Page 444

পদ্মবিলা দাঙ্গা

ফরিদপুরবাসী যত নমঃশূদ্রগণ।

অস্ত্র শস্ত্র লাটি খেলা জানে বিচক্ষণ।।

বড়ই তেজস্বী সবে তাহার কারণ।

অত্যাচার অবিচার মানে না কখন।।

ইসলাম ধর্মী লোক আছে সেই দেশে।

নমঃশূদ্র সঙ্গে বাস করে পাশে পাশে।।

উভয়ে কৃষক জাতি এ ব্যবসায়।

এক দেশে বাস করে এক দেশে রয়।।

কিন্তু কি দুর্ভ্যাগ্য! দেখ সময়ে সময়।

দুই জাতি দাঙ্গা করে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।।

কোনখানে নমঃশূদ্র আগে দোষ করে।

কোনখানে ইসলাম আগে অস্ত্র ধরে।।

অস্ত্র খেলা দু’জাতির জানা আছে ভাল।

সামান্য কারণে ঘটে বিষম জঞ্ছাল।।

কাশিয়ানী থানা মধ্যে পদ্মবিলা গ্রাম।

যেই দেশে ছিল সাধু দশরথ নাম।।

মহাজ্ঞানী রামতনু জন্মে সেই দেশে।

গোমস্তা রূপেতে ছিল ওড়াকান্দী এসে।।

তেরশ’ তিরিশ সালে সেই পদ্মবিলা।

বঙ্গবাসী দেখেছিল তান্ডবের লীলা।।

সামান্য ঘটনা এক তুচ্ছ হতে তুচ্ছ।

তাহা হতে জ্বলে, অগ্নি স্বর্গভেদী পুচ্ছ।।

লোকমুখে শুনি যাহা করিল রটনা।

কত মর্ম্মভেদী সেই দুরন্ত ঘটনা।।

খেলা নিয়ে মারামারি বালকে বালকে।

কণা হল পরিণত প্রচন্ড পাবকে।।

আদি পর্ব্বে নমঃশূদ্র সহে নির্য্যাতন।

তবু চেষ্টা করে তারা মীমাংসা কারণ।।

মুসলমানের মধ্যে পদ্মবিলা গ্রাম।

তাতে নীচ হয়ে বলে ‘‘মোরা ঠকিলাম।।

বিবাদেতে প্রয়োজন আর কিছু নাই।

নমঃশূদ্র, ইসলাম দোঁহে ভাই ভাই।।’’

কুচক্রী পাষন্ড দেখি আছে সর্ব্ব ঠাঁই।

যা হোক বিবাদ কিছু বাধানেই চাই।।

দুষ্টবুদ্ধি নিয়ে তারা সবখানে রয়।

ফাঁক পেলে বুদ্ধি দিয়ে সব করে ক্ষয়।।

নমঃশূদ্র সবে যদি এমত কহিল।

ইসলাম ধর্ম্মী যত সন্তুষ্ট হইল।।

কিন্তু দুষ্ট গ্রহ শনি আসিয়া জুটিল।

মুসলমানেরে ডাকি কহিতে লাগিল।।

‘‘কাফেরের এত বৃদ্ধি দেখা নাহি যায়।

ধর অস্ত্র কর রণ হোক সব ক্ষয়।।’’

সাধারণ লোক যারা তারা ডাকি কয়।

‘‘এই কার্য্য কোন ক্রমে উচিত না হয়।।

আমাদের কাছে তারা চাহিয়াছে ক্ষমা।

হেন বাক্য আর নাহি বল শনি মামা।।’’

দুষ্ট কয় ‘‘হায়!হায়! কিবা শুনিলাম।

বুঝিলাম আজ হতে মরিল ইসলাম।।

পূর্ব্বস্মৃতি কোন কিছু মনে বুঝি নাই।

ইসলামে মেরেছে কত ভেতে দেখ তাই।।

প্রতিশোধ তার যদি নিতে নাহি পার।

কলসী গলায় বেন্ধে জলে ডুবে মর।।

Page 445 start

এইমত উত্তেজিত করে বাক্যবাণে।

সরল কৃষক তাহা বুঝিবে কেমনে?

