Page 404

১৩২৬ সালের মহাঝড়

তেরশ ছাব্বিশ সালে মনোদ শারদ কালে।

দিকে দিকে বেজে ওঠে আগমনী সুর।

বঙ্গবাসী নর নারী আশা-রসে প্রাণ ভরি।

ব্যথা-ভরা বুক হতে দুঃখ করে দূর।।

আসিবেন শৈল-সুতা আপনি জগত মাতা

জনে জনে সেই কথা কহিছে আনন্দে।

হাসিলে শেফালী ফুল ছুটে আসে অলিকুল

উড়ে পড়ে করে ভুল ফুলের সুগন্ধে।।

বরষা কাঁদিয়া গেল আকাশ সুনীল হল।

প্রকৃতির কালোমুখে ফুটে হাসি রেখা।

ধানের পাতার গায় পরশ বুলায়ে যায়

শারদ রানীর হাসি বায়ু-তলে ঢাকা।।

আশার মোহন ছবি শারদ গগনে রবি

হাসি হাসি নিত্য আসি কহে কত কথা।

মনের নিরাল কোণে স্বপ্নে কিংবা জাগরণে

বিরহী প্রিয়ের বুকে বেজে ওঠে ব্যাথা।।

স্বপনের রাজ্য খানি কল্পলোক হতে আনি

শারদ রজনী যেন রাখিল ধরায়।।

কন্ঠে কন্ঠে বাজে গান দিকে দিকে নাচে প্রাণ

আত্মভোলা নরনারী দিকে দিকে ধায়।

আহা রে! মানবকুল! কেন নাহি বোঝে মূল

আশা-করা কত ভুল নশ্বর জীবনে।

আশা যে ছলনাময়ী আশা, আশা দেয় কই?

মোরা শুধু-ভুলে রই আশার ছলনে।।

তাহা হলে বল কেনে তের শ ছাব্বিশ সনে

শারদ আকাশ কেন কালো মেঘে ঢাকে।

বঙ্গোপসাগর বুকে বল দেখি কোন ফাঁকে

প্রলয়ের নাদে কেন ঘুর্ণীবায়ু ডাকে?

কালো হল নীলাকাশ প্রলয়ের ক্রুদ্ধ শ্বাস

মহারোষে ছোটে কেন বঙ্গভূমি পরে?

মরে নারী মরে নর ভাঙ্গে বৃক্ষ পড়ে ঘর

হাহাকার ওঠে কেন প্রতি ঘরে ঘরে।।

আমি বলিয়াছি তাই শুনহে মানব ভাই।

বুঝে দেখ কিছু নাই তব অধিকারে।

ক্রীয়া পুত্তলিকা প্রায় গড়ায়ে রেখেছে হায়

জগতের স্বামী যিনি আছে বিশ্ব ভরে

আশ্বিনের অগ্রভাগে ষষ্ঠীর দুদিন আগে

বিন্দু বিন্দু বারিপাত আরম্ভ হইল।

যত যত হয় কাল বাতাসেতে কোলাহল

অশান্ত বারির ধারা আঝোরে নামিল।।

মুখে হাসি গেল মুছে জনে জনে তাই পুঁছে

একি কান্ড লন্ড ভন্ড উঠিল বাতাসে?

