Page 551

মহাপ্রস্থানের আভাষ


“মন! চল যাই নিজ নিকেতনে।সংসার বিদেশে, বিদেশীর বেশে,মিছে ভ্রম অকারণে।”(স্বামী বিবেকান্নদ কর্তৃক)

ঠেকিয়া জীবের দায়, নরাকারে দেখা দেয়,

নরভাবে করে নর লীলা।

নর সম সুখী দুঃখী, করুণ কোমল আঁখি,

নর নিয়ে চলে তাঁর খেলা।।

আপনার মত তারে, নরে দেখে নরাকারে,

তাই তারে বুঝিতে না পারে।

বোঝার ভুলের তলে, তাই প্রভু যায় চলে,

ধরে রাখা যায় নাহি তারে।।

ভক্তরূপে আছে যারা, আপন হারানো তারা,

তাঁর ইচ্ছা মানে সর্বসার।

যে ইচ্ছা করেন প্রভু, তাহাতে তাহারা কভু,

বাধা দিতে নহে অগ্রসর।।

যদি কোন ভক্ত জন, মনে মনে করে মন,

থাকিতে বলিবে তারে জোরে।

চতুরের শিরোমণি, কোন ভাবে কেন জানি,

ভুল দিয়ে রাখে তারে দূরে।।

যবে প্রভু চলে যায়, আভাষে সকলে কয়,

ভুলে ঢাকা নরে নাহি বুঝে।

তাই যবে চলে যায়, নরে করে হায়! হায়!

বন্ধু-হারা অভাগার সাজে।।

প্রমথ রঞ্জন ফিরে, আসিলেন যবে ঘরে,

মনে ইচ্ছা করে দয়াময়।

এই লীলা করি শেষ, যাব চলে নিজ দেশ,

বেশী আর রব না হেথায়।।

Page 552 start

দয়াময়ী সত্যভামা, গুণে যার নাহি সীমা,

পূর্বভাগে মাগিল বিদায়।

শিব হ’ল সতী-হারা, কিসে আর দেহ ধরা,

নিজ লোকে প্রভু যেতে চায়।।

ছলা কলা কত খেলা, করে প্রভু সারা বেলা,

চির সঙ্গী যারা কাছে রয়।

একদিন চারিজনে, ডাকিয়া আপন স্থানে,

বারে বারে তাহাদের কয়।।

“ওরে নব! ওরে নীলে! দীনে আর ও নেপালে!

অঙ্গীকার কর মোর কাছে।

জীবনে বিবাহ নাই, র’বি তোরা ভাই ভাই,

বিয়া আর না করিবি পাছে।।”

কান্দিয়া কান্দিয়া সারা, প্রতিজ্ঞা করিল তারা,

প্রভু বলে “তোরাই আমার।

তোরা কি রাখিবি মোরে? এই বিশ্ব চরাচরে,

কা’র আর নাহি ধারী ধার।।”

শ্রীনব কুমার যিনি, নিষ্ঠাগুণে শ্রেষ্ঠ জানি,

তারে প্রভু ভালোবাসে বেশী।

গরুচাঁদে সমর্পণ, করিয়াছে দেহ মন,

বুকে প্রভু কথা কয় আসি।।

তাহার অন্তর তলে, এক নব ভাব খেলে,

সঙ্গীগণে করিল প্রকাশ।

“শুন সবে বলি ভাই, মনে যাহা সাড়া পাই,

মোর কথা কর হে বিশ্বাস।।

অল্প কিছু কাল পরে, আর এই ধরা পরে,

বাবা নাহি দেহেতে রহিবে।

যার মনে যাহা আছে, বল সব তার কাছে,

পরিণামে সময় না পাবে।।”

সন্দেহেতে মন ভরা, প্রথমে বিশ্বাস তারা,

করিতে চাহে না কোন মতে।

কিছু দিন পরে তার, বোঝে তারা পরস্পর,

বাক্য সত্য পারে বটে হতে।।

সকলে নবকে বলে, “চল ঠাকুরের স্থলে,

কোন বাক্য চেয়ে রাখি মোরা।”

নব বলে “একি দায়! নিতে যদি কিছু হয়,

তার কাছে চেয়ে নে গো তোরা।।”

নবকে নিরালে ডাকি, গুরুচাঁদ কমলাখি,

বলে “নব! বলি যে তোমায়।

বিদায় দিয়াছে মোরে, সকলেই এ সংসারে,

তুমি মোরে দিও না বিদায়।।”

