Page 300

“তারক-ভাগবত”

শ্রীহরিচাঁদের কৃপা যাঁর পরে রয়।

অসাধ্য তাঁহার কিছু নাহিক ধরায়।।

শ্রেষ্ঠ কবি বলে হ’ল তারকের নাম।

দেশে দেশে সবে তাঁরে ডাকে অবিরাম।।

বাহ্মণ পন্ডিত কিবা রাজার সভায়।

বহু শাস্ত্র-বেত্তা বলি তাঁর পরিচয়।।

এবে কহি সর্ব্ব জনে অপূর্ব্ব ঘটনা।

করিল অপূর্ব্ব লীলা তারক রসনা।।

নড়াইল রাজবাড়ী কবির আসরে।

ব্রাহ্মণ পন্ডিত বসে সভা শোভা করে।।

Page 301 start

বিপক্ষ দলের যিনি ছিল সরকার।

কোন গুণে তারকেরে হতে নারে পার।।

ব্রাহ্মণ পন্ডিত তাহে হল কুতুহলী।

তারকে পরীক্ষা করে ব্রাহ্মণ মন্ডলী।।

ভাবগতে আছে লেখা শ্রীদাম পিলাপ।

কৃষ্ণ হারা সে শ্রীদাম কহিছে প্রলাপ।।

কহিতে “কানাই” তার কন্ঠ বেঁধে গেল।

কা, কা, কহিয়া শ্রীদাম কানাই কহিল।।

কি হেতু কহিল হেন রাখাল শ্রীদাম?

তারকে জিজ্ঞাসা করে যত গুণধাম।।

মোরা যাহা ব্যাখ্যা করি আগে শুন তাই।

প্রকৃত সিদ্ধান্ত যেন তাতে হয় নাই।।

মোরা বলি “তোৎলা” ছিল শ্রীদাম রাখাল।

এক সঙ্গে দিতে নারে কোন শব্দে তাল।।

এই ব্যাখ্যা করি বটে শান্তি নাহি পাই।

প্রকৃত সিদ্ধান্ত কিছু শুনিবারে চাই।।

সভাজনে সবে তাহা করে সমর্থণ।

শুনিয়া চিন্তত হ’ল তারক সুজন।।

মাথা হেঁট করি সাধু রহিল বসিয়া।

বলে “হরি কর দয়া হৃদয়ে আসিয়া।।

তুমি বিনে কেবা জানে কিসে কোন মর্ম্ম?

এ-সব সিদ্ধান্ত বলা নহে মোর কর্ম্ম।।

দয়া করে কহ কথা যদি দয়া হয়।

তুমি-ছাড়া তারকের কে আছে কোথায়?

এত ভাবি দুই চোখে বহে জল-ধারা।

আপনা-আপনি যেন হ’ল জ্ঞান হারা।।

ভকতের দুঃখ হেরি নিজে ভক্তাধীন।

তারকের হৃদাসনে হলেন আসীন।।

যে-বাণী শোনেনা কেহ শুধু ভক্তে জানে।

সেই সুরে কথা কয় তারকের প্রাণে।।

“ওঠ ভক্ত ভয় নাই আমি আছি শিরে।

যা’কিছু বলার আমি বলা’ব তোমারে।।”

তন্দ্রাবেশে সে তারক শিহরি উঠিল।

হরি! হরি! হরি! বলি সভাতে দাঁড়াল।।

মরা-গাঙ্গে ভরা স্রোত-যথা বান ধায়।

তারকের মুখে ভাষা তেমনি জোগায়।।

বিনয় করিয়া কহে সভাজন ঠাঁই।

“ইহার সিদ্ধান্ত কহি হেন শক্তি নাই।।

তবে গুরু হৃদি-মধ্যে যে বাণী জোগায়।

নিবেদন করি তাহা এ রাজ-সভায়।।

তাতে যদি শান্তি আসে কাহার হৃদয়।

শ্রীহরিচাঁদের গুণে-মোর গুণে নয়।।

এবে বলি মূলসূত্র সিদ্ধান্তের কথা।

সুধা-ভান্ড পরিপূর্ণ ভকত-বারতা।।

ব্রজের রাখাল সবে সখ্য-রস-মূর্তি।

গোপালের পরে রাখে সেই ভাবে আর্তি।।

কেহ ছোট কেহ বড় কেহবা সমান।

বয়সের মধ্যে আছে অল্প ব্যবধান।।

নিষ্কলঙ্ক ছবি যেন প্রভাত-তপন।

অবাধ প্রাণের টানে খেলে সর্ব্বজন।।

আমাদের ঘরের ঘরে ব্রজের রাখাল।

ঘরে ঘরে নাচে কত ব্রজের গোপাল।।

রাখালেরা কোনভাবে কৃষ্ণে বাসে ভাল।

কৃষ্ণ যে-কে রাখালেরা তাহা কি বুঝিল?

রাখালে রাখালে জানে ভাবে প্রাণসখা।

কৃষ্ণ বিনে পোড়া প্রাণ যায় নারে রাখা।।

কিশোরের লাগি কান্দে কিশোর রাখাল।

কি-শরে কিশোর হিয়া বিঁধিল গোপাল?

