Page 100

শিক্ষা বিস্তারকল্পে শ্রী শ্রী গুরুচাঁদ


“নহি জ্ঞানেন সদৃশ পবিত্রমিহ বিদ্যতে “---গীতা

অনুন্নত - জাতি যত এ বঙ্গ মাঝারে।

শিক্ষাশূন্য ছিল সবে ঘোর অন্ধকারে।।

অশিক্ষার অন্ধকারে সবে মহা দুঃখী।

মূঢ় জেনে দুষ্টগণে দেয় সবে ফাঁকি।।

জমিদার মহাজন সবে উত্তমর্ণ।

কু - হিসেবে কষ্ট পায় যত অধমর্ণ।।

কর দিতে জমিদার গৃহে কেহ যায়।

সাতে পাঁচে কুড়ি বলি ত্রিশ টাকা লয়।।

কেনা - খতে টিপসহি বৃদ্ধাঙ্গুলী দিয়া।

ঋণ শোধ করে শেষে সম্পত্তি বেচিয়া।।

অজানা এ অত্যাচার বুঝিতে না পারে।

জানা - শোনা এ অত্যাচার করে ঘরে ঘরে।।

কর দিতে দেরী হলে আর রক্ষা নাই।

প্যাদা গিয়ে বাড়ি পরে করে 'তাগাদাই '।।

“ওরে দুষ্ট এত কষ্ট তোর তরে সই।

এত হাটাহাটি করি খাজনাটা কই ?”

সর্ব্ব - হারা জান্তে - মরা প্রজা কেন্দে কয়।

“দয়া করে শোন কথা “প্যাদা মহাশয়।।

ধান পাট কিছু কিছু পাইয়াছি বটে।

বেচা কেনা করি নাই গিয়া কোন হাটে।।

আগ হাটে বেচাকিনি সে সব করিব।

সুদাসল সব টাকা শোধ ক'রে দিব।।

কত দুঃখে দেখ তুমি কাল যে কাটাই।

ঘরে চা 'ল চালে খর কিছু মাত্র নাই।।

রোগ ভোগ আছে কত কেবা তাহা দেখে।

অযন্তে মরেছে খোকা ভাঙ্গা ঘরে থেকে।।

দয়া করে এই ধর তোমার নজর।

সিকি খানা ছিল ঘরে শেষ কড়ি মোর।।

হাকিয়া ডাকিয়া তবে বলিছে পেয়াদা।

'সিকি নিয়ে সাধা সাধি আমি কিরে গাধা ?

দুই টাকা নজরানা পার যদি দিতে।

আজিকার মতে তবে পারিব ছাড়িতে।।'

অর্থ - হীন অন্ন -হীন বস্ত্র - হীন দীন।

দুঃখ ভারে অসময়ে সেজেছে প্রাচীন।।

'ক্ষমা করো' ' ক্ষমা করো' বলি পদ ধরে।

ঘাড় ধরে প্যাদা তারে নেয় জোর করে।।

Page 101 start

পথ মধ্যে গুতা দিতে করেনা কসুর।

দেশোয়ালী প্যাদা যেন দেখিতে অসুর।।

নায়েবের কাছে এনে উপস্থিত করে।

অযুক্তি কটূক্তি কত করে তারপরে।।

ক্ষীণ - কন্ঠে প্রজা যদি কোন কথা বলে।

পেয়াদা -গর্জনে তাহা যায় রসাতলে।।

নায়েব মশায় সাজে “ক্ষুদে জমিদার “।

“বলে চৌদ্দ পোয়া কর পা দুটো উহার”।।

দেখিয়া কৌতুক করে প্রজা দুঃখে কান্দে।

পৃষ্ঠ - মোড়া দিয়ে তার দুই হস্তে বান্ধে।।

চাবুক লাগায় পিঠে আর মলে কান।

কেন্দে কেন্দে প্রজা ডাকে কোথা ভগবান!

কত জনমের পাপী আমি নীচ ঘরে।

পশু হতে হীন জীব মোরে গণ্য করে।।

বান্ধব নাহি 'ক কেহ অবনী মাঝারে।

গরীবের মনোদুঃখ বুঝিবার তরে”।।

নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।

তাই দেখি হাসি বলে নায়েব মশায়।।

“মনে মনে অভিশাপ করিতেছে বেটা।

ওরে প্যাদা আচ্ছা করে কর জুতাপেটা”।।

অসহায় মৃগ 'পরে যথা সিংহ পড়ে।

প্যাদা হতজ্ঞান করে প্রজা এক চড়ে।।

হতজ্ঞান দেখি প্রজা নায়েবের ভয়।

জলে তেলে সুস্থ করি তাহারে বসায়।।

বলে 'ওরে শঠ্ বেটা টাকা দিবি কবে ?

সাত দিনে নাহি দিলে টের পাবি তবে'।।

আজি কালি ও কাহিনী স্বপ্ন মনে হয়।

বর্ণে বর্ণে সত্য সব ছিল সে সময়।।

অশিক্ষা যাহারে রাখে ঢাকিয়া আঁধারে।

হিতাহিত জ্ঞান বল পাবে কি প্রকারে ?

জ্ঞানাঞ্জন বিদ্যা তাই আলোকেতে ভরা।

অজ্ঞান - বিনাশী তাহা সর্ব্ব দুঃখ -হরা।।

তাই বলিয়াছি বঙ্গে অনুন্নত যত।

অবিদ্যার অন্ধকারে ছিল জ্ঞানাহত।।

দুঃখ - যন্ত্রনায় সবে কাঁদে উভরায়।

'ত্রাণ কর, দুঃখ হর ' কোথা দয়াময়!

কাঙ্গালের সে কান্নায় দয়াময় হরি।

অবতীর্ণ বঙ্গ দেশে সফলা নগরী।।

যশোবন্ত ঘরে জন্মে হরিদাস নাম।

রত্ন পেয়ে দীনগণ পূর্ণ - মনোস্কাম।।

শ্রী হরি ঠাকুর বলি হ'ল পরিচয়।

চন্দ্র তুল্য কান্তি হেরি “হরিচাঁদ “কয়।।

কাঙ্গালে তারিতে প্রভু নর দেহ - ধারী।

অপরূপ রূপে তাঁর ভোলে নর নারী।।

এই হরিচাঁদ দেখ করূণা করিয়া।

দীন জনে উদ্ধারিল প্রেম ভক্তি দিয়া।।

“হরিলীলামৃত “নামে মহা গ্রন্থ খানি।

শ্রী তারক চন্দ্র লেখে অপূর্ব্ব কাহিনী।।

অভূত অপূর্ব্ব লীলা হরিচাঁদ করে।

তাঁর লীলা কেবা কত বলিবারে পারে ?

