Page 512

গোপালচাঁদের প্রতিশ্রুতি ও প্রমথরঞ্জনের বিলাত গমন

প্রমথরঞ্জন দুঃখে কাটাইছে কাল।

হেনকালে ওড়াকান্দি আসিল গোপাল।।

যাদব নকুল এল আসিল বিপিন।

উপনীত হ’ল সবে রথযাত্রা দিন।।

Page 513 start

প্রভুর কার্যের ধারা নরে অগোচর।

দেশে দেশে জানিয়াছে সবে সমাচার।।

শ্রীগুরুচাঁদের পৌত্র প্রমথরঞ্জন।

শিক্ষা লাগি করিবেন বিলাত গমন।।

মতুয়ারা সবে তা’তে সুখী অতিশয়।

সবে বলে “হ’ল তবে সুদিন উদয়।।”

কিন্তু ওড়াকান্দি এসে দেখে ভাবান্তর।

তার জন্য মনে দুঃখ হ’ল সবাকার।।

একে একে বার্তা যত সকল শুনিল।

প্রধান মতুয়াবর্গ একত্র হইল।।

সবে মিলে করিলেন শুভ আলোচনা।

এই কার্যে বাধা হ’তে কিছুতে দিবে না।।

সবে চল “চল যাই প্রভুর নিকটে।

তাঁর কাছে সব কথা বলি অকপটে।।

‘অর্থ বলে’ বাধে যদি কোন গোলমাল।

প্রভুর সঙ্গেতে মোরা দিব তবে তাল।।

যার যে শক্তি আছে সেই ভাবে মোরা।

সাহায্য করিব এই কথা হ’ল সারা।।”

অতপর দলে বলে সব সাধু যায়।

প্রভুর নিকটে গিয়া হইল উদয়।।

অগ্রণী হইয়া কথা কহিল যাদব।

চারিদিকে বসে শোনে মতুয়ারা সব।।

যাদব কহিছে “বাবা করি নিবেদন।

দেশে বসে শুনিলাম এক বিবরণ।।

ঘরে ঘরে রটিয়াছে এই শুভ বার্তা।

বিলাতে পাঠা’বে পৌত্র ওড়াকান্দির কর্তা।।

বড় সুখে ওড়াকান্দি আসিলাম তাই।

এখানে ত’ বাবা তার কোন চিহ্ন নাই।।

কি কারণে লোকে ইহা করিল রটনা।

আমরা শুনিব বাবা সে সব ঘটনা।।”

যাদবের কথা শুনি প্রভু ডেকে কয়।

যা’ রটে তা’ বটে কিন্তু সবখানে নয়।।

আমার ত’ ইচ্ছা ছিল পাঠাতে বিলাতে।

সুধন্যের মনে মনে ভয় হ’ল তা’তে।।

বিলাত ধনীর দেশ ধনে জনে ভরা।

গরীবের সাধ্য নাকি নহে বাস করা।।

একে ত’ প্রাচীন আমি তা’তে মনে ভয়।

কি জানি কি কোনদিন কি জানি কি হয়।।

একে ত’ বিলাত তা’তে বহুদূর পাল্লা।

আমাতে সম্ভব নহে সে সব ঝামেলা।।

এই দেশে যতদূর পড়াশোনা হয়।

তা’তে নাকি কাজ হ’বে সুধন্য তা’ কয়।।

ধীরে ধীরে কহে প্রভু উদাসীর সুরে।

মুখে বটে নাহি বলে বেদনা অন্তরে।।

কথা শুনি মতুয়ারা বহু দুঃখ পায়।

হেনকালে শ্রীগোপাল দাঁড়াইয়া কয়।।

“কিছু বলিবারে বাবা সাহস না পাই।

তবু এক কথা আমি জানিবারে চাই।।

আমরা যতেক আছি মতুয়ারগণ।

মোরা সবে ব্যয়ভার করিলে গ্রহণ।।

তাহলে কি বড় বাবু যেতে সেথা পারে?

দয়া করে সেই কথা বলুন আমারে।।”

প্রভু বলে “যেতে দিতে বাধা নাই কোথা।

তোমরা বোঝ না কেন আসল যে কথা।।

আমার বড়ই সাধ যাইবে প্রমথ।

কিন্তু বল কোথা পাব অর্থ আমি এত?”

