Page 214 Start

লাট সন্দর্শন ও অভিনন্দন প্রদান!

লাট দরবার বড়ই সুন্দর

পরিস্কার চারিধার।

মঞ্চের উপর গালিচা সুন্দর

আসন তাহার পর।।

আসনেরর পরে জ্বল জ্বল করে

আসন ঢাকনি বস্ত্র।

দুই ধারে তার বিরাট আকার

প্রহরী ধরিয়া অস্ত্র।।

কিছু দূরে তার মেঝের উপর

আসনের সারি সারি।

মান্যগণ্য যাঁরা তদুপরি তাঁরা

বসিয়াছে চুপ করি।।

মঞ্চের দক্ষিণে বিবিধ আসনে

উচ্চ কর্মচারী সবে।

ফাইল আনিয়া সম্মুখে রাখিয়া

বসিল নীরব ভাবে।।

দরবার ঘর চারিধারে তার

রক্ত বস্ত্র দিয়ে ঢাকা।

বিবিধ বরণে সম্মুখে পিছনে

নানা রঙে ছবি আঁকা।।

দেবদারু পত্র দিয়া যত্র তত্র

ফুলহার দিয়া তা’য়।

চারুচন্দ্ৰাতপ শোভার গৌরব

উৰ্দ্ধদেশে শোভা পায়।।

ধনী, মানী, গুণী পেয়ে নিমন্ত্রণী

আসিয়াছে দরবারে।

পরিচয় কিছু বলিতেছি পিছু

একে একে পরে পরে।।

উজানীর রাজা অতি মহাতেজা

জমিদারী তাঁর বড়।

ওলপুরে ঘর ধনী জমিদার

প্রজার শাসনে দড়।।

খাঁ-পুর বসতি তেজবন্তি অতি

চৌধুরী উপাধিধারী।

জাতি মুসলমান অতি ধনবান

বসিল আসনো’পরি।।

বৈদ্য জমিদার খান্দারেরপার

আসনে বসিল আসি।

কাশীয়ানী ধাম শ্ৰীগিরিশ নাম

কথা কয় হাসি হাসি।।

পত্নী নিয়ে সাথে ঢুকিল সভাতে

সুজন ডক্টর মীড।

মঞ্চের বামেতে বসে আসনেতে

ঠিক রাজ পুরোহিত।।

বাস হারোয়ায় অতি মহাশয়

চৌধুরী নবাব আলি।

জিলা বোর্ডে তিনি সভাপতি জানি

বহুৎ প্রতাপশালী।।

বহরপুরের গোস্বামী দিগের

নামকীর্তি বহু আছে।

তার একজন আসন গ্রহণ

করিল সভার পাছে।।

লাহিড়ী সান্ন্যাল আছে দুইদল

কোড়কদি গাঁয়ে ঘর।

দুই ঘর হ’তে আসি এক সাথে

বসিল আসন ‘পর।।

বাস পদমদী নবাব উপাধি

জাতিতে মুসলমান।

আসি দরবারে বেশভূষা পরে

আসন উপরে যান।।

Page 215 start

বাইশ রশির সাহা দানবীর

নামেতে রমেশচন্দ্র।

এল দরবারে অতি ধীরে ধীরে

গমনে মৃদুল মন্দ্র।।

ঢেউখালী বাসী জমিদার আসি

বসিল আসন পরে।

যত মহাজন, সু-ধীর গমন,

প্রবেশ করিছে ঘরে।।

উনসিয়া ঘর আগরতলার

দ্বার পণ্ডিত যে জন।

এক সাথে তাঁর আসিল সত্বর

শ্যাম তর্কপঞ্চানন।।

বাটিকামারীর পণ্ডিত সুধীর

রামচন্দ্র ভট্টাচার্য।

ঘৃতকান্দী ঘর বসু গিরিধর

বহু দেশে সৎকার্য।।

হবিগঞ্জ বাসী জমিদার আসি।

আসনে বসিল জোরে।

কবিরাজপুর উপাধি ঠাকুর

পশিলেন দরবারে।।

কুণ্ডু পরিবার ডোমসার ঘর

অতি ধনবান তারা।

কার্তিকপুর ঘর ধনী জমিদার

তালিকা হইল সারা।।

যে যাঁর আসনে বসে’ একমনে

হেনকালে গুরুচাঁদ।

দরবার ঘরে পশিলেন ধীরে

সঙ্গে করি পারিষদ।।