স্থুল কথা গ্রান্থাকারে প্রেমের ভাষায়।

সে তারক সুপরাগ গ্রন্থ লিখে যায়।।

প্রমাণ রয়েছে তা'তে প্রাঞ্জল ভাষায়।

যবে হরিচাঁদ নরদেহ ছেড়ে যায়।।

উত্তর সাধক হ'ল শ্রী গুরুচরণ।

তাঁর কাছে বলে যত ছিল আকিঞ্চন।।

অনুন্নত জাতি মাঝে শিক্ষা প্রচারিতে।

আজ্ঞা করে হরিচাঁদ তারে বিধিমতে।।

পিতার আজ্ঞাতে প্রভু পালে ব্রহ্মচর্য।

নিরলস নিদ্রাহীন এমনি আশ্চর্য।।

দৃঢ় ভিত্তি পরে নিজ জীবন গড়িল।

মহা উদ্ধারণ - শক্তি প্রাণেতে জাগিল।।

গৃহীজনে দিতে মুক্তি দীনের করুণা।

আজীবন গুরুচাঁদ করিল সাধনা।।

Page 102 start

অর্থ হয় মহাশক্তি গৃহী পক্ষে মূল।

অর্থকে অনর্থ বলা কত বড় ভুল।।

যথা - অর্থ তথা - লক্ষ্মী তথা নারায়ণ।

আপন জীবনে করে এই আচরণ।।

অর্থ হীন গৃহীজনে শিখায় কৌশল।

ঋণ দায়ে ডোবে যেই তারে দেয় বল।।

এ আদর্শ শিক্ষা দিয়ে গুরুচাঁদ কয়।

“বিদ্যাশূন্য গৃহে কিন্তু অর্থ বৃথা যায়।।

পুরাণ - প্রবাদ বাক্য শুনিয়াছ তাই।

লক্ষ্মী সরস্বতী দোহে থাকে ভিন্ন ঠাঁই।।

আমি বলি ইহা ভুল সত্য ইথে নাই।

শ্রী বিষ্ণুর দুই পত্নী শাস্ত্র গ্রন্থে পাই।।

বিদ্যা - দেবী সরস্বতী ধন - দেবী লক্ষ্মী।

দোহে বিষ্ণুর সেবা করে শাস্ত্রে দেয় সাক্ষী।।

দোহে সতী প্রাণপতি বিনা নাহি জানে।

সতী নারী বিসম্বাদ করে কা'র সনে ?

