Page 206

লাট দরবারে গমনের উদ্যোগ-পর্ব

আসিবেন ছোট লাট মহামতি ল্যান্সলট

ঘরে ঘরে প্রভু দিল বার্তা।

শুনিয়া প্রভুর বাণী যত নমঃশূদ্র গুণী

ওড়াকান্দী সবে করে যাত্রা।।

গোপীনাথপুর বাসী রূপে যেন পূর্ণশশী

পূর্ণচন্দ্র মল্লিক সুজন।

বৈরাগী চণ্ডীচরণ প্রভু পদে নিষ্ঠা মন

ওড়াকান্দী করে আগমন।।

শ্রীরাধা চরণ নাম বাস জোৎকুরা গ্রাম

বার্তা পেয়ে আসে ওড়াকান্দী।

শ্ৰীমোহনলাল যিনি বাকপুরা বাসী তিনি

কাজ কর্মে জানে সব সন্ধী।।

আসে ভীষ্মদেব দাস ওড়াকান্দী যার বাস

শ্ৰীবিধু চৌধুরী এল সাথে।।

সবে একত্র হইল প্রভু সবাকে কহিল

“মোর ইচ্ছা জান ভাল মতে।।

জাতির উদ্ধার লাগি দিবা নিশি আছি জাগি

ইচ্ছা করি নিব ভাল পথে।।

জাতি তরে স্বর্গ ত্যজি, ভ্ৰমি আমি মর্তে আজি

ইংরাজকে করি আমি সাথে।।

Page 207 start

মীড তাহে আছে সাথী, বিশেষ রাজার জাতি

আমাদিগে’ করিবে সাহায্য।

তাঁর পরামর্শ মতে, দেখা হবে লাট সাথে

এ সুযোগ নাহি কর ত্যজ্য।।

শশী আনে মান পত্র, লেখা তা’তে সব সূত্র

মীড যাহা করেছে রচন।

এক সাথে চল সবে, জাতির উন্নতি হবে

এই বাক্য না হবে লঙ্ঘন।।”

প্রভু-মুখে শুনি বাণী, যতেক প্রধান গুণী

আনন্দেতে সবে দিল সায়।

পরে করি দিন স্থির, প্রভু পদে নতশির

আপনার ঘরে সবে যায়।।

পরামর্শ হ’ল ঠিক, চালক হইবে মীড

লাটে সব বলিবার জন্যে।

প্রভু যাবে বিধু যাবে, ভীষ্মদেব সঙ্গে র’বে

দল মধ্যে এরা অগ্ৰগণ্যে।।

শ্ৰীযুত শশীভূষণ, বালা তারিণীচরণ

রাধানাথ মোহন বিশ্বাস।

মল্লিক পূর্ণচরণ, এই কয় মহাজন

এক সঙ্গে যাবে লাট পাশ।।

কথাবার্তা ঠিক হয়, সবে আনন্দ হৃদয়

শুভদিন লাগি রহে চাহি।

প্রভু কহে ভক্তগণে, “এই জাগে মোর মনে,

এর চেয়ে সুসংবাদ নাহি।।

পতিত তরা’বে বলে, এসেছিল এই কুলে

পতিত পাবন মোর পিতা।

দিনে দিনে সাক্ষী তার, দেখিতেছি পরিষ্কার

মিথ্যা নাহি হবে তাঁর কথা।।

তের শত চৌদ্দ সাল, সাধনাতে ফলে ফল

রাজশক্তি পেতে যায় জাতি।

এ শুধু হরির কর্ম, কেহ নাহি বুঝে মর্ম

সেই দুঃখে দুঃখী আমি অতি।।

এই যে জাগিবে প্রাণ, উন্নতির মহাবান

প্লাবিত করিবে সর্বদেশ।

শুধু নমঃশুদ্র নয়, যারা যারা পিছে রয়

সকলের দুঃখ হবে শেষ।।

লাটে মানপত্র দিলে, চিনিবেন সেই কালে

নমঃশূদ্র জাতি কারে কয়?

