Page 261

“দরবার মেডেল প্রাপ্তি”

তের শত ষোল সালে বারুণী সময়।

বিধবা বিবাহ দিতে প্রভু আজ্ঞা দেয়।।

তের শ’ সতের সালে জিলা বরিশালে।

মাঠিভাঙ্গা গ্রামে বাস মধুমতী কুলে।।

Page 262 start

দুই ভাই জ্যেষ্ঠ তার নাম ধনঞ্জয়।

বিধবা বিবাহ করে প্রভুর আজ্ঞায়।।

তস্য এক ভগ্নী ছিল স্বামীহীনা নারী।

শ্রীনাথের সঙ্গে বিয়া হল বটে তারি।।

এ-সময় স্বামী মহানন্দ বেঁচে নাই।

তাঁর যত ভক্ত ছিল সব ছাড়ে হাই।।

তের শ’ আঠার সালে ‘চন্ডাল’ মোক্ষণ।

করিলেন গুরুচাঁদ পতিত পাবন।।

তের শ’ ঊনিশ সালে দীল্লী দরবার।

এবে সবে শুন বলি সেই সমাচার।।

বঙ্গ-ভঙ্গ আন্দোলন বাঙ্গালী করিল।

আন্দোলন কালে বঙ্গ একত্র হইল।।

সপ্তম এডওয়ার্ড রাজা জীবন ত্যজিল।

শ্রীপঞ্চম জর্জ্জ তাহে সম্রাট সাজিল।।

ভারত সম্রাট তিনি ইংল্যান্ডের রাজা।

কোটী কোটী নরনারী সবে তাঁর প্রজা।।

“ভারত সম্রাট” আখ্যা হইল তাঁহার।

দিল্রী নগরীতে তাই হল দরবার।।

বঙ্গভঙ্গ রদ বটে করিল সম্রাট।

দিল্লী নগরীতে গেল রাজধানী পাট।।

রাজভক্ত সম্মানিত যত প্রজা ছিল।

“দরবার মেডেল” দিয়া সম্মান বাড়াল।।

জেলায় জেলায় হল সেই দরবার।

কি হল ফরিদপুরে শুন সমাচার।।

যে সময়ে জ্যৈষ্ঠ মাসে ছোট লাট এল।

জেলাবাসী প্রধানেরা উপস্থিত ছিল।।

সংখ্যায় বায়ান্ন জন বসে মান্যবান।

ছোট লাট আগমনে ছিল অধিষ্ঠান।।

ম্যাজিষ্ট্রেট লিখিলেন লাটের নিকটে।

মেডেল পাইতে এরা উপযুক্ত বটে।।

নমঃশূদ্র সমাজেতে শুধু গুরুচান।

সর্ব্বাগ্রে মেডেল খানি তিন মাত্র পান।।

তের শ’ ঊনিশ সালে মার্গ শীর্ঘ মাসে।

নিমন্ত্রণ চিঠি গেল ওড়াকান্দী বাসে।।

স্বজাতি ডাকিয়া প্রভু সকলি বলিল।

সকল শুনিয়া তারা আনন্দিত হল।।

সকলে প্রভুকে যেতে করে নিবেদন।

সাথী হল বিশ্বেশ্বর চৌধুরী সুজন।।

তরাইল হতে দোঁহে গেল খুলনায়।

তথা হতে পৌঁহিছিল সে কলিকাতায়।।

ফরিদপুরেতে পরে হইল উদয়।

কুমুদ মল্লিক বাবু আছিল তথায়।।

ডেপুটী কার্য্যেতে তথা ছিল অধিষ্ঠান।

ঠাকুরে সঙ্গেতে করি নিজ গৃহে যান।।

বহু সুখে আলাপন করিলেন দোঁহে।

হাসিয়া হাসিয়া প্রভু বহু কথা কহে।।

ক্রমে ক্রমে জিলাবাসী সকলে জানিল।

দরবার মেডেল নিতে নমঃশূদ্র এল।।

উচ্চ বর্ণ হিন্দু তাতে কেহ সুখী নয়।

কেহ কেহ ম্যাজিষ্ট্রেটে সে কথা জানায়।।

শুনিয়া সাহেব কহে “একি কথা কাও।

মেডেল দিবার কর্তা তোমরা ত নও।।

রাজার নিকটে প্রজা সকলি সমান।

জাতি-কুল-নির্ব্বিশেষে সবে পাবে মান।।

বড়ই দুঃখিত আমি শুনি এই কথা।

তোমাদের পক্ষে ইহা শুধু বাচালতা।।”

