘বলদা’ হইলে দেখ তারে মারা দায়।

আপনি তাহারে রক্ষা করে দয়াময়।।

কি জানি কি ভাবি ‘বলদা’ বলিল তখনে।

“আজ থাক দেখি কাল কিবা হয় মনে।।”

এ কাজ করিতে গেছে বেলা গড়াইয়া।

এ দিকে সে ‘বলদী’ আছে পথেতে চাহিয়া।।

কোথা গেল প্রাণনাথ! প্রাণ উচাটন।

ঘরে কি বাইরে ‘বলদী’ ফেরে ঘন ঘন।।

হেনকালে দেখে দূরে আসিতেছে পতি।

পাদ্য অর্ঘ্য আনে শীঘ্র সেই নিষ্ঠাবতী।।

যখন আসিল ‘বলদা’ গৃহের মাঝারে।

‘বলদী’ ধোয়ায় পদ অতি যত্ন করে।।

আপন অঞ্চলে তার পদ মুছে দেয়।

বহু যত্নে দিল তেল যে ‘বলদা’র গায়।।

স্নান করি সে ‘বলদা’ সুস্থ যবে হ’ল।

ক্ষীর এনে সে ‘বলদী’ তারে খেতে দিল।।

আহারান্তে সে ‘বলদা’ করিল শয়ন।

‘বলদী’ করিছে তার চরণ সেবন।।

ধীরে ধীরে ‘বলদা’রে তার নারী কয়।

“বল দেখি এতক্ষণ আছিলে কোথায়?”

সরল লোকের মনে কোন গোল নাই।

‘বলদী’রে সব কথা খুলে বলে তাই।

‘বলদী’ বলিল “হেন কাজ নাহি কর।

আমি বলি এই কাজে তুমি আজ হার।।

আপনার বড় ভাই নিয়েছে বিষয়।

রাগ করে তাই নাকি কেড়ে নেয়া যায়?

কুচিন্তা ছাড়িয়া যাহা বলি কর তাই।

তোমাকে পশ্চিমে আমি পাঠাইতে চাই।।

সেইখানে কর তুমি যে কোন চাকুরী।

যাহা হ’বে তাহা দিয়ে চালাবেন হরি।।”

‘বলদা’ বলিছে “তুমি শোন মোর ‘বলদী’।

কথাবার্তা সব তুমি বল বটে জলদি।।

মনে কেন কর সেই এক কথা।

তোমার এ ‘বলদা’টির নাহি যে যোগ্যতা।।”

‘বলদী’ কহিছে “তুমি জান না গোঁসাই।

কত কাজ আছে যা’তে বেশী কষ্ট নাই।।

ছেলে মেয়ে রাখা কিংবা ঘরে দে’য়া ঝাট।

আসবাবপত্র সব রাখা ফিটফাট।।

এর জন্যে বড় লোকে রাখে দাসদাসী।

অল্প অল্প কাজ তা’তে কষ্ট নাই বেশী।।”

সতীর কথায় ‘বলদা’ সাহস করিল।

পরদিন যাবে বলে কথা ঠিক হ’ল।।

যাত্রাকালে সে ‘বলদী’ পদে পড়ে কয়।

“যেথা ইচ্ছা সেথা যাও নাহি কোন ভয়।।

কিন্তু এ মিনতি আমি চরণে জানাই।

মাসান্তে তোমারে দেখা যেন আমি পাই।।”

স্বীকার করিয়া ‘বলদা’ রওনা হইল।

তার দিকে চেয়ে সতী কতই কান্দিল।।

ঠাকুরের কাছে ‘বলদী’ কেন্দে কেন্দে কয়।

“আমার স্বামীকে রক্ষা করো দয়াময়।।

অবোধ সরল লোক নাহি চেনে পথ।

দয়া করে প্রভু তুমি থেক’ তার সাথ।।”

কতদূর গিয়ে ‘বলদা’ ভাবে মনে মন।

মিছামিছি শহরেতে যাব কি কারণ?

আমারে দেখিয়া কেহ চাকুরী না দিবে।

শুধু শুধু যেয়ে বল কোন ফল হ’বে?