ধনরূপে লক্ষ্মী দেবী ঐশ্বর্য দেখায়।

জ্ঞান রূপে সরস্বতী উজ্জ্বল করয়।।

দোহে এক স্বামী ভজে হয়ে এক মন।

বাদ বিসম্বাদ তারা করে না কখন।।

এই দুই শক্তি যদি নমঃশূদ্রে পায়।

জগত চিনিবে তারা কহিনু নিশ্চয়।।

আদর্শ দেখা'তে প্রভু নিজে কর্ম্ম করে।

পাঠশালে দেয় পুত্র বিদ্যা শিক্ষা তরে।।

প্রভুর প্রথম পুত্র শ্রী শশি ভূষণ।

দ্বিতীয় পুত্রের নাম সুধন্য সুজন।।

তৃতীয় উপেন্দ্র নাথ কামজিনি কান্তি।

চতুর্থ সুরেন্দ্র নাথ দরশনে শান্তি।।

পাঠশালে না থাকিলে কোথা শিক্ষা পাবে।

পাঠশালা করে প্রভু ইহা মনে ভেবে।।

নিজগৃহ পরে প্রভু করে পাঠশালা।

দেশবাসী ছাত্র আসি করিল জটলা।।

ইহা পূর্বে ঘৃতকান্দী গ্রামে স্কুল ছিল।

যতেক কায়স্ত জুটি সে স্কুল গড়িল।।

গঙ্গারাম সরকার নামেতে পণ্ডিত।

স্বজাতি কায়স্ত গণে করে যত হিত।।

প্রবল আগ্রহে তবে প্রভু সেই খানে।

শ্রী শশিভূষণে দিল শিক্ষার কারণে।।

জ্ঞান ঋষি তত্ত্বমসি যাঁহার লক্ষণ।

সেই ' পরামর্ষি ' হয় শ্রী শশিভূষণ।।

বিস্তৃত জীবন তাঁর করেছি লিখন।

এই গ্রন্থে শেষ ভাগে হ'বে সংযোজন।।

এই ভাবে শশি পড়ে ঘৃত কান্দী গাঁয়।

স্বদেশে করিতে স্কুল মনে ভাব হয়।।

দেশবাসী সবে ডাকি প্রভু বলে বাণী।

“আমার বচন শুন জ্ঞানী,গুণী, ধনী।।

শিক্ষা যদি নাহি পায় মোদের সন্তান।

শিক্ষা ছাড়া এ জাতির না হবে কল্যাণ।।

অতএব পাঠশালা করিবারে চাই।

অনুমতি করি দেহ বান্ধব সবাই “।।

প্রভুর বচন শুনি সবার আনন্দ।

সবে বলে “ধন্য তুমি প্রভু গুরুচন্দ্র।।

পতিত - তারক ছিল প্রভু হরিশ্চন্দ্র।

উপযুক্ত পুত্র তাঁর তুমি গুরুচন্দ্র।।

বিদ্যাহীন এ সমাজ পিছে আছে পড়ি।

তরাও তাহারে তুমি অকুল কাণ্ডারী “।।

সবে মিলে বসি শেষে হ'ল পরামিশে।

পাঠশালা হবে গুরুচাঁদের আবাসে।।

শুভ দিনে পাঠশালা স্থাপিত হইল।

দলে দলে ছাত্র আসি তথায় জুটিল।।

কিছুদিন পরে সবে সেই পাঠশালা।

চৌধুরী গৃহেতে রাখে বাঁধি একচালা।।

সুবিজ্ঞ পণ্ডিত নইলে শিক্ষা বৃথা হয়।

সুশিক্ষা দিবার তরে সু শিক্ষক চায়।।

Page 103 start

স্বজাতির মধ্যেতে নাহি মিলে হেন জন।

শিক্ষকের চিন্তা করি দুঃখেতে মগন।।

অন্য জাতী শিক্ষা দেয় শুধু অর্থ জন্য।

নমঃশূদ্র গণে করে মূর্খ - মধ্যে গণ্য।।

নিরুপায় হয়ে তায় সবে ক্ষুন্নমন।

পাঠশালে দৃষ্টি নাহি করে কোনজন।।

দিনে দিনে পাঠশালা সবে দিল ছাড়ি।

সবে মিলি উপনীত ঠাকুরের বাড়ী।।

বিনয় বচনে সবে করে নিবেদন।

“বড়কর্ত্তা শুন বার্ত্তা যা 'বলি এখন।।

শূণ্য গৃহ ভাল বলি দুষ্ট গরু - ছাড়া।

স্বজাতি বিহনে শিক্ষা চাহিনা আমরা।।

স্বজাতি শিক্ষক যদি মিলে কোন দিনে।

তাঁর হাতে শিক্ষা দিব আপন সন্তানে।।

বিহিত বিধান তার চাহি তব ঠাঁই।

স্বজাতি শিক্ষক মোরা সবে মিলি চাই”।।

বার্ত্তা শুনি গুরুচাঁদ মৌন হয়ে রয়।

কিছুকাল পরে প্রভু হাসি হাসি কয়।।

“শুনসবে দেশবাসী আমার বচন।

শিক্ষকের লাগি চিন্তা না কর এখন।।

এবে ভাদ্র মাস দেখ বরষার কাল।

দুই মাস গতে বাঞ্ছা হইবে সফল।।

দুই মাস পরে পাবে স্বজাতি পণ্ডিত।

তেঁহ হতে নমঃশূদ্রে পাবে বহু হিত”।।

কথা শুনি মহানন্দে সবে গৃহে যায়।

এদিকেতে হ'ল ক্রমে অঘ্রাণ উদয়।।

ইচ্ছাময় প্রভু মোর যাহা ইচ্ছা করে।

ইচ্ছামাত্র পূর্ণ হয় মুহূর্ত্ত ভিতরে।।

পরম পণ্ডিত রঘুনাথ সরকার।

দৈবক্রমে উপনীত ওড়াকান্দী ' পর।।

নমঃশূদ্র কুলে জন্ম অতি মহাশয়।

স্বজাতি উন্নতি লাগি ঘুরিয়া বেড়ায়।।

ওড়াকান্দী গুরুচাঁদ নমঃশূদ্র - পতি।

ফরিদপুরেতে আসি জানিলা সম্প্রতি।।

যার কাছে প্রশ্ন করে সেই বলে হেসে।

“কুলপতি গুরুচাঁদ “আছে এই দেশে।।

বহু মান বহু ব্যাখ্যা শুনিলেন তিনি।

দেখিবারে গুরুচাঁদে চায় গুণমণি।।

মনে ভাবি কতকাল ভ্রমি কত দেশে।

মনের বাসনা পূর্ণ হল হেথা এসে।।

ঠাকুরের গুণগাঁথা শুনে সর্ব্ব ঠাঁই।

মনে ভাবি আরোপূর্ব্বে কেন আসি নাই।।

ভাবিতে ভাবিতে চলে সেই মহাশয়।

কোন পথে ওড়াকান্দী জানা নাহি রয়।।

হেন কালে পথিমাঝে করে দরশন।

দীর্ঘ -শ্মশ্রু দীর্ঘ -কেশ এক মহাজন।।

দিব্য - কান্তি মনোহর সুহাস বদন।

ধীরপদে করিতেছে গজেন্দ্র গমন।।

মূরতি দেখিলে শির পদে নত হয়।

উজলিত দশ দিশি রূপের প্রভায়।।

দেবতুল্য মূর্ত্তি দেখি সেই রঘুনাথ।

শির নত করি পদে করে দণ্ডবৎ।।

সেই মহাজন তবে বলিল হাসিয়া।

“প্রণাম করিলে বাপ। কিসের লাগিয়া?

আভূমি প্রণাম করে” মতুয়া “সুজন।

তোমা মধ্যে দেখি না ত সে সব লক্ষণ।।

মহাজন - বাক্য শুনি বলে রঘুনাথ।

“এই প্রণামের মধ্যে নাহি মোর হাত।।

তব মূর্ত্তি দেখি প্রভু মন ভুলে গেল।

প্রণাম করিনা আমি কে যেন করা'ল।।

এক নিবেদন প্রভু করি তব পায়।

মতুয়া বলিলে যাঁরে সে জন কোথায় “।।

সে মহাপুরুষ তবে বলে হাসি হাসি।

দশন মুকুরে যেন চন্দ্র পড়ে খসি।।

Page 104 start

'শুনহে পথিক! তুমি বলো পরিচয়।

যেই জন হরি ভক্ত তারে মতো ' কয়।।

ওড়াকান্দী পুণ্যধামে হরি অবতার।

তাঁর যত ভক্ত আছে পৃথিবী ভিতর।।

'মতুয়া 'বলিয়া তাঁরা খ্যাতি পাইয়াছে।

আভূমি প্রণাম তাঁরা সবে শিখা 'য়েছে।।

যাহা হ'ক এবে দাও তব পরিচয়।

কোথা ঘর কেন তুমি এসেছ হেথায় ?