এমত শুনিয়া বাণী ম্যাজিষ্ট্রেট কাছে।

লজ্জা পেয়ে বর্ণ হিন্দু পলাইল পাছে।।

ঘরে গিয়ে জনে জনে করে আলোচনা।

এমত অন্যায় বিধি মোরা মানিবনা।।

হেন কালে এক ব্যক্তি নামেতে সুরেন্দ্র।

ওকালতী কার্য্য করে জাতি উচ্চ বর্ণ।।

পুত্র সহ সেই ব্যক্তি এল তথাকারে।

সকলি শুনিল কথা স্বজাতি গোচরে।।

Page 263 start

সকল শুনিয়া তিনি ধীরে ধীরে কয়।

তোমাদের এই চিন্তা অতীব অন্যায়।।

কার প্রতি হিংসা কর বুঝিতে না পার।

সময় থাকিলে সবে আপনারে সার।।

নমঃশূদ্র বলি যারে কর অবহেলা।

আমার নিকটে শোন তাঁর এক খেলা।।

তোমাদের মত পূর্ব্বে ভাবিতাম আমি।

গর্ব নাশ করিয়াছে নিজে অন্তর্য্যামী।।

সেই ঘটনার কথা শুন সবে বলি।

গুরুচাঁদ ঠাকুর যে ধর্ম্ম-বলে বলী।।

এই দেখ পুত্র মোর দাঁড়ায়ে সম্মুখে।

আনন্দের দীপ্তি দেখ এর চোখে মুখে।।

এই মাত্র গুরুচাঁদে দেখিলাম মোরা।

সেই আনন্দের ঢেউ ওর দেহে ভরা।।

কি কারণে ইহা হয় শুন বলি তাই।

গুরুচাঁদ নিকটেতে বৃথা যাই নাই।।

বহু দিন রোগে ভোগে আমার তনয়।

ডাক্তার বৈদ্যের বাড়ী যাই সর্ব্বদায়।।

ভারে ভারে ঔষধাদি সেবন করাই।

রোগ নাহি সারে তাতে ফল নাহি পাই।।

বড়ই দুশ্চিন্তা হল মনে নাই শান্তি।

দিনে দিনে ক্ষীণ পুত্র ম্লান হল ক্লান্তি।।

হেন কালে একদিন নিশীথ সময়।

অপরূর স্বপ্ন দেখে আমার তনয়।।

রজনী প্রভাতে মোরে কাছে ডাকি লয়।

স্বপ্নের বৃত্তান্ত সব মোর ঠাঁই কয়।।

বলে “পিতা শোন কথা স্বপ্ন বিবরণ।

নিশাকালে মোর কাছে এল একজন।।

মধুর মূরতি তাঁর গৌরাঙ্গ বরণ।

আজানুলম্বিত ভূজ আয়ত লোচন।।

হাসি হাসি মোরে বলে “ওরে বাছাধন।

রোগে ভোগে এত কষ্ট পাও কি কারণ?

আমি যাহা বলি তাহা কর একমনে।

অবশ্য রোগেতে মুক্তি পাবে একদিনে।।

পান্তাভাত প্রাতঃকালে উদর পূরিয়া।

ইলিশ মাছের সঙ্গে খাবে মাখাইয়া।।

এত বলি সর্ব্বাঙ্গে হাত বুলাইয়া দেয়।

মনে হয় মোর দেহে রোগ বুঝি নাই।।

আনহে ইলিশ বাবা তাই আমি খাই।

পুত্র মুখে এই কথা শুনিলাম যবে।

ইলিশ মাছের চেষ্টা করিলাম তবে।।

পরদিন প্রাতঃকালে ‘পান্তভাত’ দিয়া।

দিলাম ইলিশ মাছ নিজে মাখাইয়া।।

যেই মাত্র খায় ভাত জ্বর সেরে যায়।

দিনে দিনে স্বাস্থ্য তার ক্রমে ভাল হয়।।

ঘটনা দেখিয়া সদা এই ভাবি মনে।

কোথায় পাইব দেখা সেই মহাজনে।।”