নমঃশূদ্রে চেনা হলে, চিনিবে পতিত দলে

এক সঙ্গে হবে পরিচয়।।

এ যেন গাড়ীর খেলা, জোড়াবান্ধা দিয়ে তালা

ইঞ্জিন চলিছে অগ্রভাগে।

ইঞ্জিন যে ঘাটে যায়, গাড়ী পাছে পাছে ধায়

ইঞ্জিনের ঘাটে গিয়ে লাগে।।

ইঞ্জিনের ভাব নিয়ে, নমঃশূদ্র যাবে ধেয়ে

তারে ধরে তরিবে অপরে।

হরি এল নমঃকুলে, তাই তারা আগে চলে

হরিচাঁদ সেই ইচ্ছা করে।।

তাঁর ইচ্ছা ছিল যাহা, তোমরা পূরাবে তাহা

তোমাদের পরে সেই ভার।

পিতার যে ইচ্ছা ছিল, সে ইচ্ছা পুরাতে বল

ভক্ত ছাড়া কেবা আছে আর?

এই ত আরম্ভ মাত্র, বিস্তৃত করম ক্ষেত্র

সম্মুখেতে আছে যে পড়িয়া।

যাঁর ইচ্ছা ভাবি তাঁরে, ঝাঁপ দাও এ সায়ারে

হরিচান্দে কাণ্ডারী করিয়া।।

যাব লাট দরবারে, ভক্ত সব ঘরে ঘরে

হরিচান্দে করিও স্মরণ।

আমাদের এ যাত্রায়, যেন সর্ব শুভ হয়

জাতি যেন পায় জাগরণ’।।

বাক্যে যেন ক্ষরে মধু, যতেক ‘মতুয়া’ সাধু

প্রেমানন্দে চক্ষে বহে জল।

সবে ভাবে মনে মন, হেন মহারত্ন ধন

না চিনিয়া জনম বিফল।।

Page 208 start

পরম দয়াল সাজে, অন্ধ নমঃশূদ্র মাঝে

অমৃত বাটিয়া দিতে চায়।

মোরা নাহি চিনিলাম, দূরে দূরে রহিলাম

তবু ডাকে “আয়, আয়, আয়”।।

এ দয়ার তুল্য নাই, যত পাই তত চাই

যোগ্য নই তবু করি দাবী।

তা’তে নাহি করে রোষ, শুধু করে আপশোষ

বলে “তোরা পা’বি আরো পা’বি।।

তোদেরে তরা’ব বলে, আসিয়াছি এই কুলে

তা’তে তোরা দয়া অধিকারী।

তোদের সকলে ধরে, দিব দয়া জোর করে

স্বভাব ছাড়িতে কই পারি?

মেরেছিল জগামাধা, দিয়ে কলসীর কাঁধা

দয়া দিতে করি নাই বাঁধা।

দয়া করা রীতি এই, যে জানে না তারে দেই

বিনামূল্যে প্রেম তাই সাধা।।

এত ভাবি ভক্তবৃন্দে, ফুকারিয়া সবে কান্দে

ক্রোধে প্রভু বলে “সব থাম”।

কান্দকান্দি নাহি চাই, কাজ ছাড়া কান্দা ছাই

অকেজো কান্দুনে সব নাম।।

কান্দা কান্দি ঢলাঢলি, কতকাল করে এলি

কিবা ফল পেলি তা’তে বল?

কর্ম ছেড়ে কান্দে যেই, তার ভাগে মুক্তি নেই

হবি নাকি বৈরাগীর দল?

সে যুগ গিয়াছে চলে, আমি বাপু যাঁর ছেলে

তাঁর ধর্মে জন্মে মহা বীর।

‘ঢলো’ প্রেমে হ’য়ে বাম, হাতে কাজ মুখে নাম

মহাবীর্যে তুলে দাঁড়া শির।।

তাঁর ছিল এই কথা, এই কোন বাতুলতা?

