Page 426

শ্রীমৎ যাদব চন্দ্র গোস্বামীর জীবন কথা

ধন্য শ্রীযাদবচন্দ্র গোস্বামী সুজন।

নত শিরে কর জোড়ে বন্দিনু চরণ।।

রসরাজ শ্রীতারক যাঁরে কৃপা করে।

মোর শক্তি নাহি তাঁর গুণ বর্ণিবারে।।

যশোহর জিলা মধ্যে কালিয়া থানায়।

লোহারগাতীর গ্রামে শুভ জন্ম হয়।।

বার শত আশি সাল মাসেতে কার্ত্তিক।

শুভ ক্ষণে জন্ম হ’ল জ্ঞানের প্রতীক।।

নমঃশূদ্র কুলে জন্ম বংশেতে প্রধান।

ঢালী বংশ অবতংস অতি গুণবান।।

বাল্যকালে বাংলা মতে করে অধ্যয়ন।

বড়ই মেধাবী ছাত্র যাদব সুজন।।

যাহা শুনে যাহা পড়ে সব মনে থাকে।

‘শ্রুতিধর’ বলি তারে ছাত্রগণে ডাকে।।

বাংলা শিক্ষা শেষ হলে সেই মহাভাগ।

বিদ্যা শিক্ষা পাঠ তবে করিলেন ত্যাগ।।

পিতার আদেশে তেঁহ সংসারে পশিল।

বুদ্ধি গুণে অল্প দিনে উন্নতি করিল।।

বয়সে যুকব বটে জ্ঞানেতে প্রবীণ।

জ্ঞানী বলি মান্য তাঁর আছে চিরদিন।।

এই ভাবে যবে চলে সেই মহাশয়।

শ্রীতারকচাঁদের নাম শুনিবার পায়।।

কালিয়া নামেতে গ্রাম বেশী দূরে নয়।

তথাকারে রসরাজ হলেন উদয়।।

Page 427 start

যাদব চলিল তথা পরম কৌতুকে।

ইচ্ছা তার গান শোনে মনের পুলকে।।

গান শুনি মূর্ছাশো গেল যাদব সুজন।

ধীরে ধীরে পরে গৃহে করিল গমন।।

বারশ চুরানব্বই সালের ঘটনা।

কালিয়ায় গান করে তারক রসনা।।

উদাস হইল চিত্ত শান্তি কিছু নাই।

তারকেরে মনে করে সদা ছাড়ে হাই।।

কি গান করিল কবি হরিল পরাণ।

বেদনায় বুক ফাটে চোখে বহে বান।।

বয়সে কিশোর মাত্র চেনে না সংসার।

বিধির নির্ব্বন্ধে স্কন্ধে এল সব ভার।।

বার শ’ পচানব্বই সালে পিতা তার।

নাবালক পুত্র রেখে গেল ভবপার।।

সংসারের বোঝা সাধু নিল নিজ শিরে।

নাবালক ভাই গণে পালে যত্ন করে।।

যার যে মানুষ তার চেনা আছে আগে।

চেনা জনে চিনিতে বা কতক্ষণ লাগে।।

অক্ষয়, তারক আর বহু ভক্তগণ।

লোহারগাতীর গ্রামে করে আগমন।।

ভাবময় ভাবুকেরা ভাবে মত্ত রয়।

ভাব দিয়ে ভাব করে ভাবে টেনে লয়।।

তারক এসেছে শুনে যাদব ছুটিল।

রবি-রশ্মি পেয়ে যেন কমল ফুটিল।।

ত্বরা করি উপস্থিত হ’ল সেইখানে।

দেখে গিয়ে গোস্বামীর মত্ত নাম গানে।।

নাম গান সাঙ্গ হ’ল এমন সময়।

যাদব প্রণাম করে তারকের পায়।।

নবীন শ্যামল কান্তি বয়সে তরুণ।

তারে দেখি গোস্বামীর চিন্তার উদয়।

এ হেন কিশোর মুর্ত্তি ছিল বা কোথায়?

শুধু দৃষ্টি করে প্রভু কথা নাহি কয়।

প্রাণে প্রাণে আকর্ষণ করিল তাহায়।।

যাদব চাহিয়া দেখে করুণ নয়নে।

শ্রীতারক দৃষ্টি করে চেয়ে তার পানে।।

কি যেন মোহিনীভরা দৃষ্টি চোখে তাঁর।

তাহা দেখে যাদবের জ্ঞান নাহি আর।।

কালিয়ার স্মৃতি প্রাণে জাগিয়া উঠিল।

সহসা যাদব চন্দ্র পলাইয়া গেল।।

বিদায় হইয়া গেল তারক গোস্বামী।

যাদব ভাবিল মনে ‘‘কি করিলাম আমি।।’’