লাগিল চমক সভাশুদ্ধ লোক

এক দৃষ্টে রহে চাহি।

মনে মনে কয় ‘এ মর ধরায়

হেন রূপ দেখি নাহি।।

কি দিব তুলনা তুলনা মিলে না

অপরূপ রূপরাশি।

প্রভু অগ্রে যায় পিছে পিছে ধায়

কনক বরণ শশী।।

যেন সুরপতি জয়ন্ত সংহতি

নামিল ধরার পরে।

অথবা ফাল্গুনী রূপেতে বাখনি

অভিমন্যু সঙ্গে করে।।

কিবা এ তুলনা শুধু আলোচনা

অতুলনে কিবা তুল।

তুলনা রহিত রূপ গুণ জিত

তাঁহারে তুলনা ভুল।।

সবে রহে চেয়ে অবাক বিস্ময়ে

বদনে না ফুটে বাণী।

অকস্মাৎ মীড হইয়া ত্বরিত

প্রভুরে লইল টানি’।।

নির্দিষ্ট আসনে ক্রমে জনে জনে

বসাইল ধরি হাতে।

সবার বিস্ময় আর বেড়ে যায়

পারে না কিছু বুঝিতে।।

কাহারা ইহারা? রূপে আলো করা

রাজতুল্য পরিচ্ছদ।

কোন দেশে ঘর? কোন বংশধর

কেমন ধন সম্পদ?

লাট দরবারে কে জিজ্ঞাসে কারে

তাই রহে চুপ করি।

মনে মনে কয় এ ব্যক্তি নিশ্চয়

অলৌকিক শক্তিধারী।।

এহেন সময় ম্যাজিষ্ট্রেট কয়

“শুনুন সকলে কথা।

লাট বাহাদুর নহে বহুদূর

এখনি আসিবে হেথা।।

Page 216 start

গৃহে প্রবেশিলে উঠিয়া সকলে

সম্ভ্রম দেখাবে তাঁরে!

আপন আসন করুন গ্রহণ

লাট বসিবার পরে।।”

এতেক কহিয়া ত্রস্ত ব্যস্ত হৈয়া

ম্যাজিষ্ট্রেট চলি যায়।

কিছুকাল পরে পশে দরবারে

ছোট লাট মহোদয়।।

লাটেরে দেখিয়া সবে দাঁড়াইয়া

সন্ত্রম দেখা’ল তাঁরে।

মঞ্চ’পরে রাখা বসনেতে ঢাকা

বসিল আসনোপরে।।

যে যাঁর আসনে বসে সেইক্ষণে

লাট চাহে সভা পানে।

সম্মুখ আসনে ঠিক মধ্যখানে

দেখা পায় গুরুচানে।।

লক্ষ তারা মাঝে অপরূপ সাজে

শোভে যেন পূর্ণচন্দ্র।

দিব্য জ্যোতিঃ রাশি বাহিরিছে আসি

যেন রে বিজলী কেন্দ্ৰ!

নীরবে বসিয়া চাহিয়া চাহিয়া

লাট দেখে গুরুচান্দে।

কি হ’ল কি জানি গুরুচাঁদ মণি

কোন গুণে লাটে বান্ধে।।

নীরব সে লাট স্তব্ধ সভাতট

নীরব সবার গেহ।

কেন হেন হয় কেবা কারে কয়

বুঝিতে পারে না কেহ।।

যাদু মন্ত্র বলে যেন সভাস্থলে

সকলে নীরবে রয়।

মুহূর্ত সময় যাদু টুটি যায়

দরবার শুরু হয়।।

বহু প্রতিষ্ঠান, করে মান দান

নিজ নিজ দাবী কয়।

যার যার কথা, আপন বারতা

আপনার পরিচয়।।

রজত মণ্ডিত পাত্র সুশোভিত

মান পত্র তাহে পুরি’।

পাঠ শেষ হ’লে দুই হস্ত তুলে

টেবিলে রাখিছে ধরি।।

সর্ব পত্র শেষে অপরূপ বেশে

সাঙ্গ পাঙ্গ সঙ্গে করি।

পতিত পাবন শ্ৰীগুরুচরণ

ভুবনরঞ্জন কারী।।

দাঁড়াইলা এসে মৃদু মৃদু হেসে

কে জানে কিসের ছলে।

মান পত্ৰখানি ধরিয়া আমনি

শশীকে ডাকিয়া বলে।।

, “পড় মানপত্র মনে দ্বিধামাত্র

করিও না বাপধন!

