Page 357

ভক্তালয় ভ্রমণ

(প্রথম পর্ব)

বিধবার বিয়া দিল স্বামী দেবীচন্দ্র।

আনন্দিত তাহে অতি প্রভু গুরুচন্দ্র।।

অতঃপর দেবীচাঁদ ভাবিলেন মনে।

বানিয়ারী নিবে তেঁহ প্রভু গুরুচানে।।

আপন মনের কথা প্রভুরে জানায়।

তাহাতে সম্মতি দিল প্রভু দয়াময়।।

প্রভু বলে “শোন দেবী আমার বচন।

মম সঙ্গে প্রাদ্রী মীড করিবে গমন।।

যথাযোগ্য আয়োজন অবশ্য করিবে।

তোমার গৃহের ‘পরে মহাসভা হবে।।”

শুনি দেবীচাঁদ হ’ল বড় আনন্দিত।

পদে দন্ডেবৎ করে প্রেমে পুলকিত।।

দিন স্থির করি পরে নিজবাসে গেল।

ষ্টিমারে আসিবে প্রভু কথা ঠিক হল।।

নামিবেন নাগকাঠি বন্দরের পারে।

তথা হতে বানিয়ারী যাবে নৌকা করে।।

দেশে আসি দেবীচাঁদ সকলে জানায়।

আসিবেন দয়াময় আমার আলয়।।

ভক্তগণে সব্বনে সমাচার দিল।

দুইদিন পূর্ব্বে যত ভক্ত সেথা এল।।

এদিকে দয়াল প্রভু সাঙ্গপাঙ্গ সঙ্গে।

যাত্রা করে বানিয়ারী নিজে মনোরঙ্গে।।

পাদ্রী মীড সঙ্গী তাঁর আপনি হইল।

শ্রীবিধু চৌধুরী আদি কত সঙ্গে গেল।।

দূর্গাপুর হতে আসে কবি হরিবর।

ষ্টিমারে উঠিলেন তারাইল পর।।

এদিকে শ্রীদেবী করে বহু আয়োজন।

নাগকাঠী উপস্থিত লয়ে ভক্তগন।।

ডঙ্কা, শিঙ্গা কংস কাসী খোল করতাল।

লোহিত পতাকা হাতে বলে “হরিবল।।”

বিরাট সঙ্ঘট হল লোক সংঘটন।

নাগকাঠী উপস্থি শ্রীদেবীচরণ।।

আশ্চর্য্য মানিয়া লোকে বলাবলি করে।

এত আয়োজন সাধু করে কার তরে?

কেহ কেহ জিজ্ঞাসিল দেবীচাঁদ ঠাঁই।

কারে নিতে আয়োজন করেছ গোঁসাই?

আনন্দেতে দেবীচাঁদ ডেকে বলে ভাই।

সফল জনম মোর সুখে সীমা নাই।।

ওড়াকান্দীবাসী প্রভু ধন্য গুরুচাঁদ।

দয়া করি করিলেন পতিত আবাদ।।

রূপে গুণে কোনখানে যাঁর তুল্য নাই।

দয়া করে আসিছেন সেই যে গোসাই।।

পতিত পাবন প্রভু পতিতের বন্ধু।

পার করে দীনজনে এই ভব-সিন্ধ।।

মম সম পাতকীরে বড় দয়া তাঁর।

দয়া গুণে আসে প্রভু গৃহেতে আমার।।

Page 358 start

এদিকেতে গুরুচাঁদ সাঙ্গপাঙ্গ লয়ে।

উতরিল তারাইল ঘাটেতে আসিয়ে।।

সঙ্গেতে চলিল মীড অতি গুণবান।

মন্ত্রীবর যঞ্জেশ্বর সঙ্গে সঙ্গে যান।।

দূর্গাপুরবাসী কবি হরিবর নাম।

প্রভু সঙ্গে মনোরঙ্গে চলে গুণধাম।।

যখনে উঠিল প্রভু জাহাজ-উপরে।

একদৃষ্টে আরোহীরা তাঁরে দৃষ্টি করে।।

যাঁর রূপে মুগ্ধ দেখ কোটী শশধর।

ক্ষুদ্র নরে কি বুঝিবে মহিমা তাঁহার?