বিন্দু বিন্দু বিষ খেয়ে বিষাক্ত হৃদয়।

ইসলাম গর্জ্জিয়া বলে ‘‘ঘটাব প্রলয়।।’’

নমঃশূদ্র সবে তাই পেয়ে সমাচার।

তারা বলে ‘‘হায় হায় রক্ষা নাই আর।।

পুনরায় চেষ্টা করি মীমাংসার তরে।

মীমাংসা না হলে তবে দেখা যাবে পরে।।’’

এইভাবে তারা সবে গেল পুনর্ব্বার।

বহু চেষ্টা করে তারা শান্তি মীমাংসার।।

কিন্তু সব বৃথা হল জুটিল ইসলাম।

নমঃশূদ্র সবে ভাবে বুঝি মরিলাম।।

বিপদে বান্ধব কেবা আছে এই দেশে?

একমাত্র গুরুচাঁদ ওড়াকান্দী বাসে।।

দ্রুত গতি তারা সবে এল ওড়াকান্দী।

প্রভুর চরণে পড়ে করে কান্দকান্দি।।

খুলনা হইতে প্রভু আসিল কেবল।

হেনকালে উপস্থিত নমঃশূদ্র দল।।

প্রভু কয় ‘‘যাহা বলি সেই কথা শোন।

মীমাংসায় চেষ্টা সবে কর দিয়ে পুনঃ।।’’

তারা কয় ‘‘দয়াময় সময় কোথায়?

মনে হয় তারা হানা দিয়াছে খোলায়।।

প্রভু কয় ‘‘দেও দিয়ে পুলিশে খবর।’’

তারা কয় ‘‘তার আগে সাজাবে কবর।।

মাতা পিতা পত্নী পুত্র জমি এক কানি।

ইহা ছাড়া আমাদের কিছু নাই জানি।।

এদের বাঁচাতে মোরা প্রাণ দিতে চাই।

আজ্ঞা কর বড়কর্ত্তা রণক্ষেত্রে যাই।।

শ্রীহরির পুত্র তুমি নমঃর ভরসা।

শক্তি দাও গুরুচাঁদ মারি কিছু মশা।।

এতকাল এ জাতিরে করিয়াছ রক্ষা।

রক্ষাকর্ত্তা তব পদে এই মাত্র ভিক্ষা।।

তুমি শুধু বলে দাও করিবারে রণ।

তোমার আজ্ঞায় তুচ্ছ করিব জীবন।।’’

স্তব্ধ প্রভু কতক্ষণ কিছু নাহি বলে।

অকস্মাৎ বলিলেন চাহিয়া সকলে।।

‘‘শুন শুন নমঃশূদ্র আমার বচন।

‘যথা ধর্ম্ম তথা জয়’ শাস্ত্রের লিখন।।

অধর্ম্ম অন্যায় যুদ্ধ কেহ করিও না।

পরে ভিন্ন অগ্রে কোন অস্ত্র ধরিও না।।

আক্রমণ না করিলে কিছু নাহি কবে।

আক্রমণ করে যদি তবে যুদ্ধ দেবে।।

সর্ব্বক্ষণে সমাচার বলিবে আমারে।

আমি ভেবে দেখি হরি কোন ইচ্ছা করে।।’’

আজ্ঞা পেয়ে তারা সবে দ্রুত চলি গেল।

পলকে এ সব বার্ত্তা সকলে শুনিল।।

এই ভাবে দুই দলে হয় তোড়জোড়।

কাশীয়ানী পুলিশেরা পাইল খবর।।

দ্রুতগতি ‘অকু’ স্থলে হল উপস্থিত।

তাহাতেও লোকজন নাহি হল ভীত।।

রাত্রি গেল ধীরে ধীরে প্রভাত উদয়।

সংখ্যাতীত ইসলাম আসিল খোলায়।।

নমঃশূদ্র পক্ষে লোক বেশী নাহি পাই।

দারোগা দেখিয়া তারা ভাবে ভয় নাই।।

উভয় দলের যত নেতৃবর্গ ছিল।

মুসলমান দারোগা সবারে ডাকিল।।

নমঃশূদ্র পক্ষে বীর অনন্ত সর্দ্দার।

পরাণপুরেতে আসি বাঁধিয়াছে ঘর।।

কুমারিয়া, লহ্মীপুরা, পদ্মবিলাবাসী।

যতেক প্রধান সবে উপস্থিত আসি।।

দারোগা কহিল ‘‘সবে ছাড় এই ঠাট।

আমাকে সম্মুখে রেখে কর মিটমাট।।’’