পূর্ব্ব হতে তার মন উদাসী সাজিল।

উদাসীর মনে ব্যথা দারুণ বাজিল।।

কি দিয়ে ভুলা’ল মোরে তারক সুজন।

দেহ ফেলে গেছে চলে বুঝি মোর মন।।

দিবা নিশি হা হুতাশ জাগিতেছে প্রাণে।

কোথা গেলে শান্তি পাব কিছুত বুঝিনে।।

শাস্ত্রে বলে ‘‘ধর্ম্ম বিনে কোন শান্তি নাই।

বৈষ্ণব সাজিয়া দেখি যদি শান্তি পাই।

এত ভাবি সে মহাত্মা বৈষ্ণব আচারে।

একাদশী উপবাস, মালা জপ করে।।

দুই লক্ষ জপ করে একাদশী দিনে।

আহারেতে নিরামিষী তৈল নাহি স্নানে।।

এত যে কঠোর নীতি পালিছে সদাই।

কিমাশ্চর্য্য! প্রাণে মাত্র বিন্দু শান্তি নাই।।

কালিয়া সমাজে ভক্ত বহু বৈদ্য গণ।

সেই সঙ্গে সে যাদব করিল মিলন।।

শ্রীশবাবু নামে ছিল ভক্ত একজন।

বেন্দা গ্রামে গুরুনাথ সেনের ভবন।।

ইহাদের কাছে তেঁহ বলে মনোকথা।

‘কি ভাবে ঘুচাই বল মরমের ব্যথা?’’

তারা বলে ‘‘সুধা মাখা জানি হরি নাম।

সুধা মাখা হরিনাম কর অবিরাম।।’’

Page 428 start

মনের মানুষে মন হয়েছে যাঁহার।

ব্রতচারে হরিনামে কি করিবে তার?

মন-মানুষের সাথে দেখা যদি হয়।

মনের বেদনা তার সব দূরে যায়।।

তারক হরেছে মন চখের পলকে।

সে বিনে মনের ব্যথা আর ঘুচায় কে?

বৈষ্ণব আচারে চলে হরিনাম করে।

তারকের রূপ কিন্তু ভাসিছে অন্তরে।।

যে যাহারে চিন্তা করে সে যে তার চায়।

চিন্তা-বেড়ি পায়ে দিয়ে কাছে টেনি লয়।।

মাতালের দশা যাহা বসে মদ খায়।

মদের নেশার তলে সব ভুলে রয়।।

নেশা ছুটে গেলে পুনঃ বুকে বাজে ব্যথা।

বারে বারে খায় মদ শান্তি নাহি কোথা।।

যাদবের ভাব হ’ল তেমতি প্রকার।

শান্তি নাই তবু হরি বলে বারে বার।।

এ গ্রাম সে গ্রাম সদা করে সংকীর্ত্তন।

কোনরূপে নাহি শান্ত হ’ল তার মন।।

হেনকালে একদিন এক মহোৎসবে।

আসিল তারকচন্দ্র মত্ত মহাভাবে।।

মহোল্লাসে ভক্তগণে করিছে কীর্ত্তন।

তার মধ্যে শ্রীতারক করিছে নর্ত্তন।।

কিবা সে সোণার নৃত্য কহনে না যায়।

সোণার পুতুল যেন নাচিয়া বেড়ায়।।

সারাঅঙ্গ দিয়ে যেন ভাব উঠে লুটে।

ভাবের বাজার যেন নিয়েছে সে ফুটে।।

মহাভাবে কীর্ত্তনেতে নাচিছে গোঁসাই।

নাচিছে কি কি করিছে কোন সঙ্গা নাই।।

এমন মোহন নৃত্য দেখিল যাদব।

নয়নে পলক নাই মুখে নাই রব।।

নর্ত্তন দেখিয়া মন পাগল হইল।

কোন কিছু না বলিয়া গৃহে ফিরে গেল।

গোস্বামী যতই তারে ধরিবারে চায়।

যাদব পলায় ছুটে ধনা নাহি দেয়।।

দেহ নিয়ে যায় বটে মন পড়ে থাকে।

মনে হয় মনে মনে কেহ যেন ডাকে।।

এবারে পাগল মন কথা নাহি শুনে।

দিবানিশি পড়ে থাকে তারকের ধ্যানে।।

কোথা গেলে তাঁর সাথে হইতে মিলন।

দিবানিশি যাদবের চিন্তা সর্ব্বক্ষণ।।

ভবানীপুরের গাঁয় আনন্দ মন্ডল।

তারকের পদাশ্রিত ভাবের পাগল।।

তার বাড়ী মহোৎসব করে আয়োজন।

আনন্দ যাদবে তাই করে নিমন্ত্রণ।।

মহানন্দ গোস্বামীজী তারক অক্ষয়।

মহোৎসবে উপনীত তিন মহাত্মায়।।

যাদব সাষ্টাঙ্গ গিয়ে করে প্রণিপাত।

শ্রীতারক শিরে তাঁর রাখিলেন হাত।।

চোখে চোখে মনে মনে চিনাচিনি আছে।

বাক্য ছলে পরিচয় হ’ল তাই পাছে।।

তারক শুনিল তার সব পরিচয়।

বহু যত্নে সমাদরে নিকটে বসায়।।

ভোজনের কালে তারে নিকটে বসা’ল।

নিজ হস্তে তার পাতে পায়সন্ন দিল।।

প্রসাদ পাইয়া ধন্য হইল যাদব।

চিত্তে শান্তি হ’ল তার গেল সব ক্ষোভ।।

আচার বিচার তত্ত্ব সকলি ছাড়িল।

দিনে দিনে অনুরাগ প্রাণেতে বাড়িল।।

যে যেখানে শ্রীতারক করেন গমন।

নিজ হতে যাদবেরে ডাকে সর্ব্বক্ষণে।।

গোস্বামীরে ভালবাসে তাঁর কাছে যায়।

ওড়াকান্দী কিবা আছে নাহি জানে হায়।।

যাদবেরে বারেবারে গোস্বামী কহিল।

‘‘আমার সঙ্গেতে তুমি ওড়াকান্দী চল।।’’