সরল সহজ বেশে প্রভু চলে আগে।

ইংরাজী পোষাকে মীড চলে পিছু ভাগে।।

সবে ভাবে “বিমাশ্চর্য্য এই কোন জন?

সাহেব যাঁহার পিছে করিছে গমন।।

মোরা সবে এই নীতি জানি ভালমতে।

সাহেব যদ্যপি কেহ আসে এ দেশেতে।।

তার পিছু পিছু ছোটে দেশবাসী সবে।

এখানে বিরুদ্ধ ভাব হল কোন ভাবে?

এখানে সাহেব নিজে বলে এর পিছে।

এই ভাব কি কারণে সম্ভব হয়েছে?

নিশ্চয় বুঝিনু ইনি মহাজন।

তাহাতে সাহেব পিছে করিছে গমন।।

মনে মনে এই সব আলোচনা করে।

মীডের সহিতে প্রভু চলে একত্তরে।।

যার পাশ দিয়া যায় করজোড়ে সেই।

প্রণাম করিছে সুখে বাধাবাধি নেই।।

কেনবা এমন নাহি হবে তাই বল।

কমলা-সেবিত যাঁর চরণ কমল।।

অনাহারে অনিদ্রায় মুনি ঋষিগণে।

যে-চরণ চিন্তা করে বসিয়া কাননে।।

যাঁর আজ্ঞা মতে চলে রবি শশী তারা।

বরষে বরষা যাঁর করুণার ধারা।।

যাঁর ইচ্ছা হতে সৃষ্টি হল এ ব্রহ্মান্ড।

আদি মূল রূপে যিনি আর সবে কান্ড।।

সেই শক্তি নামে যদি মানব আকারে।

তাঁরে অস্বীকার বল কে করিতে পারে?

নিজ গুণে টেনে লয় সকলের মন।

পদ প্রান্তে পড়ে সবে সেই সে কারণ।।

হেনভাবে চলিলেন প্রভু দয়াময়।

নাগকাঠি বন্দরেতে হলেন উদয়।।

বহুলোক সঙ্গে করি দেবীচাঁদ আছে।

দূরেতে জাহাজ দেখি আনন্দেতে নাচে।।

বীরদাপে ধরা কাঁপে সোর শব্দ গোল।

ডঙ্কা শিঙ্গা বাজে আর বলে হরিবোল।।

অভূত অপূর্ব্ব দৃশ্য দেখিল সকলে।

মতুয়ার বক্ষ ভেসে যায় অশ্রুজলে।।

জাহাজেতে যত লোক আছিল অরোহী।

আশ্চর্য্য মানিয়া সবে দেখিলেন চাহি।।

নদীর কিনারে লোক অসংখ্য সংখ্যায়।

বীরদাপে হরিবলে নাচে কান্দে গায়।।

কাপ্তান খালাসী সবে অবাক হইয়া।

কিনারের লোক প্রতি রহিল চাহিয়া।।

কার অভ্যর্থনা লাগি আসিয়াছে সবে?

