Page 493

বাঞ্ছাপূর্ণকারী হরি প্রভু গুরুচাঁদ

বাঞ্ছাপূর্ণকারী হরি হৃদয়-রঞ্জন।

গোস্বামী নকুল কহে শোন বিবরণ।।

তের শ’ চৌত্রিশ সালে প্রভু গুরু চান।

বহু ভক্ত প্রভু গৃহে করে অভিযান।।

যহোশর জিলা আর খুলনা জিলায়।

দয়া করে মহাপ্রভু বহু স্থলে যায়।।

সেই কালে গোস্বামীজী নকুল সুজন।

প্রভুকে আপন গৃহে নিতে করে মন।।

প্রভু তাতে দিল মন আনন্দ অন্তরে।

বাক্য পেয়ে সে নকুল গেল নিজ ঘরে।।

গৃহে গিয়া ভ্রাতৃ সঙ্গে আলোচনা করে।

সব শুনে ভ্রাতা তার কহে নকুলেরে।।

‘‘প্রভুজী আসিবে তাতে বড় শান্তি পাই।

কিন্তু এক কথা মনে ভেবে দেখ ভাই।।

যত ধান্য ঘরে আছে বর্তমান কালে।

কিছু যেন টানাটানি হবে মনে বলে।।

সপ্তাহ পরেতে যদি আসিতেন প্রভু।

পাকা ধান পেলে চিন্তা নাহি হত কভু।।

দাদার বচন তবে নকুল ভাবিল।

সেই ভাব হলে বটে কার্য্য হত ভাল।।

পরক্ষণে ভাবে আমি কিবা ভাবি মনে।

এ ভাব ভাবি যে শুধু আপন ওজনে।।

দয়াময় গুরুচাঁদ যেখানে উদয়।

সর্ব্ব ঘট পূর্ণ সেথা অভাব কোথায়?

এই চিন্তা করা মোর বড়ই অন্যায়।

যা হবার হোক তাই প্রভুর ইচ্ছায়।।

এত ভাবি ডাক দিয়া বলিছে দাদারে।

‘‘তার লাগি চিন্তা কভু করো না অন্তরে।।

পূর্ণ ব্রহ্ম গুরুচাঁদ যেইখানে যায়।

কিসের অভাব সেথা সব পূর্ণ রয়।।

তাঁর ইচ্ছা যাহা তাই পূর্ণ হবে ভাই।

ইচ্ছাময় ইচ্ছায় বাধা দিতে নাই?’’

এই ভাবে তারা তবে স্থির করে মন।

ভাবনার ভাব জানে পতিত পাবন।।

ভকতের শান্তি দিতে প্রভু কত ব্যস্ত।

ভকতের পাছে সদা রাখে কৃপাহস্ত।।

নকুলের চিন্তা প্রভু জানিলেন মনে।

কিভাবে পুরায় বাঞ্ছা শোন সর্ব্ব জনে।।

প্রভুর আসিতে কাবী কয় দিন আছে।

শত বর্ষ মনে হয় নকুলের কাছে।।

দিবানিশি প্রভু রূপ করিতেছে ধ্যান।

শয়নে স্বপনে কহে ‘‘কোথা গুরুচান।।’’

এই মত ভাবে সাধু কাটায় সময়।

একদিন দেখে স্বপ্ন সেই মহাশয়।।

স্বপনে দেখিল যেন নকুলের বাড়ী।

আসিয়াছে গুরুচাঁদ অকুল কান্ডারী।।

একা প্রভু নহে তাঁর সঙ্গে একজন।

মোহন মুরতি যাঁর রেশম বরণ।।

শির হতে দীর্ঘ কেশ কটি-বিলম্বিত।

অরুণ নয়ন দুটি করুণা-পুরিত।।

দীর্ঘ ভূজদ্বয় দোলে দুই পার্শ্ব দিয়া।

কুসুম কোরক রাগ সে দেহ বেড়িয়া।।

কিবা সে অতুল শোভা রাতুল চরণে।

ধরে না রূপের ঢেউ ক্ষুদ্র এ নয়নে।।

মৃদু মৃদু হাসি নাচে অধর রেখায়।

দেখা মাত্রে অগোচরে প্রাণ কাড়ি লয়।।

যত রূপ নরকুল দেখে ভুবনে।

এরূপের কাছে তুচ্ছ হয় সব মানে।।

Page 494 start

কিবা রূপ ধরে বল ফাল্গুণী জ্যোছনা?

