Page 118 start

সভা দৃশ্য বর্ণনা

অপূর্ব্ব সভা - মণ্ডপ, উর্ধ্বে শ্বেত চন্দ্রা তপ

মধ্যে তার রক্ত - পদ্ম আঁকা।

চারিদিকে চারি দ্বার, দেখি অতি মনোহর

মঙ্গল কলসী পদে রাখা।।

পুতিয়া কদলী বৃক্ষ, পুস্প তাহে লক্ষ লক্ষ

মধ্যে তার দেবদারু পত্র।

বৃত্তাকারে দ্বার - শির, দাঁড়াইয়া রহে স্থির

শিরে যেন ধরিয়াছে ছত্র।।

সভার উত্তর দিকে, চারিটি পালঙ্ক রেখে

ঢাকে তাহা সত রঞ্চি দিয়া।

তার' পরে কাষ্ঠাসন, ঠিক যেন সিংহাসন

শ্বেত - বস্ত্রে রেখেছে মুড়িয়া।।

সম্মুখ ভাগেতে তার, কিবা শোভা মনোহর

টেবিল রাখিল সাজাইয়া।

ফুলদানী দুই ধারে, রাখিয়াছে ফুল ভরে

গন্ধ ছুটে বাতাস ভরিয়া।।

সম্মুখ ভাগেতে তার, শয্যা অতি পরিস্কার

বিস্তৃত প্রাঙ্গণ জুড়ি রহে।

ইন্দ্র-সভা তুল্য শোভা, পত্র পুস্পে মনোলোভা

'ধন্য সভা 'সবে ডাকি কহে।।

কাষ্ঠাসন বহুতর, রেখেছে মঞ্চের পর

আরো বহু সভা বেড়ি রহে।

জ্ঞানী গুণী নেতা যারা, মঞ্চের উপরে তারা

স্তব্ধ থাকি কথা নাহি কহে।।

যথা - যোগ্য স্থান লয়ে, বসে সবে ঠিক হয়ে

হেনকালে উঠে জয় ধ্বনি।

পঞ্চ - সহস্র প্রমাণ, লোক হবে অনুমান

দেব - সভা তুল্য সভা গণি।।

আসিলেন গুরুচাঁদ, সঙ্গে যত পারিষদ

হুলুধ্বনি জয় ধ্বনি উঠে।

যবে আগুয়ান হন, সভাশুদ্ধ লোকজন

দাঁড়াইল সবে কর পুটে।।

ছিল কত তর্ক বাদী, মনে মনে ছিল বাদী

দেখি গুণনিধি রহে চুপ।

উজ্জ্বল বরাঙ্গ কায়, তরুণ - তপন - প্রায়

মুগ্ধ সবে দেখি সেই রূপ।।

যবে সভা প্রবেশিল, এই মত ভাব হল

দাঁড়াইয়া সবে রহে স্থির।

হস্ত উত্তোলন করি, হৃদয়ে শ্রী হরি স্মরি

ক্ষণেক নমিয়া নিজ শির।।

গুরুচাঁদ বলে কথা, ' শুনহে স্বজাতি ভ্রাতা

আজি দেখ বড় শুভ দিন।

আরম্ভ হইবে সভা, সভা হবে মনোলভা

কেহ আজি হ'য়োনা মলিন।।

মনোগত যত কথা, সবে আজি কহ হেথা

মনোব্যথা কর অবসান।

এতকাল মহাদুঃখে, কথা নাহি ছিল মুখে

বলে কথা জুড়াও পরাণ।।”

এই বাণী শেষ করি, বসিলা আসন পরি

গুরুচাঁদ প্রভু দয়াময়।

দ্বারিক মোক্তার যিনি, সভাতে দাঁড়ায়ে তিনি

ধীরে ধীরে এই কথা কয়।।

“কহ সব সভাজনে, সভাপতি কোনজনে

অদ্য হেথা করিবে বরণ ?”