বিষ্মিত হইয়া শুধু সেই কথা ভাবে।।

জাহাজ ভিড়িল কুলে প্রভু ধীরে চলে।

পিছু পিছু চলে মীড কথা নাহি বলে।।

চরণ রাখিল প্রভু নদীর কিনারে।

সষ্টাঙ্গ প্রণাম তাঁরে দেবীচাঁদ করে।।

দেখাদেখি যতজন উপস্থিত ছিল।

ভূমিতে লোটায়ে সবে প্রণাম করিল।।

প্রণাম করিয়া সবে বলে হরিবল।

প্রেমানন্দে সকলের চক্ষে বহে জল।।

ভাব দেখি জাহাজের খালাসীরা যত।

ধন্য ধন্য মহাজন বলে অবিরত।।

Page 359 start

তাহা দেখি আরোহীরা প্রেমে মত্ত হয়ে।

হরিবল বলে সবে আপনা ভুলিয়ে।।

কাপ্তেন, খালাসী সবে ভাবে মনে মন।

এতক্ষণ চিনি নাই এ হেন রতণ।।

বহু খেদ করে পরে মিলিয়া সকলে।

প্রভুকে সেলাম করে ভাবি আঁখি জলে।।

অন্তর্য্যামী প্রভু তবে জানিয়া অন্তরে।

জাহাজের প্রতি চাহি দাঁড়ালেন ফিরে।।

তাহা দেখি আরোহীর আনন্দ বাড়িল।

জোড় হস্ত করি সবে প্রণাম করিল।।

কেহ কেহ নতশিরে করিল প্রণাম।

খালাসীরা ডেকে বলে “প্রভুজী সেলাম।।”

হাসিয়া প্রভুজী সবে করে আশীর্ব্বাদ।

হেনকালে করজোড়ে কহে দেবীচাঁদ।।

“তরণী প্রস্তুত প্রভু রাখিয়াছি আমি।

দয়া করে তরী পরে চল অন্তর্য্যামী।।

প্রভু বলে সেই ভাল চল শীঘ্র চর।

নদীর কিনারে থেকে কিবা হবে বল।।

তরণীর পরে উঠে প্রভু দয়াময়।

সঙ্গে সঙ্গে মীড আসি উঠিল নৌকায়।।

ধবল বরণ মীড প্রভুজী গৌরাঙ্গ।

একঠাঁই দুই রূপ অপরূপ সঙ্গ।।

কুলে যারা ছিল তারা ডেকে বলে ভাই।

এমন মোহন রূপ কভু দেখি নাই।।

নিরালে বসিয়া বিধি সাধনা করিল।

কোটী কল্প বসে বুঝি এরূপ গড়িল।।

তাহা বা কি কিবা ভুল বলিতেছি ভাই।

এরূপ গড়িবে বিধি হেন শক্তি নাই।।

বিধির গঠন নহে এ হেন মূরতি।

এরূপ গড়িতে কার নাহিক শক্তি।।

নিজ রূপ নিজে বুঝি গড়েছে নিরালে।

এরূপের তুল্য রূপ কোথা নাহি মিলে।।

নরনারী পশু পাখী কুসুম লতায়।

অবিরত দেখি কত হেথায় সেথায়।।

শরতের পূর্ণ চন্দ্র দেখেছি গগনে।

দেখেছি ঊষার রূপ বালার্ক কিরণে।।

সত্য বটে সে সকালে মন হরি লয়।

ক্ষণিকের তরে তাহা জানিও নিশ্চয়।।

চিরতরে মন তারা বান্ধে না কখন।

গুরুচাঁদ-রূপে অন্ধ হয় যে নয়ন।।

মন হরে প্রাণ হরে হরে সমুদয়।

হেরিলে রূপের ভাতি ভোলা নাহি যায়।।

পাষাণের বুকে রেখা অক্ষয় যেমন।

গুরুচাঁদ রূপে ভোলে তেমনি নয়ন।।

রূপের আরেক গুণ শুন বলি ভাই।

হেরিলে নয়ন কোণে আর রক্ষা নাই।।

দিবানিশি মনোমাঝে ঢেউ খেলে যায়।

নয়নের পথে এসে মন হরি লয়।।

তাতে বলি এ রূপের নাহিক তুলনা।

কিছু অংশ পেল বুঝি জারা কাঁচা সোনা।।

আজি বুঝিলাম কেন মাতিয়াছে দেবী।

ঘরে কি থাকিতে পারে দেখে এই ছবি।।

এই মত সবে মিলে বলাবলি করে।

এদিকে তরণী তবে চলে ধীরে ধীরে।।

কুলে থেকে সবে করে জয় জয় ধ্বনি।

হরি বলে চলে ধেয়ে মতুয়া-বাহিনী।।

সকল দেখিয়া মীড ভাবে মনে মন।

“মহাপ্রভু গুরুচাঁদ পুরুষ রতন।।”