নেড়া নেড়ী এল বুঝি ফিরে।

করতে চাস তো হা, হা, নেড়া নেড়ী দলে যা,

সেই দলে কাঁদ গলা চিরে।

চৈতন্য বালক ছিল, কেন্দে কেন্দে চলে গেল

কান্না তার বুঝিলনা কেহ।

মনো দুঃখে সে গোঁসাই, ঘরে ফিরে আসে নাই

জলে ডুবে জুড়াইল দেহ।।

নেড়া নেড়ী পরে যারা, ঢঙ করে সবে তারা

জনে জনে সেজেছে নিমাই।

কাজ নাই কর্ম নাই, দ্বারে দ্বারে ঘোরে তাই

বলে মোরা “বৈষ্ণব গোঁসাই।।

কান্না দেখি সে দলের, এ কিরে গ্রহের ফের!

তোরা সবে কান্দিস কি বুঝে?

ফাঁক যদি রয় মূলে তা ঢাকবি কি কৌশলে

মাথা-ঢাকা যায় লেজ গুঁজে?

এ সব ভণ্ডামী ছাড়, ছেড়ে দে মনের আড়

শক্ত হোক বুকে যত হাড়।

আগে কাজ পরে কান্না, ছেড়ে দে কান্নার ধনা

কাজ করে বাড় তোরা বাড়।।

প্রেম সোজা কথা নয়, প্রেম মেলে সাধনায়

জল না’ যে পাবি যথা তথা।

পবিত্র হৃদয় পেলে, প্রেম থাকে সেই স্থলে

প্রেম চায় সত্য পবিত্রতা।।

প্রেম যদি হ’ত সস্তা, পুরে নি’ত বস্তা বস্তা

রাস্তা বান্ধা যেত প্রেম দিয়ে।

সস্তা প্রেমে ভরে’ মন, দেখ গিয়ে কত জন

কুষ্ঠ ব্যাধি নিয়ে আছে শুয়ে।।

কান্না শুধু নয় চোখে, কান্না থাকে যার বুকে

মুখে তার কথা নাহি ফুটে।

মনে মনে টানে মন, সেই প্রেমে আকর্ষণ

টানে টানে মন চলে ছুটে।।

সে বাপু সহজ নয়, দৈবাৎ কাহার হয়

কোটী মধ্যে গুটী মেলা ভার।

প্রেমিকের যে লক্ষণ, আমি বলি তোরা শোন

তত্ত্ব মনে পড়িল আমার।।

Page 209 start

চৈতন্য প্রভুর দলে, রাজ্য রাজধানী ফেলে

দুই ভাই সাজিল ফকির।

পূর্ব নাম ছেড়ে দিয়ে, রূপ সনাতন হ’য়ে

হরি বলে ছাড়িল জীগির।।

সনাতন বৃন্দাবনে, মত্ত হরি নাম গানে

প্রভু আজ্ঞা মতে তথা রয়।

দেহ থাকে বৃন্দাবনে, মন চলে প্ৰভু সনে

আরোপেতে রূপ দেখা পায়।।

নাহি করে দাপদাপি, হরি বলে লুফালুফি

এক মনে জপে হরি নাম।

এই ভাবে দিন যায়, হেন কালে বার্তা পায়

গেছে চলি গৌর গুণধাম।।

সংবাদ শুনিয়া কানে, বসি রহে আনমনে

ভক্তগণে মানিল বিস্ময়।

সবে ভাবে মনে মন, কান্দিল না সনাতন

এই নাকি ভক্ত পরিচয়?

