Page 523

লক্ষ্মীখালী ও অন্যান্য ভক্তালয়ে গমন

গুরুচাঁদ আজ্ঞা করে, গোপালে আনিল ঘরে,

ভক্ত কুঞ্জ ঘৃতকান্দি বাসী।

এসে পরে ওড়াকান্দি, গোপাল উঠিল কান্দি,

প্রভু তবে বলিলেন হাসি।।

“কান্দ কেন অকারণ, কিসে বিষাদিত মন,

দুঃখে কেন কর তুমি ভয়।

ভক্তাধীন যেই জন, এই ভাবে বোঝে মন,

এই কথা জানিও নিশ্চয়।।”

অতঃপর দয়াময়, সকলে ডাকিয়া কয়,

“চল সবে যাই লক্ষ্মীখালী”।

সবে আনন্দিত তা’তে, নানা দিগ দেশ হ’তে,

এল সবে হয়ে কুতূহলী।।

মাধবেন্দ্র, যজ্ঞেশ্বর, থাকে ওড়াকান্দি ‘পর,

কুঞ্জ, মধু আছে ঘৃতকান্দি।

পাগল সে বিচরণ, বিপিন আর সনাতন,

ষষ্ঠীবাবু ঠিক যেন নন্দী।।

কেদার, কানাই দুই, কা’র সাথে কা’রে থুই,

অশ্বিনী গোঁসাই চলে সাথে।

কবিবর হরিবর, দুর্গাপুরে যার ঘর,

মধ্যপথে উঠিল তরীতে।।

পাটিকের বাড়ী ঘর, নামেতে রাজকুমার,

অক্ষয় মৃধার নাম জানি।

বেথুড়িয়া গ্রামে বাস, নামে প্রসন্ন বিশ্বাস,

সঙ্গে করে নিল গুণমণি।।

চলিল গোপাল রায়, বাড়ী মল্লকান্দি গাঁয়,

মান্যবান মহাধনী তিনি।

মল্লকান্দি বাসী যারা, সকলে মতুয়া তারা,

গ্রামভরা সবে বটে ধনী।।

এই মত কত জন, জ্ঞানে গুণে মহাজন,

লক্ষ্মীখালী করিলেন যাত্রা।

যত লোক বেশী হয়, গোপাল আনন্দ পায়,

আনন্দের নাহি যেন মাত্রা।।

প্রভুর তরণী ছাড়ে, দাঁড়িগণে টানে জোরে,

মাধবেন্দ্র বসিলেন হা’লে।

আসি টুঙ্গীপাড়া গাঁয়, দয়া করি দয়াময়,

তপস্বীর গৃহ’পরে চলে।।

Page 524 start

কিছু কাল রহি সেথা, কতই মধুর কথা,

প্রভু সুখে করে আলাপন।

শ্রীদেবেন্দ্র বালা নাম, হরিভক্ত গুণধাম,

প্রভু সঙ্গে চলিল তখন।।

তথা হ’তে ছাড়ে তরী, সবে বলে হরি হরি,

মধুমতী নদী ধরি যায়।

গোস্বামী বিপিন যিনি, সুখে বাস করে তিনি,

নামে গ্রাম কেনুয়াভাঙ্গায়।।

বহু স্তুতি প্রভুজীরে, গোস্বামী করিল ধীরে,

গৃহে তার বহু আয়োজন।

তার ছিল ভক্ত যত, সবে হ’ল সমাগত,

বহু সংখ্যা লোক সংঘটন।।

প্রভু কয় “যেতে পারি, দিবে তুমি কত কড়ি,

ত্বরা করি বল তা’ আমারে।”

গোস্বামী কান্দিয়া কয়, “যত নিতে ইচ্ছা হয়,

দিব তা’তে কে ঠেকা’বে মোরে?

পুত্র পৌত্র কেহ নাই, তা’তে আমি সর্বদাই,

একা ঘরে আছি বড় সুখে।

তোমার দয়ার গুণে, বাধা নাই কোন খানে,

তা’তে আনি হেন কথা মুখে।।”