ক্রমে ক্রমে তরী এল বানিয়ারী গাঁয়।

অপরূপ সজ্জা সবে দেখিল তথায়।।

পরম নৈষ্ঠিক সাধু দেবী গুণধাম।

করেছে সভার সজ্জা অতি অনুপম।।

নদীতীরে হতে নিজ গৃহ যত দূরে।

কলাগাছ রূপিয়াছে যত্ন সহকারে।।

Page 360 start

রাজপথ-সম-পথ করিয়া গঠন।

মঙ্গল কলস ঘট করেছে স্থাপন।।

যেই কালে তরী আসি ঘাটেতে ভিড়িল।

নারীগণে উচ্চ রোলে হুলু ধ্বনি দিল।।

মীড সহ প্রভু তবে কুলেতে নামিল।

“জয় গুরুচাঁদ” ধ্বনি সকলে করিল।।

অতঃপর প্রভু গেল গৃহের উপরে।

আনন্দে মতুয়া সবে কীর্ত্তণাদি করে।।

কিছু পরে প্রভু সবে নিষেধ করিল।

প্রণাম করিয়া সবে নীরব হইল।।

অতঃপর প্রভু করে স্নানাদি ভোজন।

দেবীচাঁদ করে তাহে বহু আয়োজন।।

ডক্টর মীডের গুণে বলিহারি যাই।

অভিমান শূণ্য যেন আপনি নিতাই।।

যদিও ইংরাজ জাতি বিভিন্ন আচার।

সর্ব্বত্র সবার সঙ্গে করেন আহার।।

যার গৃহে যে আহার্য্য করে আয়োজন।

যে আহার্য্য মীড সদা করে গ্রহণ।।

দেবীচাঁদ গৃহে মীড সেই ভাবে চলে।

ডাল ভাত বাঞ্জনাদি নিল অবহেলে।।

ভোজনান্তে হল সেথা সভার শোভন।

দেশদেশান্তর হতে এল বহুজন।।

প্রভু ক’ন মীড হেথা হোন সভাপতি।

সভাজনে শুনি কথা আনন্দিত অতি।।

মীড কহে “এই কার্য্যে ভাল নাহি মানি।

বড় কর্ত্তা হতে শ্রেষ্ঠ কেবা হল শুনি?

তিনি যবে উপস্থিত আছেন হেথায়।

সভাপতি হলে তিনি যথাযোগ্য হয়।।”

প্রভু বলে “সাহেব জী কথা ফেল’ নাক।

আমি বলিয়াছি কথা মোর কথা রাখ।।”

অমনি ডক্টর মীড নীরব হইল।

সভাপতি রূপে তবে আসনে বসিল।।

বৃহৎ হইল সভা লোকে লোকারণ্য।

সবে বলে “দেব-সভা তুল্য সবা ধন্য।।”

সভাতে দাঁড়ায়ে তবে দয়াল ঠাকুর।

জাতির উন্নতি কথা কহিল প্রচুল।।

তর্কবাদী বহুজন আছিল সভায়।

বিরুদ্ধে কহিবে কথা ছিল সে আশায়।।

বিরুদ্ধ পক্ষের যুক্তি খন্ডনের তরে।

মহাপ্রভু কহিলেন কথা ধীরে ধীরে।।

নখ-দর্পণেতে যাঁর এ ব্রহ্মান্ড ভাসে।

সকলের মন তেঁহ জানে অনায়াসে।।

বিরুদ্ধ বাদীর কর্ত প্রভু ভাল জানে।

না-বলিতে কোন কিছু সিদ্ধান্ত বাখানে।।

বিধবার বিবাহাদি কি কারণে হয়?