কান্দিয়া আকুল যারা, কিছু কাল পরে তারা

ক্রমে ক্রমে শোক ভুলি গেল।

এ দিকেতে সনাতন, যেন অবসন্ন মন

গ্রন্থ পাঠে মন ডুবাইল।।

একদিন দ্বিপ্রহরে, গ্রন্থকে বহিয়া শিরে

বৃক্ষতলে বসে সনাতন।

চারি ভিতে বসে ভক্ত, গ্রন্থ পাঠে অনুরক্ত

সনাতন করে উচ্চারণ।।

নদীয়া বিদায় খণ্ড, মুড়িয়া আপন মুণ্ড

সন্ন্যাসী সাজিল গোরা রায়।

কান্দে তাঁর শচীমাতা, বিষ্ণুপ্রিয়া শুনি কথা

বুক ফাটে কথা নাহি কয়।।

শচী যে বিলাপ করে, তাহা পাঠ শেষ করে

বিষ্ণুপ্রিয়া প্রসঙ্গ আসিল।

কি গভীর বেদনায়, বিষ্ণুপ্রিয়া দুঃখ সয়

পাঠ শুনি সকলি কান্দিল।।

সনাতন নির্বিকার, পাঠে বাধা নাহি তাঁর

বারেক শিহরি মাত্র উঠে।

দৈবের ঘটনে হায়, বৃক্ষ হ’তে এ সময়

পত্র এক শাখা হ’তে টুটে।।

সনাতন পৃষ্ঠোপরে, পত্র আসি লুটি’ পড়ে

আশ্চর্য ঘটনা সবে দেখে।

দপ্ করি অগ্নি জ্বলে, মুহূৰ্ত সময় কালে

পত্র পোড়ে জুলন্ত পাবকে।।

ভক্ত সবে হতবাক, সনাতন বলে ‘থাক্

আদ্যকার পাঠ শেষ হ’ল।

এতেক বলিয়া সাধু, গ্রন্থ শিরে করি শুধু

আপন কুটীর পানে গেল।।

ঘটনা দেখিয়া চোখে, কথা কা’র নাহি মুখে

লজ্জিত হইল সবে মনে।

স্তব্ধ রহিয়া পরে, সবে বলাবলি করে

‘মোরা নাহি চিনি সনাতনে।।

প্রেমের আগুন সহে, মুখে কথা নাহি কহে

এত বড় ভক্ত কেহ নাই।

আগুন রাখিয়া বুকে, অচঞ্চল রহে শোকে

পুড়ে পুড়ে দেহ হল ছাই।।

প্রেমিকের যে লক্ষণ, জানিত সে সনাতন

যে কান্নায় নাহি ছিল জল।।

বিরহ আগুন জুলে’, বাষ্প করে সব জলে

ছোট কান্না কেন্দে কিবা ফল ?

যদি প্রেম পেতে চাও, এই ভাব সবে নেও

ঢঙ করে কাঁদা নহে ভাল।

মন কান্দে যে কান্নায়, ফল ফলে সে কান্নায়

চল সবে সেই পথে চল।।”

এতেক কহিয়া বাণী, গুরুচাঁদ গুণমণি

“হায়! হায়! শব্দ করি উঠে।

কি যেন কিবেদনায়, হায় হায় শব্দ কয়

ধ্বনি যেন কোথা যায় ছুটে।।

Page 210 start

বৈরাগী চণ্ডীচরণ, করজোড়ে নিবেদন

প্রভুর অগ্রেতে গিয়া করে।

“প্রভু যদি আজ্ঞা পাই, দরবারে যেতে চাই

এ বাসনা রয়েছে অন্তরে।।”

প্রভু বলে “ভাল হ’ল, চল মোর সঙ্গে চল

লাট সঙ্গে হবে পরিচয়।

জাগিয়া উঠক জাতি, আমি তোমাদের সাথী

মনে নাহি কর কোন ভয়।।”

চণ্ডী কয় “প্রেম সিন্ধু! সদা পাই বিন্দু বিন্দু

তাই কান্দি ঢঙ নাহি জানি।

দয়াতে ডুবিয়া যাই, তাই কেন্দে ছাড়ি হাই

প্রেম ভক্তি কিছু নাহি চিনি।।”

ভক্ত হাতে ভক্তি ডোর, তাই ভক্ত মনোচোর

চুপ করে থাকে কথা নাহি কহে।

কহে দীন মহানন্দ, গেল না চিত্তের সন্দ

প্রেম প্রাপ্তি হ’ল না এ দেহে।।

---০---