প্রভুজী উঠিয়া তীরে, চলিলেন ধীরে ধীরে,

দেখিলেন চাহি চারিধারে।

গৃহাবধি নদী হ’তে, বহু কলা গাছ পুঁতে,

রাজপথ সমপথ করে।।

গৃহ মধ্যে শ্বেতাসন, সাজা’য়েছে মহাজন,

তদুপরি প্রভুরে বসা’ল।

তাহার রমণী যিনি, সতীলক্ষ্মী বলে জানি,

ঘন ঘন হুলুধ্বনি দিল।।

প্রেমানন্দে মহোৎসব, করিল ভকত সব,

আনন্দের সিমা কিছু নাই।

গোস্বামী মহৎ অতি, এনে দিল শীঘ্র গতি,

শত টাকা শ্রীপ্রভুর ঠাই।।

প্রভুর নিকটে কয়, “পরে পরে দয়াময়,

ভক্তগণ হ’তে দিব টাকা।

বিলাতে প্রমথরঞ্জন, আমাদের হৃষ্ট মন,

তার ছবি এ হৃদয়ে আঁকা।।”

প্রভু বিপিনেরে কয়, “চল লক্ষ্মীখালী গায়,

এক সঙ্গে যাব সব জনে।”

প্রভুর বচন শুনি, চলিল বিপিন জ্ঞানী,

লক্ষ্মীখালী অতি হৃষ্ট মনে।।

প্রভুর তরণী তলে, মধুমতী নদী জলে,

হেনকালে তারাচাঁদ রায়।

আঁধার মাণিক ঘর, খুলনা জিলার পর,

সাধু ভক্ত সেই মহাশয়।।

আসিয়া নৌকার ধারে, বাহুড়ি তরণী ধরে,

দাড়ী যারা তারা ওঠে রেগে।

তারাচাঁদ হেসে কয়, “রাগ কেন মহাশয়,

সময়েতে সব-করা লাগে।।”

প্রভু তা’তে বলে ডাকি, “কে হে তারাচাঁদ নাকি?

চল যাই তোমার আঙ্গিণে।”

দাড়ীরা অবাক হয়, “এই তারাচাঁদ রায়,

আগে চিনি নাই মহাজনে।।”

আঁধার মাণিক এসে, তারাচাঁদের আবাসে,

সুখে প্রভু বঞ্চিলেন নিশি।

শ্রীনাথ মাতার ঘরে, প্রভু আসিলেন ঘুরে,

সম্মান দেখায় দেশবাসী।।

তথা হ’তে ছাড়ি তরী, ভৈরবের বক্ষ ধরি,

ক্রমে তরী মিস্ত্রীডাঙ্গা এল।

গণেশ মণ্ডল তায়, প্রেমানন্দে ঘাটে যায়,

করজোড়ে প্রভুকে বন্দিল।।

মহোৎসব আয়োজন, করিলেন সেই জন,

বহু শত লোক সংখ্যা হৈল।

বিলাতের চাঁদা বলে, টাকা দিল প্রভু স্থলে,

ধন্য ধন্য প্রভু তারে কৈল।।

Page 525 start

নাম তার সোনারাম, বেতকাটা গ্রামে ধাম,

গোপালের মাতুল সেজন।

তিনি এসে কেন্দে কয়, দয়া করে দয়াময়,

তার গৃহে করিল গমন।।

স-গোষ্ঠী স-পরিবারে, প্রভুকে বন্দনা করে,

রাধাকান্ত, নিবারণ, রতি।

মহেন্দ্র উপেন্দ্র তায়, কয় ভাই সর্বদায়,

সাধু সেবা করে ইতি উতি।।

বিরজা মোহিনী দেবী, ভক্তিমতি পুণ্য ছবি,

“প্রভাতীর মাতা” পরিচয়।

প্রভুকে দর্শন করি, কত যে আনন্দ তারি,

মুখে তাহা বলা নাহি যায়।।

সোনারাম নিবারণ, রতি মিলে তিনজন,

টাকা দিল প্রভুর শ্রীকরে।

কান্দে আর টাকা দেয়, বলে ওগো দয়াময়,

পাই তোমা গোপালের জোরে।।

আমাদের ভক্তি নাই, শুভ কাজ করি নাই,

দয়া করে “শুভ” চিনাইলে।

এ বংশে আছেন যত, আসিবেন পরে যত,

সবে তুমি রেখ পদতলে।।”

শুনিয়া বিনয় বাণী, তুষ্ট প্রভু গুণমণি,

বলে “আর না করিব দেরী।

মন গেছে লক্ষ্মীখালী, কিবা আর কথা বলি,

মন মোর ব্যস্ত হ’ল ভারী।।”

ইহার কারণ যাহা, প্রত্যক্ষ বলিব তাহা,

ভাগ্যবতী কাঞ্চন জননী।

বিরলে বসিয়া মাতা, স্মরিয়া প্রভুর কথা,

অশ্রুজল ফেলে তাই জানি।।

যাবৎ না দেখা পান, পূর্ণব্রহ্ম গুরুচান,

নহে মাতা পরাণেতে সুখী।

সতীর ভক্তির টানে, প্রভু সুস্থ নহে মনে,

“চল” “চল” বলে থাকি থাকি।।

পাল্কী মধ্যে প্রভু যায়, ভক্তেরা বহিয়া লয়,

কিবা প্রেমানন্দ হ’ল মনে।

শত শত নর নারী, সবে বলে হরি! হরি!

