Page 290

শ্রীশ্রীহরিচাঁদকে দর্শণ ও শক্তিলাভ


“আমারে আড়াল করিয়া দাড়াওহৃদয়-পদ্মদলে”--বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

আর দিন সে তারক গেল সেই দেশে।

সাধনা করিছে যেথা মৃত্যুঞ্জয় বসে।।

প্রণাম করিল গিয়া গোস্বামীর পায়।

হাসি হাসি মৃত্যুঞ্জয় তারে ডেকে কয়।।

“তারক হে! তুমি নাহি জান সমাচার।

ওড়াকান্দী হরিচাঁদ হরি-অবতার।।

মোর যাহা কিছু দেখ সবি তাঁর দয়া।

আমাকে ঘিরিয়া আছে তাঁর কৃপা-ছায়া।।

জনম সফল যদি করিবারে চাও।

সময় থাকিতে তুমি ওড়াকান্দী যাও।।

যদি বল আমি তব সঙ্গে যেতে পারি।

নয়ন সার্থক হবে যদি দেখ হরি।।

কথা শুনি তারকের চিন্তা হয় মনে।

“হরি অবতার পুনঃ হ’ল বা কেমনে?”

শেষ অবতার হ’ল শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য।

পরে নাহি অবতার গোরা রায় ভিন্ন।।”

শাস্ত্র গ্রন্থে কোথা নাই প্রমাণ তাঁহার।

কিসে গুরু বলে হরিচাঁদ অবতার?”

অন্তর জানিয়া তবে কহে মৃত্যুঞ্জয়।

“তারক হে! সন্দ করা কভু ঠিক নয়।।

শাস্ত্র গ্রন্থে প্রমাণাদি নাহি বল কিসে?

সে কথা বলিয়া গেছে শ্রীজীব বিশেষে।।

“শ্রীচৈতন্য ভাগবতে সন্ন্যাস অধ্যায়।

মাতার নিকটে প্রভু অঙ্গীকারে কয়।।

তব গর্ভে জন্ম লব আর দুই বার।

এই নহে মাতা মোর শেষ অবতার।।

ভক্ত গণে সঙ্গোপনে পুনঃ ইহা বলে।

অবতার হ’ব পুনঃ সংকীর্ত্তন-ছলে।।

পড়িয়া দেখগে তাহা তারক গোঁসাই।

এই বাক্য আমি কভু ভুল বলি নাই।।

স্বচক্ষে দেখিবে যবে প্রভু হরিচান্দে।

এ কথা স্বীকার তুমি করিবে আনন্দে।।”

এই কথা বলিলেন সাধু মৃত্যুঞ্জয়।

শ্রীঘ্র গতি সে তারক নিজগৃহে যায়।।

Page 291 start

শ্রীচৈতন্য ভাবগত সংগ্রহ করিল।

সন্ন্যাস অধ্যায় পরে পাঠ করি নিল।।

দেখ সব লেখা আছে সত্য পরিচয়।

বুঝিল গৌরাঙ্গ শেষ অবতার নয়।।

কিন্তু অবতারে আছে বহুত লক্ষণ।

পাপী বিনাশন আর সাধুর লক্ষণ।।

অঙ্গে থাকে শুভ চিহ্ন দ্বাত্রিংশ প্রকার।

অন্তর বুঝিয়া করে সেই ব্যবহার।।

হরিচাঁদ হৎতে পারে মহৎ পুরুষ।

শক্তিশালী হৎতে পারে সাধক মানুষ।।

আর এক কথা মোর উঠিয়াছে মনে।

আপন গুরুকে লোকে ভগবান মানে।।

আমার প্রভুর গুরু প্রভু হরিচাঁন।

সেই হেতু গুরু তাঁরে বলে ভগবান।।

মোর পক্ষে ভগবান গুরু মৃত্যুঞ্জয়।

তাঁর পদে মন মোর যেন সদা রয়।।

কাজ নাই ওড়াকান্দী হরিচাঁদে দেখে।

সদয় আমারে যদি প্রভু মোর থাকে।।

পুনরায় তবে যায় সে কালীনগরে।

মৃত্যুঞ্জয় হাসি তবে বলিল তাহারে।।

‘হে তারক! আর কোন মনেতে সন্দেহঃ

এক মনে এই বারে মোর বাক্য লহ।।

দূরে থেকে সে কল্পনা সে সব অলীক।

ওড়াকান্দী গেলে তুমি সব পাবে ঠিক।।

সন্দেহ-ভঞ্জন হরি আছে ওড়াকান্দী।

চল এক সঙ্গে মোরা সেই পদ বন্দি।।”