কিবা সে ঊষার হাসি কিসের তুলনা?

কিবা সে ফুলের হাসি কিবা প্রজাপতি?

বিচিত্র ভূধর শোভা কত জানে ভাতি?

কিবা সে জননী দেখে শিশুর বদনে?

কিবা রূপ দেখে নর প্রিয়ার আননে?

এসব রূপেতে বটে রয়েছে মোহিনী।

কিন্তু চিরস্থায়ী তাহা নহে তাই জানি।।

এ সব রূপের মাঝে নহে চিরশান্তি।

এসব রূপের মাঝে আসে পরে ক্লান্তি।।

কিন্তু সেই রূপ ধরে সেই মহাজন।

তাহা দেখে শ্রান্তি ক্লান্তি আসে না কখন।।

এক দৃষ্টে সে নকুল চাহে অপলক।

অজানা ভাবে স্রোতে আনিছে পুলক।।

কেন্দে তায় পায়ে পড়ে গুরুচাঁদে কয়।

‘‘এ’ কারে আনিলে সাথে বল দয়াময়।।’’

মধুর হাসিয়া প্রভু বলে নকুলেরে।

‘‘শুন হে নকুল আমি বলি যে তোমারে।।

এই যে মোহন মূর্ত্তি এসেছে হেথায়।

মম পিতৃদেব ইনি হরি রসময়।।

শীঘ্র করি পাতি দাও তাঁহারে আসন।

বহু ভাগ্যে পেলে তুমি তাঁর দরশন।।’’

প্রভুর বচন শুনি নকুল যে নই।

কোন গুণে দিল দেখা ক্ষীরোদের সাঁই।।

বিস্মিত-পুলক চিত্তে নকুল তখন।

কেন্দে কেন্দে পাতিলেন দুইটি আসন।।

একখানি পরে বসে প্রভু দয়াময়।

অন্যখানি জুড়ে বসে হরি রসময়।।

কিবা কব নকুলের আনন্দের কথা।

ধরনী লোটায়ে সদা কুটিতেছে মাথা।।

ক্ষণে ক্ষণে আনন্দেতে করে লম্ফদান।

বলে ‘‘জয় হরিচান জয় গুরুচান।।

কোথা রে জগৎবাসি! সবে ছুটে আয়।

এমন সুদিন তোরা পাবি না রে হায়!

হরি, হর একসঙ্গে নেমেছে ভুবনে।

দেখে যা জগতবাসি দেখে যা নয়নে।।’’

এই ভাবে করে সাধু ভাবের আলাপ।

ক্ষণে ক্ষণে যেন কহে প্রেমের প্রলাপ।।

এই ভাবে কিছুক্ষণ গত হয়ে যায়।

প্রভুকে ডাকিয়া যেন হরিচাঁদ কয়।।

‘‘আর কেন চল তবে শ্রীগুরুচরণ!

অন্য ঠাঁই মোরা এবে করিব গমন।।’’

এত বলি দয়াময় ছাড়িল আসন।

সেই ভাব দেখে তবে নকুল সুজন।।

মনে ভাবে এ রতন যদি চলে যায়।

আর কেন বেঁচে থাকি বল এ ধরায়।।

হরি বিনে বল আর বেঁচি থাকি কিসে?

এখনি ত্যজিব প্রাণ হরির সকাশে।।’’

এত ভাবি মনে মনে সেই মহাশয়।

আছাড়ি পড়িল সাধু শ্রীহরির পায়।।

‘‘যেওনা, যেওনা তুমি পরাণ-হরণ।

তুমি গেলে সেই দন্ডে ত্যাজিব জীবন।।

নয়নের মণি তুমি জীবনের আশা।

তুমি ছেড়ে গেলে প্রাণ ছাড়ে দেহ-বাসা।।

দয়া করে দয়াময় এই ঘরে রও।

যদি যেতে হয় তবে অভাগারে লও।।’’

