Page 546

শ্রীশ্রীহরি-গুরুচাঁদ মিশন

তের শ’ ঊনচল্লিশ সাল গণনায়।

দুর্গাপূজা কালে ভক্ত ওড়াকান্দি যায়।।

শত শত ভক্ত সেথা করে আগমন।

সবারে ডাকিয়া প্রভু বলিলা বচন।।

“শুন ভক্তগণ! যাহা আসিয়াছে মনে।

‘মিশন’ গড়িব এক প্রচার কারণে।।

মতুয়া ধর্মের নীতি করিতে প্রচার।

‘মিশন’ গড়িব মোরা অতি চমৎকার।।

দেশে দেশে মিশনের বহু শাখা র’বে।

আমার বাবার নাম প্রচার করিবে।।”

প্রভুর বচনে সব ভক্তে সায় দিল।

‘হরি-গুরুচাঁদ’ নামে মিশন গড়িল।।

প্রমথ রঞ্জন তা’তে হ’ন সভাপতি।

“মতুয়ার মহাসংঘ” তার পরিণতি।।

পিতৃ কীর্তি প্রচারিতে প্রভুজীর মন।

এই কার্য হাই স্কুলে করে নিরূপণ।।

সহস্র রজত মুদ্রা ওড়াকান্দি স্কুলে।

দান করিলেন প্রভু অতি কুতূহলে।।

প্রতি বর্ষে সে টাকায় যত সুদ হয়।

সে সুদ হইবে ব্যয় নিম্নোক্ত উপায়।।

তারকচাঁদের কৃত “হরি লীলামৃত”।

তাহা হ’তে পাঠ বটে হ’বে মনোনীত।।

কৃতিত্ব তাহাতে যেবা দেখাইতে পারে।

স্কুলের কমিটি তারে পুরস্কৃত করে।।

নারী শিক্ষা তরে প্রভু আপন আলয়।

“শান্তি-সত্যভামা” নামে স্কুল গড়ি’ দেয়।।

দশভূজা তবে এক গড়িল মন্দির।

শ্রীহরি মন্দির বেড়ী গড়িল প্রাচীর।।

দিনে দিনে ভক্ত সঙ্গ ক্রমে বেড়ে যায়।

ভক্ত লাগি করে প্রভু বিশ্রাম-আলয়।।

“রাসের মণ্ডপ” বলি তুলিলেন ঘর।

ত্রিতল টিনের ঘর দেখিতে সুন্দর।।

রাস মণ্ডপের কাছে দক্ষিণ বাহিনী।

দীর্ঘিকা খনন করে নয়ন রঞ্জিনী।।

“কামনা সাগর” বলি তারে আখ্যা দেয়।

শুন বলি “সাগরের” গূঢ় পরিচয়।।

শ্রীমুখেতে বাক্য প্রভু যা’রে যাহা বলে।

অবশ্য সকল বাক্য অনায়াসে ফলে।।

আধি, ব্যাধি দায়ে নিত্য শত শত জন।

প্রভুর নিকটে আসি করিত রোদন।।

কিবা কি প্রভুর লীলা বুঝিতে না পারি।

কখনে কি বলে প্রভু কোন ভাব ধরি।।

“কামনা সাগর” করি প্রভু ডেকে কয়।

এ ‘সাগর’ ডুবাইলে বাঞ্ছা পূর্ণ হয়।।

এখানে ডুবায় যদি করিয়া কামনা।

অবশ্য পুরায় হরি তাহার বাসনা।।

তদবধি দিবারাত্রি শত শত নর।

কামনা করিয়া ডুবে “কামনা সাগর”।।

অপুত্রকে পুত্র পায় দীনজনে ধন।

“কামনা সাগর” মানে প্রভুর বচন।।

প্রভুর বচন মেনে চলে সমুদয়।

“কামনা সাগর” তার এক পরিচয়।।

Page 547 start

সমগুণধারী করে আরেক “সাগর”।

মাতৃ নামে প্রতিষ্ঠিত “শ্রী শান্তি সাগর”।।

প্রভুর লীলার ভাব কে বুঝিতে পারে?

অজস্র অর্থের ব্যয় এ সময়ে করে।।

ওড়াকান্দি বিলাঞ্চল রাস্তা ঘাট নাই।

বছরের অধিকাংশ নৌকা চলে তাই।।

জল কমে গেলে আর নৌকা নাহি চলে।

যাতায়াতে মহাকষ্ট হয় তার ফলে।।

প্রভু কয় “এই কষ্ট সহি কি কারণ?

অবশ্য রাস্তার আমি করিব গঠন।।”

এত বলি দেশবাসী সকলেরে ডাকে।

মনোগত ভাব তবে বলিল সবাকে।।

সবে কয় “কর্তা! এই রাস্তা কি থাকিবে?