একে একে কহিলেন গুরু দয়াময়।।

“জাতির মঙ্গল তরে সে কার্য্য সাধন।

আমি করিয়াছি তাহা শুন সভাজন।।

বৃথাই দেবীর দোষ দেয় সর্ব্বলোকে।

সকলি করেছে দেবী ভাবিয়া আমাকে।।

দেবী যাহা করিয়াছে সে কার্য্য আমার।

দেবীর কার্য্যেতে হ’ল এ জাতির উদ্ধার।।

কিসে জাতি ধন্য হবে জানে কয় জনে?

আপনার জাতি বল কয় জনে চেনে?

জাতি জাতি কর সবে কতটুকু লয়ে?

দেও ত জাতির ব্যাখ্যা আমারে শুনায়ে।।

বিধির বিধানে বল জাতি আছে কাটী?

“জাতি জাতি কর যদি সেই জাতি খাঁটি।।

নর জাতি পশু জাতি ভূচর খেচর।

আমি বটে জানি এই জাতির বিচার।।

মানুষে মানুষে বল ভিন্ন জাতি কোথা?

নর জাতি এক জাতি ভেদ-কথা বৃথা।।

জাতির উন্নতি যদি করিবারে চাও।

মানবের শুভ যাবে সেই পথে ধাও।।

Page 361 start

মম পিতা হরিচাঁদ মানবের তরে।

এসেছিল এ জগতে নরদেহ ধরে।।

বিশ্ববাসী মানবের যাতে শুভ হয়।

সেই ধর্ম্ম নীতি কথা বলেছে সদায়।।

মানব গোষ্ঠীর তাতে সুমঙ্গল হবে।

নরজাতি দিনে দিনে সে-ধর্ম্ম জানিবে।।

সেই নীতি শিরে করি আমি কাজ করি।

আমার ভরসা মাত্র দয়াল শ্রীহরি।।

জগত-বান্ধব ছিল হরি দয়াময়।

এ-বিশ্ব তারণ-কথা তাঁরে শোভা পায়।।

মোর মধ্যে সেই শক্তি কিছু মাত্র নাই।

পিতার আদেশ মাত্র বহিয়া বেড়াই।।

তিরোধন পূর্ব্বে তিনি ডাকিয়া নিকটে।

আমাকে বলিল কথা অতি অকপটে।।

দলিত পীড়িত যত বিদ্যাহীন নর।

মতাদুঃখে কাটে কাল পৃথিবী-ভিতর।।

তাদের দুঃখের বোঝা বিদ্যা বুদ্ধি দানে।

দূর করে দিতে আজ্ঞা করে ততক্ষণে।।

অগ্রভাগে বঙ্গবাসী নমঃশূদ্র গণে।

উদ্ধার করিতে বলে আনন্দিত মনে।।

নিপীড়িত জাতি মধ্যে এজাতি প্রধান।

অগ্রভাগে করি তাই তাদের কল্যাণ।।

নমঃশূদ্র সে আদর্শ করিলে গ্রহণ।

তাঁদের ধরিয়া ধন্য হবে অন্য জন।।

তাহার প্রমাণ আজি দেখ হে সবাই।

অবশ্য ঘটিছে সব মিথ্যা বলি নাই।।

আমার পিতার ভক্ত মতুয়া যাহারা।

দেশে দেশে কোন কর্ম্ম করিয়াছে তাহারা?

