Page 370

শ্রীশ্রীগুরুচাঁদের লক্ষ্মীখালী গমন

তেরশ তেইশ সালে গ্রন্থের মুদ্রণ।

গ্রন্থ পেয়ে ভক্তগণে অতিহৃষ্ঠ মন।।

গোপাল সাধুর দানে গ্রন্থ ছাপা হয়।

এই কার্য্যে গোপালের সত্য পরিচয়।।

এ সময়ে গোপালের পাঁচটি সন্তান।

দুই পুত্র তিন কন্যা সবে বর্ত্তমান।।

প্রভুর কৃপায় ধন্য সংসার তাঁহার।

হরশীত কাশীনাথ পুত্র দুটি তাঁর।।

জ্যেষ্ঠা কন্যা নাম তার জানি সহচরী।

দ্বিতীয়া কন্যার নাম মাণিক্য সুন্দরী।।

Page 371 start

কনিষ্ঠা সাবিত্রী জানি ভগ্নী তিনজন।

এক গৃহে রহে পঞ্চ ফুলের মতন।।

নারী শিক্ষা দিতে প্রভু ব্যস্ত সর্ব্বদায়।

ওড়াকান্দী তাতে হল নারী শিক্ষালয়।।

মীডের সঙ্গিনী ধনি নাম মিস টাক।

পরম পবিত্রা দেবী নাহি কোন জাঁক।।

মিস টমসন হন সাহায্যকারিণী।

বিধবা আশ্রম গড়ে মিলে দুই ধনি।।

বিধবা রমণী যত হারায়েছে পতি।

সহজে বিপথে যায় জীবনের গতি।।

অলস মনের কোনে পাপ বাঁধে বাসা

স্বখাত সলিলে ডোবে নাহি পেয়ে আশা।।

বিশেষতঃ বাঙ্গালীর ঘরে যে বিধবা।

গঞ্জনায় সর্ব্বদায় কাটে রত্রি দিবা।।

স্বজন বান্ধব সবে ভাবে গলগ্রহ।

তিরস্কার পুরস্কার পায় অহরহ।।

পুত্রকন্যা হীনা হলে আর রক্ষা নাই।

অভাগীরে গালি দেয় জুটিয়া সবাই।।

এর ফলে যাহা ফলে তাহা বিষয়ে।

আমি কি বলিব তার আছে পরিচয়।।

বিধবা জীবনে তাই দুঃখে নাই অন্ত।

পতিহারা হলে নারী হয় সর্ব্বস্বান্ত।।

এসব দেখিয়া প্রভু বড় ব্যথা পায়।

দয়া করে বিধবার করিল উপায়।।

মিস টাক আসি বলে প্রভুজীর ঠাঁই।

“বড়কর্তা” এক কার্য্য করিবারে চাই।।

অনাথা বিধবা যত আছে এই দেশে।

তাদেরে শিখাব শিল্প আমি সবিশেষে।।

জীবিকা নির্ব্বাহ তাতে অবশ্য হইবে।

বিধবা জীবনে দুঃখ আর না রহিবে।।

বিধবা আশ্রম তাই করিবারে চাই।

আপনার আজ্ঞা বিনে সাহস না পাই।।”

মিসটাক যদি বলে এই মত কথা।

প্রভু বলে “ধন্য তুমি অবলার মাতা।।

তব গুণে পতিহীনা পাবে বটে গতি।

তার মধ্যে এক কথা বলিব সম্প্রতি।।

শুধু পতিহীনা নয় নারীমাত্রে সব।

তোমার আশ্রমে এনে বাড়াও গৌরব।।”

মিস টাক বলে “তাতে কোন বাধা নাই।

সব নারী নিব আমি যত জনে পাই।।”

এইভাবে ওড়াকান্দী নারী বিদ্যালয়।

গড়িলেন মিস টাক প্রভু কৃপায়।।

সেই দিনে যেই বীজ হয়েছে রোপণ।

অদ্য সেই বৃক্ষে ফল হল অগনণ।।

“নারী ট্রেণিং” স্কুল আজ হল ওড়াকান্দী।

আদি সূত্রে গুরুচাঁদ করিলেন সন্ধী।।

ওড়াকান্দী শিক্ষালয়ে পড়ে সহচরী।

এ কার্য্যে গোপাল ইচ্ছা করিলেন ভারী।।

সিংহ শিশু শিলা পরে ওঠে ধীরে ধীরে।

গোপাল ঘনিষ্ঠ হয় লহরে লহরে।।

গুরুবাক্য প্রতি দৃঢ় নিষ্ঠা আছে যাঁর।

সে কেন রহিবে পড়ে যেখানে আঁধার?

