Page 305

দয়ার সাগর তারকচন্দ্র

আদর্শ মতুয়া বটে শ্রীতারক চন্দ্র।

মনে প্রাণে মানিলেন মতুয়ার ধর্ম্ম।।

মতুয়ার ধর্ম্ম যাহা স্বহস্তে লিখিলা।

আপন জীবনে তাহা পালন করিলা।।


জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।....শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত

জীব প্রতি দয়া তাঁর অসীম অনন্ত।

শুন বলি সে সম্বন্ধে একটি বৃত্তান্ত।।

গৃহের পালিত পশু ছিল যত গুলি।

সকলে তারকে চিনে শোনে তার বুলি।।

গরু গুলি তাঁরে দেখে বড় সুখ পায়।

আনন্দে নয়ন মুদে হস্ত দিলে গায়।।

তারকের স্পর্শ পেতে সকলের আশা।

তারকের কাছে তারা চায় ভালবাসা।।

পশু পাখী নর নারী গৃহে যত জন।

তারকের স্পর্শ পেতে লোভী সর্ব্বক্ষণ।।

গান করিবারে যবে বিদেশেতে যায়।

হম্বা রব করে গাভী চারিদিকে চায়।।

ঘাস জল খায় বটে তাতে মন নাই।

বিড়াল কুকুর কান্দে সর্ব্বদা সবাই।।

গান গাহি যেই কালে ফিরে আসে ঘরে।

আনন্দের মাত্রা যেন কোথঅ নাহি ধরে।।

দড়ি ছিড়ি গরুগুলি আসিবারে চায়।

মুখের ‘গেরাস’ ফেলে বিড়াল দৌড়ায়।।

পোষাপাখি পাখসাট মারিছে খাচায়।

সবে চায় তার গায় আগে হাত দেয়।।

দয়ার সাগরে সবে ডুব দিতে চায়।

‘জীবে দয়া’ এই তার সত্য পরিচয়।।

কি কারণে একদিনে সেই মহাশয়।

একটি “পালের” গরু করিল বিক্রয়।।

‘পাল’ ছেড়ে গরু কিন্তু যেতে নাহি চায়।

বহু কষ্টে নিল গরু ক্রেতা মহাশয়।।

ভাব দেখে তারকের কান্দিল পরাণ।

ভাবে-বলে ‘কাজ নাই গরু ফিরে আন।।

কিন্তু কথা দিয়া তাহা কেমনে লঙ্ঘিব।

দুঃখ পাব বলে কি না কাজে ছোট হবে?

