Page 530

বিভিন্ন ভক্তালয়ে ভ্রমণ

লক্ষ্মীখালী ছাড়ি পরে, তরণী চলিল ধীরে,

ভোলা নদী ধরি তরী ধায়।

মাদুর পাল্টার মাঝ, উপাধিতে কবিরাজ,

সেই গৃহে মহাপ্রভু যায়।।

শ্রীমধুসূদন নামে, কর্তা যিনি সেই ধামে,

করজোড়ে প্রভুকে বন্দিল।

শ্যাম সখী দুই ভাই, মনে কোন দ্বিধা নাই,

বিলাতের চাঁদা আনি দিল।।

তথা হ’তে তরী চলে, কিছুকাল গত হ’লে,

দিগরাজবাসী নিবারণ।

উপাধিতে হালদার, বহু জমি জমা তার,

চারি ভাই সবে একমন।।

গোপালেরে গুরু বলে, তাহা সবে মান্য করে,

পূর্বে তাহা করেছি লিখন।

কান্দিয়া প্রভুকে লয়, সেই চারি মহাশয়,

প্রভু তা’তে হ’ল তুষ্ট মন।।

Page 531 start

প্রভু আগ্মনে তারা, হ’ল যেন জ্ঞানহারা,

বাহ্যস্মৃতি যেন কিছু নাই।

বহু মাছ পুকুরেতে, পুষেছিল যতনেতে,

জানি যাহা তাহা লিখে যাই।।

বড় কর্তা নিবারণ, বলে “তোরা সবে শোন,

জাল দিয়ে মাছ ধর এসে।

হেন দিন পাবি নারে, সব মাছ মেরে দেরে,

চুপ করে থাকিস নারে বসে।।”

বড়কর্তা আজ্ঞা দিল, সকলে নামিল জলে,

বহু মাছ লাগিল ধরিতে।

মাধবেন্দ্র দেখে তাই, বলে “কিবা কর ভাই,

এত মাছ তোল কোন মতে?”

কহিতেছে নিবারণ, “শুন বলি মহাজন,

হেন দিন আর নাহি পাব।

প্রভুর সেবার তরে, সব মাছ দিব ধরে,

দিন পেয়ে কেন ছেড়ে দিব।।”

মাধবেন্দ্র বলে “ভক্ত! কথা বলিয়াছ শক্ত,

কিন্তু আমি এক কথা বলি।

সব যদি দাও ধরে, উপায় কি হবে পরে,

আসে যবে মতুয়া সকলি।।

হরিভক্ত সেবা তরে, রাখ কিছু যত্ন করে,

এক দিনে সব মার কেন?

ভক্ত পেলে হরি পায়, ভক্তে খেলে হরি খায়,

এই তত্ত্ব সত্য বলে জান।।”

মাধবেন্দ্র যাহা বলে, তা হাতে সুফল ফলে,

মাছ ধরা হল পরে বন্ধ।

মহোৎসব হ’ল ভারী, সবে বলে হরি হরি,

প্রভু সেথা পাইল আনন্দ।।

পরে নিবারণ গুণী, বিলাতের চাঁদা আনি,

প্রভুর শ্রীকরে করে দান।

তথা হ’তে ছেড়ে তরী, কিছুদূর অগ্রসরী,

বুড়বুড়ে গ্রামে প্রভু যান।।

মহাসাধু ইষ্ট-নিষ্ঠ, গোপালের শিস্য শ্রেষ্ঠ,

নামে সাধু শ্রীপূর্ণ চরণ।

লেংটি করে বহির্বাস, চলে সাধু বারমাস,

গুরু-পদে আত্মসমর্পণ।।

‘ওঃ হরি’ ‘ওঃ হরি’ বলে, চোখে ধারা বেয়ে চলে,

ছলাকলা কিছু নাহি জানে।

গোপালের বাক্য বিনা, কিছু করিতে জানে না,

তার চিন্তা শয়নে স্বপনে।।

নিতান্ত দরিদ্র ছিল, গোপালের দয়া পে’ল,

দিনে দিনে লক্ষ্মী এল ঘরে।

দয়া করি দয়াময়, সেই গৃহ পরে যায়,

আহারাদি তথা প্রভু করে।।

পূর্ণ চাঁদ সাধু পাকা, আনিয়া পঞ্চাশ টাকা,

চাঁদা দিল প্রভুর চরণে।

সবে ডেকে প্রভু কয়, “দেখ দেখ মহাশয়,

লেংটি-পরা সর্বনীতি জানে।।”