Page 429 start

যাদব কহিল ‘‘ওড়াকান্দী কিবা আছে?

যাঁর কাছে ছিল ধন সেত চলে গেছে।।’’

তারক বলিল ‘‘হেন বাক্য পুনরায়।

কোন দিনে যেন তুমি বলো না মশায়।।

ওড়াকান্দী কি যে আছে কিবা তার বলি।

আমি বলি ওড়াকান্দী আছেত সকলি।।

বিশ্বাস করিয়া তুমি যাও একবার।

নিজ চোখে দেখা পেলে যাবে অন্ধকার।।’’

মনের সন্দেহ তার তবু নাহি গেল।

হেন কালে তার এক পুত্র জনমিল।।

পুত্র জন্ম পরে তার পবিত্রা রমণী।

‘‘গ্রহণী’’ রোগের চাপে পড়িলেন তিনি।।

ওঝা বৈদ্য ডাক্তারাদি দেখালেন কত।

কোন ক্রমে রোগে নাহি হ’ল প্রশমিত।।

হেনকালে শোনা গেল পাইকপাড়ায়।

‘‘হরি ঠাকুরের বার’’ হয়েছে উদয়।।

বিশ্বেশ্বর নামে এক ব্রাহ্মণ সুজন।

তার দেহে ‘বার’ নাকি করে আগমন।।

রোগী মাত্রে কাছে গেলে রোগে শান্তি পায়।

যাদব পত্নীকে লয়ে তার কাছে যায়।।

যে সব বিধির কথা বলিল সেজন।

কতদিন সেই বিধি করিল পালন।।

ঈষৎ কমিয়া রোগ আর নাহি কমে।

দিনে দিনে ক্ষীণ তনু হ’ল ক্রমে ক্রমে।।

হেনকালে একদিন শ্রীতারক চন্দ্র।

লোহারগাতীতে এল যেন পূর্ণ চন্দ্র।।

যাদবের গৃহে গিয়া দেখিল যখন।

রোগে ভোগে পত্নী তার মলিন বদন।।

তাহা দেখি তারকের দয়া হ’ল মনে।

যাদবে ডাকিয়া বার্ত্তা কহিল তখনে।।

‘‘জননীরে একেবারে ফেলিল মারিয়া।

তোমার কেমন প্রাণ পাইনা ভাবিয়া।।

কোথা যাও কিবা কর নাহি পাও দিশে।

‘বার’ ধরে রোগ সারে বুঝিলে তা কিসে?

ছেড়ে দেও গন্ডগোল কাজে কাজী হও।

বারে বারে বলি আমি ওড়াকান্দী যাও।।’’

এত বলি গোস্বামীজী বিধান কহিল।

সে বিধান মেনে পরে রোগ সেরে গেল।।

বিস্মিত যাদব তাই ভাবিলেন মনে।

‘ওড়াকান্দী যেতে প্রভু মোরে বলে কেনে।।

ওড়াকান্দী কিবা আছে কিছু নাহি জানি।

একমাত্র গোস্বামীরে গুরু বলে মানি।।

বারে বারে ওড়াকান্দী মোরে যেতে কয়।

ঠাকুরের সঙ্গে মোর নাহি পরিচয়।।

কি জানি কি কোন ভাবে কি বলে ঠাকুর।

আমার মনেতে তাই সন্দেহ প্রচুর।।

তবে যদি দয়া করে প্রভু সাথে লয়।

কোনখানে যেতে আমি নাহি পাই ভয়।।

এত ভাবি সে যাদব চুপ করে রয়।

কিছুদিন পরে শুন কি ঘটনা হয়।।

বারুণীর কিছুদিন পূর্ব্বভাগে বটে।

তারক গোস্বামী একা আসিলেন হেঁটে।।

লোহারগাতিতে আসি হইল উদয়।

সেইক্ষণে ডাক দিয়া যাদবেরে কয়।।

‘‘শুন হে যাদব! তুমি আমার বচন।

মোর সাথে ওড়াকান্দী করহে গমন।।

বারুণীর কালে আমি এ পথে আসিব।

আমার সঙ্গেতে তোমা নিশ্চয় লইব।।’’

যাদব স্বীকার করে গোস্বামীর ঠাঁই।

তার সঙ্গে ওড়াকান্দী যেতে বাধা নাই।।

তারকের সাথে পরে সে যাদব গেল।

এবে শুন ওড়াকান্দী গিয়া কি দেখিল?

---০---