পুনরায় সে গোপাল করজোড়ে কয়।

“এক কথা বলি বাবা আমি পুনরায়।।

কত টাকা লাগে বাবা এই শুভ কর্মে।

বড়ই বেদনা আমি পাইয়াছি মর্মে।।”

প্রভু ডেকে কয় “তুমি শুন হে গোপাল।

এই কাজে টাকা দিয়ে পায় না নাগাল।।

রাজা বাদশাহ যারা আছে এই দেশে।

তারা টাকা দিতে পারে বটে অনায়াসে।।

Page 514 start

আমরা দরিদ্র জাতি অর্থবিত্ত শূন্য

বিশেষতঃ মেজবাবু আছে মনঃক্ষুণ্ণ।।

এই বৃদ্ধ বয়সে আমি বল পা’ব কোথা?

কিবা করি ফল নাই করিয়া মমতা।।

তোমরা মতুয়া যত মোরে ভালবাস।

সর্বদায় সকলে ত’ ওড়াকান্দি আস।।

তোমাদের যে অবস্থা সব আমি জানি।

তোমাদের পক্ষে ইহা অসম্ভব মানি।।

অধিক কি ক’ব আমি গরীব আচারে।

চৌদ্দ হাজার টাকা হ’লে হ’তে পারে।।

বল দেখি এই টাকা কেবা মোরে দিবে।

নিশ্চয় বুঝিনু বাঞ্ছা পূর্ণ নাহি হ’বে।।”

প্রভুর কণ্ঠেতে বাজে বিষাদের সুর।

মনে হয় প্রাণ যেন দুঃখে ভরপুর।।

শুনিয়া সকল কথা গোপাল বসিল।

মাথা হেট করে তবে ভাবিতে লাগিল।।

কিবা ল’য়ে ওড়াকান্দি আমি আসিলাম।

বাবার দয়ার পরে কত কি পেলাম।।

ঋণগ্রস্ত হ’য়ে আসি ওড়াকান্দি ধামে।

ঋণ কোথা? আছি আজ পরম আরামে।।

গ্রন্থ ছাপাইতে বাবা ক’টি টাকা নিল।

এক গুণে নিয়ে প্রভু শতগুণে দিল।।

যা’ কিছু হয়েছে মোর সব দিল তিনি।

অনন্ত দয়ার সিন্ধু প্রভু গুণমণি।।

অর্থ কড়ি জমা জমি সব দে’য়া তাঁর।

আমি ত’ প্রহরী শুধু দয়ায় তাঁহার।।

তাঁর কার্যে তাঁর ধন আমি নিতে কই।

বাবা ব্যাথা পায় আমি কেন বসে রই?

এত ভাবি সে গোপাল উঠিয়া দাঁড়া’ল।

করজোড় করি তবে কান্দিতে লাগিল।।

তাহা দেখি প্রভু বলে “কি বল গোপাল?

যা’ বলিতে চাও বল সকাল সকাল।।”

গোপাল বলিছে “বাবা করি নিবেদন।

দাসের অযোগ্য আমি অতি অভাজন।।

কোন কিছু বলা মোর সম্ভব না হয়।

যা বলি সকলি বলি তোমার দয়ায়।।

মূর্খ আমি মনে মনে যাহা বুঝিয়াছি।

শ্রীচরণে নিবেদন সব করিতেছি।।

মনে কয় বড় বাবু বিলাতেতে গেলে।

সকলে উদ্ধার হ’বে এই নমঃকুলে।।

আজ দেখি আসিয়াছে পরম সুযোগ।

নমঃশূদ্র পক্ষে ইহা অতি শুভযোগ।।

নাহি জানি মেঝে বাবু কিসে ভয় পায়।

কাঙ্গালের মনে বাবা এক কথা কয়।।

আমি দীন অতি ক্ষীণ নাহি জ্ঞান কাণ্ড।

আমাকে করেছ রক্ষা দিয়ে কৃপাদণ্ড।।

কত দয়া অভাগারে করিয়াছ তুমি।

সে সব দয়ার কথা কত ক’ব আমি?

অফুরন্ত দয়া বাবা শেষ নাহি তার।

দয়ায় দয়ায় ভরা দয়ার পাথার।।

কে বল চিনিত বাবা এই দীনহীনে।

তব কৃপা গুণে আজ দেশে দেশে চেনে।।

কি যে সে পরশমণি তব নামে রয়।

নাম নিলে মহাভণ্ড মহাসাধু হয়।।

পাতকী নারকী হোক তা’তে বাধা নাই।

গুরুচাঁদ নাম নিলে হয় সে গোঁসাই।।

কি ক’ব পরের কথা সাক্ষী আমি নিজে।

ভাল কিছু করি নাই কভু কোন কাজে।।

আমাকে তরা’বে বলে খেল এক খেলা।

যে কালে ছাপালে বাবা শ্রীহরির লীলা।।

অর্থাভাবে “গ্রন্থ” নাকি ছাপা নাহি হয়।

সে সব চাতুরী বাবা মোর মনে কয়।।

দিবানিশি লক্ষ্মী যার পদসেবা করে।

অর্থাভাব হল শেষে লক্ষ্মীপতি ঘরে?