গ্রন্থ ছাপা হলে ভাবে গোপাল গোঁসাই।

“আমার অদৃষ্ঠে বুঝি তাহা প্রাপ্তি নাই।।

ভক্তিগুণে ভক্তগণে প্রভুকে লইয়া।

মনোসাধে পূজে পদ নিজ গৃহে নিয়া।।

এতে ত কাঙ্গাল আমি তাতে ভক্তিহীন।

মোর ভাগ্যে হবে কিরে সেই শুভ দিন?”

এত ভাবি সাধুজীর মুখে হাসি নাই।

নিরালায় বসে সাধু সদা ছাড়ে হাই।।

মনোগত কথা আর কবে কার কাছে।

মুখ দেখে বোঝে দুঃখ হেন কেবা আছে?

অন্তর্য্যামী বিনে আর কেহ বন্ধু নাই।

মনে মনে কেন্দে বলে গোপাল গোঁসাই।।

Page 372 start

“পরম দয়াল প্রভু কিবা কব আর।

অন্তর্য্যামী জানো তুমি সব সমাচার।।

আমার পাগল মন করেছে দুরাশা।

চাঁদের ধরিতে যথা বোমনের আশা।।

অসম্ভব কথা বলে যতেক বাতুল।

আমার এ আশা করা বুঝিলাম ভুল।।

কিন্তু প্রভু একি দায় মন নাহি মানে।

মনের জ্বালায় প্রভু যাব কোনখানে।।

মনে মনে জ্বলে পুড়ে মরিতেছি আমি।

দয়া করে রক্ষা কর প্রভু অন্তর্য্যামী।।

শান্তিধামে আছ সুখে শান্তিময় প্রভু।

দুঃখধামে তোরা নিতে চাহিনা’ক কভু।।

কুব ফেটে মন কান্দে তাতে দুঃখ নাই।

হইক তোমার শান্তি এই মাত্র চাই।।

মনে মনে গোপালের হল অভিপ্রায়।

মন পোড়ে তবু মুখে কিছু নাহি কয়।।

ভকতের ব্যথা হেরি দুঃখী দয়াময়।

বাক্যচ্ছলে গোপালের কাছে ডাকি লয়।।

“হে গোপাল বাদাবনে আমি যেতে চাই।

উপযুক্ত সঙ্গী সাথী বল কারে পাই?

তোমার বাড়ীর কাছে নাকি বাদাবন।

তোমার গৃহেতে আমি করিব গমন।।”

অন্ধ যদি অকস্মাৎ চোখে দৃষ্টি পায়।

ধরে না আনন্দ ঢেউ তাহার হৃদয়।।

তদোধিক সুখরাশি পাইল গোপাল।

অবিরল চোখে তার ঝরিতেছে জল।।

কেন্দে কয় “দয়াময় যোগ্য নহি আমি।

মম গৃহে কেনা গুণে যাবে অন্তর্যাআমমি?

কোনক্রমে বাদাবনে আমি দুঃখে রই।

দুঃখ মাঝে গেলে প্রভু আমি দুঃখী হই।।

শান্তিধামে থাক প্রভু ওহে শান্তিময়।

বাদাবনে দুঃখ দিতে মোর ইচ্ছা নয়।।

বিশেষতঃ লোণা দেশে জল লবনাক্ত।

দুরন্ত লোণার ডাকে আমরা উতাক্ত।।

তোমার সোনার দেহে তাকি সহ্য পায়?