এত ভেবে ‘বলদা’র মনে দুঃখ হ’ল।

কান্দিতে কান্দিতে ‘বলদা’ বনে চলে গেল।।

বনমধ্যে গিয়ে দেখে একটি মন্দির।

আপনার ভাবে আছে দাঁড়াইয়া স্থির।।

লোকজন কেহ নাই একেলা মন্দির।

কি যেন কি ভাব ধরে রয়েছে গম্ভীর।।

মন্দিরের মধ্যে ‘বলদা’ দেখিল ঢুকিয়া।

পূজার যতেক দ্রব্য রয়েছে পড়িয়া।।

Page 572 start

‘বলদা’ ভাবিল “মোরে ডেকেছে শ্রীহরি।

শ্রীহরি মন্দিরে আমি করিব চাকুরী।।”

এত ভাবি সেইখানে সে বলদা তখন।

পূজার বাসন সব করিল গ্রহণ।।

নিকটে পুকুর ছিল গিয়া তার জলে।

পরিষ্কার করে সব অতি কুতূহলে।।

ধূপ দীপ জ্বালাইয়া দিল পুষ্পাঞ্জলি।

হরিকে ডাকিয়া বলে করে কৃতাঞ্জলি।।

“তোমার চাকুরী আমি করিব শ্রীহরি।

মাস গেলে দিও মোরে মাহিনার কড়ি।।”

অলক্ষ্যে হাসিল তাই দয়াল ঠাকুর।

সরল মনের কথা করিল মঞ্জুর।।

এইভাবে প্রতিদিন ‘বলদা’ গোঁসাই।

শ্রীহরি মন্দিরে পূজা করে এক ঠাই।।

মন্দির মার্জনা করে জলে ধৌত কড়ি।

মন্ত্র তন্ত্র নাহি শুধু বলে হরি! হরি!

প্রতিদিন প্রাতঃকালে শয্যাত্যাগ করি।

পূজা করে সে ‘বলদা’ স্নানাহ্নিক সারি।।

স্নান সেরে এসে দেখে যেন কোন জন।

নানাবিধ ফল রেখে গিয়েছে কখন।।

পূজা সেরে সেই ফল করে সে ভক্ষণ।

সেই ফলে ক্ষুধা তার হয় নিবারণ।।

এইভাবে এক মাস গত হ’তে যায়।

শেষ দিনে সে ‘বলদা’ পূজাকালে কয়।।

“ওহে হরি! আজ মোর এক মাস হয়।

মাহিনাটা দিয়ে দাও ওহে দয়াময়।।

আর এক কথা আমি বলি তব ঠাই।

তব পদে তিন দিন আমি ছুটি চাই।।

সরলা অবলা মোর গৃহিণী ‘বলদী’।

তারে টাকা দিয়ে আমি ফিরিব যে জলদি।।”

পর দিনে সে ‘বলদা’ পূজা সাঙ্গ করি।

বাহিরে আসিছে মুখে বলে হরি হরি।।

হেনকালে এক ডাল এল নোয়াইয়া।

‘বলদা’র বুকের কাছে রহিল থামিয়া।।

সোনার মোহর এক তাতে ঝুলে রয়।

‘বলদা’ ভাবিল হরি মোরে কড়ি দেয়।।

সোনার মোহর ‘বলদা’ খসায়ে রাখিল।

হরি! হরি! হরি বলে গৃহেতে চলিল।।

এদিকে ‘বলদী’ সতী সারা মাস ধরে।

সর্বদা প্রার্থনা করে করজোড়ে করে।।

“আমার পতিরে রক্ষা কর দয়াময়।

না জানি আমার পতি রয়েছে কোথায়।।

চাকুরী করিয়া পতি যেন অর্থ পায়।

পাক বা না পাক টাকা সুস্থ যেন রয়।।”

মাস গত সতী নারী পথ পানে চায়।

হেনকালে সে ‘বলদা’ আসিয়া উদয়।।

পূজিয়া পতির পদ পরম পুলকে।

জিজ্ঞাসা করিল “প্রভু আছিলে ত’ সুখে।।”

‘বলদা’ বলিল তারে সব বিবরণ।

শুনিয়া ‘বলদী’র তবে ঝরিল নয়ন।।

অতঃপর পতি পত্নী সে মন্দিরে যায়।

দুইজনে পূজা করে মহাসুখে রয়।।

প্রতিমাসে পায় তারা সোনার মোহর।

পতি পত্নী দুইজনে নাহিক দোসর।।

বহু বিত্তশালী তারা হইল যখন।

প্রভুর আদেশে দেশে করিল গমন।।

তাই বলি ঘরে ঘরে গড় হে মন্দির।

সকাল সন্ধ্যায় হেথা নামে দাও ভীর।।

শ্রীহরি মন্দিরে পূজা করিবে কাহার?

