Page 405

নন-কো-অপারেশন’ বা অসহযোগ আন্দোলন বা অসহযোগ আন্দোলন (ইতিহাস)

সতের শত সাতান্ন অব্দে পলাশীর রণে।

স্বাধীনতা-সূর্য্য অস্ত ভারত গগনে।।

ভারত বিজয়ে হ’ল আদিতে পত্তন।

ক্লাইভের সঙ্গে হায়! সিরাজের রণ।।

Page 406 start

ধীরে ধীরে ক্রমে ক্রমে ‘বণিকের জাতি’।

পুণ্যভূমি এ ভারতে সাজিল নৃপতি।।

‘ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’ বণিকের সঙ্ঘ।

বাণ্যিজ্য, রাজত্ব দুই নিয়ে করে রঙ্গ।।

শাসন শোষণ দুই চলে এই হাতে।

অরাজক হ’ল রাজ্য বহু বিধ মতে।।

এই ভাবে শতবর্ষ গত হয়ে যায়।

ভারতসাবীর মনে অশান্তি উদয়।।

আঠা’শ ছাপান্ন অব্দে আগুন জ্বলিল।

উত্যক্ত ভারতবাসী বিদ্রোহ করিল।।

সমস্ত ভারত ব্যাপী ঘোর আন্দোলন।

নর নারী শিশু হত্যা হ’ল অগনণ।।

বজ্রহস্তে ইংরাজেরা বিদ্রোহ দমিল।

বিদ্রোহী পলায় কেত, কেহ যুদ্ধে মল।।

‘‘সিপাহী বিদ্রোহ’’ নামে এই আন্দোলন।

জগতের ইতিহাসে করেছে লিখন।।

ইংল্যান্ড-ইশ্বরী রাণী নাম ভিক্ট্রোরিয়া।

জানিলেন সব কথা গৃহেতে বসিয়া।।

মন্ত্রী সঙ্গে দয়াবতী করিল মন্ত্রণা।

ভারত কহেছে বটে অশেষ যন্ত্রণা।।

বণিকের হাতে রাজ্য আর না রাখিব।

আপনার হাতে এবে রাজদন্ড নিব।।

সেই মতে নিজ হাতে রাণী রাজ্য লয়।

‘‘রাণীর মহান বাণী’’ ঘোষণা করয়।।

রাণীর ঘোষণা মধ্যে রহিল প্রচার।

রাজকার্য্যে অধিকার থাকিবে প্রজার।।

ধর্ম্মকর্ম্মে স্বাধীনাতা থাকিবে সবার।

ধর্ম্মে হস্তক্ষেপ রাণী না কিরবে কার।।

আঠার শ একষট্টি অব্দে রাণীর আজ্ঞায়।

আইন সভার সৃষ্টি এ ভারতে হয়।।

বাঙ্গালা বোম্বাই আর মাদ্রাজ প্রদেশে।

পাঞ্জাবে, সীমান্তে তাই সেই সভা বসে।।

ইংরাজী শিক্ষার হ’ল বহুল প্রচার।

শিখিল ভারতবাসী পাশ্চাত্য আচার।।

ভারতের চিন্তারাজ্যে অদ্রদূত যাঁরা।

এর পরে মনে মনে ভাবিলেন তারা।।

জাতীয় সমিতি যদি না থাকে ভারতে।

সব আন্দোলন ব্যর্থ হবে ভবিষ্যতে।।

রাষ্ট্রীয় সমিতি তাই করিতে গঠন।

ভারতের প্রধানেরা করিল মনন।।

কটন সাহায্য কার্য্যে করিল তখন।

তার ফলে আঠার শত পাঁচাশী সালে।

জাতীয় রাষ্ট্রীয় সভা বোম্বাইতে মেলে।।

সংক্ষেপে ‘‘কংগ্রেস’’ নামে হ’ল পরিচিত।

ভারতের মান্য যত মনীষি-রচিত।।

নামেতে উমেশ চন্দ্র সেরা ব্যারিষ্টার।

ব্যানার্জ্জি উপাধি তাঁর কলিকাতা ঘর।।