কাজ নাই দয়াময় গিয়ে সে বাদায়।।”

ভবারাধ্য ভক্তাধীন বাধ্য ভক্তিগুণে।

হেসে কয় গোপালের এই কথা শুনে।।

“ভয় নাই হে গোপাল ভাব তুমি মিছে।

লবণ সমুদ্রে মোর যাতায়াত আছে।।

পানীয় জলের জন্য কোন চিন্তা নাই।

মধুমতী হতে জল সাথে নিতে চাই।।

মন স্থির কর তুমি চিন্তা কর বৃথা।

আমি যাহা বলি তুমি শোন সেই কথা।।

আজি তুমি চলি যাও আপনার দেশে।

পুনরায় যাত্রা করে এসো হেথা শেষে।।

সপ্তাহ পরেতে তুমি হবে উপস্থিত।

তোমার গৃহেতে যাব বলিনু নিশ্চিত।।”

দয়ালের কথা শুনি গোপাল কান্দিল।

দেশে যেতে মন করে চরণ বন্দিল।।

বিদায় মাগিয়া চলে সাধু ভাগ্যবান।

জনে জনে ডেকে তবে বলে গুরুচান।।

“কে কে তোরা যাবি আয় গোপালের বাড়ী।

গোপাল বেন্ধেছে মোরে দিয়ে ভক্তি-দড়ি।।

মনে মনে কত টান টানিয়াছে মোরে।

চল তোরা কে কে যাবি গোপালের ঘরে।।”

প্রভুর আহ্বানে সাড়া দিল বহু জন।

প্রস্তাব শুনিয়া সবে আনন্দিত মন।।

বিধু যাবে, মধু যাবে যাবে যজ্ঞেশ্বর।

যষ্ঠী যাবে বিচরণ আর’ত কেদার।।

মাধবেন্দ্র মাঝি হবে হাল নিয়ে হাতে।

কানাই বলাই যাবে প্রভুজীর সাথে।।

দুর্গাপুর থাকি বার্ত্তা পায় হরিবর।

শ্রুতমাত্র উপনীত প্রভুর গোচর।।

Page 373 start

অশ্বিনী গোঁসাই গাবে প্রেম গীতি গাঁথা।

আর কত মতো যাবে করি একত্রতা।।

এইভাবে জনে জনে হইল প্রস্তুত।

সাঙ্গোপাঙ্গো স্থির করে নিজ হরি-সূত।।

পানসী তরণী কাছে প্রভুজীর ঘাটে।

ঠিক হল প্রভু যাবে সেই নায়ে উঠে।।

আয়োজনে দিনে দিনে সময় আসিল।

আপনি গোপাল সাধু শ্রীধামে পৌছিল।।

এবে শুন ঘরে গিয়ে সাধুজী কি করে।

দেশে গিয়ে শুভ বার্ত্তা জানায় সত্বরে।।

যেই শোনে সেই বলে ধন্য মহাশয়।

তোমার গুণেতে মোরা বাধ্য অতিশয়।।

পতিতপাবনে তুমি আনিবে এ দেশে।

দেশ ধন্য হবে মোরা ধন্য হবে শেষে।।

গোপালের পত্নীদেবী কাঞ্চন জননী।

আনন্দে কান্দিল দেবী সুসংবাদ শুনি।।

পতিপদে পড়ি সতী কান্দে অনিবার।

বলে “প্রভু হেন ভাগ্য হবে কি আমার?

কোন গুণে বল নাথ আসিবে দয়াল?

কি সাধনা দিবে মোরে এ হেন কপাল?

সাধন ভজনহীনা আমি তুচ্ছ নারী।

জগন্নাথ আসিবেন কিসে আশা করি?

যা কিছু ভরসা মোর তোমার চরণ।

তব গুণে দেখা যদি দেয় নারায়ন।।

অবলা আমি যে নাথ কিছুই জানি না।

কি ভাবে পূজিব তাঁর কিছু নাহি জানা।।

শুন নাথ এক কথা মোর মনে হয়।

পেয়ে ধন পুনঃ তারে কিসে হারা হয়?

যে-ধরেন যে-যতন তাহা নাহি হলে।

অযতনে মহাধন ছেড়ে যায় চলে।।

পাওয়া কি না পাওয়া বল কার ভাল বলি?

মহাদায় সর্ব্বদায় কোন পথে চলি?

