Page 459

ভক্তকবি শ্রীমৎ হরিবর সরকারের জীবনকথা

প্রেমিক সাধক কবি ভক্ত হরিবর।

ফরিদপুর জিলা মধ্যে দুর্গাপুর ঘর।।

রচনা কি কবিগানে বহু খ্যাতি যাঁর।

তাঁর পদে সবিনয়ে করি নমস্কার।।

ধন্য কবি বঙ্গ দেশে আনন্দ সুজন।

তাঁর পুত্র হরিবর গুণে মহাজন।।

পুত্রহীন আনন্দের দুঃখ অতিশয়।

মহোদুঃখ হরিচান্দে কেন্দে কেন্দে কয়।।

শ্রীহরি ডাকিয়া বলে আনন্দের ঠাঁই।

‘‘শুন হে আনন্দ আমি যাহা বলি তাই।।

‘এক বর্ষ ব্রহ্মচার্য্য পাল’ পত্নী সাথে।

অবশ্য সুপুত্র লাভ হইবে তাহাতে।।’’

প্রভু আজ্ঞা শিরোধার্য্য আনন্দ করিল।

তার ফলে পুত্ররূপে হরিবরে পেল।।

বার শত পচাত্তর সালের গণনা।

পুত্র দিল হরিচাঁদ করিয়া করুণা।।

শ্রীহরির বরে জন্ম নিল মহাশয়।

হরিবর বলি তার পিতা নাম দেয়।।

পুত্র লয়ে শ্রী আনন্দ ওড়াকান্দী গেল।

ভক্তিভরে বহু কথা হরিকে কহিল।।

নমঃকুলে আছে যত ‘‘কবি সরকার।’’

সুরসিক বলি ব্যাখ্যা পায় হরিবর।।

পুত্রের শিক্ষার লাগি আনন্দ সুজন।

গ্রাম মধ্যে পাঠশালা করিল গঠন।।

তথা হতে প্রাথমিক পাঠ শেষ করি।

ছাত্রবৃত্তি পড়িবারে গেল দেশ ছাড়ি।।

ঘোণাপাড়া গ্রামে গিয়ে ছাত্রবৃত্তি পড়ে।

বিশেষ যশের সঙ্গে তাহা পাশ করে।।

Page 460 start

তখনে নিয়ম ছিল ছাত্রবৃত্তি পড়ি।

মোক্তার হইত লোকে পড়িয়া মোক্তারী।।

পাঠ শেষ করি তেঁহ মোক্তারী পড়িল।

পরীক্ষাতে শেষ কালে পাশ নাহি পেল।।

তারপরে শ্রীআনন্দ পুত্রে বিয়া দিল।

সেই হতে হরিবর সংসারী সাজিল।।

কিছুকাল গতে জন্মে একটি নন্দন।

পুত্র সহ পত্নী মল দৈবের ঘটন।।

একে ত স্বভাব কবি তাতে ব্যথা পেল।

পত্নীর বিয়োগে এক গ্রন্থ বিরচিল।।

পুনরায় করিলেন দার পরিগ্রহ।

ভুলিলেন ক্রমে ক্রমে পত্নীর বিরহ।।

বাসুড়িয়া গ্রামে তার শ্বশুর আলয়।

মাঝে মাঝে কবিবর তথাকারে যায়।।

এ সময়ে হরিচাঁদ নরাকারে নাই।

ধামেশ্বর গুরুচাঁদ সবে জানে তাই।।

প্রধান ভকত জানি স্বামী মহানন্দ।

অক্ষয়, কার্ত্তিক, আর শ্রীতারকচন্দ্র।।

বহু দেশে ভ্রমে তাঁরা প্রচার কারণে।

মতো নহে শ্রীআনন্দ হরিচান্দে মানে।।

রোগের বিধান যাহা প্রভু গেছে বলে।

ব্যাধি হলে সে আনন্দ সেই ভাবে চলে।।

তাই জানে তাই মানে কবি হরিবর।

নাহি জানে মতুয়ার সব সমাচার।।

গীত বাদ্য কার্য়্যে তিনি বাল্যকাল হতে।

বিশেষ সুদক্ষ তিনি আছে নানামতে।।

একদিন বাসুড়িয়া গেল হরিবর।

আশ্চর্য্য শুনিল কথা এক সমাচার।।

বাসুড়িয়া গ্রামে কত মতোরা আসিবে।

মন্ডল বাড়ীর পরে মহোৎসব হবে।।

শ্বশুরের গৃহ হতে বেশী দুরে নহে।

তাই তারা বাক্যচ্ছলে হরিবরে কহে।।

মহোৎসবে যেতে কিবা আছে তব মন?’’