Page 515 start

সাগর তৃষ্ণার্ত হয় পাহাড় কোমল?

নাগে ভীত হল খগপতি মহাবল।।

তেজ হীন হল সূর্য শীতে করে ভয়?

যম পাশে ভীত হল প্রভু মৃত্যুঞ্জয়?

হনুমান ভীত হল দেখে দুষ্ট চেড়ী।

নারায়ণে বন্দী করে দিয়ে মায়া বেড়ী?

এসব সম্ভব যথা নহে কোন কালে।

মনে হয় “অর্থাভাব” বল সে কৌশলে।।

কোন ভাবে কারে দয়া করিতেছ তুমি।

মানুষে জানে না তাহা ওহে অন্তর্যামী!

সেই কালে অভাগারে করুণা করিলে।

দয়া করে গুটি কত টাকা মাত্র নিলে।।

নিলে যাহা তুচ্ছ তাহা কিছু মূল্য নাই।

প্রতিদানে শতগুণে দিনে দিনে পাই।।

আমি ত’ বুঝেছি বাবা! যত কিছু দিলে।

তোমার ঘরের ধন ঘরেতে রাখিলে।।

আমার কর্মেতে যদি সে সব আসিত।

বহুপূর্বে মোর ঘরে তারা দেখা দিত।।

যেই মাত্র ওড়াকান্দি আনিলে আমারে।

ধন মান সব তবে গেল মোর ঘরে।।

তা’তে বলি সেই সব মোর গুণে নয়।

সকলি হয়েছে বাবা তোমার দয়ায়।।

মোর ঘরে যাহা কিছু সকলি তোমার।

প্রহরী সাজিয়া আমি রক্ষা করি দ্বার।।

নিবেদন তাই পদে দয়াল ঠাকুর।

দয়া করে এ জাতির দুঃখ কর দূর।।

চৌদ্দ হাজার নিলে যদি কার্য হয়।

লক্ষ্মীখালী বাড়ী হতে আন দয়াময়।।

যে ধন রেখেছ সেথা সকলি তোমার।

প্রার্থনা মঞ্জুর কর এই অভাগার।।”

এত বলি সে গোপাল পড়ে ভূমিতলে।

বয়ান ভাসিয়া যায় নয়নের জলে।।

চারিদিকে মতুয়ারা ফুকারিয়া কান্দে।

অঙ্গ ঝাঁকি দিয়া তবে বলে গুরুচান্দে।।

“কি কথা শুনালে মোরে গোপাল গোঁসাই।

তব তুল্য লোক দেখি ত্রিভুবনে নাই।।

রাজা মহারাজা যাতে সাহস না পায়।

সে সাহস বল তুমি পেয়েছ কোথায়?

এত টাকা বল তুমি কোথা হতে দিবে?

কার্যে অগ্রসর হলে ফেরা নাহি যাবে।।

এমন সাহস বল কে দিল তোমায়?

চৌদ্দ হাজার টাকা অল্প স্বল্প নয়।।”

প্রভুর বচন শুনি কহিছে গোপাল।

“কিসের সাহস মোর আছে বা দয়াল!

বল কি সাহস মোর অন্য কিছু নাই।

বলাবল সব তুমি জগত গোঁসাই।।

আমি কোথা টাকা পাব কোথা হ’তে দিব।

তোমার যা’ আছে ঘরে তাই হ’তে নিব।।

জমাজমি ধান চাল যত কিছু আছে।

তোমাকে আনিয়া দিব তোমার তা’ বেচে।।”

পরীক্ষা হইল শেষ প্রভুজী হাসিল।

আনন্দে মাতিয়া তবে কহিতে লাগিল।।

“ও! যাদব! ও! বিপিন! শোন হে নকুল।

এই যে গোপাল সাধু সেজেছে বাতুল।।

ছেলে আছে মেয়ে আছে আছে আত্মজন।

তার জন্য চিন্তা বেটা করে না কখন।।

জমাজমি বেচে কিনে মোরে দিতে চায়।

মনে ইচ্ছা প্রমথেরে বিলাতে পাঠায়।।

এ বল কেমন লোক কেমন পরাণ?