আর বলি শোন কথা কথার চূড়ান্ত।

নমঃশূদ্র দেখ আজি কত ভাগ্যবন্ত।।

অস্পৃশ্য চন্ডাল বলি গালি দিত যারা।

শিষ্যরূপে আজি দেখ পদানত তারা।।

মতুয়ার গণ চলে আজি দেশে দেশে।

এক বস্ত্র ধারী বটে বেহালেল বেশে।।

নির্ব্বাণ-আগ্নেয়গিরি যথা ঘুমে রয়।

সেই মত মতুয়ারা ঘুরিয়া বেড়ায়।।

কার্য্যকালে মহোল্লাসে অগ্নি সম জ্বলে।।

পাপী তাপী তর্কবাদী ডুবায় সকলে।।

শক্তি দেখি ভক্তি দেখি যত জীব কুল।

মতুয়ারে “গুরু” করে হইয়া আকুল।।

চন্ডালত্ব ঘুচাইয়ে দিল ব্রহ্ম-পদ।

তাই বুঝি মতুয়ারে ভেবেছে আপদ।।

চিরকাল পরপদ-ধূলি মাখ অঙ্গে।

তোমরা কিসের তুল্য মতুয়ার সঙ্গে?

তোমাদের মান দিতে তাঁরা হল দোষী।

গোবরের পোকা যেন গোবরেতে খুশী।।

আরো বলি শোন কথা নমঃশূদ্রগণ।

অনর্থক ক্রোধ সবে কর কি কারণ?

নমঃ জাতি নাম ভাল নমস্য সবার।

নমস্কার পেতে লাগে কোন ব্যবহার?

ধর্ম্ম আর বিদ্যাবলে চিত্ত শুদ্ধ হয়।

চিত্ত-শুদ্ধ জনে সবে ভকতি জানায়।।

তোমার জাতির মধ্যে সেই গুণ কই?

গুণ যদি নাহি থাকে কিসে বড় হই?

মতুয়ার দ্বেষ কত কর মনে মনে।

ভেবে দেখ সব কর শুধু অকারণে।।

এক সঙ্গে তারা সবে করিছে আহার।

তার মধ্যে দোষ বাপু বল কি তাহার?

শ্রীক্ষেত্র পুরুষোত্তমে ব্রাহ্মণ যবন।

এক সঙ্গে করে থাকে প্রসাদ গ্রহণ।।

সীমাবদ্ধ স্থানে যদি এত গুণ রয়।

মতুয়ার গুণে তাহা হ’ল সর্ব্বময়।।

শাস্ত্রের দোহাই সবে দেও সর্ব্বদায়।

তত্ত্ব তার কোন জনে মান না কোথায়।।

Page 362 start

পুরাণের বাক্য বলি শান সবে বসি।

নারদের ঠাঁই প্রভু যাহা বলে আসি।।

“নাহং তিষ্ঠামি বৈকুন্ঠে নচে যোগিণাং হৃদয়ে।

মদ্ভক্তাঃ যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদ।।”

