Page 052

গার্হস্থ্য সন্ন্যাসী


‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়’-রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর

পিতৃ আজ্ঞা গুরুচাঁদ শিরোধার্য করি।

সংসারের ভার নেয় নিজ স্কন্ধোপরি।।

ক্ষণে ক্ষণে ভক্ত গৃহে যায় পিতৃসাথে।

ভক্তের চরিত্র দেখে প্রেমানন্দ চিতে।।

গম্ভীর প্রকৃতি প্রভু নাহি চপলতা।

চলে যেন সিংহ শিশু দৃঢ় একাগ্রতা।।

ঘন কৃষ্ণ কেশ দাম লম্বিত মস্তকে।

ধূর্জ্জটীর জটাসম দোলে থাকে থাকে।।

গৌরাঙ্গ বরণ কান্তি সূর্য সম প্রভা।

কুসুম কোরক জিনি বয়ানের আভা।।

মহা তেজোময় হেরি নয়নের জ্যোতিঃ।

দৃষ্টি মাত্র পাপী প্রাণে জাগে মহাভীতি।।

ভাবময় ভক্ত যত প্রেমানন্দ ভরে।

গুরুচাঁদে হেরি তেঁহ আঁখি বারি ঝরে।।

সবাসঙ্গে মিশে প্রভু নাহি কোন ভেদ।

তবু আচরণে দেখি অনেক প্রভেদ।।

হংস যথা বারি মধ্যে পুলকে ভ্রময়।

বারি মধ্যে ডুবে ভাসে আনন্দে খেলায়।।

Page 053 start

বারি হ’তে কূলে যবে সেই হংস ধায়।

এক বিন্দু বারি দেহে নাহি দেখা যায়।।

বারিকে আধার করি করে জলক্রীড়া।

বারিতে সম্বন্ধ নাহি, সত্ত্বা বারি ছাড়া।।

দেহ মধ্যে আত্মা যথা জীব কালে রয়।

আত্মা খেলে তাই দেহ চলিয়া বেড়ায়।।

জীর্ণ বস্ত্র সম দেহ ফেলি আত্মা যায়।

নিশ্চল পতিত দেহ মাটিতে লুটায়।।

দেহেতে সম্বন্ধ আত্মা কিছু নাহি রাখে।

“বিশ্রামের ঘর” ভাবে কিছুকাল থাকে।


“বিহায় কায়ং নির্লক্ষ্যং পতিতং নৈব পশ্যতি”তথাঃ--“সহবর্দ্ধি তয়োর্নাস্তি সম্বন্ধঃ প্রাণ দেহয়োঃ”।।ভূমি খণ্ড