নমঃশূদ্রগণে বলে ‘‘করিনা আপত্তি।

আপনি মধ্যস্থ হয়ে করুন নিষ্পত্তি।।

Page 446 start

দারোগা বলিল ‘‘সব লোক ছেড়ে দাও।

রাগ ফেলে সুস্থ মনে বাড়ী চলে যাও।।’’

দুই দলে তাতে রাজী হল বটে মুখে।

মনে মনে অভিসন্ধি সকলের থাকে।।

তথাপিও নমঃশূদ্র যত প্রধানেরা।

কিছু কিছু লোক ছেড়ে দিয়াছিল তারা।।

মুসলমানের পক্ষে সৈন্য সমুদয়।

কিছু দুরে গিয়া তারা দাঁড়াইয়া রয়।।

এদিকে দারোগা তবে অশ্বপৃষ্ঠে উঠি।

কাশীয়ানী প্রতি তবে চলিলেন ছুটি।।

মুসলমান সৈন্যদের নিকটে আসিয়া।

কি জানি কি বলিলেন নাচাইয়া।।

কেহ বলে বলিলেন হস্ত ইঙ্গিত করিয়া।

যা ইচ্ছা করগে আমি যেতেছি চলিয়া।।’’

অন্য জনে বলে ‘‘ইহা অতি মন্দ কথা।

দারোগারে দোষারোপ করিতেছ বৃথা।।

ইঙ্গিতে দারোগা বাবু দিলেন বলিয়া।

ঘরে যাও সবে আমি যেতেছি চলিয়া।।’’

দারোগা জীবনে এই দেখি অভিশাপ।

ভালমন্দ যাহা কর নাহি পাবে মাপ।।

বিস্তৃত সে সব তত্ত্ব বলে কার্য্য নাই।

কি ঘটনা ঘটে সেথা বলিতেছি তাই।।

দারোগা চলিয়া গেল দৃষ্টির বাহিরে।

হেনকালে ইসলামেরা দাঁড়াইল ফিরে।।

অসংখ্য নরের মুন্ড যেন সিন্ধু প্রায়।

নমঃশূদ্র তাহা দেখে করে হায়! হায়।।

মহাপ্লাবনের মত ছুটিছে ইসলাম।

নমঃশূদ্র কেন্দে বলে ‘‘এই মরিলাম।।

যাহা ভাগ্যে ছিল আজ ঘটিল না বটে।

রণ দাও যারা আছে ফেরা নাই মোটে।।

এখনি পাঠাও লোক বড়কর্ত্তা ঠাঁই।

গিয়ে বলে ‘‘দয়াময়! নমঃ আর নাই।।’’

অসংখ্য মুসলমান নমঃর বিপক্ষে।

দয়া যদি হয় প্রভু তবে কর রক্ষে।।’’

এত বলি বরে কালী কৈলাস সর্দ্দার।

বলে ‘‘তোরা কে কে যাবি আয় মরিবার।।

অসুর নাশিনী কালী আছে পক্ষে মোর।

রক্ষা কর্ত্তা হরিচাঁদ সেই মাত্র জোর।।’’