শুন সবে বলি আমি সেই সমাচার।।

বিশ্ব ভরে’ এই নীতি দেখি পরস্পর।

যে যারে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর।।

মম পিতা হরিচাঁদ ক্ষীরোদ ঈশ্বর।

দয়া করে এ জগতে হ’ল অবতার।।

Page 573 start

দলিত পীড়িত যত পতিত মানব।

তাঁর কৃপাগুণে রক্ষা পাইয়াছে সব।।

তাঁর পূজা কর সবে তাঁর ভক্ত হও।

শ্রীহরি মন্দিরে তাঁর মূরতি সাজাও।।

“বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ” সর্ব শাস্ত্রে কয়।

সদভাবে কর সবে সাধু ব্যবসায়।।

বিবাহ শ্রাদ্ধেতে সবে কর ব্যয় হ্রাস।

শক্তির চালনা সবে রাখ বারমাস।।

আত্মরক্ষা শক্তি সবে অবশ্য রাখিবে।

অগ্রভাগে কভু কা’রে আঘাত না দিবে।।

কেহ যেন নাহি হও ‘গোলামের জাতি’।

চিরকাল হাল-গরু থাকে যেন সাথী।।

হাল-গরু ছাড়া কিন্তু বুদ্ধি সর্বনাশা।

সকলের রক্ষাকর্তা হাল-চষা চাষা।।

শক্তি না দেখিলে কেহ করে না সম্মান।

শক্তিশালী হ’তে সবে হও যত্নবান।।

সহজ জীবন পথে চলিবে সকলে।

দুর্বলতা থাকে কিন্তু বিলাসিতা কোলে।।

গড়া-সিদ্ধ চাল খেয়ে চাটায়ে শয়ন।

সে বীর্যে জন্মিবে ধ্রুব তেজস্বী নন্দন।।

ধনহীন বিদ্যাহীন যারা এই ভবে।

রাজনীতি ক্ষেত্রে তারা শান্তি নাহি পাবে।।

আত্মোন্নতি অগ্রভাগে প্রয়োজন তাই।

বিদ্যা চাই, ধন চাই, রাজকার্য চাই।।

দুর্বলে সবলে যদি করিবে মিলন।

সবলে বাড়িবে বলে দুর্বলে মরণ।।

স্বল্প নিদ্রা মানবের সুখের কারণ।

মৃত্যুজয়ী এই ভবে ‘অতন্দ্র যে জন’।।

নিশাকালে খণ্ড-হস্তে উগ্রচণ্ডা ধায়।

নিদ্রায় অবশ যেবা তারে করে ক্ষয়।।

‘অতন্দ্র’ যেজন আছে বীরের স্বভাবে।

উগ্রচণ্ডা তারে পূজা করে নম্র ভাবে।।

ভেকধারী বৈরাগীরে ভিক্ষা নাহি দিবে।

ভিক্ষা দিলে ব্যভিচার বাড়িয়া চলিবে।।

দীক্ষা, শিক্ষা, কোন কিছু নাহি প্রয়োজন।

হরিনাম মহামন্ত্র জান সর্বক্ষণ।।

ব্রাহ্মণ কি অধিকারী দীক্ষা গুরু যারা।

ফাঁকি দিয়ে প্রণামীর টাকা নেয় তারা।।

অজ্ঞান আঁধার যিনি করিবে উজ্জ্বল।

তিনি গুরু তাঁর কাছে আছে মোক্ষফল।।

দীক্ষা ত স্বীকৃতি মাত্র ‘হব আমি ভাল’।

‘হব ভাল, র’ব ভাল, ক’ব আমি ভাল’।।

ভাল কারে বলে বাপু কিসে ভাল হয়?

