Page 554

মহাপ্রস্থান


“কোথা যাও ফিরে চাও, ওহে দিনমণি!তুমি অস্তাচলে দেব! করিলে গমন,ভারতে আসিবে পুনঃ বিষাদ-রজনী।।”---- নবীন চন্দ্র সেন।

বসন্ত আসিল নিয়ে ফুল রাশি রাশি।

আকাশে হাসিল চন্দ্র মধুময় হাসি।।

মলয় সমীরে যেন জুড়াইল প্রাণ।

শাখে শাখে যত শাখী কণ্ঠে ভরা গান।।

আলোকে উজল ধরা ভরা গন্ধে গন্ধে।

বিশ্ববাসী মত্ত যেন মিলন আনন্দে।।

রে কাল! নিষ্ঠুর তুই বড়ই কঠিন।

আপনার মনে চলি গেলি চিরদিন।।

তোরে নাহি ব্যথা দেয় শিশুর ক্রন্দন।

জননীর দুঃখে তোর ঝরে না নয়ন।।

সতীর বেদনা চোখে নাহি পড়ে তোর।

দুরন্ত ডাকাত তুই, আপনাতে ভোর।।

Page 555 start

নিয়তি নামিনী তোর নিয়ত সঙ্গিনী।

ভাঙা-গড়া নিয়ে খেলে দিবস রজনী।।

ইঙ্গিত করিবে তুই আর রক্ষা নাই।

সোনার বাগান পুড়ে হয় ভস্ম ছাই।।

রে কাল! দংশন তোর কত ভয়ঙ্কর।

পলকে আলোর বুকে দিস অন্ধকার।।

মধুর হাসিছে শিশু জননীর কোলে।

আধ আধ স্বরে শিশু ডাকে মা মা বলে।।

জননীর ডুবিয়া যায় স্নেহের তুফানে।

শত চুমু খায় তার শিশুর আননে।।

জননীর সে আনন্দে স্বর্গ নেমে আসে।

রে কাল! দুরন্ত তুই-তুই সর্বনেশে।।

মুহূর্তে করাল দন্ত করিয়া বাহির।

নিষ্ঠুর আঘাত দিস বক্ষে জননীর।।

সোনার কমল পড়ে অকালে ঝরিয়া।

চোখের সমুখে মণি নিসরে হরিয়া।।

তাই বলি কাল তুই কত যে নিষ্ঠুর।

তোর বুকে গাঁথা শুধু বেদনার সুর।।

তা’ না হ’লে বল দেখি ওরে সর্বনেশে!

তেরশ তেতাল্লিশ সালে এলি কোন বেশে?

ফাল্গুন আকাশ তলে উজল আলোকে।

বল দেখি কোন সুরে দিলি কালী মেখে?

গুরুচাঁদে পেয়ে ধরা ছিল গরবিনী।

কোন সুরে সাজালিরে তারে অনাথিনী।।

মকরন্দ ভরা ছিল ভকত হৃদয়।

(দুই লাইন জ্ঞাপ)

কেন রে দহিলি তাহা বিষের জ্বালা?

মতুয়া তরণী কেন ফেলিলি অকুলে?

মাঝি রেখে কেন তরী দিলি তুই ঠেলে?

বল দেখি ওরে অন্ধ! ওরে দয়াহীন।

কি নিয়ে মতুয়া আর কাটাবেরে দিন?

সে যে হায়! মতুয়ার নয়নের আলো।

তার মত মতুয়ারে কে বাসিবে ভালো?

সুখে সখা ছিল সে যে দুঃখেরি বান্ধব!

পোড়া প্রাণে বল ব্যথা কোনখানে স’ব।।

বলরে নিয়তি তুই বল দয়াহীনে।

নয়নের মণি তুই কেড়ে নিলি কেনে?

কাল-চক্র আর তুই পাষাণ পাষাণী।

তোদের কারণে ধরা সাজিল দুঃখিনী।।

শোন্‌ শোন্‌ শোন্‌ তবে নিষ্ঠুর নিষ্ঠুরা।

কোন ভাবে নিলি হরে ভক্ত-মন-চোরা।।

ফাল্গুন আকাশ ছিল উদার নির্মল।

সহসা আনিলি তোরা মেঘ ভরা জল।।

কল কল ধারে ধরা ডুবালি ধারায়।

অশনি নির্মোঘ যেন ধরা ফেটে যায়।।

শন্‌ শন্‌ বহে বায়ু ভীষণ বাত্যায়।

ত্রাসে কাঁপে নরকুল প্রাণে এল ভয়।।

কাল রাত্রি এসে যেন ধরাকে গ্রাসিল।

তোদের নিষ্ঠুর রথ শ্রীধামে নামিল।।

আপন বিধান প্রভু না লঙ্ঘে আপনে।

ধীরে ধীরে চলে তাই সে রথের পানে।।

ভক্তের পরাণ হরি ভক্ত প্রতি মায়া।

চলে যায় তবু ফিরে চাহে করি দয়া।।

বিরহ বেদনা বুকে নাহি সহে আর।

ঘর ছেড়ে গেল দূরে সে নবকুমার।।

যাত্রাকালে উচ্চ কণ্ঠে বলে দয়াময়।

“মোর শেষ বাণী-যথা ধর্ম তথা জয়।।

স্নেহের পুতলি নব! বাবা তুই কই।

এ জনমে কথা বৎস! এই মাত্র কই।।”