প্রাণ চায় ময়াময় দেখিব নয়নে।

মনে ভয় পাছে হায় হারাই রতনে।।

কিবা কই কিবা করি কিছু নাহি বুঝি।

অকুল সাগরে নাথ তুমি হও মাঝি।।

জীবন তরণী মোর করিয়াছি দান।

তুমি মম দেহ মন তুমি মোর প্রাণ।।

যে ভাবে চালাবে মোরে চলি সেই পথে।

আমার সকল ভার রেখেছি তোমাতে।।”

এত বলি কান্দে সতী পতি-পদ ধরি।

কথা শুনি গোপালের চক্ষে ছরে বারি।।

সান্তনা করিয়া কথা বলে তার প্রতি।

“আমার বচন ধর যা বলি সম্প্রতি।।

সত্যই বলেছ তুমি মোরা দীন হীন।

শ্রী-গুরু-চরণ চিন্তা নাহি কোন দিন।।

আমাদের গুণে নয় প্রভু নিজ গুণে।

আসিতে চেয়েছে এই ঘোর বাদাবনে।।

কি দিয়া পূজিব তাঁরে মোদের কি আছে?

কোন দ্রব্য মূল্যবান বল তাঁর কাছে?

সোনা চুণী মণি মুক্তা অথবা মাণিক।

কিসে তুষ্ট রহে হরি বল দেখি ঠিক?

কুবের ভান্ডারী যাঁয় লহ্মী সেবাদাসী।

কোন ধনে কিবা দিয়ে তাঁরে কর খুশী?

কোন ধনে তুষ্ট নহে প্রভু জনার্দ্দন।

হরি শুধু চাহে তাঁর ভকতের মন।।

ভক্তি সূত্রে মনোপুষ্পে গাঁথ প্রেম হার।

অশ্রুর চন্দন দেও তাহার উপর।।

কর জোড়ে কর পূর্ণ আপন অঞ্চলি।

রাখ অর্ঘ্য পদে তাঁর হরি হরি বলি।।

তাতে তুষ্ট জগদিষ্ট হইবে নিশ্চয়।

দীনের নৈষ্ঠিক পূজা-অন্য কিছু নয়।।

আর এক কথা দেবী আসিল স্মরণে।

“বাবা” বলে ভাব তাঁরে আপনার মনে।

Page 374 start

জগতের রীতি এই জান সবিশেষ।

পিতার সম্মুখে কন্যা নাহি ধরে বেশ।।

কাঙ্গালিনী কি দুঃখিনী কিবা আসে যায়?

পিতাকে পূজিতে তাতে কিবা বাধা রয়?

কন্যা-গৃহে পিতা যদি করে আগমণ।

তাঁর লাগি কন্যা কিবা করে আয়োজন?

দুঃখিনী কি রাজরাণী পিতা সব জানে।

পিতাকে আনিতে কন্যা ভয় পাবে কেনে?

তাই বলি মনে প্রাণে তাঁর কন্যা হও।

সগোষ্ঠী সকলে মিলে পথে চেয়ে রও।।

কমল কারনে দেখ লহ্মীর বসতি।

নারায়ণ থাকে সদা লহ্মীর সংহতি।।

নয়নের জলে সিক্ত রাখ নিজ মন।

কমল রূপেতে ভক্তি ফুটিবে তখন।।

এই ভাবে যদি দেবী পার গো থাকিতে।

আর যদি দিবারাত্র পারগো ডাকিতে।।

দীনের বান্ধব তবে করিবেন দায়।

নিজগুণে দিতে পারে স্নিগ্ধ পদ-ছায়া।।

বারে বারে বলি তাই শুন মোর প্রিয়া।

চোখে রাখ প্রেমবারি তাঁহারে ভাবিয়া।।

এত যদি বলিলেন শ্রীগোপাল সাধু।

উঠিল কাঞ্চন দেবী যে পূর্ণ বিধু।।

বলে নাথি আশীর্ব্বাদ কর অভাগীরে।

প্রভুর চরণে যেন রহে এ অন্তরে।।”