শুনিয়া প্রভুর কথা, হেঁট করে রহে মাথা,

মনে মনে ভাবে মহাজন।

“কিছু যদি চেয়ে লই, তারে রাখা হ’ল কই,

তারে ছেড়ে দিব কি কারণ।।”

প্রধান ভকতগণে, নব বলে জনে জনে,

“প্রভু যেন বেশী দিন নাই।”

সেই কথা শুনি কানে, এক সাথে চারি জনে,

গোপাল যাদব আর বিপিন গোঁসাই।।

নকুল গোস্বামী যিনি, একসঙ্গে যান তিনি,

গিয়া বসে ঠাকুরের কাছে।

অন্তর্যামী ভগবান, মহাপ্রভু গুরুচান,

বলে হেথা কে কে বসে আছে।।

সেই কালে চারিজন, বলে বাবা অভাজন,

যাদব, গোপাল, আর বিপিন, নকুল।

আপনি কাণ্ডারি বিনে, মতো’ তরী দিনে দিনে,

অকুলেতে কোথা পাবে কুল।।

প্রভু কয় “নাহি ভয়, শোন চারি মহাশয়,

এ তরীতে দিয়েছ কাণ্ডারি।

বিলাতে পড়ায়ে যারে, ফিরায়ে এনেছি ঘরে,

সে চালাবে এই ম’তো তরী।।

আমার হাতেতে হাত, তোমাদের চারি হাত,

দেও ধরা আমার এ হাতে।”

প্রভুর আদেশ শুনে, ততক্ষণে চারিজনে,

দিল হাত কান্দিতে কান্দিতে।।

Page 553 start

চারি হাত ধরে হাতে, মন্মথের হস্ত সাথে,

মিশায়ে বলিল দয়াময়।

“প্রমথ বাড়ীতে নাই, মন্মথ তাহারি ভাই,

তার হাতে হাত দিলে হয়।।

প্রতিজ্ঞা করিয়া মোরে, বল সব চিরতরে,

ইহাদের করিবে পালন?

আমার বলিতে আর, কেহ নাহি ধরা’পর,

আছে এরা ভাই দুইজন।।”

সকলে কান্দিয়া কয়, “যাহা বল দয়াময়,

অবশ্য পালিব সবে মোরা।

কিন্তু বাবা একি কথা, তুমিই ছেড়ে যাবে কোথা,

এ কথা যে বড় ব্যাথা ভরা।।”

প্রভু কয় “শুন সবে, চিরদিন কেহ ভবে,

জীব দেহে বাঁচিয়া না রহে।

জন্মিলে মরণ আছে, কেবা চিরকাল বাঁচে,

নশ্বর জীবন তাই কহে।।

আমি যাই যাব চলে, ভাব নাকি তাই বলে,

ঠাকুর না র’বে ধরা ‘পরে?

মোরে সবে দেও ছেড়ে, প্রমথ রহিল ‘পরে,

সে দেখিবে সব তোমাদেরে।।”

কিছু কথা শোন এবে, শ্রীপ্রমথ কোন ভাবে,

চলিছেন আপন জীবনে।

যখনে বাড়ীতে রয়, বসে থাকে সর্বদায়,

প্রভুর নিকটে এক মনে।।

প্রভু যত কথা কয়, বসে বসে শোনে তায়,

সুদৃঢ় বিশ্বাস বুকে রাখে।

মুখ হতে নিষ্ঠীবন, প্রভু করে বরিষণ,

গায়ে গেলে ভক্তি ভরে মাখে।।

করিলেন ব্যারিস্টারি, পূর্ণ দুই বর্ষ ধরি,

ভাল কিন্তু নাহি লাগে মনে।

প্রভু তারে একদিনে, আপনার কাছে এনে,

বলে কথা অতীব যতনে।।

“শুন হে প্রমথ ভাই, মনে যাহা বলি তাই,

পাশ করে হ’লে ব্যারিস্টার।

তার মধ্যে যাহা তত্ত্ব, “মিথ্যাকে বানানো সত্য,

সত্য মিথ্যা সব একাকার।।”

এটুকু শিখিতে ভাই, বিলাতে পাঠাই নাই,

মহান উদ্দেশ্যে আছে পাছে।

বড় যত হও তুমি, আর বড় হই আমি,

আনন্দে পরাণ মোর নাচে।।

তুমি বড় হলে পরে, সবে সেই সূত্র ধ’রে,

আমার বাবার নাম ক’বে।

আমার বাবার ধর্ম, আমাদের যত কর্ম,

দেশে দেশে প্রচারিত হবে।।

এই ইচ্ছা বুকে রেখে, বিলাতে পাঠাই তো’কে,

অর্থ দিবে সে নহে কামনা।

আমার বাবার নাম, ভরে থাক বিশ্বধাম,

এই মাত্র মনের বাসনা।।”