“ভাল হলে ভাল হবে মোর পিতা কয়।।”

মনে যাহা বলে ইহা মোটে ভাল নয়।

সেই কার্য কোনক্রমে কর না নিশ্চয়।।

গুরু নামে গুরু বিত্ত করিয়া গ্রহণ।

আত্মসাৎ করে যদি কোন অভাজন।।

আপনি ঈশ্বর যদি থাকেন সহায়।

তথাপি পতন তার জানিও নিশ্চয়।।

যত বড় সাধু কিংবা গুরু হন তিনি।

যত হোক বড় বড় কথার গাঁথুনি।।

ছিদ্র পাত্রে জল বিন্দু যথা নাহি রয়।

সাধুত্ব, গুরুত্ব, তার মহাপাপে ক্ষয়।।

অধিক কি কব গুরু বিত্ত অপহারী।

গণ্য করি গুরু পত্নী অপহরণকারী।।

সামাল! সামাল! তাই মতুয়ারগণ।

‘হাজৎ’ কখনও কেহ কর না হরণ।।

মতুয়ার পক্ষে কোন পূজা পর্ব নাই।

শ্রীহরি মন্দিরে নিত্য পূজা করা চাই।।

মতুয়ার এক গুরু ভিন্ন গুরু নাই।

ওড়াকান্দি প্রভু যিনি ক্ষীরোদের সাঁই।।

Page 574 start

মধ্যস্বত্ব জমিদারী ধর্মক্ষেত্রে নাই।

ভিন্ন ভিন্ন দল কেহ কর না গোঁসাই।।

যিনি ধরে আনে দলে তাঁর ‘ধরা’ হয়।

ঠাকুরের কাছে গেলে তারে ‘মরা’ কয়।।

‘ধরা’ ‘মরা’ দুই কথা দুই ভাবে রয়।

‘মরা’ হ’তে ‘ধরা’ কভু শ্রেষ্ঠ নাহি হয়।।

কত জনে বড় হয় কহিয়া দোঁহাই।

বিদ্রোহী সাজিয়া দেখ আর পাত্তা নাই।।

এক দ্বীপ হ’তে বহু দ্বীপের জনম।

মূল দ্বীপ তবু সদা করিবে পূজন।।

নেড়া নেড়ী বৈরাগীর ধর্ম এই নয়।

নারী দিয়ে অঙ্গ সেবা হবে ধর্ম ক্ষয়।।

তেল ঘষা, অঙ্গ সেবা মহা ব্যভিচার।

স্পর্শই করিতে মানা তেল ঘষা তাঁর!

পরনারী মাতৃজ্ঞানে দূরেতে থাকিবে।

পরিহাস বাচালতা কভু না করিবে।।

মদ, গাজা নাহি খাবে করিবে না চুরি।

তাস, দাবা, জুয়াখেলা সব দাও ছাড়ি।।

হরি বলে ডঙ্কা মার শঙ্কা কর কারে?

শ্রীহরি সহায় হয়ে সাথে সাথে ফেরে।।

পর দোষ ছেড়ে সদা নিজ দোষ কও।

আত্মগুণ ফেলে রেখে হরিগুণ গাও।।

পবিত্র চরিত্রে যেথা রহে নরনারী।

সত্য কথা সত্য ভাব রয়েছে প্রহরী।।

শ্রীহরি মন্দিরে যেথা নিত্য সংকীর্তন।

ধন্য সতী সদা করে পতির পূজন।।

ঘর দ্বার পরিষ্কার আশ্রমের প্রায়।

‘পুণ্যতীর্থ’ বলি তারে সাধু জনে কয়।।

সেই তীর্থে বাস করে লক্ষ্মী নারায়ণ।

বেদের বচন ইহা না হবে লঙ্ঘন।।

পবিত্রতা, সত্যবাক্য, মানুষে বিশ্বাস।

তিন রত্ন যার আছে হরি তার বশ।।

শ্রীহরি এনেছে ইহা বিশ্বের দুয়ারে।

বিশ্ব ভরে’ এই ভাব হোক ঘরে ঘরে।।

সে ধর্ম যাজন যেবা করে মনে প্রাণে।

দেবের দুর্লভ শান্তি লভে একদিনে।।

সর্বতত্ত্ব মূলে এক তত্ত্ব জান সার।

“যথা ধর্ম তথা জয়” কথা নাহি আর।।

-------

* ‘নল দ্বারা তৈয়ারী কঠিন বিছানা।

---০---