সপ্তাহ পর্যান্ত সাধু গৃহেতে রহিল।

দেশে ভক্তগণে সংবাদ পাঠাল।।

শুনিয়া সকল ভক্ত আনন্দে উতলা।

দিবানিশি ক্ষ্যান্ত নাই শুধু হরি-বলা।।

নিদ্রা জাগরণে সবে বলে হরি বল।

গুরুচাঁদে মনে করে চক্ষে বহে জল।।

ঘর দ্বার পরিস্কার করে ভক্ত গণে।

প্রাণান্ত করিছে শ্রম আনন্দিত মনে।।

এদিকে কাঞ্চন দেবী নারীগণ সঙ্গে।

ধান্য ভানি চাল করে অতি মনোরঙ্গে।।

মৃত্তিকা নির্ম্মিত মাঠে যেই চাল রাখে।

আচ্ছাদন দিয়া তার মুখ রাখে ঢেকে।।

যেখানে যে কাজ করে অন্য কথা নাই।

‘গুরুচাঁদ’ বলে সবে সদা ছাড়ে হাই।।

একমনে এক প্রাণে সবে কাজ করে।

কি পুরুষ কিবা নারী অন্দরে বাহিরে।।

কাঞ্চন জননী দেবী সর্ব্বখানে রয়।

নিজ হাতে ব্যবস্থাদি করিছে সদায়।।

চোখে তাঁর নাহি ঘুম দিবা কি রজনী।

সব কাজে ব্যস্ত মাতা যেন পাগলিনী।।

এদিকে গোপাল সাধু সঙ্গীর সহিতে।

যাত্রা করে ওড়াকান্দী শ্রী গুরু আনিতে।।

ভক্ত আর ভগবান কোন ভাব করে।

কিছু নাহি বুঝি তাহা মোরা ক্ষুদ্র নরে।।

লহ্মীখালী আয়োজন চলে নানা মতে।

এদিকেতে মহাপ্রভু ব্যস্ত অতি চিতে।।

এরে ডাকে তারে ডাকে বলে বারে বার।

লহ্মীখালী মোর সাথে চলহে এবার।।”

এভাবে চলিছে খেলা উত্তরে দক্ষিণে।

লহ্মীখালী যেতে প্রভু ব্যস্ত কত মনে।।

সপ্তাহ অতীত প্রায় এহেন সময়।

শ্রীগোপাল ওড়াকান্দী হলেন উদয়।।

প্রভুর চরণ বন্দি বসে মৃত্তিকায়।

গোপালে দেখিয়া প্রভু মহানন্দময়।।

কুশলাদি বারে বারে জিজ্ঞাসে তাঁহারে।

সংবাদ পাঠাল প্রভু সবার গোচরে।।

দলে দলে ভক্তসবে উপস্থিত হল।

তৃতীয় দিবসে প্রভু তরীতে উঠিল।।

সঙ্গে বলে বিচরণ আর যজ্ঞেশ্বর।

শ্রীবিধু চৌধুরী চলে তরুণীর পর।।

Page 375 start

মাধবেন্দ্র বসিলেন তরণীর হালে।

কেদার মিস্ত্ররী সহ যষ্ঠিবাবু চলে।।

অশ্বিনী গোঁসাই চলে আর হরিবর।

ইতি উতি কতজন চলিল বিস্তার।।

তরণী চলিল রঙ্গে উঠে জয়ধ্বনি।

পতাকায় লেখা “গুরুচাঁদের তরণী।।”