‘‘ডব্লিউ, সি, ব্যানার্জ্জি’’ বলিসবে তারে জানে।

প্রথমে বসিল সভাপতির আসনে।।

সেই হতে অদ্যবধি সেই যে কংগ্রেস।

‘‘জাতীয় সমিতি’’ নামে সেবিতেছে দেশ।।

জাতীয় সমিতি গড়ি করে আন্দোলন।

স্বাধীনতা দাবী তারা করিছে এখন।।

আঠার শ’ নিরানব্বই আব্দেতে আবার।

ভারসতাবসীরা পেল কিছু অধিকার।।

আইন সভায় সভ্য হইল অধিক।

বহু সঙ্ঘ নিজ সভ্য করে দেয় ঠিক।।

ঊনিশ শ’ নয় অব্দে আর অগ্রসর।

‘‘মার্লি-মিন্টো’’ নামে হ’ল নব সংস্কার।।

লাটের সভায় সভ্য হয় নির্ব্বাচন।।

প্রতিনিধি নামে মাত্র মূল শক্তি নাই।

স্বায়ত্ত শাসন নীতি ইথে নাহি পাই।।

Page 407 start

এই ভাবে ক্রমে দিন হ’ল অগ্রসর।

নামিল বিশ্বের বুকে রণ ভয়ঙ্কর।।

ঊনিশ শ’ চৌদ্দ অব্দে সমর বাধিল।

সেই সব কথা পূর্ব্বে লিখিত হইল।।

এই যুদ্ধে ভারতের যত নর নারী।

রাজার সাহার্য্য করে দৃঢ় নিষ্ঠা করি।।

রক্ত দিল বিত্ত দিল জোগা’ল সৈনিক।

বাঙ্গালী মাদ্রাজী গেল আর কত শিখ।।

রাজশক্তি পরিচয় দিল ভারতবাসী।

বিরাতে ইংরাজ জাতি তাতে মহাসুখী।।

চেমসফোর্ড রড়লাট ছিলেন ভারতে।

সেক্রেটারী মন্টেগু ছিলেন বিলাতে।।

ভারতবাসীর এই মহত্ব দেখিয়া।

রাজার পক্ষেতে বাণী দিলেন বলিয়া।।

‘‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে যত উপনিবেশ আছে।

স্বায়ত্ত শাসন প্রথা সর্ব্বত্র রয়েছে।।

সেই প্রথা প্রবর্ত্তিত হইবে ভারতে।

ক্রমে ক্রমে নিব মোরা তারে সেই পথে।।’’

মহা সমরের কালে এক মহাজন।

ইংরাজে সাহায্য করে অতি দৃঢ় মন।।

নামেতে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।

করজোড়ে মহাত্মের সবিনয়ে বন্দি।।

পবিত্র চরিত্র অতি ধর্ম্মিক সুজন।

‘‘মহাত্মা’’ বলিলে তাঁরে চেনে সর্ব্বজন।।

বাল্যকাল হতে তাঁর স্বভাব সুন্দর।

প্রতি কার্য্যে ছিল তাঁর সত্য ব্যবহার।।

এক মাত্র ধর্ম্ম তাঁর সত্যকে প্রতিষ্ঠা।

সত্যকে ঈশ্বর মানে এত তাঁর নিষ্ঠা।।

ব্যারিষ্টারী পড়িলেন লন্ডন সহরে।

আমিষ ভোজন সেথা কভু নাহি করে।

ব্যারিষ্টারী পাশ করি আসিলেন দেশে।

হাইকোর্টে যোগদান করে অবশেষে।।

ব্যবসায় পথে দেখি বিথ্যার আচার।

ব্যারিষ্টারী কার্য্য ক্রমে করে পরিহার।।

সত্যকে মেনেছে যেবা বাক্যে, মনে প্রাণে।

তাঁরে অস্বীকার কেবা করে কোনখানে?