সেই ভাবে গুরুচাঁদ মিশে সবা সঙ্গে।

আপনাতে রহে ডুবি আপন তরঙ্গে।।

শ্রী গোলক হীরামন, সাধু মৃত্যুঞ্জয়।

গুরুচাঁদে মান্য তারা করে অতিশয়।।

ইহ সঙ্গে গুরুচাঁদ করয়ে সম্প্রতি।

ভাবালাপ করে সদা এদের সংহতি।।

যবে গৃহে রহে থাকে একক হইয়া।

বাহির বাটিতে রাত্রি বিনিদ্র কাটিয়া।।

গভীর নিশীতে করে একা পরিক্রম।

কভু বৃক্ষ তলে বসি দৃষ্টি করে ব্যোম।।

নির্ভয় উদার চিত্তে গাঢ় নিশাকালে।

আপনার ভাবে ডুবি মাঠ মধ্যে চলে।।

পিতা যবে গৃহে আসে ভকত সংহতি।

আহারাদি সুব্যাবস্থা করে শীঘ্র গতি।।

পিতার অগ্রেতে প্রায় কভু নাহি যায়।

দূরে রহি প্রীতি কার্য সকল করয়।।

ইচ্ছামত পিতা যদি কভু ডাকি লয়।

পিতার প্রীতার্থে সব মনন কহয়।।

দিনভরি করে প্রভু গৃহস্থালী কর্ম।

ঠিক যেন ব্রতচারী পালে ব্রতধর্ম।।

আলস্য নাহিক কভু কোন কার্য লাগি।

রাত্রে অল্প নিদ্রা যায় বেশি রহে জাগি।।

হাসি গল্প রসালাপ কিছু মাত্র নাই।

দূরে দূরে পাপি সব রহিত সবাই।।

এইভাবে গুরুচাঁদ পিতৃ বাক্য রাখে।

শুন দেবী সত্যভামা কি ভাবেতে থাকে।।

শান্তি দেবী জননী সদা সেবা করে।

গৃহস্থালী কর্ম করে আনন্দ অন্তরে।।

কোন কর্ম করিবারে শান্তি দেবী ধায়।

হাত হতে সত্যভামা তাহা কাড়ি লয়।।

হাসিয়া বধূকে মাতা কত করে রোষ।

“এইটুকু কাজ করা কিসে মোর দোষ।।

একেত বালিকা তুমি তাহে আদরিণী।

সব কাজ একা তুমি পার না জননী।।

কৃত্রিম রোষের ছলে মাতা এই বলে।

সত্যভামা দেবী তাহে বলে কতূহলে।।

“তোমার চরণে দাসী আমি যবে আছি।

সকল কাজের ভার আপনি নিয়েছি।।

আমি তব কন্যা দেবী বলিনু নিশ্চিত।

তব সেবা করে মনে হই বড় প্রীত।।

কর্মেতে আনন্দ মোর জান ঠাকুরাণী।

আমাকে বঞ্চিত করে হয়ো না পাষাণী।।

তোমার প্রীতিতে মোর জনম সফল।

তব আশির্বাদ হয় মোর মহাবল”।।

পিত্রালয়ে যেতে তাঁর নাহি লয় মন।

বর্ণে বর্ণে হরি-বাক্য করিছে পালন।।

যখন গৃহেতে ফিরে প্রভু হরিশ্চন্দ্র।

যতনে পূজেন দেবী চরণার বিন্দ।।

তাহে তুষ্ট হরিচাঁদ বলিত হাসিয়া।

“ঘরে ছিলে পাষাণী মা কেমন করিয়া।।

Page 054 start

এবে পুত্র মুখ দেখি কতই উতলা।

মোরে ছেড়ে দিয়ে ঘরে কেমনে রহিলা।।

শ্রী হরির মুখে শুনি মধুময় বাণী।

প্রভুকে বলিত কথা করি জোড় পাণি।।

“পাষাণের মেয়ে আমি স্বভাবে পাষাণী।

তোমা হেন গুণনিধি তাই নাহি চিনি।।

তোমাকে চিনিতে তাতঃ পারিতাম যদি।

তোমাকে পাহারা দিতাম বসে নিরবধি।।

মোর পক্ষে তুমি বটে রয়েছ অচেনা।

তোমাকে চিনেছে যত ভকত ললনা।।

তারা সবে মন তব করিয়াছে চুরি।

পাষাণী মা ফেলে তাই রহ তেঁহ বাড়ি।।

কথা শুনি হরিমণি আনন্দ পাইল।

শিরে হাত রাখি তাঁর আশীষ করিল।।

বলে “মাগো তুমি মোরে হারায়েছ আজ।

কিছু দিন সেবা লব থাকি গৃহ মাঝ।।