তথা হ’তে দয়াময়, কাইনমারিতে যায়,

মহিম মণ্ডল যেথা রয়।

মহাধনী মহাশয়, “গোপালের পদাশ্রয়,

আছি মোরা” সেই কথা কয়।।

কিছু কিছু পরিচয়, এখানে বলিতে হয়,

গুরুচাঁদ যাহা শিক্ষা দিল।

পূর্বে নমশূদ্র মাঝে, যদিও এক সমাজে,

ইতি উতি ভিন্নভাব ছিল।।

নানা ভাবে পরিচয়, দিত তারা সর্বদায়,

কেহ ‘ধানী’ কেহ বা ‘শেফালী’।

ভিত্তিহীন এই ভেদ, সমাজের অঙ্গচ্ছেদ,

দেখিত না কেহ চক্ষু মেলি।।

প্রভু গুরুচাঁদ তায়, ডাক দিয়া সবে কয়,

“ওরে অন্ধ! কি করেছ বসে?

আপনার অঙ্গ কেটে, যেতে তুমি চাও হেটে,

এই বুদ্ধি জোটাইলে শেষে।।

Page 532 start

নমশূদ্র দুই নয়, এক জাতি সর্বদায়,

একদেহ এক মন প্রাণ।

দুষ্ট বুদ্ধি দিয়ে কে রে? রেখেছে পৃথক করে,

ভেঙ্গে ফেল ভেদের পাষাণ।।”

প্রভুর আদেশ পেয়ে, মতোরা চলিল ধেয়ে,

শ্রীগোপাল পথ দেখাইল।

মহিমের ভ্রাতুষ্পুত্র, শুন বলি সেই সূত্র,

এক কন্যা তারে বিয়া দিল।।

‘ধানী’ বলি পরিচয়, মহিম মণ্ডল কয়,

প্রভু বলে “আর নাহি বল।

নমশূদ্র এক সবে, কেন দুই কথা ক’বে,

এক মনে এক ভাবে চল।।”

মহিম মণ্ডল একা, দিল একশত টাকা,

প্রভু তাহে বহু তুষ্ট হ’ল।

তরী ছাড়ি পুনরায়, উত্তর মুখেতে ধায়,

রমণীর গৃহেতে পৌছিল।।

বসতি হুকুড়া গ্রাম, রমণী গোঁসাই নাম,

শক্তিমন্ত সাধু অতিশয়।

ভক্তিগুণে গুরু চান, তাহার গৃহেতে যান,

এক রাত্রি রহিল তথায়।।

বিলাতের চাঁদা বলে, আনিয়া প্রভুর স্থলে,

রমণী গোঁসাই দিল টাকা।

তথা হতে দয়াময়, রোমজাইপুর যায়,

গ্রামখানি ছায়াতলে ঢাকা।।

শ্রীগুরু চরণ রায়, পূর্বেতে তাপালি কয়,

প্রভু বলে “ইহা ভাল নয়।”

“তাপালি” উপাধি ফেলে, বলে “রায়” কুতূহলে,

যেই মত প্রভু আজ্ঞা দেয়।।

ভ্রাতার নন্দন তার, পঞ্চানন নাম যার,

কেহ কেহ বলে পঞ্চানন।

হ’য়ে নামেতে বিভোল, উপাধি পায় পাগল,

“পাগল দা” বলে সর্বজন।।

তার কীর্তি আছে যাহা, পশ্চাতে বলিব তাহা,

এবে বলি মূলসূত্র ধরে।

প্রভু সেই বাড়ী যায়, বিলাতের চাঁদা দেয়,

খুড়া ভাইপো এসে একত্তরে।।

পাগলের গৃহ কাছে, একটি ভকত আছে,

তার নাম জানি ধনপতি।

প্রভুর অপূর্ব খেলা, করিল আশ্চর্য লীলা,

সেই গৃহে জগতের পতি।।

পাগলের বাড়ী হ’তে, ভকতগণের সাথে,

প্রভু যাত্রা করে বড়দিয়া।

ধনপতি মনে ভাবে , প্রভুকে গৃহেতে নিবে,

বিলাতের চাঁদা দিবে দিয়া।।

সেই ভাবে বাড়ী যায়, ফিরে এসে দেখে হায়,

প্রভু চলে গেছে নদী পারে।

দারুণ বেদনা পেয়ে, মাটিতে পড়িল শুয়ে,

অঝোরে নয়নে অশ্রু ঝরে।।

সহজ সরল হ’লে, অনায়াসে হরি মে’লে,

প্রমাণ হইল তাহা সেথা।

ধনপতি পড়ে কান্দে, সেই কথা গুরুচান্দে,

কেহ আসি জানায় বারতা।

প্রভু কয় “নাহি ভয়, যাব আমি সুনিশ্চয়,

সুস্থ্য হ’তে বল গিয়া তারে।”