দক্ষিণ আফ্রিকা হতে এল আমন্ত্রণ।

বহু কষ্টে সহে সেথা ভারতীয় গণ।।

সেই আমন্ত্রণে তবে সেই মহাশয়।

দক্ষিণ আফ্রিকা আসি উপনীত হয়।।

সত্যের পথেতে দেখ বহু দৃঃখ রয়।

হাসি মুখে সব দুঃখ সহে মহাশয়।।

সত্যের পূজারী যাঁরা আছে ধরা পরে।

সত্য ভিন্ন অন্য কিছু মান্য নাহি করে।।

যতই উদ্ধত হোক মানবীয় শক্তি।

সত্যের পূজারী তাঁহে নাহি রাখে ভক্তি।।

অকপটে বিনা ভয়ে কহে সমুদয়।

কপটীর প্রাণে তাহা সত্য নাহি হয়।।

উদ্ধত শাসন দন্ড তাই নেমে আসে।

তাহা দেখি সত্যাচারী বসে বসে হাসে।।

অহিংসা সত্যের ভিত্তি মনে করি সার।

সর্ব্ব কার্য্যে করে গান্ধী সেই ব্যবহার।।

পথ দেখাইল তাঁরে ঋষি টলষ্টয়।

তাঁর নীতি মেনে গান্ধী তাতে দীক্ষা লয়।।

দক্ষিণ আফ্রিকা যবে করে আন্দোলন।

বহু দুঃখ পেল সেথা সেই মহাজন।।

শ্বেতাঙ্গ সমাজ সেথা দোর্দ্দন্ড প্রতাপ।

কোন ভাবে গান্ধীজীরে নাহি করে মাপ।।

প্রত্যক্ষে পরোক্ষ কত করে অসম্মান।

তবু ধীর সত্য বীর ক্রুদ্ধ নহি হন।।

বিনা প্রতিবাদে যত অপমান সয়।

শ্বেতাঙ্গ সমাজ তাতে আরো ক্রুদ্ধ হয়।।

একদা রুখিয়া তারা অনেকে আসিল।

বিনা দোষে গান্ধীজীর দাঁর ভেঙ্গে দিল।।

Page 408 start

সূর্য্যকে ঢাকিতে বল কেবা কবে পারে?

গান্ধীজীর কীর্ত্তি গেল দেশ দেশান্তরে।।

ইংরেজ প্রধান বর্গ তাঁহারে চিনিল।

আফ্রিকার সমস্যার সমাধান হল।।

অহিংসা নীতির পথে একটি বিগ্রহ।

প্রতিবাদ ‘নির্ব্বিবাদ’ পূর্ণ সত্যাগ্রহ।।

মান যশ দন্ডভয় করি অবহেলা।

সত্যকে বহিয়া শিরে দৃঢ়পদে-চলা।।

‘অক্রোধ পরমানন্দ’ নিতাই যেমন।

সেই মতে সেই পথে সঙ্কল্প সাধন।।

সত্য লাগি যে বিরোগী এত কষ্ট সয়।

বিজয়লহ্মীর দানে বিজয়ী সে হয়।।

এতকাল রাজনীতি বিশারদ গণ।

অহিংসা নীতির কথা বলেনি কখন।।

‘‘শঠে শাঠ্যৎ সমাচরেৎ’’ এই শ্রেষ্ঠ নীতি।

ছলা, কলা, হিংসা দ্বেষ সেই পথে গতি।।

মিথ্যা ছাড়া রাজনীতি চলে না কখন।

ধর্ম্মপথে লাগে বটে সাধন ভজন।।

কিন্তু গান্ধী নব সন্ধী দেখা’ল জগতে।

‘‘অহিংসা নীতির গতি’’ চলে সর্ব্ব পথে।।

কিবা ধর্ম্ম, কিবা কর্ম্ম, কিবা রাজনীতি।

অহিংসা নীতির আছে সবখানে গতি।।

অস্ত্র বলে দেহ বলে জয় নাহি হয়।

অহিংসা অস্ত্রেতে বিশ্ব জয় করা যায়।।

দক্ষিণ আফ্রিকা খন্ডে সেই নীতি ফলিল।

বিশ্ববাসী নর নারী বিস্ময় মানিল।।

হেনকালে মহাযুদ্ধে নামিল ইংরাজ।

বিশ্বময় পড়ে রব ‘সাজ সাজ সাজ’।।

পরাধীন ভারতের বহু অধিকার।

যুদ্ধ শেষে দিবে বলি করে অঙ্গীকার।।

মন্টেগুর বাণী যাহা পূর্ব্বে বলিয়াছি।

আনন্দে ভারতবাসী ওঠে তাই নাচি।।

সত্যের পূজারী গান্ধী ভাবিলেন মনে।

ইংরাজে সাহায্য যদি করি এই রণে।।

যুদ্ধ শেষে ভালবেসে ইংরাজ তখন।

ভারতবাসীকে দিবে স্বাধীনতা ধন।।

তার লাগি সেই ত্যাগী যুদ্ধের সময়।

বহু ভাবে ইংরাজের সাহায্য করয়।।

তাঁর কার্য্যে ইংরাজেরা প্রীত অতিশয়।

তারা বলে ‘‘ধন্য ধন্য গান্ধী মহাশয়।।’’

ঊনিশ’শ আঠার অব্দে যুদ্ধ শেষ হলো।

বলদর্পী জার্মানীর দর্প ভেঙ্গে গেল।।

‘‘ভার্সাই নগরে সন্ধি করে সবে মিশে।

জুড়াল ধরার অঙ্গ শান্তির বাতাসে।।

ভারতের কি করিবে ইংরাজ এখন?

