Page 394

স্তব

‘‘জয়তু! জয়তু! তৃপ্যতু! তৃপ্যতু!

সতীরূপা কাল-ধাত্রি!

সম্বর! সম্বর! তেজঃ ভয়ঙ্কর

আমি যে মরণ-যাত্রী।।

ভীমা ভয়ঙ্করা ভব-ভয়-হরা,

ভীষণা ভাবিনী বেশে।

পলকে প্রলয় য়টিবে নিশ্চয়

কালের কেতন কেশে।।

অবোধ অজ্ঞান তাই অপমান

দিতে চাই জননীরে।

ভাঙ্গিয়াছে ভুল ভাবিয়া আকুল

পাপ কেন নিছি শিরে।।

যে কর্ম্ম করেছি মরি কিংবা বাঁচি

কোন দুঃখ তাতে নাই।

একের কারণে মরে সর্ব্বজনে

মিনতি চরণে তাই।।

কাল-অগ্নি ঢেকে এ অপরাধীকে

শুধুই কথায় বাণে।

তারে শুধু লও জগত বাঁচাও

অপরে মারিবে কেনে?

সতীর মহিমা দিতে নারে সীমা

আপনি জগত-স্বামী।

সাজিয়া অজ্ঞান কামে হতজ্ঞান

গরণ খেয়েছি আমি।।

শুন গো জননি ব্রহ্মান্ড ধারিণি।

পাতকী সন্তানে ক্ষম।

ক্রোধ-অগ্নি জ্বেলে আঁখি খুলে দিলে

রাতুল চরণে নমঃ।।

Page 395 start

জননী আমার আপনি সংহার

চরণে পড়িয়া রয়।

নারী-রূপধারী তুমি সতী নারী

আজিকে বুঝিছে হায়।।

সতীর দোহেতে সতীত্ব রূপেতে

তেজময়ী তুমি মাতা।

ক্ষম অপরাধ দেহ নিত্য পদ

চরণে রাখিনু মাথা।।

করুণা রূপিণী কৃকল-গৃহিণী

সেজেছ নারীর সাজে।

চরণে শরণ করেছে গ্রহণ

ক্ষমা কর দেবরাজে।।’’


এ ভাবে করিল স্তব দেব সুরপতি।

শূণ্য হতে বলে তবে দেবী ভগবতী।।

অতি ধন্যা প্রিয়া কন্যা কৃকল গৃহিণী।

ক্ষমা কর দেবরাজে ওগো সীমন্তিনী।

আর না করিবে ইন্দ্র এ হেন আচার।

তোমাকে পরীক্ষা করে মনে ভাব তাঁর।

অবোধ অজ্ঞান ইন্দ্র বৃদ্ধি নাহি ধরে।।

পবিত্র গঙ্গার জল কিসে শুদ্ধ করে।।

বহু শিক্ষা দেবরাজ পেল তব ঠাঁই।

শরণাগতরে মেরে কোন ফল নাই।।’’

দৈববাণী শুনি কোণে কৃকল-গৃহিনী।

চাহিয়া ইন্দ্রের পানে কহিলা তখনি।।

‘‘মাতার আজ্ঞায় ইন্দ্র! করিলাম ক্ষমা।

কিন্তু এক সর্ত বটে দিব আমি তোমা।।

যে যেখানে যেই নারী সতীধর্ম্মে আছে।

ত্রাণকর্ত্তা রূপে রবে তাহাদের কাছে।।

কোন দুষ্টু যদি চাহে ধর্ম্ম নাশিবারে।

অবশ্য হানিবে ব্রজ সে দুষ্টের শিরে।।’’

করজোড়ে বলে ইন্দ্র ‘‘ওগো কৃপাময়ি।

তোমার পবিত্র সর্তে আমি বাধ্য হই।।

আমি রব দেব তোমা আনন্দ অন্তরে।

অবিলম্বে তব পতি আসিবেন ঘরে।।

তোমার কীর্ত্তির কথা শুনিবে যে নারী।

পতিসহ হবে সেই স্বর্গ অধিকারী।।’’