নাম ধ্বনি উঠিল গগনে।।

ধীরে ধীরে পাল্কী চলে, শতে শতে দলে দলে,

নর প্রাণী সঙ্গে সঙ্গে যায়।

সে কি যে তরঙ্গ দোলা, মুখে কিসে যায় বলা,

অনুমানে বোঝা বড় দায়।।

ক্রমে লক্ষ্মীখালী বাসে, প্রভুর বাহিনী আসে,

সঙ্গে প্রভু আনন্দ মূরতি।

তুলিলেন যত্ন করে, ভক্তিপ্রেম অশ্রুনীরে,

কাঞ্চন জননী দেবী সতী।।

শ্রীহরি মন্দির ঘরে, বসাইল শ্রীপ্রভুরে,

পালঙ্ক উপরে শয্যা দিয়া।

গোপাল-কাঞ্চন দোঁহে, করজোড় করি রহে,

অশ্রুবারি পড়িছে ঝরিয়া।।

গোপালের মনোসাধ, পূর্ণব্রহ্ম গুরুচাঁদ,

মন্দিরেতে হ’বে অধিষ্ঠান।

বাঞ্ছাপূর্ণ হ’ল তার, তাই শত অশ্রুধার,

বক্ষে পড়ে সৃষ্টি করে বান।।

কাঞ্চন জননী পরে, নারীগণে সঙ্গে করে,

পূজা উপাচার সব আনে।

আনে ধূপ, আনে দ্বীপ, কুম্কুমের এক ঢীপ,

মিশা’য়ে দিল তা’ চন্দনে।।

পঞ্চ প্রদীপের বাতি, যেন মুকুতার পাঁতি,

ধান্য দূর্বা পদ্ম শতদল।

কুসুমের মালা করে, সাজা’ল তা থরে থরে,

কর্পূর-বাসিত আনে জল।।

সাজা’ল বরণ ডালা, যেন রে চন্দ্র মেখলা,

হীরা-গলা ভাতি দেখি তায়।

আহার্য আনিল যত, মুখেতে বলিব কত,

ফল মাত্রে বাকী নাহি রয়।।

Page 526 start

আঙ্গুর বেদানা এল, আম, জাম, আতাফল,

বাদাম, পেয়ারা, আনারস।

পক্ক রম্ভা, পক্ক বেল, কটি সুমিষ্ট আপেল,

খণ্ড ইক্ষু ভরা মধুরস।।

সপেটা’ কাবুলী পেস্তা, দামে ভারী নহে সস্তা,

আখরোট আনিলেন কিছু।

বাংলার প্রধান ফল, কাঁচা ডাব ভরা জল,

দুই চারি ছড়া ছিল লিচু।।

কাঞ্চন জননী সতী, হ’য়ে দেবী একমতি,

নিজ হস্তে করিল প্রস্তুত।

পিষ্টকাদি ক্ষীর সাজ, রসভাজা পাটীসাজ,

চন্দ্রপুলি মিষ্টরস যুত।।

দুধ দিয়া পায়সান্ন, করিল প্রভুর জন্য,

ক্ষীর করে আনন্দিত চিতে।

কাঁচা মিষ্ট দু’ প্রকার, দধি করে চমৎকার,

সন্দেশ করিল নিজ হাতে।।

প্রভুর অগ্রেতে আনি, রাখিতেছে সে জননী,

করুণ নয়নে প্রভু চাহে।

ভক্তাধীন ভগবান, ভক্তপ্রতি চেয়ে র’ণ,

মুখে কোন কথা নাহি কহে।।

সকল আনিয়া পরে, করে দেবী উচ্চৈঃস্বরে,

হুলুধ্বনি মঙ্গল আরতি।

কেহ করে শঙ্খধ্বনি, স্বহস্তে সাজায়ে আনি,

জননী নাচায় পঞ্চবাতি।।

ঘণ্টা ধ্বনি করে পরে, ধরিয়া আপন করে,

দূর্বাপুষ্প দিল প্রভু পদে।

গৃহে কি বাহিরে সবে, ‘জয়’ দিল উচ্চরবে,

জননী পূজিল গুরুচাঁদে।।

---০---