যেই খানে হরি নাম গুনগান হয়।

আপনি বৈকুন্ঠনাথ উদয় তথায়।।

যেখানে উদয় হয় কমল লোচন।

ক্ষেত্র হতে হীন তারে বলে কোন জন।।

প্রেমানন্দে মতুয়ারা নাম গান গায়।

অন্ন কোথা শ্রীনাথের প্রসাদান্ন খায়।।

প্রসাধের মধ্যে যেবা আনে ভিন্ন ভেদ।

তার পক্ষে প্রসাদ তো নরকের ক্লেদ।।

শ্রীক্ষেত্রের ভাব আজি প্রতি ঘরে ঘরে।

আমার পিতার ভক্ত মতুয়ারা করে।।

এসব দেখিয়া তবু আছ দৃষ্টি হীন।

কয়লা ছাড়িতে কভু পারেনা মলিন।।

ছেড়ে দাও গন্ডগোল আঁখি মেলে চাও।

সাধুর তরঙ্গে ডুবে প্রাণ ভরে খাও।।

অভিমান বশে সবে হয়ে আছ অন্ধ।

অন্ধকারে বসে পায় পেচকে আনন্দ।।

হিংসা হিংসি দ্বেষা দ্বেষী ভুলে যাও তাই।

একতা বিহনে দেখ উদ্ধার ত নাই।।

আর কথা বলি যাহা শোন মন দিয়া।

নরনারী বিদ্যাশিক্ষা কর এক হইয়া।।

মাতা ভাল নাহি হলে পুত্র ভাল নয়।

মার গুনে ছ ভাল লোকে তাই কয়।।

এই যে ডক্টর মীড বসিয়া এখানে।

তোমাদের জন্যে চিন্তা করে সর্ব্বক্ষণে।।

নারীর শিক্ষার তরে এই মহামতি।

ওড়াকান্দি বিদ্যালয় করেছে সম্প্রতি।।

ইহার সঙ্গিনী যিনি মিস টাক নাম।

নারীর উন্নতি লাগি চেস্টা অবিরাম।।

কত ঋণী নমঃশূদ্র ইহাদের ঠাঁই।

সে সব বলিব কিবা গুণে সীমা নাই।।

বহু কথা একা আমি বলিয়াছি হেথা।

এবে সবে শোন তবে সাহসের কথা।।

বসিবার পূর্বে পুনঃ বলি আরবার।

ধর্ম্ম আর বিদ্যা বিনে নাহিক উদ্ধার।।

পবিত্র চরিত্র জানি সর্ব্ব নীতি সার।

ধর্ম্মে কর্ম্মে সর্বখানে মান সদাচার।।

এত বলি দয়াময় বসিল আসনে।

আকাশ ভরিয়া গেল জয় জয় গানে।।

অতঃপর উঠিলেন মীড মহামতি।

অনেক বলিল কথা করিয়া যুকতি।।

সার মর্ম্ম তার কিছু ত্রিপদীর ছন্দে।

বলিব সবার ঠাঁই মনের আনন্দে।।


কহে মীড বাস্তবিক

আজিকার দিনে।

কেন হেন মনে হল

ভার মোর মনে।।

বৈদেশিক আমি ঠিক

ভিন্ন জাতি ভাষা।

দীনজনে কৃপা দানে

মনে মোর আশা।।

আমি বঙ্গে মনোরঙ্গে

ভ্রমিয়া বেড়াই।

যাঁরে চাহি তাঁরে নাহি

খুঁজিয়া ত পাই।।

মনে মনে সর্ব্ব ক্ষণে

করি অন্বেষণ।

তবু দেখা প্রাণ সখা

না দেয় কখন।।

Page 363 start

দিনে দিনে মনে প্রাণ

হতেছি হতাশ।

এ সময় দয়াময়

দিলেন আশ্বাস।।

কিবা নাম শুনিলাম

গ্রাম ওড়াকান্দী।

শুনি কানে সেই ক্ষণে

মন হল বন্ধী।।

আসিলাম দেখিলাম

বুঝিলাম মনে।

খুঁজি যারে হেথাকারে

রয়েছে গোপনে।।

দীন গৃহে ঢেকে রহে

আপন সৌরভ।

অন্ধ জাতি ছন্ন মতি

জানেনা গৌরব।।

দেখা মাত্রে প্রেম সূত্রে

বাঁধিয়াছে মোরে।

শক্তি নাই কোথা যাই

ছাড়িয়া তাহারে।।

তাতে বলি মহাবলী

নমঃশূদ্রগণ।

জান মনে এই জনে

পরম রতন।।

হেন রত্ন বিনা যত্ন

আসেনা কোথায়।

ভুল করে যেন তারে

ছেড় না হেলায়।।