কৈলাসের কথা শুনি অনন্ত সর্দ্দার।

লম্ফ দিয়ে বলে ‘‘আছি সঙ্গেতে তোমার।।

শ্রীপূর্ণ, রজনী দোঁহে দিঘড়া নিবাসী।

শম্ভু, ষষ্ঠী, চারি ভাই নামে রণে আসি।।

কালীনগর, দিঘড়া, সদ্দারের বাস।

নাম শুনে ইসলামের লাগিত তরাস।।

দিঘড়া গ্রামেতে এক ছাড়া-ভিটা আছে।

বেত বনে ঢাকা এবে ‘‘জঙ্গল’’ হয়েছে।।

পুরাণ প্রবাদ বাণী যাহা শোনা যায়।

সেই ভিটা পরে নাকি দেবতা আশ্রয়।।

পূর্ব্ব হতে সদ্দারের রয়েছে নিয়ম।

আজ নাহি করে তারা তার ব্যতিক্রম।।

রণে যাবে যায় তারা তার পূর্ব্ব ভাগে।

সারা রাত্রি বসে বসে সেইখানে জাগে।।

দৈববাণী শোনে তারা রাতের আঁধারে।

আজ্ঞা পেয়ে রণে দিয়ে শত্রু জয় করে।।

আশ্চর্য্য একটি কথা বলিব এখনে।

সেই ভিটা রয় ঢাকা শুধু বেতবনে।।

বহুকাল আছে বেত ভিটার উপরে।

ভিটা ছেড়ে কোন বেত নীচে নাহি পড়ে।।

সেই বেত কেহ নাহি কাটে কোন দিনে।

বেতে বেতে ভরা ভিটা শুধু বেত বনে।।

কিভাবে কোথায় প্রভু রাখে কোনধন।

সামান্য মানব মোরা বুঝিনা কখন।।

সেই সূত্র ছেড়ে দিয়ে মূল সূত্রে ফিরে।

বলিতেছি শোন সেথা কি হইল পরে।।

Page 447 start

ভাদ্রমাসে গঙ্গা যথা ছোটে দিশে হারা।

সেই মত এল ছুটে মুসলমানেরা।।

‘‘আল্লা হে আকবর’’ বলি ছাড়িল জিগির।

শব্দে যেন ধরা ফেটে হিইল চৌচির।।

হাতে ঢাল চক্ষু লাল কপালে সিন্দুর।

দক্ষিণ করেতে বর্শা গর্ব্বিত হিন্দুর।।

কার হস্তে রাম দাও কাহারো ধনুক।

ঝক ঝক লক লক করিছে কার্ম্মুক।।

প্রতি রক্ত বিন্দু যেন নাচে রণ সঙ্গে।

হুলুধ্বনি নারীগনে করে সঙ্গে সঙ্গে।।

অবশ্য-মৃত্যুর কোলে পড়িতে ঝাঁপায়ে।

বীরমুর্ত্তি নমঃশূদ্র রয়েছে দাঁড়ায়ে।।

সে দৃশ্য বর্ণিতে দেখ মোর সাধ্য নাই।

বীরত্ব মন্ডিত দৃশ্য মনে দেখ ভাই।।

দেখিতে দেখিতে এল ইসলাম বাহিনী।

মুখে বলে ‘‘আল্লা’’ ‘‘আল্লা’’ হর্ষ পূর্ণ ধ্বনি।।

তাহা দেখি নমঃশূদ্র দেরী নাহি করে।

‘‘কালী মায় কি জয়’’ বলে নামিল সমরে।।

গ্রামের নিকটে আছে ক্ষুদ্র এক খাল।

তার কুলে হানা দিল নমঃশূদ্র দল।।

অসংখ্য ইসলাম নাচে খালের ওপারে।

অল্প-সংখ্যা নমঃশূদ্র বসিয়া এপারে।।

ইসলাম পড়িল তাতে ঘোর সমস্যায়।

শত্রুর সম্মুখে খাল পার হাওয়া দায়।।

কৌশলী সদ্দারগণে তীহ্ম বুদ্ধি গুণে।

দুরে দুরে খাল তীরে হানা দিল রণে।।

বিষম হইল দশা খাল ডিঙ্গাবারে।

কিছুক্ষণ শত্রু পক্ষ থাকে চুপ করে।।

মহোল্লাসে এসেছিল জিনিবারে রণ।

খালে বাধা দিল শুধু দৈবের ঘটন।।

এত বড় অভিযান নষ্ট হতে যায়।

মহাক্রুব্ধ হল তাতে শত্রু সমুদয়।।

ক্রোধ যদি স্কন্ধে চড়ে বুদ্ধি লোপ হয়।

নির্ব্বুদ্ধিতা পাপে অেক মেষে হয় ক্ষয়।।

শত্রু পক্ষে সেই কথা সত্য বটে হল।

ক্রুব্ধ হয়ে ইসলামেরা জলেতে নামিল।।

মনে ভাবে ‘‘কুলে আছে কয়টী কাফের।

কুলে উঠে একে একে কেটে নেবে ছের।।

বিশ গুণে বেশী মোরা তাতে মুসলমান।

ক্ষুদ্র হিন্দু কিসে হবে মোদের সমান?

