Page 478

শ্রীমৎ বিপিন চাঁদ গোস্বামী জীবন কথা

ধন্য শ্রীবিপিন চন্দ্র গোস্বামী সুজন।

ওড়াকান্দী ভক্ত মধ্যে শ্রেষ্ঠ একজন।।

বরিশাল জিলা মধ্যে কেনুভাঙ্গা গ্রাম।

সেই গ্রামে বাস করে সাধু গুণধাম।।

তালুক বলিয়া গ্রাম ছিল বটে কাছে।

বর্ত্তমানে মধুমতী নদী-গর্ভে গেছে।।

সেই গ্রামে জন্ম নিল সেই মহাশয়।

বার শ’ বিরাশী জানি সাল পরিচয়।।

পিতৃ পরিচয় এবে করিব প্রকাশ।

শ্রীবিষ্ণু চরণ নামে উপাধি বিশ্বাস।।

Page 479 start

হিমালা নামেতে দেবী গর্ভে ছিল স্থান।

চারি ভাই গোস্বামীরা সবে গুণবান।।

খুলনা জিলার মধ্যে গ্রাম উজলপুর।

রাজচন্দ্র মাঝি যাঁর সম্মান প্রচুর।।

তস্য পত্নী ছিল বটে অতি ভক্তিমতী।

হরিচাঁদে মানে বলে জগতের পতি।।

পঞ্চ পুত্র একে একে সবে মারা গেল।

কোন জনে সেই দেবী ঔষধ না দিল।।

‘‘যা’’ করে ঠাকুর তাতে কোন দুঃখ নাই।

ঠাকুরের বাক্য ফেলে ঔষধ না খাই।।

এত তেজস্বিনী ছিল সেই ভক্তিমতী।

তাঁর কন্যা গোস্বামীর মাতা ভাগ্যবতী।।

গোস্বামীর পিতামহ নাম মনুরাম।

দেশ মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি অতি গুণধাম।।

‘‘তালুকের মনুরাম’’ এক ডাকে চেনে।

‘‘প্রাচীন বনেদি ঘর’’ কহে সর্ব্ব জনে।।

গোলক পাগল যিনি মহা ভাবময়।

তালুকের এই বাড়ী একবার যায়।।

মহাপ্রভু গুরুচাঁদ তেরশত সালে।

তালুকেতে একবার যান কুতুহলে।।

পরে যবে ওড়াকান্দী হাইস্কুল হল।

সে সময়ে দয়াময় তালুকেতে গেল।।

উন্মাদিনী মধুমতী কিছু নাহি মানে।

অল্পকালে তালুকেরে নিল গর্ভে টেনে।।

তার পরে করে বাস কেনুভাঙ্গা গাঁয়।

অদ্যাবধি সেইখানে গোস্বামীজী রয়।।

বাল্যকালে নিজ দেশে পড়ে পাঠশালে।

প্রাথমিক শিক্ষা লাগি পাটগাতী চলে।।

ব্রাহ্মণ বাড়ীতে থাকি করে অধ্যয়ন।

অল্প দিনে প্রাথমিক হল সমাপন।।

উচ্চ প্রাথমিক শিক্ষা লভিবার আশে।

খুলনা জিলার মধ্যে ডিংসীপাড়া আসে।।

‘‘গড়গড়ি’’ বলি কয় বংশেতে ব্রাহ্মণ।

সেই গৃহে গোস্বামীজী করে আগমন।।

পাঠশেষে করি করে বস্ত্র ব্যবসায়।

ব্যবসায় উপলক্ষ্যে নানা দেশে যায়।।

পাটগাতী গ্রামে ঘর মন্ডল উপাধি।

ধনবান মান্যবান তারা নিরবধি।।

শ্রীচন্দ্র কুমার নামে সেই বংশে যিনি।

বিপিনের ভগ্নী বিয়া করিলেন তিনি।।

এদিকে প্রভুর পুত্র সুধন্য কুমার।

মন্ডল বংশেতে হয় পরিনয় তাঁর।।

সেই সুত্রে ঠাকুরের সঙ্গে কুটুম্বিতা।

বিপিন রাখিত মনে সেইসব কথা।।

গউর বিশ্বাস নামে পন্ডিত সুজন।

বিপিনের গৃহে বাস করিত সেজন।।

নিবাস ফলসী গ্রাম ওড়াকান্দী কাছে।