রাজা বাদশাহ নহে ইহার সমান।।

আপনার সব বেচে দিতে চায় মোরে।

আজ হতে সে গোপাল কিনিল আমারে।।

যে কাজ করিল সাধু তার তুল্য নাই।

ভবিষ্যৎ কথা আমি কিছু বলে যাই।।

Page 516 start

চন্দ্র সূর্য যতকাল আছে ধরা ‘পরে।

গোপালের নাম সবে কবে ঘরে ঘরে।।”

প্রভুর বচন শুনে গোপাল বেহুঁশ।

মতুয়ারা সবে বলে “কি ধন্য! পুরুষ!”

প্রেমের তরঙ্গ উঠে ওড়াকান্দি বাড়ী।

প্রেমানন্দে মতুয়ারা বলে হরি হরি।।

হেনকালে দাঁড়াইল গোস্বামী নকুল।

প্রভুর বচন শুনে ভাবে প্রেমাকুল।।

বলে “বাবা এক কথা করি নিবেদন।

জানি তুমি দয়াময় পতিত পাবন।।

তারিত পতিত জনে করিতেছ খেলা।

দিনে দিনে দেখি কত প্রেমময় লীলা।।

যে পথ দেখাল আজি গোপাল গোঁসাই।

সেই পথে সাথে সাথে মোরা যেতে চাই।।

আমি বলি যত মতো’ আছে দেশে দেশে।

এ কার্যে সাহায্য দিবে আনন্দেতে এসে।।

তাই বলি বড় বাবু যাউক বিলাতে।

মতুয়ারা দিবে টাকা তাহারে পড়াতে।।”

গোস্বামী নকুল যদি সেই কথা কয়।

যাদব, বিপিন সবে উঠিয়া দাঁড়ায়।।

আর যত মতো’ ছিল সকলে উঠিল।

নকুলের বাক্যে তারা সবে সায় দিল।।

ভক্তের মিনতি শুনি প্রভুজী তখন।

বলিতে লাগিল কথা অতি হৃষ্টমন।।

“শুন শুন সাধুগণ আমার বচন।

তোমাদের বাক্যে আমি আনন্দে মগন।।

সবে মিলে যেই কার্য আজিকে করিলে।

প্রমথরঞ্জনে আজি তোমরা কিনিলে।।

আজ হ’তে সে তোমাদের হইল ঠাকুর।

তোমাদের মনোব্যাথা করিবে সে দূর।।

সুধন্যকে একবার ডাক’ এইখানে।

তারে কিছু কথা আমি বলিব এখনে।।”

প্রভুর আজ্ঞায় তবে একজন গিয়ে।

সুধন্য বাবুকে সেথা আনিল ডাকিয়ে।।

পিতার নিকটে আসি দাঁড়াইয়া রয়।

তার প্রতি চাহি তবে বলে দয়াময়।।

“আমার বচন শোন সুধন্য সুজন।

তোমাকে করেছি আমি সংসার অর্পণ।।

চারি পুত্র মধ্যে মাত্র তুমি আছ বেঁচে।

সকলে আব্দার তাই করে তব কাছে।।

মনে মোর ছিল সাধ এই বংশ হ’তে।

একটি বালক আমি পাঠা’ব বিলাতে।।

আমার পিতার কথা সদা মনে জাগে।

পথ পা’বে নমশূদ্র সকলের আগে।।

প্রমথকে পাঠাইতে ইচ্ছা ছিল মনে।

সে কার্যে তোমার তত উৎসাহ দেখিনে।।

আমি বলি সে প্রমথ যেতে যদি চায়।

সেই কার্যে বাধা দে’য়া উচিৎ না হয়।।

অবশ্য যে সব তুমি বলেছ বচন।

অযৌক্তিক তাহা আমি বলি না কখন।।

এত বড় কাজ করা একার কি সাধ্য?