ক্রমে যেন বাড়ে রোষ বায়ু করে ফোঁস ফোঁস

অসংখ্য নাগের বংশ যেন নেমে আসে।।

Page 405 start

বুধের সকাল হতে চারিদিকে আচম্বিতে

আকাশে অশনি নাদে অতি ভয়ঙ্কর।

কাঁপিল নদীর জল কাঁপিল গৃহের তল

বৃক্ষ আদি ঘরবাড়ী কাঁপে থর থর।।

সুতীহ্ম শরের প্রায় বারিধারা লাগে গায়

অকস্মাৎ নদীজলে বহিল উজান।

তরণী ডুবিল কত গণনায় সংখ্যাতীত

হত ভাগ্য দাঁড়ি কত তাজিল পরাণ।।

বন্যা এল নদী জলে দুকুল ছাপিয়ে চলে

জলে জলে মাঠ ঘাট হল একাকার।

সূর্য্য নাহি দেখা দিল কোথা দিয়ে দিন গেল

কালদূত সম কাল গাঢ় অন্ধকার।।

রাত্রি যত বেশী হয় তত জোরে বায়ু ধায়

প্রলয়ের কাল নৃত্য উঠে চারি ভিতে।

লক্ষ লক্ষ বৃক্ষ পড়ে প্রলয়ের সেই ঝড়ে

ইষ্টক নির্ম্মিত গৃহ পারে না সহিতে।।

পশু পাখী সংখ্যাতীত প্রলয়েতে হল কত

মর্ম্মভেদী দৃশ্য কত জাগে চারিদিকে।

শিশু পুত্র বুকে ধরি মরে কত শত নারী

পতি-পত্নী এক সাথে জড়াজড়ি বুকে।।

সে কি যে প্রলয় কান্ড বিধাতার গুরুদন্ড

সারা বঙ্গ লন্ড ভন্ড কয়েক ঘন্টায়।

লোহার সিন্দুক ঘরে রাখিল বৃক্ষের পরে

কার চাল কার ঘরে চেনা হল দায়।।

ধান্যসহ গোলা উড়ে গেল দেশ দেশান্তরে

বায়ু-রথে সুখে চড়ে নদী হল পার।

তরণী চড়িয়া গাছে শাখায় বুলিয়া আছে

ক্ষুদ্র শিশু তার মাঝে করিছে চিৎকার।।

তাল গাছ উড়ে জোরে তেঁতুলের বুক চিরে

কীলকের মত রহে বুকে বদ্ধ তার।

ভেদিয়া ধরণী বক্ষঃ প্রাচীন অশ্বত্থ বৃক্ষ

উর্দ্ধ-মূল করি রহে শিরে বহি ভার।।

এত বড় অত্যাচার বঙ্গদেশে পূর্ব্বে আর

হয় নাই দেখে নাই কভু বঙ্গবাসী।

উদার মহান যত জীবসেবা পুণ্যব্রত

দেশে দেশে অবিরত করিলেন আসি।।

গুরুচাঁদ এ সময় দেশের এ দুর্দ্দশায়

গলিলেন করুণায় আপনার মনে।

অন্নহীন দীন গণে ডাকি আনি নিজ স্থানে

অকাতরে অন্ন দেয় প্রতি জনে জনে।।

সরকার বাহাদুর প্রজা যত ব্যথাতুর

করিবারে দুঃখ দূর ব্যবস্থা করিল।

দেশে দেশে কেন্দ্র করি দান দিল দেশ ভরি

বাল বৃদ্ধ নর নারী প্রাণেতে বাঁচিল।।

রামকৃষ্ণ মিশনারী সন্ন্যাসীর বেশধারী

দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করি দরিদ্রে বাঁচায়।

দীনের দরদী বন্ধু মহামনা কৃপাসিন্ধু

আর্ত্তত্রাণে এল ছুড়ে স্যার পি,সি রায়।।

রসায়ন শাস্ত্র-গুরু দানে যেন কল্পতরু

দার পরিগ্রহ নাহি করিল জীবনে।

সেবাব্রতে আত্মত্যাগ করিলেন মহাভাগ

বিশ্ববাসী এই যাগ রাখিবে স্মরণে।।

প্রকৃতির এ-খায়ালে দেশ গেল রসাতলে

দীন গ্রন্থকার বলে শুন জীবকুল।

এ জগতে যাহা হয় সব করে ইচ্ছাময়

সৃষ্টি ধ্বংস তাঁর ইচ্ছা এই জান মূল।।

---০---