সবিনয় রঘুনাথ বলে তাঁর ঠাঁই।

“শিক্ষকতা “কার্য লাগি ঘুরিয়া বেড়াই।।

নমঃশূদ্র কুলে জন্ম আমি লভিয়াছি।

বহু কষ্টে কিছু বিদ্যা শিক্ষা করিয়াছি।।

স্বজাতির ঘরে মোর বিদ্যা নাহি চিনে।

স্বজাতি বিদ্বান করি ভাবি মনে মনে।।

যেই যেই দেশে যাই স্বজাতি ভিতর।

বিদ্যা অবহেলা করে বোঝে না আদর।।

সবে মনে ভাবে “বিদ্যা আমাদের ঘরে।

আসিতে পারেনা কভু কোনদিন তরে।।

ব্রাহ্মণাদি উচ্চ বর্ণ যত এই দেশে।

তাঁরা বিদ্যা শিক্ষা করে বিশেষ বিশেষে।।

বিধাতা করেছে সবে কৃষি - ব্যবসাই।

বিদ্যা শিক্ষা এই ভাগ্যে লেখা জোকা নাই।।

মনোদুঃখে বহু দেশে আমি ভ্রমিয়াছি।

মনোমত কথা প্রভু কথা কভু না শুনেছি।।

শান্তি নাই কোথা যাই মনোদুঃখে কান্দি।

হেনকালে শুনিলাম নাম ওড়াকান্দী।।

পতিতে তারিতে নাকি হ'ল অবতার।

ভাবিলাম গেলে সেথা যাবে মনোভার।।

হেথা আসি শুনিলাম হরিচাঁদ নাই।

তস্য পুত্র গুরুচাঁদ হয়েছে গোঁসাই “।।

জনে জনে জিজ্ঞাসিয়ে বুঝিলাম সার।

পিতার সুযোগ্য পুত্র শ্রী হরি কুমার।।

তাঁর কাছে মনোব্যথা জানাবার তরে।

ওড়াকান্দী মনে ভাবি চলিয়াছি ধীরে।।

কোন্ পথে যেতে হবে কিছু নাহি জানি।

ভাবিয়াছি পথে মোরে নেবে সেথা টানি।।

আপনাকে দেখে পথে করেছি ধারণা।

পথ বলি দেবে তুমি করিয়া করুণা “।।

পুনঃ জিজ্ঞাসিল তাঁরে করিয়া মিনতি।

“কিবা নাম কোথা ধাম কোথায় বসতি ? “

সেই মহাজন তবে হাসি হাসি কয়।

“বাসুদেব “ নাম মোর শুন পরিচয়।।

শান্তিপুর ঘর মোর প্রেমবাড়ী থানা।

সব থেকে কিছু নাই এমনি ঘটনা।।

ঘর -ভরা আছে মোর সন্তান সন্ততি।

মোর বাক্য মানিবারে নাহি কা'র মতি।।

মনোদুঃখে ঘর ছাড়ি আসিয়াছি পথে।

দীন দুঃখী পেলে যাই তার সাথে সাথে।।

দীনে ভালবাসি দিয়ে সারা প্রাণ টুক্।

ধনী ছেড়ে দীনে নিয়ে তাই মোর সুখ।।

ওড়াকান্দী গাঁয়ে দুই বৈষ্ণব - বৈষ্ণবী।

পরম পবিত্র দোঁহে করুণায় ছবি।।

নমঃশূদ্র কুলে জন্ম আচারে বৈষ্ণব।

কৃষ্ণ ধ্যান কৃষ্ণ জ্ঞান দোঁহার স্বভাব।।

অন্তরে কাঙ্গাল দোঁহে বাহিরে ঐশ্বর্য।

অহরহ পান করে প্রেমের মাধুর্য।।

মম গুরুদেব যিনি পরম উদার।

তাঁর সাথে সেই গৃহে যাই একবার।।

পতি সনে সাধ্বী দেয় উত্তম আহার।

ভক্তি দেখি মনে পাই আনন্দ অপার।।

অমৃত - অধিক লাগে অন্নাদি ব্যঞ্জন।

মনোসাধে প্রাণভরে করিনু ভোজন।।

আমার আনন্দ দেখি গুরুজীর সুখ।

বলে “বাসো! এতদিনে জুড়ালি রে বুক।।

Page 105 start

সাথে সাথে নিয়ে তোরে ঘুরি যেথা সেথা।

এই খানে খে'লি অন্ন করিয়া মমতা।।

মোর সাথে থাকি বাছা কত কষ্ট পাও।

দিন কত ' এই গৃহে পুত্র হয়ে রও।।

অন্নপূর্ণা মাতা তোরে বাসিয়াছে ভাল।

পতি যশোবন্ত দেখ প্রেমের কাঙ্গাল “।।

গুরুজীর কথা শুনি সেই সতী কান্দে।

ইচ্ছা করে, বাধিলাম তার প্রেম ফাঁদে।।

পুত্র সাজি সেই ঘরে খেলিলাম কত!