এতেক বলিয়া ইন্দ্র বিদায় হইল।

স্বর্গে যেতে পথে পথে অন্তরে ভাবিল।।

‘‘এই যে কৃকল সাধু পুণ্যধর্ম্ম-আশে।

সতী ফেলে একা চলে দুর তীর্থবাসে।।

পুণ্যময় ধর্ম্মতত্ত্ব তার জানা নাই।

পবিত্র ধর্ম্মের তত্ত্ব তাহারে শিখাই।।

সুকলার সম সতী যার ঘরে রয়।

শত শত তীর্থফল ঘরে বসে পায়।।

অবোধ কৃকল তাহা বুঝিতে না পারে।

সতী ফেলে মিছামিছি তীর্থে তীর্থে ঘুরে।।

তাহারে শিখাব আজ পূণ্যধর্ম্ম কথা।

যেভাবে শিখাল মোরে তাঁর পতিব্রতা।।

এত ভাবি ইন্দ্র তবে চলিল দক্ষিণে।

যে দিকে কৃকল সাধু ফিরে গৃহ পানে।।

গৃহের নিকটে আসি নামি পঙ্গাজলে।

করিল তর্পণ সাধু অতি কুতুহলে।।

তর্পণ করিয়া বৈশ্য জুড়ি কর পানি।

‘তৃপ্ত হও তৃপ্ত হও’ করে এইধ্বনি।।

পিতৃ পুরুষের প্রতি করিল তর্পণ।

বলে ‘‘তীর্থ-যাত্রা ফল করিনু অপূর্ণ।।’’

হেনকালে দেখ তথা কিবা কান্ড হল।

প্রত্যক্ষে কৃকল সাধু দেখিতে লাগিল।।

জ্যোতির্ম্ময় রূপধারী কোন মহাজন।

কৃকলের পিতৃগণে করিছে পীড়ন।

পিতৃপুরুষেরা কান্দি কহিছে বচণ।

‘‘কোনপাপে আমাদিগে’’ করিছে শাসন।।’’

জ্যোতির্ম্ময় মহাজন ক্রোধভরে কয়।

‘‘চৌর্য্য অপরাধে দোষী তোমরা নিশ্চয়।।

Page 396 start

এই যে কৃকল বৈশ্য তোমাদের সূত।

নিজ হস্তে শ্রাদ্ধ পিন্ড করেছে প্রস্তুত।।

শাস্ত্রে বলে ধর্ম্মপত্নী সঙ্গে করি লবে।

সতী নারী শ্রাদ্ধ পিন্ড প্রস্তুত করিবে।।

এই দুষ্ট সেই ধর্ম্ম করিয়াছে ভঙ্গ।

ধর্ম্ম পত্নী ঘরে ফেলে এসেছে নিঃসঙ্গ।।

যেই মূঢ় ধর্ম্মযুতা সতী নারী ফেলে।

ফললোভে তীর্থে যায় নিজ বাহুবলে।।

তার কৃতযত ধর্ম্ম সব বৃথা যায়।

তার দত্ত পিন্ড নিলে চুরি করা হয়।।

আর শুন সতীগুণে কত ফল হয়।

সতী যেথা সর্ব্বতীর্থ তথা আসি রয়।।

যার গৃহে সত্যবতী সতী নারী রয়।

দেব, ঋষি, বেদ শ্রুতি অধিষ্ঠান হয়।।

পুণ্যা নদী, পুণ্যতীর্থ যে আছে যেখানে।

সতী নারী যেথা রয় রহে সেইখানে।।

এ কারণে গৃহাশ্রমে সর্ব্বোত্তম কয়।

গার্হস্থ্য ধর্ম্মের তুল্য অন্য কিছু নয়।।


‘‘গার্হস্থ্যৎ পরমোধর্ম্মো দ্বিতীয়োনাস্তি ভূতলে।।’’---পদ্মপুরাণম---

আর বলি শুন বৈশ্য ধর্ম্মনীতি যত।

ত্রিভূবনে ধর্ম্ম নাই গৃহধর্ম্ম মত।।

‘যত্র ভার্য্যা তত্র গৃহ সাধু জনে কয়।

ভার্য্যা ছাড়া গৃহ ধর্ম্ম কিসে বল হয়?