পণ্ডিত শ্রী রঘুনাথ, করি সবে দণ্ডবৎ

কহিলেন মধুর বচন।।

“স্ব-জাতির এ-সভায়, মোর নিবেদন রয়

সভাপতি করি নির্ব্বাচন।

যদি অনুমতি হয়, আমি বলি এ সভায়

উপযুক্ত আছে একজন।।

Page 119 start

গুরুচাঁদ বরকর্ত্তা, জানে সবে যাঁর বার্ত্তা

শ্রী হরিচাঁদের পুত্র যিনি।

স্ব-জাতির এ সভায়, তাই মোর মনে লয়

অদ্য হোন্ সভাপতি তিনি।।”

মঞ্চ'পরে নেতা যত, করে করে করাঘাত

শুভ - বাক্য সমর্থন করি।

সবে কহে ' জয় জয়, জয় সভাপতি জয়

জয় শব্দ উঠে শূন্য ভরি।।

সভাপতির আসনে, বসাইল গুরুচাঁনে

ফুল - মালা দিল গলে তাঁর।

আহা কিবা রূপ হেরি, বর্ণনা করিতে নারি

অঙ্গ স্পর্শে ধন্য ফুল হার!

মঞ্চ পরে চারিধারে, নেতৃবর্গ তথাকারে

সবে বসিয়াছে হৃষ্ট মনে।

প্রতিজনে মাল্য দান, দিয়া করে সু সন্মান

শোভা দেখি সকলে বাখানে।।

কেশব ডাক্তার যিনি, পুরাভাগে গিয়া তিনি

সম্বোধি সকল জনে বলে।

“স্ব জাতি বান্ধব যত, সবে করি দণ্ডবৎ

মনোকথা বলে কুতূহলে।।

ছিন্ন ভিন্ন সবে মোরা, আছি বঙ্গ দেশ ভরা

একত্রতা কভু হয় নাই।

অদ্য শুভ দিন ধন্য, স্ব-জাতি - মিলন জন্য

মিলিয়াছি সবে এক ঠাঁই।।

জাতীয়তা বিনে ভাই, উন্নতির আশা নাই

সেই ভাব বলিব এখানে।

এক ভাবে এক টান, এক মূলে বাঁধা প্রাণ

এক সুর গাহে এক তানে।।

সেই ভাব যদি হয়, এ জাতির নাহি ভয়

দিনে দিনে ঘটিবে উন্নতি।

সবে লহ এক দীক্ষা, কর এক পণ - রক্ষা

মূলমন্ত্র মনে রাখ জাতি।।

কেশব ডাক্তার তবে, কথা বলি এই ভাবে

করিলেন আসন গ্রহণ।

ধন্য ধন্য সবে কয়, করে করতালি দেয়

আনন্দেতে সবে বহুক্ষণ।।

পাটগাতী গ্রামে ঘর, দিব্য - কান্তি মনোহর

দ্বারিক মণ্ডল যাঁর নাম।

মঞ্চ পরে দাঁড়াইয়া, সভা দণ্ডবৎ হৈয়া

কহি লেন কথা গুণধাম।।

“শুনহে স্বজাতি ভাই, এ জাতির রক্ষা নাই

সবে যদি নাহি এক হও।

ভাব ' মনে নহি ক্ষুদ্র, বীর্যবান নমঃশূদ্র

এক তালে সবে পা ফেলাও।।

কু-সংস্কার আছে যত, দূর কর অবিরত

বিদ্যা শিক্ষা কর ঘরে ঘরে।

মান - জ্ঞান থাকা চাই, নিজ - মান রাখা চাই

কর কাজ সবে একত্তরে”।।

এত বলি মহাশয়, বসিলেন পুনরায়

সভা করে করতালি ধ্বনি ---

দ্বারিক মোক্তার যিনি, উঠিয়া দাঁড়ান তিনি

করতালি পড়িল অমনি।।

সবিনয়ে করজোড়ে, সবে নমস্কার করে

ধীরে ধীরে বলিলেন তিনি।

“নমঃশূদ্র বন্ধু গন! করি এই নিবেদন

বলি সবে যাহা কিছু জানি।।

ভুল দোষ ত্রুটি গুলি, সভাসদ মণ্ডলী

দয়া করি করিবেন ক্ষমা।

অসাধু যদ্যপি বলি, সব ফেলিলেন ঠেলি

সাধু সব রাখিলেন জমা।।

'নমঃশূদ্র ' নমঃশূদ্র ' শুনি মাত্র এই শব্দ

নাহি জানি সব পরিচয়।

অপর যতেক হিন্দু, কেহত নহেরে বন্ধু

মোদেরে শোষণ করি খায়।।

Page 120 start

কৃষি জীবি সব মোরা, খাদ্য শস্য ঘর - ভরা

থাকে বটে কতক সময়।

জমিদার মহাজন, হরে লয় সব ধন

কাঙ্গালের সাজে ঘুরি হায়!