সম্বন্ধ করিল সাথে অন্তরঙ্গ যত।।

হরিচাঁদ নাম যাঁর শুনিয়াছ কানে।

অভেদাত্মা মোরা দোঁহে ছিনু সর্ব্বক্ষণে।।

যেই “বাসো “সেই হরি কহিত সকলে।

নাচিতাম অন্নপূর্ণা জননীর কোলে।।

হরিপুত্র “গুরুচাঁদ “জানে সর্ব্বজনে।

নিজ -পিতা সম তেঁহ সদা মোরে মানে।।

সেই হরিচাঁদ যবে লীলা করে শেষ।

তেঁহ সঙ্গে আমি তবে ছেড়েছি সে দেশ।।

তবে এক মায়া মোর আজো কাটে নাই।

বড় ভালবাসে মোরে গুরুচাঁদ সাঁই।।

মনে হয় তাঁর মধ্যে আমি সদা আছি।

মম - আত্মা হরিচাঁদ তাঁহাতে পেয়েছি।।

প্রত্যক্ষ সাক্ষাতে মোর নাহি লয় মন।

অদেখার মাঝে তাঁরে দেখি সর্ব্বক্ষণ “।।

মুরজ মুরলী যথা কান্দে নিরালায়।

সে মহাজনের বাণী তথা শোনা যায়।।

বিস্মৃতির প্রায় শুনে সেই রঘুনাথ।

অগোচরে তাঁর কত হয় অশ্রুপাত।।

মহাজন প্রতি চাহি কহিছে কাতরে।

“কোন পথে ওড়াকান্দী বল দয়া করে।।

আপনার কথা শুনে প্রাণে এই বলে।

দিবানিশি থাকি পড়ে চরণ - কমলে।।

তবু মনে হয় যেন কেন ওড়াকান্দী।

আমার পাগল মন করিয়াছে বন্ধী।।

কিবা করি কোথা যাই নাহি পাই দিশে।

মতিচ্ছন্ন হ'ল বুঝি এসে এই দেশে।।

দয়া করে বল মোরে কোন পথে যাই।

কত দূরে ওড়াকান্দী বল শুনি তাই”।।

রঘুনাথ বলে যদি এহেন বচন।

হাসি হাসি বলে তাঁরে সেই মহাজন।।

“এবে সন্ধা হ'ল তুমি দেখ রঘুনাথ।

সাহসেতে ভর করি রাত্রে চল পথ।।

যতদূর গেলে হবে নিদ্রার আবেশ।

নিশ্চয় জানিও সেই ওড়াকান্দী দেশ।।

দক্ষিণ দিকেতে এবে তুমি চল হাঁটি।

তব ঠাঁই এবে আমি লইলাম ছুটি।।

গুরুচাঁদ ঠাকুরের সাথে দেখা পাবে।

দেখা পেয়ে মোর কথা তাহাকে জানাবে।।

সে তোমা' রাখিবে দেশে দিতে পাঠশালা।

শিখা'বে বালক গণে করিওনা হেলা।।”

এত বলি দ্রুতগতি হ'ল অন্তর্দ্ধান।

বাতাসে মিশিয়া গেল হয় হেন জ্ঞান।।

আশ্চর্য মানিয়া রঘু রহে দাঁড়াইয়া।

কেবা এল কেবা গেল ভাবিছে বসিয়া।।

আশ্চর্য ঘটনা দেখি প্রেমে পুলকিত।

রঘুনাথ পথে তবে চলিল ত্বরিত।।

মনে ভাবে গুরুচাঁদে পেয়ে দরশন।

তাঁর কাছে জানাইবে সব বিবরণ।।

অবোধ্য প্রভুর খেলা খেলার চুড়ান্ত।

ধ্যানে জ্ঞানে নাহি বুঝে পেল সে অনন্ত।।

মনে ভাবে রঘুনাথ এ কেমন কথা।

এক রাতে ওড়াকান্দী যেতে চাওয়া বৃথা।।

হেথা হতে ওড়াকান্দী রহে বহুদূর।

তাহা ছাড়া আমি অদ্য কাতর প্রচুর।।

Page 106 start

নিদ্রাবেশ অল্প পরে চোখে হবে মোর।

হারে মন অকারণ রাত্রে চলা তোর।।

পুনঃ ভাবে এই চিন্তা কেন হল মনে।

অবিশ্বাস কেন করি সেই মহাজনে।।

এই কথা মনে হলে প্রাণে এল বল।

রঘুনাথ চলে পথে চক্ষে বহে জল।।

যে জন বাতাসে মিশে অন্তর্দ্ধান হয়।

দৈবশক্তি ধারী নর হবে সে নিশ্চয়।।

এত ভাবি রঘুনাথ কিছু পথ চলে।

মনে হল এক ক্রোশ চলে অবহেলে।।

আশ্চর্য প্রভুর চক্র দেবে অগোচর।

নিদ্রা আসি রঘুনাথে করিল কাতর।।

ঘুম ঘোরে পদক্রমে অসার হইল।

বট বৃক্ষ মূলে পড়ি নিদ্রামগ্ন হ'ল।।

কোন্ ভাবে রাত্রি কাটে কেহ নাহি জানে।

জাগিল ঊষার আলো প্রভাত আঙ্গিণে।।

নয়ন মেলিয়া দেখে সেই রঘুনাথ।

কাটিয়া গিয়াছে রাত্রি এসেছে প্রভাত।।

বৃক্ষ তল ছাড়ি তবে চলে দ্রুত গতি।

একা যায় নাহি আর সাথে কোন সাথী।।

কিছুদূরে পেল দেখা এক পথিকেরে।

“ওড়াকান্দী কতদূরে “জিজ্ঞাসে তাঁহারে।।

বিস্মিত নয়নে পান্থ চাহে তার পানে।

ক্ষণকাল স্তব্ধ রহি কহিছে তখনে।।

“অনুমানে জ্ঞান হয় তুমি ভিন্ - দেশী।

নৈলে কোথা ওড়াকান্দী বল হেথা আসি।।

ওড়াকান্দী কোন বাড়ী তুমি যেতে চাও।

এই ত সে ওড়াকান্দী কোথা যাবে যাও।।

অকস্মাৎ রঘুনাথ চমকিয়া ওঠে।

মহা পুরুষের বাণী সত্য হল বটে।।

মনে ভাবিয়াছি যাহা তাহা সব ভুল।

ওহোরে অভাগা আমি শিমুলের ফুল।।

সাশ্রুনেত্রে রঘুনাথ চাহে তার পানে।

ধীরে ধীরে বলে তারে মধুর বচনে।।

“বহু দেশ ছাড়ি আমি এসেছি এ দেশে।

হরি পুত্র গুরুচাঁদ দেখিবার আশে।।

নমঃশূদ্র কুলে জন্ম নাম রঘুনাথ।

পরম সৌভাগ্য মোর আজি সু - প্রভাত।।

প্রাণের বাসনা মোর আছে বহুতর।

ইচ্ছা আছে গুরুচাঁদে জানাতে সত্ত্বর।।

কোন্ ঘরে গুরুচাঁদ করিছে বসতি ?

দয়া করি বল ভাই আমাকে সম্প্রতি।।”

পথিক ডাকিয়া বলে “শুন মহাশয়।

রজত - ধবল সম অই দেখা যায়।।

“ঠাকুরের বাড়ী “ উহা পরম পবিত্র।

শ্রী হরিচাঁদের পীঠ পুণ্যতীর্থ ক্ষেত্র।।

টিনে - ঘেরা ঘর বাড়ী দেখিতে সুন্দর।

গুরুচাঁদ আছে বসি উহার ভিতর।।

অপলকে চেয়ে দেখে সুধী রঘুনাথ।

সসম্ভ্রমে করজোড়ে করে প্রণিপাত।।

ত্রস্ত - ব্যস্ত রঘুনাথ উঠে বাড়ী 'পরে।

অপরূপ শোভা দেখে গৃহের ভিতরে।।

মহাপ্রভু গুরুচাঁদ আছে উপবিষ্ট।

কথা কয় হাসি হাসি মনে হয়ে হৃষ্ট।।

ধীরে ধীরে রঘুনাথ নিকটেতে যায়।

ভক্তি ভরে দণ্ডবৎ করে রাঙ্গা পায়।।

সুদৃষ্টে চাহিয়া তারে মহাপ্রভু কয়।

“কে আপনি কোথা ঘর দিন পরিচয়।।

কিবা হেতু দণ্ডবৎ করিলেন মোরে।

কি উদ্দ্যেশ্যে আগমন হল হেথাকারে ?