সেই গ্রামে বিপিনের যাতায়াত আছে।।

একবার চৈত্রমাসে সেই গ্রামে যায়।

ওড়াকান্দী গেল পরে বারুণী সময়।।

সংক্রান্তীর দিনে হল বারুণী উৎসব।

সে ভাব নাহিক এবে বারুনীর ভাব।।

অল্প সংখ্যা লোক হত উৎসবেরে কালে।

দিনমাত্র বারুণীর মহামেলা মেলে।।

বিপিন চলিল সেথা কুটুম্বের বেশে।

প্রণাম করিতে গেলে ঠাকুরের পাশে।।

বিপিনের পরিচয় লইল ঠাকুর।

আনন্দ প্রকাশ প্রভু করিল প্রচুর।।

যত্ন করে জলয়োগ করাইল তারে।

বিপিন ফিরিয়া তবে আসিলেন ঘরে।।

সে সময়ে ঠাকুরের শিরে দীর্ঘ কেশ।

কটী-বিলম্বিত তাহা মনোহর বেশ।।

বিপিনের প্রাণে প্রশ্ন জাগে বারে বার।

দীর্ঘ কেশ রাখে কেন মাথার উপর।।

Page 480 start

এমন সুন্দর রূপ মনোমুগ্ধকর।

দীর্ঘকেশ রাখে কেন বুঝিনা ব্যাপার।।

যতবার এই কথা চিন্তা করে মনে।

মন হয় প্রভু যেন প্রাণ ধরে টানে।।

তাঁর চিন্তা লাগে ভাল শয়নে স্বপনে।

রূপ যেন আছে ঘিরে তার দুনয়নে।।

মনে মনে এই ভাব কাহারে না কহে।

চলে ফেরে কাজ করে চুপ করে রহে।।

এর পূর্ব্বে মাতিলেন শ্রীদেবীচরণ।

সম্পর্কেতে বিপিনের মামা সেই জন।।

গঙ্গাচর্না গ্রামে বাস মদন বিশ্বাস।

গুরুবলে দেবীচাঁদ যান তাঁর পাশ।।

আদি বীজ শ্রীমদন করিল বপন।

তারকের সঙ্গে গুণে শক্তি জাগরণ।।

শ্রীতারক দেবীচাঁদে নিল ওড়াকান্দী।

বর্ণনা করেছি পূর্ব্বে সেই সব সন্ধী।।

এবে মুন কি করিল বিপিন গোঁসাই।

একদিন জিজ্ঞাসিল দেবীচাঁদ ঠাঁই।।

‘‘আচ্ছা মামা সত্য করে বল মোর ঠাঁই।

ওড়াকান্দী গুরুচাঁদ কেমন গোঁসাই?

এমন সুন্দর রূপ ফুলের মতন।

লম্বা চুল রাখে শিরে বল কি কারণ?’’

এ সময়ে বিপিনের শুন পরিচয়।

মাঝে মাঝে যাত্রা গানে করে অভিনয়।।

অভিনয়ে ছিল তাঁর বহু নিপুনতা।

প্রশংসা করিয়া সবে বলে তার কথা।।

প্রশ্ন শুনি দেবীচাঁদ মধুর হাসিল।

স্তব্ধ হয়ে ক্ষণ পরে কহিতে লাগিল।।

‘‘ওরে ভোলা সারা বেলা কিখেলা খেলিলি?

কিবা অভিনয় তুই জীবনে করিলি।।

ওড়াকান্দী গুরুচাঁদে চিনিবারে চাস।

চিনিবি যে সেই চোখ কোথা তুই পাস?

তুই সেথা গিয়াছিলি কুটুম্বের বেশে।

কুটুম্বের সাধ্য নাই চেনে হৃষীকেশে।।

সে যে কি পরম রত্ন কি বলিব তোরে।

একবার দেখে ভোলা যায় কি রে তারে?

বল দেখি সত্য করে ওরে বাছাধন।

যেই হতে গুরুচাঁদে করিলি দর্শন।।

জাগে কিনা জাগে সেই সদা তোর প্রাণে?

হেন কেহ জাগে নাকি কভু কোন খানে?

দেখা মাত্র অগোচরে হরে যেঁই মন।

বল দেখি সে মানুষ গোঁসাই কেমন?

চিনিতে কি চাস তুই গুরুচাঁদে মোর?

জেগেছে কি সেই ইচ্ছা আজ প্রাণে তোর?