টুঙ্গীপাড়া বাসী সাধু শ্রীতপস্বীরাম।

তাঁর গৃহে নামিলেন প্রভু গুণধাম।।

তথায় থাকিয়া নিশি পরদিন প্রাতেঃ

উপস্থিত কেনুভাঙ্গা সবে হৃষ্ট চিতে।।

বিপিন গোস্বামী যিনি কেনুভাঙ্গা রয়।

উঠিলেন দয়াময় তাঁহার আলয়।।

প্রেমানন্দে কলরোল উঠি সেই বাড়ী।

কীর্ত্তনেতে মতুয়ারা যায় গড়াগড়ি।।

তথা হতে তরী খুলি চলিল দক্ষিণে।

বিপিন চলিল সাথে ভ্রমণ কারণে।।

আন্ধারমাণিক গ্রামে তারাচাঁদ রায়।

প্রভুর নৈষ্ঠিক ভক্ত সেই মহাশয়।।

সরল সহজ সাধু দেল-খোলা তাঁর।

শ্রীগুরুচাঁদের কৃপা তাঁহার উপর।।

তার গৃহে দয়াময় করিল গমন।

মহোৎসবে মতুয়ারা করিল ভোজন।।

কিছু কাল রহি সেথা তরণী ছাড়িল।

অল্পপরে বাগেরহাট শহরে আসিল।।

সেদিন হাটের বার লোকে লোকারণ্য।

অসংখ্য লোকের সংখ্যা হল সেই জন্য।।

মতুয়ারা করিতেছে সুধাময় নাম।

ডঙ্কা শিঙ্গা ধ্বনি তাতে হয় অবিরাম।।

ধ্বনি শুনি যত লোক হাটে এসেছিল।

সকলে ছুটিয়া তারা ঘাটে দাঁড়াইল।।

কাতারে কাতারে নর দাড়াইয়া রয়।

নদী মধ্যে কল কল তরী চলে যায়।।

সকলে জিজ্ঞাসা করে তরণী কাহার?

ভক্তে ডাকি বলে “ওড়াকান্দীর কর্ত্তার।।

অমনি ব্যকুল চিত্তে ধায় নর নারী।

ইচ্ছা করে দেখে তারা রূপের মাধুরী।।

উচ্চকন্ঠে ডেকে বলে তরণী ভিড়াও।

কেমন ঠাকুর তাহা মোদের দেখাও।।

হইল অপূর্ব্ব দৃশ্য তটিনীর তীরে।

প্রভু কয় “কাজ নাই বারে তোমরা জোরে।।

জোরে জোরে ভকতেরা তরী বেয়ে যায়।

হতাশায় নরনারী কুলে বসে রয়।।

ক্রমে ক্রমে মিস্ত্রীডাঙ্গা উপস্থিত হল।

গণেশ মন্ডল আসি প্রভুকে বন্দিল।।

ধনবান মান্যবান সেই মহাশয়।

তালুকদারী তেজারতি দেশ মধ্যে রয়।।

তাহার বিনয়ে প্রভু সন্তুষ্ট হইল।

দয়া করি তার গৃহে রজনী বঞ্চিল।।

বহু কথা আলোচনা হল সেই বাড়ী।

কথা শুনি সে গণেশ সুখী হল ভারী।।

প্রভুর বচন তার মুগ্ধ হল মন।

সামাজিক ব্যক্তি বটে তিনি একজন।।

মনে মনে ভাবে তবে সেই মহাশয়।

এমন মানুষ আমি দেখিনি কোথায়।।”

সেই হতে সামাজিক ক্রিয়া ছেড়ে দিল।

গোপালের পদাশ্রয়ে মতুয়া হইল।।

তথা হতে চলিলেন বেতকাটা গ্রাম।

গোপালের মামা তাঁর সোনারাম নাম।।

দেশ-মধ্যে সুপ্রসিদ্ধ বটে সেই জন।

সামাজিক ভাবাপন্ন ছিলেন তখন।।

মাধব ভাইপো তাঁর গোপালের সাথী।

অন্য তিন লহ্মীকান্ত, রাধাকান্ত রতি।।

প্রভু আগমনে তাঁরা ভাই চারিজন।

বিভেদ ভুলিয়া সবে হল একমন।।

Page 376 start

সোনারাম দেখিলেন প্রভুর চরণ।

এক দিনে এক সঙ্গে ভুলে গেল মন।।

গৃহবাসী সবে আসি মতুয়া হইল।

গোপালেরে “বাবা” বলি জামিন রাখিল।।

তাহার শরিক যত ছিল বাড়ী পরে।

‘মতুয়া’ হইল সবে মাধবেরে ধরে।।

রজনী নামেতে ছিল জ্যেষ্ঠতাত ভাই।

অন্য ঘরে নিবারণ সবে জানে তাই।।

শ্রীগুরুচাঁদের রূপ দেখিয়া নয়নে।

মাধবের সাথী হয়ে পড়িল চরণে।।

ক্রমে ক্রমে হালদার বাড়ী যত লোক।

সকলে ‘মতুয়া’ হ’ল হইয়া পুলক।।

বিশেষে রজনী ধন্য হ’ল কালে কালে।

মন প্রাণ সমর্পিল শ্রীগুরু গোপালে।।

বড়ই করুণ ছিল তাঁহার হৃদয়।

যেই যাকে তার গৃহে অধিষ্ঠান হয়।।

যেথা যায় গুণ গায় সর্ব্বদা প্রভুর।

উপাধি হইল তাঁর “দয়াল ঠাকুর।।”