আসন গ্রহণ করি বলুন সকল।

আপনার দরশনে চিত্তে এল বল।।

শ্রী মুখের মধুবাণী শুনি রঘুনাথ।

আসন গ্রহণ করে জুড়ি দুই হাত।।

Page 107 start

পথি মধ্যে মহাজনে যাহা বলিয়াছে।

ধীরে ধীরে সব কথা মনে জাগিয়াছে।।

বিপুল বিনয়ে তবে রঘুনাথ কয়।

“করিতেছি নিবেদন তব রাঙ্গা পায়।।

নমঃশূদ্র কুলে জন্ম ভিন্ন দেশে ঘর।

বিভিন্ন কারণে দেখা চাহি আপনার।।

ঈশ্বরের কৃপাক্রমে আমি নিজ দেশে।

বিদ্যালাভ করি কিছু নিজ ঘরে বসে।।

শিক্ষা শেষে এই ভাব এসেছে অন্তরে।

বিদ্যার সমান বন্ধু নাহিক সংসারে।।

এই নমঃশূদ্র জাতি বিদ্যাহীন দোষে।

দলিত ঘৃণিত হয়ে আছে বঙ্গ দেশে।।

মনে মনে আমি তাই করিলাম ঠিক্।

যদি কিছু পেয়ে থাকি স্বজাতি তা' নিক্।।

উদ্দেশ্য সাধিতে আমি বহু দেশে ঘুরি।

স্বজাতি বোঝেনা তাহা এই দুঃখে মরি।।

ঘুরিতে ঘুরিতে আসি সেই ফরিদপুরে।

তব নাম শুনিলাম প্রতি ঘরে ঘরে।।

সবে বলে এই নাকি আপনার পণ।

'নমঃশূদ্র ঘরে ঘরে দিবে বিদ্যা ধন'।।

এই কথা শুনি প্রাণে আনন্দ হইল।

ভাবিলাম মনোবাঞ্ছা আজ পূর্ণ হল।।

শুভক্ষণে ওড়াকান্দী বলে যাত্রা করি।

আশ্চর্য দেখেছি কত সারা পথ ভরি।।

বাসুদেব নামধারী এক মহাজন।

তব পিতৃ - বন্ধু বলি করিল কীর্ত্তন।।

হরি - হর অভেদাত্মা যেমন প্রকার।

তব পিতৃসনে সেই ভাব ছিল তাঁর।।

যেদিন শ্রী হরি করে লীলা সম্বরণ।

সেই হ'তে এই দেশে না দেয় দর্শন।।

সাধক দম্পতি ছিল এই ওড়াকান্দী।

গুরু তার রাখে তাঁরে সেই ঘরে বন্ধী।।

নিজ পুত্র সম তোমা করে দরশন।

তব ঠাঁই আসিবারে বলে সেই জন।।

আশ্চর্য শক্তি তাঁর বুঝিবারে নারি।

পলকে অদৃশ্য হ 'ল বায়ু - ভর করি।।

মোরে বলে চিন্তা নাই নিশি গত হ'লে।

ওড়াকান্দী উপনীত হবে অবহেলে।।

প্রথমে বিশ্বাস নাহি হয় সেই কথা।

এবে দেখি তাহা ঠিক মোর চিন্তা বৃথা।।

অসম্ভব কার্য এই কেমনে ঘটিল।

এক রাতে এত পথ মোরে সে আনিল।।

এই নিবেদন মোর বলি তব ঠাঁই।

আপনার উপদেশ আমি এবে চাই”।।

সে রঘুনাথের বাক্য যবে শেষ হ 'ল।

'হায়' 'হায়' বলি প্রভু কান্দিয়া উঠিল।।

বলে “ধন্য মহাশয়! তুমি ভাগ্যবান।

নিজ চোখে দেখিয়াছ স্বয়ং ভগবান।।

দণ্ডবৎ করি তোমা সরল - পরাণ।

নিজে দেখা দিল তোমা, প্রভু হরিচাঁন।।

পিতামহ পিতামহী দুই জন মোর।

অবিরত কৃষ্ণ প্রেমে ছিল দোঁহে ভোর।।

“রামকান্ত “ নামে সাধু মহিমা অপার।

বাসুদেব ' মুর্ত্তি সেবা সাধনা তাঁহার।।

অকপট ভক্তিগুণে সাধক দম্পতী।

রামকান্তে করে ভক্তি দোঁহে নিতি নিতি।।

তাঁহে তুষ্ট রামকান্ত দিল সিদ্ধ বর।

জন্ম নিবে বাসুদেব ঘরেতে তোমার।।

হরিচাঁদ রূপে বাসুদেব জন্ম নিল।

তাঁর আগমনে ধরা পবিত্র হইল।।

দয়া করে তাঁর ঘরে জন্ম দিল মোরে।

তোমাকে বলেছে কথা শুধু ভাবান্তরে।।

দুই মাস পূর্ব্বে পিতা স্বপ্ন ঘোরে বলে।

পণ্ডিত আসিবে দেশে দুই মাস গেলে।।

Page 108 start

সেই দুই মাস আজি উতরিয়া যায়।

মনে ভাবি পিতৃবাক্য কিসে রক্ষা হয়।।

তাঁর কাজ তাঁরে সাজে তাই তিনি করে।

তোমাকে আনিয়া দিল আমার গোচরে।।

তুমি ধন্য কর ধন্য বিদ্যা - শুন্য জাতি।

দয়া করে ওড়াকান্দী কর তুমি স্থিতি।।

শ্রী গুরুর মুখে শুনি সব বিবরণ।

কেন্দে বলে রঘুনাথ “ আমি অভাজন।।

পেয়ে ধন হারা হই এমন যে অন্ধ।

বুঝিলাম কৃপা বিনে ঘুচে না'ক সন্দ।।

তাঁর সব কথা আমি এবে বুঝিয়াছি।

যাহা ইচ্ছা কর প্রভু শরণ নিয়াছি।।”