এ মত কহিল যদি প্রভু মৃত্যুঞ্জয়।

তারক স্বীকার করি পড়ে তাঁর পায়।।

দুই দিন পরে দোঁহে করে শুভযাত্রা।

অন্তর্য্যামী মহাপ্রভু জানিলেন বার্ত্তা।।

সন্দেহ-দোলায় দোলে তারকের মন।

কি জানি কি-ভাবে হরি দেয় দরশন।।

হেন-মতে ওড়াকান্দী হেইল উদয়।

চক্ষে জল মৃত্যুঞ্জয় হরি! হরি! কয়।।

স্পর্শ মাত্রে শ্রীধামের পবিত্র প্রাঙ্গন।

অকস্মাৎ উচাটন তারকের মন।।

প্রাঙ্গণের প্রান্তভাগে চটকা তলায়।

মহাপ্রভু বসিয়াছে ছিন্ন-কান্থা গায়।।

বলিষ্ঠ উন্নত দেহ এক মহাজন।

উম্মাদের প্রায় যেন করিছে ভ্রমণ।।

সম-কায় দেখা যায় অন্য একজনে।

প্রফুল্ল বদনে রহে প্রভুর পিছনে।।

যবে মৃত্যুঞ্জয় আসি উপনীত হ’ল।

হাসি হাসি মহাপ্রভু কহিতে লাগিল।।

“ওরে গোলক! হীরামন! তোরা দেখে যা।

মিত্যুনে এনেছে সাথে এক তোতার ছা।।

সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করি পড়ে মৃত্যুঞ্জয়।

প্রভু প্রতি এক দৃষ্টি সে তারক চায়।।

মৃত্যুঞ্জয় উঠে বসে চক্ষে ঝরে জল।

ভাব দেখি সে তারক হইল বিহ্ববল।।

প্রণাম করিতে যবে ভূমি স্পর্শ করে।

সন্দেহ-ভঞ্জন-প্রভু দেখা’ল তাঁহারে।।

দুই পদ প্রসারিয়া প্রভু দেখাইল।

ধ্বজ বজ্রাঙ্কুশ চিহ্ন তারক দেখিল।।

ঊদ্ধ দৃষ্টি করি তবে চাহিল তারক।

ঊর্দ্ধ হস্ত করিলেন ভূবন-পালক।।

সবে ভাবে অলসতা নাশিবার তরে।

মহা প্রভু হস্ত পদ প্রসারিত করে।।

তারক দেখিল কিন্তু সর্ব্ব সুলক্ষণ।

শাস্ত্রে গ্রন্থে যেই সব করেছে কীর্ত্তন।।

“পঞ্চদীর্ঘো পঞ্চ সূহ্মঃ সপ্তরাক্তঃ ষড়োন্নতঃ।ত্রিহ্রাস্ব প্রীতিগাম্ভীর্য্যং দ্বাত্রিংশো লক্ষণ মহান।।”

সন্দেহ-মেঘেতে-ঢাকা ছিল যে হৃদয়।

হরি কৃপা-বায়ু তাহা দূরে লয়ে যায়।।

Page 292 start

জ্ঞানহারা সে তারক পড়িল ধরায়।

শির-স্পর্শ হ’ল তার ঠাকুরের পায়।।

কৃপাময় কৃপা করি শক্তি দিল তারে।

বলে “ধর মৃত্যুঞ্জয় ধর তুমি ওরে।।”