গোপালের পদে নিষ্ঠা ছিল তার ভারী।

দিবারাত্র মুখে সদা বলে হরি হরি।।

গোপালের রূপ চিন্তা সদা ছিল তাঁর।

দয়াময় দয়া করি দির পুরস্কার।।

পথে যবে সে রজনী করিত ভ্রমণ।

গোপালের অনুরূপ দেখাতে তখন।।

এমনি সাদৃশ্য ছিল অঙ্গেতে তাঁহার।

কতজনে করে ভুল দেখে বারে বার।।

নিবারণ নামে যিনি পরম নৈষ্ঠিক।

দেখে রূপ দিল ডুব ছাড়ে না নিরিখ।।

অনাচারী, ব্যাভিচারি দেখিতে না পারে।

বাজে কথা বাজে কাজ নাই তাঁর ধারে।।

পুরাতন বাড়ী ছাড়ি যেই মহাজন।

মরা নদী কুলে বাড়ী করেছে এখন।।

ওড়াকান্দী লহ্মীখালী যত মতো যায়।

মেঝ কর্ত্তা নিবারণ সবে খেতে দেয়।।

গোপালচাঁদের যেন দোয়ালিয়া বাড়ী।

সতীলহ্মী পত্নী তার ভক্তিমতী নারী।।

মাধবের পত্নী নাম শ্রীবীরজা দেবী।

সরলা-স্বভাবা অতি ভক্তিমতী ছবি।।

প্রভাতী নামেতে কন্যা দেবী গর্ভে ধরে।

“প্রভাতীর মাতা” বলি সবে ডাকে তাঁরে।।

কাঞ্চন দেবীর তিনি সদা অন্তরঙ্গ।

সুললিত গানে তাঁর নামে প্রেমগঙ্গা।।

তিনিও কাঞ্চনদেবী যবে করে গান।

একমনে শুনে তাহা প্রভু গুরুচাঁন।।

গোপাল সাধুর দল বারুনীতে যায়।

দলপতি নিবারণ আগে আগে ধায়।।

এই হালদার-বাড়ী এল দয়াময়।

গোপালের দয়া বলে এই কার্য্য হয়।।

জ্ঞানবান সোনারামে বলে দয়াময়।

“এক কথা বলি শোন হালদার মশায়।।

এই যে গোপাল সাধু তব ভাগিনেয়।

কোন দিন তাঁরে তুমি ভাবিওনা হেয়।।

এঁরে মান্য কর যদি আমি বলে যাই।

দিনে দিনে হবে ভাল কোন ভয় নাই।।”

কান্দিয়া বলিল তবে সেই সোনারাম।

“দয়াময় তব আজ্ঞা আমি মানিলাম।।”