আলো ভরা কালো আঁখি মুদিয়া আসিল।

অভাগা ভক্তের দল কান্দিয়া উঠিল।।

দীন কান্দে, নীলে কান্দে কান্দিল নেপাল।

নবকুমারের চোখে নাহি ধরে জল।।

অভুমন্যু, মাধবেন্দ্র, পড়িল ভূতলে।

কান্দিয়া সুখদা দেবী বসিয়া নিরালে।।

Page 556 start

মনে মনে সুখদার জাগে কত কথা।

কতই করিল প্রভু তাহারে মমতা।।

ভাগ্যদোষে স্বামীহীনা তরুণ জীবনে।

আদরে পালিলা প্রভু পরম যতনে।।

বিশ্বাসী বন্ধুর মত তারে চিরকাল।

সর্বনীতি দিল শিক্ষা পরম দয়াল।।

সরলা অবলা মাতা বড় ঠাকুরাণী।

ফুকারিয়া কান্দিলেন আপনি জননী।।

কান্দিছে বলিছে দেবী “বাবা কোথা যাও।

কান্দিছে দুঃখিনী কন্যা চক্ষু মেলে চাও।।

চিরকাল ছায়াদানে পালিয়াছ মোরে।

পিতৃহীন শিশু দুটি ছিলে বক্ষে ধরে।।

কা’র মুখ পানে তারা চাহিবে আজিকে।

তা’দের জীবন বুঝি গেল দুঃখে দুঃখে।।”

কে কা’রে শান্তাবে বল শোকের সভায়।

পিতৃহারা বিশ্ববাসী সেই দিনে হয়।।

কুচক্রী কালের খেলা শেষ হ’য়ে গেল।

ঝড় বৃষ্টি বন্যা সব মুহূর্তে থামিল।।

পলকের মধ্য বার্তা গেল ঘরে ঘরে।

দলে দলে নরনারী ছুটে এল পরে।।

ওড়াকান্দি স্কুলবাসী যত ছাত্রগণ।

উর্ধশ্বাসে সবে ছুটে আসিল তখন।।

পাদরি মাস্টারস আর মিস টমসন।

সঙ্গে সঙ্গে সে অক্ষয় করে আগমন।।

ওড়াকান্দি, ঘৃতকান্দি, আর যত যত।

সর্বদেশ হতে লোক হ’ল সমবেত।।

সকলের চক্ষে বহে ঘন জলধারা।

সবে বলে “পিতৃহীন আজিকে আমরা”।।

কানাই মাস্টার নামে একটি গায়ক।

তার গান শুনে প্রভু পাইত পুলক।।

শেষের আসরে গান করিল কানাই।

আঁখি জলে ভাসে সবে ছাড়ে ঘন হাই।।

শ্রীহরি মন্দির যেথা আছে দাঁড়াইয়া।

তার পূর্বে ভিতে দেহ রাখিল আনিয়া।।

সর্বাঙ্গে মাখিয়া পরে ঘৃতাদি চন্দন।

ব্রহ্মার বদনে তুলে দিল সর্বজন।।

যাও প্রভু! মর’ মাঝে অমরার ধন!

কেমনে রাখিবে ধরা বন্দিয়া চরণ?

অবিরাম দেবকুল ডাকিছে তোমায়।

পথ চেয়ে কান্দে মাতা ঐ অমরায়।।

ক্ষীরোদ সাগরে তব জনক জননী।

তোমারে ডাকিছে সদা ওহে গুণমণি।।

ধরার বেদনা বুকে সহিয়াছ কত!

কুসুম কোমল হিয়া হ’ল কত ক্ষত।।

অনাদি অসীম ছিলে সসীম সাজিয়া।

সীমার বেদনা কত নিলে যে বহিয়া।।

সুখ দুঃখাতীত প্রভু যাও নিজ লোকে।

তুমি সুখে থাক প্রভু চাহিনা তোমাকে।।

অনাথিনী ধরারাণী রহিবে দুঃখিনী।

মুছিবে নয়ন স্মরি চরণ দু’খানি।।

কোটি কোটি নরনারী হৃদয় রাখিয়া।

পুজিবে চরণ যুগ আঁখি-নীর দিয়া।।

তোমার চরণ-রেখা কাল-সিন্ধু তীরে।

অব্যয় অক্ষয় হোক চিরকাল তরে!

মায়া মুক্ত ওহে ভোলা! যাও নিজ ঘরে।

করিল তর্পণ বিশ্ব নয়নের নীরে।।

---০---