হরিবর বলে ‘‘তাহা করে কোনজন?

টলুয়া বৈরাগী যদি করে মোহৎসব।

সেথা যেতে মনে করি মহা অগৌরব।।’’

তারা বলে মহাশয় এরা তারা নয়।

মতুয়ার মহোৎসব শোন পরিচয়।

জাতিভেদ প্রথা কিছু নাহি বাঁধাবাঁধি।

মতো হলে সবে মিলে করে কাঁদাকাঁদি।।

জ্যেষ্ঠ কি কনিষ্ঠ সবে সমভাবে দেখে।

সকলের পদধুলি সবে নিয়ে থাকে।।’’

ক্রোধে কয় হরিবর কার্য্য ভাল নয়।

কতগুলি কার্য্য দেখি মন্দ অতিশয়।।

তাহাদের নেতা বল আছে কোন জন।

নিশ্চয় তাঁহারে আমি করিব শাসন।।’’

এতবলি পরদিন সেই হরিবর।

মহোৎসবে উপনীত হইল সত্বর।।

পথে যেতে শোনে কাণে সুললিত ধ্বনি।

ব্যাকুল হইল প্রাণ গীতধ্বনি শুনি।।

মধুর মৃদঙ্গ বাজে মতুয়ারা গায়।

‘‘কে যাবি গৌরঘাটে, আয় চলে আয়।।’’

তারকের কৃত ‘বোল’ ভাবরসে ভরা।

স্বভাব কবির চিত্ত হল দিশাহারা।।

কি যে মনে করে এল কিছু মনে নাই।

মনের গোপনে যেন ওঠে শুধু হাই।।

দ্রুতগতি সভামধ্যে হরিবর যায়।

মৃদঙ্গে সঙ্গৎ তার মনে নাহি লয়।।

ত্বরা করি নিল ধরি মধুর মৃদঙ্গ।

সুসঙ্গত বাদ্য করি ঝাঁকি দিয়ে অঙ্গ।।

এই ভাবে গানে মত্ত রহিল তথায়।

গান অন্তে এল ফিরে শ্বশুর আলয়।।

সবে বলে কি কি তর্ক হইল সেখানে?

হরিবর বলে তর্ক নাহি ছিল মনে।।’’

Page 461 start

সকলে ডাকিয়া বলে আশ্চর্য্য অই।

দুরে যাহা বলি নাক কাছে চুপ রই।।

কি যেন মোহিনী শক্তি মতুয়ারা ধরে।

কাছে গেলে কথা কেহ বলিতে না পারে।।’’

হরিবর ভাবে মনে যাবে পুনরায়।

দেখিবে মতুয়া দেহে মোহিনী কোথায়?

পরদিন গেল পুনঃ মতুয়ার বাড়ী।

মনে মনে আজ বটে রাখিলেন আড়ি।।

হেনকালে মহানন্দ গোস্বামী সুজন।

আসিয়া বাড়ীর পরে দিল দরশন।।

কিবা সে মোহন কান্তি ভাবে ঢলঢল।

দীর্ঘ কেশ দীর্ঘ শ্মশ্রু আঁখি ছল ছল।।

শ্যামল কোমল কান্তি কোরকের সম।

ভস্মে ঢাকা অগ্নি সম জ্যোতিঃ অনুপম।।

সন্ধ্যা তারকার প্রায় আঁখি দুটি স্থির।

অধরে মৃদুল হাসি বা সুগম্ভীর।।

এমন মোহন ছবি যেই দেখিয়াছে।

বলাবলি নাই কিছু প্রাণ সঁপিয়াছে।।

করুণ কোমল চোখে বারেক তখন।

গোস্বামীজী হরিবরে করে দরশনে।।

মন্ত্র-মুগ্ধ ফণী যথা সাপুড়িয়া ধরে।

পলকে ধরিল স্বামী সেই হরিবরে।।

অবশ বিবশ দেহ বাক্য শক্তি নাই।

ঘন ঘন হরিবর ছাড়িতেছে হাই।।

কুমুদিনী পেল যেন চন্দ্র দরশন।

রবির কিরণে পদ্ম মেলিল নয়ন।।

সেই মত ভাব হল তাঁহার হৃদয়।

বাক্যহারা হয়ে পড়ে গোস্বামীর পায়।।

কৃপা দানে গোস্বামীজী তাঁহারে ধরিল।

তর্কবাদী হরিবর সেখানে মরিল।।

ভাব-ঘোরে ভাব নিয়ে পুনর্জম্ম হয়।

এবে শুন বলি কিছু সেই পরিচয়।।