সেই হতে এক ভাবে হালদার যত।

ওড়াকান্দী নামে সদা শির করে নত।।

তথা হতে দয়াময় উঠিয়া নৌকায়।

দক্ষিণ বাহিনী হয়ে লহ্মীখালী যায়।।

দুরন্ত ঘোলার নদী ভোলা নামে খ্যাত।

হাঙ্গর কুম্ভীর তাতে ছিল শত শত।।

অতি ভয়ঙ্কর ছিল তার গতি-ধারা।

থর থর কাঁপে হিয়া দেখিলে চেহারা।।

Page 377 start

দর্পহারী দিনে দিনে দর্প চূর্ণ করে।

বান ডেকে ভোলা নদী ক্রমে গেল মরে।।

প্রভু যবে লহ্মীখালী করিল গমন।

একেবারে মরে নাই জীবন্ত তখন।।

তাই দেখি প্রভু বলে “কিবা ভয়ঙ্কর।

ভোলার ঘোলার চোটে চোখে অন্ধকার।।

ধীরে ধীরে তরী চলে নাচে নদী-জল।

মতুয়ারা তালে তালে বলে হরিবল।।

ক্রমে ক্রমে তরী আসি ঘাটেতে ভিড়িল।

নৌকা দরশনে ভক্তে আনন্দ বাড়িল।।

গৃহ হতে ঘাট হবে দূর দশ রশি।

নর নারী উপনীত সবে ঘাটে আসি।।

ঘাট হতে গৃহাবধি করিয়াছে পথ।

কিবা সে পথের শোবা বড়ই মহৎ।।

রক্তবর্ণ “শালু” বস্ত্রে সারা পথ ঢাকা।

মাঝে মাঝে পূর্ণ কুম্ভ হইয়াছে রাখা।।

কদলী বৃক্ষের সারি শোভে দুই ধারে।

সর্ব্বত্র ফুলের মালা দোলে থরে থরে।।

ঢোল ঢাক, করতাল ডঙ্কা শিঙ্গা লয়ে।

আসিল মতুয়ারগণ আনন্দে মাতিয়ে।।

ঝাঁকে ঝাঁকে হুলুধ্বনি করে নারীদলে।

তুলিয়া গ্রমের ঢেউ ভক্তে হরিবলে।।

পড়িল বিপুল সাড়া দেশের ভিতরে।

দলে দলে নরনারী ছোটে তথাকারে।।

সাধ্বী সতী গুণময়ী কাঞ্চন জননী।

ত্বরিতে চলিল ঘাটে লইয়া সঙ্গিনী।।

চোখে তাঁর বহে জল বন্ধ দুই কর।

ভাবাবেশে শুদ্ধা দেহে কাঁপে থর থর।।

খাল-পারে উপনীতা হইলা যখন।

নৌকা হতে গুরুচাঁদ করে দরশন।।

আঁখি নীরে ভাসে দেবী ভাতেবে বিহ্বলা।

কিবা সে বরাঙ্গ কান্দি রূপেতে উজলা।।

নামিলেন জগদম্বা যেন ধরা পরে।

আপন রূপের স্রোতে দিক আলো করে।।

দেবী কান্দে সঙ্গে সঙ্গে কান্দিছে সঙ্গিনী।

ঠিক যেন ব্রজপুরে গোপের গোপিনী।।

ভাব দেখি গুরুচাঁদ মহাশান্তি পায়।

সঙ্গিগণে ডাকি তবে বলে দয়াময়।।

“মাতা ঠাকুরাণী কুলে দাঁড়াইয়া রয়।

চল সবে কুলে যাই দেরী নাহি সয়।।

এতেক বলিয়া প্রভু কুলেতে আসিল।

সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গী সব কুলে উত্তরিল।।

হরিধ্বনি গুলুধ্বনি পড়ে অবিরত।

ধীরে ধীরে চলিলেন জগতের নাথ।।

যেই ক্ষণে গৃহ পরে হইল উদয়।

উঠিল প্রেমের ঢেউ ভক্তের হৃদয়।।

মহাভাবে মতুয়ারা করিছে কীর্ত্তন।

মনে হয় গৃহ করে আনন্দে নর্ত্তন।।

পালঙ্ক উপরে পাতি সুশ্বেত বিছানা।

মনোসাধে সাজায়েছে যতেক ললনা।।

প্রভু আসি বসিলেন তাহার উপরে।

হইল অপূর্ব্ব শোভা ঘরের ভিতরে।।

দীর্ঘ তালবৃন্ত পাখা করেতে ধরিয়া।

করিছে ব্যঞ্জন ভক্ত আনন্দে মাতিয়া।।

গোপালের চক্ষে সদা ঝরিতেছে জল।

নয়ন-আসরে ভাবে নরনারী দল।।

কে যেন হৃদয়ে আসি কান্দায় সবারে।

কান্দিছে ভকত সবে লহরে লহরে।।

গোপালের পরিবারে ছিল যত জন।

পতি পত্নী পুত্রকন্যা সবে একমন।।

সকলের চোখে জল দেখিয়া ঠাকুর।

আনন্দে হৃদয়-পদ্ম সদা ভরপুর।।

ভক্তাধীন ভগবান প্রীত তাহে অতি।

এবে শুন কি ঘটনা ঘটিল সংপ্রতি।

---০---