পুণ্যবতী সতী নারী পুণ্যতীর্থ ময়।

সতীর গুণেতে গৃহ স্বর্গ তুল্য হয়।।

তোমার পবিত্রা সতী সুকলা নামিনী।

তোমার বিরহে গৃহে কাদে একাকিনী।।

তাঁহারে ফেলিয়া তুমি যে ধর্ম্ম করিলে।

সেই সব ধর্ম্মফল গিয়াছে বিফলে।।

যদি নিজ শুভ চাও নিজ গৃহে যাও।

পত্নীর সন্তুষ্ট করি শ্রাদ্ধপিন্ড দাও।।

পিতৃপুরুষেরা তবে পাইবে নিস্তর।

অন্যথায় দন্ড আমি দিব ঘোরতর।।

এমত শুনিয়া বাণী কৃকল তখন।

মহাদুঃখে গৃহপানে করিল গমন।।

কৃকলে আসিতে দেখি সুকলা কল্যাণী।

উচ্চরবে করিলেন সুমঙ্গল ধ্বনি।।

পাদ্য অর্ঘ্য শীঘ্রগতি করে আনয়ন।

স্বহস্তে পতির পদ করে প্রক্ষালন।।

অঞ্চলে মুছায় পদ যতন করিয়া।

দন্ডবৎ করে পদে গলে বস্ত্র দিয়া।।

কুশল জিজ্ঞাসা করে সুমধুর ভাষে।

সুখাদ্য আনিল দেবী চক্ষের নিমেষে।।

মনে মনে কৃকলের জাগে অনুতাপ।

বলে ‘‘দেবী! আজ মোরে কর তুমি মাপ।।

বড়ই কুকর্ম্ম আমি করেছি জীবনে।

কোন ফল হয় নাই তীর্থাদি ভ্রমণে।।

তব সম সতী সদা গৃহে আছে যার।

সর্ব্বতীর্থ করে বাস গৃহেতে তাহার।।

মূঢ় আমি সেই তত্ত্ব পূর্ব্বে বুঝি নাই।

অনর্থক তীর্থবাসে কত কষ্ট পাই।।

মমতা রূপিনী তুমি কত গুণময়ী।

তোমার স্নেহের আমি সদা বাধ্য রই।।

তোমার গুণের কতা কি বলিব আর।

দোষ পেয়ে কোন দোষ লহনা আমার।।

নিষ্ঠুর সাজিয়া আমি ফেলে একাকিনী।

গোপনে করিনু ত্যাগ সতী শিরোমণী।।

এত বড় অপরাধ কিছু নাহি মনে।

ফিরে পেয়ে পূজ মোরে পরম যতনে।।

হায়, হায় মন্দমতি আমি অভাজন।

দেখি নাই নিজ ঘরে পরম রতন।।’’

এতেক বলিয়া বৈশ্য অনুতাপ করে।

শশব্যস্ত সে সুকলা কহে পদ ধরে।।

Page 397 start

‘‘প্রাণনাথ হেন বাক্য আর না কহিও।

পদানতা সুকলার পরাণে রহিও।।

তোমার মঙ্গল ইচ্ছা রক্ষিয়াছে মোরে।

আমি বেঁচে আছি শুধু তব কৃপা জোরে।।

কত অপরাধ নাথ এই অভাগিনী।

পারে নাই পূজিবারে চরণ দুখানি।।

নারীর জীবনে যাহা পরম সম্বল।

কর্ম্ম দোষে হারা হয়ে ছিনু এতকাল।।

কত যে করুণা তব তুল্য দিতে নাই।

দয়া করে অভাগীরে দেখা দিলে তাই।।

এই কথা বলে দেবী কান্দিয়া কান্দিয়া।

দুই হস্তে পতিপদ বক্ষেতে বান্ধিয়া।।

কৃকল কান্দিছে আর কান্দিছে সুকলা।

শূণ্যে জয়ধ্বনি করে যত দেববালা।।

দেব ঋষি মুনিগণে করিছে স্তবন।

ধন্য সতি ধন্য পতি ধন্য দুই জন।।

অপঃপর সে কৃকল পত্নীর সহিতে।

পিতৃগণে পিন্ডদান করে বিধিমতে।।

তবে পিতৃগণ তার দিব্যদহে ধরি।

স্বর্গ পথে গেল চলি আশীর্ব্বাদ করি।।

কিছুকাল পরে দেখ পতী পত্নী দোঁহে।

তাজিয়া মরত ধাম উর্দ্ধে যেতে চাহে।।

ইচ্ছা মাত্রে বিষ্ণু লোক হতে অকষ্মাৎ।

আসিল ধবল মূর্ত্তি জ্যোতির্ম্ময় রথ।।

সেই রথে এক সাথে পতি পত্নী গেল।

দোঁহা আগমনে স্বর্গে দুন্দুভি বাজিল।।

বিষ্ণুলোকে যেই মাত্রে করিল প্রবেশ।

নর দেহ ছাড়ি নিল ‘‘বিষ্ণুলহ্মী’’ বেশ।।

সতীর গুণেতে তাই নমস্কার করি।

সতীলহ্মী প্রীতে সবে বল হরি হরি।।

---০---