এভাবে ভারতে আগে এক আন্দোলন।।

উনিশ’শ ঊনিশ অব্দে ভারত আইন।

পার্লিমেন্টে হল পাশ দেখি একদিন।।

যুদ্ধকালে যত কিছু কথা বলা হল।

কার্য্যকালে প্রায় কিছু দেয়া নাহি গেল।।

দ্বৈত-নীতি প্রচলিত হইল প্রদেশে।

সেই নীতি বার্ত্তা কিছু বলিব বিশেষে।।

নির্ব্বাচিত মনোনীত সভ্য দু প্রকার।

আইন সভায় যাবে ব্যবস্থা তাহার।।

শাসন ব্যবস্থা ভাগ দুই ভাগে করে।

মন্ত্রী এক ভাগে রহে সদস্যে অপরে।।

যেই ভাগ মন্ত্রীগণে করিবে চালনা।

‘‘হস্তান্তর ভাগ বলি তাহার ঘোষণা।।

সংরক্ষিত ভাগ লাট রাখে নিজ খাসে।

মনোনীত সদস্যেরা সেই ভাগে বসে।।

মন্ত্রীকে সদস্য চলে লাটের ইচ্ছায়।

আইন সভার কাছে দায়ী নাহি রয়।।

সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর একটি নিয়ম।

স্বায়ত্ব শাসনে যাহা পূর্ণ ব্যতিক্রম।।

Page 409 start

স্বৈর তন্ত্র বলি যাহা নীতি শাস্ত্রে কয়।

লাট-হস্তে সেই শক্তি সব রাখি দেয়।।

স্বৈর তন্ত্র কথা কিছু সংক্ষেপে বলিব।

মূল সূত্র ধরি পরে যা হয় বলিব।।

আৈইন সভার মত হোক বা না হোক।

জন স্বার্থ তাতে ঠিক রোক বানা রোক।।

লাট যদি মনে করে এ আইন হলে।

নির্ব্বিঘ্নে শাসন-যন্ত্র ঠিক ভাবে চলে।।

আপনার শক্তি বলে লাট মহোদয়।

যে কোন আইন পাশ নিজে করি লয়।।

প্রকৃত প্রস্তাবে শক্তি ইংরাজের হাতে।

ব্যথিত ভারতবাসী সুখী নহে তাতে।।

অবশ্য প্রত্যেক কার্যে আছে দুই দিক।

কোন কার্য্য সবে নাহি বলে কভু ঠিক।।

সে সব বিচার কিছু এখানে না করি।

গ্রন্থের ভাবের ভাবে চলি পথ ধরি।।

‘‘ভারত আইন’’ দেখি নিরাশ হইয়া।

আন্দোলন করে সব নেতারা জুটিয়া।।

আন্দোলন দমনের হল প্রয়োজন।

‘‘রাউলাট আইন’’ তবে করে প্রচলন।।

বেগবতী স্রোতস্বতী যদি বাধা পায়।

বাধা-প্রাপ্তে বেগ যথা দ্বিগুণিত হয়।।

আন্দালন ধারা চলে অতি দৃঢ় বেগে।

গান্ধীর আদর্শ মানে গাঢ় অনুরাগে।।

হেনকালে হল এক দুরন্ত ঘটনা।

ইংরাজ শাসনে ঘোর কলঙ্ক নিশানা।।

পাঞ্চাব প্রদেশে লাট ছিল ও’ডায়ার।

বড়ই উদ্ধত ছিল প্রকৃতি তাহার।।

পরোয়ানা জারী করে দেশেরে ভিতরে।

সভা সমিতির কার্য্য সব বন্ধ করে।।

এ সময়ে সত্য-বীর গান্ধী মহাশয়।

অহিংসা নীতির তত্ত্ব ভারতে জানায়।।

সত্যকে বরণ করি সহিবারে দুঃখ।

ভারতের নর নারী সকলে উন্মুখ।।

গান্ধী কহে ‘‘সত্য যদি মানিবারে চাও।

অন্যায্য আদেশ নাহি মাথা পেতে লও।।’’