কিছুদিন পরে সেই প্রভু মহাজন।

যাত্রা কৈল ওড়াকান্দী স্থির করি মন।।

ওড়াকান্দী সন্নিকটে মাঠের ভিতর।

ঘটিল অপূর্ব্ব কান্ড শুন অতঃপর।।

সেই গরু সেই ক্রেতা জুড়িয়াছে হালে।

দারুণ গ্রীষ্মের তারে জল নাহি বিলে।।

পিপাসায় শুষ্ক কন্ঠ চক্ষে বহে জল।

ধীরে ধীরে কোনরূপে টানিতেছে হাল।।

কৃষক তাহাতে সুখী নাহি হয় মনে।

করিছে প্রহার তারে বিশেষ তাড়নে।।

Page 306 start

যেইখানে হাল চাষে তার কাছে পথ।

দিবারাত্রি লোকজন করে যাতায়াত।।

যেই কালে শ্রীতারক সেখানে আসিল।

হাল স্কন্ধে সেই গরু তাঁহারে দেখিল।।

দরদী বান্ধবে দেখি মন নাহি মানে।

হাল ভেঙ্গ চলে ছুটে প্রভুর সদনে।।

হাম্বা হাম্বা রব করে চক্ষে বহে জল।

ভাব দেখে তারকের দেহে নাহি বল।।

তারকের গাত্র গুরু চাটিতে লাগিল।

তাই দেখি গোস্বামীর হৃদয় ফাটিল।।

মনে ভাবে হায়! হায়! আমি কি নিষ্ঠুর।

ইচ্ছা করে ‘অ-বলারে’ করিয়াছি দূর।।

অনুতাপে গোস্বামীর হৃদি ফাটি যায়।

ঝর ঝর অশ্রু তাঁর পড়িল ধরায়।।

ক্রেতারে ডাকিয়া বলে “শুন মহাশয়।

দয়া করে এই গরু ফিরে দিতে হয়।।

হাল-কার্য্যে এই গরু বহু কষ্ট পায়।

তাই দেখে মোর কাছে নালিশ জানায়।।

যে-টাকা দিয়াছ তুমি লহ তাহা ফিরে।

দয়া করে ছেড়ে দাও গরুটী আমারে।।

তোমার মঙ্গল হবে জানিও নিশ্চয়।

এই টুকু কর দয়া ক্রেতা মহাশয়।।

দেখিয়া গরুর কান্ড ক্রেতা’ত অবাক।

চুপ করে দেখে শুধু নাহি সারে বাক।।

পরে যবে শ্রীতারক এই কথা কয়।

নিরাপত্তে গরু ছাড়ে ক্রেতা মহাশয়।।

গরুরে উদ্ধার করি তারক চলিল।

সে-গরু তারকের সঙ্গে সঙ্গে গেল।।

এই ভাবে জীবে দয়া সীমা দিতে নাই।

দয়ার সাগর ছিল তারক গোঁসাই।।

অতঃপর শুন সবে আরেক ঘটনা।

দেশে দেশে সেই কির্ত্তি রয়েছে রটনা।।

একদিন পথে চলে গোস্বামী রতন।

চলেছে পদুমা গ্রামে মল্লিক-ভবন।।

সঙ্গেতে যাদব চন্দ্র ঢালী মহাশয়।

পরম ধার্ম্মিক যিনি অতি সদাশয়।।

তারকের পদাশ্রিত নিষ্ঠা সেই পদে।

পূর্ণ-ব্রাহ্ম-জগন্নাথ জানে গুরুচাঁদে।।

তাঁর যত কীর্ত্তি কথা বলিব পশ্চাতে।

এবে শুন কি ঘটনা ঘটে সেই পথে।।

দরিদ্র কুটীর এক পথপার্শ্বে রয়।

তারক যাদব দোঁহে সেই পথে যায়।।

কুটীরের পার্শ্বে যবে উপনীত হল।

সুন্দর বালক এক বাহিরে আসিল।।

পথ বাহুড়িয়া সেই বালক দাঁড়ায়।

গোস্বামীর পানে চাহি মৃদুস্বরে কয়।।

“তোমার যে যেতে হবে আমাদের বাড়ী।

না গেলে আজিকে তোমা নাহি দিব ছাড়ি।।

মাতা বলিয়াছে তোমা লইতে ডাকিয়া।

তোমাকে দেখেছি মোরা ঘরেতে থাকিয়া।।”

গোস্বামী ডাকিয়া বলে ‘চলুন যাদব।

বলুন কেমন প্রাণে উপেক্ষি” এ-সব?”

যাদব বালকে বলে “শোন রে গোপাল।

কত জন্ম তপস্যাতে পেলিএ কপাল।।

চলেছে “দয়ার গাজী” আর ভয় নাই।

চল চল তাড়াতাড়ি তোর বাড়ী যাই।।”