এই ভাবে রঘুনাথ পণ্ডিত সুজন।

ওড়াকান্দী স্থিতি কৈল আনন্দিত মন।।

বারশ ' সাতাশী সনে অঘ্রাণ মাসেতে।

পাঠশালা হল সৃষ্টি চৌধুরী বাটীতে।।

একেত পণ্ডিত সাধু রঘুনাথ নাম।

তাহে শক্তি দিল গুরুচাঁদ গুণধাম।।

দলে দলে ছাত্র আসি সকলে জুটীল।

অন্ধকার মাঝে যেন আলোক ফুটিল।।

শ্রী শশিভূষণ যিনি প্রভু জ্যেষ্ঠ - পুত্র।

সেই পাঠশালে পড়ে বলি সেই সূত্র।।

ফাল্গুন মাসেতে সবে করিলেন মন।

অন্যস্থানে পাঠশালা করিতে স্থাপন।।

গৃহস্থের গৃহ পরে ' পাঠশালা -ঘর।

উচিৎ না হয় মনে বুঝে অতঃপর।।

গ্রাম্য মধ্যস্থল দেখি একটি ভিটায়।

পাঠশালা গৃহখানি নির্মাণ করয়।।

দীর্ঘ এক ঘর তাতে বাঁধি পোতাখান।

টিনের ছাউনি করি করিল নির্ম্মাণ।।

আসবাব পত্র যত তৈরী করিল।

শুভ দিনে স্কুল গৃহে সবে প্রবেশিল।।

প্রভু গুরুচাঁদ করে দ্বার উদঘাটন।

জয় ধ্বনি করে জুটি দেশবাশী গণ।।

জয় হরিচাঁদ কী গুরুচাঁদ কী জয়।

জয়ের হুঙ্কারে যেন ধরা ফেটে যায়।।

গুরুচাঁদ বলে “শুন ভাই যত সব।

জাতির উন্নতি কিন্তু এই সূত্রপাত।।

যাক্ ধন যাক্ মান তা'তে ক্ষতি নাই।

সব দিয়ে এই দেশে স্কুল রাখা চাই।।

স্ব - জাতি শিক্ষক এবে পাইয়াছি মোরা।

আর কিসে ভয় করি কিসে দুঃখ করা?

মোর পিতা হরিচাঁদ বলে গেছে মোরে।

বিদ্যা শিক্ষা স্বজাতিকে দিতে ঘরে ঘরে।।

বিদ্যা বিনা সব বৃথা দেখ মনে ভেবে।

বিদ্যা পেলে ধন মান সব কিছু পাবে।।

শুন স্বজাতির গণ সবে মনোকথা।

বিদ্যা শূন্য ধন মান সব জানো বৃথা।।

নমঃশূদ্র জাতি যদি বাঁচিবারে চাও।

যাক্ প্রাণ সেও ভাল বিদ্যা শিখে লও।।

আমি বলি বিদ্যা শূন্য রবে যেই জন।

নমঃশূদ্র বলি তারে বলনা কখন।।

বিদ্যাবান যেই জন তাঁরে মান্য দাও।

বিদ্যার ভিত্তিতে সবে সমাজ গড়াও।।

যেই জন বিদ্যাবান পরম পণ্ডিত।

সমাজের পতি তারে মানিবে নিশ্চিত।।

বিদ্যা ছাড়া কথা নাই বিদ্যা কর সার।

বিদ্যা ধর্ম্ম, বিদ্যা কর্ম্ম,অন্য সব ছার।।

বাঁচ বা না বাঁচ প্রাণে, বিদ্যাশিক্ষা চাই।

বিদ্যাহীন হ'লে বড় তার মূল্য নাই।।

বারে বারে বলি তাই স্বজাতির গণ।

শেখ বিদ্যা রাখ বিদ্যা করে প্রাণপণ “।।

এত যদি বলে প্রভু সভার ভিতর।

জনে জনে সবে মিলি করে অঙ্গীকার।।

Page 109 start

“আজ হ'তে সবে মোরা অঙ্গীকার করি।

বিদ্যা ঘরে নিব তাতে বাঁচি কিবা মরি।।

ঘরে ঘরে জনে জনে করে আলোচনা।

প্রাণ দিয়ে কর সবে বিদ্যার সাধনা।।

প্রভুর চরণে করি এই নিবেদন।

মো ' সবার থাকে যেন সদা এই মন।।

দিনে দিনে মোরা সবে এই বুঝিয়াছি।

'হরিচাঁদে 'ঘরে পেয়ে ধন্য হইয়াছি।।

তাঁর ঘরে মহারত্ন গুরুচাঁদ তুমি।

পরম পবিত্র প্রভু তুমি অন্তর্যামী।।

ভয় নাই এ জাতির বুঝিয়াছি ঠিক।

যার যত মনে বলে ধন্য হয়ে নি'ক।।

জাতীয়তা পবিত্রতা একতার বাণী।

অন্ধকারে থেকে মোরা কিছু নাহি জানি।।

যেই শুভ দিনে এই জাতির ভিতর।

পরম দয়াল হরি হ'ল অবতার।।

সেই দিনে পুনর্জন্ম পেয়েছে এ জাতি।

দিনে দিনে হবে এর অবশ্য উন্নতি।।

ভাঙ্গা - বুকে এল আশা শূন্য-দেহে প্রাণ।

প্রাণ দাতা দয়াময় প্রভু হরিচান।।

ত্রেতা যুগে ক্ষাত্রজাতি সহেছিল কষ্ট।

কষ্ট দূর করেছিল রাম জগদিষ্ট।।

পরশুরামের হাতে ক্ষত্র নির্যাতিত।

দশরথ বাঁধা রয় প্রাণ ভয়ে ভীত।।

মান - দায় উভরায় কান্দে ক্ষত্রগণ।

সেই ঘরে জন্ম নিল রাম - নারায়ণ।।

পরশুরামের দর্প করিলেন চূর।

রামচন্দ্রে বলে ক্ষত্র প্রাণের ঠাকুর।।

দ্বাপরেতে জীবকুল কাঁদিয়া আকুল।

কৃষ্ণ রূপে করে লীলা যমুনার - কূল।।

বলদর্পী সবে হত কুরুক্ষেত্রে হল।

ধরা বলে ভার - হারী ধরাতে আসিল।।

যাহারে যে রক্ষা করে তাঁহারে সে ডাকে।

রাম নাম বিনা ক্ষত্র কিবা বলে থাকে?