তাই যবে পাঞ্জাবের লাট মহোদয়।

সভা সমিতির কার্য্য বন্ধ করে দেয়।।

সে আদেশ লঙ্ঘিবারে সবে করে মন।

দুঃখ হোক কিংবা তাতে হোক না মরণ।।

অমৃতসহর মধ্যে জালিয়ানা বাগ।

ইংরাজ শাসনে প’ল কলঙ্কের দাগ।।

নর নারী শিশু করি অসংখ্য সংখ্যায়।

সভাক্ষেত্রে এল সবে ভাবের বন্যায়।।

যখনে সভার কার্য্য আরম্ভ হইল।

ইংরাজের সৈন্য আসি সেথা হানা দিল।।

চারিদিকে ঘেরা বাগ একটী দুয়ার।

পাতিল ‘‘মেশিন গান’’ তাহার উপর।।

আজ্ঞা পেয়ে সৈনিকরা দাগিল কামনা।

সেই দৃশ্য মনে হলে আজো কান্দে প্রাণ।।

নিরস্ত্র জনতা বব্ধ বাগের ভিতরে।

কত শত গুলি আসে মৃত্যুরূপ ধরে।।

নর নারী শিশু সেথা ত্যজিল জীবন।

রক্তযজ্ঞে সভা তবে হল সমাপন।।

বিদ্যুতের মত বার্ত্তা গেল ঘরে ঘরে।

স্তন্তিত ভারতবাসী এই অত্যাচারে।।

গান্ধী বলে ‘‘কেহ নাহি হও উত্তেজিত।

শক্তি-শূণ্য জাতি মোরা তাহাতে বিজিত।।

বাঁচিবার অধিকার বটে কিছু নাই।

মরিবার অধিকার সাথে আছে ভাই।।

ইংরাজের নীতি সঙ্গে যোগ নাহি দিব।

অসহযোগের নীতি সকলে মানিব।।

কত জন শ্বেতকায় এই দেশে রয়?

সর্ব্বস্থানে দেশবাসী সহযোগ দেয়।।

Page 410 start

ইংরাজ রাজত্ব তাই চলে সুস্থভাবে।

দেশবাসী ছাড়া রাজ্য কেমনে চলিবে?

আর দেখ অস্ত্র শূন্য এ ভারতবাসী।

বিশেষতঃ অস্ত্রে আমি নাহিক বিশ্বাসী।।

তথাপি তর্কের লাগি করি আলাপন।

অস্ত্র দিয়ে নাহি হবে স্বকার্য্য সাধন।।

অস্ত্রগুণে বহুগুণে বলীয়ান তারা।

সেই পথে চেষ্টা অর্থ মিছামিছি মরা।।

সেই অস্ত্রে কভু নাহি আসিবে বিজয়।

অসহযোগের অস্ত্র পরম সহায়।।

এই কথা দৃঢ় করে বলিবারে পারি।

কথা যদি শোনে ভারতের নর নারী।।

স্বরাজ আনিতে পারি আমি একদিনে।

একথা নহেক মিথ্যা জানিও পরাণে।।

কি পথে সম্ভব তাহা বলিতেছি তাই।

অসহযোগের পথে ভিন্ন পথ নাই।।

বিদেশী যতেক কিছু করহে বর্জ্জন।

সকলের স্বদেশী দ্রব্য করগো গ্রহণ।।

ইংরাজের আদালত স্কুল পাঠশালা।

ইংরাজের দাস্যবৃত্তি সব দূরে ফেলা।।

ইংরাজের বস্ত্র ছাড় ইংরাজের নীতি।

স্বদেশী সাজিলে রক্ষা পাবে এই জাতি।।’’