যাদবের ভাব দেখি বড়ই মধুর।

বুকে থাকে এক ভাব মুখে অন্য সুর।।

মৌখিক রহস্য করে গোস্বামীর সনে।

“পরম দেবতা” বলি মানে মনে প্রাণে।।

অল্পক্ষণে উপস্থিত বালকের বাড়ী।

বসিবারে এনে দিল দুইখানা পীড়ি।।

গৃহ মধ্যে কথা কয় বালকের মাতা।

বাহিরে গোস্বামী বসি শোনে সেই কথা।।

Page 307 start

গোস্বামী ডাকিয়া বলে সেই রমণীরে।

“মাগো! কথা বল না’ক আসিয়া বাহিরে।।

আমিত তোমার পুত্র তুমিও জননী।

কাছে এসে কথা বল প্রাণ ভরে শুনি।।

গোস্বামীর কথা শুনি নারী কেন্দে কয়।

বাহিরে আসিতে বাবা নাহিক উপায়।।

জীর্ণ দীন বস্ত্র-হীন আমি অভাগিনী।

মোর দিন কাটে বাবা পরে এক কাণি।।

শত ছিন্ন বস্ত্রে করি লজ্জা নিবারণ।

কেমনে বাহিরে আসি বল বাপধন।।

তোমার গুণের কথা সর্ব্ব দেশে কয়।

দীনজনে ধনী হয় তোমার কৃপায়।।

নাড়ী-ছোঁড়া-ধন মোর এক মাত্র ছেলে।

স্বর্গে চলে গেছে স্বামী বালকেরে ফেলে।।

দয়া করে আশীর্ব্বাদ কর তুমি তারে।

আর কষ্ট তার যেন না হয় সংসারে।।

এই লাগি কষ্ট দিতে এনেছি ডাকিয়া।

কাঙ্গালের আশীর্ব্বাদ কর মন দিয়া।।

এই কথা বলে নারী ফুকারিয়া কান্দে।

বড়ই বাজিল ব্যথা সে তারকচান্দে।।

আপনার উত্তরীয় করি পরিধান।

নিজবস্ত্র রমনীরে করিলেন দান।।

যত অর্থ ছিল সাথে সব তারে দিল।

প্রাণ ভরে সে-বালকে আশীষ করিল।।

গোস্বামীর আশীর্ব্বাদে সে দীন বালক।

ধন পেয়ে ভবিষ্যতে হয় ধনী লোক।।

দীন বন্ধু সে তারক দীনের সহায়।

কত জনে করে দয়অ তুলনা কোথায়?

আর এক কথা শুন অপার মহিমা।

নিঃস্বার্থ তারকচন্দ্র শুনে নাহি সীমা।।

মাধব নামেতে তাঁর ছিল প্রতিবেশী।

গোস্বামীর কাছে টাকা কর্জ্জ লয় আসি।।

খত লিখি দিল আনি রেজেষ্ট্রেীর করিয়া।

টাকা পেয়ে গোস্বামীকে দিল সে ধরিয়া।।

দিনে দিনে দিন যায় তামাদি উদয়।

মাধবের ডাক দিয়া গোস্বামীজী কয়।।

কি মাধব টাকাগুলি শোধ দিবে কিনা?

শোধ করে দেও টাকা কেন থাক দেনা।।

খতের তামাদি এল কিবা করি বল।

আসল না পার কিছু সুদ দিয়ে ফেল।।

মাধব জানিত সাধু পরম দয়াল।

ধীরে ধীরে টাকা নেবে বসে কতকাল।।

যেমন দয়াল তাতে কোন চিন্তা নাই।

নালিশে আদায় টাকা করে না গোঁসাই।।

তাই ভেবে বাহ্য রাগে শক্ত কথা কয়।

বলে যাহা পার তুমি কর গে মশায়।।

ভারী কটা টাকা তাতে এতই তাগাদা।

এতই উত্যক্ত কর আমি নাকি গাধা?

টাকা নিছি খত দিছি আর কিবা চাও?

এভাবে আমারে আর কেন বা জ্বালাও?

মাধবের ভাগ্যদোষে হিতে বিপরীত।

দুই জন ভক্ত সেথা ছিল উপস্থিত।।

ক্রোধে পরিপূর্ণ হল তাহাদের মন।

গোস্বামীকে সঙ্গে করি করিল গমন।।

গৃহে গিয়া ক্রোধে বলে শুন দয়াময়।

মাধবের এই দম্ভ দেখা নাহি যায়।।

এতই মাধব দাস হল অহঙ্কারী।

ওরে সাজা দিব নিয়ে রাজার কাছারী।।

আপনার কোন কথা শুনিব না আজ।

এতই যোগ্যতা তার করে হেন কাজ?

কাল্য গিয়ে নড়াইল করিব নালিশ।

রাজার কাছারী হতে উচিত শালিশ।।

এত বলি জোর করি দিুই মহাশয়।

করিল খতের আর্জ্জি বিচার আলয়।।

Page 308 start

বিবাদীর পরে যবে আসিল নোটিশ।

মাধব বুঝিল তবে কাজের হদিশ।।

আর্জ্জি দেখে মাধবের মন ভেঙ্গে গেল।

নালিশের কোন রূপ জবাব নাহি দিল।।

এক তর্ফা ডিক্রী হল দাবী সমুদয়।

তথপি মাধব তাতে কথা নাহি কয়।।

বিধির নির্ব্বন্ধ বল কে খন্ডাতে পারে?