সেই সমাচার পেয়ে, ধনপতি এল ধেয়ে,

উপস্থিত হ’ল নদী ধারে।।

বড়দিয়া কেনারাম, প্রভু গেল তার ধাম,

বিলাতের চাঁদা তেহ দিল।

প্রভু তবে পুনরায়, রোমজাইপুর যায়,

ধনপতির বাসনা পুরিল।।

তথা হ’তে বাঁশতলী, চলিলেন তরী খুলি,

শ্রীমন্ত বিশ্বাস বলি নাম।

মাধবের এক কন্যা, ‘প্রভাতী’ নামেতে ধন্যা,

বিয়া সেথা দিল গুণধাম।।

Page 533 start

ভক্তিগুণে দয়াময়, একরাত্রি তথা রয়,

পরদিনে গেল খেগড়া ঘাট।

প্রসন্ন বলিয়া নাম, সেইখানে তার ধাম,

তরী আসি লাগে তার ঘাট।।

প্রসন্নের ছোট ভাই, জয়চাঁদ জানি তাই,

গোপালচাঁদের পদানত।

ঠাকুরদাস, রজনী, দুই ভাই আছে জানি,

হরিনাম করে অবিরত।।

একরাত্রি থেকে সেথা, গুরুচাঁদ বিশ্বপিতা,

চৌমোহনা নামে গ্রামে গেল।

শুদ্ধ শান্ত ভক্তিমন্ত, নাম তার লক্ষ্মীকান্ত,

জমিজমা পূর্বে বহু ছিল।।

দয়া করি দয়াময়, তাহার গৃহেতে যায়,

বসে প্রভু গৃহের ভিতরে।

সোনার মোহর দিয়া, প্রণাম করিল গিয়া,

লক্ষ্মীকান্ত অতি ভক্তিভরে।।

তা’তে প্রভু ডেকে কয়, “এই ব্যক্তি মহাশয়,

রাজ-ব্যবহার বটে জানে।

এ ভাবে সম্মান মোরে, অন্য কেহ কোথাকারে,

করে নাই এই বাদাবনে।।”

এ ভাবে দক্ষিণ দেশ, ভ্রমণ হইল শেষ,

ওড়াকান্দি প্রতি প্রভু চলে।

সঙ্গে তার সর্বদায়, গোপাল সাধুজী রয়,

বক্ষ সদা ভাসে অশ্রুজলে।।

কাথলীর নিবারণ, ভক্ত সাধু একজন,

তার গৃহে চলিল ঠাকুর।

সেই দেশে যত ছাত্র, ঠাকুরে দেখিয়া মাত্র,

আনন্দে হইল ভরপুর।।

তারা সবে সভা ক’রে, যথাযোগ্য ব্যবহারে,

শ্রীঠাকুরে জানাল প্রণতি।

সেই সভা করি শেষ, গুরুচাঁদ হৃষীকেশ,

চলিলেন মাটিয়ার গাতি।।

সাধু সেথা মৃত্যুঞ্জয়, প্রভু তার গৃহে যায়,

তথা হ’তে পৌছিল কেন্দুয়া।

ঈশান নামেতে রয়, সেথা এক মহাশয়,

হরিভক্ত সেই যে মতুয়া।।

প্রভু তার গৃহে গেল, কিছু কাল কাটাইল,

পরে গেল গাওলার গাঁয়।

রামচাঁদ জলধর, ভজন, অনন্ত আর,

সেই গৃহে মহাপ্রভু যায়।।

মথুর বিশ্বাস নাম, হাড়ীদহে যার ধাম,

নিবারণ হ’ল যার গুরু।

কেন্দে এসে পড়ে পায়, প্রভু কৃপা করে তায়,

ঘরে পেল বাঞ্ছাকল্পতরু।।

ধন্য সাধু ধনঞ্জয়, বাস ছিল পাতলায়,

এ সময় তিনি বেঁচে নাই।

তার পুত্র নারায়ণ, করে বটে আয়োজন,

সেথা গেল জগত-গোঁসাই।।

পাতলা ছাড়িয়া পরে, সাঙ্গোপাঙ্গ সঙ্গে করে,

ধাম প্রতি গুরুচাঁদ ধায়।

ধামে যবে উপস্থিত, গাহিল মঙ্গল গীত,

প্রীত মনে যত মতুয়ায়।।

সঙ্গী যারা পরে পরে, বিদায় গ্রহণ করে,

সর্বশেষে চলিল গোপাল।

শ্রীগুরুচাঁদের তরী, ঘুরে গেল দেশ ভরি,

মহানন্দ পেল না নাগাল।।

---০---