জলে ডুবে রাস্তা সব ধুয়ে মুছে যা’বে।।”

প্রভু কয় “নাহি ভয় রাস্তা ঠিক র’বে।

আমি বলি রাস্তা কোথা নষ্ট নাহি হ’বে।।”

ডক্টর মীডের শিস্য অক্ষয় সুজন।

ওড়াকান্দি চিরস্থায়ী বাসিন্দা এখন।।

প্রভুর বাক্যেতে তার সুদৃঢ় প্রত্যয়।

তিনি কন “এই বাক্য লঙ্ঘন না হয়।।”

পরে সবে এক সঙ্গে করে আলাপন।

কত ব্যয় ধরা যায় রাস্তার কারণ।।

অনুমান শত টাকা নিরূপিত হ’ল।

সব টাকা দিতে প্রভু স্বীকার করিল।।

কার্য কালে দেখা গেল বহু টাকা লাগে।

কথা শুনি প্রভু তবে বলিলেন রেগে।।

“এক কদর্পক আর আমি নাহি দিব।

এত টাকা বল আমি কোথায় পাইব?”

ক্রোধ দেখি কেহ তাঁর কাছে নাহি যায়।

অক্ষয় বাবুর কাছে সকলে উদয়।।

সব কথা শুনি তবে অক্ষয় আসিল।

প্রভুর নিকটে বসি কহিতে লাগিল।।

“বড় কর্তা এক কথা বলি তব ঠাই।

রাস্তা বলে টাকা বটে কিছু নাহি চাই।।

কিন্তু এক কথা আমি করি বিবেচনা।

আপনার টাকা দিয়ে কাজ ত’ হল না।।

আধাআধি হ’লে কাজ তা’তে কিবা ফল?

এর চেয়ে ভালো ছিল দেশ ভরা জল।।”

অক্ষয়ের কথা শুনি প্রভুজী হাসিল।

সব টাকা দিবে বলি স্বীকার করিল।।

এইভাবে ওড়াকান্দি রাস্তার নির্মাণ।

দয়া করি করিলেন প্রভু গুরুচান।।

কতই সুযোগ এবে হয়েছে তথায়।

মুখে বলে সেই কথা শেষ নাহি হয়।।

এইভাবে ওড়াকান্দি রাস্তা হ’য়ে গেল।

ঘৃতকান্দি রাস্তা নিতে প্রভুজী ইচ্ছিল।।

ঘৃতকান্দিবাসী সবে প্রভু ডেকে কয়।

“রাস্তা দিতে ইচ্ছা কি গো কর মহাশয়?”

তারা বলে “মোরা সবে দেখি চিন্তা করে।

কোন ভাবে এই কাজ করা যেতে পারে?”

কিন্তু দেশে গিয়ে কিছু ঠিক নাহি হ’ল।

দিনে দিনে কতদিন শুধু চলে গেল।।

ভাব দেখে গুরুচাঁদ পতিত পাবন।

ডাক দিয়া বলে “শুন হে রাধা চরণ!

তব গৃহাবধি যদি এই রাস্তা যায়।

স্বর্গ-পথ তুল্য পথ তবে সৃষ্টি হয়।।”

এই রাধাচরণের শুন পরিচয়।

ঘৃতকান্দি বাস করে সেই মহাশয়।।

“মৃধা” বলি দিত সবে আদি পরিচয়।

উপাধি মজুমদার পরে সবে কয়।

তপস্বীরামের পুত্র সেই মহাশয়।

কুঞ্জবিহারীর বটে নোয়া খুড়া হয়।।

তার প্রতি ঠাকুরের কতই করুণা।

বহু বহু আছে জানি তাহার নিশানা।।

Page 548 start

ইহার কনিষ্ঠ পুত্র কুমুদরঞ্জন।

গোপালের অনুষঙ্গ সদা সেইজন।।

রাধাচরণের পিতা যবে মারা যায়।

তাহার কিঞ্চিৎ পূর্বে ডাক দিয়া কয়।।

ঠাকুরের নিকটেতে ছিল এক খত।

কর্জ নিয়াছিল বটে টাকা এক শত।।

তপস্বী ডাকিয়া বলে পুত্রের নিকটে।

“কিছুকাল পরে আমি মারা যাব বটে।।

বড় শান্তি হ’ত যদি দেখিতাম চোখে।

ঠাকুর দিয়াছে খত ফিরি’য়ে তোমাকে।।”