সে সব কথায় বটে আছি আমি বাধ্য।।

কিন্তু দেখ ঠাকুরের ইচ্ছা কি সুন্দর।

কোন ভার থাকিল না মোদের উপর।।

যার কাজ তিনি নিজে নিল আজ হাতে।

সেই কথা হ’ল এই মতুয়া সভাতে।।

বাবার যতেক ভক্ত এই বাড়ী আসে।

বাবার গুণেতে তারা মোরে ভালবাসে।।

তারা সবে এইমাত্র বলেছে আমারে।

বিলাত পাঠাবে তারা সেই প্রমথরে।।

যত টাকা লাগে তারা দিতে তা’ স্বীকার।

একাই গোপাল দিবে চৌদ্দটি হাজার।।

মতুয়ারা কিনে নিতে চায় সেই ছেলে।

আমি তা’তে বাধা বল দিব কিবা বলে?

Page 517 start

তাই বলি মতুয়ারা বলিছে যখন।

সুস্থ মনে অনুমতি দেও গে’ এখন।।”

সকল শুনিয়া তবে মেঝে বাবু কয়।

“অনুমতি দিতে বাধা মোটে নাহি রয়।।

আপনার জন সব মতুয়ার গণ।

তারা সবে করিয়াছে যখনে এ’ মন।।

তা’তে বুঝি এই কার্যে মোটে সন্দ’ নাই।

অনুমতি দিতে আর বাধা মোটে নাই।।”

এত বলি মহাশয় গেল নিজ ঘরে।

মতুয়ারা এক সঙ্গে পরামর্শ করে।।

শীঘ্র শীঘ্র বড় বাবু প্রস্তুত হইয়া।

বিলাতে করুণ যাত্রা টিকিট কাটিয়া।।

কিছু কিছু টাকা সবে এ সময়ে দিব।

প্রভুকে লইয়া পরে ভ্রমণ করিব।।

পরামর্শ শেষ করি প্রভুকে জানায়।

প্রভুজী বলিল “ইহা কথা মন্দ নয়।।”

এ সময়ে বড় বাবু গৃহে নাহি ছিল।

পত্র যোগে সব কথা তাহারে জানা’ল।।

“পাসপোর্ট” ব্যবস্থাদি করিতে লিখিয়া।

টিকিটের মূল্য প্রভু দিল পাঠাইয়া।।

আনন্দে প্রমথ যেন হইল পাগল।

প্রভুর করুণা ভাবি চক্ষে ঝরে জল।।

“পাসপোর্ট” ব্যবস্থাদি সমাপ্ত করিয়া।

উপনীত হইলেন গৃহেতে আসিয়া।।

ওড়াকান্দি আসি শোনে সব সমাচার।

হরিভক্ত মতুয়ার উচ্চ ব্যবহার।।

সাথে সাথে শুনিলেন গোপালের কথা।

শ্রদ্ধায় প্রমথ তাই নোয়াইল মাথা।।

এই কার্যে মতুয়ার সত্য পরিচয়।

প্রমথরঞ্জন পেয়ে মুগ্ধ অতিশয়।।

মনে মনে করিলেন এই অঙ্গীকার।

“আমি মতুয়ার, মতো’ হইল আমার।।

মতুয়ার জন্য ধন্য হইল জীবন।

আমারে কিনিল যত মতুয়ার গণ।।

সকলের মূলে দেখি মোর পিতামহ।

কত যে গভীর তার রহিয়াছে স্নেহ!

এই পিতামহ আর মতুয়ার গণ।

ইহাদের লাগি ধন্য আমার জীবন।।

প্রভু যদি কৃপা করে দেশে আনে ফিরে।

জীবন বিলা’ব আমি ইহাদের তরে।।”

সে কথা সেদিনে বলে প্রমথরঞ্জন।

বর্ণে বর্ণে সবটুকু পালিছে এখন।।

গোপালচাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা অতিশয়।

বিলাতে থাকিতে এক পত্র তারে দেয়।।

সেই পত্র এইখানে করিনু উদ্ধৃত।

তাহা হ’তে মনোভাব হ’বে প্রমাণিত।।

(শ্রীমৎ গোপালচাঁদ সাধু ঠাকুরের নিকট লিখিত)