গান্ধীজীর এই ভীর গেল ঘরে ঘরে।

দলে দলে ঘর ছেড়ে আসিল বাহিরে।।

এক সাথে যোগ দিল হিন্দু মুসলমান।

কি কারণে বলি শুন তাহার প্রমাণ।।

ইসলাম ধর্মে ের গুরু উপাধি ‘খলিফা’।

রাজত্ব ও ধর্ম্ম কার্য্য তাঁর দুই দফা।।

তুরস্ক রাজ্যেতে তেঁহ ছিল নরপতি।

সকল ইসলাম তাঁরে জানায় প্রণতি।।

জন্মিল কামাল পাশা তুরস্ক মাঝারে।

সূহ্ম রাজনীতি বুদ্ধি সে মহাত্ম ধরে।।

তিনি দেখে ইউরোপে যত রাজ্য আছে।

রাজনীতি হতে ধর্ম্ম দুরে রাখিয়াছে।।

মধ্য যুগে স্বৈরাচারী যেই প্রথা ছিল।

সেই প্রথা লোপ করে গণতন্ত্র এল।।

গণতন্ত্রে তারা সবে মহাসুখে রয়।

শৌর্য্যে, বীর্য্যে কোন রূপে কভু হীন নয়।।

অথচ তুরস্ক দেশে ধর্ম্ম আচ্ছাদনে।

জগতেরতালে পা ফেলেনা সমানে।।

দুর্ব্বলতা দিনে দিনে ঘিরেছে তাহারে।

কুচক্রী ইউরোপবাসী ভাবিল অন্তরে।।

ইউরোপ খন্ডে রাজা সকলি খৃষ্টান।

তুরস্ক এখানে মাত্র আছে মুসলমান।।

ক্রমে ক্রমে তুরস্কেরে করে দাও পার।

এশিয়া ভূখন্ডে রাজ্য ঠিক হোক তার।।

অনুমানে বুঝি বটে এই সব ভাব।

জ্বলন্ত প্রমাণ নিয়ে বল কিবা লাভ?

তবু শোন প্রতিবেশী গ্রীক জাতি যারা।

অকস্মাৎ তুরস্কেরে আক্রমিল তারা।।

বিপন্ন জাতির তরে সে কামাল পাশা।

করিল অদ্ভুত রণ ছেড়ে সব আশা।।

দেশপ্রীতি শ্রেষ্ঠ বলে হইল প্রমাণ।

রাখিল কামালপাশা জাতির সম্মান।।

দেশরক্ষা করি বীর ভাবে মনে মন।

পাশ্চাত্য আদর্শে দেশ করিব গঠন।।

ধর্ম্ম নীতি আচ্ছাদনে খলিফা রহিল।

কামালেরে বাধা দিতে সঙ্কল্প করিল।।

কিন্তু দেখ বীরত্বের মহিমা অপার।

দেশবাসী সবে বাধ্য হইল তাঁহার।।

কামাল কহিল “মোরা খলিফা না চাই।

নিজেদের বাহুবলে রাজত্ব চালাই।।

দেশবাসী সবে জুটি’ প্রতিনিধি দিব।

তারা মিশি যাহা বলে সে কার্য্য করিব।।”

Page 411 start

তুরস্কের অধিবাসী যত নবীনেরা।

কামালের এই বাক্যে সায় দিল তারা।।

দেশ মধ্যে তারা হ’ল সংখ্যাতে প্রধান।

“খলিফা” ছাড়িল রাজ্য রাখিল সম্মান।।

তুর্কী ছাড়া অন্য দেশে যত মুসলমান।

তারা বলে ‘‘এই কার্য্যে বড় অকল্যাণ।।

ধর্ম্মের প্রধান যিনি “খলিফা” উপাধি।

তাঁরে সিংহাসনচ্যুত বড়ই অবিধি।।

খোদার রসুল যিনি নবী মহম্মদ।

তিনি নিজে করিলেন ‘‘খলিফার পদ’’।।

তাঁর আজ্ঞা কেবা নাড়ে এত শক্তি কার?