মৃত্যুঞ্জয় পরশিলে জ্ঞান ফিরে এল।

উচ্চঃস্বরে সে তারক কাঁদিতে লাগিল।।

লক্ষ কথা আসে মনে বুক ফেটে যায়।

এক মুখে কিবা কবে করে হায় হায়।।

প্রভু কয় মৃত্যুঞ্জয় এই তোতার ছা।

আর কারে দিবি তুই মোরে দিয়ে যা।।

কেন্দে বলে মৃত্যুঞ্জয় অনাথের নাথ।

এ তোমাকে নেয়া দেয়া সব নিজ হাত।।

তোতা তো সামান্য কথা ব্রহ্মান্ড তোমার।

নেয়া দেয়া কর্তা তুমি ব্রহ্ম পরাপর।।

দয়া করে এ তোতারে যদি তুমি নিলে।

জনমের মত বাঁধ কৃপার শৃঙ্খলে।।

মহাপ্রভু ডেকে বলে তবে তাই হোক।

যা বলি তোতারে আমি সেই বুলি কোক।।

এ সময়ে তারকের কিছু চিত্ত স্থির।

দর দর ধারে দুই চক্ষে বহে নীর।।

যেই মাত্র প্রভু বলে “সেই বুলি কোক।।

তারকের জিহ্বাগ্রে অম্নি ফুটিল শ্লোক।।

অপলকে শ্লোকে শ্লোকে করিল বন্দনা।

মৃত্যুঞ্জয় আনন্দিত শুনিয়া রচনা।।

দেব-ভাষা সহযোগে বন্দনা করিল।

মাতৃ-ভাষা সহযোগে ভাব লেখা হ’ল।।


স্তব

গুরু কৃপা দীনে অধম অধীনে

অনন্ত অসীম স্বামী

নরাকারে নাথ করি কৃপাপাত

নামিলে মনত ভূমি।।

ছিলে নিরাকার নিলে নরাকার

স্বরূপে সাকার হলে।

আপনা আপনি নিগুণ হে গুণি।

সগুণ সাজিয়া রলে।।

রসে রসময় লীলা লালসায়

অসীম সাজিলে সান্ত।

স্বাদিতে আপনে বিবিধ বিধানে

করুণ-কোমল-কান্ত।

অসীম-অ-সীমা সেথা তোমা আমা

পরিচয় নাই পাই।

সীমায় সীমানা সেথা জানা-শোনা

বাধা বিঘ্ন বটে নাই।।

ইচ্ছায় ঈশ্বর রচে চরাচর

সাকারে আকার ধরে।

ভাগে ভগবান এক বহু হন

বহুধা বিভাগ করে।।

নিজ-রস নিজে রস-লিপ্সু সেজে

পাণি পাতি করে পান।

ভক্ত ভগবান ভিন্ন-ভাব ভাণ

নিয়ে করে নিজে দান।।

যে-ঘটে যা ঘটে তোমাতে তা বটে

ঘট-কর্তা ঘটময়।

তার হে তারক তাপিত তারক

মৃত্যুহারী মৃত্যুঞ্জয়।

ওহে নিরাকার নিয়েছ আকার

নরের আকার ধারী।

যুগে যুগে তুমি সাজি যুগ স্বামী

ধবারে ধরিলে হরি।

ধ্যানে ধরাধর ধরণী-ধাতার

ধরমে ধরিলে ধরা।

মৎস্য মহান গুণে গরীয়ান

উদকে উদ্ধার করা।।

Page 293 start

কুর্ম্ম-ক্রিয়া করি বদ্ধ করি বারি

জগতে জাগালে সুখে।

বরি বর দেহ বিরাট বরাহ

দর্পহারী দন্তে মুখে।।

নরের “আয়ণ” নাম নারায়ণ

বরিলে বামন দেহ।

নর আর সিংহ সাজিলে নৃসিংহ

নারকীরে নাহি স্নেহ।।

নাশিলে ক্ষত্রিয় পীড়িতের প্রিয়

জামদগ্নি অবতার।

দূর্ব্বাদল-কান্তি দয়া, ক্ষমা, শান্তি

শ্রীরাঘব রঘুবর।।

বেনু বাজে বনে গোপী মরে প্রাণে

যমুনা উজানে ধায়।

রা’ রা রবে রাধা মিছে চুল-বাঁধা

কলসী কক্ষেতে কয়।।

“শুন লো সজনি জলকে যাবি নি?