এই ছয় মাস গত এমন চিন্তায়।

অদ্য দেখা দিয়াছেন সেই মহাত্মায়।।

গুরুচাঁদ আসিয়াছে রাজ-দরবারে।

বসতি করিছে তিনি ডেপুটীর ঘরে।।

পুত্র সহ সেই পথে আমি যবে যাই।

গৃহ মধ্যে গুরুচাঁদে দেখিবারে পাই।।

গুরুচাঁদে দেখে মোর পুত্র বলে ডাকি।

‘ঐ সে ঠাকুর বাবা যাঁরে স্বপ্নে দেখি।।”

কথা শুনি জ্ঞানহত আমি চেয়ে রই।

পুত্র বলে বারে বার “বাবা তিনি অই”।।

বিষম সন্দেহ মনে হই আগুসার।

প্রণাম করিল পুত্র চরণে তাঁহার।।

সস্নেহে তাহার অঙ্গে হস্ত বুলাইয়া।

জিজ্ঞাসিল গুরুচাঁদ হাসিয়া হাসিয়া।।

“কেমন সংবাদ খোকা সারিয়াছে জ্বর?

খেয়েছ ইলিশ মাছ পান্তার ভিতর?”

Page 264 start

আশ্চর্য্য মানিয়া আমি ভাবি মনে মনে।

“এ তত্ত্ব ঠাকুর তবে জানিল কেমনে?

এ নহে সামান্য কেহ বুঝিনু নিশ্চয়।

কুলমান ফেলে দিয়ে পড়ি তাঁর পায়।।

যে সব শুনেছি কথা আমি তাঁর ঠাঁই।

এ জীবনে হেন কথা আর শুনি নাই।।

তাই বলি ছাড় হিংসা ছাড় গন্ডগোল।

হিংসাতে টানিয়া আনে অনর্থ কেবল”।।

এত বলি গেল চলি সেই মহাশয়।

বর্ণ হিন্দু সব তাত চুপ করি রয়।।

হইল মধ্যাহ্ন বেলা গগন উপরে।

সভাসদ চলিলেন দরবার ঘরে।।

বায়ান্ন জনের লাগি ‘মেডেল’ আসিল।

তারা সবে ধীরে ধীরে গৃহ মধ্যে গেল।।

আপন আসনে বসি চুপ করি রয়।

সর্ব্ব শেষে গুরুচাঁদ সভাতে উদয়।।

কুমুদ বিহারী বাবু সঙ্গে সঙ্গে চলে।

রূপের তরঙ্গ যেন পড়িছে উথলে।।

যত নমঃশূদ্র ছিল সেই সহরেতে।

সকলে হাঁটিয়া চলে প্রভুর পশ্চাতে।।

ধীর পদে অগ্রভাগে গুরুচাঁদ চলে।

কাজ ফেলে চেয়ে রয় নর-নারী দলে।।

মনোলোভা কিবা শোভা বলিহারি যাই।

সবে বলে ‘হেন রূপ আর দেখি নাই।।

রূপের তরঙ্গ যেন করে ঝিকিমিকি।

রূপ দেখে কেহ নারে পালটিতে আঁখি।।

দোকানী দোকান করে বসিয়া দোকানে।

বেচাকিনি ছাড়ি রূপ দেখে দু’নয়নে।।

পথচারী পথ চলে ব্যস্ত নিজ কাজে।

সে দেখিল গুরুচাঁদে অপরূপ সাজে।।

হাঁটা ভুলি আঁখি তুলি শুধু চেয়ে রয়।

মনে ভাবে এ মানুষ আছিল কোথায়।।

দুই সারি বাড়ী বাড়ী নর নারী যত।

এক দৃষ্টে রহে চেয়ে পুত্তলিকা মত।।

সবে কয় “কেবা হেন মোহন মূরতি।

রূপ দেখে মনে হয় ইনি লহ্মীপতী।।”