শুনিয়া প্রভুর বাণী, প্রমথরঞ্জন গুণী,

ব্যারিস্টারি করিলেন ত্যাগ।

কার্য কিংবা আচরণে, ত্যাগী হ’ল সর্বক্ষণে,

মনে রাখে দৃঢ় অনুরাগ।।

কহে ভকতের ঠাই, “মোর অন্য বাঞ্ছা নাই,

যাহা বলে সে ঠাকুর দাদা।

প্রাণ দিয়ে তা’ করিব, অন্য দিকে না চাহিব,

না মানিব তা’তে কোন বাধা।।”

একদা নিশীথ কালে, সবে আছে নিদ্রাতলে,

জেগে মাত্র সে নব কুমার।

প্রভুর চরণ সেবা, করে তেহ রাত্রি দিবা,

শ্রান্তি ক্লান্তি কিছু নাহি তার।।

হেনকালে দয়াময়, নব কে ডাকিয়া কয়,

“আর কেহ আছে কি এখানে?”

করজোড়ে নব কয়, “অন্য কেহ নাহি রয়,

দাস আমি রয়েছি চরণে?”

Page 554 start

হাসিয়া প্রভুজী কয়, “হেথা আর কেহ নয়,

মাত্র তুমি আর মাত্র আমি।

পিতা-পুত্রে আলাপন, এস করি কিছুক্ষণ,

যা’ বলিব সাক্ষী মাত্র তুমি।।

এই যে প্রমথ আছে, কিবা কয় কার কাছে,

তুমি তার কিছু জান নাকি?

যত জনে কথা কয়, মোর মনে এই হয়,

প্রায় সবে দেয় মোরে ফাঁকি।।”

কান্দিয়া কহিছে নব, “বাবা আমি কিবা ক’ব,

বড় বাবু অতি ভক্তিমান।

তিনি কহে সর্বদায়, পিতামহ যাহা কয়,

তার লাগি দিব আমি প্রাণ।।”

প্রভু বলে “যদি তাই, তবে শোন বলে যাই,

যা বলিবে প্রমথ রঞ্জন।

সব তা’তে আছি আমি, এই কথা জান তুমি,

এই বাক্য না হবে লঙ্ঘন।।”

ক্রমে ক্রমে দিন যায়, দিনে দিনে দয়াময়,

দেহ যেন রাখিতে না চাহে।

কলিকাতা হ’তে তায়, শ্রীপ্রমথ চিঠি পায়,

ঠাকুরের কাছে গিয়া কহে।।

ঠাকুর ডাকিয়া কয়, “দাদা! নাহি কোন ভয়,

শীঘ্রগতি যাও কলিকাতা।

আইন সভায় যাও, আমি বলি “রাজা হও,

দূর কর এ জাতির ব্যথা।।”

প্রমথ কান্দিয়া কয়, “কতদিনে যেন হয়,

আইন সভার কাজে দেরী।

এই অবসর পেয়ে, যদি তুমি ফাঁকি দিয়ে,

চলে যাও অকূল কাণ্ডারি।।”

বিষাদের হাসি হেসে, প্র ভু বলিলেন শেষে,

“যাও দাদা, দিতেছি এ কথা।

তুমি না আসিলে ফিরে, কভু এই বাড়ী ছেড়ে,

আমি নাহি যাব আর কোথা।।

তোমারে না বলে কথা, আমি নাহি যাব কোথা,

এই বাক্য করিও বিশ্বাস।”

প্রভুর এ কথা পেয়ে, প্রমথ চলিল ধেয়ে,

প্রভু ছাড়ে সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস।।

ভক্তগণে রহে ঘিরি, প্র ভু ভাবে কিবা করি,

অবিলম্বে পাতে মায়া জাল।

প্রভু কিছু হ’ল সুস্থ, বলে “নাহি হও ব্যস্ত,

দেশে যাও বিপিন গোপাল।।”

প্রভু মায়া সূত্র ধরে, কে তাহা কাটিতে পারে,

ভক্ত সবে হইল বিদায়।

কবি কহে “শুন ভাই, ইহা ছাড়া পথ নাই,

এই ভাবে প্রভু ফাঁকি দেয়।।”

---০---