কথা শুনি দ্রুত চলে সে রাধাচরণ।

নয়নের জলে বন্দে প্রভুর চরণ।।

খুলিয়া সকল কথা প্রভুকে জানা’ল।

দয়া করে দয়াময় খত দিয়া দিল।।

শ্রাদ্ধের পরেতে টাকা মিটাইয়া দিল।

এতই প্রভুজী তারে বাসিতেন ভালো।।

পিতৃ শ্রাদ্ধে প্রভু তারে তিন টাকা দেয়।

আর এক কথা শোন বলি পরিচয়।।

রাধাচরণের মাতা আসন্ন সময়।

ঠাকুরের শ্রীপ্রসাদ খাইবারে চায়।।

সে রাধাচরণ ছুটে যায় ওড়াকান্দি।

ঠাকুরের কাছে সব বলিলেন কান্দি।।

ঠাকুর ডাকিয়া বলে জননীর ঠাই।

“এক বাটি মিষ্ট শীঘ্র এইখানে চাই।।”

মাতা মিষ্ট এনে দিলে প্রভু তারে কয়।

“শীঘ্র তুমি বাড়ী যাও মৃধা মহাশয়।।

অদ্য বাড়ী হ’তে কোথা দূরে নাহি যেয়ো।

তোমার মাতার শব ‘কাচায়ে’ (জমির আইল) পোড়া’য়ো।।”

এই রাধাচরণেরে প্রভু তাই কয়।

“রাস্তা হ’লে সেই রাস্তা স্বর্গ তুল্য হয়।।”

সে রাধাচরণ বলে করিয়া মিনতি।

“কেমনে এসব আমি বলিব সম্প্রতি।।

দেশ মধ্যে এক ব্যক্তি খুন হইয়াছে।

সে চিন্তায় সকলেই চিন্তাযুক্ত আছে।।

এই কথা বলিবারে তাই ভয় পাই।”

কথা শুনে ডেকে বলে জগত গোঁসাই।।

“এই কথা মুখে নাহি বল পুনরায়।!

যাহা বলি তাহা কর মৃধা মহাশয়।।

আমার গৃহেতে দেখ রয়েছে কোদালি।

তৈল মেখে তাই নিয়ে যাও তুমি চলি।।

তিন চাপ মাটি কেটে ফেলে রেখে এসো।

কোদাল লইয়া ফিরে হেথা এসে বস।।”

প্রভুর আজ্ঞায় তবে সে রাধাচরণ।

তিন চাপ মাটি কেটে করিল গমন।।

হেন কালে দেখ এক আশ্চর্য ঘটন।

দেশবাসী সকলের আছে বটে জানা।।

পূর্ণচন্দ্র, চারুচন্দ্র উপাধি বিশ্বাস।

উভয়ে কায়স্থ তারা ঘৃতকান্দি বাস।।

‘রাস্তা’ ‘রাস্তা’ করি দোঁহে কোলাহল করি।

উপনীত হইলেন ঠাকুরের বাড়ী।।

পূর্ণ বিশ্বাসের কাছে চাঁদা বেশী চায়।

সেই হেতু গোলমাল হইল সেথায়।।

সকল শুনিয়া প্রভু পূর্ণচন্দ্রে কয়।

“এক কথা বলি শোন বিশ্বাস মশায়?

ধন জন টাকা কড়ি চিরকাল নয়।

“কীর্ত্তীয্যস্য সঃ জীবতি” শাস্ত্রে এই কয়।।

এই দেশে এই রাস্তা যদি সৃষ্টি হয়।

কত উপকার পাবে লোক সমুদয়।।

তার লাগি অর্থ দিতে কেন বা কুণ্ঠিত।

এতে টাকা কভু নাহি হইবে লুণ্ঠিত।।

টাকা দিতে এত কষ্ট যদি মনে হয়।

রাস্তা কর আমি দিব টাকা সমুদয়।।”

Page 549 start

প্রভুর বচনে তারা লজ্জিত হইল।

সব টাকা দিবে পূর্ণ স্বীকার করিল।।

তখনি রাস্তার কাজ আরম্ভ হইল্ল।

দেখিতে দেখিতে রাস্তা ঘৃতকান্দি গেল।।

কোদালিরা বলে সবে মৃধাজীর ঠাই।

“শোন মৃধা মহাশয়! বৃষ্টি এবে চাই।

ঠাকুরের কাছে এই দরবার করি।

দেশ পুড়ে গেল বৃষ্টি দাও তাড়াতাড়ি।।”

ঠাকুরের কাছে যবে সেই কথা কয়।

ঠাকুর বলিল “রাস্তা এখন কোথায়?

তোমার বাড়ীর কাছে যদি গিয়া থাকে।

বলিনু অবশ্য বৃষ্টি নামিবে কালিকে”।।

পরদিন বর্ষা হ’য়ে দেশ ডুবে গেল।

মৃধাদের গৃহাবধি সেই রাস্তা হ’ল।।

সমস্ত রাস্তার ব্যয় পাঁচ শত টাকা।

শ্রীপূর্ণচন্র বিশ্বাস দিয়া দিল একা।।

শ্রীগুরুচাঁদের কথা সর্ব দুঃখহারী।

অন্ধ সেজে মহানন্দ গেল ডুবে মরি।।

----------

* জমির আইল