বিশজনে এক সাথে করে আক্রমণ।

শত শত হিন্দু আজ করিব নিধন।।’’

এত ভাবি জলে নামে বিপক্ষের দল।

ফলিল খালের মধ্যে অব্যর্থ যে ফল।।

অল্প পরে বিপক্ষের চেতনা জাগিল।

শত শত ক্ষত হয়ে ফিরে কুলে গেল।।

তাহাতেও রক্ষা নাই পৃষ্ঠ কেবা ঢাকে?

ভয় পেলে বিপক্ষেরা সেইদৃশ্য দেখে।।

রণে ভঙ্গ দিয়ে সবে ছুটিতে লাগিল।

নমঃশূদ্র তাহা দেখি খাল ডিঙ্গাইল।।

শত্রুর পশ্চাতে ছুটে মার মার।’’

দিশা-হারা শত্রু ছোটে জ্ঞান নাহি আর।।

কিছু দুরে দিয়ে ফিরে এল নমঃশূদ্র।

প্রথমাঙ্ক হল শেষ পদ্মবিলা যুদ্ধ।।

যতক্ষণ লাগিয়াছে লিখিতে কাহিনী।

ততোধিক অল্পকালে যুদ্ধ শেষ জানি।।

আদি অঙ্কে যুদ্ধ কিবা কৌশলের খেলা।

প্রকৃত যুদ্ধের কথা বলি এই বেলা।।

ভয় পেয়ে পিবক্ষেরা ছুটিতে লাগিল।

কিছু দূরে গিয়ে তারা ফিরিয়া দাঁড়াইল।।

তারা ভাবে এই ভাবে নির্ব্বোধের মত।

পৃষ্ঠভঙ্গ দিয়ে কেন হই সবে হত।।

মরিত মরিব সব সম্মুখ সমরে।

ভয় পেয়ে মিছামিছি কেন যাই ফিরে।।

Page 448 start

এত ভাবি প্রধানেরা ফিরিয়া দাঁড়াল।

হস্ত মেলে সৈন্য দল সকলে ঠেকাল।।

তারা বলে ‘‘ওরে ভাই! মোরা কত বোকা।

নমঃশূদ্র আমাদের দিল এক ধোঁকা।।

বুদ্ধি দোষে মরি মোরা মিথ্যা কভু নয়।

তা’ না হলে এত লোক কিসে পাই ভয়?

এক বুদ্ধি কর সবে যাতে হবে জয়।

সেই পথে আছে মাত্র একটি উপায়।।

দেখ খাল দীর্ঘ বটে নহে বেশী দুর।

খাল এড়ে আক্রমণ কর নমঃ-পুর।।

এই যদি কর তবে নমঃরা সকলে।

কোন কেহ নাহি যাবে আর খাল কুলে।।

খাল ছেড়ে নমঃযবে আসিবে সে ধারে।

এক দলে তাড়াতাড়ি যেও খাল পারে।।

এই ভাবে দুই দিকে কর আক্রমণ।

অবশ্য পড়িবে মারা নমঃশূদ্র গণ।।

সেই ভাবে তারা সবে আসিল বাহুড়ি।

এবে শোন কিবা হ’ল ওড়াকান্দী বাড়ী।।

সর্দ্দারেরা যেই লোক পাঠাইয়া দেয়।

সে গিয়া গড়ায়ে পড়ে প্রভুজীর পায়।।

প্রভু বলে ‘‘ওরে বোকা বল সমাচার।’’

সে বলে ‘‘দয়াল প্রভু! রক্ষা নাই আর।।’’

এত বলি বলে খুলি সব বিবরণ।

তাহা শুনি প্রভুজীর আরক্ত নয়ন।।

ক্রোধে প্রভু বলে ডেকে ‘‘কোন ভয় নাই।

তুই ছুটে যারে চলে আমি রণে যাই।।’’

কি সে কি শক্তি প্রভু দিল তার দেহে।

ছুটে ছুটে চলে আর গ্রামে গ্রামে কহে।।

‘‘ওরে ভাই আয় তোরা আয় মোর সনে।

বড়কর্ত্তা গুরুচাঁদ চলেছেন রণে।।’’