এই ভাবে গুরুচাঁদ অগ্রসর হয়।

দরবার গৃহে আসি হইল উদয়।।

কুমুদ বিহারী আর প্রভু দয়াময়।

এক সঙ্গে গৃহ মধ্যে প্রবেশ করয়।।

দরবার গৃহে যবে উপনীত হল।

বিস্ময়ে সকল লোকে চাহিয়া রহিল।।

পরিচয় জিজ্ঞাসিতে কেহ করে মন।

শ্রীগিরশ সেন বাবু বলিল তখন।।

‘ভদ্র মহোদয় যত শুনুন এখন।

নমঃশূদ্র বটে হন এই মহাজন।।

ওড়াকান্দী বাসী নাম শ্রীগুরুচরণ।

বিশ্বাস উপাধি ছেড়ে ঠাকুর এখন।।”

উৎপ্রেক্ষা মতে কথা বলিল গিরীশ।

নমঃশূদ্র পক্ষে তাহা হইল আশীষ।।

গিরীশের বাক্যে কেহ নাহি দিল সায়।

ব্যর্থকাম সে গিরীশ বহু লজ্জা পায়।।

প্রভুকে করিয়া সঙ্গে কুমুদ বিহারী।

চলি গেল অগ্রভাগে অতি ত্বরা করি।।

অগ্রভাগে একখানি আসন যে ছিল।

তথা আসি শ্রীকুমুদ প্রভুকে কহিল।।

‘এ আসনে এই ক্ষণে বসুন আপনি।

কর্ণে নাহি তুলিবেন প্রলাপ কাহিনী।।

যদি কেহ কোন কথা বলিবারে চায়।

“ম্যাজিষ্ট্রেট জানে সব” বলিবে তাহায়।।

এত বলি সে কুমুদ গেল অন্য ঠাঁই।

প্রভু বলে “মোর লাগি কোন চিন্তা নাই।।

লর্ড কারমাইকেল আসিলেন পরে।

উঠিয়া দাঁড়ায় সবে দরবার ঘরে।।

Page 265 start

আসন গ্রহণ করি বসিলেন লাট।

অপরূপ শোভা হল দরবার পাট।।

রজন নির্ম্মিত ছিল মেডেল সকল।

চন্দ্র করজ্যোতিঃ সব করে ঝলমল।।

একে একে ম্যাজেষ্ট্রেট পড়িলেন নাম।

রাজ-সম্মানিত যত ছিল গুণধাম।।

এক এক জন করি লাটের সম্মুখে।

উপস্থিত হল সবে পরম পুলকে।।

নিজ হাতে লাট তবে মেডেল পরায়।

শির নত করি সবে সম্ভ্রম জানায়।।

মহাপ্রভু গুরুচাঁদ আসিলেন ধীরে।

আপনি উঠিয়া লাট তাঁর হস্ত ধরে।।

সম্মান করিয়া পরে মেডেলটী দেয়।

মেডেল পাইয়া প্রভু নিজাসনে যায়।।

সকলে মেডেল দিয়া বসিলেন লাট।

“এব শেষে হ’ল এই দরবার পাট।।

এই দরবারে যাঁরা ‘মেডেল’ পেয়েছে।

রাজ-পরিচিত তারা সবে হইয়াছে।।

এদেশে প্রধান তাঁরা জানিল সম্রাট।

দরবার শেষ হ’ল বলিলেন লাট।।

মেডেল পাইয়া প্রভু আসিলেন বাসে।

নমঃশূদ্র সবে তাহে প্রেমানন্দে ভাসে।।

রাজ-পরিচিত হ’ল স্বজাতি সমাজ।

নমঃশূদ্র সবে তাহে প্রেমানন্দে ভাসে।।

আপনি করিয়া কৃপা পতিতে তরা’ল।

হরি-গুরুচাঁদ প্রীতে হরি হরি বল।।

---০---