Page 424

যাদবের রাগাত্মিকা ভক্তি ও প্রভুর লোহারগাতী গমন

শ্রীযাদব মহাভাগ প্রাণে গাঢ় অনুরাগ

মনে ভাবে বৃথা মোর জীবন ধারণ।

বাঞ্ছাপূর্ণ নাহি হ’ল প্রভু গৃহে নাহি গেল

কোন পাপে এ ঘটিল বুঝিনা কারণ।।

বিচরণ পাগলেরে ডেকে নিয়ে একান্তরে

তার দু’টী করে ধরে আঁখি জলে ভাসি।

পরাণে দারুণ ব্যথা, যাদব না বুঝিল তা

মনে প্রাণে তাই ব্যথা হ’ল আর বেশী।।

বলে শোন বিচরণ জানিস ত মোর মন

কিবা ছাই ধন জন সব বৃথা মানি।

প্রভু যদি নাহি গেল আমার মরণ ভাল

মিছা সবে কেন বল কর টানাটানি।।

জনমের মত তাই সকলে ছাড়রে ভাই

দেশ ছেড়ে চলে যাই অচেনা বিদেশে।

গুরু মোরে হ’ল বাম পূর্ণ নহে মনস্কাম

বেঁচে কেন রহিলাম বল কা’র আশে?

এক কথা বলি শোন পাগলা রে বিচরণ

জানি তোরে গুরুধন করে বহু দয়া।

তুই যদি জোর করে মোরে ঘরে নিস তাঁরে

বুঝিব আমার পরে আছে তোর মায়া।।’’

এত বলি মহামতি চলি গেল শীঘ্রগতি

মনে মনে ইতি উতি কত চিন্তা করে।

যাদব মল্লিক যিনি নীরবে বসিয়া তিনি

করে করে কর টানি যাদবেরে ধরে।।

কল কল তরী চলে আসিয়া প্রকান্ড বিলে

যাদব ডাকিয়া বলে যাদবের প্রতি।

‘‘বল মূঢ় বলে মোরে বিড়ালের পদ ধরে

কেবা পায় কোথাকারে পরম রতন?

তালতলা বিড়ালের পদ ধরে এই জোর

কথা হল কি দুঃখের! হয়েছে কেমন?

কিন্তু তাতে রক্ষা নাই বল আমি কোথা যাই?

কেমনে ঠাকুর পাই বল তাই বল।

বুদ্ধি কিরে নাহি তোর কি চিন্তায় আছিস ভোর

তৃষ্ণা নাহি মেটে মোর দে রে মোরে জল।।

যাহা বলি তাহা কর ধর পদ্ম-কলি ধর

করে করে জুড়ি কর, কর উচ্চারণ।

শ্রীগুরু-গুরুবে নমঃ এই অর্ঘ্য লহ মম

শত অপরাধ ক্ষম গুরু প্রাণধন।।

জোখ ভরে জল আন বি-গুণে নির্গুণে টান

কলি ভরে দেরে প্রাণ চলুক উজানে।

কর দেখি এই ভাবে দেখি বেটা কোথা যাবে

টান যদি পায় তবে আসিবে এখানে।।’’

রাগাত্মিকা ভক্তি গুণে যাদব এসব ভণে

তাই শঙ্কা পেয়ে মনে যাদব মল্লিক।

পদ্ম কলি হাতে লয় কেন্দে কয় ‘‘দয়াময়!

কি ভাবে কি খেল’ হায় নাহি পাই ঠিক।।’’

এত বলি আঁখিজলে কলি ফেলে দিল জলে

নেচে নেচে কাল চলে বিপরীত টানে।

মহাভাবে ভরা প্রাণ যাদব ডাকিয়া কন

‘‘চেয়ে দেখ ভগবান শুনিয়াছে কাণে।।’’

তাঁর বাক্য হ’ল সত্য শুন এবে সেই তত্ত্ব

মহাভাবে মহামত্ত যাদব সুজন।

অন্তর্য্যামী দয়াময় সব দেখিবারে পায়

বিচরণে ডাকি কয় ‘‘শোন বিচরণ!