London Wl.-24th August, 1929

শ্রীশ্রীচরণকমলেষু-

অসংখ্য প্রণিপাতপূর্বক নিবেদন এই, বিলাতে আসিয়া অবধি আপনাদের নিকট কোন পত্রাদি লিখিতে পারি নাই। তবে আপনাদের কুশল সংবাদ অন্যান্য পত্র হইতে অবগত হইয়া থাকি। অদ্য শ্রীমান মহানন্দের পত্র পাইলাম। বোধ হয় শুনিয়া থাকিবেন, আপনাদের আশীর্বাদে আমি ব্যারিস্টার হইয়াছি। আগামী বৎসর এই সময়ে বাড়ী ফিরিব।এ বৎসর হাইকোর্টের কার্যাদি শিক্ষা করিবার জন্য এখানে থাকিতে হইতেছে। বিশেষ আর কিছু লিখিবার নাই। আশীর্বাদ করিবেন যেন মঙ্গলমত থাকিয়া আগামী বৎসর দেশে ফিরিতে পারি। তারপর কথা এই দীর্ঘ তিন বৎসর কাল বিদেশী লোকের সহিত বাস করিয়াও আমি মতুয়াদের ভুলিতে পারি নাই। ঠাকুরদাদার অভয় বাণী ভুলিয়া যাই নাই। জগতের নানা স্থান দর্শন করিয়াছি এবং আরও করিব; কিন্তু তাহার মধ্যে প্রাণে প্রাণে বুঝিয়াছি ঠাকুরদাদার মত লোক আর এ ব্রহ্মাণ্ডে নাই। তাঁহার অনুগ্রহে

Page 518 start

আমার এত সৌভাগ্য হইল। অতএব তাঁহার আদেশ পালনই আমার জীবনের সর্বপ্রথম কর্তব্য। দেশে ফিরিয়া আমিও আবার মতুয়া-ধর্মে দীক্ষিত হইব। ভোগ-বিলাসিতায় কোন কালে লোকের সুখ হয় নাই এবং হইবেও না। সেই জন্যেই ঠাকুর সর্ব-ত্যাগী ছিলেন।

আমার ঠিকানা উপরে ইংরেজীতে ছাপান অক্ষরে দেওয়া হইল। যদি দয়া করিয়া পত্রের উত্তর দেন, তবে বড়ই সৌভাগ্য মনে করিব। ইতি-

সেবক

শ্রীপ্রমথরঞ্জন ঠাকুর

মূলসূত্র ধরে এবে বলি কিছু কথা।

প্রমথ শুনিল গৃহে সকল বারতা।।

তের শ’ তেত্রিশ সাল বাংলা গণনায়।

ভাদ্র মাসে সে প্রমথ যাত্রা করি যায়।।

অমূল্যকুমার দাস দোঁহে এক সঙ্গে।

চলিল সাগর পথে অতি মনোরঙ্গে।।

গৃহ হ’তে বিদায়ের কি মধুর দৃশ্য!

বিষাদ মাখানো তা’তে আছিল অবশ্য।।

দেশবাসী সবে বটে আনন্দিত মন।

জনে জনে করিলেন সু-অভিনন্দন।।

উৎসাহ বাড়িল তা’তে কিছু সন্দ’ নাই।

কিন্তু সব গেল ডুবে এসে এক ঠাই।।

প্রভুর চরণে যবে করে প্রণিপাত।

আশীর্বাদ করে প্রভু শিরে রাখি হাত।।

বুকের জমাট বাধ বুঝি ভেঙ্গে গেল।

প্রমথের হাত ধরে প্রভুজী কান্দিল।।

প্রমথ লুটায়ে তা’তে পড়িলেন কোলে।

প্রভুর চরণে ভিজায় নয়নের জলে।।

প্রভু বলে “যাও দাদা! করি আশীর্বাদ।

পূর্ণ যেন করে প্রভু তব মনোসাধ।।

এ বংশ উজ্জ্বল কর স্বদেশে ফিরিয়া।

যেতে যেন পারি আমি চোখেতে দেখিয়া।।”

এইভাবে গৃহ হ’তে বিদায় হইল।

সঙ্গে সঙ্গে বড় মাতা কলিকাতা এল।।

নয়ন রঞ্জন পুত্র প্রমথরঞ্জন।

জননীর দুই চোখে ঝরিল শ্রাবণ।।

বিদায়ের পূর্বভাগে ডাকিল গোপালে।

সংবাদ পাইয়া সাধু এল দলে বলে।।

সাধুরে বিনয় করি আশীর্বাদ চায়।

কাঁদিয়া গোপাল বলে “বাঞ্ছা পূর্ণ হয়।।”

অসীম সাগর বুকে চলিলেন বীর।

মতুয়ারা দিল অর্ঘ্য ঢেলে অশ্রুনীর।।

প্রমথরঞ্জন তবে বিলাত পৌছিল।

পরে শোন মহাপ্রভু কি কার্য করিল?

শ্রীগুরুচরিত গাঁথা বিপদাপহারী।

মহানন্দ বলে সবে শোন নিষ্ঠা করি।।

---০---