হৃদিপদ্মে বেন্ধে প্রভু হরিচান্দে

ধীরে কর উচ্চারণ।।”

পিতার আজ্ঞায় প্রফুল্ল হৃদয়

মান পত্র হাতে করে।

পড়িতেছে শশী যেন বাজে বাঁশী

করুণ কোমল স্বরে।।

ভীষ্মদেব দাস না ছাড়ে নিঃশ্বাস

শ্ৰীবিধু আকুল প্রাণে।

তারিণী দেখিল প্রভু পড়ি’ গেল

শ্রীশশী দাঁড়ায়ে শোনে।।

শ্রীরাধা চরণ আর যে মোহন

পাশাপাশি দুই জনে।

তাহারা দেখিল অন্যকে পড়িল

শশী রহে আন মনে।।

Page 217 start

সভাজন শোনে গৃহ মধ্য খানে

অশরীরী এক বাণী।

মীড শুনে তায় শশীর গলায়

এ সুর কভু না শুনি।।

শ্ৰীবিধু দেখিল প্রভু যা’ বলিল

শশী করে তাই পাঠ।

এক দৃষ্টে চেয়ে শুনিল বসিয়ে

বাঙলার ছোট লাট।।

শুনিলেন লাট মনের কবাট

আপনি খুলিয়া যায়।

রাজ প্রতিনিধি তাই নহে বিধি

আপনা সামলি’ রয়।।

পাঠ শেষ হলে নিজ করে তুলে

মানপত্র প্রভু ধরে।

চলি ধীরে ধীরে গিয়ে মঞ্চ’ পরে

রাখিল টেবিল পরে।।

ঢল, ঢল, ঢল শত শতদল

জিনিয়া বরণ আভা।

ঘন মেঘ প্রায় দেহ জুড়ি রয়

রাজবেশ মনোলোভা।।

সব হত বাকে সভাজন দেখে

লাট ও দেখিল সুখে।

রূপের গৌরব গুণের সৌরভ

এক দেহে বন্ধী থাকে।।

ক্ষণেক থাকিয়া আসিল নামিয়া

নয়ন মোহন ছবি।

লাট ও দেখিল প্রভুজী হাসিল

নাচিল হৃদয় রবি।।

সে দিন সভায় যে ছিল যথায়

কথা নাহি কেহ কয়।

যেই খানে যান প্রভু ভগবান

সকলে সেদিকে চায়।।

ভাবে সবে একি কেন দুটি আঁখি

ঘুরে ঘুরে দেখে তাঁরে।

ভাবি দেখিব না কিন্তু যে পারি না

টেনে নেয় জোর করে।।

বিস্ময়! বিস্ময়! অতীব বিস্ময়

সেই দরবারে হল।

যদিও বিস্ময় তবু শক্তিময়

মহাশান্তি উপজিল।।

মানপত্র পেয়ে নিজে দাঁড়াইয়ে

জবাব দিলেন লাট।

যথা সদুত্তর দিলেন সত্বর

নিরুত্তর সভা পাট।।

যে অভিনন্দন নমঃশূদ্র গণ

রচনা করিয়া দেয়।

তাহার উল্লেখে লাট বলে ডেকে

“সুখী আমি অতিশয়”।।

যে সব বিষয় তা’তে লেখা রয়

তাহার ব্যবস্থা আমি।

বিধির কৃপায় করিব নিশ্চয়

কিছুতে যাব না থামি।।

ম্যাজিষ্ট্রেট সনে পরে আলাপনে

জানিব সকল তত্ত্ব।

আমার শাসনে পাবে জনে জনে

আপন আপন স্বত্ব।।

পরে কতক্ষণ করি আলাপন

মহামান্য ছোট লাট।

বসিলা আসনে আনন্দিত মনে

দরশনে ফিট ফাট।।

ভাঙ্গে দরবার তিন ঘণ্টা পর

বিদায় হইল সবে।

মীড মহামতি গুরুচাঁদ প্রতি

কহিলা অনুচ্চ রবে।।

Page 218 start

“শুন বড় কর্তা বড় শুভ যাত্রা

করিয়া আসিলে তুমি।

রহ অপেক্ষায় লাট কামরায়

এখনে চলিব আমি।।

তোমাদের কথা সব মনে গাঁথা

লাটরে খুলিয়া ক’ব।