কি-শর, কিশোর কৃষ্ণ! হানিলি কিশোরে।

কি স্বরে কিশোর কথা কহে নিদ্রা জাগরণে।।

যাঁর রূপ ভরা আছে সারা মনে প্রাণে।।

জাগরণে বনে বনে যাঁরে বুকে ধরি।

স্বপনের মধ্যে যার সঙ্গে খেলা করি।।

Page 302 start

স্বপনের খেলা যেন নহে’ক স্বপন।

একভাব কিবা স্বপ্ন কিবা জাগরণ।

প্রতি রক্ত-কণিকায় যার সাড়া পাই।

কাণায় কাণায় ভরা প্রাণের কানাই।।

এ-কানাই ছেড়ে যদি যায় দূর দেশে।

আর কিবা থাকে বল সেই পোড়া দেশে?

“কানু নাই” এইকথা মনে নাহি মানে।

শ্রীদাম কান্দিয়া ফেরে যমুনা-পুলিনে।।

হারে স্মৃতি! ইতি উতি লতায় পাতায়।

‘ঐ বুঝি’ ঐ বুঝি বাঁশী শোনা যায়।।

প্রেমোম্মাদ শ্রীদামের নাহি জ্ঞান-লেশ।

লতায় পাতায় দেখে কৃষ্ণের আবেশ।।

কালিন্দির কালো জলে ধারা বয়ে যায়।

শ্রীদাম ভাবিছে বুঝি নবঘন-কায়।।

মনে মনে ভাবে এই নাকি কালীদহ কূপ।

শ্রীদাম নামিল জলে হইছে আকুল।।

কালীদহে কালীনাগ বড়ই দুরন্ত।

অবোধ কানু কি জানে সেসব বৃত্তান্ত।।

কি জানি কি ঘটে শেষে বিষম ঘটনা।

একা একা যাসনারে ওরে কেলে সোনা।।

এত বলি জলে ঝাঁপ দিল সে রাখাল।

কানু কোথা এ যে হায় কালিন্দির জল।।

কালিন্দির বুকে জল করে কল কল।

শ্রীদামের বুক ফাটে আঁখি ছল ছল।।

কুলে ওঠে সে-রাখাল চারিদিকে চায়।

তরুণ তমাল তরু দেখিবারে পায়।।

বুকে-আঁকা কালো চোখে দেখে তাই।

তমাল দেখিয়া ভাবে ঐ মোর কানাই।।

তমাল তরুর মূলে দাঁড়া’য়ে কানাই।

ব্যাকুল শ্রীদাম ছুটে বাহ্য জ্ঞান নাই।।

কানু-হারা শূণ্য প্রাণ সদা ছাড়ে হাই।

তমাল সাপুটী ধরে ভাবিয়া কানাই।।

কোথা কানু? এ যে তরু-পরশে কঠিন।

ক্ষোভে দুঃথে শ্রীদামের বক্ষ যেন ভিন।।

হতাশায় প্রাণে ক্ষোভ বাক্য নাহি সরে।

কানাই কহিতে শুধু কি কি শব্দ করে।।

ভাবাবেগে ভরা-বুক কন্ঠরুদ্ধ তায়।

ভাঙ্গা-স্বরে কা কা মাত্র শব্দ বাহিরায়।।

সখ্য-রসে-ভরা ছিল রাখালের প্রাণ।

কা কা শব্দ হ’ল তার জাজ্জ্বল্য প্রমাণ।।

কা কা শব্দ করি পরে কানাই কহিল।

শ্রীদাম তোৎলা নহে-প্রেমেতে বিহবল।।

এত বলি শ্রীতারক নিস্তব্ধ হইল।

ব্রাহ্মণ পন্ডিত সবে ছুড়িয়া আসিল।।

কেহ কোল দেয় কেহ করে আশির্ব্বাদ।

বলে ধন্য শ্রীতারক কোটি ধন্যবাদ।।

এমত সিদ্ধান্ত মোরা কভু শুনি নাই।

হরিভক্ত সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বুঝিলাম তাই।।

ভক্তের হৃদয়ে সদা থাকে নারায়ন।

ভক্তের মুখের বাক্য না হয় খন্ডন।।

সাধারণে যাহা চোখে না দেখে কখন।

ভক্ত তার মধ্যে করে রস আস্বাদন।।

প্রকৃত সিদ্ধান্ত মোরা শুনিলাম আজি।

এ সিদ্ধান্ত শিরোধার্য্য হইলাম রাজি।।

কিবা শাস্ত্র কিবা গ্রন্থ পুরান নিচয়।

গ্রন্থকর্তা মনীষীর সত্য পরিচয়।।

যে-ভাব খেলিয়া যায় ভক্তের হৃদয়।

সেই ভাবে ধারা গ্রন্থে দেয় পরিচয়।।

কবি আর কাব্য তাই নহে’ত বিভিন্ন।

তোমাকে উপাধি দিব অদ্য সেই জন্য।।

ভাগবত-রস-শাস্ত্রে তুমি অধিকারী।

“শ্রীতারক ভাগবত” নাম দিনু করি।।

ভাগবত আর তুমি সমান সমান।

“শ্রীতারক ভাগবত” তাহার প্রমাণ।।

Page 303 start

“শ্রীতারক ভাগবত” পাইল উপাধি।

যাঁর পদ-তরী পার করে ভবনদী।।

---০---