এই কার্য্যে চাহি তোরা উচিত বিচার।।

ভারতের মুসলমান ছিল যত জন।

‘‘খেলাফত’’ নামে তারা করে আন্দোলন।।

তাহাদের সঙ্গে যোগ মহাত্মাজী দিল।

তাঁর কার্য্যে মুসলমান সন্তুষ্ট হইল।।

তাই যবে দিল ভীর গান্ধী মহাশয়।

দলে দলে নর নারী তাতে যোগ দেয়।।

মহম্মদ, সৌকত নামে আলী ভ্রাতৃ দ্বয়।

গান্ধীর আহবানে দোঁহে দৃঢ় সাড়া দেয়।।

জিন্না যিনি সাজিয়াছে আজ লীগপতি।

সেই আন্দোলনে ছিল এক সেনাপতি।।

পাঞ্জাব প্রদেশ বাসী লালা লাজপত।

আন্দোলনে দিল যোগ সখা সাথী সাথ।

দুই ভাই প্যাটেলেরা গুজরাট বাসী।

সেনাপতি রূপে যুদ্ধে দাঁড়াইল আসি।।

রাজগোপালাচারী মাদ্রাজী ব্রাহ্মণ।

মনে প্রাণে মানিলেন সেই আন্দোলন।।

রাজেন্দ্রপ্রসাদ আর সীতারামিয়া।

আবুল কামাল আজাদ আসিল ধাইয়া।।

মতিলাল নেহেরুর বুদ্ধি বিচক্ষণ।

পুত্রসহ আন্দোলন করে মহাজন।।

শ্রীজহরলাল যার উপাধি পন্ডিত।

বর্ত্তমান ভারতে শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রাবিৎ।।

শ্রীমতিলালের তিনি একমাত্র পুত্র।

যেম্নি বাপ তেম্নি বেটা এই তার সূত্র।।

বঙ্গ দেশে উঠে ঢেউ প্রচন্ড আকারে।

ঢেউ ছোটে মহা বেগে প্রতি ঘরে ঘরে।।

শ্রীচিত্তরঞ্জন দাস ছিল ব্যারিষ্টার।

আন্দোলনে যোগ দিয়ে ছাড়িল সংসার।।

‘‘দেশবন্ধু’’ বলে আখ্যা সবে দিল তাঁরে।

সর্ব্বস্ব দেশেরে লাগি দিল দান করে।।

রাজনীতি বুদ্ধি কিংবা বাক পটুতায়।

‘‘দেশবন্ধু’’ তুল্য আর দেখা নাহি যায়।।

কি মোহিনী শক্তি যেন ছিল বাক্যে তাঁর।

জাহাত বিপুল সাড়া অন্তরে সবার।।

তাঁর প্রিয় শিষ্য বসু শ্রীসুভাষ চন্দ্র।

আন্দোলনে ছাঁপ দিয়ে পাইল আনন্দ।।

‘‘সিভিল সার্ভিস’’ পড়ি ম্যাজিষ্ট্রেট হ’ল।

মাতৃ-পূজা দেবী তলে তাহা বিসর্জ্জিল।।

‘‘দেশপ্রিয়’’ আখ্যা পে’ল যতীন্ত্র মোহন।

হাইকোর্টে ব্যারিষ্টার তিনি একজন।।

ইস্কুল কলেজ ছাড়ে ছাত্র দলে দলে।

‘‘স্বাধীনতা চাহি মোরা’’ এই কথা বলে।।

কিন্তু রাজকার্য্যে যারা নিয়োজিত ছিল।

চাকুরী ছাড়িয়া প্রায় কেহ না আসিল।।

কতক উকীল বটে আসিল বাহিরে।

অধিকাংশ আদালতে যাতায়াত করে।।

কিছু কিছু মুসলমান বটে যোগ দিল।

অধিকাংশ আন্দোলনে কভু না ভিড়িল।।

অসহযোগের নীতি সকলে না মানে।

তাতে শ্লথ গতি পরে এল আন্দোলনে।।

ঊনিশ শ’ পাঁচ অব্দে আন্দোলন হয়।

নমঃশূদ্রগণ তাতে যোগ নাহি দেয়।।

Page 412 start

অশিক্ষা-আন্ধারে জাতি কিছু নাহি জানে।

কিবা সে করিতে পারে গিয়ে আন্দোলনে।।

শ্রীগুরু চাঁদের আজ্ঞা মানে তাঁর জাতি।

আন্দোলনে যোগ দিতে নহে কা’র মতি।।

এই আন্দোলন কালে তাই পুনরায়।

স্বদেশী নেতারা জুটি গুরুচাঁদে কয়।।

জাতি সহ আন্দোলনে যোগ দিতে কহে।

প্রভু কহে ‘‘মাপ চাই আজ তাহা নহে।।’’

কিকারণে প্রবু কহে এহেন বচন?

সেই ইতিহাস এবে করিব বর্ণন।।

কাঙ্গাল অবোধ জনে দেখাইতে পথ।

নাশিতে অসুর শক্তি রক্ষিবারে সৎ।।

নরাকারে এল যিনি এই ধরা পরে।

হরি হরি বল তাই তাঁর চিন্তা করে।।

---০---