আঁধার আসিছে চুপে।

সে’ত ছলা-কলা শুধু কথা বলা

মন-হারা কালো রূপে।।

ফুরা’ল সে-অঙ্ক বেণূ হ’ল শঙ্খ

আশঙ্কা অসুর-কুলে।

কুরুক্ষেত্র রণে সুজন অর্জ্জুনে

বিশ্ব-রূপে দেখা দিলে।।

থামিল তরঙ্গ লীলা হল সাঙ্গ

উত্তঙ্গ হিমাঙ্গ-পদে।

রঙ্গের শিখরে গোমতীর শিরে

জনহীন জনপদে।।

সেদিনে সদায় রক্তের রেখায়

মত্ত মানব দল।

ছিনিমিনি ছলে অতি অবহেলে

বলহীনে বাধে খল।।

অরুণ-অরুণ কোমল-করুণ

কম-কান্তি কৃপাময়।

বুদ্ধ-মুর্ত্তি ধরে শুদ্ধোধন ধরে

রাজপুত্র রাজালয়।।

প্রেম পবিত্রতা অহিংসা-বারতা

জানা’লে জগত-জনে।

ভাই ভাই তাই ভিন্ন ভাব নাই

পরম পীরিত প্রাণে।।

মায়ার মায়ায় সাগর শুকায়

মরুময় মর ধরা।

তুলিলে তরঙ্গ সাজিলে গৌরাঙ্গ

নদীয়ায় নম-গোরা।।

বেহালের বেশে দিলে দেশে দেশে

মধুমাখা হরিনাম।

গলিল গৌরাঙ্গ ব্রজরাণী-অঙ্গ

মিশিল পুরুষোত্তম।।

বুকের বেদনা কিছুতে শোধে না

সাধা সাধি হ’ল সার।

হলে হরিচাঁদ পূর্ণিমার চাঁদ।

পরিপূর্ণ পারাবার।।

যুগল চরণ রকত বরণ

রেশম বরণ কান্তি।

চারু চন্দ্রানন সুদৃশ্য দশন

ঊন নহে এক ক্রান্তি।

নিটোল কপোল বরণে ধবল

অমল মোহন জ্যোতিঃ।।

রক্ত-রাগ শোভা আঁখি মনোলোভা

তরুণ অরুণ-ভাতি।

দীর্ঘ দুই ভূজ বিশ্ব মনোসিজ

‘শাল-প্রাংশু’ বলি কহে।

অতুলন ধন সে-ধন কখন

বচন-বাঁধনে রহে?

Page 294 start

সুন্দর ললাট সুপ্রশস্ত তট

তিল ফুল জিনি নাসা।

কেশদাম জিনি ফণীণী-নাগিণী

রাগিণী-কিঙ্কিণী-ভাষা।।

ললিত-লোচন অরুণ-বরণ

ক্ষরিছে করুণা-ধারা।

শীতলিয়া যায় করুণা ধারায়

জর-জর-জারা ধরা।।

অতল সলিলে যথা মণি জ্বলে

দীনবেশে-ঢাকা হরি।

রূপের মাধুরী দু’নয়ন ভরি

হেরিয়া ঝুরিয়া মরি।

শান্ত-সদানন্দ অসীম আনন্দ

প্রেমানন্দ-ময়-বিভু।।

করহে করুণা দিয়ে কৃপা-কণা

পেতে যোগ্য নহি কভু।।

চরণ শরণ আমি অভাজন

করিলাম করপুটে।

আমার আমাকে দিয়াছি তোমাকে

রাখহে চরণ তটে।।

গুরু মৃত্যুঞ্জয় যাঁর করুণায়

এ-ভাগ্য ঘটিল মোর।

পদতটে তাঁর কোটি নমস্কার

অঞ্জলি নয়ন-লোর।।

রচন-বচন শুধু অকারণ

কারণ-কারণ তুমি।

মূঢ় মন্দমতি তাই গাঁথা গাঁথি

অবোধ অজ্ঞান আমি।

অপরাধ ক্ষম প্রিয় প্রিয়তম মম

করিয়াছি অসম্ভ্রম।

বিশ্বময় হরি দুঃখ তাপ-হারী

রাতুল চরণে নমঃ।।


স্তব করি সে তারক পুনঃ পদে পড়ে।

পুনরায় মৃত্যুঞ্জয় তারে তুলে ধরে।।

প্রভু বলে “রে তারক! সুস্থ হও এবে।

বল দেখি ওড়াকান্দী এলে কিবা ভেবে?”

তারক কান্দিয়া কয় “ওগো অন্তয্যামি।

তৃণ হয়ে সিন্ধু বারি মাপিয়াছি আমি।।

ঠাঁই নাই এবে দেখি আমি ভেসে যাই।

দয়াকরে ধর মোরে এই ভিক্ষা চাই।।”

প্রভু বলে “তাই হোক ধরিলাম তোরে।

মিত্যুনে দেখাল পথ তারে ছেড়ে নারে।।

যাও এবে দেশে চলি হয়োনা মলিন।

তারক রে! তোর লাগি আমি যে জামিন।।

হায়! হায়! করি সাধু পড়ে পুনর্ব্বার।

“ওহোরে দয়াল বন্ধু! বলে বারে বার।।

এই ভাবে কৃপাদৃষ্টি লভিল তারক।

নিজে মাতে আর সাথে মাতে কত লোক।

হরি-কৃপাগুণে পেল অলৌকিক শক্তি।

মন-প্রাণ করে সারা পদে অনুরক্তি।।

সংক্ষেপে বলিব কিছু সেই পরিচয়।

বিস্তৃত বলিতে গেলে পুথি বেড়ে যায়।।

মৃত্যুঞ্জয় পদে বসি শাস্ত্র শিখি নিল।

এব শুন কবিগানে কিসে শ্রেষ্ঠ হল?

ধন্য সে তারকচন্দ্র হরি-প্রিয় যিনি।

পদে দন্ডবৎ করি লোটায় ধরণী।।

---০---