বুঝেছি নিশ্চয় লাট সদাশয়

তাঁর হাতে ফল পাব।।

আর যাহা যাহা ফিরে এসে তাহা

আলোচনা করা যাবে।

লাট বাহাদুর জ্ঞানে সুচতুর

বুঝিয়াছে সব ভাবে”।।

এই কথা বলি মীড যায় চলি

প্রভুজী ফিরিয়া আসে।

সঙ্গীজন সবে মহা উৎসবে

আনন্দ সাগরে ভাসে।।

গভীর রজনী সুপ্ত জন প্রাণী

কেহ জেগে নাই কোথা।

প্রভু জাগি রয় মীডের আশায়

মীড যে দিয়াছে কথা।।

কিছুকাল পরে ভৃত্য সাথে করে

মীড আসি উপস্থিত।

জাতিতে ইংরাজ যে কথা সে কাজ

ধন্য রাজ পুরোহিত।।

আদরে মীডেরে আপনার ধারে

বসাল ভবানী পতি।

মীড হাসি কয় “শুন মহাশয়

শুভ সমাচার অতি।।

বহুক্ষণ ধরি লাটের কাছারী

করিয়াছি আলাপন।

দেখিয়া তোমায় লাটের হৃদয়

আনন্দেতে নিমগন।।

আমার নিকট শুধাইল লাট

আদি অন্ত পরিচয়।

সকল শুনিয়া বলিল হাসিয়া

অসম্ভব কিছু নয়।।

এই বঙ্গদেশে লাট হ’য়ে এসে

বহু বাঙ্গালী সনে।

হল পরিচয় গৃহে কি সভায়

সব আছে মোর মনে।।

ইহার মতন মানুষ এমন

দেখি নাই কোন জন।

এর দরশনে এই হয় মনে

প্রাণ করে আকর্ষণ।।

যে জাতির ঘরে ইনি জন্ম ধরে

সে জাতি উদ্ধার হবে।

ভবিষ্যৎবাণী বলিব এখনি

মন দিয়া শুন সবে।।

“নমঃশূদ্র জাতি আজি হীন অতি

বিদ্যা ঘরে নাহি বলে।

বিদ্বান হইলে আমি যাই বলে

কে রাখিবে তারে ঠেলে?

ঠাকুরের ঠাঁই তুমি বল তাই

আমি নাহি করি ভেদ।

যত প্রজা রয় সমদৃষ্টি পায়

রাখিব না কার খেদ।।

পরের বারতা চাকুরীর কথা

কহিলাম ধীরে ধীরে।

সাবরেজিষ্ট্রার হইবে সত্বর

শশী কিছুদিন পরে।।

কুমুদ মোহন তারিণীচরণ

চাকুরী পাইবে সবে।

সে রাধাচরণ কিসে ক্ষুন্নমন

বাদ নাহি সেও র’বে”।।

Page 219 start

শুনি সমাচার দয়াল আমার

আনন্দে মাতিয়া কয়।

ধন্য তুমি মীড রাজ পুরোহিত

ধন্য ধন্য মহাশয়।।

নমঃশূদ্র বন্ধু তুমি গুণ সিন্ধু

পরম বান্ধব হলে।

যে ক্ষণে বান্ধিলে আমি কোন কালে

নাহি যাব তাহা ভুলে”।।

বহু আলাপন করে দুই জন

বিদায় মাগিল শেষে।

প্রভু মীডে কয় ‘শুন মহাশয়

প্রভাতে চলিব দেশে”।।

পোহা’ল রজনী প্রভু গুণমণি

সবারে ডাকিয়া কয়।

“শুন সঙ্গিগণ মোদের এখন

স্বদেশে চলিতে হয়”।।

মীড রাত্রি কালে যাহা কিছু বলে

প্রভু নাহি বলে কা’রে।

করিলে প্রকাশ হতে পারে নাশ

তাহাতে গোপন করে।।

সাঙ্গ পাঙ্গ লয়ে উত্তরিল গিয়ে

স্বদেশে জগত পতি।

এহেন প্রকারে লাট দরবারে

পতিতেরে দিল গতি।।

হ’ল জাগরণ নমঃশূদ্র গণ

রাজকার্য পায় বঙ্গে।

শুন সমাচার পরের ব্যাপার

কি করে মীডের সঙ্গে?

---০---