কি জঞ্জাল হে চন্ডাল

বলিত যাহারে।

কৃপা করে নিজ করে

উদ্ধারে তাহারে।

মোরে বাধ্য করে সাধ্য

হেন নাহি কার।

মোরে বান্ধে গুরুচাঁন্দে

মহিমা তাহার।।

ওঠ জাড়ি কিবা লাগি

রয়েছে আঁধারে।

দীপ্ত রবি সম ছবি

তোমাদের ঘরে।।

বলে যাহা কর তাহা

মন ঠিক কর।

ডেকে যায় এ সময়

তাঁর পথ ধর।।

মতিমান দেবীচান

গুণেতে বাখানি।

কুল শ্রেষ্ঠ ইষ্ট নিষ্ঠ

তারে আমি জানি।।

একত্রতা বান্ধবতা

তার সাথে মোর।

হেথা আসি মিশামিশি

প্রেমেতে বিভোর।।

দলে দলে সর্ব্ব স্থলে

জাগ নমঃশূদ্র।

কেন হায় এ ধরায়

রবে সবে ক্ষুদ্র।।

নমঃ জাতি প্রতি প্রীতি

মোর সদা আছে।

চিরদিন মোর ঋণ

আছে নমঃকাছে।।

বলি তাই শোন ভাই

ওঠ সবে জেগে।

সিংহ প্রায় যেতে হয়

বীর অনুরাগে।।

Page 364 start

কর হুষ কি মানুষ

আসিয়াছে ঘরে।

ধর তারে নিষ্ঠা ভরে

অন্তরে বাহিরে।।

এ সুযোগ যোগাযোগ

বড়ই আশ্চর্য্য।

মনোমত অবিরত

কর সবে কার্য।।

যে কান্ডারী দয়া করি

ধরিয়াছে হাল।

অন্যজনে কোন গুণে

পায়না নাগাল।।

এ সৌভাগ্য পেতে যোগ্য

নহে অন্য কেহ।

কেন জানি গুণমনি

করেছে এ স্নেহ।।

উপদেশ করি শেষ

মহতী সভায়।

কর সবে উচ্চ রবে

গুরুচাঁদ জয়।।


ভাবেবে করিল মীড বাক্য সমাপন।

জয় গুরুচাঁদ ধ্বনি করে সভাজন।।

প্রভু কহে জয় মীড দীনের বান্ধব।

সঙ্গে সঙ্গে সভা জনে করে সেই রব।।

সভা সাঙ্গ করি প্রভু বানিয়ারী রয়।

পরদিন উপনীত বড় বাড়ী গাঁয়।।

শ্রীরাম চরণ নামে অতি ধনবান।

তার গৃহে মহাপ্রভু করিল প্রয়াণ।।

বহু কথা আলোচনা হইল তথায়।

তদন্তে পুলিশ সাহেব সেইখানে যায়।।

বৈদক্রমে প্রভু সঙ্গে হল দেখাদেখি।

প্রভুর সঙ্গেতে তেহ করে মাখমাখি।।

বিনয়ে প্রভুর তেঁহ করিল সম্মান।

ভাব দেখি ভক্ত গণে নেচে ওঠে প্রাণ।।

যেইখানে যায় প্রভু ন ভাব আনে।

আনন্দের ঢেউ সদা নাচে সেই খানে।।

প্রত্যহের রীতি নীতি জীবে ভুলে যায়।

আনন্দে পাথরে পড়ি হাবুডুবু খায়।।

মানবের আচরণে দেখি ব্যবহার।

রাজ্য মধ্যে রাজা যবে করেন বিহার।।

ছুটি পায় কয়েদীরা কাটে কর্ম্ম বন্ধ।

জয় মহারাজ বলি করে যে আনন্দ।।

সামান্য কারার দ্বারমুক্ত হয়ে যায়।

সংসার করার বুকে আসি বন্ধু হয়।।

গুরুচাঁদ আগমনে ভব কারা খোলে।

পাপী তাপী, দুঃখী সদা নাচে কুতুহলে।।

ইহা দেখি মনে হয় তারকের গান।

মানুষের আগমনে বহে প্রেম বান।।

যে যে খানে দয়াময় করিল গমন।

জাতির উন্নতি কথা কহে সর্ব্বক্ষণ।।

সেই বাণী কানে শুনি জাতি জেগে ওঠে।

গুরুচাঁদ কৃপা গুণে এত সব ঘটে।।

ভ্রমণ করিয়া শেষ প্রভু আসে ঘরে।

জয় ধ্বনি করে সবে আনন্দ অন্তরে।।

ঘরে ঘরে ঘুরে প্রভু প্রেম-বাতি জ্বলে।

সেজে অন্ধ মহানন্দ চক্ষু নাহি মেলে।।

---০---