এই মত কাঁদাকাদি করিছে নকুল।

অকুল-কান্ডারী দিল অকুলেতে কুল।।

গুরুচাঁদ পানে চাহি বসে পুনরায়।

শ্রীগুরুচাঁদের অঙ্গে পলকে মিশায়।।

ঈষৎ আভাষে তাহা নকুল দেখিল।

গুরুচাঁদ অঙ্গে হরিচাঁদ লুকাইল।।

এই দৃশ্য যেই ক্ষণে দেখিবারে পায়।

তখনি ঘুমের নেশা তার কেটে যায়।।

Page 495 start

সজাগ হইয়া সাধু উঠিলেন কান্দি’।

পরদিন প্রাতেঃ বলে ‘‘যাব ওড়াকান্দী।।’’

কিছুক্ষণ পরে সাধু ওড়াকান্দী যায়।

প্রভুকে দেখিয়ে কান্দে পড়িয়া ধরায়।।

প্রভু কয় ‘‘কি নকুল কান্দ’ কি কারণ?

তোমার গৃহেতে যেতে আছে মোর মন।।’’

দুই দিন পরে প্রভু করিলেন যাত্রা।

নকুলের নাহি আর আনন্দের মাত্রা।।

গোপীনাথপুর আর সূচীডাঙ্গা গাঁয়।

দয়া করি উঠিলেন প্রভু দয়াময়।।

উপনীত হইলেন পরে বড়দিয়া।

হৃদয় ডাক্তার নিল যতন করিয়া।।

যে যে কীর্ত্তি পথে পথে করে দয়াময়।

ভ্রমণ বৃত্তান্তে দিব সেই পরিচয়।।

এই খানে নকুলেরে প্রভু দিল ছাড়ি।

বলে ‘‘শীঘ্র হে নকুল! যাও তুমি বাড়ি।।

তুমি অগ্রে যাও আমি আসিব পশ্চাতে।

কোন বাধা নাহি হবে তব গৃহে যেতে।।’’

প্রভুর বচনে সাধু গৃহে ফিরে গেল।

দুই দিন যায় তবু প্রভু না আসিল।।

আকুল হইয়া সাধু ছুটিল ত্বরায়।

মিলিল প্রভুর দেখা গ্রাম পদুমায়।।

প্রভু বলে ‘কি নকুল ব্যস্ত কেন বেশী।

অগ্রভাবে চল মোরা বেড়াইয়া আসি।।

তোমার ক্ষেতেতে দেখ আছে পাকা ধান।

সেই ধান কেটে মোরে করো অন্নদান।।’’

কথা শুনি নকুলের চোখে ঝরে জল।

মনে ভাবে অন্তর্য্যামী জেনেছে সকল।।

প্রভুর ইচ্ছার পরে নির্ভর করিল।

দশদিন পরে প্রভু তার বাড়ি গেল।।

স্বপ্ন-দৃষ্ট মত ঘরে করিল আসন।

গুরুচাঁদ দেখে বলে ‘‘অতি সুশোভন।।’’

পাকিল ক্ষেতের ধান কাটা হল সারা।

সেই ধানে চাল যত ভানিয়াছে তারা।।

সব চাল হল ব্যয় মতুয়া সেবনে।

নকুলের বাঞ্ছাপূর্ণ হল এত দিনে।।

একদিন পরে প্রভু গৃহে যেতে চায়।

আপন আসন হতে উঠিয়া দাঁড়ায়।।

সেই দৃশ্য নকুলের স্বপ্ন মনে পড়ে।

লোটায় পড়িল তবে প্রভু পদ ধরে।।

কেন্দে কয় ‘‘দয়াময়! যেয়োনা এখন।

যেয়োনা, যেয়োনা তুমি পতিত পাবন।।’’

যাহা দেখে স্বপ্নে তাহা ঘটিল বাস্তবে।

গুরুচাঁদ বলে ‘‘মোর যাওয়া নাহি হবে।।’’

নকুল চাহিয়া দেখে গুরুচাঁদ অঙ্গে।

মোহন মুরতি পশে প্রেমের তরঙ্গে।।

শ্রীগুরুচাঁদের লীলা সুধাধিক সুধা।

কবি কহে খেলে দুরে যায় ভব-ক্ষুধা।।

---০---