বল দেখি কি কারণে যাদবের লাগি কেনে

ব্যথা মোর বাজে প্রাণে বলত এখন।।’’

Page 425 start

বিচরণ কেন্দে কয় ‘‘ভক্তাধীন দয়াময়

ভক্তের কারণে হায়! উচাটন প্রাণ।

আমি বুঝিয়াছি কথা বলহে জগত পিতা!

কোন ভাবে ব্যাকুলতা হবে অবসান?

যাদব বলেছে মোরে গাঢ় ভক্তি অনুসারে

নিতে তোমা তাঁর ঘরে আজিকার দিনে।

যদি তব আজ্ঞা পাই আর কোন কথা নাই

একা একা চলে যাই লয়ে তোমা ধনে।।’’

প্রভু বলে ‘‘ওরে বোকা এসব রবে কি ঢাকা।

যাদব বিশ্বাস বেঁকা তা কি মনে নাই?

তার চেয়ে এই কর আমার বচন ধর

কারে নাহি কর ডর, বেয়ে যাওয়া চাই।।

আমি যদি করি সোর না শুনিস বারণ মোর

যা’স ইচ্ছা যথা তোর বাধা নাই কিছু।

একবার গেলে চলে যতজনে যাহা বলে

আমি তবে দিব বলে যাহা হয় পিছু।।’’

এই ভাবে করি সায় গুরুচাঁদ দয়াময়

উঠিয়া আপন নায় বলিছে তখন।

‘‘আর কেন বসে রও জোরে জোরে নাও বাও

তাড়াতাড়ি চলে যাও আপন ভবন।।’’

সায় জানে বিচরণ লগী নিয়ে ততক্ষণ

‘খোচ দিয়ে ঘন ঘন তরণী চালায়।

সঙ্গে যারা তারা কয় ‘‘এ কি কান্ড মহাশয়

কোন দিকে তরী যায় যাবে কোন গাঁয়?’’

বিচরণ কহে হাসি ‘‘চুপ করে থাক’ বসি

কিছুদূর ঘুরে আসি এই পথ ধরে।

তোমাদের ভয় নাই আমি একা একা বাই

যথা ইচ্ছা তথা যাই নিজবাহু জোরে।।

যাদব বিশ্বাস শুনি এসব অবাধ্য বাণী

ক্রোধে যথা ফুলে ফণী সেই মত ধায়।

প্রভুর নিকটে যায় ক্রোধভরে কথা কয়

বলে ‘‘শুন দয়াময়! প্রাণে নাহি সয়।।

বিচরণ সর্ব্বক্ষণ কাজ করে নিজ মন

একা যেন সেই জন কর্ত্তা সাজিয়াছে।

আপনার আজ্ঞা ফেলে তরী বেয়ে কোথা চলে

সেই কথা নাহি বলে এমনি হয়েছে।।’’

যাদবের কথা শুনি চতুরের শিরোমণি

উচ্চ কন্ঠে করে ধ্বনি কহে বিচরণ।

‘‘ওরে দুষ্ট বিচরণ কোথা কর বিচরণ

অমি মন্দ আচরণ দেখা’লে এখানে।।

এখনি ফিরাও তরী আমি যে নিষেধ করি

মোরে অবহেলা করি যাও কোনখানে?