অন্নপূর্ণা তুমি মাগো আছ এই ঘরে।

নিত্য সুখে অন্ন বাটি দিবে তুমি মোরে”।।

এই ভবে মহাদেবী পালে নিজ ধর্ম।

নাহি জানে হাসি, কলা, চটুলার কর্ম।।

স্বামীর মঙ্গল চিন্তা ক’রে দিবা রাতি।

হরিপদে বর মাগে করিয়া প্রণতি।।

স্বামী হতে দূরে বটে রাখে নিজ দেহ।

মনে প্রাণে স্বামী পদে সীমাহীন স্নেহ।।

বয়সে বালিকা বটে কর্মেতে গৃহিণী।

ধীর পদে যাতায়াত মধুর ভাষিণী।।

গুরুচাঁদ সত্যভামা শঙ্কর শঙ্করী।

রূপে গুণে সর্বাতীত নর দেহ ধারী।।

তাঁদের গুণের কথা অসীম অনন্ত।

কেবা কি বলিতে পারে যার নাই অন্ত।।

পথভ্রষ্ট নর কুলে দেখাইতে পথ।

পাপীরে দণ্ডিতে আর রাখিবারে সৎ।।

আপন জীবনে পালি যাহা শ্রেষ্ঠ ধর্ম।

নর রূপে নর মাঝে করে সেই কর্ম।।

মনে প্রাণে যেই মানে প্রভুর আদর্শ।

দেবতা বাঞ্ছিত শান্তি পেয়ে মহাহর্ষ।।

আদি জন্ম পরে বিদ্যা বালক বয়সে।

বিদ্যা শেষে ব্রহ্মচর্য পালিল বিশেষে।।

আদর্শ গার্হস্থ্য নীতি পরে করে সার।

বংশ রক্ষা ধনার্জন পবিত্র আচার।।

সুশিক্ষা আত্মজগণে সমাজ সংস্কার।

মূঢ় অন্ধ নরগণে করিলা উদ্ধার।।

রাজ শক্তি সহযোগে জাতির কল্যাণ।

জ্ঞান দানে গড়ি তোলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।।

রাজ কার্যে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা বাড়িল।

হীন মান হীন আখ্যা দূর করি দিল।।

অর্থনীতি শাস্ত্রনীতি শিল্প ব্যবসায়।

রাজনীতি ধর্মনীতি সকলি শিখায়।।

দূর্নীতি দূরত্ব যত সমাজেতে ছিল।

বজ্রদণ্ড দানে সব দূর করি দিল।।

এমত প্রকারে গড়ি সমাজ জীবন।

পিতৃ ধর্ম ঘরে ঘরে করে বিতরণ।।

বিনিদ্র রজনী কাটে ধর্ম আলাপনে।

দয়া দণ্ডে শুদ্ধ করে যত ভক্ত গণে।।

ভক্ত মন উল্লাসিতে ভক্ত গৃহে যায়।

যথা যায় তথাকারে সর্ব্বনীতি কয়।।

ধর্ম কর্ম শুদ্ধাচার পবিত্র চরিত্র।

“ধীর হও সাধু হও” বলে যত্র তত্র।।

পৃথিবী ভরিয়া দিতে নিজ জাতি নাম।

অবিরাম আন্দোলন নাহিক বিশ্রাম।।

নিজ পৌত্র গণে তবে লণ্ডনে পাঠা’ল।

কিছুই অসাধ্য নহে এই শিক্ষা দিল।।

প্রথমে বিলাতে দিয়া নিজ পৌত্রগণে।

অসীম সাহস দিল জাতির পরাণে।।

Page 055 start

এ জাতির নাম গেল পৃথিবী ভরিয়া।

প্রমথ রঞ্জন এল ব্যারিষ্টার হৈয়া।।

উত্তর সাধক ধন্য প্রমথ রঞ্জন।

দেশ বাসী জনে গণে করেছে রঞ্জন।।

তেঁহ আগমন দেখি আনন্দ লভিল।

কর্ম কাণ্ড ছাড়ি প্রভু আত্ম কাণ্ডে গেল।।

অহর্নিশি অবিরাম কহে হরি কথা।

বিনা মূল্যে দেয় ফল মোক্ষ ফল দাতা।।

উত্তর আয়ণে প্রভু গেল নিজ লোকে।

প্রমথ রঞ্জন মাঝে শক্তি গেল রেখে।।

গোপাল চাঁদের পদ মনে করি সার।

ক্রমে ক্রমে এই সব করিব বিস্তার।।

হাতে কাজ মুখে নাম মতুয়ার রীতি।

হরি-গুরুচাঁদ বিনে ভবে নাই গতি।।

--০--