'শ্রীকৃষ্ণ 'গৌরাঙ্গ ' আদি যত অবতার।

অন্য অন্য সম্প্রদায় করিল উদ্ধার।।

সরল কৃষক কুল সবে অবনত।

কোন অবতার নাহি করে দৃষ্টি পাত।।

এই সব অবতার বহু মহাজন।

বহুবিধ গ্রন্থ রাজি করেছে লিখন।।

ভক্ত বলি, সাধু বলি, বলি মুনি ঋষি।

বর্ণনা করেছে কত ভক্ত রাশি রাশি।।

পরিচয় সবাকার আছে সেই গ্রন্থে।

দলে দলে থরে থরে ফুল যথা বৃন্তে।।

আশ্চর্য ঘটনা সবে শুন দিয়া মন।

অবনত মধ্যে ভক্ত নাহি একজন।।

উচ্চকুলে জন্ম সবে ভক্ত পরিচয়।

নীচ কুলে জন্মে' কেবা ভক্ত কবে হয়?

সত্য বটে হরিদাসে ভক্ত বলি বলে।

ব্রহ্ম অংশে জন্ম নাকি যবনের কোলে।।

উপাধি করিল তারে ব্রহ্ম - হরিদাস।

নীচ জন উদ্ধারের কি হল প্রকাশ ?

ঝড়ু ভুঁইমালী বলি আর এক জন।

চরিতামৃতের মধ্যে রয়েছে লিখন।।

যবনের শাখা - জাতি ভুঁইমালী কয়।

যবন দেশের রাজা ছিল সে সময়।।

রাজ শক্তি ধারী যারা কিসে তারা হীন।

উচ্চ,নীচ সবে থাকে রাজার অধীন।।

রাজভয়ে যবনেরে নীচ নাহি বলে।

যবন তরিলে তা'তে নীচ কিসে তরে ?

চৈতন্যের মতে দেখি যত ভক্ত জন।

কায়স্থ ব্রাহ্মণ বৈদ্য আছে নিরূপণ।।

হীন বলি নীচ বলি যে সব - জনেরে!

দূর করি দিয়াছিল বনের ভিতরে।।

Page 110 start

সেই সব সর্ব্বহারা মানুষের দল।

অবতার এলে তাঁরা কিবা পেল ফল।।

আর এক যুক্তি উঠে মনের ভিতর।

যার জাতি তার সাথী আর সব পর।।

উচ্চ বর্ণ বলি যাঁরা করেছিল গর্ব্ব।

কালের বিধানে দেখ আজি তারা খর্ব্ব।।

ব্রাহ্মণাদি উচ্চ বর্ণে অবতার হয়।

যার যার ঘর সারি পরে ফাঁকি দেয়।।

যার জাতি তার সাথী তার যে আত্মীয়।

পর ঘর হ'তে হয় নিজ - ঘর প্রিয়।।

সকলে তারিতে যদি কেহ এসেছিল।

কিছু ধন্য হ'ল,অন্যে বাকি কেন র'ল?

অন্য ঘর ছিটে ফোঁটা নিজ ঘরে ঘড়া।

কেউ ধরে সুদর্শন কেউ সাজে নাড়া।।

যার যার তার তার পর - পাতে ছাই।

তারিতে সকল জনে কেহ আসে নাই।।

যেই উপকার করে তার দেয় দায়।

আপন নামের ডঙ্কা আপনি বাজায়।।

পিছনে পড়িয়া যাঁরা রয়েছে পতিত।

কেহ কভু করে নাই তাহাদের হিত।।

আর কত মনে পড়ে যুক্তি মিথ্যা নয়।

ব্যথিত না হ'লে সে কি ব্যথা বোঝে হায়!

ব্যথিতের ঘরে যদি আসে কোন জন।

সেইত বুঝিবে ব্যথা ব্যথিত কেমন।।

ব্যথিতের ঘরে এল শ্রী হরি ঠাকুর।

কৃপা করি ব্যথিতের ব্যথা কৈল দূর।।

ব্যথিতের হেন বন্ধু আর কেহ নাই।

প্রাণের - ঠাকুর তাই হরিচাঁদ সাঁই।।

ঘরে ঘরে জনে জনে কত কি বলেছে।

তাঁর শক্তি পেয়ে জাতি জাগিয়া উঠেছে।।

তরি 'বা না তরি 'তা'তে দুঃখ কিছু নাই।

শ্রী হরি - চরণ সার কর সবে ভাই।।

ঘরে ঘরে সভা করি সবারে জানাও।

এসেছ দয়াল মাঝি তরী খুলে দাও।।

সবে মিলি পরামর্শ করিল সভায়।

ঘরে ঘরে এই বার্ত্তা দিতে যেতে হয়।।

প্রতি জেলা প্রতি ঘরে জাগাও চেতনা।

ঘরে ঘরে এই বাণী করহে রটনা।।

স্থির হল সভা হবে খুলনা জেলায়।

দত্তডাঙ্গা নামে গ্রামে ঈশ্বর আলয়।।

শ্রাদ্ধ কার্যে জ্ঞাতি ভোজ বৃহৎ আকারে।

ঈশ্বর গাইন নামে সেই ব্যক্তি করে।।

দেশে বা বিদেশে যত নেতৃবর্গ ছিল।

সেই বাটি হতে পত্র সবাকে পাঠাল।।

প্রথম 'জাতীয় সভা ' সেই বাড়ী হল।

ক্রমে ক্রমে সেই বার্ত্তা কহিব সকল।।

জাতি ছিল দুঃখে - জারা বন্ধু নাহি ছিল।

'গুরুচাঁদ' বন্ধু হয়ে সে ঘরে আসিল।।

চাঁদের কিরণ লাগে সকলের গায়।

মহানন্দ অন্ধকারে বসে অন্ধ রয়।।

--০—