বিদ্যাহীন আছি মোরা, তাই করিতেছি সারা

ব্রাহ্মণ কায়স্থ আদি জাতি।

যদ্যপি অবিদ্যা যায়, তবে আর নাহি ভয়

কোন দিকে নাহি হবে ক্ষতি।।

সকলে মিলিয়া ভাই, পাঠশালা করা চাই

প্রতি জেলা প্রতি গ্রামে গ্রামে।

বিদ্বান হইলে সবে, কেহ ঘৃণা না করিবে

মান্য হবে নমঃশূদ্র নামে”।।

এতেক বলিল যবে, করতালি মহারবে

করতালি করে সব জন।

দ্বারিক মোক্তার যিনি, ধীরে ধীরে পরে তিনি

করিলেন আসন গ্রহণ।।

গুরু চরন বিশ্বাস, আটের হাটেতে বাস

মহাশয় ব্যক্তি সেই জন।

দাঁড়ায়ে সভার আগে, কর জোড়ে বর মাগে

ধীরে ধীরে করে নিবেদন।।

“ স্বজাতি বান্ধব যত, করি সবে দণ্ড বৎ

মাগি বর সবাকার পায়।

সভার বন্দনা সারি, বলিবারে যেন পারি

স্বজাতির কিসে শুভ হয়।।

পর-অন্ন পর-সেবা, ধরা ধামে করে যেবা

তার আর নাহিক উপায়।

পর অন্ন ছাড় ভাই, পর-সেবা কার্য নাই

দেখা যাক কি ভাব দাঁড়ায়।।

কায়স্থ ব্রাহ্মণ সবে, গর্ব্ব করে যে গৌরবে

মোরা তার কিবা ধার ধারি।

নিজ ঘরে প্রসাদান্ন, করো সবে তাহা মান্য

তা'তে মোরা বাঁচি কিংবা মরি।।

শুন সব মহাশয়, এক কথা মনে হয়

ক্ষৌর কার্যে লাগে যে নাপিত।

ব্রাহ্মণ যবন মিলে, এক হাতে ক্ষৌরি হলে

সেই কার্য হয় কি বিহিত ?

নমঃশূদ্র আছি যারা, সে ধার ধারি না তারা

ব্রাহ্মণ নাপিত আছে ভিন্ন।

পবিত্র বলিতে গেলে, আছে কিছু নমঃকুলে

ধর্ম্ম কর্ম্ম তারা করে মান্য।।

“স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ, পর - ধর্ম্ম ভয়াবহঃ

গীতা ভাগবতে তাই বলে।

নিজ ধর্ম্ম নাহি মান্য, খেলে পরে পর-অন্ন

অন্ন দোষে ধর্ম্ম যাবে চলে।।

শুনহে স্বজাতি ভাই, মোর অন্য কথা নাই

পর - অন্ন না করো গ্রহণ “।

এত বলি সেই জন, করি কথা সমাপন

করিলেন আসন গ্রহণ।।

বোম্ভাগ গ্রামেতে ঘর, পণ্ডিত জী শ্রী ঈশ্বর

ঈশ্বর পণ্ডিত নাতে খ্যাত।

উঠিয়া আসন হতে, করজোরে প্রণিপাতে

নিজ শির করিলেন নত।।

চাহিয়া সভার পানে, ' ভাই সব! সম্বোধনে

কহিলেন গুটী কত কথা।

“শ্রবণ করুন সবে, বড় হব কোন ভাবে

তার লাগি কর একাগ্রতা।।

এক হয়ে যাহা কবে, এক মনে যা ' করিবে

সেই কার্য না হবে বিফল।

অন্য কথা শোনা নাই, অন্য মানা মানি নাই

এক লক্ষ্য রাখিবে সকল।।

কুসংস্কার যত আছে, ফেল সব ধুয়ে মুছে

ভাল কর সব হবে ভাল।

ভাল তুমি হবে যবে, মন্দ আর কে বলিবে

ঘুচে যাবে আপদ জঞ্জাল।।

Page 121 start

নামে জগন্নাথ রায়, মান্য যাঁর অতিশয়

পুকুর কুলের পরিচয়।

আদিতে সর্দ্দার বংশ, প্রতাপের সেনা অংশ

অতঃপর কৃষি জীবি হয়।।

এই দীন গ্রন্থকার, এই বংশে জন্ম তার

জন্ম ধন্য দেখি গুরুচাঁদে!