মাধব পড়িল মারা কিছু দিন পরে।।

নানা দেশে নানা কাজে গোস্বামী নিযুক্ত।

অল্পই জানিলা তেঁহ এই সব তত্ত্ব।।

এ দিকেতে ভক্ত দলে জোগাড় করিয়া।

মাধবের বাড়ী এল মাল ক্রোক নিয়া।।

দৈবক্রমে গোস্বামীজী গৃহে উপস্থিত।

ভক্তগণে এল বাড়ী প্যাদার সহিত।।

মাধবের নারী জানি সব সমাচার।

গোস্বামীর পদে পড়ি করে হাহাকার।।

গোস্বামীর শান্তায়ে তারে শুনিলেন কথা।

হেঁট করি রহিলেন আপনার মাথা।।

বিষম বেদনা-রেখা ফুটিল বদনে।

বহু তিরস্কার করে নিজ শিষ্য গণে।।

দেনা-দায়ে মুক্ত হল মাধবের নারী।

গোস্বামী নিলেন নাক এক কাণা কড়ি।।

পেয়াদা বিদায় করে নিজ দিয়ে টাকা।

এমন দয়াল ভবে নাহি যায় দেখা।।

পর-দুঃখে দুঃখী সদা মতুয়া সুজন।

শ্রীতারক তারমধ্যে শ্রেষ্ঠ একজন।।

নিঃস্বার্থ দয়ার দানে কাঙ্গালে বাঁচায়।

দ্বিতীয় চরিত্র-চিত্র এই পরিচয়।।

নামে রুচি মতুয়ায় নীতি অন্যতম।

এ-নীতি পালনে তেঁহ ছিল সর্ব্বোতম।।

বারুণীতে যায় ভক্ত কন্ঠে করে নাম।

বীরের স্বভাবে চলে সবে গুণ ধাম।।

অবশ্য নামেতে নিষ্ঠা রাখে দূঢ়তর।

তার মধ্যেভাব আছে ভাবে ভাবান্তর।।

শ্রীতারক যাত্রা করে ধাম ওড়াকান্দী।

গৃহ হতে হরি বলে সাধু ওঠে কান্দি।।

সারা পথে হরিনামে নাহিক বিশ্রাম।

নয়নের জলে বক্ষ ভাবে অবিরাম।।

স্বেদ কম্প পুলকাশ্রু সাত্ত্বিক বিকার।

ক্ষণে ক্ষণে পথিমধ্যে হইত তাঁহার।।

ধামে আসি পরমর্ষি পড়ে ধরাতলে।

মৃত্তিকা কর্দ্দম হয় তাঁর অশ্রুজলে।।

দরশন পরশন যেবা তাঁরে করে।

মহাপ্রেম-সিন্ধু মাঝে ডুব দিয়া মরে।।

মতুয়া চরিত্রে যাহা দ্বিতীয় লক্ষণ।

শ্রীতারক পূণ তাহা ছিল সর্ব্বক্ষণ।

মতুয়া-চরিত্রে যাহা পরম লক্ষণ।।

মানুষেতে নিষ্ঠা যাহা জানে সর্ব্বজন।।

এই গুণে তারকের তুল্য দিতে নাই।

প্রমাণ তাহার জানে সর্ব্বত্র সবাই।।

নিজ-কৃত গানে তেঁহ করিল রচনা।

কাজ কি আমার মন্ত্র বীজে।হরিচাঁদ ছবি রবির কিরণউথলিল মধু হৃদ-সরোজে।।.........তারকচন্দ্র

তন্ত্র মন্ত্র দীক্ষা শিক্ষা করিলেন ত্যাগ।

শুধু হরিচাঁদে রাখে দৃঢ় অনুরাগ।।

এই নিষ্ঠা নিল তাঁরে প্রেমময় লোকে।

সেই সূত্রে পিতা-পুত্রে অভিন্নতা দেখে।।

কায়া ছাড়ি হরিচাঁদ গুরুচাঁদে কয়।

শ্রীতারক পেল তার আদি পরিচয়।।

নিষ্ঠাগুণে তারকের নাহি হল ভুল।

তাই দেখে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদে স্থুল।।

Page 309 start

শক্তি সত্য কায়া মিথ্যা নিষ্ঠাবান জানে।

তাই তাঁর মন চলে শক্তির সন্ধানে।।

যে শক্তি করেছে তাঁর পরাণ হরণ।

ঘরে ঘরে ঘুরে তাঁরে করে অন্বেষণ।।

যেইখানে মেলে দেখা আর কথা নাই।

সেই পদে মন প্রাণ বিক্রীত সবাই।।

তাই দেখি নিষ্ঠা-গুণে তারক প্রধান।

মন-মানুষের নিল করিয়া সন্ধান।।

মতুয়ার তিন গুণে পূর্ণতারকেতে।

সেই শিক্ষা পেল ক্রমে সবে তাঁহা হতে।।

তাঁহার জীবন কথা অসীম অনন্ত।

কণামাত্র বলি পরে করিব সে ক্ষান্ত।।

---০---