ইচ্ছা যদি জেগে থাকে তবে চলে আয়।

আর কত রবি মত্ত অসার খেলায়।।’’

এই ভাবে দেবীচাঁদ বলিল বচন।

কথা শুনি বিপিনের ঝরিছে নয়ন।।

কেন্দে কয় ‘‘দয়াময়! আর কথা নাই।

দয়া করে শ্রীচরণে দেহ মোর ঠাঁই।।

এতকালে গেছে কাল করে অভিনয়।

বুঝিলাম ধর্ম্ম ছাড়া কেহ কার নয়।।

এতদিন তোমা মনে ভাবিয়াছি মামা।

অপরাধ যা করেছি কর আজি ক্ষমা।’’

এত বলি গোস্বামীর চরণে পড়িল।

দয়া করে গোস্বামীজী তারে কোলে দিল।।

সেই হতে বিপিনের গতি ফিরে গেল।

দিবানিশি নামে মত্ত বলে হরিবল।।

পরে স্বামী দেবীচাঁদ তারে সাথে করে।

উপনীত হইলেন প্রভুর গোচরে।।

ওড়াকান্দী এসেছিল পূর্ব্বে যে বিপিন।

সেদিনের সে বিপিন নহে সে বিপিন।।

একবস্ত্র দীন বেশে চক্ষে জল ধারা।

বেশভূষা যত কিছু দফারফা সারা।।

Page 481 start

প্রভুজীর পদে যবে করিল প্রণাম।

চেয়ে দেখে প্রভু যেন নবঘন শ্যাম।।

উজ্জ্বল শ্যামল অঙ্গ মন্দ মন্দ হাসি।

সারা অঙ্গ হতে যেন ছোটে জ্যোতিঃ রাশি।।

কোথা সে গৌরাঙ্গ অঙ্গ কষিত কাঞ্চন?

কালো রূপে আলো যেন করেছে ভুবন।।

অপলক হতবাক বিপিন গোঁসাই।

ক্ষণ পরে দেখে সেই রূপ আর নাই।।

জ্ঞান ফিরে এল দেহে শুনিলেন কাণে।

দেবীচাঁদে ডাকি প্রভু কহিছে তখনে।।

‘‘কুটুমের ছেলে এ যে বিপিন বিশ্বাস।

এরে তুমি কেথা পেলে করিয়া তালাস?’’

দেবী কয় ‘‘দয়াময়! বিপিনের ভাগ্য।

কুটুম্ব বলিয়া তুমি তারে কর যোগ্য।।

লোকাচারে কুটুম্বিতা কর কৃপাময়।।’’

প্রভু কয় ‘যাহা ইচ্ছা করুক বিপিন।

আমি বলি তুমি তার হও গে জামীন।।’’

দেবীচাঁদ বলে ‘‘প্রবু যে আজ্ঞা তোমার।

তব কৃপা বলে লই বিপিনের ভার।।’’

কথা শুনে বিপিনের কোন কথা নাই।

ক্ষণে ক্ষণে ভাবাবেশে ছাড়িতেছে হাই।।

এইভাবে কিছুক্ষণ গত হয়ে গেল।

তাহারে ডাকিয়া তবে প্রভুজী কহিল।।

‘‘কি বিপিন সেই দিন পড়ে নাকি মনে?

কুটুম্বের বাড়ী এলে কুটুম্ব বিধানে।।

সে বিধান আজ তুমি যদি ছেড়ে দিলে।

কিসের কুটুম্ব তুমি এ-ঘরের ছেলে।।

আপনার বাড়ী ভেবে কর যাতায়াত।

ভয় নাই দেবী সদা রবে তব সাথ।।’’

মধুর বচন শুনি কান্দিল বিপিন।

বলে ‘‘বাবা আজ মোর বড় শুভদিন।।

আপনার দয়া পেয়ে ধন্য এ জীবন।

দয়া করে অভাগারে করুন গ্রহণ।।’’

প্রভু কয় ‘‘নাহি ভয় নিলাম তোমারে।

ওড়াকান্দী যাতায়াত কর বারে বারে।।

দেবীচাঁদ গুরু বলে কর তুমি মান্য।

দেবীর আশ্রয়ে তুমি হবে চির-ধন্য।।’’

এইভাবে গুরুচাঁদ করুণা করিল।

এবে শোন কি কার্য্য তাঁরে দিয়া হল।।

---০---