হরি হল অবতংস, ধন্য নমঃশূদ্র বংশ

ভাগ্য গুণে পেয়ে হরিচাঁদে।।

এই জগন্নাথ রায়, দাঁড়াইয়া কথা কয়

সভা মাঝে বহুত প্রকারে।

জ্ঞান-গর্ভ কথা কয়, সবে করতালি দেয়

সভা শুদ্ধ ধন্য ধন্য করে।।

নব কৃষ্ণ সেই জন, জ্ঞানী গুণী মহাজন

সভামধ্যে বহুত কহিল।

সবে তার কথা শুনি, ধন্য ধন্য করে ধ্বনি

জয় শব্দে করতালি দিল।।

জ্ঞানে গুণে মহাবলী, পিয়ারী চরণ ঢালি

অন্য ভাবে উপাধি বিশ্বাস।

দাঁড়াইয়া সভা মাঝে, কথা বলে মহা তেজে

মনে হয় ফেলেনা নিঃশ্বাস।।

কথা কয় কতক্ষণ, মুগ্ধ হয় সর্ব্বজন

সবে বলে ' ধন্য ব্যক্তি বটে!

উমাচরণ বিশ্বাস, সচিয়াদহেতে বাস

কথা বলে সভার নিকটে।।

রামলোচন বিশ্বাস, দাঁড়াইয়া সভা-পাশ

বলিলেন জ্ঞান গর্ভ কথা।

তাঁহার বচন শুনি, সবে করে জয় ধ্বনি

বাক্যে তার এত মধুরতা।।

পণ্ডিত শ্রী রাম নাথ, কর জোড়ে প্রণিপাত

করিলেন সভাজন প্রতি!

ধীরে ধীরে কথা কয়, যেন কেহ গীত গায়

কন্ঠ - স্বর সুললিত অতি।।

বিদ্যার যতেক গুণ, ধন মান সব ন্যূন

বিদ্যাহীন রয় যেই জাতি!

নমঃশূদ্র ঘরে ঘরে, যা'তে বিদ্যা শিক্ষা করে

সেই কথা বলিলা সম্প্রতি।।

এই ভাবে জনে জনে, কথা কয় সভা স্থানে

কেহ কম কেহ বলে বেশী।

সকলের বলা হলে, উঠিলেন সভাস্থলে

গুরুচাঁদ যেন পূর্ণ শশী।।

বীণাপাণী লয়ে বীণা, আপনার মধ্যে লীনা

গাহে যদি সুধাময় গীতি।

অথবা নারদ ঋষি, সুর সাধে যবে বসি

যদি শোনে কমলার পতি।।

অথবা কৈলাস পতি, যেমন করিল গীতি

যে দিনে গলিল নারায়ণ।

সৃষ্টি মোহ-প্রাপ্ত হয়, নারায়ণ পদে তায়

গঙ্গা করে জনম গ্রহণ।।

তেমনি সুরের ধ্বনি, গুরুচাঁদ গুণমনি

নিজ কন্ঠে আনিল সে দিন।

সে স্বরে নাহি তুলনা, যেমন কমলা - বাসনা

অনাহত ধ্বনি মাঝে লীন।।

গুরুচাঁদ কয় কথা, বসে শোনে সব শ্রোতা

অপূর্ব্ব ভাবেতে নিমগন।

এ যেন ক্ষীরোদ কুলে, দৈত্য - ভীত দেব কুলে

ভয় নাই বলে নারায়ণ।।

সে সব মধুর কথা, অমিয় - পূরিত গাঁথা

কহিবারে শক্তি মোর নাই।

যদি গুরু করে দয়া, দেয় মোরে পদছায়া

মনে তবে আমি জোর পাই।।

বারশ ' সাতাশী সালে, এই সভা নমঃকুলে

প্রথমে হইল অধিষ্ঠান।

পতিত - পাবন বন্ধু, গুরুচাঁদ কৃপাসিন্ধু

অন্ধে চক্ষু করেছিল দান।।

Page 122 start

কুভাব কুরুচি যত, দেশে ছিল প্রবাহিত

সে সকলে ফেলিল মুছিয়া।

বোঝে নমঃশূদ্র জাতি, জাতি যদি চাহে গতি

যেতে হ'বে সূক্ষ্ম পথ দিয়া।।