যদি নাহি শোন কথা ভাঙ্গিব তোমার মাথা

চেষ্টা তুমি কর বৃথা আপনার মনে।।’’

প্রভু যত রেগে কয় বিচরণ হাসে তায়

এই ভাবে চলে যায় বাহিয়া তরণী।।

প্রভু কয় অবশেষে ‘‘যা ইচ্ছা করুক গে সে

আমি এই থাকি বসে কিছু নাহি জানি।।’’

এ দিকে যাদব ঢালী তরণীতে দ্রব্য তুলি

দুঃখে অশ্রুবারি ফেলি করিতেছে যাত্রা।

হেনকালে উদ্ধাশ্বাসে শ্যাম আসি তাঁর পাশে

মহানন্দে হেসে হেসে কহে শুভ বার্ত্তা।।

‘‘শুন শুন মহাশয় হ’ল তব ভাগ্যোদয়

গুরুচাঁদ দয়াময় আসিছেন হেথা।

দ্রব্য নিয়ে কোথা যাও ঘাটে ফিরে বান্ধ নাও

যদি নিজ ঘরে পাও জগতের পিতা।।’’

এই কথা শুনি কানে আশ্চর্য্য ভাবিয়া মনে

চাহি রহে দুর পানে যাদব গোস্বামী।

চোখে জল বুকে ভাব মুখে নাহি রহে রব

গরুচাঁদ জানে সব প্রভু অন্তর্য্যামী।।

অকস্মাৎ ছুটি যায় জনে জনে ডেকে কয়

‘‘আয় সবে ছুটে আয় গেলরে সময়।

আসিয়াছেন গুরুচাঁন পরিপূর্ণ ভগবান

ভরে যাবে মন প্রাণ প্রেমের নেশায়।।’’

Page 426 start

গোস্বামীর বাণী শুনি গ্রামবাসী যত প্রাণী

জনে জনে টানাটানি করে এল ঘাটে।

এদিকে প্রভুর তরী দূরে সবে লক্ষ্য করি

মুখে বলে হরি হরি সবে নদী তটে।।

কিছুকাল গত হল যবে তরী ঘাটে এল

কি যেন কি ভাব হ’ল বলিতে না পরি।

নরনারী সারি সারি, হাতে হাতে ধরি তরী

টেনে নেয় গৃহোপরি প্রেমানন্দে ধরি।।

আনন্দে নাহিক সীমা গৃহে যত ছিল রমা

কিছুতে না করে ক্ষমা মঙ্গলের ধ্বনি।

প্রভু কয় ‘‘থামা’’ ‘‘থামা’’ এখন আমাকে নামা’’

পাগলিনী গোপী সমা যতেক রমনী।।

আজ্ঞা মুনি প্রভু মুখে সকলে থামিয়া থাকে

প্রভুজী যাদবে ডেকে কহিছে বচন।

‘‘শুনহে যাদব গুণি! তোমার অন্তর জানি

বিচরণ আনে টানি না শুণি বারণ।।’’

যাদব কান্দিয়া কয় ‘‘বিচরণ মহাশয়

তাঁর গুণে ভাগ্যোদয় হয়েছে আমার।।’’

এতবলি বিচরণে কোল দিল হৃষ্ট মনে

যাদবের দু’নয়নে বহে অশ্রুধার।।

বহুমতে আয়োজন করে যাদব সুজন

নাম গান ভক্তগণ কর অবিরাম।

যাদবের সুগৃহিণী সমাসতী তাই জানি

পরম পবিত্রা ধনি অতি গুণধাম।।

তাঁর ভক্তি গুণে প্রভু বালক সাজিয়া কাবু

বহু খেয়ে বলে তবু ‘‘মোরে দিলে কউ?’’

মাতা তাতে কেন্দে বলে তোমার মতন ছেলে

পাই যদি ভাগ্যবেলে নিয়ে বসে রই।।

যাদবের ভক্তিগুণে প্রভু গেল তাঁর স্থানে

দীন ভাবে মনে মনে কি মদুর খেলা

খেলোয়ার যারা ভাবে তাহারা বুঝিবে সবে

কোন খেলা কোনভাবে চলে সারা বেলা।।

মনে মনে তলে তলে এই সব খেলা চলে

যারা জানে তারা বলে পরম সুন্দর।

সেই খেলা নাহি চিনে মহানন্দ দিনে দিনে

মারা বুঝি গেল প্রাণে মায়ার ভিতর।।

---০---