বিদ্যুতের মত বাণী নাচাল পরাণ।

বাল বৃদ্ধ এক সঙ্গে করে লম্ফ দান।।

মৃত্যু ভয় কা’র মনে নাহি পেল স্থান।

সবে বলে ‘‘জয় হরি! জয় গুরুচাঁন।।’’

হেনকালে প্রভু পুনঃ বলিল গর্জ্জিয়া।

‘‘ঘৃতকান্দী গিয়ে আন’ কুঞ্জরে ডাকিয়া।।’’

আজ্ঞা মাত্রে লোক ছুটে গেল ঘৃতকান্দী।

শোনা মাত্র কুঞ্জ চলে এল ওড়াকান্দী।।

কুঞ্জকে দেখিয়া প্রভু ডাক দিয়া কয়।

‘‘ওরে কাঞ্জ! নমঃ তরী বুঝি ডুবে যায়।।

আমি যাহা বলি কুঞ্জ মন দিয়া শোন।

এই যুদ্ধ ধর্ম্মযুদ্ধ জাতির করণ।।

বিনা দোষে ইসলামে করে অত্যাচার।

এই যুদ্ধে তাহাদের রক্ষা নাহি আর।।

‘‘যথা ধর্ম্ম তথা জয়’’ এক বাক্য সার।

ধর্ম্ম পথে যে চলিবে ক্ষয় নাহি তার।।

এই ধর্ম্মদন্ড আমি দিতেছি তোমায়।

দন্ড হাতে পেলে তার নাহি পরাজয়।।’’

এত বলি প্রভু তারে এক যষ্টি দিল।

বলে ‘‘কুঞ্জ! ভয় নাই বল হরি বল।।

হরি বলে ডঙ্কা মেরে সবে যাও রণে।

এ যুদ্ধে সহায় হবে যত পিতৃ গণে।।

তারক গোলক আর যত সাধু জন।

প্রত্যক্ষে তাহারা আসি করিবেন রণ।।

ধর্ম্ম রক্ষা করিবারে আছে সাধু জন।

ধর্ম্মের সহায় হরি পতিত পাবন।।

তারা সবে যাবে যুদ্ধে আর যাব আমি।

মোদের সারথি নিজে হরি অন্তর্য্যামী।।

যাও, যাও, কুঞ্জ তুমি দেরী নাহি কর।

ধর্ম্ম লাগি হরি বলে যুদ্ধ ক্ষেত্রে মর।।

যুদ্ধ কালে কেহ যেন নাহি করে শঙ্কা।

জয় ধ্বনি, হরি ধ্বনি কর মার ডঙ্কা।।

অধর্ম্ম পথেতে যুদ্ধ কেহ করিবে না।

ধর্ম্ম পথে যুদ্ধ হলে কেহ মরিবে না।।’’

Page 449 start

প্রভুর বচন শুনি কুঞ্জ ছুটে যায়।

যারে দেখে তারে বলে কে কে যাবি আয়।।

পড়িল বিষম সাড়া প্রতি ঘরে ঘরে।

বাল, বৃদ্ধ, শিশু, যুবা, যুদ্ধ সজ্জা করে।।

আপন সন্তানে মাতা সাজাইয়া দেয়।

বরে ‘‘বাছা! যাও নাহি কোন ভয়।।

তোমার সহায় আছে নিজে হরিচাঁন।

তাঁহারে স্মরণে রেখে হও আগুয়াণ।।’’

গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে পড়ে গেল রোল।

নারী করে হুলুধ্বনি নরে হরি বোল।।

ডঙ্কা, শিঙ্গা, ভেরী, তুরী মৃদঙ্গ মাদল।

ধর্ম্মযুদ্ধে মন্ত্র মাত্র হরি হরি বোল।।

শতেক সহস্র মিশি যুদ্ধ পানে ধায়।

ডঙ্কা, কাশি, ভিন্ন তারা অস্ত্র নাহি লয়।।

এদিকে যুদ্ধের ক্ষেত্রে দৃশ্য ভয়ঙ্কর।

ভয় পেয়ে নমঃশূদ্র কাঁপে থর থর।।

যে শত্রু পালিয়ে গেল সে বা কেন ফিরে।

নিশ্চয় কালের দন্ড পড়িল এ শিরে।।

চিন্তা কিবা করি আর যা থাকে কপালে।

প্রাণপণে দিব যুদ্ধ মিলিয়া সকলে।।

হেনকালে যেই জন ওড়াকান্দী গেল।

ফিরিয়া আসিয়া সেই কহিতে লাগিল।।

‘‘ভয় নাই বীরগণ! কর গিয়া রণ।

নিজে যুদ্ধে আসিবেন শ্রীগুরু চরণ।।

‘‘যথা ধর্ম্ম তথা জয়’’ বলেছে এ বাণী।

অধর্ম্ম করো না কেহ তাঁর আজ্ঞা মানি।।’’

কি যে সে বিদ্যুৎ শক্তি সবে দেহে পেল।

আনন্দে মিলিয়া সবে বলে হরিবল।।

হেনকালে দলে দলে চারিদিক হতে।

হরিবলে আসে সবে ডঙ্কা শিঙ্গা হাতে।।

ধ্বনি শুনি নেচে ওঠে নমঃশূদ্র প্রাণ।

আনন্দে যতেক বীর করে লম্ফ দান।।

প্রলয় সমুদ্র যেন গর্জ্জন করিল।

চারিদিকে শুনি শব্দ হরি! হরি! বল।।

আশ্চর্য্য মানিয়া দেখে ইসলামের গণ।

কোন ভাবে কোথা ছিল এরা কতক্ষণ।।

আচম্বিত মাটি ফুঁড়ে যেন রে উঠিল।

এমন আশ্চর্য্য কেবা দেখিয়াছে বল?

ডঙ্কা বাজে শিঙ্গা বাজে ভেরী দিল তার।

রণ-মত্ত নমঃশূদ্রে সাজা’ল মাতাল।।

প্রাণের মমতা ছেড়ে একত্রে মিশিয়া।

অযুত শত্রুর মধ্যে পড়ে ঝাঁপ দিয়া।।

কি যে সেথা হল হায়! ভোজ বাজী প্রায়।

কল্পনা নয়নে দেখ বলিবার নয়।।

বীরেন্দ্র কেশরী যথা অতি ক্রোধ ভরে।

মদমত্ত কুঞ্জরের আক্রমণ করে।।

অতিকায় যুথনাথ হস্তি মহাবল।

সিংহের বীর্য্যের বলে পড়ে ধরাতল।।

সেই মত ভাব যেন হইল সেখানে।

হার মেনে শত্রু পক্ষ ভঙ্গ দিল রণে।।

প্রাণদায় ব্যস্ত হয়ে ছুটিল সকলে।

পশ্চাতে ধাইল তবে নমঃশূদ্র দলে।।

দেশ হতে বহু দুরে দিল খেদাইয়া।

আর না আসিল শত্রু গেল পালাইয়া।।

পশ্চাতের কথা কিবা করি আলাপন।

পুলিশ দারোগা পরে করে আগমন।।

দাঙ্গার তদন্ত হ’ল বহুদিন ধরি।

বিচারেতে পেল শাস্তি জন দুই চারি।।

বিপদের দিনে রক্ষা গুরুচাঁদ করে।

তাঁর জয় ধ্বনি সবে করে ঘরে ঘরে।।

প্রভু কয় ‘‘শুন সবে নমঃশূদ্রগণ।

দাঙ্গা যুদ্ধ করা ভাল নহে কদাচন।।

অকারণে কার সনে না কর বিবাদ।

বিবাদে বাড়ায় দেখি শুধুই আপদ।।

Page 450 start

আত্মরক্ষা কারণেতে পার যুদ্ধ দিতে।

কিন্তু কাজ নাহি কর অধর্ম্মের পথে।।

বিশেষতঃ এক কথা কহি সকলেরে।

হিন্দু ও মুসলমান আছি দেশ ভরে।।

এক ভাষা, এক আশা, এক ব্যবসাতে।

কেন বা করিবে রণ তাহাদের সাথে।।

দুই ভাই এক ঠাঁই রহ মিলে মিশে।

ভাই মেরে বল কেন মর হিংসা বিষে।।’’

শ্রীগুরুচাঁদের বাণী জ্ঞানলোকে দেয়।

মহানন্দ চির-অন্ধ দেখেনা রে হায়।।

---০---